Thursday, November 22, 2012

হিন্দু হৃদয় সম্রাট

বালাসাহেব কেশব ঠাকরে তার পুরো নাম হলেও গণমাধ্যমে তিনি বাল ঠাকরে নামেই পরিচিত। শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা ভারতীয় এই রাজনীতিকের মৃত্যু হলো ১৭ নভেম্বর। ভারতীয় গণমাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর শুধু গুরুত্ব সহকারে নয়, রীতিমতো আনুষ্ঠানিকতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গেই পরিবেশিত হচ্ছে। শিবসেনা ও বাল ঠাকরে সম্পর্কে যাদের ধারণা নেতিবাচক, তাদের কাছে ভারতীয় মিডিয়ার এই কভারেজ কিছুটা প্রশ্নের উদ্রেক করছে বটে। কিন্তু একই সঙ্গে মিডিয়া কেন; মতবাদ নির্বিশেষে গণমাধ্যমগুলো ধর্মীয় রাজনীতির এমন একজন নেতার প্রস্থানে সম্মিলিত শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শোক জ্ঞাপন করছে_ তা বোঝাও জরুরি। অনুসারীদের কাছে বাল ঠাকুরে 'হিন্দুদের হৃদয়সম্রাট' নামে আখ্যায়িত। ধর্মীয় রাজনীতিতে দীর্ঘকালীন নেতৃত্বদানের স্বীকৃতি হিসেবে এমন আখ্যা তার প্রাপ্য। পুরো ভারতেই তার অনুসারী তৈরি হয়েছে। এ অনুসারীরা ধর্মভিত্তিক ক্ষমতার দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পথ খুলে দিয়েছে বলে মনে করা হয়। ফলে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে তার ভূমিকা বিশাল। কিন্তু যদি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের কথা বলা হয়, তবে বাল ঠাকরে ছিলেন মহারাষ্ট্র ও মুম্বাইয়ের সম্রাট। তার অনুজ্ঞাতেই মুম্বাই ও মহারাষ্ট্র পরিচালিত হতো। একটি ভারতীয় পত্রিকা লিখেছে, বালাসাহেব ঠাকরেই ঠিক করে দিতেন_ অমিতাভ বচ্চনকে ফ্রেঞ্চ কাটে মানাবে কি-না, মণিরত্নমের বোম্বে সিনেমা মুক্তি পাবে কি-না। মুম্বাইয়ের ফিল্মি দুনিয়াকে তিনি কার্যত নিয়ন্ত্রণ করতেন তার মতাদর্শিত পাহারার মাধ্যমে। পান থেকে চুন খসলে শিবসেনারা মাঠে নেমে যেত। ফলে, তার নির্দেশ অমান্য করার সাধ্য কারও ছিল না। তবে, মুম্বাইয়ের ফিল্ম জগতের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ ছিল না। তিনি এ জগতের ভালো-মন্দ দেখভাল করতেন। আর বলিউডও তার পৌরোহিত্য মেনে নিয়েছিল এবং এতে অভ্যস্তও হয়ে উঠেছিল। তাই তার মৃত্যুতে বলিউডে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। পুরো মুম্বাই শহর ছুটি হয়ে গেছে হয় শিবসেনাদের ভয়ে, নয়তো আন্তরিক সমীহ প্রদর্শন করে। অমিতাভ বচ্চন ছিলেন তার মৃত্যুশয্যার পাশে। কেউ কেউ তাকে বলেন বলিউডের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। কেউ বলিউডের সঙ্গে তার সম্পর্ককে অম্ল-মধুর বলে আখ্যায়িত করেন। বলিউডের বড় স্টারদের সঙ্গে ভারতের বড় রাজনীতিকরা তার মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। এমন একজন রাজনীতিক বাল ঠাকরে, যার অনুসারীরা বল প্রয়োগ ও লাঠালাঠিতে বিশ্বাসী। প্রয়োজনে হিংসার রাজনীতি করতেও কুণ্ঠিত নয়। দাঙ্গা, হামলার বহু অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তার প্রতি এই শ্রদ্ধা কি শুধু ক্ষমতার প্রতি সমীহ প্রদর্শন করার জন্যই, নাকি রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশেই এমনটা বিধেয়? খোঁজ নিতে গেলে দেখা যাবে_ না, সবটাই ভয়, সমীহ বা ভান নয়। বিপুল ধর্মান্ধ ভক্তশ্রেণীর বাইরে অনেকে আন্তরিকভাবেই তাকে সম্মান জানাচ্ছেন। কেননা, বাল ঠাকরের রাজনীতির অভিমুখ শুধু ধর্মের দিকেই নয়। মহারাষ্ট্রে তিনি ভূমিপুত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নায়ক। মারাঠি ভাষা ও সংস্কৃতির রক্ষক। মহারাষ্ট্র থেকে বোম্বে প্রেসিডেন্সি আলাদা করার সিদ্ধান্ত যেমন তিনি রুখে দিয়েছিলেন, তেমনি মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকের সীমান্ত বিরোধে রীতিমতো লড়াই করেছিলেন। মুম্বাইয়ের কসমোপলিটন আবহে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এথনিক বা স্থানীয় মানুষের অধিকার। সাধারণত দেখা যায়, কসমোপলিটন শহর তার এথনিক বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে; স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে প্রান্তে ঠেলে দেয়। বাল ঠাকরে মুম্বাইয়ের ক্ষেত্রে এমনটি হতে দেননি। আর নিজেকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে। সব মিলিয়ে তিনি মারাঠিদের গোত্রপতি ও সম্রাটে পরিণত হয়েছিলেন। বাল ঠাকরে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন সাংবাদিক ও কার্টুনিস্ট হিসেবে। ফ্রি প্রেস জার্নাল ও টাইমস অব ইন্ডিয়ায় তার আঁকা কার্টুন প্রকাশ হতো। সে পেশা ছেড়ে রাজনীতিতে ঢুকলেও পরে সামানা ও দো পেহের কে সামানা নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। বাল ঠাকরের জন্ম ১৯২৬ সালের ২৩ জানুয়ারি। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি যুগের অবসান হলো। হয়তো শিবসেনার রাজনীতিও আর আগের মতো থাকবে না। কেননা, তার জীবিত অবস্থাতেই রাজনীতির উত্তরাধিকার নিয়ে পরিবারে বিবাদ লেগেছে। বিবাদ যে সামনে আরও বাড়বে_ তাতে সন্দেহ নেই।

Tuesday, November 13, 2012

রবীন্দ্রনাথ ও কারনাড

 
বাল্মিকী প্রতিভা নাটকে ইন্দিরা দেবী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৯ নভেম্বর ফেসবুকে সহসা এক ভারতীয় বন্ধুর স্টেটাস নজর কেড়ে নিল। তিনি গিরিশ কারনাডকে একহাত নিয়েছেন। তিনি যা লিখেছেন তার মর্মার্থ হলো, রবীন্দ্রনাথ দূরের কথা, গিরিশ কারনাড নাট্যকার হিসেবে আমাদের গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গেও তুলনীয় নন। তবে কি এবার রবীন্দ্রনাথ নিয়েই মন্তব্য করলেন কারনাড? উত্তর পেতে বেশি সময় লাগল না। ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় নজর বুলিয়েই বুঝলাম, একেবারে বাঙালির আঁতে ঘা দিয়ে বসেছেন কারনাড। খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সমালোচনা করেছেন। তাও আবার আক্রমণাত্মক ভাষায়। কিছুদিন আগে ভিএস নাইপলকে একহাত নিয়ে সাহিত্যসেবীদের নজর কেড়েছিলেন কন্নড় ভাষার এই নাট্যকার ও অভিনেতা। গিরিশ কারনাড ভারতের জ্ঞানপীঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত আলোচিত নাট্যকার। বাংলা ভাষায় বাদল সরকার যে থার্ড থিয়েটার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তারই সমান্তরালে কারনাডও তার ভাষায় নাটকের রীতি পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। নাট্যকার হিসেবে তিনি ভারতখ্যাত। আমাদের দেশেও কিছু পরিচিতি আছে তার। এর মধ্যে ভারতের একটি করপোরেট সংস্থা ভিএস নাইপলকে সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নিলে কারনাড নাইপল-বধে নামেন। বলাবাহুল্য, নাইপল বিশ্বখ্যাত ইসলামবিদ্বেষী, কিছুটা ভারতবিদ্বেষীও; যদিও পৈতৃক সূত্রে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত। ভারতের ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নিয়ে তিনি লিখেছেন। ভারতে এসে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে দহরম-মহরম করেছেন। নানাভাবে সাম্প্রদায়িকতায় উস্কানিও দিয়েছেন। এসব প্রসঙ্গ তুলে ধরে কারনাড বলেন, ভারত সম্পর্কে, ভারতে মুসলিম শাসকদের অবদান সম্পর্কে নাইপলের কোনো ধারণা নেই। তিনি সময়ের প্রতিভাবান একজন সাহিত্যিক সন্দেহ নেই, কিন্তু আত্মীয়তার সূত্রে তাকে পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল। নাইপলকে নিয়ে এ মন্তব্যের পর ভারতজুড়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। কারনাডকে অনেকে সমর্থন জানিয়েছেন, আবার ধুয়ে দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই। ওই তর্ক এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যেই কারনাড বলে বসলেন, 'রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাট্যকার। রবীন্দ্রনাথ প্রভাবসঞ্চারী চিন্তক। কিন্তু তার নাটকগুলো মাঝারি মানের।' যুক্তি হিসেবে কারনাড বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের নাটক ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে মেকি। আর সেগুলো তার সমকালে বা পরে মঞ্চায়িত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় সমালোচনার ঊর্ধে নন। কিছু ব্যতিক্রম বাদে রবীন্দ্র অনুরক্ত বাঙালি লেখক-পাঠকরা তা করেও থাকেন। অনেকেই বলেন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস এখন আবেদন হারিয়েছে। কালের গ্রাসে চলে গেছে তার অনেক গদ্য রচনাও। কিন্তু তার গান এখনও বাঙালির সার্বক্ষণিক সঙ্গী। রবীন্দ্রনাথের নাটকের কী অবস্থা তা নিয়েও আলোচনা চলতে পারে। যে উপন্যাস নিয়ে পাঠকের কিছুটা দ্বিধা সে উপন্যাসকেও তো আমরা চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ফিরে আসতে দেখছি। রাজা, রক্তকরবী, বিসর্জন, গান্ধারীর আবেদন তো অহরহই মঞ্চে আসছে। কেউ তো বাধ্য করছে না অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। দর্শকও দেখে আনন্দ পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও তার নাটক অভিনীত হচ্ছে। তবে নাটক অভিনীত হচ্ছে না সে কথা জোর গলায় কীভাবে বলা যায়? সমকালে ঠাকুরবাড়ির প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাটক অভিনীত হয়েছে। কিন্তু একটা কথা তো বলতেই হবে যে, রবীন্দ্রনাথ কখনোই মঞ্চ কাঁপানো নাট্যকার নন, বেস্টসেলিং ঔপন্যাসিকও নন। তার গুরুত্ব তার জায়গায়। আর যদি ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির কথায় আসি তবে তার নাটকগুলোর রূপক-সাংকেতিক আবহ কতটা ভাষার ভিন্নতা দাবি করে সে প্রশ্নও উঠবে। বরং ছোটগল্পগুলোতে চরিত্রগুলো কেন এক ভাষায় কথা বলে সে প্রশ্ন উঠতে পারে। রবীন্দ্রনাথের নাটক দৃশ্যমান জগতের অন্তরলোকের কথা বলেছে। তবে প্রযোজনার গুণে সে নাটকও ভিন্ন আবেদন তৈরি করতে পারে। বাদল সরকারের নির্দেশনায় রক্তকরবী কি বাজারে-মাঠে সহস্র দর্শককে আপ্লুত করেনি? তবু তর্ক চলতে পারে। কেউ যদি বলেন, রবীন্দ্রনাথের নাটকের আবেদন আর নেই তবে প্রতিবাদ করার কিছু নেই। তাই বলে দ্বিতীয় শ্রেণীর বা মাঝারি মানের সৃষ্টি বলা হবে? এটা কিন্তু আক্রমণই। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে আর যা-ই বলা হোক মাঝারি মানের বলা যায় না। সেগুলো রবীন্দ্রনাথের গুণেই একটি উচ্চতর মান অর্জন করেছে। তবে কথা বলে গিরিশ কারনাড একটা ধাক্কা দিয়েছেন। ধাক্কাটা খুব দরকার। চিন্তার জগতে এখন তো ধাক্কা দেওয়ার লোকও নেই তেমন। রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করায় ভারতের বাঙালিরা যেভাবে সোচ্চার হয়েছেন তাতে কিন্তু আশাও জাগে।

Mahbub Morshed

Sunday, November 4, 2012

লালন ফকিরের গান :: ইলিনা সেন

 Illustration: Mayanglambam Dinesh


ছোটবেলায় প্রতি বছর আমরা কলকাতার বাইরের বাংলায় যেতাম পরিবারের সঙ্গে মিলবার উদ্দেশে। তখন স্বজনদের বাড়িতে কিংবা যাওয়া-আসার পথে ট্রেনে ও বাসস্টপে ভ্রাম্যমাণ বাউলদের গান শুনে বাউল সঙ্গীত নিয়ে আমার ভাসাভাসা ধারণা হয়েছিল। বাউল ঐতিহ্য ও সঙ্গীতের পিতৃপুরুষ লালন ফকিরের অবদান অনেক পরে আমার কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। বীরভূমের মোহনীয় শীতে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, কেঁদুলীর মেলায় ঘুরতে ঘুরতে তরুণ হিসেবে বাংলা কবিতা ও গান সম্পর্কে আমার একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছিল। তখন ছত্তিশগড়ের খেটে খাওয়া মানুষের সান্নিধ্যে সম্ভবত আমি কিছুটা স্রোতের বাইরের জীবনযাপন করার চেষ্টা করছিলাম। সাধারণ মানুষের কাছে আমার প্রতিদিনের আনন্দ, দুঃখ ও নির্ভরতার শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলো লালনের ম্যাজিক। 'নবঅঞ্জর' সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ছত্তিশগড়ের ১৮৫৭ সালের বীর নায়ক বীর নারায়ণ সিংয়ের জীবন নিয়ে একটি নাটকের মহড়া করছিল। দীর্ঘ বিকেলগুলোতে ওই মহড়া দেখতে দেখতেই বাউল গান সম্পর্কে আমার ধারণা আরও উঁচুতে পৌঁছেছিল। সময় ও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলাম লালনের গানের পরতে পরতে মর্মার্থ লুকিয়ে আছে। জীবন ও সমাজকে বুঝতে ব্যক্তির নিজস্ব অভিযাত্রায় এ গানগুলো দরকারি ও সমৃদ্ধ দিশা হিসেবে উপস্থিত হতে পারে।
লালনের সবচেয়ে চেনা গানগুলোর মধ্য দিয়ে আমার ভ্রমণের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করতে চাই। কেঁদুলীর মেলার বাউল আখড়ায় প্রথম 'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে' গানটি শোনার পর আমার মধ্যে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আমি বুঝতে পারি- লালন বর্ণ ও ধর্মমতের বিভাজন অগ্রাহ্য করে মৌল মানব-অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। ছত্তিশগড়ের খনি শ্রমিকদের মধ্যে গড়ে ওঠা আন্দোলন দেখে আমি লালনের কথাগুলোর স্বতঃসিদ্ধভাবে তুলনা করতে পেরেছিলাম। আন্দোলনটি গড়ে তুলেছিলেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী। সেখানে বলা হতো, মানুষের মধ্যে দুটি গোষ্ঠী আছে- বাগওয়া গোষ্ঠী (মানুষখেকো বা শোষক) এবং মানখি, যারা মানুষের মতো মানবতার সঙ্গে বাস করে। কয়েক বছর পর আমি যখন ধর্মীয় ও সামাজিক কাঠামোর পিতৃতান্ত্রিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে জানলাম, বুঝতে পারলাম এগুলো কীভাবে নারীকে প্রান্তে ঠেলে দেয়, তখন লালনের গানের অননুকরণীয় সেই লাইনগুলো মনে পড়ল, 'সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারীর তবে কী বা বিধান।/বামুন চিনি পৈতার প্রমাণ/বামনী চিনবি কেমনে'। জেন্ডার পরিচয় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে লালনের অনুজ্ঞা যেমন তাত্ত্বিক, তেমনি বাস্তব। লালনের অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক চর্চায় জেন্ডার-সাম্য স্থাপন করার চেষ্টা করেন। আমার বন্ধু মিমলু সেন অবশ্য বাউলস্ফিয়ার বইয়ে দেখিয়েছেন, সেটা করা সব সময় সহজ নয়।
লালনের সুফি গানগুলো একইভাবে বহুস্তর অর্থ তৈরি করে। আঠারো শতকের বাংলায় তন্ত্র, বৈষ্ণব ও ইসলামী সংস্কৃতির মোহনায় বসে লালন এমন গান লিখেছেন ও গেয়েছেন- যা অনুধাবনযোগ্য এবং এর তাৎক্ষণিক সৌন্দর্য সাধারণ মানুষকে সম্পর্কিত করতে পারে। কবীর জন্মেছিলেন ভিন্ন সময়ে ও ভিন্ন স্থানে। কিন্তু তারই মতো লালনও হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বলে গণ্য হন। প্রিয় পরমাত্মার সন্ধানে লালনের খোঁজ কোনো দেখার অভিজ্ঞতা না দিয়ে তাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়- 'আমার বাড়ির পাশে আরশিনগর, যেথায় পড়শি বসত করে/আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।' কখনও সেই প্রিয় আবার লালনের মধ্যেই বাস করেন, তার ভাষাতেই কথা বলেন, তবু অনন্ত সন্ধান অব্যাহত থেকে যায়-  'কথা কয় রে দেখা দেয় না/নড়ে চড়ে বুকের ভিতর/তবু খুঁজে জনমভর মেলে না।'
মরমী সুফি অভিজ্ঞতা চেনা যায়, সেটি বুল্লে শাহ ও অন্য সন্তদের নিকটবর্তী। তার পরও ভিন্ন স্তরে মানবমনে অনেক স্তরের চেতনা জাগ্রত করে। এ গানগুলোকে মৌলিক মানব-অভিজ্ঞতার ইতিবাচক চিন্তার প্রেক্ষাপটে যেমন ব্যাখ্যা করা যায়, তেমনি ভগ্নমনস্কতার প্রকাশ বলেও চিহ্নিত করা চলে। লালন ব্যাখ্যার ভার শ্রোতার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন- এ কথা খুব বাঁধাগৎ হয়ে যায়। এগুলো যতদূর ও যতভাবে সম্ভব তার সঙ্গে আমাদের সংযোগ তৈরি করে।
আমি যতভাবে বলতে পারি তার চেয়ে বেশি প্রভাব লালনের- আমার ওপর। সম্ভবত তার কবিতার মতো একেও সময় ও স্থান থেকে আলগা করা যাবে না। আমি বলতে পারি, লালন আমাকে অবসম্ভাব্যতার বাইরে তাকানোর সাহস দিয়েছেন, পুরো অর্থহীন পরিস্থিতির মধ্যেও অর্থ ও কার্যকারণ খোঁজার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তার কবিতার সৌন্দর্য তীব্র নৈরাশ্যের মধ্যেও আশা জাগিয়ে রাখার শক্তি দিয়েছে।

ইলিনা সেন : ভারতীয় নারীবাদী তাত্ত্বিক ও মানবাধিকারকর্মী; মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক; অ্যাক্টিভিস্ট ড. বিনায়ক সেনের স্ত্রী। তেহেলকা পত্রিকায় চিন্তার উৎসব আয়োজনে তিনি লালনকে নিয়ে এ লেখাটি লিখেছেন। ভাষান্তর করেছেন মাহবুব মোর্শেদ।

Thursday, November 1, 2012

ঢিল ও পাটকেলের কথা



আমাদের লোককথায় আছে, ঢিলটি মারলে পাটকেল খেতে হয়। ইংরেজিতে বলা হয়, টিট ফর ট্যাট। অনেক আগে ঢিলটি মেরেছিলেন ভিএস নাইপল। এক ব্রিটিশ সাংবাদিক বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপলের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে সালমান রুশদি প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, 'আমি জানি না আপনি কার কথা বলছেন, তার সম্পর্কে আমি একদমই কিছু জানি না।' নাইপলের জন্ম ১৯৩২ সালে আর রুশদির ১৯৪৭-এ। লেখক হিসেবে দু'জনেই খ্যাতিমান। ফলে পরস্পরের সম্পর্কে না জানার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। আরও মজার ব্যাপার হলো, দু'জনেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে পরিচিত। নাইপলের পূর্বপুরুষ ভারত থেকে ত্রিনিদাদে অভিবাসী হয়েছিল। আর রুশদি তো ভারতীয় বংশোদ্ভূত বটেই। কাশ্মীরি মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। নাইপলের এই অবজ্ঞাসূচক উক্তির জন্য রুশদির মনে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ ছিল। জ্বলাপোড়াও যে ছিল না তা নয়। কিন্তু তিনি সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে নাইপলের ঢিলের বদলে একটি পাটকেল ছুড়েছেন। বইটির নাম জোসেফ অ্যান্টন : আ মেমোয়ার। বইটি আত্মজৈবনিক। বিতর্কিত বই 'স্যাটানিক ভার্সেস' লেখার পর রুশদির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়। আর তখন পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল তাকে। এমনকি নিজের নামে লিখতেও পারতেন না, লুকিয়ে থাকার জায়গা প্রকাশিত হয়ে পড়ে সে ভয়ে। এ সময় তিনি জোসেফ অ্যান্টন ছদ্মনামে লিখতেন। নামটি তিনি নিয়েছিলেন দুই প্রিয় লেখক জোসেফ কনরাড ও আন্তন চেকভের নাম থেকে। আর সেই পালিয়ে বেড়ানো জীবনের কথাই বইটিতে তিনি লিখেছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বইয়ে রবার্ট গোটলিয়েবের সঙ্গে কথোপকথনের বর্ণনা দিয়েছেন। গোটলিয়েব তখন আলফ্রেড এ নফ প্রকাশনীর প্রধান ছিলেন। আর এ প্রকাশনী থেকেই বেরিয়েছিল মিডনাইটস চিলড্রেনের যুক্তরাষ্ট্র সংস্করণ। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর গোটলিয়েব বলেছিলেন, রুশদির সঙ্গে দেখা করার জন্য তার তাড়া নেই। গোটলিয়েবের ভাষায়, 'আমি আপনাকে পছন্দ করি, আমি ভেবেছি আমি আপনার সঙ্গে দেখা করব না।'
রুশদি বলেন, 'কেন? আপনি আমাকে পছন্দ করেন না? আপনি আমার বই প্রকাশ করেছেন।' 'আপনার বইয়ের জন্য নয়, আমি সম্প্রতি মহান এক লেখকের মহৎ একটি সৃষ্টি পড়েছি। আমার মনে হয় কি জানেন, আমি বোধহয় মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এমন লেখককে কোনোদিনই পছন্দ করতে পারব না।' রুশদি বলেন, 'কী সেই মহৎ সৃষ্টি আর কে সেই মহান লেখক? গোটলিয়েব বলেন, 'বইটার নাম অ্যামাং দ্য বিলিভার্স আর লেখকের নাম ভিএস নাইপল।' রুশদি বলেন, 'তাই? বইটি পড়তে হবে তো।' রুশদির অবস্থান থেকে অ্যামাং দ্য বিলিভার্সের কথা না জানার কিছু নেই। কিন্তু যে ভঙ্গিতে নাইপল সম্পর্কে বলেছেন তাতে মনে হয় ঢিলের জবাবে পাটকেলটিই তিনি ছুড়তে চেয়েছেন। এখানে বলে রাখা দরকার, ভাবনা-চিন্তার দিক থেকে রুশদি ও নাইপলের ভীষণ মিল আছে। দু'জনেই মুসলিমদের কঠোর সমালোচক। অনেকের মতে মুসলিমবিদ্বেষী। অ্যামাং দ্য বিলিভার্সের বিষয় মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার উত্থান। ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ঘুরে তিনি এ বই লিখেছেন। শুধু এটাই নয়, ১৯৮১ সালে প্রকাশিত অ্যামাং দ্য বিলিভার্সের পর তিনি ১৯৯৮ সালে একই বিষয়ে তিনি লিখেছেন, বিয়ন্ড বিলিফ। বই দুটি মুসলিমবিদ্বেষের জন্য সমালোচিত হয়েছিল। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ বিয়ন্ড বিলিফকে আখ্যায়িত করেছিলেন একজন লেখকের মতাদর্শিক বিপর্যয় হিসেবে।
তবে নাইপলকে ফতোয়ার মুখে পড়তে হয়নি। ফতোয়ার মুখে পড়তে হয়েছে আহমেদ সালমান রুশদিকে। ধর্ম অবমাননার দায়ে তিনি যখন নাম-পরিচয় লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তখনও তাকে ধর্মের খোটা খেতে হচ্ছে। তারই প্রকাশক তাকে মুসলিম বলেই চিহ্নিত করছেন। তিনি নাইপলকে জবাবটা না দিলে এই তথ্যটা অজানাই থেকে যেত।