Monday, August 30, 2010

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়


একুশ আগস্ট ভারতের রাজ্যসভায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস হলো। পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে উত্থাপিত একটি প্রস্তাব অনুসারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পুরো প্রজেক্টটি এক বিলিয়ন ডলারের। বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্তর্বর্তীকালীন গভর্নিং বডির প্রধান নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। রাজ্যসভায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের সভায় কংগ্রেস সদস্য করণ সিং ও সিপিএম সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির মধ্যে একটি কৌতূহলকর বিতর্ক হয়েছে। করণ সিং অধিবেশনে বখতিয়ার খিলজি যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিলেন সেটি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। তার কথার সূত্র ধরে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, 'ডক্টর সাহেব (করণ সিং) সত্যিই বলেছেন বখতিয়ার খিলজি ও তার সৈন্যরা নালন্দায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। কিন্তু জনাব, এটাই ইতিহাস : বর্বর যাযাবর ও উপজাতি যারা হুন নামে পরিচিত ছিল তাদের হাতে রোমান সাম্রাজ্যের বিলয় ঘটেছিল। কিন্তু ইতিহাসের সেই ভ্রান্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে সংশোধন করা যায় না।' এরপরই সীতারাম উল্লেখ করেন নেহরুর 'ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া'র কথা, যেখানে ভারতের ইতিহাসকে নেহরু উল্লেখ করেছেন পালিমপসেসট হিসেবে। এটা এমন এক স্মারক পাথর যা শাসকরা নতুন করে লেখায় এবং লেখানোর আগে আগের লিপি মুছে দেয়। নেহরু লিখেছিলেন, 'ভারত এক প্রাচীন পালিমপসেসট, যেখানে আদি ভাবনা ও স্বপ্নকল্পনা স্তরের পর স্তরে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো স্তরই আগের পুরো লিপিটিকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারেনি।'
সীতারাম মনে করিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় ইতিহাসের সেই পরম্পরার কথা, যা বিরামহীনভাবে সভ্যতার গতিকে ধরে রেখেছে। যেখানে দ্রাবিড় সভ্যতা থেকে শুরু করে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ঐতিহ্য এসে মিলেছে। তাই সীতারাম বলেন, 'এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আমি উচ্ছ্বসিত। ইতিহাসের ভুলগুলোকে শুদ্ধ করে দেওয়ার জন্য নয়, ইতিহাসে নালন্দার যে ঔজ্জ্বল্য ছিল তাকে পুনরুদ্ধার করার অভিপ্রায়েই। আমরা ইতিহাসে যে ভূমিকা রেখেছি তাকে অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে ভবিষ্যতে এগিয়ে দেওয়ার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়।... আমি মনে করি, এর মাধ্যমে আমরা মানবিক জ্ঞান ও সভ্যতার উচ্চতর স্তরে আরোহণ করতে যাচ্ছি।' তিনি মনে করিয়ে দেন স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ঘোষণার কথাও। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'আমি ওদের জন্য অন্তরের অন্তস্তল থেকে করুণা অনুভব করি, যারা নিজের ধর্মের স্বার্থের জন্য অন্যের ধর্ম ধ্বংস করার নীতিতে বিশ্বাস করে। চূড়ান্ত কথা এই, সব ধর্মের পতাকায় এই বাক্য লিখে রাখতে হবে যে, ধ্বংস নয়, ঐক্যই বাঞ্ছনীয়।' আবারও তিনি ফিরে যান নেহরুর কথায়, নেহরু এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, 'একটি বিশ্ববিদ্যালয় মানবতার স্বার্থে, সহনশীলতা, যুক্তি, আইডিয়ার সঞ্চারণ ও সত্যের অনুসন্ধানের জন্য তৈরি হয়। এটি মানব প্রজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আরও উচ্চতর লক্ষ্যে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য গঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় যদি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে জাতি ও জনগণের ভালো হয়।' সীতারাম বলেন, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও এ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হোক।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নালন্দা। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতেই যত প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নজির মিলেছে তার মধ্যে নালন্দা অন্যতম। ৪২৭ থেকে ১১৯৭ সাল পর্যন্ত এটি ভারতের অন্যতম বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে সক্রিয় ছিল। প্রাচীনকালে চীন, গ্রিস ও পারস্য থেকে বিদ্যার্থী ও বিদ্বানরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন। মৌর্য শাসক অশোক নালন্দা বেশ কিছু ভবন তৈরি করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে গুপ্ত ও পাল সম্রাটরাও এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনা থেকে প্রাচীন নালন্দার দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার এককালীন ঘনিষ্ঠ সংযোগের কারণেই হোক আর বুদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সংযোগের জন্যই হোক, বাংলাদেশের মানুষ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যকে ধারণ করে। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনরুত্থান আমাদের জন্যও একটি বড় খবর। এশিয়ার জাতিগুলোর এমন বৃহৎ উদ্যোগে আমাদের শুভ কামনা।

Tuesday, August 24, 2010

রূপা


আজ নিউ ইয়র্ক বা লন্ডনে যে নতুন বইটি ছাপা হলো, কাল তা বাংলাদেশে মিলতে পারে। মিলবে কি-না তা নির্ভর করে পাঠকের চাহিদা আর পাঠক রুচি সম্পর্কে বই বিক্রেতা এবং সরবরাহকারীদের ধারণার ওপর। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় বইগুলো সচরাচর না মিললেও জনপ্রিয় বইগুলো ঠিকই মিলে যায়। শুধু মেলে বললে ভুল হবে, যে বই ভালো বিকোয় তা রাতারাতি পাইরেটেড হয়ে হকারদের হাতে ফেরি হতে থাকে। ঢাকার বিখ্যাত জ্যামে আটকে পড়ে থাকা মানুষকে এ বইগুলো যে বেশ আকৃষ্ট করে তা বেশ বোঝা যায়। দুর্বল মলাটে, দুর্বল ছাপায় কম দামের এ বইগুলো লোকে কেনে এবং দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়। এ ছাড়া উপায়ও হয়তো পাঠকের সামনে নেই। র‌্যানডম হাউস থেকে প্রকাশিত অরুন্ধতী রায়ের একটি বইয়ের দাম হয়তো ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা। কিনতে হলে জ্যাম উজিয়ে দোকানে যেতে কত সমস্যা গুনতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। ঢাকার রাস্তায় সেখানে ২০০ টাকায় ওই বই হকার একেবারে চোখের সামনে নিয়ে দোলাচ্ছে। পাইরেসি বিষয়ে অতি সচেতন ব্যক্তিও লোভ সামলাতে হিমশিম খাবেন। সমস্যা শুধু প্রাপ্যতায় নয়, দামেও। ইউরোপ-আমেরিকায় যে বই যে দামে বিক্রি হয়, সে বই সে দামে বাংলাদেশের পাঠকরা কিনতে চাইবেন না, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ছোট বাজারের হিসাব বড় প্রকাশকদের মাথায় থাকে না। ফলে বিকল্প হয় পাইরেসি, নয়তো বেশি দাম। এজন্যই রূপা। ভারতীয় প্রকাশনা সংস্থা রূপার ইংরেজি বই বেশ জনপ্রিয় ছিল এক সময়, এখনও আছে। দেখা যেত, বিখ্যাত, প্রয়োজনীয় ও জনপ্রিয় ইংরেজি বইগুলোর ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করত রূপা। সে বই বাংলাদেশেও সুলভে বাজারজাত হতো। বাইরের বই প্রকাশে রূপা এখন তত তৎপর নয়, কিন্তু ভারতীয় বইগুলো সুলভে বাজারে আনার ক্ষেত্রে রূপা এখনও অদ্বিতীয়। যশোবন্ত সিংয়ের 'জিন্নাহ : ইন্ডিয়া-পার্টিশন-ইন্ডিপেন্ডেন্স' বইটির সহজলভ্যতা রূপার সেই ক্যারিশমার কথা মনে করিয়ে দিল সম্প্রতি। বাংলাদেশে পাঠকদের মধ্যে ইংরেজি বইয়ের চাহিদা আছে; কিন্তু প্রকাশক হাতেগোনা। আর সে প্রকাশকরা বেশি পাঠকের কাছে যাওয়ার পথে বাধা নিজেরাই বানিয়ে রাখেন অধিকাংশ সময়। দাম দেখে বোঝা যায় রূপার পথে যাত্রা করতে কেউ প্রস্তুত নন। অথচ রূপার স্বত্বাধিকারী বলেন, এখনও তাদের বইয়ের দাম ৫০ রুপি থেকে শুরু হয়। তাই অন্যদের প্রকাশ করা ইংরেজি বই যেখানে ৪-৫ হাজার কপি চলে, সেখানে রূপার বই ১ মিলিয়ন সহজেই বিক্রি হয়ে যায়।
রূপা এই আগস্টেই ৭৫ বছর পূর্ণ করতে চলেছে। বাংলাদেশের পাঠকরা জেনে খুশি হবেন, ভারত-বিখ্যাত এ প্রকাশনা সংস্থার শুরুতে বাঙালির বেশ যোগ ছিল। রূপার কর্ণধার দাউদয়াল মেহরার হোসিয়ারির দোকান ছিল কলকাতা নিউমার্কেটে। সেই দোকানের সাফল্য দেখে কলিন্স ডিকশনারির এজেন্ট তাকে ডিকশনারি বিক্রির জন্য হাত করেন। ডিকশনারি বেচতে বেচতেই তিনি ঢুকে যান বই-বাণিজ্যে। কলেজ স্ট্রিটে একটি দোকান নেন। সে দোকানের প্রথম ক্রেতা ফরিদপুরের সন্তান হুমায়ুন কবীর, ভারতের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও সাহিত্যিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রূপা কলকাতা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে এলাহাবাদ-বোম্বে হয়ে দিলি্লতে গিয়ে আখড়া গাড়ে। যুদ্ধের ভয়ে তখন অনেকেই ব্যবসা গুটিয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে রূপা। প্রথম দিকে বাংলা কবিতার বই করত। আর রূপার প্রথম বেস্ট সেলার হারমান হেসের 'সিদ্ধার্থ'। রূপার আত্মপ্রকাশের সঙ্গে আছে সত্যজিৎ রায়ের যোগ। বিখ্যাত এ শিল্পী ও চলচ্চিত্রকার তৈরি করে দিয়েছিলেন রূপার লোগো। এখনও এই লোগো ব্যবহার করে রূপা। রূপার কর্ণধার কপিশ মেহরা জানান, সত্যজিৎ এ কাজ করে সম্মানী বাবদ কিছু ভালো বই নিয়েছিলেন।
বোঝাই যাচ্ছে, রূপার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে, বাণিজ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে। সঙ্গে আছে পাঠক সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা। কপিশ মেহরা বলেন, 'পাঠক বই পড়ূক_ এভাবে আমরা বলি না, পাঠক যে বই পড়ে সে বই-ই আমরা প্রকাশ করি।' বইকে জনপ্রিয় করার জন্য ভারতজুড়ে ছোট-বড় বই মেলার আয়োজন করেন তারা। আর লেখকদের নিয়মিত সম্মানী দেন, প্রতি বছর লেখকদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থাও করেন।
আমাদের দেশে রূপা হয়নি, তামা, পিতল, কাঁসা যদি কিছু হতো তাহলেও গর্ব করা যেত।

Wednesday, August 4, 2010

নাওমি ও ব্লাড ডায়মন্ড


নাওমি ক্যাম্পবেলকে সবাই চেনেন। ব্রিটিশ সুপার মডেল নাওমি। লন্ডনে শপিং করা অবস্থায় তাকে আবিষ্কার করেন ফ্যাশন জগতের লোকেরা। আর শিগগিরই মিলান ও প্যারির ক্যাটওয়াকগুলোতে এবং বিখ্যাত সব ম্যাগাজিনের কভারে তার দেখা মিলতে থাকে। শুধু সুপার মডেল নয়, তাকে বিশ্বের এক নম্বর সুপার মডেল হিসেবেও গণ্য করা হতো। নানা আইনি জটিলতার জন্ম দিয়েও বিখ্যাত হয়েছেন তিনি। নাওমি আজ হাজিরা দিতে যাচ্ছেন হেগের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে। বিষয় গুরুতর। এ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে মিডিয়ায়। ঘটনা এত দূর গড়িয়েছে যে, আন্তর্জাতিক আদালত নাওমির ইচ্ছা অনুসারে ৩ তারিখে নির্দেশ দিয়েছে সুপার মডেলের ব্যক্তিগত বিষয়ের নিরাপত্তার জন্য কেউ ট্রাইব্যুনাল বিল্ডিংয়ে হাজির হওয়ার সময় বা সেখানে অবস্থান করার সময় তার ছবি তুলতে পারবে না। কোর্ট বলেছেন, নাওমি ক্যাম্পবেলের খ্যাতির কারণে তার প্রাইভেসি সংক্রান্ত বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে কোর্ট এই আদেশ জারি করেছেন। প্রশ্ন হলো, এই সুপার মডেলকে কেন কোর্টে হাজিরা দিতে হবে? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হলে চিনতে হবে চার্লস টেলরকে। জানতে হবে ব্লাড ডায়মন্ড কী জিনিস। লাইবেরিয়ার ২২তম প্রেসিডেন্ট চার্লস টেলর এখন আন্তর্জাতিক আদালতে বন্দি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যুদ্ধাপরাধের। সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের সময় তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা চলছে। টেলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধ চলার সময় তিনি বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন। আর এর বিনিময়ে তিনি তাদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন হীরা। যুদ্ধরত এলাকা থেকে বেআইনিভাবে যে হীরা উত্তোলন করে যুদ্ধ ব্যয়ের কাজে লাগানো হয়, তাকে সাধারণভাবে ব্লাড ডায়মন্ড বলা হয়। যুদ্ধ ও হীরার সম্পর্ক আফ্রিকায় খুব পরিচিত। এই হীরা কনফ্লিক্ট ডায়মন্ড, ওয়ার ডায়মন্ড, হট ডায়মন্ড হিসেবেও পরিচিত। এডওয়ার্ড জুয়িক ব্লাড ডায়মন্ড নামে একটি সিনেমাও তৈরি করেছেন হলিউডে। সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি এ ছবিটি পাঁচটি একাডেমী পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। ব্লাড ডায়মন্ড ও চার্লস টেলরের সঙ্গে নাওমি ক্যাম্পবেলের সম্পর্কের পেছনে আছে একটি সেলিব্রেটি ডিনার। ডিনারের হোস্ট ছিলেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। ঘটনা ১৯৯৭ সালের। ম্যান্ডেলার আমন্ত্রণে কেপটাউনে হাজির হয়েছিলেন মিয়া ফারো, কুইঙ্কি জোনস, চার্লস টেলর, নাওমি ক্যাম্পবেলসহ অনেক তারকা। সেখানে চার্লস টেলর নাওমির প্রতি আকৃষ্ট হন। ঘটনা এতদূর পর্যন্ত গড়ায় যে, সেই সন্ধ্যাতেই নাওমির দরজায় টেলরের করাঘাত পড়ে। তিনি নাওমিকে উপহার দেন এক বা একাধিক বড় হীরা। এই মূল্যবান উপহারে নাওমি কাত হয়ে যান। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে হাজির। এখন নাওমিকে কোর্টে হাজিরা দিয়ে বলতে হবে তিনি চার্লস টেলরের কাছ থেকে ব্লাড ডায়মন্ড নিয়েছিলেন কি-না। যদি প্রমাণিত হয় যে, নাওমি ক্যাম্পবেলের কাছ থেকে হীরা নিয়েছেন, তবে মারাত্মক ঘটনা ঘটবে। কেননা এ যাবৎ টেলর বলে এসেছেন, তার কাছে কোনো হীরা ছিল না। নাওমি স্বীকার করলে টেলর ফেঁসে যাবেন এবং এর ফলে আফ্রিকায় হীরার বিনিময়ে অস্ত্রের যে অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে তা প্রমাণিত হবে। ফলে ঘটনা এখন নাওমির দিকে তাকিয়ে আছে। নাওমি আজ কী বলেন তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। সুপার মডেল, গৃহযুদ্ধ, আফ্রিকা, একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট, ম্যান্ডেলার ডিনার পার্টি! ঘটনাটি হলিউডের যে কোনো সিনেমাকে হার মানাবার জন্য যথেষ্ট বটে।

Sunday, August 1, 2010

আগে যদি জানাই ছিল তবে...


গত কয়দিনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে গেল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর সাড়ে চার শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার পর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন। কেউ ফোড়ন কেটে বলবেন, রাস্তায় কেন নামবে শিক্ষার্থীরা? তাদের ক্যাম্পাসে নামতে পারে না? না নামতে পারে না, যে বিল্ডিংগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে আমরা চিনি সেখান থেকে নামলে সোজা রাস্তাই পড়ে। খুব কম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই ক্যাম্পাস আছে, যেখানে ছাত্ররা নামতে পারে। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তাতেই নেমেছে। রাস্তা বন্ধ হয়েছে, ভাংচুর হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছে। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নগরে বিক্ষোভ-মিছিল নিষিদ্ধ করেছে। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বেড়েছে তারা প্রতিবাদ করবে, রাস্তায় নামবে এটা স্বাভাবিক যুক্তি। আবার ঢাকার দুর্মূল্যের রাস্তা পথচারীদের জন্য খোলা রাখতে হবে সেটাও প্রত্যাশিত। কিন্তু যেটা প্রত্যাশিত নয় সেটি হলো, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর সরকারের অবস্থান। শিক্ষার্থীদের যখন রাস্তায় নামতে হলো, আর পুলিশকে যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হলো তার আগে-পরে ভাবনা-চিন্তার অবকাশ ছিল। ভ্যাট বসিয়েছে সরকার। কিন্তু বসিয়েই ক্ষান্ত থেকেছে। ভ্যাট কে দেবে তা স্পষ্ট করেনি। এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো সরকারের চেয়ে এককাঠি সরেস। ভ্যাট বসানোর পর তারা ধরেই নিয়েছেন, দেনেঅলাই দেবে। কে দেনেঅলা? শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ছাড়া আর কে? অতএব তারা আর স্পষ্ট করে জেনে নেওয়ারও দরকার বোধ করেননি যে কে ভ্যাট দেবে। ফলে শিক্ষার্থীরা সোজা রাস্তায় নেমে পড়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত নানা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অবশেষে পানি যখন অনেক গড়িয়েছে তখন সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা বিষয়টাকে স্পষ্ট করে বললেন। জানালেন, শিক্ষার্থীদের ভ্যাট দিতে হবে না। মন্ত্রীদের যখন বিষয়টা জানা, তখন যুক্তির খাতিরে বলতেই হয় কর্তাদেরও জানা ছিল। যদি জানাই ছিল তবে আগে কেন বলেননি? এ প্রশ্নও উঠবে এখন। সঠিকভাবে জানা থাকলে, প্রথমেই মিডিয়ায় জানানো যেত, নিদেনপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোকে বোঝানো যেত। যেদিন রাস্তায় প্রথম শিক্ষার্থীরা নামল তখনও বলা যেত। কিন্তু দেরিটা করা হলো কেন? এই অস্পষ্টতা কার স্বার্থে? মনে পড়ছে, হাসপাতালগুলোর রোগীদের ওপর ভ্যাট আরোপের কথা। ভ্যাট দেওয়ার কথা হাসপাতালের, কিন্তু হাসপাতালগুলো এতকাল রোগীদের কাছ থেকেই ভ্যাটের টাকা নিয়ে এসেছে। এ নিয়ে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে মামলাও চলেছে। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে রোগীরা ভ্যাটের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। সেদিক থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাগ্য যে কে ভ্যাট দেবে তা নিয়ে তাদের দীর্ঘকাল ধরে আদালতের বারান্দায় অপেক্ষা করতে হয়নি। বিচিত্র এই দেশ! ভ্যাট আরোপ হলো, সে ভ্যাট কে দেবে তাও স্পষ্ট করে বলা হলো না। ক্ষমতাধররা ক্ষমতাহীনের কাঁধে দায় চাপিয়ে ক্ষান্ত। কোথাওবা এ বলে তুমি দাও, ও বলে তুমি দাও। কিন্তু ভ্যাট আরোপের সময় একথা কি স্পষ্ট করে বলা যেত না এ না ও, কে আসলে ভ্যাট দেবে? নাকি এও এক জটিল অঙ্ক। যে অঙ্ক সঠিকভাবে কষতে পারবে ভ্যাট শেষ পর্যন্ত সে-ই দেবে?