Wednesday, January 26, 2011

বই প্রকাশের আগে প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তি ছাড়া লেখকের স্বার্থ রক্ষা করা কঠিন::মনজুরুর রহমান


সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মাহবুব মোর্শেদ
অমর একুশে বইমেলার প্রেক্ষাপটে লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে কপিরাইট, রয়ালটি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নানা আলোচনা ও তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে। এসব বিতর্কে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দেশে কপিরাইট ও রয়ালটি সংক্রান্ত আইনকানুন বিষয়ে সামগ্রিক সচেতনতার বিশেষ অভাব আছে। এ প্রেক্ষাপটেই সমকাল কথা বলেছে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার মনজুরুর রহমানের সঙ্গে। মনজুরুর রহমানের জন্ম ৬ নভেম্বর ১৯৫৯ সালে, কিশোরগঞ্জে। ২০০৯ সাল থেকে তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কপিরাইট বিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করেন। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বিষয়ে তার একটি বই আগামী মেলায় প্রকাশিত হবে। কপিরাইট অফিসের কার্যক্রম, মেধাস্বত্ব, রয়ালটি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে


সমকাল : বাংলাদেশে একটি কপিরাইট অফিস থাকা সত্ত্বেও এর কার্যক্রম সম্পর্কে অনেকেই জানেন না বা কপিরাইট আইন সম্পর্কে অনেকেই সচেতন নন। কপিরাইট অফিস কতদিন আগে কাজ শুরু করেছে?
মনজুরুর রহমান : কপিরাইট অফিস যাত্রা শুরু করেছে ১৯৬২ সাল থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে। তখন পুরনো আইনে চলত। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ আইন অনুসরণ করা হতো। পাকিস্তান আমলে কিছু কিছু সংশোধন আনা হয়েছিল। ২০০০ সালে বাংলাদেশে নতুন আইন হয়েছে, বাংলাদেশ কপিরাইট আইন নামে। ২০০৫ সালে এটি সংশোধন হয়েছে। ২০০৬ সালে আইন অনুসারে বিধিমালা তৈরি হয়েছে। কপিরাইট অফিস এখন এই বিধিমালায় চলে। ২০১০ সালে আইন ও বিধিমালা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। আমাদের কপিরাইট আইন পৃথিবীর যে কোনো দেশের কপিরাইট আইনের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম। ছোটখাটো ত্রুটি সত্ত্বেও এটি বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য আইন। তবু এর ক্রমাগত সংশোধনের একটি প্রক্রিয়া চলমান আছে।
সমকাল : কপিরাইট আইন ও বিধিমালার আওতায় কী কী পড়ে?
মনজুরুর রহমান : সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত, ফটোগ্রাফি, অ্যাডভার্টাইজিং, কম্পিউটার সফটওয়্যার থেকে শুরু করে যত ধরনের সৃজনশীল কাজ আছে তা এই আইনের আওতায় আসবে। এসব ক্ষেত্রে যত ভায়োলেশন হতে পারে তা এই আইন ও বিধিমালার দ্বারা প্রতিবিধান করা যাবে।
সমকাল : কপিরাইট আইনে কপিরাইট অফিসকে কি পুলিশিং অথরিটি দেওয়া হয়েছে?
মনজুরুর রহমান : আমাদের সরাসরি পুলিশিং অথরিটি দেওয়া হয়নি। এই আইন অনুসারে একটি কপিরাইট বোর্ড কাজ করে। এটি একটি কোয়াসি জুডিসিয়াল অফিস। কেউ যদি রেজিস্ট্রেশন চায় তবে আমরা রেজিস্ট্রেশন করি। আমি রেজিস্ট্রার হিসেবে কারও কপিরাইট দাবিকে রেজিস্টার করি। কারও কপিরাইট রেজিস্ট্রি প্রক্রিয়ার দ্বারা অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি কপিরাইট বোর্ডে আপিল করতে পারেন। কপিরাইট বোর্ড অভিযোগ পেলে দু'পক্ষকে ডেকে শুনানি করে। কেউ যদি বোর্ডের সিদ্ধান্তে দ্বিমত প্রকাশ করেন তবে তিনি আদালতে যেতে পারেন। এর বাইরে যদি কোনো অন্যায় হয়, যেমন_ কোনো লেখকের বই যদি এখানে নকল হয় বা বিদেশি কোনো প্রকাশনা যদি নকল হয় তবে বিক্ষুব্ধরা সরাসরি থানায় যাবে এবং মামলা হবে। সে ক্ষেত্রে কোর্ট বিচার করে কপিরাইট আইন অনুসারে শাস্তি দেবেন। টাস্কফোর্সের অপারেশনে এমন বহু পাইরেটেড বই আমরা উদ্ধার করেছি। দেশি-বিদেশি বহু বই এখানে আইনবহির্ভূতভাবে পাইরেটেড হওয়ার নজির আছে। আমি ২০০৯ সালে এ অফিসের দায়িত্ব গ্রহণের পর মোট ৯টি অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছে।
সমকাল : একজন শিল্পীর গান বা সিডি যদি পাইরেটেড হয়ে বাজারে চলে আসে তবে তার করণীয় কী?
মনজুরুর রহমান : তিনি সরাসরি কোর্টে মামলা করতে পারেন। সত্যিকার অর্থে কপিরাইট কী আমরা জানি না বা এ বিষয়ে সচেতন নই। একজন মানুষের দু'ধরনের সম্পদ আছে। একটা বস্তুগত সম্পদ, আরেকটি মেধাসম্পদ। জমি, ঘর, বাড়ি, ব্যবসা, ব্যাংক ব্যালান্স বস্তুগত সম্পদ। আর একজন শিল্পী-সাহিত্যিক-চলচ্চিত্র নির্মাতা যে শিল্প-সাহিত্যকর্ম তৈরি করেন সেগুলো তার মেধাসম্পদ। মেধাসম্পদের দুটি দিক আছে : একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ট, আরেকটি কালচারাল পার্ট। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্টের আওতায় আসে পেটেন্ট, ডিজাইন, ট্রেডমার্ক, জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন ইত্যাদি বিষয়। এটা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্রেডমার্ক অফিস দেখাশোনা করে। আর কালচারাল পার্টটা দেখাশোনা করে কপিরাইট অফিস। প্রেস আবিষ্কারের পরপরই এ ধরনের আইনের উদ্ভব ঘটে। ঊনবিংশ শতকে গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো চালু হলে গানের ব্যাপারে আইন চালু হয়। একটি সৃষ্টিকর্ম, যেমন_ গান, কবিতা, উপন্যাস, ছবি ইত্যাদি যদি শিল্পীর অনুমতি, স্বীকৃতি বা তাকে যথাযথ ক্রেডিট না দিয়ে কোথাও ব্যবহৃত হয়, তবে তাতে শিল্পকর্মটির স্রষ্টার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। কপিরাইটের দুটি দিক, একটি হলো_ অর্থনৈতিক স্বার্থ, আরেকটি নৈতিক স্বার্থ। যখন কেউ একজন লেখকের লেখা কোথাও ব্যবহার করবে তখন লেখকের নাম থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, লেখকের লেখা ব্যবহার করতে হলে তা অবিকৃতভাবে করতে হবে। এগুলো মোরাল রাইটের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে বাংলাদেশের আইনে একজন লেখক বা শিল্পী জীবিত অবস্থায় তার সৃষ্টিকর্মের অর্থনৈতিক স্বত্ব তিনি আজীবন ভোগ করবেন। তিনি মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীরা ৬০ বছর পর্যন্ত স্বত্ব ভোগ করতে পারবেন। এটি অর্থনৈতিক অধিকার। এ কারণেই নজরুলের লেখার স্বত্ব তার পরিবার এখনও ভোগ করতে পারছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ৬০ বছর পেরিয়ে যাওয়ায় তার উত্তরাধিকারীরা স্বত্ব আর ভোগ করতে পারছেন না। অর্থনৈতিক অধিকার সময়ের ব্যবধানে ফুরিয়ে যেতে পারে; কিন্তু নৈতিক অধিকার কখনও শেষ হবে না। হোমারের লেখা হোমারের নামেই, শেক্সপিয়রের লেখা শেক্সপিয়রের নামেই চলতে হবে। আমাদের দেশে এখনও অনেকেই কপিরাইট বিষয়ে জানেন না, মানেনও না। এখানে মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা আছে। লেখালেখি, আলোচনা, টক শো ইত্যাদির মাধ্যমে এ বিষয়গুলোতে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে বলে আমি মনে করি।
সমকাল : একজন শিল্পী-সাহিত্যিক পাইরেসির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি কি কপিরাইট অফিসে আসতে পারেন?
মনজুরুর রহমান : তিনি সরাসরি কোর্টে বা থানায় যেতে পারেন। কিন্তু কোর্টে বা থানায় সুবিধা পেতে হলে তাকে কপিরাইট অফিসে কিছু কাজ করতে হবে। তাকে এখান থেকে কপিরাইট সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে। কপিরাইট সার্টিফিকেট থাকলে সৃষ্টিকর্মের ওপর শিল্পী-সাহিত্যিকের অধিকার আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সুবিধা হয়। সারা পৃথিবীতেই কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক নয়। আইনি সুবিধা পেতে হলে আপনাকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। পাইরেসির কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে সিভিল কোর্টে যেতে হবে অথবা শাস্তি দিতে হলে ক্রিমিনাল কোর্টে যেতে হবে।
সমকাল : কোনো অ্যালবাম বা বইয়ের প্রকাশক যদি শিল্পী-সাহিত্যিককে প্রাপ্য রয়ালটি না দেন তবে সে ক্ষেত্রে তিনি কী করতে পারেন? এখানে কপিরাইট অফিসের ভূমিকা কী?
মনজুরুর রহমান : এক্ষেত্রে আমাদের শিল্পী ও লেখকরা যে ভুলটা প্রথমেই করছেন তা হলো তারা বইয়ের প্রকাশক বা অ্যালবামের প্রকাশকের সঙ্গে কোনো চুক্তি করছেন না। কিন্তু বইয়ের পাণ্ডুলিটি প্রকাশকের হাতে তুলে দেওয়ার আগে চুক্তি করাটা বাধ্যতামূলক। কপিরাইট আইনের ১৯ নম্বর ধারা অনুসারে এ চুক্তি হতে হবে এবং তাতে লেখকের স্বাক্ষর থাকতে হবে। এবং লেখকের প্রাপ্য রয়ালটির হার, চুক্তির সময়সীমা উলি্লখিত থাকতে হবে। এমন চুক্তি থাকে না বলেই সমস্যার উদ্ভব ঘটে। আপনি দেখবেন, সমানে বহু বই অনূদিত হচ্ছে, সেগুলো বইমেলায় বাজারজাত হচ্ছে।
মেধা খরচ করে অনুবাদ করার পরও যদি ৫২ ধারার ব্যত্যয় ঘটে তবে সেটি বেআইনি হবে।
সমকাল : একজন লেখক যদি প্রকাশকের কাছ থেকে রয়ালটি দাবি করেন তবে আইনগতভাবে তাকে প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে।
মনজুরুর রহমান : এটি না করা হলে প্রকাশক বলতে পারেন, লেখকের সঙ্গে আমার কোনো চুক্তি ছিল না। কথা ছিল, আমি তাকে ১০ কপি বই দেব, তার সঙ্গে আমার আর কোনো লেনদেন নেই। এরকম হচ্ছেও।
সমকাল : কপিরাইট অফিসের পক্ষ থেকে প্রকাশকদের চুক্তি করতে বাধ্য করার কোনো উপায় কি আছে?
মনজুরুর রহমান : না। এটা আমরা করতে পারি না। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কোর্টে না যাবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কোনো উদ্যোগ নিতে পারি না। এর আগে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা আইন আমাকে দেয়নি।
সমকাল : অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কি প্রকাশকদের চুক্তি করতে বাধ্য করতে পারে?
মনজুরুর রহমান : অন্য প্রতিষ্ঠানও বাধ্য করতে পারে না। তবে মানসিক চাপটা তৈরি করা যায়। যেমন বইমেলা উপলক্ষে কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বইমেলা শুধু প্রকাশক ও পাঠকের মেলা নয়, এটি লেখক-প্রকাশকের মেলা। একজন প্রকাশক কোনো লেখকের বই প্রকাশ করে যদি তাকে রয়্যালটি না দেন তবে লেখককে রয়্যালটি পাইয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বোধহয় এখন আমাদের তৈরি হয়েছে। অন্যায় থেকে দূরে থাকার জন্যই তো আমরা ভাষা আন্দোলন করেছিলাম। এখন এমন লেখকের দেখাও আমি পেয়েছি, যিনি ১৫টি বইয়ের মধ্যে শুধু একটি বইয়ের রয়্যালটি পেয়েছেন। প্রশ্ন হলো, তাহলে লেখক কি সারাজীবন বঞ্চিত হতেই থাকবেন? এটা তো হতে পারে না। আপনি লিখিত চুক্তি করলে লেখককে রয়্যালটি দিতে বাধ্য থাকবেন। প্রকাশক কত কপি বই প্রকাশ করলেন সেটি প্রেসের সার্টিফিকেটসহ লেখককে জানাবেন। বছরের শেষে কত কপি বই বিক্রি হলো সে তথ্য জানাবেন। এগুলো যদি না করা হয় তবে লেখকের অধিকার কীভাবে রক্ষিত হবে? এগুলো যতদিন পর্যন্ত মানা না হবে ততদিন পর্যন্ত বঞ্চনা চলতে থাকবে। এ কারণে আমাদের দেশে প্রফেশনালিজম গড়ে ওঠে না। এদেশে ক'জন লেখক আছেন যারা শুধু লিখেই জীবিকা নির্বাহ করেন? হাতেগোনা কয়েকজন। অথচ লেখকরা যদি ঠিকমতো রয়্যালটি পেতেন তবে পরিস্থিতিটা অন্যরকম হতো। লেখকদের এমন বঞ্চিত ও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা আমাদের দেখতে হতো না।
সমকাল : আমরা জেনেছি, বাংলা একাডেমী বইমেলায় স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে একটি নিয়ম করেছে। তারা কোনো প্রকাশনাকে স্টল দেওয়ার আগে লেখকের সঙ্গে প্রকাশকের চুক্তিপত্র জমা দেওয়ার নিয়ম চালু করেছে।
মনজুরুর রহমান : এটা কী করেছে বাংলা একাডেমী? আমি বইমেলা আয়োজক কমিটির একজন সদস্য। এই নিয়ম চালু করার জন্য আমি বারবার অনুরোধ করে আসছি। কিন্তু আমার জানা মতে, এখনও এ ধরনের কোনো নিয়ম চালু হয়নি। এটা করলে এক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হবে বলে আমি মনে করি। এ বছর নিয়ম করলে আগামী বছরেই হয়তো পুরো সাফল্য আসবে না। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারে সাফল্য আসবে বলে আমার বিশ্বাস। বইমেলায় স্টল বরাদ্দের আগে প্রকাশকের কাছে লেখকের সঙ্গে চুক্তিপত্র জমা দিতে বলবে। যেমন বই ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে জমা দিয়ে আইএসবিএন নম্বর নিতে হয় এবং সেই নম্বরের রিসিট জমা দিতে হয় তেমনি কপিরাইট আইনের ১৯ ও ৫২ ধারা অনুসারে লেখকের সঙ্গে চুক্তি বা অনুবাদকের সঙ্গে চুক্তির ফটোকপি একাডেমীকে জমা দিতে হবে। খুব সহজেই এ নিয়ম চালু করা সম্ভব। এটা হলে প্রকাশকদের মধ্যে একটা মানসিক চাপ তৈরি হবে, লেখকদের সঙ্গেও তার একটা স্বচ্ছ সম্পর্ক তৈরি হবে।
সমকাল : লেখক-প্রকাশক চুক্তির কোনো খসড়া কি আপনাদের আছে?
মনজুরুর রহমান : নেই। তবে বাংলা একাডেমী লেখকদের সঙ্গে যে চুক্তি করে সেটি মডেল ধরে নিয়ে একটি চুক্তিপত্র তৈরি করা যেতে পারে। চুক্তি একটা বোঝাপড়া, সে ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই শর্তগুলো নির্ধারিত হওয়া দরকার। তাকে কপিরাইট আইনের ১৯ নম্বর ধারা অনুসরণ করা দরকার। আইনসম্মত চুক্তি না হলে সে চুক্তি লেখক-প্রকাশকদের কাজে আসবে না। তবে চুক্তির প্রয়োজনীয়তা সর্বাগ্রে, এটি না হলে লেখকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা আসলেই খুব কঠিন। পাশাপাশি এ কথাও বলে রাখতে চাই, সব প্রকাশক খারাপ নন, অনেক সৎ প্রকাশক আছেন। তারা লেখকের সঙ্গে চুক্তি করে, নিয়মিত রয়্যালটি পরিশোধ করেই ব্যবসা করছেন। এক্ষেত্রে লেখকরা একদলে, প্রকাশকরা বিপরীত দলে, এমন বিবেচনার সুযোগ নেই। প্রকাশকদের সমস্যার দিকেও আমাদের তাকাতে হবে। কিন্তু সবার উদ্দেশ্য হবে আইনসম্মত একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থা তৈরি করা, যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
সমকাল : প্রকাশকরা অনেক সময় অভিযোগ করেন যে, বই বিক্রি হয় না বলে তারা লেখককে রয়ালটি দিতে পারেন না।
মনজুরুর রহমান :এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। কোনো বই প্রকাশের আগে প্রকাশক যদি বিচার করতে না পারেন বইটি চলবে কি-না তবে সেটি তার ব্যর্থতা। একটি বই যখন প্রকাশিত হচ্ছে, তখন ধরেই নিতে হবে বাজারে বইটির চাহিদা বিষয়ে প্রকাশক সচেতন। এবং সে সচেতনতার অংশ হিসেবে তাকে লেখকের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। এরপর যদি বই বিক্রির ক্ষেত্রে তিনি সাড়া না পান তবে বুঝতে হবে তার বিপণন ব্যবস্থায় দক্ষতার ঘাটতি আছে। তবে এ কথাও সত্য, বই বিক্রির ক্ষেত্র বাড়াতে বইমেলার বাইরে আরও অনেক উদ্যোগ নিতে হবে।
সমকাল : আমরা আশা করব, লেখক-প্রকাশকরা কপিরাইট আইন, রয়ালটি ও চুক্তি বিষয়ে সচেতন হবেন। সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মনজুরুর রহমান : সমকালকেও ধন্যবাদ।

Tuesday, January 25, 2011

বিবাহ বিচ্ছেদ ও ফেসবুক


মাঝে মধ্যে মজার অনেক খবরে চোখ আটকে যায়। খবর ছোট হলেও কিংবা পত্রিকার কাছে গুরুত্ব না পেলেও দেখা যায় পাঠকরা ঠিকই সেই খবর নিয়ে রীতিমতো খোশগল্প জুড়ে দিয়েছেন। তেমনি এক খবর এটি। খবর দেখে স্বাভাবিকভাবে খুব আগ্রহ তৈরি হলো। 'ফেসবুকের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে।' বেশ মজার খবর বটে। ফেসবুকের কারণে বিবাহিত মানুষেরা পরিচিত-অপরিচিত মানুষের সঙ্গে, বিশেষত বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারছেন। তাদের মধ্যে সম্পর্কও গড়ে উঠছে। এই সম্পর্ক পরকীয় প্রেম পর্যন্ত গড়াচ্ছে। বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সমস্যা হচ্ছে। ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। ব্রিটেনের বিবাহ বিচ্ছেদের সঙ্গে জড়িত আইনজীবীরা এই গুরুতর তথ্য ফাঁস করেছেন। সাধারণ চোখে দোষ অবশ্যই ফেসবুকের। ফেসবুক তৈরি হলো বলেই না মানুষ পরস্পরের সঙ্গে মিশে মিশে ভাববিনিময় করে নিজেদের এমন সর্বনেশে হাল করল। এখন যারা শান্তিপূর্ণ পারিবারিক জীবনের সমর্থক, যারা চান না এই পারিবারিক শান্তির পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াক তাদের দাবি কী হবে? ফেসবুক বন্ধ করে দিন? বেশ, ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া হলো। তাতে কি বিবাহ বিচ্ছেদ বন্ধ হবে? যখন ফেসবুক ছিল না, তখন বিবাহ বিচ্ছেদ হতো না? তর্কের খাতিরে কেউ হয়তো বলবেন, এখন বিচ্ছেদের হার বেশি। এখানে ফেসবুকের কোনো ভূমিকা না থেকেই যায় না। প্রশ্ন হলো, অন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোও কি পরিবর্তিত হয়ে যায়নি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। জীবনে কি জটিলতা বাড়েনি? ফেসবুক একটা টুল। ফেসবুকের মাধ্যমে জটিলতা সামনে এসেছে মাত্র। এর চেয়ে বড় ভূমিকা কি একটি ওয়েবসাইটের আছে? ওয়েবসাইটের পেছনে তো মানুষ আছে। তাদের বাদ দিয়ে কি আলোচনা করা যায়? প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে গেল একটি লেখার কথা। রোমান সাম্রাজ্যের পতন বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক পুরনো ইতিহাসবিদদের নিয়ে আলোচনা করছিলেন। রোমান সাম্রাজ্যের পতন কেন হয়েছিল? পুরনো ইতিহাসবিদদের মধ্যে একটা চালু ধারণা ছিল সে সিসার পাত্রে খাওয়া ও পান করা ছিল রোমানদের শরীরে বিষক্রিয়া, স্বাস্থ্যহানি এবং ফলে সাম্রাজ্যের পতনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। লেখক বলছেন, সিসা নিশ্চয়ই একটা কারণ। গুরুত্বপূর্ণ কারণও বটে। কিন্তু একটা সাম্রাজ্যের পতনের জন্য শুধু সিসাকে দায়ী করলে তা পূর্ণ সত্যটি প্রতিফলিত করে না। যেমন, আমেরিকায় এখন হটডগ খুব জনপ্রিয়। এ খাবারটি আমেরিকানদের স্বাস্থ্যের নানা ক্ষতিও করে থাকে। কিন্তু কয়েকশ' বছর পর যদি কোনো গবেষক বলেন, আমেরিকান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ অত্যধিক মাত্রায় হটডগ খাওয়া, তাহলে তাকে কীভাবে নেওয়া হবে? লেখক বলছেন, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অনেক কারণ আছে। অন্যতম কারণ হলো, সাম্রাজ্যের মোট আয়ের চেয়ে সাম্রাজ্য রক্ষার ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে গিয়েছিল। সীমান্ত রক্ষার খরচ বিশেষভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে সাম্রাজ্যকে কৃষি জমি, বন, খনি ইত্যাদির ওপর অত্যধিক চাপ দিতে হচ্ছিল। ফলে আখেরে বহিরাগতদের আক্রমণ সাম্রাজ্যটিকে পর্যুদস্ত করে ফেলতে পেরেছিল। ফেসবুকের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার খবরে সে কথাই আবার মনে হলো। সমাজের জটিলতা, সংস্কৃতির সংকট, অর্থনীতির নাজুক দশা_ কোনো কিছুকে দায়ী না করে স্রেফ ফেসবুকের ওপর দায় চাপানো সহজ বটে। এখন কেউ যদি গবেষণা করে বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে, তবে সেটি ফেসবুকের দায়ী হওয়ার খবরের মতো মুখরোচক হবে না। ফলে খবর তৈরি করলে এখন ফেসবুককে জড়ানো একটা ভালো উপায় বটে।

Monday, January 24, 2011

বেবি ডকের প্রত্যাবর্তন


২৫ বছরের স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে 'বেবি ডকে'র প্রত্যাবর্তন ঘটেছে হাইতির রাজনীতিতে। তরুণ প্রজন্মের কাছে বেবি ডক খুব পরিচিত নাম নয়। কিন্তু হাইতির রাজনীতির খবর একটু তলিয়ে দেখলেও বেবি ডকের খবর মেলা কঠিন কিছু নয়। রবিঠাকুরের গল্প 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' কথাটি বাংলায় কালক্রমে একটি বাগধারা হিসেবেই গৃহীত হয়েছে। সেই বাগধারাটি বোধকরি বেবি ডকের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে বেশ মিলিয়ে দেওয়া চলে। হাইতির রাজনীতিতে বেবি ডক বা খোকাবাবু বলে পরিচিত জঁ ক্লদ দুভেলিয়ের প্রত্যাবর্তনের পর দেশটির রাজনীতির দিকে সবাই বেশ কৌতূহলী দৃষ্টি দিয়েছেন। দেশে ফিরে বেবি ডক বলেছেন, তিনি দেশের সংকটের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই ফিরেছেন। অবশ্য ক্ষমতাসীন সরকার তাকে গ্রেফতার করে দুর্নীতির অভিযোগে জেলে পুরে দিয়েছে ইতিমধ্যে। এ হলো গত সপ্তাহের ঘটনা। হাইতির বর্তমান সংকট কোথায়, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সকলের মনে পড়বে ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারির কথা। অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে দেশটি ৭ মাত্রার মারাত্মক ভূমিকম্পে পুরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ভূমিকম্পে প্রায় ৩ লাখ মানুষ মারা যায়, ৩ লাখ আহত হয় এবং ১০ লাখ গৃহহীন হয়ে পড়ে। রাজধানী পোর্ট অ প্রিন্সের প্রেসিডেন্ট প্যালেস, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, কেন্দ্রীয় ক্যাথিড্রালসহ বহু স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। এই ভূমিকম্পের পর লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে গরিব এই দেশটি এক গভীর সংকটে পড়ে। গত একটি বছর ডায়রিয়া-কলেরার মতো মহামারীর ধকল সইবার পর 'পতন' বা 'আরও খারাপ দশা'র কোনো অস্তিত্ব সেখানে নেই। কারও কারও হয়তো মনে পড়বে, বিধ্বস্ত এই দেশটির প্রাথমিক উদ্ধার অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র বুশ ও ক্লিনটন দু'জনকেই পাঠিয়েছিল। কিন্তু হাইতিকে বাঁচানোর তাদের প্রচেষ্টা থমকে যায়। কারণ, এই বিপর্যয়ের মধ্যেও হাইতিয়ানরা ষড়যন্ত্রমূলক সাহায্যের বিরোধিতা করেছিল। এর ফল হয়েছে মারাত্মক। বিভিন্ন রিপোর্ট সূত্রে দেখা যাচ্ছে, এক বছর আগের হাইতির সঙ্গে আজকের হাইতির কোনো পার্থক্য নেই। যে ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছিল, তাতে জীবনের কোনো আশা তৈরি হয়নি। এ অবস্থাতেই ফিরলেন বেবি ডক। অনেকের মনে পড়বে, আশির দশকে আফ্রিকান সোয়াইন ফ্লুর মহামারীর পর যে সংকটে পড়েছিল হাইতি, তারই ফল হিসেবে বেবি ডকের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছিল। ২৫ বছর পরের আরেকটি বিপর্যয়ের পর বেবি ডকের প্রত্যাবর্তন ঘটল। ইতিমধ্যে দেশটিতে কেউ কেউ তাকে উদ্ধারকর্তা হিসেবে ভাবতে বসেছেন। বেবি ডকের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটেছিল অভ্যন্তরীণ আন্দোলন ও খানিকটা বাইরের চাপে। কিন্তু বেবি ডক যার সন্তান সেই পাপা ডক হাইতির জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। পাপা ডক নামে পরিচিত ফঁদ্ধাসোয়া দুভেলিয়ের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে গণআন্দোলনের ফল হিসেবে হাইতির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি হাইতি শাসন করেছেন। মৃত্যুর পর বেবি ডক তার উত্তরাধিকার ১৫ বছর বহন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাপা ডক স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেছিলেন তা শাসনকালের বহর দেখলেই বোঝা যায়। আর বেবি ডকের কথা তো বলাই বাহুল্য। সব মিলিয়ে হাইতির মতো দুর্ভাগা জাতি বোধ হয় খুব কমই আছে। কিন্তু আঠারো-উনিশ শতকে পৃথিবীর বুকে হাইতি এক নতুন আশা নিয়ে এসেছিল। হাইতিই লাতিন আমেরিকার প্রথম স্বাধীন দেশ। ১৮০৪ সালে হাইতিয়ান বিপ্লবের পর প্রথম আফ্রিকান দাসদের নেতৃত্বে স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল হাইতিতেই। বলা হয়ে থাকে, হাইতি হলো লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা আর আমেরিকার সেতু। প্রথম স্বাধীনতা, সম্ভাবনা ও স্বপ্নে উদ্গাতা। হাইতি হয়তো এখনও স্বাধীনতা, মুক্তি ও সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখানোর দায় শোধ করে চলেছে। ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণায় হাইতিতে যে বিপ্লব হয়েছিল তারই প্রেক্ষাপটে কিউবান ঔপন্যাসিক আলেহো কার্পেন্তিয়ের একটি উপন্যাস লিখেছিলেন 'এল রেইনো দ্য এস মুন্দে' বা 'কিংডম অব দিস ওয়ার্ল্ড'। বাংলায় উপন্যাসটি অনুবাদ করেছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় 'এই মর্ত্যের রাজত্বে' নামে। সেখানে বলা আছে দুর্ভাগা এই জাতিটির করুণ ইতিহাস, সবিস্তারে। আজকের হাইতির দিকে তাকালে মনে হয়, মর্ত্যের রাজত্বে নিজের দেশ থেকে উৎখাত হওয়া দাসদের যে দুঃখের জীবন শুরু হয়েছিল সে বঞ্চনার ইতিহাস কখনও
থামবার নয়।

Saturday, January 15, 2011

বিআরটিএর বিজ্ঞপ্তি


সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকাগুলোতে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করছে বিআরটিএ। বিজ্ঞাপনের বিষয় সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া পুনর্নির্ধারণ। যারা ঢাকার রাস্তায় চলাফেরা করেন বা চলতে বাধ্য হন, তাদের কাছে এ বিজ্ঞাপন মহামূল্যবান বস্তু। কাজে যাওয়া বা কাজ থেকে ফেরার পথে যাদের প্রতিদিন বাসের মতো গণপরিবহনে উঠতে হয়, তারা জানেন এ বাস বস্তুটি কত দামি। আর রাস্তার ধারে অপেক্ষমাণ যে যাত্রীর পাশে এসে সিএনজি অটোরিকশা তাকে গন্তব্যে পেঁৗছে দিতে রাজি হয় তিনি মহাভাগ্যবান। প্রয়োজনের সময় অটোরিকশা মেলা ভার, মিললেও যাত্রীর পছন্দসই গন্তব্যে যেতে চালককে রাজি করানো কঠিন, ভাগ্যক্রমে চালক রাজি হলেও দামে বনিবনা হওয়া আরও কঠিন ব্যাপার। একটি মেট্রোপলিটন বলে কথিত রাজধানী শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থা এত বিশৃঙ্খল হতে পারে তা ভাবতেও কষ্ট হয়। মাঝে মধ্যে রাস্তায় পরিবহনের অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দেখে মনে হয় এক 'সমাধানহীন নাগরিক অসভ্যতার' মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এটিকে গড়েপিটে সভ্যতা বানানো কার পক্ষে সম্ভব? একজন নাগরিকের গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা সময় যে দেশে রাস্তায় ব্যয় হয়, সে দেশ উন্নতির আশাই-বা করে কী করে?
অবশ্য ধীরে হলেও কিছু কিছু উদ্যোগ আসছে। সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া পুনর্নির্ধারণ ও মিটার সচল করার উদ্যোগ রাস্তার বিশৃঙ্খলাকে নিয়মে আনতে একটি উদ্যোগ হতে পারে। তবে এটি বাস্তবায়িত হতে হবে। অনিয়মে অভ্যস্ত হতে হতে যাত্রীরা এখন ভুলতেই বসেছেন যে, রাজধানীতে সিএনজি অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাব ইত্যাদিতে মিটার নামে একটি ব্যবস্থা আছে। কেউ পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, ঢাকায় ট্যাক্সিক্যাব বলতে কোনো ব্যবস্থা আছে নাকি? ট্যাক্সিক্যাব নামকাওয়াস্তে আছে। অটোরিকশা প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও আছে এবং তাতে ন্যায্যমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্য পরিশোধ করেই তবে যাত্রীকে কোথাও যাওয়ার মাশুল গুনতে হয়। চালকরা বলেন, জমা ৭০০ টাকা, কম ভাড়ায় পোষায় না_ তাই তারা যথেচ্ছ ভাড়া আদায়ের লাইসেন্স পেয়ে গেছেন। অটোরিকশার মালিক বলেন, ২-৩ লাখ টাকার গাড়ি তারা ৮-৯ লাখে কিনেছিলেন অনেক বছর আগে, তাই জমা বেশি হওয়াই নিয়ম। এমনিভাবে এ-ওর ওপর দোষ চাপিয়ে এক অব্যবস্থাপনাই নিয়মে পরিণত করতে চলেছেন। যিনি সিএনজি অটোরিকশার দাম ৮-৯ লাখ টাকা করেছেন তিনি লাভের ভাগ আগেই খেয়ে বসে আছেন। তারপর রাস্তায় প্রতিদিনই খেসারত দিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা। অবস্থা দেখে মনে হয়, দেখার কেউ নেই, বলার কেউ নেই, প্রতিবিধান করারও কেউ নেই। এবারের বিজ্ঞপ্তির পর পরিস্থিতির কি উন্নতি হবে কেউ বলতে পারে না। কারণ, বিজ্ঞপ্তি তো ছাপা কাগজ, বিজ্ঞপ্তি বাস্তবায়ন করতে হলে ট্রাফিক পুলিশকে তৎপর হতে হবে। সিএনজি বেঁধে দেওয়া নিয়মে চলছে কি-না তা যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী না দেখে তবে স্বেচ্ছায় নিয়ম কে মানে এ দেশে? বিজ্ঞপ্তি তখন শুধু ছাপা কাগজ। অটোরিকশার মালিকরা জমা বেশি আদায় করছেন কি-না তা যদি না দেখা হয় তবে সিএনজিচালকরাও বিজ্ঞপ্তি মানতে চাইবেন না। ফলে ব্যবস্থাটা চালু করতে হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার বিকল্প নেই। কিন্তু সে সময় কি তাদের হবে? এই যানজট ও বিপুল ভিড় নিয়ন্ত্রণের পর সিএনজিগুলো মিটারে যাচ্ছে কি-না সে প্রশ্ন তাদের মনে উঠবে? নাকি আগের মতোই সিএনজি সিএনজির মতো, রাস্তা রাস্তার মতো, পুলিশ পুলিশের মতো চলতে থাকবে? যে বিপুল অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের জঞ্জাল আমরা তৈরি করেছি তা অপসারণের উদ্যোগ কোথাও থেকে শুরু হবে না তাহলে? কোনো একটা জায়গা থেকে কিন্তু শুরু হওয়া দরকার। বিআরটিএর বিজ্ঞপ্তিটি বাস্তবায়নের মাধ্যমেও সে সূচনা
হতে পারে।

Thursday, January 13, 2011

এখন প্রগাঢ় শীত পৃথিবীতে


photo : soulsshine
একদেশদর্শিতা বলে একটি চমৎকার শব্দ আছে বাংলায়। যেখানে আছি সেখানকার সময়, স্থান, মানুষ ও প্রকৃতিকেই সারা পৃথিবীর বাস্তবতা বলে ভাবা একদেশদর্শিতার একটা নমুনা। আমাদের জনপ্রিয় গানে আছে, দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও-দাও ফুর্তি করো। মস্ত বড় দুনিয়াটা কত মস্ত সে ধারণা আমাদের নেই। কখনও শুনি আধুনিক প্রযুক্তি দুনিয়াটাকে হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। কখনোবা শুনি দুনিয়াটা অধিকাংশ মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। সে যা-ই হোক, যখন শীতের কথা ওঠে তখন পৃথিবী বলতে আমরা হয়তো উত্তর গোলার্ধকেই বুঝি। পুরো উত্তর গোলার্ধজুড়ে তীব্র শীত এখন। ইউরোপ-আমেরিকা আমাদের কাছে মিয়ানমার, নেপাল, ভুটানের চেয়ে নিকটবর্তী। এমনকি দার্জিলিংয়ে বরফ পড়ল কি-না সে খবর জানার আগে আমরা জেনে ফেলি লন্ডন, নিউইয়র্কের কী হাল। কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধে যে এখন রীতিমতো বন্যা চলছে, শহর-জনপদ পানির নিচে তলিয়ে গেছে সে খবর কয়জন রাখে? গত বছর লন্ডনের এক পত্রিকা লিখেছিল, ইউরোপ নাকি বড় একটা ফ্রিজে পরিণত হয়ে গেছে। এবারও অবস্থা তথৈবচ। সবাই বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমন হচ্ছে। এক পত্রিকায় কার্টুন আঁকা হয়েছে, সেখানে দুই চরিত্র পরস্পরকে বলছে, যখন জলবায়ু পরিবর্তন দরকার তখন তো তার দেখা নেই। সাধারণ অর্থে জলবায়ু পরিবর্তন বলতে উষ্ণায়নই বোধহয় বোঝানো হয়। উষ্ণায়ন, মেরুর বরফ গলে যাওয়া আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি_ এই হলো জলবায়ু পরিবর্তনের সহজ হিসাব। কিন্তু এটি যে বরফও বাড়াতে পারে, শীতও তীব্র করে তুলতে পারে তা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্পষ্ট হচ্ছে। তবে শীতকালকে সবসময়ই একটা রহস্য-কৌতুকে ঠাসা ঋতু বলে মনে হয়। কাউকে জিজ্ঞেস করুন, ঢাকা শহরে এত শীত দেখেছেন কখনও? বলবে, না ভাই, এমন শীত তো দেখিনি। তবে বছর কয়েক আগে বোধহয় ছিল। কেউ বলবে, পড়েছিল একবার। গত বছরের আগের বছর। আবহাওয়া দফতরের নথি ছাড়া মানুষের স্মৃতির শীতকাল সর্বদাই তীব্র। হালকা শীতের কথা কারইবা মনে থাকে! দেশের অঞ্চল ভেদে শীতের প্রকোপ একেক রকম। কিন্তু ঢাকা শহরে শীত মানে হরেদরে তিন দিনের অতিথি। এলো আর গেল। একটু রয়েসয়ে বঙ্গবাজারে গিয়ে পছন্দসই সোয়েটার-শাল কেনার আগেই শীত হাওয়া। শীত হাওয়া মানে আরামও হাওয়া। নগরবাসী একবার ফ্যান চালু করলেই দিনে পাক্কা ৫ ঘণ্টার লোডশেডিং শুরু। এবার শীত বড় প্রসন্ন। এসে আর যাওয়ার নাম নেই। সরকারের উচিত, শীতের উদ্দেশে একটা নাগরিক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা। এমন হিম বাতাস, উত্তুরে হাওয়া, গরম কাপড় ব্যবহারের এমন চমৎকার সুযোগ সহজে আসে না। অবশ্য শীতের এই সুযোগ ব্যবহার করতে গিয়ে বস্ত্রবঞ্চিত মানুষের কথা ভুললে চলবে না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, \'কন্?কনে শীত তাই/চাই তার দস্তানা;/বাজার ঘুরিয়ে দেখে,/জিনিসটা সস্তা না।/কম দামে কিনে মোজা/বাড়ি ফিরে গেল সোজা,/ কিছুতে ঢোকে না হাতে,/তাই শেষে পস্তানা।\' দস্তানা কেনার কথা কি কবির এদেশেই মনে এসেছিল? হাতমোজা পরার মতো শীত এলেও দস্তানা কী কাজে লাগে? হয়তো ইউরোপের অভিজ্ঞতার কথাও কবির মনে থাকবে। কবি একবার ইউরোপের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন এভাবে_ \'দিনে দিনে শীত খুব ঘনিয়ে আসছে; লোকে বলছে, কাল-পরশুর মধ্যে হয়তো আমরা বরফ পড়া দেখতে পাব। তাপমান যন্ত্র ত্রিশ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে গেছে, সেই তো হচ্ছে ফ্রিজিং পয়েন্ট। অল্পস্বল্প ফ্রস্ট দেখা দিয়েছে। রাস্তার মাটি খুব শক্ত। কেননা তার মধ্যে যা জল ছিল সব জমাট হয়ে গেছে। রাস্তার মাঝে মাঝে কাঁচের টুকরোর মতো শিশির খুব শক্ত হয়ে জমেছে। দু\'এক জায়গায় ঘাসের মধ্যে কে যেন চুন ছড়িয়ে দিয়েছে, বরফের এই প্রথম সূত্রপাত। খুব শীত পড়েছে, এক এক সময়ে হাত-পা এমন ঠাণ্ডা জ্বালা করতে থাকে। সকালে লেপ থেকে বেরোতে ভাবনা হয়। আমাদের দেশি কাপড় দেখে রাস্তার একেকজন সত্যি সত্যি হেসে ওঠে, একেকজন এত আশ্চর্য হয়ে যায় যে, তাদের আর হাসার ক্ষমতা থাকে না। কত লোক হয়তো আমাদের জন্য গাড়িচাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। প্যারিসে আমাদের গাড়ির পেছনে পেছনে একদল ইস্কুলের ছোকরা চিৎকার করতে করতে ছুটেছিল, আমরা তাদের সেলাম করলেম। একেকজন আমাদের মুখের ওপর হেসে ওঠে, একেকজন চেঁচাতে থাকে, “Jack look at the blackies!”

শীত বিলাসী, উদাস, আরামপ্রিয়, এলিটদের ঋতু। গরিবের জন্য শীত যত কম পড়ে ততই ভালো। ফলে এবারের এইটুকু শীত সকলের আরামে ও নিরাপদে কাটুক। কামনা
আপাতত এইটুকুই।