Saturday, May 14, 2011

বিন লাদেন : ক্রমশ বদলে যাওয়া গল্প






"We're an empire now, and when we act, we create our own reality. And while you're studying that reality—judiciously, as you will—we'll act again, creating other new realities, which you can study too, and that's how things will sort out. We're history's actors…and you, all of you, will be left to just study what we do."

Karl Christian Rove, Senior Advisor and Deputy Chief of Staff to former President George W. Bush, on October 17, 2004


জর্জ ডবলিউ বুশের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও ডেপুটি চিফ অব স্টাফ কার্ল রোভ ১৭ অক্টোবর ২০০৪ তারিখে ওপরের উক্তিটি করে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পুরনো সত্য বা বাস্তবতার ধারণা এখন অচল। পৃথিবী এখন নতুন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কার্ল রোভ বলেছিলেন, 'আমরা এখন এমপায়ার/সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে আমরা নিজস্ব সত্য/বাস্তবতা তৈরি করি। আপনারা সেই বাস্তবতাকে যাচাই করেন। আপনারা যাচাই করতে গেলে আমরা আবারও তৎপরতা চালাই, আরও নতুন সত্য/বাস্তবতা তৈরি করি। সেটাও আপনারা যাচাই করতে পারেন। এ প্রক্রিয়াতেই বিষয়গুলো আকার পায়। আমরাই ইতিহাসের কুশীলব। আপনারা_ আপনারা সবাই, আমরা যা করি তার পর্যবেক্ষক মাত্র।'

স্টিলথ চপারের ধ্বংসাবশেষ
কার্ল রোভের এই উক্তিটির কথা নতুন করে অনেকের মনে পড়েছে ২০১১'র মে'র প্রথম সপ্তাহজুড়ে বিন লাদেন হত্যাকাণ্ডের ক্রমপরিবর্তনশীল বিবরণের প্রেক্ষাপটে। পহেলা মে-তে [পাকিস্তান তখন ২ মে, রাত ১টা] পাকিস্তানের রাজধানী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গ্যারিসন শহর এবোটাবাদে যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেড টেরোরিস্ট ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের পর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে বিশেষ বাহিনী 'নেভি সিলস'-এর ৭৯ সৈন্যের একটি দল [Navy SEALs- Navy Sea, Air and Land, সাগর, আকাশ ও ভূমিতে সমান পারদর্শী সেনাদল] প্রথমে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে গিয়েছিল। পাকিস্তানের গাজি এয়ারবেস থেকে ৪টি হেলিকপ্টারে [প্রথমে বলা হয়েছিল দুটি বা তিনটি] করে উপস্থিত হয়েছিল ওসামা বিন লাদেনের বাড়িতে। প্রথমে বলা হয়েছিল হেলিকপ্টারগুলো ছিল এমএইচ-সিক্সটি। পরে ঘটনাস্থলে একটি হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা যায়, এই বিশেষ মিশনে স্টিলথ চপার নামে বিশেষ হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হয়। সম্ভবত বিশেষভাবে নির্মিত এই হেলিকপ্টারের কারণেই পাকিস্তানের রাডারকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়। এর আগে এই হেলিকপ্টার কোনো মিশনে ব্যবহৃত হয়নি এবং প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টারটি ব্যবহার করতে গিয়ে একটি বিপর্যয় ঘটে। স্থানীয় উচ্চতাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে একটি স্টিলথ চপারে আগুন ধরে যায়।
নেভি সিলস সদস্যরা ৪০ মিনিটের অভিযানে বিন লাদেনসহ ৫ জনকে হত্যা করে। বিন লাদেন ছাড়া অন্য মৃতদেহগুলো তারা এবোটাবাদের বাড়িতেই রেখে আসে। জানা যায়, মুসলিম রীতি মেনে জানাজা পড়ে বিন লাদেনের লাশ আরব সাগরে সমাহিত করা হয়। অভিযান শেষ হলে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হোয়াইট হাউসে সকণ্ঠে বিন লাদেনের মৃত্যুর প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ১১ সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ারে হামলাসহ ন্যক্কারজনক সব সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিটিকে হত্যার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার করা হলো। প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা পুরো বিশ্বকে নড়েচড়ে বসিয়ে দেয়। অভিযান চলেছিল যুক্তরাষ্ট্র সময় দুপুরে। প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন রাতে এবং রাতেই মার্কিন নাগরিকরা বেরিয়ে পড়ে উৎসব করতে। মূলত হোয়াইট হাউসের সামনে ও গ্রাউন্ড জিরোতে সমবেত হয়ে তারা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ড উদযাপন করতে থাকে। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমে বিন লাদেন হত্যার খবরটি নিয়ে খবর প্রকাশিত হতে থাকে। অভিযানের ৪০ মিনিটে কী ঘটেছিল তা নিয়ে শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। হোয়াইট হাউস ও মিডিয়ার প্রযোজনায় শুরু হয় একটি হত্যাকাণ্ডের গল্প রচনার প্রতিযোগিতা। ক্রমশ বদলে বদলে যেতে থাকে বিবরণ।

লাদেনের মিলিয়ন ডলার (?) মূল্যের বাড়ি
প্রথমে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানের এবোটাবাদে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও উচ্চবিত্তের মানুষদের জন্য নির্মিত অভিজাত আবাসিক এলাকায় মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি আলিশান বাড়িতে থাকতেন। মিডিয়া এখনও বাড়িটিতে বিন লাদেন কম্পাউন্ড বলছে। পরে জানা গেল, বাড়ির দাম মোটেও মিলিয়ন ডলার নয়। তবে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট ছিল। দুই স্তরের দেয়ালের মধ্যে কাঁটাতার ঘেরা তিনতলা বাড়িটি বিন লাদেনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এ বাড়িতে কোনো এসি ছিল না, টেলিফোন সংযোগ বা ইন্টারনেট ছিল না। উপরন্তু বাড়িটি মোটেও অভিজাত এলাকায় নয়। এবোটাবাদ অভিজাত শহর, কাকুল মিলিটারি একাডেমীসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনাও এ শহরে আছে। কিন্তু বিন লাদেনের বাড়ি শহরতলির প্রান্তে ক্ষেতখামারের মধ্যে ও নোংরা রাস্তার ধারে অবস্থিত। বাড়িটি আশপাশের বাড়িগুলোর থেকে বড়, অনেক জায়গা নিয়ে তৈরি হলেও এমন বাড়ি এবোটাবাদে অনেক আছে। হিমালয়ের পাদদেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নির্জনতায় বিন লাদেনের বার্তাবাহক বলে কথিত দুই পশতুন কাজিন এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন।
হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানেরও জিও টিভি ও যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিহতের একটি ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু হোয়াইট হাউস বলে, ছবিটি আসল নয়। এমনকি এনবিসিকে ছবি সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়। জানা যায়, ফটোশপের মাধ্যমে মৃত লাদেনের মাধ্যমে ছবিটি তৈরি করা হয়েছিল। জিও টিভিতে স্থানীয়ভাবে অ্যামেচার ক্যামেরায় তোলা একটি ভিডিও চিত্র সম্প্রচারিত হয়। তাতে বিন লাদেনের বাড়ির আশপাশে প্রচণ্ড অগ্ন্যুৎপাতের ছবি দেখা যায়। এতে অনেকে ধারণা করেন, আল কায়দা নেতাকে হত্যা করতে গিয়ে মার্কিনিরা প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। উভয় পক্ষে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু পরে জানা যায়, মার্কিন হেলিকপ্টার স্টিলথ চপার বিস্ফোরণের কারণেই মূল অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। ভবনের গেট বা দেয়াল ধসানোর জন্যও সৈন্যরা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। হেলিকপ্টারের অপারেশন বলে মিডিয়া প্রথমে ধারণা করেছিল, হেলিকপ্টার বিন লাদেনের বাড়ির ছাদে অবতরণ করেছিল এবং ছাদে নামতে গিয়েই প্রতিপক্ষের গুলিতে একটি হেলিকপ্টার খোয়া যায়। কিন্তু পরে জানা যায়, বিন লাদেনের বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গায় সৈন্যরা নেমেছিল। তারা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে বিন লাদেনের কক্ষে ঢুকেছিল।
হোয়াইট হাউস প্রথমে বলেছিল, বিন লাদেন ও তার সহযোগীরা সশস্ত্র ছিলেন। তারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি বিন লাদেন একজন নারীকে মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করে বাঁচতে চেষ্টা করেছেন। পরে বলা হয়, যে লোকটি একজন নারীকে মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন তিনি বিন লাদেন নন, তার একজন সহযোগী। পরে এই ঘটনাকে আরও পরিবর্তিত করে বলা হয়, আসলে লাদেনের বাড়িতে সৈন্যরা কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়েনি। একজন সহযোগী বাদে সবাই নিরস্ত্র ছিলেন সেখানে। মানববর্ম হিসেবে নারীকে ব্যবহারের কথা সম্ভবত নারী হত্যার দায় ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। এখন জানা যাচ্ছে, অপারেশনের পর থেকেই বিন লাদেনের শিশুপুত্র নিখোঁজ। কেউ কেউ এতে ধারণা করছেন, অভিযানে শিশু হত্যার ঘটনাও ঘটে থাকতে পারে। প্রথমে বলা হয়েছিল, বিন লাদেন সশস্ত্র ছিলেন। প্রতিরোধ করতে গিয়েই তিনি মারা পড়েছেন। পরে বলা হলো, বিন লাদেন নিরস্ত্র অবস্থায় ছিলেন। নিরস্ত্র অবস্থায় তাকে গুলি করা হয়। আরও পরে বলা হয়, বিন লাদেন গ্রেফতার হয়েছিলেন কিন্তু তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন ভেবে তাকে গুলি করা হয়। বিন লাদেনের মেয়ে পরে জানায়, তার বাবাকে গ্রেফতারকৃত অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযানে বাড়ির ২২ জন বাসিন্দার ৫ জন নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়েছে। বাকিদের পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ গ্রেফতার করে।

হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে ওবামা ও তার সহযোগীদের সেই বিখ্যাত ছবি

এবোটাবাদে 'অপারেশন জেরোনিমো' নামে যে অভিযান চলে তাতে বারাক ওবামা স্বাক্ষর করেছিলেন ২৯ এপ্রিল সকালবেলা। এতে বিন লাদেনকে হত্যার অধিকার সৈন্যদের দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তিনি নগ্ন না থাকলে তাকে হত্যা করতে। তবে গ্রেফতারের বিকল্পও ছিল। অভিযানের অনুমোদন থেকে বাস্তবায়নের শেষ সময় পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার সহযোগীরা মুখ খোলেননি। স্বাভাবিক কাজকর্ম করে গেছেন। ঘনিষ্ঠ মিত্রদেরও জানানো হয়নি। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষও কিছু জানত না। পাকিস্তানের কেউ অপারেশনে বাধা দিতে পারে বা অপারেশনকে ব্যর্থ করে দিতে পারে এই আশঙ্কায় তাদের জানানো হয়নি। পাকিস্তানে যখন ৪০ মিনিটের অভিযান চলে তখন ওবামা কী করছিলেন, এমন প্রশ্ন সাধারণত ওঠার কথা না। কিন্তু প্রশ্নটিকে উস্কে দেয় হোয়াইট হাউস। মৃতের ছবি প্রকাশ না করে হত্যাকাণ্ডের পরদিন হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে সিচুয়েশন রুমের একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। ক্লাসিফায়েড হিসেবে চিহ্নিত ছবিটি নানামুখী জল্পনার জন্ম দেয়। ছবির বিবরণে বলা হয়, হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে বসে প্রেসিডেন্ট ও তার সহযোগীরা অপারেশনের আপডেট জানছেন। কিন্তু ছবিতে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের মুখভঙ্গিতে মনে হয়, তারা সকলে মিলে উৎকণ্ঠিতভাবে কিছু দেখছেন। মূলধারার মিডিয়াগুলো ছবিটিকে ব্যাখ্যা করে বাড়তি খবর তৈরি না করলেও ছবির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে প্রেসিডেন্ট যে লাইভ লাদেন হত্যাকাণ্ড দেখছিলেন সে খবর কিছু মিডিয়া প্রচার করে। সিআইএ প্রধান লেওন পেনেট্টাকে উদ্ধৃত করে কিছু বিবরণও তারা যোগ করে। কীভাবে সৈন্যদের হেলমেটে থাকা ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও হেলিকপ্টারের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে গ্রহণ করে উপগ্রহের মাধ্যমে হোয়াইট হাউসে সম্প্রচারিত হতে পারে তার একটি কাল্পনিক চিত্রও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সিআইএ জানায়, সিচুয়েশন রুমে প্রেসিডেন্টকে সিআইএ সদর দফতর থেকে আপডেট জানানো হচ্ছিল। পরে আরও জানানো হয়, সিআইএ সদর দফতর ও অভিযানকালে সৈন্যদের থেকে হোয়াইট হাউস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। লাইভ ভিডিও দূরের কথা, ওসামার বাড়িতে তখন কী ঘটছিল তাও বোঝা যাচ্ছিল না। যতদূর বোঝা যাচ্ছে, সম্ভবত স্টিলথ চপার বিস্ফোরণের পর থেকে লাদেনের লাশ হেলিকপ্টারে তোলা পর্যন্ত হোয়াইট হাউস ও সৈন্যদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। তবে হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা জানান, এ সময় প্রতিটি মিনিট তাদের কাছে একেকটি দিনের সমান মনে হচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামাও একটি টিভি চ্যানেলকে জানিয়েছেন, তারা ওই সময় সৈন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। কিছুই জানতে পারছিলেন না। ওবামার কাছেও এই ৪০ মিনিটকে জীবনের দীর্ঘতম সময় বলে মনে হয়েছে। তবে যদি সত্যই হোয়াইট হাউসে সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমেই অপারেশন ঘটে থাকে এবং নিরস্ত্র লাদেনকে গ্রেফতারের পর হত্যা করা হয়ে থাকে তবে আরও বেশ কিছু প্রশ্ন ভবিষ্যতে উঠবে।
মৃত বিন লাদেনের প্রথম ভুল ছবিটি সম্প্রচারের পর হোয়াইট হাউস বলে তারা আসল ছবি প্রকাশ করবে। ছবি প্রকাশ করার একটি সম্ভাব্য দিনক্ষণও অনুমিত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সিদ্ধান্তে ঠিক হয়, হোয়াইট হাউস মৃত ওসামার কোনো ছবি প্রকাশ করবে না। কারণ মৃত বিন লাদেনের ছবি ইসলামিক জঙ্গিদের উস্কে দিতে পারে। তবে হোয়াইট হাউস শেষ পর্যন্ত জীবিত লাদেনের ভিডিও চিত্র প্রকাশ করে। বলা হয়, নেভি সিলস সদস্যরা ওসামার লাশ ছাড়াও এবোটাবাদের বাড়ি থেকে তার কম্পিউটার হার্ডড্রাইভসহ বেশ কিছু আলামত জব্দ করে। এই আলামতগুলোর মধ্যে ওসামার কিছু ভিডিও চিত্র ছিল। সেগুলোই প্রচার করা হয়। এই ভিডিও চিত্রগুলো নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। কেউ এগুলো দেখে মনে করেছেন ওসামা গৃহবন্দি ছিলেন। কেউবা বলেছেন, ওসামা এই বাড়ি থেকে আল কায়দা পরিচালনা করতেন। কেউবা বলেছেন, এই ভিডিওগুলোর কোনো বক্তব্য নেই। স্রেফ মনের খেয়ালে ওসামা ভিডিওগুলো রেকর্ড করেছিলেন।
এবোটাবাদের বাড়িতে ওসামা কতদিন ছিলেন? ন্যাটো বাহিনীর অভিযানে আফগানিস্তানের পতনের পর নানা স্থানে ঘুরে ওসামা আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে হরিপুর নামে একটি উপজাতীয় গ্রামে বিন লাদেন সপরিবারে আড়াই বছর ছিলেন। পাকিস্তানের ভূমিকম্পের সময় প্রচুর আহত মানুষকে সীমান্ত অঞ্চল থেকে এবোটাবাদে নিয়ে আসা হয়েছিল। সম্ভবত সেই দলের সঙ্গে ওসামাও এবোটাবাদে আসেন। ২০০৫ সালে তিনি এবোটাবাদের বিল্লাল টাউনে এসেছিলেন। তখন থেকে ২০১১'র পহেলা মে পর্যন্ত পশতুন ভাইদের বানানো বাড়িতেই ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল, ওসামার কবর যেন চরমপন্থিদের পবিত্র স্থানে পরিণত না হয় তাই লাশ সাগরে ফেলা হয়। কিন্তু এ বাড়িটি ইতিমধ্যে দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা শহরটিকে বিন লাদেন সিটি বলে ডাকতে শুরু করেছেন।

দর্শনীয়
লাদেন নিশ্চয়ই সন্ত্রাসবাদী ছিলেন, ভয়ঙ্কর অপরাধ করেছিলেন। বহু মানুষের প্রাণহানির জন্য দায়ী ছিলেন। শান্তির ধর্মকে কলঙ্কিত করেছেন। বিচারে হোক আর বিনাবিচারে হোক একটি মৃত্যুই তার প্রাপ্য ছিল। কিন্তু তার মৃত্যুকে ঘিরে যেভাবে একের পর এক মিথ্যা খবর ছড়ানো হয়েছে তাতে অনেক সন্দেহ-সংশয়ই ঘনীভূত হয়েছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য যে হত্যাকাণ্ড তাতে এমন সব বিবরণ কেন ঢুকল আগামী পৃথিবী তার উত্তর দেবে, নাকি একে আমেরিকার তৈরি নতুন বাস্তবতা হিসেবেই মেনে নেবে?

Tuesday, May 10, 2011

অসহনীয়!


রাধাচূড়া ও কৃষ্ণচূড়া। ছবি : নিয়াজ আহমেদ
টিএস এলিয়ট ওয়েস্টল্যান্ড কবিতায় লিখেছিলেন, 'এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ...' অর্থাৎ নিষ্ঠুরতম মাস এপ্রিল। পাশ্চাত্যে কতটা নিষ্ঠুর ছিল এপ্রিল এলিয়টের কালে তা নিশ্চয়ই আবহাওয়াবিশারদদের গবেষণার বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে যে এপ্রিল উষ্ণতম তা নির্ভাবনায় বলে দেওয়া যায়। শুধু এপ্রিল কেন, মে-ও কম উষ্ণ নয়। বাংলা মাসের হিসেবে বৈশাখ। বৈশাখ রুদ্র। কালবৈশাখীর জন্যই হয়তো বৈশাখের রুদ্রতা বিশেষ প্রচার পেয়েছে। কিন্তু অসহনীয় গরমের জন্যও কি বৈশাখের প্রচার হয়েছে? জীবনানন্দ দাশ কবিতার মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, একদিন এই পৃথিবীর রোদ ছিল আরও লাল। অতীতের কোনো পৃথিবীতে হয়তো রোদের রঙ লালই ছিল। এখন রোদের রঙ খানিকটা ফিকে হয়ে গেছে। রোদ লালিমা হারিয়েছে বটে কিন্তু বেড়েছে তার তীব্রতা, আঘাতের শক্তি। রোদের রশ্মিতে যুক্ত হয়েছে জানা-অজানা সব অতিবেগুনি উপাদান। রোদের রঙ বদলেছে, রূপ বদলেছে। আর পৃথিবীর উষ্ণায়নের সঙ্গে বেড়েছে গরম। বৈশাখে একটা স্বাভাবিক গরম বহু প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গদেশে পড়ে। শুধু বৈশাখ নয়, জ্যৈষ্ঠ এমনকি ভাদ্র মাসের গরমও বেশ বিখ্যাত। আর এ দেশের গরমের নিত্যসঙ্গী আর্দ্রতা। রোদের নিচে দাঁড়ালেই ঘেমে-নেয়ে ওঠে মানুষ। দেশে এখন রুদ্র বৈশাখের দাবদাহ চলছে। গরম অসহনীয় হয়ে উঠেছে। গরম বাড়লে শহরে আবশ্যিকভাবে দুটো দুর্বিপাক এসে হাজির হয়। আর্দ্রতা ও উষ্ণতার চেয়ে কম কিছু নয় তারা। প্রথমজন লোডশেডিং, দ্বিতীয়জন ট্রাফিক জ্যাম। গরমে এসি বেশি চলে, ফ্যান বেশি ঘোরে, বিদ্যুৎ ব্যবহার বেড়ে যায়। চাহিদার চেয়ে কম সরবরাহের বিদ্যুতে লোডশেডিংয়ের একটা যুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু ট্রাফিক জ্যাম? গরম বাড়লে কেন ট্রাফিক জ্যাম বাড়ে তা জানতে নিশ্চয়ই নগরবিশারদদের দ্বারস্থ হতে হবে। উষ্ণতা, আর্দ্রতা, লোডশেডিং, জ্যামের বাইরে গ্রীষ্মের আরেক রূপ আছে। শহরে, গ্রামে প্রচুর ফুল ফোটে। বিশেষ করে কৃষ্ণচূড়া। কৃষ্ণচূড়া ফোটার জন্য ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা লাগে। আর সে তাপমাত্রা বৈশাখে মিলে যায়। বাগানে লালের আগুন লেগে যায়। শহরের রাস্তায় কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি মোহময় এক আবহ তৈরি করে। শুধু কৃষ্ণচূড়া নয়, কনকচূড়া, জারুল, রাধাচূড়া, অলকানন্দা ফুল ফোটে এ সময়। তবে কৃষ্ণচূড়ার আধিপত্যই সর্বত্র বিস্তৃত। শহর সাজানোর জন্য কৃষ্ণচূড়ার বেশ কদর আছে কর্তাদের কাছে। বলা হয়ে থাকে, গাছটি নাকি টিকেই আছে নগর পরিকল্পনাকারীদের আতিথ্যে। এমনিতে বন্য অবস্থায় একে পাওয়া যায় না। কিন্তু শহর সাজাতে কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া, জারুল পরপর লাগানোর একটা রীতি নাগরিকরা রপ্ত করেছেন। কৃষ্ণচূড়া নামটি সহজবোধ্য। হিন্দিতে এ ফুলের নাম গুলমোহর। মানে ময়ূর ফুল। ময়ূরের পেখমের সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করতেই এ নাম। ভিয়েতনামে এর নাম ফুঙ ভি। মানে রূপকথার পাখি ফিনিক্সের লেজ। হিন্দি ভাষায় হলুদ কৃষ্ণচূড়াকেও বলা হয় গুলমোহর। আমাদের দেশে এ ফুলের নাম রাধাচূড়া। আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের পার্শ্ববর্তী রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া অনেকটা পরপর লাগানো। গরমের দিনে লোডশেডিং আর জ্যাম পেরিয়ে ঘামতে ঘামতে কেউ যদি সহসা এসব রাস্তায় পেঁৗছান তবে তার কাছে ফুলের সৌন্দর্য কি বার্তা বয়ে আনবে? তিনি কি বলবেন, সুন্দর। নাকি নিজের অজান্তেই গাছে ফোটা ফুলের অপূর্ব রূপ দেখে এই সৌন্দর্যকেও বলে বসবেন অসহনীয়?

Monday, May 9, 2011

রবীন্দ্র-পুরস্কার


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে বহুবর্ণিল আয়োজনে মেতেছে বাংলাদেশ। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আয়োজন চলছে। চলবে আরও কিছুকাল। অনুরাগীরা বলছেন, আয়োজন যেন সার্ধশতবর্ষ পালনেই থেমে না থাকে। রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবনের চেষ্টাটা যেন অনুষ্ঠান-আয়োজনের বাইরেও চলতে থাকে। বস্তুত, এই প্রত্যাশার মধ্যে ইতিবাচক দিক যেমন আছে তেমনি এর অন্তর্গত মৃদু পরিহাসও লক্ষ্য করার মতো। আমাদের গুণীরা বলেন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনের সর্বত্র। প্রশ্ন করেন রবীন্দ্রনাথ কোথায় নেই? সাহিত্যে, শিক্ষায়, জীবনে, রাজনীতিতে, সমাজে সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আমাদের পাথেয়। কিন্তু কেতাবের কথা বাদ দিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয়, রবীন্দ্রনাথ আসলে আমাদের জীবনে, জীবনাচারে, রাজনীতিতে, সমাজে কোথায় আছেন? তবে অনেকেরই মাথায় হাত পড়বে। অনেকেই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ও আদর্শ খুঁজতে রীতিমতো গবেষণা শুরু করবেন।
বস্তুত, আমাদের জীবনের বহিরঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আছেন বটে; কিন্তু অন্তরে রবীন্দ্রনাথ বোধহয় অনুপস্থিত। তার সাহিত্য অনুধাবনের চেষ্টা কতটা আমাদের পাঠকদের মধ্যে আছে, সে প্রশ্ন তুলে রেখে যদি এ প্রশ্ন করা যায়, তার মতো সাহিত্য সাধনা, পরিশ্রম, নিষ্ঠা কি আজকাল কোনো সাহিত্যিকের মধ্যে দেখা যায়? সাহিত্যিক হিসেবে তিনি অনন্য প্রতিভা নিশ্চয়ই কিন্তু কর্মোদ্যোগী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের যে শিক্ষা, সামাজিক উদ্যোগ তেমন উদ্যোগও কি আছে আমাদের সমাজে? রবীন্দ্রনাথকে, তার শুভ কাজকে অনুসরণের চেষ্টা যদি না থাকে, তাকে স্মরণ করে এত এত উৎসবের কী প্রয়োজন? কেউ বলবেন, উৎসবের নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে। নতুন প্রজন্মের কাছে তার নাম, গান, বাণীকে কিছুটা হলেও সঞ্চারিত করতে পারে এ উৎসবগুলো। সে নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু কতটুকু পারে? উৎসব শেষে প্যান্ডেল পড়ে থাকে, শামিয়ানার নিচে প্রচুর আবর্জনাও জমে। বক্তৃতা শেষ হলে তার অনুরণন রয়ে যায়। চারপাশে যত আয়োজন তার অধিকাংশই তো এভাবেই ফুরাবে। হয়তো কিছু বই, কিছু প্রকাশনা থাকবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রচনার চেয়ে শ্রেয়তর তো নয় সেসব। তবে? রবীন্দ্রনাথের রচনাকে মানুষের কাছে পেঁৗছানোর কোনো আয়োজন কিন্তু এবার এত ডামাডোলের মধ্যেও চোখে পড়ল না। রচনার কথা বাদ, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের বাইরে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখার মতো কিছু কি হলো? রবীন্দ্রনাথের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বাংলাদেশে। কোনো একাডেমী, ইনস্টিটিউট নেই, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এক বছরে কিছু গড়ে উঠল না। গড়ার উদ্যোগও এলো না। অন্যদিকে ভারতের দিকে তাকান। অনুষ্ঠান আয়োজনে ভারত আমাদের সঙ্গী। কলকাতা-দিলি্লতে নানা আয়োজন চলছে আমাদের মতোই। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও কাজের উত্তরাধিকার ভারতীয়রাও গভীরভাবে বহন করে। ইতিমধ্যে সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্র-রচনাবলি অনলাইনে প্রকাশ করে ভারত আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছে। এবার রবীন্দ্রনাথের ২০০০ ছবি অনলাইনে প্রকাশ করা হলো। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীকে নতুনভাবে বরাদ্দ দেওয়া হলো ৯৫ কোটি রুপি। ঘোষণা এসেছে শান্তিনিকেতনসহ রবীন্দ্রস্মৃতিগুলো আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সংরক্ষণেরও। আর আগামী বছর থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য এক ব্যক্তিকে রবীন্দ্র-পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বদৃষ্টিকে আবারও সবার সামনে তুলে ধরার এমন আয়োজন নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। দেশে যেমন, দেশের বাইরেও তেমন পুরস্কারের মর্যাদা রক্ষায় ভারতীয়রা বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। দলমতের বাইরে এসে দেশের ভেতরে গুণীজনদের পুরস্কৃত করার একটি শক্তিশালী ধারা তারা গড়ে তুলেছে। তাদের আয়োজনে রবীন্দ্র-পুরস্কার নিশ্চয়ই বিশেষ মর্যাদা পাবে। কীভাবে গুণীদের পুরস্কৃত করতে হয় তা নিশ্চয় আমরা তাদের কাছে শিখতে পারি। একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় শিখে নিতে হবে। সাময়িক আয়োজনে, তাৎক্ষণিক আবেগে না ভেসে কীভাবে একটি স্মরণ আয়োজনকে দীর্ঘস্থায়ী মাত্রা দেওয়া যায়, সে শিক্ষাও ভারতীয়দের কাছ থেকেই নিতে হবে।