Wednesday, May 5, 2010
জ্যোতি থেকে মমতায়
২০০০ সালের কথা। জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিচ্ছেন। দায়িত্ব নিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০০১ সালের নির্বাচন সামনে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, লাল দুর্গে পতন এবার আসন্ন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দায়িত্ব নিয়েছেন বটে, কিন্তু এ ক্ষণস্থায়ী, মন্তব্য করছিলেন কেউ কেউ। পশ্চিমবঙ্গে একটা রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটবার অপেক্ষায় অনেকে। তখন একটা বই বেরিয়েছিল বাংলায়, নাম জ্যোতি থেকে মমতায়। ইংরেজিতে সাবটাইটেল ছিল, ফ্রম এনলাইটমেন্ট টু ইমোশনাল বন্ডেজ। বইয়ের লেখক কলিম খান। পশ্চিমবঙ্গের লেখক। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেন। ভাবিয়ে দেওয়ার মতো নানা প্রবন্ধ লেখেন। তার এই আইডিয়াটা মনে ধরেছিল। পশ্চিমবঙ্গে শাসনভার জ্যোতি থেকে মমতায় যাচ্ছে এমন একটা আভাস নির্বাচনের আগে এভাবে দেওয়াটা অভিনব বটে। জ্যোতি বসু এনলাইটমেন্ট বা আলোকদীপ্তির সন্তান বটে। কলকাতা শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মনে উনিশ শতকে যে রেনেসাঁ ঘটেছিল, সেই রেনেসাঁর সন্তান জ্যোতি বসুর প্রজন্ম। সেদিক থেকে তিনি এনলাইটেন বটে, নামেও তাই। পশ্চিমবঙ্গে তার শাসনকাল, বিশেষত বামপন্থি শাসন এক প্রকার সামাজিক-অর্থনৈতিক এনলাইটমেন্ট ঘটিয়েছিল, সেও সত্য। কিন্তু বুদ্ধদেব? ভাবগত অর্থে জ্যোতি যা বুদ্ধও তাই। একদিন এক ক্ষ্যাপাটে জ্ঞানী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বলো তো, বুদ্ধ কী? আমি বললাম, বুদ্ধি হতে যদি বুদ্ধ হয় তবে বুদ্ধ ইনটেলেক্ট বা রিজন (জ্ঞান বা যুক্তি) ধারণকারী ব্যক্তি। তিনি বললেন, যার মধ্যে জ্ঞান বা রিজনের বসতি তিনি কে? আমি উত্তর না দিতে পেরে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বললেন, তিনি এনলাইটেন্ড ওয়ান। বুদ্ধ তিনি যিনি জ্যোতির্ময়। তাই ভাবগত অর্থে জ্যোতি ও বুদ্ধ এক ব্যাপার। এনলাইটমেন্ট, রেনেসাঁ, রিজন, ইনটেলেক্টও সমার্থক ধারণা। বাস্তবে জ্যোতি বসুর অনুসারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অনেকে বলবেন, একটু দুর্বল অনুসারী। কেউ বলবেন, জ্যোতির বদলে শুধু বিষয়-বুদ্ধি।
জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর এই কথাগুলো বিশেষভাবে মনে পড়ল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়। জ্যোতি বসুর শেষ যাত্রায় মমতা যাননি। বাংলাদেশের রাজনীতির যমজ ভাই যেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। এই রেষারেষি, খুনোখুনি দেখে তাই মনে হয়। কিন্তু মমতা কি আসলেই ইমোশনাল বন্ডেজ? নামে মমতা তিনি। কিন্তু জ্যোতি বসুর শেষ যাত্রায় যাওয়ার মতো মায়া-মমতা তার হৃদয়ে জন্মাল না দেখে নামটিকে কেউ কেউ অর্থহীন বলছেন। বলছেন, মমতাহীনা। জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা নাটক করেছেন। সোনিয়া গান্ধী যখন শোকবার্তায় জ্যোতি বসুকে কমরেড সম্বোধন করলেন, তখন নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেহারা বেশি রেড হয়ে গিয়েছিল। এত কিছুর পরও মমতা শেষ যাত্রায় যাননি।
জ্যোতি থেকে মমতায় কত সুন্দর আইডিয়া। দীপ্তি থেকে অনুভূতি। কিন্তু মায়া-মমতা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছে। প্রতিদিন খুনোখুনি, সংঘর্ষ। কংগ্রেস-তৃণমূল-সিপিএম লেগে আছে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে। আছে মাওবাদী, আছে স্বায়ত্তশাসিত নানা রাজ্যের বাদী। পশ্চিমবঙ্গ অগি্নগর্ভ। জ্যোতিবাবু সরে যাওয়ার পর আলো সরে গিয়ে আগুন লেগেছে। যুক্তি, বুদ্ধি, দীপ্তি কিছুই কাজ করছে না। সামনের নির্বাচনে বামপন্থিদের ভরাডুবি হবে বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু তাতে কি সমাধান আসবে? মমতা পশ্চিমবঙ্গে হাল ধরলে আবারও কি স্থিতিশীলতা প্রত্যাবর্তন করবে? উত্তর আপাতত জানা নেই।
কিন্তু একটি বিষয় সবার জানা। পশ্চিমবঙ্গের ভ্রাতৃঘাতী পরিস্থিতিতে মমতার খুব দরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়োজনীয় মমতা দিয়ে শান্তি ফেরাতে পারবেন কি-না কে জানে?
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment