Friday, December 21, 2012

গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্র :: মাহবুব মোর্শেদ


তেল ও জল যে কারণে মিশ খায় না, ঠিক একই কারণে গণতন্ত্রের সঙ্গে রাজতন্ত্রের মেলবন্ধন ঘটার কথা নয়শাসন-রীতি হিসেবে দুটি পরস্পরবিরোধীরাজা বা রানী থাকলে গণতন্ত্র থাকার কথা নয়আবার গণতন্ত্র থাকলে রাজা-রানী থাকার কথা নয়কিন্তু পৃথিবীর নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে এও এক বৈচিত্র্য যে, একই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রও মিলেমিশে পারস্পারিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই টিকে থাকতে পারেএমন বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবেকিন্তু এক্ষেত্রে ব্রিটেন বোধ হয় শ্রেষ্ঠ উদাহরণব্রিটিশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহুল প্রশংসিতবিশ্বব্যাপী একে আদর্শ ব্যবস্থা হিসেবেই দেখা হয়আর রাজতন্ত্রের বেলাতেও ব্রিটেন আদর্শএমন আড়ম্বড়পূর্ণ, বহুল আলোচিত রাজতন্ত্রও বোধ হয় পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ভারব্রিটিশরা বহু পূর্বে তেল ও জল আলাদা পাত্রে রাখার ব্যবস্থা করেছেরাজারটা রাজাকে, গণতন্ত্রেরটা মন্ত্রিসভাকে বিলি-ব্যবস্থা করে দিয়েছেশাসন, প্রশাসন ও পরিচালনার সঙ্গে রাজা-রানীর সম্পর্ক নেইসেসব কাজ করেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাইরাজতন্ত্রের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধরাজতন্ত্র আনুষ্ঠানিকতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও, আনুষ্ঠানিকতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেইরাজতন্ত্র ব্রিটিশদের কাছে চলমান রূপকথাগণতন্ত্রের সুখ ও স্থিতিকে রূপকথার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে তারারানীর সিংহাসনে আরোহণের ষাট বছর পূর্তি তারা এমনভাবে পালন করে যে, দুনিয়া পুরনো সাম্রাজ্যের স্মৃতি মনে করতে বাধ্য হয়আবার রাজপরিবারের ছেলেমেয়ের বিয়ে এমন ঘটা করে পালন করে যে, দুনিয়া রুদ্ধশ্বাসে তা দেখতে বাধ্য হয়প্রিন্স আর প্রিন্সেসদের নিয়ে মিডিয়া সবসময়ই সরগরমপ্রিন্সেস কেট সন্তানসম্ভবা হয়ে কিছুদিন আগেই মিডিয়াকে একদফা নাড়া দিয়েছেনবিষয় দেখে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের যেমন হলিউডের রূপকথার জগৎ, যুক্তরাজ্যের তেমনি রাজতন্ত্ররাজপরিবার একদা সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করত, এখন সে পরিবারের অনেক সদস্য জনগণের হৃদয়-সম্রাট হওয়ার সাধনায় রতপ্রিন্সেস ডায়ানার কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়তবে, হৃদয়-সম্রাট হয়েও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তাদের কখনও লিপ্ত হতে দেখা যায় নাকেননা, আনুষ্ঠানিক রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকতায় ক্ষমতা কম নয়ব্রিটেনে রানীর ভূমিকা আনুষ্ঠানিকরানী এলিজাবেথ কাগজে-কলমে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানশুধু ব্রিটেন নয়, সার্বভৌম ১৬টি রাজ্যের প্রধান তিনি৫৪ সদস্যবিশিষ্ট কমনওয়েলথ সংঘেরও প্রধান তিনিআর রানীই চার্চ অব ইংল্যান্ডের সুপ্রিম গভর্নর, বিশ্বাসের রক্ষকবলতে গেলে ধর্মীয় দিক থেকেও তিনি প্রধান ব্যক্তিএমন একজন ব্যক্তি আনুষ্ঠানিক দায়িত্বে থাকলেও শাসনকার্যে নাক গলাবেন না- তা কি হয়? আমাদের দেশে হয়তো হয় না, কিন্তু ব্রিটেনে হয়হয় বলেই, গণতন্ত্রের সঙ্গে  রাজতন্ত্রের মৌতাত চলছে প্রশুহীনভাবেরীতি অনুসারে রানী কখনোই মন্ত্রিসভার বৈঠকে যান নাএবার একটু ব্যতিত্রক্রম ঘটল১৭৮১ সালের পর প্রথম কোনো রাজা বা রানী মন্ত্রিসভার বৈঠকে গেলেনব্রিটেনে রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে একটা বৈপরীত্য আছেরাজতন্ত্র যেখানে আড়ম্বর আর আনুষ্ঠানিকতায় ভরা, গণতন্ত্র সেখানে ততটাই অনানুষ্ঠানিক আর সাধারণরানী মন্ত্রিসভায় গেলে কী ঘটে- সে দৃশ্যটা দেখার জন্যই টেলিগ্রাফ পত্রিকার অ্যালবাম দেখছিলাম১০ নম্বর ড্রাউনিং স্ট্রিটে কোনো সাজ সাজ রব নেইরানী এলিজাবেথ আসবেন, না হরিপদ কেরানী আসবেন, তা ১০ নম্বরের সাদামাটা দরজাটি দেখে বোঝার উপায় নেইএকান্তই রানী আসবেন, তাই খুঁজে পেতে একটা লালগালিচা বিছানো হয়েছেনীল পোশাকে সজ্জিত রানীকে ১০ নম্বরের গোড়ায় মাথা নুইয়ে স্বাগত জানালেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনভেতরে নিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে পরিচয় করালেনতারপর সোজা মন্ত্রিসভার বৈঠকসেখানে রানীর জন্য নেই কোনো সিংহাসন; চেয়ারে নেই আলাদা কোনো আড়ম্বরসবার চেয়ার সমানপ্রধানমন্ত্রীর চেয়ারও আর সবার মতোআর সে চেয়ার একদিকে আলাদা করে বসানোও নয়অল্প আলাপ-আলোচনার পর মন্ত্রীরা তাকে উপহার দিলেন, একসঙ্গে বসে ছবি তুললেনব্যসপররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ এবার রানীকে বিদায় জানাতে বেরুলেন ১০ নম্বর থেকেএত বছর পর রানী এলেন মন্ত্রিসভায়, কিন্তু কোনো আড়ম্বর ছাড়াই সব শেষ হয়ে গেলতারপরও গণমাধ্যম বলছে, রানীকে উষষ্ণ আতিথেয়তা দিয়েছে মন্ত্রিসভাউষষ্ণতা কি তাহলে তাদের হৃদয়ে ছিল? হতে পারেআমাদের দেশে এমন সাদামাটা দৃশ্যই রূপকথার মতো শোনায়সিংহাসন, আড়ম্বর, আনুষ্ঠানিকতা, হায়ারার্কি, প্রটোকলের এমন বাড়বাড়ন্ত এখানে যে, মনে হতে পারে রাজতন্ত্র আমাদের নেই বটে কিন্তু প্রকৃত রাজতন্ত্র দেখতে হলে ব্রিটেন নয়, আমাদের দেশেই আসতে হবে

Tuesday, December 18, 2012

হলুদ

পশ্চিমে হলুদ রঙকে কিছুটা নেতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়। হলুদ সেখানে বিবর্ণতার প্রতীক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিকর রঙ বলেও বিবেচিত। ইয়েলো জার্নালিজম কথাটির উদ্ভব পশ্চিমে। কেন খারাপ সাংবাদিকতাকে ইয়েলো জার্নালিজম বলা হয়? উত্তরে একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক বলেছিলেন, ইয়েলো জার্নালিজম ইয়েলো বলেই ইয়েলো। বোঝা যায়, এ রঙটার প্রতিই এক ধরনের বিরাগ আছে। পশ্চিমে কেউ হলুদ জামা পরে বেরোলে তাকে দর্শকদের কাছে ম্লান বলে মনে হতে পারে। রঙের যেমন দেশকাল আছে, তেমনি রাজনীতিও আছে। সংস্কৃতিভেদে রঙের প্রতি মানুষের সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও পার্থক্য আছে। আমাদের দেশে অপরাধী বা খারাপ লোকের কালো হাত ভেঙে দেওয়ার স্লোগান ওঠে সচরাচর। কালো অমঙ্গলের প্রতীক এখানে? কালো কীভাবে অমঙ্গলের প্রতীক হয়ে উঠল? এর পেছনে কোনো বর্ণবাদী ইতিহাস নেই তো? সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ব্র্যান্ড কালার লাল। লাল বিপ্লবের রঙ, তাই এসব দেশের পতাকায় লাল থাকবেই। যে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে লাল রঙের ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লালের দেখাদেখি ইসলামী বিপ্লবের দেখাও মিলেছে নানা দেশে। সেসব দেশে সবুজের ছড়াছড়ি। সবুজ হয়ে উঠেছে ইসলামী বিপ্লবের প্রতীক। ভারতীয় উপমহাদেশ ঐতিহ্যগতভাবেই রঙিন ভূখণ্ড। এখানকার প্রকৃতিতে হাজারো রঙের খেলা। ধারণা করা যায়, অতীতে এ দেশে কালো রঙ নেতিবাচক বলে বিবেচিত হতো না। সাদা, হলুদ, সবুজও নয়। যে হলুদ পাশ্চাত্যে নেতিবাচক রঙ বলে বিবেচিত, এ দেশে তা রীতিমতো উৎসবের প্রতীক। আমাদের দেশে বিয়ের আগে গায়ে হলুদ দেওয়ার রেওয়াজ। হলুদ এখানে জীবন ও উর্বরতারও প্রতীক। বিয়ে বা জন্মসংক্রান্ত নানা আচারে হলুদের ব্যবহার সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। শুধু বিয়েতেই নয়, নানা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে হলুদ রঙের ছড়াছড়ি পড়ে যায়। ফাল্গুনের প্রথম দিন মেয়েরা হলুদ শাড়ি পরে বের হয়। ছেলেরাও কম যায় না। কেউ হলুদ পোশাক পরে বেরোলে খুব উজ্জ্বল ও আনন্দিত মনে হয় তাকে। ফলে হলুদ এখানে ইতিবাচক সংকেতই দেয়। কিন্তু আমাদের প্রকৃতিতে হলুদ কোথায়? দিগন্তজোড়া সবুজ আমাদের আছে। ধানক্ষেত যখন পরিপকস্ফ হয়ে ওঠে, তখন হলুদাভ রঙ ধারণ করে বটে কিন্তু সে তো ধানগাছের জীবনের অন্তিম অবস্থাকেই নির্দেশ করে। বসন্তে গাছের পাতা হলুদ হয়ে ঝরে যায়। নতুন কচি পাতা জাগে। হলুদ ফুলও তো ফোটে কত গাছে। কিন্তু দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ কোথায় আমাদের দেশে? দিগন্ত বিস্তৃত শর্ষেক্ষেতের মাঠের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কি এ প্রশ্ন করা সম্ভব? শীতকাল এলে কি হলুদ রঙ না দেখে থাকা সম্ভব এই বাংলায়? শর্ষেক্ষেতে এখন ফুল ফোটার সময়। ফুল মানেই শুধু বর্ণ নয়, গন্ধেরও মৌতাত। মৌমাছি শর্ষে ফুল থেকে মধু নিয়ে মৌচাক ভরে ফেলে। আর বসন্তে সে মধুই হয়ে ওঠে মিষ্টি। মৌমাছি মধু নেয়, কিন্তু মানুষ কী নেয়? হলুদ শর্ষে ফুল উৎসবের বার্তা নিয়ে আসে। আর ক'দিন পরেই যে উৎসবে উৎসবে মেতে উঠবে সবাই সে কথাই হয়তো এ রঙ বলে যায়। অবশ্য শহরের জীবনে হলুদ কেন কোনো রঙই নেই। শহরে বসে বড়জোর চোখে শর্ষে ফুল দেখা সম্ভব। চোখে শর্ষে ফুল দেখলে কি বিভ্রম হয়? যদি না-ই হবে তবে এমন কথা কেন তৈরি হলো?

Wednesday, December 12, 2012

১২ ১২ ১২


কবি বলেছেন, নামে কী আসে যায়। গোলাপকে যে নামেই ডাকো, সে গোলাপই। সংখ্যার ব্যাপারেও হয়তো কবি বলতেন, সংখ্যাতেই বা কী আসে যায়। প্রতিটি দিনই সমান। প্রতিটি দিন সমান বললে তবু মন ভরছে না। কেননা, বিপুলা পৃথিবীর রহস্য অনন্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত গবেষণা যেমন এসব রহস্য ভেদ করতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তেমনি রহস্যাবৃত নানা পন্থাতেও লোকে রহস্যভেদের চেষ্টা করে চলেছে। গ্রহ-নক্ষত্র বিচার, রাশিফলের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জানার চেষ্টা চলছে সমানে। গ্রহ-নক্ষত্র, রাশির মতো সংখ্যাতত্ত্ব নিয়েও মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। সংখ্যাতত্ত্বের প্রতি মানুষের অদম্য আকর্ষণের একটা চেহারা দেখা যাচ্ছে ১২-১২-১২ নিয়ে উন্মাদনায়। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর তারিখটা সাজিয়ে ১২-১২-১২ লিখলে আকর্ষণীয় দেখায়। বিশেষ কোনো তারিখ মনে হতেই পারে। হিসাব অনুসারে এমন দিন এসেছিল ১৯১২ সালে। একশ বছর পর ২১১২ সালেও ফিরে আসবে এমন আরেকটি দিন। স্বাভাবিক নিয়মে এখন যারা বেঁচে আছেন, তারা ২১১২ সাল দেখে যেতে পারবেন না, যেমনভাবে ১৯১২ সালে বেঁচে থাকা কাউকে এখন খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। ১২-১২-১২ কি বিশেষ তারিখ? কী হয়েছিল ১৯১২ সালের ১২ ডিসেম্বর। ইন্টারনেট ঘেঁটে খুব আগ্রহী হওয়ার মতো ঘটনা জানা যাচ্ছে না। ১৯১২ সালের পৃথিবী আজকের মতো এতটা কাছাকাছি ছিল না। তথ্যপ্রযুক্তি না থাকার কারণে পৃথিবীতে কোথায় কী ঘটেছে, তা নিয়েও খুব বেশি তথ্য নেই। তবে এ দিনের বড় কোনো ঘটনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ নেই। আজ বড় কিছু ঘটবে কি? পৃথিবীব্যাপী অনেক জুটি
আজ বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হবে। ১২-১২-১২কে স্মরণীয় করে রাখবে ভালোবাসার বন্ধন। চিকিৎসকরা সন্তান প্রসব করানোর অনুরোধ পাচ্ছেন। সংখ্যা নিয়ে মানুষের মাতামাতিতে সংখ্যাতাত্তি্বকদের দ্বারস্থ
হওয়া ভালো। সন্তান জন্মদান নিয়ে সংখ্যাতাত্তি্বকদের মত হলো, ১২-১২-১২ খুব সৌভাগ্যের দিন। এ দিনে জন্ম নেওয়া শিশুদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এমনকি এ দিনটি নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্যও শুভ। একটি জরিপ অনুসারে, ৭৫ হাজার জুটি আজ বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে। এমনকি বিয়ে করা দম্পতিরাও এ দিনে নতুন করে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে শীতকাল এমনিতেই বিয়ের জন্য উপযুক্ত সময় বলে বিবেচিত হয়। ১২-১২-১২ ম্যাজিকে বিয়ের সংখ্যাটা বেড়ে যাবে, সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে দু'জন তারকার বিয়ে নিয়ে মিডিয়া সরগরম। একজন ক্রিকেটের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। আরেকজন জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী মোনালিসা। বিশেষ দিনে এই দুই বিয়েতে সবার শুভকামনা থাকবে। বিখ্যাত ভারতীয় সংখ্যাতাত্তি্বক ড. বিবেক চোপড়ার মতে, '১২-১২-১২ খুব তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ১২-১২-১২ বা ১২-১২-২০১২ যোগ করলে ৫ ও ৯_ এ দুটি সংখ্যা পাওয়া যায়। এ দুটো সংখ্যা মঙ্গল ও চাঁদের প্রতীক। আমরা যদি ১ ও ২কে যোগ করি, তাহলে ফল মিলবে ৩। এটি বৃহস্পতির প্রতীক। ৫, ৯, ৩_ তিনটি সংখ্যাই সৌহার্দ্যপূর্ণ ও শান্তিময় বিশ্বজগতের পক্ষে যুক্তি নির্দেশ করে।' মায়া ক্যালেন্ডার অনুসারে, ২০১২ সময়ের শেষ বিন্দু। এ বছরই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। ধ্বংসের দিনক্ষণ একটি হিসাবমতে ২১ ডিসেম্বর। সে দিক থেকে ১২-১২-১২ অশুভ সংখ্যা বলে অনেকের মত।
এ দিন নিয়ে দুঃসংবাদের ভবিষ্যদ্বাণী আরও আছে। অস্ট্রেলিয়ার জ্যোতিষী জেসিকা অ্যাডামস সংবাদ মাধ্যমকে বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছেন, ১২ ডিসেম্বর ইন্টারনেট ব্যবহার বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে। মিডিয়াতেও ঘটতে পারে অশুভ কোনো ঘটনা। তিনি অনলাইন ডাটার নিরাপদ ব্যাক-আপ তৈরির জন্যও পরামর্শ দিয়েছেন।
এসব বিষয়ে বিবেক চোপড়ার মত হলো, 'এই তারিখে পৃথিবী ধ্বংস হবে না। আমরা আনন্দিত চিত্তে ও নিরাপদে ২০১৩কে বরণ করে নিতে পারব।' কিন্তু কেন এ তারিখটির প্রতি মানুষের অসীম আগ্রহ? বিবেক চোপড়ার মতো অনেকের মতে, লোকে আসলে অনেক দিনের ভিড়ে মনে রাখার মতো একটা দিন চায়। স্মরণীয় একটা দিনের সঙ্গে নিজের জীবনের ঘটনাবলিকে মেলাতে চায়। ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সঙ্গে মানুষ জড়াতে পারে ভাগ্যচক্রে। ক্যালেন্ডারের বিশেষ একটি দিনের সঙ্গে জড়াতে ভাগ্যযোগ লাগে না। স্রেফ পরিকল্পনা থাকলেই চলে। সে কারণেই ১২-১২-১২ নিয়ে এমন উন্মাদনা। এ দিনটি বিশেষ কি-না, তা দিন ফুরালেই বোঝা যাবে। কিন্তু দিন ফুরাবার আগেই গণমাধ্যমের কল্যাণে দিনটি বিশেষ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ দিনটিকে ইতিমধ্যেই ঐতিহাসিক মর্যাদা দিয়ে ফেলেছে। ১২-১২-১২ নিয়ে মানুষের উন্মাদনা ও আগ্রহ স্পর্শ করেছে বিখ্যাত গায়কদেরও। তারা নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে একটি কনসার্টের আয়োজন করেছেন। গাইবেন বনজোভি, ডেভ গ্রোল, বিলি জোয়েল, এলিসিয়া কি'স, ক্রিস মার্টিন, ব্রুস স্প্রিংস্টিন, এডি ভেডার, রজার ওয়াটার্স, কেনি ওয়েস্ট, পল ম্যাককার্টনি। বিশাল আয়োজন নিঃসন্দেহে। এ আয়োজন থেকে পাওয়া অর্থ ব্যয় করা হবে হারিকেন স্যান্ডি-বিধ্বস্তদের সেবায়। মানুষের কল্যাণে মানুষের জন্য একটা উৎসব তৈরি হলো_ এও কি কম পাওয়া?

গ্রীষ্মের ছুটিতে, চাঁদে

বিপুলা পৃথিবীর অসীম রহস্যের অনেকটা এখনও মানুষের জানার বাইরে। গবেষণা, অভিযান, জানার জন্য নানা তৎপরতা চলছে সমানে। গহিন জঙ্গলে, পর্বতচূড়ায়, মাটির নিচে, সমুদ্রের গভীরে_ সর্বত্র বিস্তৃত এ তৎপরতা। অবশ্য ভূলোকেই সীমাবদ্ধ নয় আয়োজনগুলো, বিশ্ব ছেড়ে মহাবিশ্বের দিকে নজর পড়েছে বহুদিন হলো। আকাশ ছেদ করে মহাকাশের দিকে যাত্রা শুরুর পরও বহুদিন কেটে গেছে। মঙ্গলে নেমেছে কিউরিওসিটি। নিত্যনতুন খবর মিলছে সেখানকার। চাঁদে মানুষের পদচ্ছাপ পড়ার খবর পুরনো হতে হতে পাঠ্যবই থেকেও হারিয়ে গেছে। বলতে গেলে মহাকাশচারীদের কাছে চাঁদ এখন ডালভাত। সকাল-বিকেল চাঁদে যাওয়া-আসা চলছে যেন। চাঁদে যাওয়াটা এতটাই হালকা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় আয়োজনে নামি মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে চন্দ্রগমনেই আর সীমাবদ্ধ নেই ব্যাপারটি। চাঁদের রাস্তাও বেসরকারি খাতে যাওয়ার জোগাড়। বেসরকারি খাত মানেই উন্মুক্ত বাণিজ্য। দিব্যি প্রস্তাব চলে এসেছে, যে কেউ (টাকা থাকলে) চাঁদে পিকনিক করতে যেতে পারবেন। শহর থেকে বেরিয়ে কোনো পিকনিক স্পটে একদিনের বেড়িয়ে আসাটা আমাদের কাছে ডালভাত। কেউবা সপ্তাহ বা আরেকটু বেশি সময়ের জন্য পাহাড়ে, জঙ্গলে, নদী বা সমুদ্রেই চলে যান। আরেকটু বেশি আয়োজন হলে পাশের দেশগুলোতে ছোট সফর। যাদের সময়-সুযোগ বেশি তারা হয়তো আমাজনের গহিন জঙ্গলে, কেনিয়ার তৃণভূমিতেই গেলেন_ চাঁদের রাতে পিরানহা আর বৃহৎ সিংহের সঙ্গে রাত কাটালেন। তাই বলে চাঁদে? আমাদের দেশের লোকেরা অপেক্ষাকৃত ঘরকুনো। ঘর থেকে আঙিনা তাদের কাছে বিদেশ। কিন্তু পশ্চিমের লোকেরা তেমন নয়। তারা বহু অভিযান, আবিষ্কারের নেশায় কত দুর্গম অভিযান চালিয়েছে তার হিসাব নেই। দেখা যাবে, সেসব দেশের লোক দলে দলে চাঁদে যাচ্ছে। সামার ভ্যাকেশনে চাঁদ ভ্রমণ আইডিয়াটা মন্দ নয়। দেখাদেখি আমাদের দেশের কেউ কেউ যদি চাঁদে চলে যান তবে সেটা রীতিমতো একটা খবর হয়ে যাবে। কোনো ধনকুবের হয়তো সবার কাছে বিদায় নিয়ে, গুরুজনদের দোয়া নিয়ে চাঁদে চলে গেলেন। ফিরে আসার পর তার সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়া শুরু হলো। আহা রূপালি চাঁদ! পূর্ণিমার রাতে সে চাঁদের আলো যখন জলের ওপর এসে পড়ে, যখন মাঠের ভেতর এসে নামে তখন কত যে আলো ও ছায়ার খেলা তৈরি হয়! কত যে রহস্য রাতের আলো ও ছায়ায়! রহস্যের আধার সেই চাঁদ না জানি কত মোহনীয়, রমণীয়। চাঁদের আলো পড়লে ভাঙা ঘরেও কত সুখ আসে। স্বয়ং চাঁদ না জানি কত সুখের! সত্যিই কি তা-ই? চাঁদ তো খটখটে এক উপগ্রহ। হাঁটতে চাইলে উড়তে হবে। সেখানে না আছে পানি না আছে গাছ। সমুদ্র, নদী কিছুই নেই। অভিযাত্রী মানুষকে কে বোঝাবে পৃথিবী থেকেই চাঁদ সুন্দর। গবেষণার প্রয়োজনে চাঁদে যাওয়াটাই কর্তব্য। উপগ্রহটিকে তলিয়ে দেখা উচিত। কিন্তু ভ্রমণের আইডিয়াটা বোধ হয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। লোকে পকেটের টাকা গচ্চা দিয়ে খটখটে উপগ্রহ থেকে অযথা ঘুরে আসবে কেন? টাকা খরচ করার জায়গা না থাকলে ধনকুবেররা জনহিতকর কাজেই খরচ করুন না। আর অভিযানপ্রিয় হলে নাসার মতো প্রতিষ্ঠানেই যোগ দিয়ে ফেলা যায়। বেসরকারি খাতে চাঁদের রাস্তা ইজারা দিলে সাধারণ মানুষের মনেও যে চাঁদযাত্রার চাহিদা তৈরি হবে সেটি সামাল দেওয়া কিন্তু কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, চন্দ্র ভ্রমণ হবে সোনার ডিম পাড়া হাঁস হত্যা করে তার পেট থেকে ডিম বের করার সমান। রূপালি চাঁদ কতটা রূপালি সেটা বই পড়লেই জানা যায়। খরচাপাতি করে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনের কারণ কী?

Saturday, December 1, 2012

গুজরাল ডকট্রিন

ইন্দর কুমার গুজরাল, সংক্ষেপে আইকে গুজরাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সাকুল্যে এক বছরেরও কম সময়। ১৯৯৭ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ পর্যন্ত। ওই সময়কার ভারতের রাজনীতির অস্থির পরিস্থিতির কথা অনেকেরই মনে পড়বে। কংগ্রেসের একাধিপত্যের পর হঠাৎ শুরু হয়েছে পরিবর্তনের হাওয়া। বড় দলের জনপ্রিয়তা তছনছ করে রাজ্যে রাজ্যে গড়ে উঠেছে জনপ্রিয় সব আঞ্চলিক দল। জোট বা কোয়ালিশনের রাজনীতি সরগরম। এই জোটের নেতৃত্বে কখনও বড়, কখনও ছোট, কখনও মাঝারি দলের আধিপত্য ও প্রধানমন্ত্রিত্ব। বলা চলে, কোয়ালিশনের সরকারে হাত পাকিয়ে টালমাটাল পরিস্থিতি সামলে ১৯৯৮ সালে অবশেষে বিজেপির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আগমন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পিভি নরসিংহ রাও। তার পর এক মাসের জন্য গদিতে বসেছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। বাজপেয়ির পর বছরখানেকের জন্য গদিনসীন হয়েছিলেন এইচডি দেব গৌড়া। দেব গৌড়ার পর আইকে গুজরালের ক্ষণজন্মা শাসন। টলোমলো ওই শাসনকালে কোনো প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সুদূরপ্রসারী নীতি প্রণয়ন দূরের কথা, অমন নীতির কথা চিন্তা করাও কঠিন। অথচ নরসিংহ রাও, বাজপেয়ি, দেবগৌড়া, গুজরাল_ সবাই বেশ কিছু নতুন নীতির কথা ভেবেছিলেন। শুধু ভাবনা নয়, তারা সে প্রক্রিয়ায় কিছু এগিয়েছিলেনও। বাংলাদেশের কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছিল তা সম্ভব হয়েছিল এইচডি দেব গৌড়া সরকারের আমলে। অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকলে এমন চুক্তি সম্ভব ছিল কি-না সে আলোচনা আজও চলছে। প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়বে, ওই সময়েই ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তিও স্বাক্ষরিত হতে পেরেছিল। অনেকেরই মনে পড়বে, সে সময় জ্যোতি বসু ভারতরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পার্টির উল্টো সিদ্ধান্তের কারণে। ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণের প্রবক্তা হিসেবে পিভি নরসিংহ রাওয়ের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নীতির কথাও এখন সর্বজনস্বীকৃত। আর আইকে গুজরালের অবদানের কথা তো সর্বজনবিদিত। তিনি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন তা রীতিমতো গুজরাল ডকট্রিন বলে খ্যাত। আইকে গুজরালের জন্ম ১৯১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর, মৃত্যু ৩০ নভেম্বর ২০১২। গুজরাল পরিবার সাংস্কৃতিকভাবে খুব উজ্জ্বল। আইকে গুজরাল নিজে লেখক ও কবি। তার স্ত্রী শীলা গুজরাল পাঞ্জাবি ভাষার নামকরা কবি। খ্যাতনামা চিত্রকর সতীশ গুজরাল তার ভাই। গুজরাল পরিবারের জামাই অনুপ জালোটা। রাজনীতি ও শিল্পকলা গুজরাল পরিবারের হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে সবসময়। তবে সবকিছুর ওপর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আইকে গুজরালকে আমাদের বিশেষভাবে স্মরণ করতে হবে তার নীতির কারণে।
কী ছিল গুজরাল ডকট্রিনে? নিকটবর্তী প্রতিবেশীদের ব্যাপারে ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি কী হওয়া উচিত তা গুজরাল পাঁচটি পয়েন্টে ব্যক্ত করেছিলেন। রাষ্ট্র হিসেবে ভারত যেহেতু তার প্রতিবেশীদের থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হতে পারবে না, তাই বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক সম্পর্ক নির্মাণের দিকেই তাকে এগোতে হবে।
১.সার্কভুক্ত দেশগুলোর মতো প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত পারস্পরিক সহযোগিতা আশা করবে না। ভারত থাকবে উদার ভূমিকায়। প্রতিবেশীরা যা দেবে তা বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে গ্রহণ করবে।
২.কোনো দক্ষিণ এশীয় দেশই নিজের ভূমিকে অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে দেবে না।
৩.কোনো রাষ্ট্রই অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
৪.দক্ষিণ এশীয় প্রতিটি রাষ্ট্রই পরস্পরের ভৌগোলিক ও আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।
৫.দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো যে কোনো বিবাদ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধা করবে।
বলাবাহুল্য, গুজরাল ডকট্রিন ভারতে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত এ নীতি অনুসৃতও হয়নি। ফলে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের সম্পর্ক এখনও অটুট। চারদিকের প্রতিবেশীদের নিয়ে ভারতও যে খুব সুখে আছে তা নয়। অথচ কে অস্বীকার করবে, শান্তিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া প্রতিষ্ঠা করতে গুজরাল ডকট্রিনের বিকল্প আসলেই নেই?