Sunday, May 23, 2010

সমকালের নিউজ কভারেজ : ভায়া টাইমস অব ইন্ডিয়া : ভারতে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ধ্বংস


টাইমস অব ইন্ডিয়ার শিরোনাম : সত্য হারিয়ে গেল?
মুক্তিযুদ্ধের দলিল খোয়া গেছে ভারতে
মাহবুব মোর্শেদ
রোববার সকালেই দুঃসংবাদটি জানালো ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া। কয়েক ঘণ্টা পত্রিকাটির ওয়েবসাইটে শীর্ষ সংবাদ হিসেবে জ্বলজ্বল করছিল 'সত্য হারিয়ে গেল? বাংলাদেশ যুদ্ধের অধিকাংশ সামরিক দলিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।' পত্রিকাটি জানাচ্ছে, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পগুলোর বিস্তারিত তথ্য খুঁজছিল। সাম্প্রতিক এ অনুসন্ধানের ফলে এ স্পর্শকাতর তথ্যটি জানাজানি হয়ে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানান, 'আমরা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পগুলোর বিস্তারিত তথ্য খুঁজছিলাম। এই ক্যাম্পগুলো কোথায় ছিল, কারা এগুলোর দায়িত্বে ছিলেন_ এ তথ্যগুলো জানতে চাচ্ছিলাম। ফাইলগুলো খুঁজে না পাওয়ায় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড একটি ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। এরপরই জানতে পারি, দলিলপত্রগুলো খোয়া গেছে।' পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সাবেক দুই প্রধানের মতে, সুপরিকল্পিতভাবেই এই দলিলপত্র ধ্বংস করা হতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ ছিলেন লে. জেনারেল এফ আর জ্যাকব। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা জেনারেল জ্যাকবের বই 'স্যারেন্ডার অ্যাট ঢাকা : বার্থ অব এ নেশন' এবং বিভিন্ন ভারতীয় সূত্র থেকে জানা যায়, তিনিই ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে শুরু হওয়া চূড়ান্ত যুদ্ধে ঢাকা বিজয়কে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। এ বিষয়ে তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম
মানেক শ'র দ্বিধা সত্ত্বেও তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। জেনারেল জ্যাকব ১৯৭৪ সালের আগস্টে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হন। জেনারেল জ্যাকব টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হওয়ায় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র চেয়ে পাঠান। তখন তাকে জানানো হয়, দলিলপত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তবে কে দলিল ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়ে থাকতে পারেন সে আলোচনা করতে তিনি রাজি হননি বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। তবে পত্রিকাটি বলছে, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সাবেক প্রধানদের সঙ্গে আলোচনার সূত্রে বোঝা যায়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই দলিলগুলো ধ্বংস করা হতে পারে। তখন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, যদি এটি সত্য হয় তবে তা হবে অরোরার ইমেজের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় ও পাকিস্তান বাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের নায়ক হিসেবে অরোরা বাংলাদেশ ও ভারতে বীর হিসেবে খ্যাত।
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। পত্রিকাটির অনলাইন পাঠকরা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এ-রকম একটি খবর প্রকাশের জন্য কেউ কেউ পত্রিকাটিকে বাহ্বা দিয়েছেন। কেউ বা প্রশ্ন করেছেন কেন ভারতীয় সেনাবাহিনী এরকম গুরুত্বপূর্ণ দলিল ধ্বংস করে দিল? কোনো স্পর্শকাতর সামরিক তথ্য কি তারা লুকাতে চেয়েছিল? বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো অনলাইন সংস্করণে টাইমস অব ইন্ডিয়ার বরাতে সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। 'কেন' এ প্রশ্নটি এখন সবার মুখে মুখে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া সন্দেহ পোষণ করে বলেছে, এসব দলিল হারিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হয়তো কখনো লেখা সম্ভব হবে না। ভারতের এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, ভারতের সেনাসদর ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সেনা দফতরেও কিছু দলিল থাকতে পারে। কিন্তু এগুলো থেকে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধের শুরু থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন, যোদ্ধাদের অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত যুদ্ধে নেতৃত্বদান পর্যন্ত অনেক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে ছিল পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের গুরুত্বপূর্ণ এসব অবদান গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকার করা হয়। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এ খবরটি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। তার মতে, ভারতে আর্কাইভাল ডকুমেন্ট সংগ্রহের শক্ত বিধান আছে। ফলে, হুট করে কোনো ডকুমেন্ট ধ্বংস করে দেওয়া সেখানে সম্ভব নয়। বলতে গেলে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একমাত্র বিজয়ের ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ঘটেছে। কেন তারা এমন একটি বিজয়ের দলিল ধ্বংস করবে, এ প্রশ্ন তুলেছেন মুনতাসীর মামুন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও এস ফোর্সের প্রধান, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ (অব.) বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা আমাদের সর্বতোভাবে উপকৃত করেছে এবং সেটি আমাদের স্বার্থেই হয়েছিল। আমরা পাকিস্তানিদের কাবু করে ফেললেও আমাদের বিমান শক্তি ছিল না, দূরপাল্লার অস্ত্রও ছিল না। ফলে, ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য অর্জন কঠিন হতো, আরও রক্ত ক্ষয়ের আশঙ্কা ছিল। জেনারেল শফিউল্লাহর মতে, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প বা প্রশিক্ষণ শিবির সংক্রান্ত তথ্য আমাদের কাছে সংরক্ষিত থাকার কথা। মুক্তিযুদ্ধের পর এ দলিলগুলো সেনা সদরে আনা হয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরেক সাবেক মেজর জেনারেল জানিয়েছেন, আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রয়োজনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সব প্রশিক্ষণ শিবিরের বিস্তারিত তথ্য আনা হয়েছিল। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী ও নেতাদের তালিকা তাতে আছে। মুক্তিযুদ্ধের অপারেশনাল ডকুমেন্টেশন মিলিটারি অপারেশন ডিরেক্টরিতে সংরক্ষিত আছে। পরবর্তীকালে এ ডকুমেন্টগুলো ঢাকা সেনানিবাসে স্থাপিত বিজয় কেতন জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। আশির দশকে পাওয়া প্রশিক্ষণ শিবির-সংক্রান্ত ডকুমেন্টগুলো ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সূত্রে পাওয়া গেছে কি-না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ডকুমেন্টগুলো দিলেও এগুলো পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সূত্রে পাওয়া গেছে কি-না তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
একজন সামরিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সামরিক দলিলপত্র নষ্ট করে দেওয়ার ঘটনা রহস্যময় বলেই মনে হচ্ছে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ ঘোষণার আগে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড অষোষিত যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছিল। অঘোষিত যুদ্ধের দলিলপত্র হয়তো তারা সংরক্ষণ করতে চাননি। ফলে, যুদ্ধের পর পরই দলিলপত্র নষ্ট করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। তবে, ভারতীয় সেনাবাহিনী যে ৩ ডিসেম্বরের আগেও অংশ নিয়েছিল তা এখন স্বীকৃত বিষয়। জেনারেল জ্যাকব তার বইয়ে এ সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি জানিয়েছেন অক্টোবরের শুরু থেকেই পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ এ প্রস্তুতির বড় অংশ হলেও সেনাবাহিনীতেও সমান্তরাল প্রস্তুতি চলছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মঈদুল হাসান তার 'মূলধারা: '৭১' বইয়ে অক্টোবর-নভেম্বরে এমন প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজিও তার 'দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান' বইয়ে লিখেছেন, ভারতীয় বাহিনী নভেম্বরেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের ভেতরে অভিযান পরিচালনা করেছে।
ইতিহাসের অনেক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তথ্যগুলো স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পরে এগুলো স্পর্শকাতর বলে বিবেচিত হতে পারে। আর এ কারণেই এগুলো ধ্বংস করা হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে, তিনি মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্যাবলী সযত্নে সংরক্ষণ করে এবং নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর সেগুলো প্রকাশ করে তেমন নীতি উপমহাদেশের দেশগুলোতেও অনুসৃত হওয়া উচিত। কারণ, একদিন মানুষকে প্রকৃত ইতিহাসের সামনে দাঁড়াতে হয়। ইতিহাসের পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ তথ্যগুলো বিচার না করলে প্রকৃত ইতিহাস রচনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এদিকে বিবিসির শুভজিত বাচ্চি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল অশোক মেহতার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। মেহতা বলেন, '৭১ সালের যুদ্ধে তিনি ভালোভাবে জড়িত ছিলেন। ওই নথিতে সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, সে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। ওই তথ্যগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। এই দলিল কেন বিনষ্ট করা হলো, সে ব্যাপারে জেনারেল মেহতা বলেন, পাকিস্তান সম্পর্ক ভবিষ্যতে প্রভাবিত হতে পারে, এ জন্য এসব দলিল বিনষ্ট করে ফেলা হয়। তিনি বলেন, এটা ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতিতে করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের তথ্য ধ্বংস করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কিছু জানে না বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম। তিনি গতকাল বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকালে এ মন্তব্য করেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য ধ্বংস করা হলেও ইতিহাস বিষয়ক কোনো তথ্য ধ্বংস করা হয়নি বলে তিনি মনে করেন। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করব।
তিনি বলেন, যদি এগুলো সত্যি ধ্বংস করা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
সমকাল


মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ধ্বংস ঘটনার তদন্ত দাবি ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ধ্বংস করার খবরে ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিজেপি, কংগ্রেস ও সিপিআই ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে। গত রোববার ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছিল, কলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কাছে রক্ষিত ১৯৭১ সালের যুদ্ধবিষয়ক ফাইলপত্র নষ্ট করা হয়েছে।
ভারতীয় জনতা দল বিজেপির মুখপাত্র রবি শংকর প্রসাদ দলিলপত্র হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম সুস্পষ্ট বিজয় অর্জন করেছিল ভারত। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার ঘটনা ভারতের
ইতিহাসের গৌরবজনক অধ্যায়। সে সময় ভারতের কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশল ছিল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বিজেপি দলিল নষ্ট হওয়ার ঘটনার সরেজমিন তদন্ত দাবি করেছে। দলিল কেন ধ্বংস করা হলো_ এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সরকারকে জনসমক্ষে হাজির হতে হবে।' অবশ্য ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি সামরিক বাহিনীর মনোভাবের সঙ্গে একই মত পোষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, কিছু দলিল প্রকাশিত হলে তা 'ক্ষতিকর' হতো।
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই) এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহকে উল্টে দেওয়ার জন্য এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হতে পারে।
অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির (এআইসিসি) মুখপাত্র শাকিল আহমেদ বলেছেন, 'এটি বিস্ময়কর একটি তথ্য। ভারতের মহান বিজয়ের ইতিহাসে এ দলিলগুলো মহামূল্যবান হিসেবে বিবেচিত। ১৯৭১ সালে ঢাকায় প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। দলিল হারানোর ঘটনা যদি সত্য হয় তবে সরকারের উচিত ঘটনা খতিয়ে দেখা এবং ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নেওয়া।'
দলিল খোয়া যাওয়ার এ ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সংরক্ষণ ও প্রকাশের ব্যাপারে সুস্পষ্ট আইনের প্রয়োজনীয়তা নতুন করে অনুভূত হচ্ছে বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। তারা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো ভারতেও ২৫-৩০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রকাশযোগ্য দলিল উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
উল্লেখ্য, ভারতে বেশ কিছু দিন ধরে তথ্য অধিকার নিয়ে আলোচনা চলছে। সেখানকার গণমাধ্যম ও নাগরিকরা তথ্য অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তারা মনে করেন, স্পর্শকাতর সামরিক তথ্য ছাড়া ইতিহাসের স্বার্থে ভারত-পাকিস্তান যুুদ্ধের সব তথ্য প্রকাশ করা উচিত। এর ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। ইতিহাসের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হয়। সামরিক নথিপত্র, যুদ্ধবিষয়ক তথ্যাবলির প্রকাশযোগ্য অংশগুলো অবমুক্ত করার জন্য ভারতে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। সে কমিটি '৬২, '৬৫ ও '৭১ সালের যুদ্ধের বিভিন্ন দলিল প্রকাশের পক্ষে মত দিলেও তা মানা হয়নি। ৩০ বছর পার হওয়ার পর নথিপত্র অবমুক্ত করার ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধা না থাকলেও সাম্প্রতিককালে ভারত কোনো দলিলপত্র অবমুক্ত করেনি বলে জানিয়েছে সেখানকার পত্রপত্রিকাগুলো।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান দলিলপত্র হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আবারও পুরনো ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন নথিপত্র প্রকাশের ব্যাপারে গণমাধ্যম ও নাগরিকদের দাবি সামনে চলে এসেছে।
সমকাল


১৯৭১ সালের নথিপত্র ধ্বংস একটি অপরাধ : ভারতের প্রধান তথ্য কমিশনার
মাহবুব মোর্শেদ
ভারতের প্রধান তথ্য কমিশনার ওয়াজাহাত হাবিবুল্লাহ বলেছেন, সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কাছে রক্ষিত ১৯৭১ সালের যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্যের ধ্বংস সাধন একটি অপরাধমূলক কাজ। এ ধরনের বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি এড়াতে নথিপত্র অবমুক্ত করার ব্যাপারে সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া।
বাংলাদেশ যুদ্ধের নথিপত্র ধ্বংসের ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে হাবিবুল্লাহ বলেন, 'এ বিষয়ে আইন খুব স্পষ্ট। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ২০ বছরের পুরনো সব নথিই প্রকাশ করতে হবে।' তিনি বলেন, আইনগত অনুমোদন ছাড়া কোনো নথির ধ্বংস সাধন অপরাধমূলক কাজ। 'ধ্বংস সাধনের জন্য আইন আছে।' তবে সে ক্ষেত্রে ধ্বংস করা দলিলপত্রের বিস্তারিত বিবরণ
সরকারের কাছে থাকতে হবে।
এদিকে সেনা সূত্রগুলো টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছে, ১৯৭১ সালের দলিলপত্র ধ্বংসের কোনো লিখিত অনুমোদন ছিল না।
প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বলেছেন, পুরো ঘটনাটির বিস্তারিত তদন্ত হওয়া উচিত। 'আমাদের জানানো উচিত_ কেন, কোথায় এগুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং তা কার স্বার্থে হয়েছে।'
কুলদীপ নায়ার ঢাকার সহযোগিতা নিয়ে পুরো দলিল দ্রুত পুনর্গঠন করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। যুদ্ধের সৈনিকদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার তাগিদও দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, 'এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দলিল।'
তিনি আরও বলেন, ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্ধের সংরক্ষিত দলিলগুলো প্রকাশ করার জন্য সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। তার ভাষায়, 'সরকার অযথাই কাগজের স্তূপের ওপর বসে আছে। ১৯৪৮, ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭১-এর নথিপত্র ছেড়ে দেওয়া উচিত। এমনকি ১৯৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের দলিলপত্রও আমাদের জাতীয় মহাফেজখানায় নেই।'
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দফতরেই ৩০ হাজার ফাইল বন্দি হয়ে আছে। এ ফাইলের অনেকটিই ভারতের সমান বয়সী। সরকারের দফতরগুলো এ নথিপত্র অবমুক্ত বা মহাফেজখানায় পাঠানোর ব্যাপারে গড়িমসি করে।
অতিরিক্ত গোপনীয়তার কারণে বিভিন্ন দফতরের স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থে নথিপত্র বেছে ধ্বংস বা নষ্ট করে দেওয়ার সুযোগ পায়। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সূত্র বলছে, ১৯৭১ সালের দলিলপত্র ধ্বংসের ঘটনাও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়।
আরেকটি প্রতিবেদনে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, বর্তমান ও সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন, মুক্তিবাহিনী গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত দলিলগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার ঘটনায় তারা বিস্মিত নন। কারণ এ দলিলগুলো প্রকাশিত হলে এটি বেরিয়ে আসত যে, ভারতীয় বাহিনী ডিসেম্বরের ঘোষিত যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা একজন সেনা কর্মকর্তা যিনি পরবর্তীকালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হয়েছিলেন তিনি বলেন, 'আমি দলিলপত্র ধ্বংসের ব্যাপারে জানি না। আমি তখন ক্যাপ্টেন ছিলাম। যদি এটি করা হয়, তবে সেটি সরকারের পরামর্শেই হয়েছে। ঘোষিত যুদ্ধের অনেক আগেই যে ভারতীয় সেনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে গিয়েছিল তা এখন সবার জানা বিষয়। সঙ্গত কারণেই সামরিক বাহিনী এ সম্পর্কিত দলিল সংরক্ষণ করতে চাইবে না।' ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সাবেক কর্নেলও বলেছেন, 'যুদ্ধ ঘোষণার অনেক আগেই ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনী সংগঠনের কাজে জড়িত হয়েছিল। ঘোষিত যুদ্ধের অনেক আগে আমি নিজে বাংলাদেশের ভেতরে ছিলাম।'


সমকাল



পাকিস্তানি সাবমেরিন ধ্বংসের তথ্য নথিপত্রও নষ্ট
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কাছে রক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক দলিলপত্র ধ্বংস করার খবরের পর এবার মিলেছে যুদ্ধে নৌবাহিনীর নথিপত্র ধ্বংস করার খবর। ধারণা করা হচ্ছে, গাজি ডুবিয়ে দেওয়া সংক্রান্ত দলিল নষ্ট করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের সূত্রে এ দুঃসংবাদটি বেরিয়ে এসেছে। গত রোববার টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ১৯৭১ সালের যুদ্ধের নথিপত্র ধ্বংসের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতের রাজনৈতিক দল, সরকার, সামরিক ও বেসামরিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়। বেরিয়ে আসতে থাকে নানা বিস্ময়কর তথ্য।
১৯৭১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রথম বড় বিজয় ছিল পাকিস্তানি সাবমেরিন গাজি ধ্বংস করা। ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সাবমেরিন গাজি ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘোষিত যুদ্ধের প্রথম দিনই, ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বিশাখাপত্তমের কাছে গাজি ডুবে যায়। মারা
যায় গাজির ৯২ জন ক্রু। ভারতীয় নৌবাহিনী দাবি করে, আইএনএস রাজপুত থেকে তীব্র গোলাবর্ষণের মাধ্যমে গাজির পতন ঘটানো হয়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণের কারণে অথবা বিশাখাপত্তম পোতাশ্রয়ে গাজি যে মাইনগুলো স্থাপন করেছিল তারই আকস্মিক বিস্ফোরণে গাজি ধ্বংস হয়।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার কাছে নৌবাহিনীর নানা সূত্র নিশ্চিত করেছে, তাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের সূত্র ধরে তারা এই গুরুতর সত্যে উপনীত হয়েছে যে, গাজি ধ্বংসের ফাইলগুলো নেই। গাজি
ধ্বংসের পর ভারতীয় নৌসেনারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু দলিলপত্র সাবমেরিনটি থেকে উদ্ধার করেছিল। সাবমেরিনটির ধ্বংসাবশেষ এখন বিশাখাপট্টনামের সমুদ্রের নিচে আছে।
ভাইস অ্যাডমিরাল হিরানন্দানি ভারতীয় নৌবাহিনীর দাফতরিক ইতিহাস লিখেছেন। ১৯৯৮ সালের ২২ জুন তখনকার পূর্বাঞ্চলীয় নৌকমান্ডের প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল কে মোহনরাও তাকে বলেন, 'বিভিন্ন অফিস ও সংস্থায় অনুসন্ধান চালানোর পরও আমি গাজি সংক্রান্ত দলিলপত্র পাইনি। অথচ এর আগে কাজ করার সময় সেগুলো আমি দেখেছি।'
মোহনরাও জানিয়েছিলেন, ডকুমেন্টগুলো পাওয়া গেলেই তা হিরানন্দানির কাছে পাঠানো হবে। কিন্তু মোহনরাও কমোডর পিএস বাওয়ার একটি চিঠির বিষয়ে কিছু বলেননি হিরানন্দানিকে। এই চিঠি বাওয়া ১৯৮০ সালে লিখেছিলেন। ১৯৮০ সালের ২০ ডিসেম্বর বাওয়া লিখেছিলেন, 'ভয়াবহ ব্যাপার হলো বীরবাহুতে আমি গিয়ে জেনেছি গাজি সংক্রান্ত দলিল, সিগন্যাল ও গাজির বিভিন্ন সামগ্রী এ বছরই ধ্বংস করা হয়েছে। এখন সেখানে আর কিছুই নেই।' বিশাখাপট্টনামের বীরবাহুতে গাজি সংক্রান্ত দলিলপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তিনি এই চিঠি নৌবাহিনীর সদর দফতরের চিফ অব পার্সোনেল এমপি আওয়াতিকে লিখেছিলেন।
শেষ পর্যন্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর কোনো দাফতরিক ইতিহাস প্রণেতাই গাজির ফাইলপত্র হাতে পাননি। ১৯৭১ সালে নৌবাহিনীতে যুক্ত এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, গাজির দলিলপত্র থেকে শুরু করে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের ফাইলপত্র হারানোর সব ঘটনাই যুদ্ধের ইতিহাসকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ধারাবাহিকতায় হয়েছে। অথচ এটাই ছিল ইতিহাসের ঘটনাবলিকে জনসমক্ষে আনার সবচেয়ে ভালো সময়।

সমকাল

No comments:

Post a Comment