Sunday, February 26, 2012

বই বাছাই

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে প্রত্যাশিত পাঠক সমাজ গড়ে ওঠেনি। এই তথ্যে হতাশা ও আশাবাদ দুই-ই আছে। প্রতি ফেব্রুয়ারির বইমেলায় গত কয়েক বছর ধরে তিন হাজারেরও বেশি বই প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশকরা পয়সা খরচ করে বই প্রকাশ করছেন, স্টল নিয়ে বসছেন, পাঠকরা মেলায় আসছেন, বছরভর বিপণনের নানা কসরত চলছে। পাঠক যদি না-ই থাকে তবে এত এত বই প্রকাশিত হচ্ছে কেন? তার চেয়ে বড় কথা, এ দেশে অন্তত ৫ থেকে ১০ জন লেখক আছেন যাদের বই ৫ হাজার কপির ওপরে চলে। একজন লেখকের বই নিশ্চিতভাবেই ৩০ থেকে ৫০ হাজার কপি চলে। পাঠক সমাজ গড়ে ওঠেনি, এমন কথার তাহলে ভিত্তি কোথায়? যে বইগুলোর পসার ভালো_ তালিকা করলে দেখা যাবে তাদের সংখ্যা ২৫টির বেশি হবে না। অথচ বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার বই। বিপুলসংখ্যক বইয়ের মধ্যে অনেকগুলোই হয়তো প্রকাশিত হওয়ার যোগ্য নয়, পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতোও নয়। কিন্তু ঝাড়াই-বাছাই করে মেলায় কি শ'খানেক বইও মিলবে না, যেগুলো পাঠকের মনোযোগ পেতে পারে। সকলেই স্বীকার করবেন, পাঠক-নন্দিত বইগুলোর বাইরে অন্তত শ'খানেক, এমনকি তারও বেশি বই পাঠকের দৃষ্টিতে পড়তেই পারত। জনপ্রিয় উপন্যাসের বাইরেও ভালো উপন্যাস প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকার, অনুবাদ, ভ্রমণ, জার্নাল, গল্প, কবিতাও প্রকাশিত হয় এন্তার। অনেক প্রকাশক গুরুত্ব দিয়ে বিদগ্ধ চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রকাশকদের সূত্রে জানা যায়, আগে চিন্তাশীল বইগুলো নিশ্চিন্তে এক হাজার কপি বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু এখন এসব বইয়ের গড় বিক্রি নেমে এসেছে তিনশ'-পাঁচশ' কপির কোটায়। বাজারের পরিস্থিতি বলে, কিছু উপন্যাসের পাঠক বাড়লেও গড়ে পাঠক কমেছে। জনসংখ্যা বেড়েছে, সাক্ষরতা বেড়েছে, উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে, সংবাদপত্রের পাঠক বেড়েছে_ সংখ্যাতত্ত্ব অনুসারে কিন্তু পাঠকও বাড়ার কথা। যে ধরনের বই আগে ২০ হাজার কপি চলত সে বই এখন ৫০ হাজার চলার কথা। আর যে বই এক হাজার কপি চলত তা এখন অন্তত দেড় হাজার তো চলবে? কিন্তু সংখ্যাটা ৫শ'তে নেমে আসবে কেন? ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিকাশ ঘটেছে, ইন্টারনেট মাধ্যম এগিয়ে এসেছে_ নগরজীবনে বইয়ের গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে, সবই সত্য। তবু বিদ্বৎসমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হওয়ার পরও একটি বইয়ের বিক্রি ৫শ'তে এসে ঠেকে যাবে, এ যেন অবিশ্বাস্য এক হিসাব। কিন্তু ঘটছে বাস্তবে তা-ই। কেন এমন ঘটল? বইয়ের প্রচারে কিন্তু কমতি নেই। সারাবছর বই নিয়ে প্রায় নিশ্চুপ থাকলেও গণমাধ্যমগুলো কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে বেশ সরব। প্রায় সব টিভিই বইমেলা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করে। লেখকদের সাক্ষাৎকার নেয়। বইয়ের প্রচ্ছদ দেখায়। দৈনিকগুলোতে বিশেষ কর্নারে বইয়ের মেলা ও বইয়ের খবর প্রচারিত হয়। তবু বইয়ের বিক্রি বাড়ছে না। কেন? একজন বললেন, টিভিগুলো বইমেলা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করে বটে। কিন্তু সেগুলো দেখে কি বোঝায় উপায় আছে কোন বইটি কিনব? জনপ্রিয় বইগুলোর কথা সবাই জানে। কিন্তু অন্য বইগুলোর মধ্যে কোনটা ভালো, কোনটা দরকারি তা বোঝার উপায় কি সত্যিই টিভির অনুষ্ঠানগুলোতে থাকে? বই কি লোকে প্রচ্ছদ দেখে কেনে? নাকি লেখকের চেহারা দেখে কেনে? অধিকাংশ টিভি অনুষ্ঠানই কিন্তু ভালো বইগুলোকে সামনে আনতে পারে না। অথবা ভালো বই বাছার কোনো ব্যবস্থাই তাদের নেই। এমনকি সংবাদপত্রগুলোতেও ভালো বই, ভালো লেখকদের বই বাছাই করে তার খবরের ব্যবস্থা কমই থাকে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বই চেনার জন্য গণমাধ্যমের উদ্যোগ তেমন কাজে আসে না। মেলায় গিয়ে একজন সাধারণ পাঠক ৩ হাজার বইয়ের সমুদ্রে পড়ে যান। নিরুপায় হয়ে তিনি হয়তো নাম জানা কয়েকজন লেখকের বই কিনে ফেরেন। কিন্তু গণমাধ্যম যদি দায়িত্ব নিত তবে হয়তো পাঠক হাজার হাজার বইয়ের বদলে একশ' ভালো বইয়ের ভেতর থেকে তার দরকারি বইটা বেছে নিতে পারতেন। মেলার পর ভালো ২৫টা বই খুঁজে পাওয়া ভার, কিন্তু মেলার মধ্যে একশ' বই বাছাই করাও অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু কঠিন কাজটার দায়িত্ব মিডিয়াগুলোকে তো নিতেই হবে। মিডিয়া না চেনালে মানুষ চিনবে কীভাবে আর পাঠকই-বা বাড়বে কীভাবে?

পাকিস্তানে এক চাকমা রাজা ::: নিরুপমা সুব্রামানিয়ান



কার্যত তিনি পাকিস্তানের এখনকার প্রজন্মের কাছে অচেনা, আর যাদের মনে থাকার কথা সেই পুরনো লোকদের কাছেও তার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের আবির্ভাবের পর, ১৯৭১ সালের পর রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের কাছে বিশেষ একজন ব্যক্তি ছিলেন বটে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের বংশানুক্রমিক প্রধান ছিলেন ত্রিদিব। ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের দুই সাংসদের মধ্যে একজন, যারা নতুন দেশটিকে অস্বীকার করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। দু'জনের অপরজন নূরুল আমীন।
পাকিস্তানে ১৬ ডিসেম্বরকে স্মরণ করা হয় 'ঢাকার পতন' হিসেবে। এ রকম এক অনুষ্ঠানে ইসলামাবাদে রাজা ত্রিদিব রায় দ্য হিন্দুকে বলেছেন, জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তার কোনো অনুতাপ নেই, বাংলাদেশ এখনও তার জনগণের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করে যাচ্ছে।
পাকিস্তানের রাজধানীতে রায় সাহেবের বাড়ির গেটে ছোট একটি অস্পষ্ট ফলকে লেখা আছে 'চাকমা হাউস'। পত্রপল্লবে ছাওয়া ই-৭ সেক্টরে এই বাড়ি। বংশের পরিচয়সূচক ঢাল এখন সময়ের ফেরে ম্লান। ভেতরে থাকার ঘরে আসবাব সাধারণ। ঘরের দেয়ালে অল্প কিছু ছবি টাঙানো। এর মধ্যে দুটি বাঙালি শিল্পীর আঁকা। তাতে তারিখ দেওয়া নভেম্বর, ১৯৭১। ছবিতে চিত্রায়িত হয়েছে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের কর্মবিমুখ গ্রাম-জীবনের ছবি।
ত্রিদিব রায় বললেন, '১৯৭১ সালে বিদ্রোহীদের সমর্থন না দিয়ে পাকিস্তানিদের সমর্থন দেওয়ার পেছনে আমার সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ বাঙালি নয়। কিন্তু তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সরকার ওই অঞ্চল ও আদিবাসী জনগণকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছিল।'
তিনি বললেন, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছিল, তারপরও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে থাকতেই অধিক নিরাপদ বোধ করছিল।
পরিবর্তিত ভূপ্রকৃতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি 'আজও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। ভূমিপুত্ররা নিজেদের ভূমিতেই আজ সংখ্যালঘু।' রায় সাহেব ৩৮ বছর ধরে চাকমা ইস্যু নিয়ে সচেতনভাবে মুখ বন্ধ রেখেছেন। চুপ থাকার কারণও বলেননি। হতে পারে, নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে তিনি পাকিস্তানকে বিব্রত করতে চাননি।
পাকিস্তানের জন্য তার এই স্পষ্ট ভূমিকার জন্য জুলফিকার আলি ভুট্টো তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন। ১৯৭১ সালে গঠিত ১২ সদস্যের মন্ত্রিসভায় তাকে দিয়েছিলেন সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রীর পদ, পর্যটনও ছিল তার এখতিয়ারে।
তিনি কখনোই পাকিস্তান পিপলস পার্টিতে যোগ দেননি এবং এখনও পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। তবু জেনারেল জিয়াউল হক তাকে আর্জেন্টিনায় রাষ্ট্রদূত করে পাঠান। সেখানে নজিরবিহীন ১৫ বছরের কাজ সেরে ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানে ফেরেন ত্রিদিব রায়। তখনও মন্ত্রণালয়বিহীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তিনি।
আগের দিনে জাঁকালো ব্যক্তিগত জীবনের জন্য তার সুনাম ছিল, বাড়িতে পার্টি দিতেন। এখন ৭৬ বছর বয়সে নিজের পূর্ববর্তী জীবনের প্রতিচ্ছায়া হয়ে আছেন। কিছু আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সংবর্ধনা ছাড়া আজকাল রায় সাহেব অনেকটাই নিঃসঙ্গ। তবু এখনও বেশ চটপটে মানুষ তিনি। সাধারণভাবে চলাফেরা করেন। গলফ আর ব্রিজ খেলেন। পাকিস্তানের ছোট বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ আর ঘোরাফেরা করেন।
তিনি বলেন, 'আমি চাকমাদের ব্যাপারে সচেতন, কিন্তু কোনো চাকমা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। কোনো গ্রুপের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। তারা আমার পরামর্শ চায় না, আমিও কাউকে বলি না কীভাবে তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করা উচিত।' ৭৬ বছর বয়সী এই বৌদ্ধ বলেন, 'আমার সার্বিক পরামর্শ হলো, নিজের অধিকারের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে অবিশ্রাম লড়াই কর। কখনোই সহিংস হইও না, নিজেদের মধ্যে এবং অপরের সঙ্গে খুনোখুনি কর না।'
তিনি কিছুটা সংরক্ত হলেও মনে করেন পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশকে বেছে নিলেও নিজের মানুষের জন্য তিনি কিছুই করতে পারতেন না। তিনি বলেন, 'আমি যদি সেখানে থাকতাম আর সরকারের মর্জি অনুসারে কথা না বলতাম, পক্ষে কথা বলতে পারতাম না আমি। তাহলে পর্দার আড়ালে সরিয়ে দেওয়া হতো। কোনো না কোনো যুদ্ধে আমাকে স্তব্ধ করে দেওয়া হতো। আমি যদি উপহাসের পাত্রে পরিণত হতাম তাহলে সেটা চাকমাদের কী সাহায্য করত?'
রায় সাহেব মানুষের একটি ধারণার সংশোধন করতে চান। অনেকের ধারণা, তিনি পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের পর ১৬ ডিসেম্বর পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ১১ নভেম্বর যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলেন, 'পাকিস্তানের সরকার (ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন) আমাকে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ডাকে। আমার ভূমিকা ছিল আসন্ন যুদ্ধের প্রাক্কালে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করা।'
যুদ্ধ শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর। তখনও তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সফরে। তিনি বলেন, ১৬ ডিসেম্বর তিনি ব্যাংককে ছিলেন। পাকিস্তানে ফেরেন ২২ ডিসেম্বর। জুলফিকার আলি ভুট্টো তখন শাসনভার নিয়েছেন। তিনি তাকে মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। ত্রিদিব রায় ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে একমাত্র স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর নূরুল আমীন ছিলেন একমাত্র নন-আওয়ামী লীগার। বৌদ্ধ হিসেবে তিনি ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের একমাত্র অমুসলিম সদস্য।
ভুট্টোর এক সহযোগী ও মন্ত্রিসভায় তার জ্যেষ্ঠ এক সদস্য মুবাশি্বর হাসান তার কথা মনে করতে গিয়ে বলেন, 'তিনি ছিলেন তার মানুষের সমীহ ও শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি ও নূরুল আমীনের উপস্থিতির কারণেই আমরা বলতে পারতাম, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিবিহীন নই আমরা।'
প্রথমদিকে তাকে ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে নিউইয়র্কে গেলে শেখ মুজিব তার কাছে তার মাকে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তিনি তাকে ফিরে আসার জন্য রাজি করাতে পারেন। মায়ের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি ফিরে আসেননি। তিনি ফিরে আসার পর তার এই বিশ্বস্ততার জন্য ভুট্টো ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন।
স্ত্রীসহ তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিলেন। তিন সন্তান পরে তার কাছে এলেও বড় ছেলে দেবাশিস রায় মা ও বোনদের সঙ্গে থেকে যান। তিনি নতুন চাকমা প্রধান হিসেবে অভিষিক্ত হন। ঢাকায় তিনি একজন ব্যারিস্টার, সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ছিলেন তিনি।
রায় সাহেব আর কখনোই রাঙামাটিতে তার বাড়িতে ফেরেননি। এই বছরগুলোতে তিনি বাংলাদেশেও যাননি। বয়স্ক রাজা বলেন, 'অবশ্যই আমি আমার মানুষ, বাড়ি আর সম্প্রদায়কে মনে করি। কিন্তু পরিস্থিতি আর ইতিহাস আমার জীবনে বিশাল এক ভূমিকা পালন করেছে।'
 ১৫ ডিসেম্বর ২০০৯ এর দ্য হিন্দু থেকে ভাষান্তর : মাহবুব মোর্শেদ

Thursday, February 16, 2012

সুদিন তাহলে কার?

বৃহস্পতিবারের দৈনিক সমকালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে 'লিটলম্যাগের দুর্দিন' শিরোনামে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সর্বশেষ পরিস্থিতিটি উঠে এসেছে। আশি ও নব্বই দশকে বাংলাদেশে প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো। সারা বছর ধরে ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেট মুখরিত থাকত লিটল ম্যাগাজিনকেন্দ্রিক তরুণ সাহিত্যিকদের আড্ডায়-আলাপে। বহু লিটল ম্যাগাজিনের একাধিক সংখ্যা প্রকাশিত হতো বছরজুড়ে। আর বইমেলার সময় তো কথাই নেই। ডিসেম্বর-জানুয়ারি বা তারও আগে থেকে তোড়জোড় শুরু হতো। ক্রেতা ও পাঠকদের নজর থাকত মেলার দিকে। লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে তরুণ লেখক, পাঠকদের এই বিশেষ আগ্রহের কারণেই বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরটি একদা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। বহেড়া তলার লিটল ম্যাগ চত্বর ছিল আদিতে ছোট। পরে লিটল ম্যাগাজিনগুলোর চাহিদা অনুসারে পুরো চত্বরটার মূল সুর হয়ে ওঠে লিটল ম্যাগাজিন। বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষের উদারতায় লিটল ম্যাগাজিনের জন্য বরাদ্দ জায়গাটা বেড়ে যায়। কিন্তু জায়গা বাড়ার পরপরই লিটল ম্যাগাজিনের রমরমা অবস্থাটা পড়তির দিকে যায়, নব্বই দশকের শেষাশেষি কিংবা শূন্য দশকের প্রথম দিকেই। গত দু'তিন বছরে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন বলতে গেলে প্রায় স্তিমিতই হয়ে এসেছে। এবারের মেলায় ক'টি লিটল ম্যাগাজিন স্টলে নতুন পত্রিকা এসেছে, সেটি হাতে গুণে বলে দেওয়া যাবে। অধিকাংশ স্টলেই ম্যাগাজিনের লোকেরা ঠিকঠাক বসেননি বা নিয়মিত বসছেন না। বহেড়া তলার আড্ডা অবশ্য এখনও জমজমাট আছে। সেখানে তরুণ লেখকদের সমাবেশ কমবেশি দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, লিটল ম্যাগাজিনের এই দুর্দিনের পেছনে কী কারণ আছে? আজকাল কি তেমন উদ্যমী তরুণের সংখ্যা কমে যেতে বসেছে, যারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ম্যাগাজিনে নিজেদের লেখা প্রকাশ করবেন। নাকি লেখকই কমে গেছে? লিটল ম্যাগাজিনকে সমর্থন দেওয়ার মতো মানুষ কি নেই? হয়তো সবই সত্য। এও সত্য, তরুণদের মধ্যে লেখালেখির অভ্যাস এখন অনেক কম। আগে যেখানে শত শত তরুণের দেখা মিলত সেখানে এখন লেখালেখির জগতে নবাগতের সংখ্যা হাতেগোনা। অন্তত লিটল ম্যাগাজিনকেন্দ্রিক সিরিয়াস লেখালেখির ক্ষেত্রে তরুণদের আনাগোনা কম। তাই স্বাভাবিক কারণেই লিটল ম্যাগাজিন বের হয় কম। কিন্তু তরুণরা লিখতে-পড়তে আগ্রহী হচ্ছেন না, তা বোধহয় ঠিক পর্যবেক্ষণ নয়। লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে না, সাহিত্য পত্রিকাগুলোকে ঘিরে বেড়ে উঠছে না লেখকগোষ্ঠী; কিন্তু প্রচুর তরুণ লিখছেন, প্রকাশও করছেন। সে লেখা লিটল ম্যাগাজিন আকারে আসছে না মেলায়। আসার উপায়ও নেই। গত এক দশকজুড়ে তৈরি হয়েছে লেখালেখির এক ভার্চুয়াল দুনিয়া। ব্লগ, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে লিখছেন অসংখ্য তরুণ। এখানে অনেকেই স্রেফ গালগল্প করেন। অনেকে সিরিয়াস মতপ্রকাশ করেন। কিন্তু তরুণ সাহিত্যিকদের অধিকাংশই এখন ব্লগেই প্রথম লেখাটা প্রকাশ করেন। সেখানেই গড়ে উঠছে নতুন লেখকদের নতুন বৃত্ত। স্বাভাবিক কারণেই আমরা লেখালেখির সে জগৎ সম্পর্কে অনবহিত। কিন্তু ব্লগে-ফেসবুকে লিখে লিখে বড় হচ্ছেন, এমন লেখকদের বইও বেরিয়ে যাচ্ছে। লিটল ম্যাগাজিন বহুকাল এ দেশের লেখকদের কাছে বিকল্প মিডিয়া হিসেবে কার্যকর ছিল। এখন বিকল্প মিডিয়া আর ছাপা কাগজে নেই। বিকল্প মিডিয়া এখন পোর্টেবল, অনলাইন। একদিন হয়তো কোনো লিটল ম্যাগাজিনই আর প্রকাশিত হবে না। কিন্তু তরুণদের ভাবপ্রকাশ কি থেমে থাকবে? নতুন সাহিত্যিক কি আসবে না? আসবে। কোন মাধ্যমে আসবে সেটা খেয়াল রাখলেই হতাশা আর ঘিরে ধরবে না আমাদের।

Wednesday, February 8, 2012

ডক্টর জেকিল ও মিস্টার হাইড

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে, রবার্ট লুই স্টিভেনশনের 'ডক্টর জেকিল ও মিস্টার হাইডের অদ্ভুত ঘটনা' উপন্যাসের কথা মনে হতে পারে। এই উপন্যাসের বিষয় এক ব্যক্তির মধ্যেই পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্বের অবস্থিতি। কোনো এক ওষুধের কারণে ডক্টর জেকিল ও মিস্টার হাইড নামে দুই ধরনের ব্যক্তির বিকাশ ঘটে একই ব্যক্তির মধ্যে। এই উপন্যাসের সূত্রেই কোনো ব্যক্তির মধ্যে প্রবল পরস্পরবিরোধী উপাদান থাকলে ডক্টর জেকিল ও মিস্টার হাইডের উদাহরণ আসে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডক্টর জেকিল ও মিস্টার হাইডের উদ্ভব কোন ওষুধে ঘটেছে তা নিশ্চয় অভিজ্ঞ চিকিৎসক বলতে পারবেন। তবে পরস্পরবিরোধী কোনো অসুখ যে রাজনীতি বহন করছে তাতে সন্দেহ নেই। উদাহরণ হিসেবে মঙ্গলবারের পত্রিকা আদর্শ হতে পারে। এদিনের একটি খবরে দেখা যাচ্ছে, ১২ মার্চের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল রীতিমতো মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী দল ১২ মার্চ ব্যাপক লোক সমাগম করে সরকারকে একটি মেসেজ দিতে চায়। আর সরকার দলও এদিন সর্বশক্তি নিয়ে হাজির থাকতে চায় মাঠে। ১২ মার্চের কর্মসূচি নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দলের রীতিমতো বাক ও কর্মসূচি যুদ্ধ চলছে। খবর পড়ে মনে হবে, দেশ অনিবার্য সংঘাতের মুখোমুখি। বিরোধী দল একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে চলেছে, সরকারও সেগুলো বানচালের জন্য তৎপর। যেন রাজনীতির সেই ঢিল ও পাটকেল পর্ব শুরু হয়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতে যে কেউ উদ্বিগ্নবোধ করবেন। কিন্তু উদ্বেগ পরক্ষণেই কনফিউশনে পরিণত হবে, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মনোভাব নিয়ে খবরটি কেউ পড়েন। দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়কের বিকল্প হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর একটি মন্তব্যকে ঘিরে রাজনীতিতে সুবাতাস বইছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা একে স্বাগত জানাচ্ছেন। এ খবর পড়লে মনে হবে, দেশের রাজনীতিতে শাসক দলগুলোর মূল বিবাদের মীমাংসা আসন্ন। তত্ত্বাবধায়কের বদলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালু হবে। অপেক্ষা শুধু সংসদে বিল উঠবার। তর্ক চলছে কে বিল ওঠাবে? সরকার না বিরোধী দল? সরকার বলছে, বিরোধীরা ওঠাক, বিরোধীরা বলছে সরকার ওঠাক। মধুর এই বিতর্কের শেষে হয়তো দেখা যাবে সমস্বরে সবাই বিল ওঠাচ্ছেন আর তা পাসও হয়ে যাচ্ছে। তারপর সবাই মিলে সুখে-শান্তিতে বসবাস করা শুরু হচ্ছে। আসলেই কি তাই? বিবদমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান নিশ্চয় সংসদে এমন একটি আলোচনার ওপরই নির্ভর করে। কিন্তু সে আলোচনা কি এখনই হবে? রাজপথে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যেভাবে মারমুখী আচরণ করছে তাতে এটা নিশ্চিত যে, বিনাযুদ্ধে কেউ কাউকে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়বে না। সরকার দেখবে, রাজপথে বিরোধীরা কতটা শক্তি দেখাতে পারে। আর বিরোধীরা তড়িঘড়ি বাধ্য করাতে চাইবে সরকারকে। রাজনৈতিক দলগুলো এখন দুটি চেহারা নিয়েই মাঠে। এক চেহারা ডক্টর জেকিলের, আরেক চেহারা মিস্টার হাইডের। এক চেহারা কর্মসূচি ও পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে চলেছে। আরেক চেহারা আলোচনা-সংলাপ করছে। এর শেষ কোথায় কে জানে? তবে সাধারণের চিন্তাটা খুব স্পষ্ট সাধারণ মানুষ মনে করে, রাজপথ গরম না করে আলোচনার টেবিলেই বসা উচিত। শেষ পর্যন্ত তো আলোচনার টেবিলেই বসতে হবে। তবে আর দেরি কেন? কেন বৃথা পরিশ্রম, সংঘাত ও রক্তক্ষয়?

Tuesday, February 7, 2012

একজন ডিসি ও একজন পিয়ন

'ডিসির কাছ থেকে ঘুষ দাবি : পিয়ন গ্রেফতার।' সমকালের শেষ পাতায় বেশ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছে খবরটি। শুক্রবারের সংখ্যায়। শিরোনামই বলে দেয় খবরটি কৌতূহলোদ্দীপক। অবশ্যই ঘুষ দেওয়া-নেওয়া আমাদের সমাজে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার নয়। প্রয়োজনের কাজটি করতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়নি বা ঘুষ দিতে বাধ্য হননি বা ঘুষ না দিয়ে ভোগান্তির শিকার হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। আর কে না জানে, অধিকাংশ ভোগান্তির ঘটনা ঘটে সরকারি অফিসগুলোতে। কর্মকর্তা-কর্মচারী তো বটেই কোনো কোনো অফিসে পিয়ন পর্যন্ত উৎকোচ ভোগ করতে অভ্যস্ত। ঘুষ ছাড়া ফাইল এগোয় না। কোনো অবস্থায় ঘুষ না হলে ফাইল হারিয়ে যায়। অনুরোধ-উপরোধ, তদবিরে যখন কাজ হয় না তখন লোকে বুঝে যায় কাজ আদায়ের সহজ পদ্ধতি হলো ঘুষ। অবস্থাভেদে অঙ্কটা বাড়ে আবার কমেও। অনেক সময় ছোট কাজে বড় ভোগান্তি আর বড় কাজে ছোট ভোগান্তির অভিজ্ঞতাও হয়। লোকে রসিকতা করে কোনো কোনো অফিস সম্পর্কে বলেন যে, এ অফিসের চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত ঘুষ খায়। কোথাও কোথাও নাকি চেয়ার-টেবিল গুণে ঘুষ দিতে হয়। অফিসপাড়ার নিয়মিত যাত্রীদের কাছে তাই ঘুষ অবাক করার ব্যাপার নয়। কিন্তু ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব যদি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের কাছেই আসে তা নিশ্চয়ই অবাক করার ব্যাপার। আর সে ঘুষ যদি একজন পিয়ন দাবি করেন তবে বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। দেশে তবে নিয়মনীতি বলে কিছু থাকল? কার কাছ থেকে কে ঘুষ চাইতে পারেন তেমন কোনো নিয়ম থাকার কথা নয়। তাই বলে যে কেউ যে কারও কাছ থেকে ঘুষ দাবি করবেন? পদোন্নতি প্রার্থী ডেপুটি কমিশনারের কাগজপত্রে কিছু সমস্যা ছিল। আর এ সমস্যা মেটাতে তার কাছ থেকে ঘুষ দাবি করে বসলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক পিয়ন। রীতিনীতি বলে আর কিছু থাকল? কাগজপত্রে সমস্যা থাকতেই পারে, সে সমস্যা মেটানোও যেতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ঘুষের কথাও উঠতে পারে। কিন্তু কার কাছে কে ঘুষ চাইবেন? ডিসির কাছে পিয়ন? পিয়নের এমন দৌরাত্ম্য হয় কী করে? নিশ্চিতভাবেই পিয়নের সঙ্গে আরও লোকজন নিশ্চয় আছেন। যদি থেকেই থাকেন তবে একটু ঊর্ধ্বতন কাউকে দায়িত্বটা দেওয়া যেত না? পদের সম্মান আছে, পদের অধিকার আছে। সেটুকু রক্ষা তো করতে হবে। যাই হোক, পিয়ন ঘুষ দাবি করায় বিক্ষুব্ধ ডিসি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। এতে টনক নড়েছে। কর্তৃপক্ষের সহায়তায় পিয়ন ধরা পড়েছে। এই সৎসাহসের জন্য ডিসিকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কিন্তু পিয়নের কী হবে? পিয়নের ক্ষমতা যারা জুগিয়েছেন তাদেরই-বা কী হবে? আদৌ কি তাদের নাম জানা যাবে কখনও? নাকি বরাবরের মতো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবেন তারা? অভিজ্ঞতায় বলে, সরকারি কর্মকর্তাদের ভোগান্তি শুরু হয় অবসর গ্রহণের পর পেনশন ও পাওনা তুলতে গিয়ে। যে অফিসে এতকাল কাজ করেছেন সে অফিসেই হেনস্তা হতে হয়। উৎকোচ গুনতে হয়। ক্ষমতা হারানোর পর ক্ষমতাধরদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এতকাল এসবই গল্প আকারে শুনেছি আমরা। এখন দেখা যাচ্ছে, চাকরিরত অবস্থাতেও ঘুষের টাকা গুনতে হচ্ছে তাদের। রাজধানীর ঊর্ধ্বতন অফিসের পিয়ন পর্যন্ত টাকা চেয়ে হেনস্তা করছেন তাদের। পরিস্থিতিটা দুঃখজনক। কিন্তু পরিস্থিতিটা কি সরকারি কর্মকর্তাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট? তারা কি এখন একজোট হয়ে নিজেদের ও অপরের ভোগান্তি দূর করার উদ্যোগ নেবেন? নাকি চলতে থাকবে যেমন চলছে এখন?