Tuesday, November 23, 2010

চলতি কথা : বাসাবাড়ির রাজনীতি কি জমবে?


১৪ নভেম্বর। হরতালের পর সন্ধ্যা। রাস্তাঘাটে গাড়ি অল্প। পথচলতি মানুষও কম। ভিড়ভাট্টা নেই বলে বাসে ওঠা গেল সহজে। বসার মতো আসনও মিলে গেল। দেখলাম, বাসযাত্রীরা বেশ বৈঠকি মুডে আছেন। বাসযাত্রীদের বৈঠকি মুড মানেই রাজনীতি নিয়ে তপ্ত কথা। শুরু করলেন একজন। সঙ্গে সঙ্গে তাতে সায় দিলেন কয়েকজন। বিরোধিতার জন্য অনেকে এক পায়ে খাড়া। বোঝা গেল, যাত্রীরা বেশ তেতে আছেন। মওকা পেয়ে নিজের মনোভাব জানিয়ে দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না কেউই। মুহূর্তের মধ্যেই বেশ সরগরম হয়ে উঠল পুরো বাস।
প্রথম বক্তা হরতালের ভুক্তভোগী। ঈদে গ্রামে ফেরার কথা ছিল। ফিরতে পারেননি। আপাতত বাড়ি ফেরার আশা ছেড়ে ঢাকায় ঈদ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তার মত_ বাড়ি একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। দেশের আইন-আদালতে বিষয়টার সুরাহা হবে। লড়াই হবে আদালতে। এ নিয়ে রাজনীতি করার স্কোপ নেই। হরতাল ডাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। ঈদের আগে এমন সময় হরতাল ডেকে বিএনপি মানুষের সিমপ্যাথি হারাল।
কথা শেষ হওয়ার আগেই তাকে চেপে ধরলেন একজন। খানিকটা রুষ্ট কণ্ঠে। বললেন, আপনাদেরই-বা কেমন নীতি? ঈদের আগে বাড়ি ছাড়াতে বাধ্য করলেন, তাও এক কাপড়ে? প্রথমজন বললেন, ভাই \'আপনাদের\' মানে কী? আমি তো কোনো দলের লোক না। তিনি হয়তো দলের লোক না। কিন্তু আরেকজন বাসের পেছনের সিট থেকে বলে উঠলেন, ঈদের আগে-পরে তো ব্যাপার না ভাই। অবৈধ বাড়ি থেকে তাকে চলে যেতে হতোই। ৪০ বছর ধরে তিনি যে বাড়িটা দখল করে রেখেছিলেন সেইটাই তো বড় ভুল ছিল। বাড়িটা আগেই ছাড়লে তিনি ভালো করতেন। এই বাড়ি দখলমুক্ত করে এতদিনে একটা কাজের কাজ করল সরকার।
বিএনপির পক্ষে আরেকজন এইবার গলা চড়িয়ে বললেন, বাড়ি অবৈধ হবে কেন? বাড়ি তো এই দেশের সরকারেরই দেওয়া। আর সুপ্রিম কোর্টে তো মামলার সুরাহা হয় নাই। এবার আওয়ামী পক্ষের একজন বললেন, আপনারা তো কথায় কথায় স্বৈরাচার বলেন। এখন স্বৈরাচারের দেওয়া বাড়িতে থাকতে সমস্যা হয় না? স্বৈরাচারের কথায় বৈঠকে নতুন এক তাত্তি্বকের আগমন ঘটল। তিনি বললেন, আসলে এখনও এরশাদই সবকিছুর কলকাঠি নাড়ছেন। কেমনে? খালেদা জিয়াকে বাড়ি দিয়ে তিনি আগেই সমস্যা তৈরি করে রেখেছিলেন। এখন বসে বসে দুই দলের বিবাদ দেখছেন আর মজা পাচ্ছেন। এরশাদবিরোধী একজন দেখা দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন, এরশাদ আসলে এখন আর ফ্যাক্টর না। রাজনীতিতে তার বলার কিছু নাই, দেখারও খুব বেশি কিছু আছে বলে মনে হয় না।
কথা চলছে কখনও উঁচু, কখনও নিচু লয়ে। আলাপ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে রেফারির মতো একেকজন গলা চড়িয়ে বলছেন, আমরা সাধারণ মানুষ। এসব নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে আমাদের কাজ কী? রেফারিদের কথায় কাজ হচ্ছিল। পরক্ষণেই আবার তাপ বাড়ছিল। বাসের আলাপ শুনে মনে হচ্ছিল, রাজনীতি দেশের মানুষের ভাগ্যের নির্ধারক বিষয় না শুধু। মানুষের বিনোদনেরও অন্যতম উৎস বটে। রাজনীতি নিয়ে মুখরোচক আলোচনা করে মানুষ তৃপ্ত হয়। বিতর্কে জড়িয়ে নিজের মতের শক্তি পরীক্ষা করে। পত্রপত্রিকায়, টিভিতে রাজনীতি নিয়ে টক শো গোগ্রাসে গেলে। ক্ষমতাবানদের নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। ক্ষমতার উত্থান-পতন নিয়ে ভাবে। কখনও এ-পক্ষ, কখন ও-পক্ষ এবং শেষ পর্যন্ত একা একা শুধু আত্মপক্ষ। তখন হয়তো তার অতিপ্রয়োজনীয় চালের দাম বাড়তির দিকে, পকেটে টান পড়েছে, বাসার বিদ্যুৎ ফুড়ূৎ ফুড়ূৎ করছে। কিন্তু এসবের সঙ্গে রাজনীতির যোগ নিয়ে আলোচনা জমে না। জমে খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়েই। আর এ নিয়ে মানুষের নখদর্পণে এত তথ্য, এত উপাত্ত আর এত যুক্তি যে ভাবতে ভালোই লাগে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই বলছিলেন, রাজনীতির পুরনো ধারা আর চলবে না। বাঙালি না বাংলাদেশির মতো সস্তা তর্কে আর মানুষের মন ভিজবে না। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-দলপ্রীতি আর ফিরতে পারবে না। সংসদে বসে সবকিছুর সমাধান হবে। সহিংসতা-সংঘাতের দিন শেষ। সরকার যখন খালেদা জিয়ার বাড়ির বরাদ্দ বাতিল করল আর বিরোধী দল যখন বিষয়টি শক্তভাবে মোকাবেলা করার হুমকি দিল, তখনও এসব আশাবাদ থিতু হয়ে যায়নি। অনেকেই বলছিলেন, একটা বাড়ি কি আর রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে? বাড়ি ইস্যু নিয়ে বিএনপি আর কত দূর যাবে? খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়ে মানুষ রাস্তায় নামবে কেন? এসব কথার ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতি ফিরছিল পুরনো খাতে। ফিরতে ফিরতে দু\'বছরের মাথায় এসে দেখা গেল_ ঠিকই, একটা বাড়িই রাজনীতির কেন্দ্র হতে পারে। সরকার ও বিরোধী দল মিলে যদি চেষ্টা করে তবে একটা বাড়ি কেন, একটা ইটও রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসতে পারে। সে নিয়ে জনগণ দু\'ভাগে বিভক্ত হতে পারে। বিবাদে জড়িয়ে রক্তও ঝরাতে পারে। আমাদের জনগণেরই-বা দোষ কী? যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ যদি বারাক ওবামার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিশ্বাস করে আর ভোটে তার প্রভাব পড়ে তবে আমরা আর কতটুকু এগিয়ে থাকব? ভাবতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপকসংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করে, বারাক ওবামা মুসলিম এবং কমিউনিস্ট?
মোটাদাগে হিসাব করলে, আমাদের দেশে তিন ধরনের রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের দেখা পাওয়া যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় দলের কথা আগে বললাম। এইবার তৃতীয় দলের কথা। তারা মনে করেন, রাজনীতিতে যা হচ্ছে তার কোনোটাই ঠিক হচ্ছে না। ভুল সবই ভুল, এ জীবনের পাতায় পাতায় ভুল। খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়ে তাদের মন্তব্য কী তা নিয়ে স্বাভাবিক একটা কৌতূহল আছে মানুষের মধ্যে। এখন দেখা যাক তারা কী মনে করেন। তারা মনে করেন, এরশাদ যে সেনানিবাসের মইনুল রোডের মতো জায়গার একটা বাড়ি খালেদা জিয়াকে দিয়েছেন সেটা ঠিক করেননি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, বাড়ি ভেট দিয়ে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিরত রাখবেন। এই ভাবনা ছিল ভুল। আবার সেনানিবাসের বাড়িতে থেকে রাজনীতিতে জড়ানো ছিল খালেদা জিয়ার ভুল। তার উচিত ছিল, রাজনীতি শুরু করার পর বাড়ি ছেড়ে দেওয়া। বাড়ি তিনি না ছাড়লেও তার মনে রাখা উচিত ছিল, এ বাড়ি কারো স্থায়ী সম্পদ হতে পারে না। ফলে তিনি যে বিকল্প কোনো আবাসে নিজেকে মানিয়ে নেননি সেটা ছিল তার ভুল। আবার মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়ার বাড়ির বরাদ্দ বাতিল করার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা ছিল একটা ভুল। এ সিদ্ধান্ত রাজনীতিতে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সরকারের সিদ্ধান্তের পর খালেদা জিয়া বাড়ি না ছেড়ে একগুঁয়ে মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এতে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বাড়ির বিবাদ আদালতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। কারণ, এতে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার পথ বন্ধ হয়েছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের উচিত ছিল হাইকোর্টের রায় \'স্টে\' করার আবেদন করে আপিলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া। সেটি তারা করেননি, সেটাও ছিল ভুল। আবার আদালতের চূড়ান্ত রায়ের আগে সরকার পক্ষ খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাও ছিল ভুল। সরকারের চাপ সত্ত্বেও খালেদা জিয়া যে বাড়ির দখল রাখতে মরিয়া হয়েছিলেন সেটা ছিল ভুল। আবার সরকার যে বেশ জোরজবরদস্তি করেছে সেটাও ছিল ভুল। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে অশ্রুসিক্ত হয়ে খালেদা জিয়া দুর্বল মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রীর অশ্রুপাত ও সাজপোশাক নিয়ে মন্তব্য করে সরকারের নেতা-নেত্রীরাও শুভবোধের পরিচয় দেননি। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে ঈদের আগে হরতাল ডেকে বিএনপি ঠিক করেনি। সরকারও ঈদের আগে খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ঠিক করেনি। মোটকথা, যা হয়েছে সবই ভুল, যা হচ্ছে, যা হতে পারে তাও।
অবশ্য ভুলবাদী লোকেরা কী চায়, সেটি বোঝা বড় শক্ত। কারণ, রাজনীতিতে এদের স্পষ্ট ও স্থায়ী কোনো চেহারা নেই। এরা কখনও তৃতীয় পক্ষ, কখনও মধ্যপক্ষ, কখনও কোনো পক্ষই না, স্রেফ সাধারণ নাগরিক।
এদের একদল হৃদয় খুঁজে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে না। তারা চায়, যেমন আছি তেমন রবো। মিলমিশের রাজনীতি চলুক। সংসদে বিতর্ক হোক। হরতাল-সংঘাত না থাকুক। নেতা-নেত্রীদের কথাবার্তা হোক।
আরেক দল চায়, রাজনীতিতে পরিবর্তন আসুক। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নাগরিকদের সামনে যথার্থ কর্মসূচি উত্থাপন করা হোক। দেশ ও জাতি একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাক। যে বিষয়গুলো রাজনীতির প্রকৃত ইস্যু নয়, সেগুলোকে ইস্যু বানানোর প্রক্রিয়াটা আর না চলুক। এটা হোক বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়েই।
আরেক অংশ মনে করেন, রাজনীতির পুরনো চর্চা আর চলবে না। বিদ্যমান রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব এমনকি তাদের কর্মসূচিও চলবে না। দেশ চালাবে উচ্চশিক্ষিত, অবসরপ্রাপ্ত লোকেরা। পারলে অগণতান্ত্রিক পথে, অনির্বাচিত সরকার গঠন করেই।
বলাবাহুল্য, দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনের পর দেশে তৃতীয় পক্ষের বক্তব্যের পসার এখন ভালো না। তাদের কথা ভালো কি মন্দ সেটা পরের কথা। কাটতি ভালো না এটাই বাস্তবতা। তৃতীয় পন্থার বিগত সমাধান দেখে মানুষ কিছুটা হতাশ। নতুন করে আশা ফিরতে সময় লাগবে। ফলে আপাতত পুরনো ধারার নাটকের দর্শক হওয়ার বিকল্প কী?
এসব নাটকের ফাঁকে ফাঁকে একটা বিষয় কিন্তু অনেকেরই চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে হিংসা-প্রতিহিংসা, ভুল-শুদ্ধ, অগ্রগতি-পশ্চাৎগতি সবই আছে, থাকবেও। খোলা চোখে যত অমানবিক মনে হোক, খালেদা জিয়ার সেনানিবাস ছাড়ার ঘটনা শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজনীতিতে একটা অগ্রগতিই। ওয়ান-ইলেভেনের আগে-পরে রাজনীতির সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর কথা হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যরা তো বটেই, শুভবোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ মনে করে, গণতন্ত্রই শেষ কথা; রাজনীতিতে সশস্ত্র বাহিনীর জড়ানো ঠিক নয়। এই বাস্তবতায় একজন রাজনীতিকের সেনানিবাস ছাড়ার ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ। খালেদা জিয়া বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হলেন বটে। কিন্তু এর মাধ্যমে সেনানিবাসের সঙ্গে রাজনীতির একটি যোগাযোগ ছিন্ন করল। আরও গ্রহণযোগ্য হতো, যদি এই প্রক্রিয়া শুধু আদালতের রায়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো।
বিএনপির উচিত এখন মানুষের শক্তির দিকে দৃষ্টি দেওয়া, সাধারণের সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করা। সেনানিবাসের বাড়ির স্মৃতি নিশ্চয়ই একজন শীর্ষস্থানীয় নেত্রীকেও অশ্রুসিক্ত করতে পারে। কিন্তু মানুষ নেতা-নেত্রীদের অশ্রুপাত দেখতে চায় না। তারা বরং নেতা-নেত্রীদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের কথা মনে করেই অশ্রুপাত করতে চায়। খালেদা জিয়ার উচিত, পুরনো বাড়ির শোক দ্রুত কাটিয়ে উঠে নতুন একটি বাড়ি তৈরি করা। আর নাগরিকদের উচিত খেয়াল রাখা, যাতে স্থায়ী বা অস্থায়ী, বাস্তব বা অবাস্তব কোনো রাজনৈতিক বাড়ি যেন সেনানিবাসে আর তৈরি না হয়।

মাহবুব মোর্শেদ : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mahbubmorshed@ymail.com

Sunday, November 21, 2010

তলস্তয়ের মৃত্যুশতবার্ষিকীতে


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী পালনের জন্য প্রায় এক বছর ধরে প্রস্তুত হচ্ছি আমরা। কবির গত জন্মদিনে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠানমালা, শেষ হবে আগামী জন্মদিনে। কবি জন্ম নিয়েছেন ১৮৬১ সালের ৭ মে। সে অনুসারে আগামী ২৫ বৈশাখেই তার সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী। কবির জন্মদিন বা মৃত্যুদিন পালন নিয়ে আমরা যতটা উৎসাহী, ততটা বোধহয় তার বিপুল রচনাবলি নিয়ে নয়। নইলে আজ যে শিল্প ও সৌন্দর্যবোধ বঞ্চিত জীবনাচারের রাজত্ব চলছে চারদিকে, তা দেখতে হতো না আমাদের। মেধা ও মননের চর্চা তো বটেই, আমাদের সমাজে সহনশীলতা, সততা ও ঐক্যের আবহও তৈরি হতো যদি কবির রচনাবলির সামান্য শিক্ষা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রবেশাধিকার পেত। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন আরও মধুর হতে পারত তার রচনার স্পর্শে। তার বাণীকে ধারণ করতে না পারলেও কবিকে কেন্দ্র করে আতিশয্যের নানা আয়োজনের প্রতি আমাদের উৎসাহ বেশ। তাই হয়তো সুমন তার গানে অনেক বছর আগে বলেছিলেন, প্রাণে গান নেই বুঝি তাই রবিঠাকুর মূর্তি গড়া। সত্যিই আমাদের প্রাণে গান নেই। প্রাণ গান-বঞ্চিত, তাই প্রাণের বাইরে কবির নানা মূর্তি নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, আমাদের প্রধান সাহিত্যিক-শিল্পীদের শিক্ষাকে কি অন্তরে ধারণ করতে পেরেছি আমরা? বোধহয় নয়। যদি তা হতো তবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যসৃষ্টির প্রতি আমাদের একটা সহজাত আকর্ষণ তৈরি হতো। রবীন্দ্রনাথকে না হয় আমরা অন্তরের বাইরে পালন করি। কিন্তু পৃথিবীর অন্য সেরা সাহিত্যিকদের তো সেখানেও জায়গা নেই বলে মনে হয়। যেমন গতকাল, ২০ নভেম্বর লেভ তলস্তয়ের মৃত্যুর ১০০ বছর পূর্ণ হলো। গত এক শতকের বেশি সময় ধরে তিনি পৃথিবীর মহত্তম লেখক ও চিন্তক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। অনেকের মতে, তিনি বিশ্বের সেরা ঔপন্যাসিক। কই তাকে নিয়ে তো কোনো আয়োজন চোখে পড়ল না। অথচ বিশ্বের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তিনি প্রভাবিত করে চলেছেন। তার অনেক রচনা বাংলায় অনূদিত হয়েছে। পাঠকের একটি অংশ এখনও তাকে অবশ্যপাঠ্য মনে করেন। কিন্তু তার মৃত্যুশতবার্ষিকী চলে গেল নীরবে। জানুয়ারিতে চলে গেল আন্তন চেখভের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী। চেখভের মতো মহান লেখকের জন্মবার্ষিকীর এত বড় আয়োজনও আমরা পালন করতে পারলাম না। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তিগুলোর ব্যাপারে আমাদের এমন নীরবতা কিন্তু গর্বের বিষয় নয়। কেননা যে জাতি রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করে সে জাতি শিল্পের প্রতি ভালোবাসার নিয়মেই তলস্তয় ও চেখভকেও ভালোবাসতে বাধ্য। ফলে এ প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, সত্যিই কি আমরা রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি? নাকি এ আমাদের ভান। যাই হোক, তলস্তয়ের মৃত্যুশতবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি তার প্রতি। তলস্তয়ের মৃত্যুর দিনটি শুধু নয়, তার মৃত্যুর ঘটনাটি বহুকাল পৃথিবীর চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিয়েছে। শেষ জীবনে জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গে বিশ্বাস ও কর্তব্যের মিল নিয়ে সংকটগ্রস্ত হয়েছিলেন তিনি। এ সংকটের কারণে পরিবারের অমতে ঘর ছেড়েছিলেন এই ভূস্বামী। বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ জীবন। তার এই ত্যাগই তাকে শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ার মতো কঠিন রোগে আক্রান্ত করে এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার অমর উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধের মতো তার জীবনও মানুষকে ভাবিয়েছে। নতুন উপলব্ধি ও আবিষ্কারের সামনে দাঁড় করিয়েছে।

Sunday, November 14, 2010

মানুষকে ইতিহাস বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে চাই না : অরুন্ধতী রায়


অরুন্ধতী রায় সম্প্রতি কাশ্মীরের শ্রীনগরে আয়োজিত এক সেমিনারে বলেছেন, 'কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়।' এ নিয়ে ভারতে তীব্র বিতর্ক উঠেছে। এ বিতর্কের রেশ ধরে তেহেলকা পত্রিকার পক্ষ থেকে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোমা চৌধুরী। সাক্ষাৎকারটি সমকালের পাঠকদের জন্য অনূদিত হলো


প্রশ্ন : আপনি দিলি্ল ও কাশ্মীরে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র আপনার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনার কথা ভাবছে। রাষ্ট্রদ্রোহ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী? আপনি কি নিজেকে রাষ্ট্রদোহী হিসেবে দেখেন? আপনি যে দিলি্ল ও কাশ্মীরে বললেন 'আজাদিই একমাত্র সমাধান'_ তার পেছনে কারণ কী?
উত্তর : রাষ্ট্রদ্রোহ একটি প্রাচীন ও বাতিল ধারণা, 'টাইমস নাউ' নামে একটি চ্যানেল আমাদের জন্য এটি পুনরাবিষ্কার করেছে। মনে হচ্ছে, চ্যানেলটি উন্মত্তভাবে আমাকে পেড়ে ফেলতে এবং জনতার রুদ্ররোষের শিকার বানাতে চায়। আমি কে এইখানে? একটা টিভি চ্যানেলের জন্য ছোট টার্গেট। এরকম পরিস্থিতিতে একজন লেখককে বিনা বিচারে বলি দেওয়া খুব কঠিন কিছু নয়, আমার মনে হয় তারা সেটাই করতে চায়। আক্ষরিকভাবেই এটি আমাকে উত্ত্যক্ত করছে। আমি এতে মনোবৈকল্যের দেখা পাচ্ছি। আমি যদি ভারত সরকারে থাকতাম তবে একধাপ পিছিয়ে সাম্প্রতিক সংকটজনক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন তুলতাম, কীভাবে একটি টিভি চ্যানেল পোকায় খাওয়া, বাতিল ধারণাগুলো সামনে এনে উন্মত্ততায় বাতাস দিচ্ছে এবং আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। 'কাশ্মীর ইস্যু'কে আন্তর্জাতিক মাত্রা দেওয়ার নানা চেষ্টা হয়েছে অতীতে আর ভারত সরকারও একে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
এর পেছনে একটা কারণ হলো, আজমির বিস্ফোরণের দায় থেকে শীর্ষ আরএসএস নেতা ইন্দ্রেশ কুমারকে রেহাই দিতে বিজেপি মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা মানুষের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে চায়। যারা খবর তৈরি করার জন্য মরিয়া সেসব মিডিয়ার জন্য এটা ছিল মোক্ষম সুযোগ। আর এরই নেতৃত্ব দিয়েছে টাইমস নাউ। আমার কখনও মনে হয়নি আমি রাষ্ট্রদ্রোহী। 'আজাদিই একমাত্র সমাধান' শিরোনামে আয়োজিত হলেও দিলি্লর সেমিনারে আমি বক্তব্য দিতে রাজি হয়েছিলাম। আমার মতে, যারা প্ররোচিত হতে চায় তাদের প্ররোচিত করার মতো শিরোনাম ছিল সেমিনারটির। কাশ্মীরে গত অর্ধশতাব্দী ধরে যা হচ্ছে তার বাস্তবতায় এই সেমিনার খুব বড় কিছু বলে আমার সত্যিই মনে হয়নি।
শ্রীনগরের সেমিনারের বিষয় ছিল 'কোন পথে কাশ্মীর : আজাদি না গোলামি'। এটা কাশ্মীরের তরুণদের জন্য আয়োজিত। তাদের মধ্যে এই তর্ককে জোরদার করার উদ্দেশ্যে যে, তারা আজাদি বলতে কী বোঝে আর আজাদির কাছ থেকে কী চায়। অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার কোনো ধ্বংসাত্মক আহ্বান নয় এটি, বরং উল্টোটাই। এটি ভাবনাচিন্তার, তর্ককে গভীরে নিয়ে যাওয়ার এবং অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলার একটি আয়োজন ছিল।
প্রশ্ন : আপনি সবসময়ই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। আপনি কেন সৈয়দ আলি শাহ গিলানি এবং বারাবারা রাওয়ের মতো লোকের সঙ্গে একই প্লাটফর্মে, একই দলে গেলেন। তারা তো খুবই গোঁড়া এবং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করেন। যদি আপনি নাগরিক সমাজের কোনো মঞ্চ থেকে কথা বলতেন তবে হয়তো একজন লেখক বা চিন্তক হিসেবে আপনার বক্তব্য ভিন্নভাবে গৃহীত হতো।
উত্তর : এটা নাগরিক সমাজের প্লাটফর্মই ছিল! এটি এমনসব মানুষের প্লাটফর্ম যাদের কোনো কার্যালয় নেই, তাদের ভিন্নমতেরও নানা মাত্রা আছে। বারাবারা রাও ও গিলানির আদর্শ সম্পূর্ণ ভিন্ন বটে। এটাই বলে দেয়, এই প্লাটফর্ম নানা মতের মানুষের, যদিও তাদের মধ্যে কিছু ঐক্যও আছে। আমি আমার কথা বলেছি। যেভাবে তারা বলেছেন। আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে বলিনি আমি হুরিয়াত (গিলানি) বা সিপিআই (মাওবাদী) হয়ে গেলাম। আমি তাই বলেছি, যা আমি ভাবি।
প্রশ্ন : স্পষ্টভাবেই গিলানি শুধু আজাদির পক্ষে বা ভারতবিরোধী নন, কথাবার্তায়ও শরিয়াপন্থি, জামাতপন্থি। কাশ্মীরী নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও তার ভূমিকা ধোঁয়াশাপূর্ণ। আপনি যদি কাশ্মীর প্রসঙ্গে আপনার মতামত ব্যক্ত করবেনই তবে তাদের সঙ্গে জড়ো হয়ে সেটি করলেন কেন? আপনি ভারত রাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে তার সমালোচনা করলেন না কেন?
উত্তর : অনেক কাশ্মীরী গিলানির মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না এবং ভারত রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি না হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে শ্রদ্ধাও করেন। আমার কথা হলো, আমি তার অনেক কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। এ নিয়ে আমি লিখেছি। কথা বলার সময় বিষয়গুলো স্পষ্টও করেছি। আমি বাস করি এমন একটি রাষ্ট্রের প্রধান যদি তিনি হতেন আর তিনি যদি তার মত আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন, তবে আমার সাধ্যমতো সব উপায়ে আমি সেগুলো প্রতিরোধ করতাম।
কিন্তু ঘটনা হলো, তারা কাশ্মীরে আছেন। তাকে ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করা এবং উভয়কে সমানভাবে সমালোচনা করার যুক্তি হাস্যকর। এমনকি ভারত সরকার, এর সর্বদলীয় প্রতিনিধি সভা এবং নতুন 'মধ্যস্থতাকারীরা' পর্যন্ত জানেন কাশ্মীরে যা ঘটছে তাতে গিলানির বৃহৎ অংশীদারিত্ব আছে। এটাও সত্যি যে, তিনি কাশ্মীরী নেতৃত্বের সঙ্গে গৃহবিবাদে লিপ্ত। নব্বইয়ের দশকে সেখানে গোষ্ঠীগত হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোতে গিলানিকে জড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিরোধ আন্দোলনে অন্তর্কলহ নতুন কিছু নয়। এগুলো রাষ্ট্র সমর্থিত হত্যাকাণ্ডের সমান নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস ও ব্ল্যাক কনসাসনেসের মধ্যে ভয়ঙ্কর লড়াই হয়েছিল। এতে স্টিভ বিকোসহ হাজারো মানুষ খুন হয়েছিলেন। এখন আপনি কি বলবেন, নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে একই মঞ্চে বসা অপরাধ?
সেমিনারে কথা বলে, লিখে, তিনি যা বলছেন তাকে প্রশ্ন করে গিলানি পরিবর্তনের সপক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। তিনি এখন যা বলছেন আর কয়েক বছর আগে যা বলেছেন তার মধ্যে তফাত আকাশ-পাতাল। আমি আপনার এই প্রশ্নে অবাক হচ্ছি। যখন রতন টাটা ও মুকেশ আম্বানি নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে প্রকাশ্যে গুজরাট গরিমা পুরস্কার নিলেন এবং তাকে আলিঙ্গন করলেন তখন ক'জন সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে? সেটা তো কোনো সেমিনার ছিল না, ছিল কি? টাটা-আম্বানিরা নরেন্দ্র মোদিকে প্রশ্ন করেননি, নিজেদের ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করেননি, মোদির সভাপতিত্বে যে গণহত্যা হয়েছিল তার সমালোচনা করেননি... তারা তাকে সমর্থন করেছেন। তারা বলেছিলেন, মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত। সেটা সঠিক অবস্থান, তাই না?
প্রশ্ন : বারাবারা রাওয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা। তারা সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলছেন, ভারত রাষ্ট্র এখন যেখানে দাঁড়িয়ে তার সমালোচনা করছেন। এই অবস্থান সম্ভবত আপনার সঙ্গে যায় না। মাওবাদী আদর্শে পরিবর্তনের কেন্দ্রীয় উপায় অস্ত্র হাতে নেওয়া। আপনার কোনো লেখায় আপনি একে সমর্থন করেননি। কাশ্মীরের এমন একটি উচ্ছল সময়ে কেন আপনি বারাবারা রাও ও গিলানির সঙ্গে একই মঞ্চ শেয়ার করলেন?
উত্তর : আমি মাওবাদীদের নিয়ে বিশাল একটি প্রবন্ধে আমার মত জানিয়েছি, এখানে সেই মতকে একবাক্যে সংক্ষেপ করতে চাচ্ছি না। সব বিষয়ে একমত না হলেও আমি বারাবারা রাওকে প্রশংসা করি। কিন্তু আমি এই সংকটময় পরিস্থিতিতে মাওবাদীদের নিয়ে এবং কাশ্মীরে সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করি। কারণ এখন মিডিয়ার বড় একটি অংশ রক্তচোষা প্রচারযন্ত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, চেষ্টা করছে সবার মাথা থেকে শেষ বুদ্ধিবৃত্তিক ঘিলুটুকু বের করে নিতে। এটা তত্ত্বের বিষয় নয়, এটা মানুষের জীবন, নিরাপত্তা ও আত্মবোধের বিষয়। আগের কোনো সময়ই এটি এতটা সংকটাপন্ন ছিল না।
প্রশ্ন : আপনি কেন এমন একজন মানুষকে সমর্থন করছেন, যিনি কাশ্মীরকে ভারত থেকে আলাদা করে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে চান?
উত্তর : যাকে আমি সমর্থন করছি বলে মনে হচ্ছে সেই লোকটি কে? গিলানি? আপনারা কি সিরিয়াসলি এই প্রশ্ন করছেন? আমি ভারত থেকে আলগা করে নিয়ে কাশ্মীরকে পাকিস্তানে জুড়ে দেওয়ার চিন্তা সমর্থন করেছি কোথায়, সেটি কি আপনারা আমাকে দেখাতে পারেন? গিলানি কি কাশ্মীরে একমাত্র লোক, যিনি কাশ্মীরের আজাদি চান? আমি কাশ্মীরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করি। এটা গিলানিকে সমর্থন করা থেকে ভিন্ন ব্যাপার।
প্রশ্ন : 'কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। এটা ঐতিহাসিক সত্য।' এই মন্তব্য থেকেই মূলত তর্ক উঠেছে। কেন এ কথা বললেন?
উত্তর : ইতিহাস তো সর্বজনবিদিত। আমি মানুষকে ইতিহাস বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে চাই না। কিন্তু কাশ্মীরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কি এর অস্পষ্ট ইতিহাসের কারণে তৈরি হয়নি? ভারতীয় সরকার সেখানে ৭ লাখ সৈন্য কেন রেখেছে? মধ্যস্থতাকারীদের ভাষায়, 'তারা কি সেখানে আজাদির রোডম্যাপ তৈরি করছে?' নাকি এলাকাটাকে 'বিবাদপূর্ণ' হিসেবে আখ্যায়িত করছে? আমরা যখন কাশ্মীরের রাস্তার বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করি তখন কেন চোখ ছোট করে ফেলি?

ভাষান্তর : মাহবুব মোর্শেদ

Saturday, November 13, 2010

কাশ্মীর :: আজাদি, অরুন্ধতী রায় ও সৈয়দ আলী শাহ গিলানি


কাশ্মীর আবার তর্কের কেন্দ্রে। বর্ণনায় একটু ভুল হলো, তর্কের কেন্দ্রে এবার শুধু কাশ্মীর নয়, অরুন্ধতী রায়ও। ১৯৪৭ থেকে কাশ্মীর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, যুদ্ধ-বিবাদ সবই চলছে সমানে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার অন্যতম অমীমাংসিত ইস্যু এটি। তারা কাশ্মীরের দুটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, নিজেদের মতো করে কাশ্মীর নিয়ে মত ব্যক্ত করে। দুটি দেশের মিডিয়া, মধ্যবিত্ত সমাজের বড় অংশ, রাজনীতিক ও ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো কাশ্মীর প্রসঙ্গে চলতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তৃপ্ত। ফলে, ভারতীয় ও পাকিস্তানি এ দুই উচ্চকণ্ঠ মতকে ছাপিয়ে সাধারণ কাশ্মীরিদের কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি অনেক দিন। কিন্তু সম্প্রতি কাশ্মীরিদের কিছু কিছু কথা কানে আসছে। তারা বলছেন, কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার সেখানকার জনগণের। প্রশ্ন তুলছেন, ভারত বা পাকিস্তানের শাসকরা কেন তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে? যুদ্ধের বদলে জনমতের ভিত্তিতে কেন কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারিত হবে না? কাশ্মীরিদের কণ্ঠস্বর যখন মৃদুস্বরে ধ্বনিত হচ্ছিল, তখন ভেতরে-বাইরে পরিস্থিতির মৌলিক কিছু পরিবর্তনও ঘটছিল। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ সে সময় পাকিস্তানের ঘরের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। একদা \'জিহাদ\' ও \'জঙ্গিবাদের\' প্রশ্রয়দাতা হিসেবে অভিযুক্ত দেশটি স্বয়ং ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে জঙ্গিবাদ দমনে ব্যস্ত। তার মনোযোগ আর কাশ্মীরে কেন্দ্রীভূত নয়, আফগান সীমান্তের দিকে, নিজের সীমান্ত প্রদেশে। নানা সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তানের মনোযোগ সরে গেলে ক্রমে কাশ্মীরের নিজস্ব কণ্ঠস্বর শক্তি পেতে থাকে। আত্মঘাতী হামলা, প্রশিক্ষিত জঙ্গি ও জিহাদের স্বপ্নে বিভোর মোল্লাদের বদলে রাস্তায় নামতে থাকে সাধারণ মানুষ। বন্দুক-বোমার বদলে তরুণরা হাতে তুলে নেয় ইট-পাটকেল। নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয় সেখানে। এই তরুণদের ওপর থেকে জঙ্গিবাদের ছায়া অনেকটাই অপসৃত। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এরাই নতুন পরিস্থিতি তৈরি করে। গণতান্ত্রিক ভারত নতুন সংকটের মুখে পড়ে। ২০০৮ সালে কাশ্মীরী তরুণরা যে বিশাল প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিল তা বিস্মিত করে দেয় অনেককে। ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করেন। অরুন্ধতী রায় বলেন, কাশ্মীর থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। বছর দুয়েক আগে দেওয়া এই বক্তব্য অনেককে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। শুধু সৈন্য প্রত্যাহারের দাবিই নয়, সেখানকার নাগরিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করছিলেন তিনি। কাশ্মীরের মানবাধিকার পরিস্থিতিও ছিল তার পর্যবেক্ষণের কেন্দ্রে। আর এ কথা অরুন্ধতীর শত্রুও স্বীকার করেন যে, এসব ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্বচ্ছ, স্পষ্ট ও স্বাধীন_ কারও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তিনি কথা বলেন না। অরুন্ধতী ১৯৯৭ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ পুরস্কার তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বিশ্বের। তাকে নিয়ে সাহিত্যজগতে বড় প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি সাহিত্য নয়, সক্রিয়তা দিয়ে নিজের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। অর্জন করেছেন অ্যাক্টিভিস্ট পরিচয়।
এই অরুন্ধতী গত ২৪ অক্টোবর কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে বলেন, \'কাশ্মীর কখনই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না।\' আলোচনার বিষয় ছিল_ \'কোন পথে কাশ্মীর : দাসত্ব নাকি আজাদি?\' সভায় কাশ্মীরের চলমান অস্থিরতা বিষয়ে বলতে গিয়ে অরুন্ধতী ঔপনিবেশিক শক্তি হয়ে ওঠার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন ভারতকে। তার এ বক্তব্য ঝড় তোলে। তাৎক্ষণিকভাবে পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি চলতে থাকে। কংগ্রেস ও বিজেপি_ ভারতের দুই প্রধান দল বক্তব্য প্রত্যাহার দাবি করে। বিজেপি দাবি তোলে, অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করা হোক। মামলার কথা জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছিল। কিন্তু ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে মামলা করার ইচ্ছা ভারত সরকারের নেই। এটি করে ভারতীয় সরকার যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারত চরম ভিন্নমতও সমালোচনা সহকারে গ্রহণ করতে পারে, এমন একটি ধারণা জনমনে তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা বা গ্রেফতার পরিচালনা করলে তিনি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতেন এবং বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার সমর্থন তার দিকে যেত। মামলা না করায় বিরুদ্ধ-মতের বুদ্ধিজীবী কলামিস্টরা অরুন্ধতীকে ধুয়ে দিতে পারছেন। অবশ্য ভারত সরকারের মধ্যেও একটি অংশ মনে করে, কাশ্মীরকে \'আজাদি\' দেওয়া যায়। হয়তো সেটা সীমিত, কিন্তু তার নাম আজাদিই।
অরুন্ধতীর বক্তব্যের পর সবচেয়ে মজার প্রশ্ন তুলেছেন কাশ্মীরের অ্যাক্টিভিস্ট ড. সাবির চৌধুরী। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, \'পাকিস্তানের মধ্যে কি সত্য কথা বলার মতো একজন অরুন্ধতী তৈরি করা সম্ভব?\' ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেখানে সেনাশাসন চলছে_ সবই হয়তো সত্য। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের নীতিও তো ভ্রান্ত। সেখানে তারাও সেনাশাসন চালাচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। কিন্তু পাকিস্তানে কি এমন একজন লেখক, বুদ্ধিজীবী আছেন যিনি পাকিস্তানের কাশ্মীর-নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন? সাবির চৌধুরীর প্রশ্নের উত্তরে না-ই বলতে হবে।
পাকিস্তানে হয়তো তেমন বুদ্ধিজীবী থাকতেও পারেন। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে বলার পর তাকে দেশে থাকতে দেওয়া হবে, গ্রেফতার করা হবে না_ এমন ভাবা কঠিন।
মামলা না হলেও অরুন্ধতীকে অবশ্য নানা সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিজেপির মহিলা সংগঠনের কর্মীরা তার বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। অনেকে বলছেন, অরুন্ধতী কাশ্মীর নয়, নিজেকে নিয়ে বিতর্ক চান। তিনি জঙ্গিবাদীদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছেন। তিনি সৈয়দ আলী শাহ গিলানির মতো প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিমদের দলে ভিড়ে গেছেন। শ্রীনগরের সেমিনারে সৈয়দ আলী শাহ গিলানি উপস্থিত ছিলেন, বক্তব্য দিয়েছেন; ছিলেন আয়োজকদের একজন। ধারণা করা হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হতে পারে। তিনি স্বাধীন কাশ্মীর আন্দোলনের নেতা। সম্প্রতি তার একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছে ইন্ডিয়া টুডে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার বিষয়ে কী ভাবছেন? তিনি বলেন, \'আমার বিরুদ্ধে ৯০টি এফআইআর আছে। ৯১টা হলে কিছু যায়-আসে না। ২১ অক্টোবর দিলি্লতে আমি যা বলেছি, শ্রীনগরেও সেই একই কথা বলেছি। এটাই কঠিন বাস্তবতা। জম্মু ও কাশ্মীর বিতর্কিত এলাকা। এটি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। ১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর ভারত এটি দখল করে নিয়েছে।\' গিলানি চান স্বাধীন কাশ্মীর হবে আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র। তাকে প্রশ্ন করা হলো, স্বাধীন কাশ্মীরে কি আপনি অরুন্ধতীকে নেবেন? তিনি উত্তর দেন, যদি তিনি চান তবে কেন নেব না? অবুঝ লোকেও বোঝে, সৈয়দ আলী শাহ গিলানি আর অরুন্ধতী রায়ের মতের মধ্যে তফাত বিস্তর। তেহেলকা পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী বলেছেন, তারা যার যার জায়গা থেকে কথা বলেছেন, এখানে দলে ভেড়ার কোনো ব্যাপার নেই।
এখন কেউ যদি বলেন, অরুন্ধতী কাশ্মীরকে স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছেন, সেটি ভুল হবে। তিনি মূলত মানবাধিকার নিয়েই চিন্তিত। আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্র অনেক দূরের যুক্তি। সে যুক্তি দিয়ে তর্কে জেতা যায়, কিন্তু এখনকার দগদগে বাস্তবতা তাতে ফিকে হয় না।

মাহবুব মোর্শেদ : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mahbubmorshed@ymail.com

Tuesday, November 9, 2010

ঈদের পর ...

শীত আসি আসি করছে। উত্তর থেকে মৃদুমন্দ বাতাস বইতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। ধারণা করা হচ্ছে, লোকে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে গিয়ে সঙ্গে শীতের শুভেচ্ছা নিয়ে ফিরবে। নাগরিকরা যখন শীতের জন্য প্রস্তুত তখন রাজনীতি উল্টো দিকে পাল তুলে বসে আছে। পুরো গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ শীতঘুমে কাটিয়ে শীতের প্রাক্কালে শীতঘুম ভাঙার আয়োজন করছে বিরোধী দল। তাদের পক্ষ থেকে অকালে জাগরণের এই ইঙ্গিত থেকে কেউ কেউ ধারণা করছেন, ঈদের পর সত্যিই বোধহয় রাজনীতির মাঠ গরম হয়ে উঠবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতির নিজস্ব কিছু ঋতুবৈচিত্র্য আছে। গরমে মানুষ রাস্তায় নামতে পছন্দ করে না। ফলে গরমের দিনে একান্ত জরুরি না হলে আন্দোলন জমানো কঠিন। বর্ষাতেও তথৈবচ। পানি আর কাদা ভেঙে রাস্তায় নামার ধকল কে আর সইবে? তাই বর্ষাও বাদ। থাকে শুধু হেমন্ত আর বসন্ত। এই সময়ে আন্দোলন জমাতে না পারলে আবার অপেক্ষা পরের হেমন্তের জন্য। ইংরেজি হিসাবে নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি বড়জোর মার্চ পর্যন্ত বাঙালির আন্দোলনের মরসুম। শুধু ঋতু কেন, অন্য হিসাবও আছে। যেমন রমজানের আগে কিংবা রমজান মাসে আন্দোলন হবে না। ঈদের আগে নয়। তবে যে কোনো ঈদের পরে হতে পারে। ঈদের ছুটির লাগোয়া কয়টা দিন হরতাল দিলে লোকে এমনকি অভিনন্দনও জানাতে পারে। কিন্তু লোকে যখন পুরো মুডে থাকে, কাজে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে, তখন হরতাল-ধর্মঘট ইদানীং আর পছন্দ করে না। হরতাল-ধর্মঘট তো বটেই ঢাকা শহরে এখন ছোটখাটো মিছিল করারও জো নেই। একেকটা ছোট মিছিলে ঘণ্টা তিন-চারেকের জ্যাম পড়ে যায়। ফলে পথচারীরা যদি ঘুণাক্ষরে জানতে পারেন কার মিছিল তবে তার জনপ্রিয়তা বাসে বসিয়েই কমিয়ে দেন। সমাবেশ হলে তো কথাই নেই। সরকারি-বেসরকারি যে নেতাই হোক, সমাবেশ করলে ওইদিন তার জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়। ফলে সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষের জন্যই সহজ কর্মসূচি হলো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন। আর তাতেও যদি বাধা আসে তবে টিভিতে ক্যামেরা আন্দোলনই একমাত্র উপায়। তাই ভাবছি, ঈদের পর আন্দোলনের কথা যে বলা হচ্ছে সেটা হবে কী করে? তর্কের খাতিরে ধরেই নেওয়া হলো, আন্দোলন হবে। মিছিল-সমাবেশ-হরতালে মুখর হয়ে উঠবে রাজধানীর পথঘাট। বিরোধীদের মাঠ থেকে হটাতে পুলিশ নামবে, পুলিশ না পারলে রাজনৈতিক কর্মীরা নেমে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু লোকে সেই আন্দোলনে-সংঘর্ষে খুশি হবে তো? লোকে বলে, আমাদের ভোজ্য তালিকার শীর্ষে নাকি লাউ। লাউ খেতে খেতে ক্লান্ত হলে বিকল্প ব্যবস্থা কদু। আর কদু খেতে ভালো না লাগলে লাউ। আমরা কখনও কদুর ওপর রাগ করে লাউ খাই, অথবা লাউয়ের ওপর রাগ করে কদু খাই। কখনও মনে হয় লাউ ভালো, কখনও কদু। অবশ্য সরকারের শেষ দিক হলে কথা ছিল। পাঁচ বছর লাউ খেয়ে ক্লান্ত হলে লোকে বলত, এবার কদু আনো। ফলে কদু আনার ছলে শেষ দিকে কিছু আন্দোলন রেওয়াজমতো জমতেও পারত। তাই বলে এখনই? ঈদের পরেই? অবশ্য দুর্জনরা বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধী দলে থাকলে অমন করে করেই সময় কাটায়। সংসদে যাওয়ার নামগন্ধ নেই। মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে চিন্তা নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। আবার একটা বোঝাপড়ার বোধ আছে। সরকার যখন ক্ষমতায় আছে তখন পাঁচ বছর তো ক্ষমতায় থাকবেই। ফলে সময় কাটানোর একটা উপায় দরকার। সেটা কী হতে পারে। নিজেদের জানানও দিতে হবে, পাঁচটা বছর কাটাতেও হবে। ফলে একেকটা লক্ষ্য তৈরি করার উদ্যোগ। তারই অংশ ঈদের পর আন্দোলন, রোজার পর কঠোর কর্মসূচি, শীতের পর দেশব্যাপী কর্মসূচি, গ্রীষ্মের পর সরকার পতন। রাজনীতিতে সময় এইভাবেই কাটে। ফলে চিন্তার কিছু নেই। ঈদের পর কিছু হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু সত্যিই যদি বিরোধী দল রাজনীতির ময়দানে উষ্ণ হাওয়ার ব্যবস্থা করতে চায়। আগের মতো সংঘর্ষ-সংঘাতে ফিরিয়া যাইতে চায় আর যদি সরকার পক্ষ তাতে তাল দিয়ে গরম বাড়িয়ে তোলে, তবে জনগণের কপালে দুঃখ আছে। শহরে তাৎক্ষণিক বিপত্তির কথা ভুলে গেলেও সুদূরপ্রসারী দুঃখের কথা তো ভুললে চলবে না।