Friday, December 30, 2011

সংলাপ

হাওয়া কোনদিকে তা বোঝা বড় ভার। দেশে আবহাওয়া অফিস আছে। তারা সারাক্ষণই হাওয়ার গতিবিধি খেয়ালে রাখে। কখন ঝড় হবে, কখন বৃষ্টি হবে, কখন শৈত্যপ্রবাহ হবে তার খবর রাখে। খবর রাখলেও সবসময় যে সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারে_ তা নয়। কেননা, খবর রাখাটাই জরুরি নয়, খবর নিয়ে সম্ভাব্য ভবিষ্যদ্বাণীটিই জরুরি। আমাদের দেশে অবশ্য আবহাওয়া অফিসের দিকে তাকিয়ে থাকার রেওয়াজ নেই। কেউ আবহাওয়া অফিসের সংকেত মেনে ছাতা নিয়ে বেরিয়েছেন ঘর ছেড়ে_ এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না। কিন্তু পাশ্চাত্যে লোকে রেডিও, টিভি, ইন্টারনেটে আবহাওয়ার সংবাদ শুনে, দেখে, পরে ঘর থেকে বের হন। সবসময় মিলতে হবে তা নয়, কিন্তু কিছুটা মিললেও প্রস্তুতির সার্থকতা মেলে। খবর যা মেলে তাতে বোঝা যায়, পাশ্চাত্যের লোকেরা আবহাওয়ার সংবাদে খুশি। আমাদের অবশ্য তত খুশির অবকাশ নেই। পাশ্চাত্যের আবহাওয়া দফতরগুলো মারফত খবর মিললে তা আমাদের আবহাওয়ায় ফলে বটে। কিন্তু দেশীয় আবহাওয়া দফতরের খবরে ভরসা অনেকেরই নেই। আবহাওয়া দফতরগুলোর তরফেও ভরসা আনার উদ্যোগ নেই। খুব চাপাচাপি করলে তারা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির অভাবের কথা জানিয়ে দেয়। সত্যিই তো, আগামীকাল কী ঘটবে তা জানার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কি আমাদের আছে? আবহাওয়ায় যেমন, তেমনি রাজনীতিতেও_ আগামীকাল কী ঘটবে তা জানার উপায় নেই।
এখন রাজনীতিতে চলছে শীতকাল, সংলাপের মৌসুম। শীতের শুরুতে অবশ্য মনে হয়েছিল আবহাওয়া শীতল থাকলেও রাজনীতি গরম থাকবে। বিরোধী দল একটু গরম কর্মসূচি নিয়েছিল; সরকারও গরম হয়েছে। ভাংচুর-অগি্নসংযোগ, ধরপাকড় সব ঘটবার পর একেবারে সব নিশ্চুপ। কোনো কোনো তরফে বলা হচ্ছে; না, এখনও সময় আসেনি। কেউ বলছেন, ধ্বংসের পথ নয়, সৃষ্টির পথে থাকুন। এসব কথায় কাজ হচ্ছে। বিরোধী দল ঠাণ্ডা হয়েছে। কতটা ঠাণ্ডা হয়েছে তা আবহাওয়া অফিস বলতে পারবে। কিন্তু কিছুটা ঠাণ্ডা যে হয়েছে তা নিশ্চিত। রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপে তারা যেতে রাজি হয়েছে। বলেছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবেই যাচ্ছে আলোচনায়। দাবি জানানোই মূল উদ্দেশ্য। মুখে যাই বলুক, যাচ্ছে_ সেটাই বড় কথা। রাষ্ট্রপতি ডাকলে যাওয়াটাই শ্রেয়। এর মধ্যে অবাক করার আরেক কথা শোনা গেল। পরিবেশ পেলে বিরোধীরা নাকি সংসদেও যাবেন। বেশ! সহসা কি রাজনীতির হাওয়া উল্টে গেল তাহলে? কোথায় লোকে ভেবেছিল, বিরোধীরা মাঠ গরম করবে; উল্টো সংসদ-সংলাপ শুরু হলো? রাজনীতির হাওয়া বদলের এসব চিহ্ন দেখে কিছু বোঝা যায়? শীত ঋতুতে বৃষ্টি হবে, নাকি শৈত্যপ্রবাহ, তাও কি বলা সম্ভব? যাই হোক, সংলাপ চলছে। বিষয় নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন। একে একে সবাই যাচ্ছেন। কেউ বলছেন, আইন করুন। আইন করে নিয়োগ দিন। কেউ বলছেন, এখনকার নিয়মেই চলুক। কেউ বলছেন, এই কমিশনই থাকুক। কেউ বলছেন, নতুন লোক আনুন। কেউ বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া হবে না। কেউ বলছেন, ওটি ছাড়াই কাজ সারুন। সবার কথাই শোনা হচ্ছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না_ শেষে কী হবে? নানা মুনির নানা মত উজিয়ে সিদ্ধান্ত কীভাবে হবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবু তো সংলাপ হচ্ছে। দু'বছর বাদে নির্বাচন। সময় তো চোখের পলকে চলে যায়। দেখতে দেখতে দু'বছর কেটে যাবে। তার চেয়ে বড় কথা, এখনই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ না দিলে চলবে না। নির্বাচন কমিশন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই দুই নিয়েই তো চিন্তা। দেশে তো আর কোনো বিষয় নেই। থাকলেও রাজনীতিকদের সেসব নিয়ে ভাবতে নেই। কথা বলতেও নেই। টম অ্যান্ড জেরির মতো তারা পঞ্চবার্ষিক তত্ত্বাবধায়ক খেলা খেলে যাবেন। আন্দোলন করবেন, মারপিট করবেন, ধরপাকড় করবেন, সংলাপ করবেন। সংসদ ছেড়ে রাজপথ, রাজপথ ছেড়ে সংসদ_ এই নিয়ে কাটিয়ে দেবেন। বেশ তো! রাজনীতি এখন অনেক ভালো। হরতাল কম, জ্বালাও-পোড়াও কম। ষড়যন্ত্র অল্প। এতেই নাগরিকদের স্বস্তি পাওয়া উচিত। নাগরিকদের সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় কারও কি আছে? না থাকুক। তবু রাজনীতি ভালো থাকুক। ভালো নির্বাচন কমিশন হোক, নির্বাচন নিয়ে ভালো ব্যবস্থা হোক। নাকি শেষে দেখা যাবে, এসব কিছুই হচ্ছে না। ফাইনাল খেলা রাজপথেই হচ্ছে! সে আমরা চাই না। আমরা চাই, রাজনীতিকরা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সংলাপ করে একটা সমাধান করুন। রাজনীতিকরা সুখে থাকলে দেশের মানুষও সুখে থাকবে নিশ্চিত।

Friday, December 23, 2011

তেল ও জলের দর

দুধ বেচে মদ খাওয়ার কথা আমাদের লোকপ্রবাদে আছে। মূল্যজ্ঞান লোপ হয়েছে এমন ব্যক্তির পরিস্থিতি বর্ণনা করতে দুধ বেচে মদ খাওয়ার উদাহরণ দেওয়া হয়। আমাদের সামাজিক ধারণায় মদ্যপান অহিতকর, পরিত্যাজ্য। পুষ্টির জন্য দুগ্ধপান উৎসাহিত করা হয়। ফলে বাজারে মদ যে দামেই বিক্রি হোক, কেউ যদি দুধ বেচে মদ খায় তবে তার মূল্যজ্ঞান লোপ পেয়েছে বলে ধরা হয়। দুধ বেচে যে মদ খায় সে নিশ্চিত উচ্ছন্নে গিয়েছে। অবশ্য ভ্রমণপিপাসু লোকদের কাছে শুনেছি, কোনো কোনো দেশে নাকি পানি, ওয়াইন আর দুধের মূল্য এক। কোথাও কোথাও নাকি একগ্গ্নাস পানির দর এক পেগ হুইস্কির চাইতে বেশি। বাজারে কোন জিনিসের দাম বেশি হবে তা ওই জিনিসের প্রাপ্যতা ও উৎপাদন খরচের ওপর নির্ভর করে। যেখানে মদের চাইতে পানির দাম বেশি সেখানে পানি উৎপাদনের খরচও নিশ্চয় বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে এটি জানবার মতো খবর বটে। কেননা মদ এখানে দুর্মূল্য। অন্যদিকে সস্তায় কোনো জিনিস বিক্রি হলে আমরা বলি_ পানির দরে বিক্রি হচ্ছে, বোঝা যায় পানির দাম কত কম। অবশ্য ক্রমশ পানির দাম বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে পানির দাম, দুধের দাম, মদের দাম কখনও এক হবে বলে মনে হয় না। কেননা, বাজারই শুধু মূল্য নির্ধারণ করে না। সমাজও মূল্য তৈরি করে, এমনকি মূল্যবোধও তৈরি করে। আমরা কথায় কথায় বলি, অমুক আর অমুক এক পঙ্ক্তিতে বসতে পারে না। পঙ্ক্তি মানে কবিতার লাইন নয়, বসার লাইন। খাবার আসরে একই মর্যাদার মানুষের একই পাতে বা লাইনে বসার রেওয়াজ। অসম মর্যাদার ব্যক্তিরা একই পঙ্ক্তিতে বসলে তাতে মূল্যের হানি ঘটে বলে সামাজিক ধারণা। অনেক সময় বলা হয়, অমুক ও অমুককে একই পাল্লায় মেপো না। পাল্লাও এখানে মর্যাদারই স্মারক। যে পাল্লায় চাল মাপা হয়, একই পাল্লায় মিষ্টি মাপার রেওয়াজ নেই। একইভাবে বলা হয়, তেল ও জলের দাম এক করো না। সমাজের মূল্যবোধ বদলের সঙ্গে বহু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন এক পঙ্ক্তিতে বসার ক্ষেত্রে মর্যাদার প্রশ্ন ওঠে না। আকবর বাদশাহ আর হরিপদ কেরানীকে এক পাল্লায় মাপলে কেউ সমালোচনার তর্জনী বাড়িয়ে দেন না। জলজ পানীয়গুলোর সমমূল্য কোনো দেশে থাকলে তা বিস্ময়কর হলেও, অগ্রহণযোগ্য খবর নয়। কিন্তু তেল ও জলের দাম এক হওয়া কঠিন। মাঝে মধ্যে দেশে অভিনব কিছু খবর মেলে, তাতে তেলের বদলে পানি, কচুরিপানা, খড় দিয়ে গাড়ি চালনার মতো বিস্ময়কর আবিষ্কারের কথা বলা হয়। এত আবিষ্কারের পরও তেলের মূল্য আর পানির মূল্য এক হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বোঝা যায়, তেল ও পানির ক্ষেত্রে বাজার ও সমাজের মূল্যবোধ এখনও অটুট। ভবিষ্যতে বহুদিন তা থাকবে। তবে সম্প্রতি ভারত সরকার তেল ও জলের মূল্য এক করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। তারা পেট্রোলের দাম খুব বেশি কমায়নি, আপাতত রাজনৈতিক কৌশলের কারণে স্থিতিশীল রেখেছে। কিন্তু ভারত-রত্ন পুরস্কারকে গণচরিত্র দিয়েছে। ভারতের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাবটি এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের রথী-মহারথীদের বাইরের লোকদের মধ্যেও বিতরণ করা হবে। ক্রিকেটার ও চলচ্চিত্র অভিনেতারাও পুরস্কৃত হবেন। এ নিয়ে ভারতের পত্রপত্রিকায় শোর উঠেছে। নাগরিক সমাজও সোচ্চার হয়েছে। তারা বলছেন, ক্রিকেট জনপ্রিয়, বলিউডের ফিল্মও জনপ্রিয়। কিন্তু বিদ্যা-জ্ঞান ও সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এগুলোর অবদান কী? শচীন টেন্ডুলকার কি সিভি রমণ রাধাকৃষ্ণনের মতো পণ্ডিতদের পঙ্ক্তিতে বসতে পারেন? ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মার্কন্ডেয় কাটজু বলেছেন, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মির্জা গালিবকে ভারত-রত্ন দেওয়ার কথা বলে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এখন ফিল্মস্টার আর ক্রিকেট স্টারদের পুরস্কার দেওয়ার কথা হচ্ছে। এটা করা হলে তার কোনো সামাজিক গুরুত্ব থাকবে না, এটা হবে স্রেফ একটা পরিহাস। ক্রিকেটারদের দোর্দণ্ড প্রতাপের মধ্যে ভারতীয় পত্রিকাগুলো যেভাবে কথা বলছে ভারত-রত্নের মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে তা প্রশংসনীয় বটে। জনপ্রিয়তাই যদি একমাত্র মানদণ্ড হয় তবে তো সমাজে কোনো দণ্ডই স্থির থাকতে পারে না। ফলে তেল ও জলের দাম কখনও এক হওয়া উচিত নয়। জলের কাছে তেলের কাজ আশা করাও ভুল কিংবা তেলের কাছে জলের কাজ। ভারতের সৌভাগ্য যে, সে দেশে তেল ও জল সকলে চেনে। আমাদের দেশে সমাজের জ্ঞানী-বিদ্বানদের চিহ্নিত করার ব্যবস্থাই নেই। ফলে এসব কথা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয় বলেই মনে হয়।

Sunday, December 11, 2011

পৃথিবীর সীমাহীন নিঃসঙ্গতা ও কেপলার-২২বি

আমাদের কবি একদা লিখেছিলেন, 'বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।' পৃথিবীকে সত্যিই কতটুকু জানা হয়েছে মানুষের? দেশে দেশে কত নগর, কত রাজধানী অলক্ষ্যে পড়ে রয়েছে। অনাস্বাদিত, অশ্রুত ও অদৃষ্ট সেসব নগর-বন্দর-রাজধানীকে জানার নিরন্তর প্রক্রিয়া চলছে। আজ অনেকেই বলেন, হাতের মুঠোয় এসে গেছে পৃথিবী। ধারণাগত দিক থেকে হাতের মুঠোয় এলেও বাস্তবে কিন্তু পৃথিবীতে জানা ও বোঝার জন্য জ্ঞান এবং তথ্য আহরণের প্রচেষ্টা চলছে নিরন্তর। শুধু পৃথিবী নয়, জানার প্রক্রিয়া পৃথিবীর বাইরে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। পৃথিবীকে যদি কবির ভাষায় বলতে হয় বিপুলা, তবে পৃথিবীর বাইরের পুরো বিশ্বজগৎকে বলতে হবে মহা মহা বিপুলা। কত নক্ষত্র, কত গ্রহ, কত ছায়াপথ সেখানে। আমাদের আরেক কবি লিখেছিলেন, "মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া,/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর।" বিশ্ববিধাতৃর বিস্ময় উৎপাদনের মতো পদক্ষেপ এখন মানুষের আয়ত্তে আসেনি। মানুষের পদধূলি সৌর জগতের বাইরে এখনও পড়েনি। কিন্তু দূরবীক্ষণের সাহচর্য নিয়ে মানুষের চোখ চলে গেছে অনেক দূর কোটি আলোকবর্ষেরও ওপারে। মহাবিশ্বজুড়ে মানুষ খুঁজে চলেছে অনেক কিছু। দেখে চলেছে যা দেখা যায়। কিন্তু অনুসন্ধানী মানুষের প্রথম ও প্রধান প্রশ্ন শুরুতে যা ছিল এখনও তা-ই। মহাবিশ্বে কি পৃথিবী একটাই, বুদ্ধিমান প্রাণী বলতে কি মানুষই একমাত্র? এ প্রশ্নে পৃথিবী সৌরজগতের একটি গ্রহ নয় শুধু, পৃথিবী হলো উপযুক্ত তাপ, চাপ, জলবায়ুর সমন্বয়ে গঠিত প্রাণধারণ উপযোগী গ্রহ। পৃথিবীতে বসে আরেক পৃথিবীকে খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রাণের সামান্যতম সম্ভাবনা কোথাও দেখা দিলে সমস্বরে ঘোষণা করছেন, হ্যাঁ মঙ্গলে মিললেও মিলতে পারে প্রাণ। বা অন্য কোথাও_ অন্য কোনোখানে। কিন্তু মানুষের নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে পারে এমন তথ্য এখনও মেলেনি। সবার বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারে এমন কথা এখনও কেউ বলেনি। তবু এবার আশা একটু বেশি। নাসার বিজ্ঞানীরা এবার একটু ভেবেচিন্তে, অপেক্ষা করে ঘোষণা দিলেন। বললেন, আছে আরেক পৃথিবী। আমাদের পৃথিবীর বোন। তার নাম কেপলার-বি২২। আমাদের গ্রহ থেকে দুই কোটি বিশ লাখ আলোকবর্ষ দূরে। অনেক দূরের সেই গ্রহ আমাদের পৃথিবীর মতোই আরেক সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সেখানেও দিন হচ্ছে, রাত হচ্ছে। তবে সেখানে কি প্রাণ আছে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর মতো অনুকূল তাপ আছে সেখানে। যুক্তি মোতাবেক, প্রাণ থাকার কথা। প্রাণ যদি থাকে তবে বিবর্তনের পথ ধরে সে প্রাণ কি মানুষের মতো বুদ্ধি সঞ্চয় করেছে? এখনও কেউ জানে না। তবে নাসার বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। তবে কি মানুষের সীমাহীন নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে যাচ্ছে কেপলার-বি২২? হয়তো। আরও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ যদি জানতে পারে যে সেখানে প্রাণ আছে; তবে পৃথিবীর সন্তানদের সঙ্গে কেপলার বি২২-এর সন্তানদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? ধরা যাক, সেখানে সভ্যতার পর সভ্যতা ধ্বংস হয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীরা এখন উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে। নয়তো, তারা আছে আদিম কোনো অবস্থানে। বিকশিত হতে হতে একদিন উন্নতির শীর্ষে উঠবে। আবিষ্কার করবে প্রযুক্তি। দূরবীক্ষণে তাকিয়ে দেখবে আকাশ, নক্ষত্রলোক। আমাদের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হবে। ভাববে, এখানে আছে প্রাণের সম্ভাবনা। মহাবিশ্বে তারা আর একা নয়। কিন্তু তারা কি আরেক গ্রহের প্রাণের সন্ধানে যাত্রা করবে? দুই কোটি ২০ লাখ বছর পর এসে পেঁৗছাবে? অথবা আমাদের পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানীরা কি রওনা হবেন সুদূর ভবিষ্যতের কোনো একদিন সেই পৃথিবীর উদ্দেশে? প্রযুক্তি এখনও সে শক্তি অর্জন করেনি। আপাতত তাই কবির কথা দিয়ে শেষ করি, 'আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি/সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ।' বিশ্বজগতে পৃথিবীর মতোই আরেক গ্রহ আছে, আপাতত এই আমাদের সুখের খবর।

Thursday, December 1, 2011

নতুন ঢাকা, পুরান ঢাকা

ঢাকার অধিবাসীদের কাছে শহরটি বহুদিন ধরেই দুই ভাগে বিভক্ত। সিটি করপোরেশন ভাগ নিয়ে তুমুল বিতর্কের মধ্যে এই সাধারণ তথ্যটির দিকে কারও মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি বলেই মনে হয়। তীব্র রাজনৈতিক তর্কের মধ্যে অত্যন্ত সাধারণ তথ্যটিও অনেক সময় সবার অলক্ষ্যে থেকে যায়। সেটা স্বাভাবিকও। ঢাকার অধিবাসীদের কাছে শহরের পুরাতন অংশটি পুরান ঢাকা আর নতুন অংশটি নতুন ঢাকা বা ঢাকা বলে পরিচিত। একদা বুড়িগঙ্গার তীরে এ নগরীর পত্তন ঘটেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা মোটামুটিভাবে পুরাতন অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। স্বাধীনতার পর ঢাকা উত্তরে বিস্তৃত হয়েছে_ টঙ্গীর সীমান্ত উত্তরা পর্যন্ত। স্বাধীনতার পরের চার দশকে যে ঢাকা তৈরি হয়েছে তাকে সহজে চেনা যায়। পুরান ঢাকাকেও আলাদা করে চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ২৯ নভেম্বর সংসদে বিল পাস হয়ে ঢাকা দু'ভাগ হলো। আর এ বিলে ঢাকা ভাগের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে ঢাকার ওই ধারণাগত বিভক্তিটাই সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেল। ঢাকা দক্ষিণ মোটাদাগে স্বাধীনতার আগের শহুরে জনবসতি। আর ঢাকা উত্তর স্বাধীনতার পরের জনবসতি। বিভক্ত ঢাকার ম্যাপের দিকে তাকালে এ সত্যটি সহজেই সবার চোখে ধরা দেওয়ার কথা। আর যারা সচক্ষে প্রতিদিন এ শহরকে দেখেন তারা সহজেই এ দুই ঢাকার গুণগত পার্থক্যের কথা জানেন। এ কথা সত্য, পুরান ঢাকার উত্তরাংশে অর্থাৎ ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুরে কিছু উন্নয়ন ঘটলেও, এর অধিকাংশ এলাকাই অবহেলিত। ঠিক যেন মেট্রোপলিটন শহর হয়ে উঠতে পারেনি। এক রাইডে উত্তরার রাস্তা থেকে চলমান একটি গাড়ি ওয়ারির রাস্তায় এসে পড়লে সহজে বোঝা যেতে পারে গুণগত পার্থক্যটি। সরকার ঢাকাকে দু'ভাগ করে ফেলায় এখন বুঝতে সুবিধা হবে। শহরের দুই অংশে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের সমতা বিধানের জন্য যদি ইতিবাচক প্রতিযোগিতা হয় তবে নিশ্চয়ই নাগরিকরা তাকে স্বাগত জানাবেন। দুটি সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পার্থক্যও বোঝা যাবে সহজে।
সবচেয়ে ভালো হতো যদি উত্তর-দক্ষিণ দিকনির্দেশ না করে পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকা নাম দেওয়া হতো। ভারতের রাজধানী দিলি্লর ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ আছে। তবে দিলি্ল বলতে যে পুরনো শহরের কথা আমরা জানি তা কিন্তু রাজধানী নয়। রাজধানী হলো নয়াদিলি্ল। দিলি্লর নতুন ও পুরাতনের সঙ্গে ঢাকার নতুন ও পুরাতনের বেশ মিল আছে। তবে দিলি্ল শুধু শহর নয়, শহরভিত্তিক একটি রাজ্যও। দিলি্লর পথ অনুসরণ করে ঢাকা নামটি শহরের পুরনো অংশকে দিয়ে নতুন অংশের আলাদা একটি নাম খোঁজা হলে আরও ভালো হতো। ঢাকার এই বিভক্তি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে এক ধরনের সংশয় কাজ করেছে আগাগোড়া। সত্যি কথা বলতে, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, রাজনৈতিক দল সবাই ঢাকা ভাগের বিপক্ষে। বলা যায়, সরকারি দলের গুটিকয় মানুষ ছাড়া প্রকাশ্যে কেউ ভাগ সমর্থন করেননি। তবু সংসদে বিল পাস হয়েছে। এখন দ্বিখণ্ডিত সিটি করপোরেশন নগরবাসীর জন্য বাস্তবতা। ঢাকা শুধু সিটি করপোরেশন নয়, বাংলাদেশের রাজধানীও। সিটি করপোরেশন দু'ভাগ হলেও রাজধানী নিশ্চয়ই দু'ভাগ হতে পারবে না। সঙ্গত কারণেই যে কোনো এক ভাগকে রাজধানী ঘোষণা করতে হবে, নয়তো বলতে হবে উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে পুরোটাই রাজধানী। অর্থাৎ শুধু সিটি করপোরেশনের সেবা দু'ভাগ হলো, রাজধানী নয়। তবে ঢাকা শহরের যে বাস্তবতা তাতে রাজধানীটিকে যে কোনো একটি অংশে ফেললেই ভালো হতো। যদিও পুরান ঢাকা রাজধানী নয় তবু রাজধানী ঐতিহ্যের কাছাকাছি থাকল। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সব ভবন পুরাতন অংশে স্থানান্তর করে ফেলা যেতে পারে। আবার নতুন ঢাকাতেও রাজধানী আসতে পারে, নতুন রূপ নিয়ে নতুন কোনো জায়গায় প্রশাসনিক ভবনগুলো স্থাপন করা যেতে পারে। শহরের দুই অংশের আলাদা চরিত্রও দাঁড় করানো যেতে পারে। এসব গঠনমূলক চিন্তা_ অবশ্যই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে। আমাদের রাজনীতি যেভাবে চলে সে ধারায় ঢাকা চললে, যে ঢাকা সেই ঢাকাই থাকবে। দুই কেন চার ভাগ করলেও কোনো পরিকল্পিত, আধুনিক ও উন্নত শহর অদূর ভবিষ্যতে আমরা পাব না।

Saturday, November 26, 2011

চপেটাঘাত

চারদিকে কত খুনোখুনি, কত রক্তপাত_ তোলপাড় করা নানা হত্যাকাণ্ড। কিন্তু সেসব নিয়ে যেন কারও ভ্রূক্ষেপ নেই। গোটা ভারত গতকাল মগ্ন ছিল একটা চড় নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলে মাওবাদী নেতা কিশেনজি নিহত হলেন। বৃহস্পতিবারের ঘটনা হলেও সে নিয়ে খুব বেশি কথাবার্তা ছিল না সংবাদমাধ্যমগুলোতে। কিশেনজির মৃত্যুর খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু লোকের মুখে মুখে ফিরছিল সামান্য এক চড়ের ঘটনা। কে, কাকে চড় মেরেছে? টেম্পোচালক হরবিন্দর সিং চড় মেরেছিলেন কৃষিমন্ত্রী শারদ পাওয়ারকে। কেন মেরেছেন? মন্ত্রী বা ভিআইপিদের ওপর হামলা হলে ধরেই নেওয়া হয় যে, তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই তা হয়েছে। নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হামলা। কিন্তু টিভিগুলোর লাইভ প্রচারের দৌরাত্ম্যে দেখা গেল হত্যা বা মারাত্মক আহত করার উদ্দেশ্য হরবিন্দরের ছিল না। ছোট একটি চাকু হাতে থাকলেও তা ব্যবহার করেননি হরবিন্দর। বরং একটি চড় মেরেই রাগ প্রকাশ করেছেন। চড়টি মারার পর খোদ হরবিন্দরই শারদ পাওয়ারের নিরাপত্তারক্ষীদের প্রচণ্ড কিল-ঘুষির শিকার হয়েছেন। বেদম চড়চাপড় খেয়েছেন। মজার ব্যাপার, ঢিলটি সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পেলেও পাটকেলটি কিন্তু গুরুত্ব পায়নি। সবাই গুনে বলতে পারছেন, শারদ পাওয়ার একটি চড় খেয়েছেন। কিন্তু বদলে হরবিন্দর কতটি চড় খেয়েছেন সেটি কিন্তু কেউ গোনার প্রয়োজন মনে করছে না। তবে একটি চড়ই পুরো ভারতকে মাতিয়েছে। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে রস করেছেন। রস করতে গিয়ে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতা আন্না হাজারে তো বেফাঁস এক মন্তব্যই করে বসেছেন। চড়ের সংবাদ শুনে তিনি বলে বসেছেন, 'এক হি মারা কেয়া?' তিনি জানতে চেয়েছিলেন, চড় কি একটাই মেরেছিল কি-না। পরে অবশ্য সমালোচনা হওয়ায় তিনি দায়িত্বশীল বক্তব্য দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'সকালে একজন আমাকে খবরটা দেওয়ার পর আমি জানতে চেয়েছিলাম একটাই চড় মেরেছিল কি-না। সেটাকেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। যিনি চড় মেরেছিলেন তিনি হয়তো রাগান্বিত ছিলেন। রাগ ভালো জিনিস নয়। সংবিধান সহিংসতা সমর্থন করে না।' শারদ পাওয়ার চড় খেয়েছেন শুনে আন্না হাজারে হয়তো সত্যিই জানতে চেয়েছিলেন চড় কতটি পড়েছে? কিন্তু ভারতের অনেক আম আদমি এতে খুশি হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বল্গাহারা গতিতে চড়ছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ত্রাহি রব চারদিকে। মানুষ কতটা অসহায় তার পুরো সংবাদ গণমাধ্যমে আসে না। আসলে সে সংবাদের নানা মাত্রা থাকে। হরবিন্দর সিংয়ের পকেটের হিসাব মিলছে না কিন্তু বাজারের নীতি, প্রবৃদ্ধি, ভর্তুকি নানা হিসাবে শেষ পর্যন্ত হরবিন্দরদের পকেটের হিসাব হারিয়ে যায়। তো হরবিন্দর ঠিক করেছেন, খবরটা জানানো দরকার আলাদা করে। আর সে কারণেই বাসা থেকে বেরিয়েছেন মন্ত্রীকে চড় কষাবেন বলে। ঝাঁকের মধ্যে মিশে গিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় বসে থেকেছেন। সুযোগ পেয়ে মেরে দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মন্ত্রীকে এভাবে অপমান করা ঠিক নয়। আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সংবিধানও এটা সমর্থন করে না। কিন্তু এর তো একটা বার্তাও আছে। হরবিন্দর যে বার্তাটা পেঁৗছে দিতে চাইলেন তার সমাধান না করে যদি তাকে আলাদা করে শাস্তি দেওয়া হয় তবে সেটি কেমন হবে? ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে এ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে, হরবিন্দর এখন নায়ক। অনেকেই স্মরণ করছেন জর্জ বুশের দিকে জুতা ছুড়ে মারা সেই ইরাকি সাংবাদিকের কথা। সে ঘটনাটিকে ঐতিহাসিক আখ্যা দেওয়া হয়েছে। গুণে-মানে হয়তো এটি অনেক ছোট। কিন্তু হরবিন্দরের নাম অনেকেই যে মনে রাখতে চেষ্টা করবেন, তা নিশ্চিত।

Saturday, November 12, 2011

কিঁউ কি সাস ভি কাভি বহু থি

কিঁউ কি সাস ভি কাভি বহু থি'_ এই হিন্দি বাক্যটির অর্থ 'কেননা শাশুড়িও কোনো এক সময় বউ ছিলেন।' হিন্দি এই বাক্যটি রীতিমতো একটি বাগ্ধারায় পরিণত হয়েছে একটি টিভি সিরিয়ালের কল্যাণে। সিরিয়ালের নাম 'কিঁউ কি সাস ভি কাভি বহু থি'। স্টার প্লাসে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বকালের সেরা দশটি অনুষ্ঠানের প্রথমটি এই সিরিয়াল। শুধু তাই নয়, এশিয়ার সবচেয়ে বেশি দেখা ও সবচেয়ে বেশি পুরস্কার পাওয়া সোপ অপেরাও এটি। হিন্দি ভাষায় প্রচারিত এই সিরিয়ালটি প্রযোজনা করেছিল একতা কাপুর ও শোভা কাপুরের বালাজি টেলিফিল্মস। ২০০০-০৮ পর্যন্ত ৮ বছরে এর এক হাজার ৮৩০টি পর্ব প্রচারিত হয়েছিল। পর্বগুলো পরিচালনা করেছেন ২০ জনেরও বেশি পরিচালক। সিরিয়ালটিতে একটি পরিবারের পাঁচ প্রজন্মের ইতিহাস দেখানো হয়েছে। গৃহবিবাদ, গৃহদাহ ও গৃহদুর্ঘটই এই সিরিয়ালের বিষয়। তবে মূল থিম অবশ্যই বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক। সত্য যে, উপমহাদেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেক শাশুড়িই একদিন নববধূ হিসেবে স্বামীর ঘরে আসেন। শাশুড়ির সঙ্গ পান, তার কাছে সংসারের প্রয়োজনীয় দীক্ষাও নেন। আবার গৃহের কর্তৃত্ব নিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে বউয়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কাহিনীও আছে। এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে একদিন নববধূও শাশুড়ি হন। উপমহাদেশের নারীদের এই রূপান্তর বহু বছর ধরে চলছে। দায়িত্বের বণ্টনও নতুন কিছু নয়। তারপরও পরিবারগুলোতে বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব খুব আলোচিত বিষয়। আলোচিত শুধু নয়, রীতিমতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এ এমনই চাঞ্চল্যকর যে, এ নিয়ে নাটক-সিনেমা হলে তা জনপ্রিয় হবেই এটা নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়। কিঁউ কি সাস ভির সাফল্যের পেছনে খুব গূঢ় রহস্য খোঁজার দরকার নেই বলেই মনে হয়। ভারতের মতো বাংলাদেশেও গৃহবধূরা প্রতি সন্ধ্যায় পরম আগ্রহে স্টার খুলে বসেছেন সোপ অপেরাটি দেখার জন্য। শাশুড়িরা যেমন গৃহবধূরাও তেমন নিজেদের পছন্দের বিষয়টি সেখানে পেয়েছেন। শুধু এই সিরিয়াল নয়, বহু হিন্দি সিরিয়ালের সাফল্যের মূল সূত্রও ওই গৃহবিবাদ। কেউ কেউ বলেন, হিন্দি সিরিয়ালের গৃহবিবাদ আমাদের দেশে গৃহবিবাদকে উস্কে দিচ্ছে। সরাসরি হয়তো দোষ দেওয়া যাবে না এভাবে। কিন্তু পরোক্ষে হলেও কিছু প্রভাব তো পড়ছে। ঈদের বাজারে গেলে মেয়েদের পোশাক-আশাক যত দেখা যায় তার বেশিরভাগই হিন্দি সিরিয়াল বা সিনেমা প্রভাবিত। শুধু মেয়েদের পোশাক কেন? ছেলেদের অজস্র পোশাক বাজারজাত হচ্ছে যা শুধু হিন্দি সিরিয়ালের চরিত্রদেরই পরতে দেখা যায়। সিরিয়ালগুলোতে যেমন দু'দিন পরপর আনন্দ-আয়োজন লেগে থাকে, তাতে সেখানকার চরিত্রদের নানা রকম শেরওয়ানি, পাঞ্জাবি, দোপাট্টা, চুড়িদার পরতে হয় বটে। কিন্তু সিরিয়াল দেখে যারা পোশাক কেনেন তাদের হয়তো বছরে এক-দু'বারই সেগুলো পরার অবকাশ জোটে। হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাব কতটা পড়ছে আমাদের সমাজে তা আলোচনার বিষয় নয়। বিষয় বউ-শাশুড়ি সম্পর্কই। ভেবেছিলাম, শুধু সিরিয়ালের নামটি বলে প্রসঙ্গে আসব। কিন্তু বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক আর হিন্দি সিরিয়াল যেমন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িয়ে আছে তাতে আলাপের একটু বিস্তার না করলে কি চলে? ঘটনা জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার। সেখানে শাখারগঞ্জ-চৌধুরীপাড়ায় এক অভিনব আয়োজন হয়েছে সম্প্রতি। সেখানে বউ-শাশুড়ির মেলা হয়েছে। এলাকার গৃহবধূ ও শাশুড়িরা মেলা করেছেন। হৈ-হল্লা করে সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু অভিনব এ আয়োজন অনেককে আকৃষ্ট করেছে। হাজারো মানুষ মেলা দেখতে এসেছেন। হঠাৎ করে বউ-শাশুড়ি মেলার কারণ কী? হয়তো ঈদের সাইড এফেক্ট। শহর থেকে লোকেরা ঘরে ফিরেছে। এ অবকাশে ভিন্নধর্মী এ আয়োজনের আইডিয়া খেলে গেছে কারও মনে। কিন্তু এমন মেলা সত্যিকার অর্থেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে পরিবারগুলোতে। বউ-শাশুড়ি সংঘাত পরিবারগুলোতে যে গৃহদাহ তৈরি করে তাতে এ মেলাগুলো আলাপ-আলোচনার খোলামেলা পরিবেশ তৈরি করতে পারে। আর ওই বাগ্ধারাটিও কিন্তু ফেলনা নয়। কিঁউ কি সাস ভি কাভি বহু থি। শাশুড়িও একদিন বউ ছিলেন_ এটি যেমন সত্য তেমনি এও সত্য যে, বউও একদিন শাশুড়ি
হতে পারেন। ফলে মিলেমিশে থাকাটাই শ্রেয়।

Friday, November 11, 2011

১১/১১/১১

বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে আজ কার্তিকের ২৭। সন ১৪১৮। অতীতের হাজারো কার্তিকের মতো এ কার্তিকেরও বিশেষত্ব নেই। বিশেষত্ব একেবারেই নেই তা নয়_ সাম্প্রতিক তীব্র তাপদাহের পর আবহাওয়া এখন অনেকটাই সহনীয়। কার্তিকের নবান্নের দেশে এখন শীতের আমেজ। গ্রামে ইতিমধ্যে শীত পড়ে গেছে। কার্বনপ্রবণ উষ্ণ শহুরে এলাকাগুলোতেও এখন হিমেল উত্তুরে হাওয়ার রেশ। সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে ২৭ কার্তিক ১৪১৮'র বিশেষ গুরুত্ব থাকার কথা নয়। বাঙালির জীবনে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব গণনা, কুষ্ঠি বিচার, মঙ্গল-অমঙ্গল নির্ধারণ এখনও বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারেই হয়। তবে বাংলা ক্যালেন্ডারের দাপট এখন সীমিত পর্যায়ে। জীবনের বড় জায়গাজুড়ে এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের দাপট। এ ক্যালেন্ডারের ভালো-মন্দ, গ্রহ-নক্ষত্র এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ। কেউ কেউ মনে করেন, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হবে। অগ্ন্যুৎপাত, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, আগ্নেয়গিরি, ঝঞ্ঝা পৃথিবীতে আকুল করে তুলে শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাবে। এ নিয়ে বই লেখা হয়েছে, সিনেমাও তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশেও কেউ কেউ এ বিশ্বাস পোষণ করছেন। এ ক্যালেন্ডারের সংখ্যাতত্ত্ব এখন অনেক মানুষের বিশ্বাসের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। যেমন ঘটেছে ২০১১ সালের ৩১৫তম দিনটিকে নিয়ে। বছর শেষ হতে বাকি মাত্র ৫০ দিন। অর্থাৎ পৃথিবী ধ্বংসের বহুল প্রচারিত বছরটি এখনও খানিক দূরে। কিন্তু ১১/১১/১১-তে এসে বিশ্বব্যাপী গোল বেধেছে। সারা পৃথিবীতে দিনটি নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। জল্পনার ঢেউ এসে লেগেছে আমাদের দেশেও। কোনো কোনো ভবিষ্যদ্বাণী বলছে, ২০১২ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না_ ১১/১১/১১ অর্থাৎ আজকেই পৃথিবীর শেষ দিন। শুক্রবার হওয়ায় এ আশঙ্কা অনেকটাই বেড়ে গেছে। অবশ্য পৃথিবী ধ্বংসের মতটা তত প্রচার পায়নি। গুরুত্ব হয়েছে বেশ কিছু ইতিবাচক ব্যাপার। ১১ সংখ্যাটি বহু মানুষের কাছে সৌভাগ্যের সূচক। আর আজ তো ক্যালেন্ডারে ১১'র আধিপত্য। পুরো ১০০ বছর পর এমন এগারোময় দিন এলো। ১৯১১ সালে এমনকি ১৮১১ সালেও এমন দিন এসেছিল। আগামী ১০০ বছর পরপর এমন দিন আসতেই থাকবে। কিন্তু মানুষের জীবনের জন্য ১০০ বছর এখনও লম্বা সময়। তাই অনেকের ভাগ্যেই তিনটা ১১ দেখার ভাগ্য হয় না। যাদের হয়েছে তারা দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে চাইছেন। সৌভাগ্যের দিন হিসেবে অনেকে চাইছেন এ দিনে বিয়ে করতে। গর্ভবতীরা মা হতে চাইছেন এ দিনটিতে। পৃথিবীর অনেক স্থানে রীতিমতো বিয়ে আর সন্তান প্রসবের বিপুল প্রস্তুতি চলছে। সবার নজর বিভিন্ন অদ্ভুত ঘটনার দিকে। যেমন খবর মিলেছে এক জোড়া যমজ শিশু আজকেই ১১ বছরে পড়তে যাচ্ছে। তাদের জীবনে ১১ বিশেষ প্রসঙ্গ হয়ে আসছে। ভারতে বাজিকররা ব্যস্ত অনাগত এক শিশুকে নিয়ে। অমিতাভ বচ্চনের নাতি, অভিষেক আর ঐশ্বরিয়ার যমজ কন্যার জন্ম হওয়ার কথা নাকি ১১ নভেম্বর। এ নিয়ে বাজিকররা কোটি কোটি টাকা ইতিমধ্যে লগি্ন করে ফেলেছেন। ১১ উদ্যাপনের পেছনে মানুষের নির্ভেজাল আনন্দ উপভোগের আয়োজন আছে সত্য, কিন্তু সঙ্গে আছে অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারেরও নানা প্রভাব। আর এ কুসংস্কারগুলো তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাবে পুরো পৃথিবীতেই ছড়িয়েছে। ফলে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার মতো বড় ঘটনা না ঘটলেও ছোটখাটো কিছু অঘটন যে ঘটবে তা বলাই বাহুল্য। আজ যা ঘটবে তা আগামীকালের সংবাদপত্রে নিশ্চয় আমরা জানব। কিন্তু ১৯১১ সালের ১১ নভেম্বর কী ঘটেছিল তা জেনে নেওয়া যেতে পারে। তখন পৃথিবী এত কানেকটেড ছিল না। ফলে সারা পৃথিবীর কোথায় কী ঘটেছিল তা জেনে নেওয়া কঠিন। এটুকু জানা যায়, এদিনে যুক্তরাষ্ট্রে মিড-ওয়েস্টার্ন রাজ্যগুলোতে তাপমাত্রা বিকেলে সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়েছিল আর রাতে সর্বনিম্ন হয়েছিল। খুব অবাক করার ব্যাপার বটে। এবার তেমন অবাক করার ব্যাপার ঘটবে কি? পৃথিবীর জন্য শুভ ও সুন্দর কিছু ঘটুক, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। বিবাহ ও সন্তান জন্মদানের নানা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে প্রিয় পৃথিবীর কল্যাণই কামনা করছি এবং সেটাই আপাতত সুখবর।

Monday, October 31, 2011

তাতা

তাতা বললে সহসা তাকে কারও চিনতে পারার কথা নয়। যদি বলা হয় মানিকের বাবা তাহলেও চেনা কঠিন। নামডাক ও ডাকনামের মধ্যে একটা সংঘর্ষ আছে। কারও নামডাক হলে তার ডাকনামটা সকলেই ভুলে যায়। যেমন সুকুমার রায়ের ডাকনাম যে তাতা সেটি তার নামডাকের পর অনেকেই ভুলে গেছে। তাকে যারা ডাকনামে ডাকতেন তাদের অনুপস্থিতি বড় কারণ বটে। কিন্তু শিশুদের কাছে ডাকনামের গুরুত্ব অনেক। ছোটরা ডাকনামেই অভ্যস্ত। ফলে তারা যখন শোনে যার ছড়া পড়ে তারা খুব পছন্দ করছে তার নাম তাতা, তবে নিজেদের একজন ভেবে নিতে সহজ হওয়ার কথা। তাতার কথা লোকে ভুলে গেলেও তাতার ছেলে মানিকের কথা অবশ্য অনেকেরই মনে থাকার কথা। চলচ্চিত্র অঙ্গনে এমন বহু মানুষ এখনও জীবিত যারা সত্যজিৎ রায়কে মানিকদা বলে ডাকতেন। তারা যখন সত্যজিৎ প্রসঙ্গে লিখেছেন তখন আমরাও জেনে গেছি যে ছোটদের প্রিয় চলচ্চিত্রকারের ডাকনাম মানিক। সুকুমার ও সত্যজিৎ দু'জনে বড়দেরও বেশ প্রিয়। সুকুমারের বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও ছোটদের বিশেষ পছন্দের নাম। রায় পরিবারের কথা বিশেষভাবে উঠছে, কারণ গতকাল ছিল তাতা অর্থাৎ সুকুমার রায়ের জন্মদিন। জন্মদিনের বাসি লেখা লেখার রেওয়াজ পত্রিকায় নেই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশে বোধহয় কারোই মনে ছিল না, কবে সুকুমার রায়ের জন্মদিন। আমারও মনে ছিল না। জন্ম ও মৃত্যুদিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের আয়োজন কয়েকটা তারিখকে কেন্দ্র করে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ২৫ বৈশাখ, ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২২ শ্রাবণ আমরা বেশ ঘটা করে পালন করি। এ দিনগুলোকে একেবারে জাতীয়ভাবে পালনীয় দিন বটে। কোনো কোনো দিবস ঘিরে মাস এমনকি বছরভর অনুষ্ঠানও হয়। মজার ব্যাপার, অনেকের অনেক পছন্দের কবি জীবনানন্দের জন্ম-মৃত্যুদিন কিন্তু অত ঘটা করে পালিত হয় না। এর কারণ কী? কেন বাৎসরিক রিচুয়ালের অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না স্মরণযোগ্য বাকি দিনগুলো? শুধু দু'চারজন বড় কবিকে স্মরণ করলেই কি দায় চুকে যায়? নতুন প্রজন্মের কাছে অন্যদের কথা পেঁৗছাবার দায় কার? সমালোচকরা বলেন, রিচুয়াল মেনে কাউকে স্মরণ করলে তাকে আত্মস্থ করা যায় না। এটা বহিরঙ্গের দিক। কিন্তু অন্তরে কোনো সাহিত্যিককে ধারণ করতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে, সাহিত্যকে ধারণ করতে হবে। কিন্তু রিচুয়ালের বহিরঙ্গেও কিন্তু অনেক মেসেজ থাকে। স্কুল পড়ূয়া শিক্ষার্থীরা কিন্তু এসব দেখে বুঝতে শেখে। তাদের কাছে, প্রিয় ও প্রয়োজনীয় মানুষগুলোকে তুলে ধরাও কিন্তু কর্তব্য। সেদিক থেকে সুকুমার রায় শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় সাহিত্যিক। প্রিয় তো বটেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় বলার পেছনে বিশেষ কারণ হলো, সুকুমার রায়ের গুরুত্ব ছোটদের জন্য এখনও সমান। অনেকেই বলেন, ছোটদের জন্য লেখা খুব বেশি এগোয়নি। কোথায় যেন থমকে আছে। অথচ শিশুদের জন্য তো ছড়া দরকার। গল্প দরকার। এখনও ছড়ার জন্য সুকুমারের কাছেই হাত পাততে হয়। ইংরেজি ভাষায় নার্সারি রাইমস বলে যে ছড়ার বিপুল সম্ভার আছে তার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন বাংলা ছড়া নেই।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ইংরেজি ছড়াগুলো ইংরেজি ভাষাভাষী সব দেশে এমনকি ইংরেজি মাধ্যমের সব স্কুলে ছড়িয়ে গেছে। তুলনায় বাংলা ছড়ার কী হাল? সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, শিশুদের জন্য সহজবোধ্য ছড়া কয়টি? তাই ছোটদের স্বার্থেই সুকুমার রায়কে স্মরণ করা দরকার। এখনও যদি ছোটদের জন্য সমৃদ্ধ সাহিত্যের ভাণ্ডার তৈরি না হয়, তবে কবে হবে? সুকুমার এখানে আমাদের অনেক কিছু শেখাতেও পারেন।

Thursday, October 27, 2011

কে হতে চায় কোটিপতি?

ভারতের সনি বা বাংলাদেশের দেশটিভিতে যারা 'কৌন বানেগা ক্রোড়পতি' বা 'কে হতে চায় কোটিপতি' অনুষ্ঠান দুটির নিয়মিত দর্শক, তাদের অনেকের কাছে হয়তো এমন কুইজ শোতে অংশ নিয়ে কোটিপতি হওয়াটাই সহজ পন্থা। কিন্তু কুইজ শো ছাড়া কোটিপতি হওয়ার আর উপায় কী? শোনা যায়, দেশে এখন হাজার হাজার কোটিপতি আছে। তাদের কাছে জেনে নেওয়া যেতে পারে কোটিপতি হওয়ার উপায়। কিন্তু কোটিপতিরা কোটিপতি হওয়ার গল্প কি সহজে বলেন? টাকা বানানোর জাদুর প্রদীপ যাদের হাতে তারা সহজে প্রদীপের রহস্য ফাঁস করতে চান না। ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়। যারা বাঁকা চোখে দেখতে অভ্যস্ত তারা বলেন, এমন অনেক কোটিপতি আছেন যারা কখনও কোটিপতি হওয়ার গল্পটি বলতে পারবেন না। কেননা, কোটিপতি হওয়ার অনেক পথই বন্ধুর, সাধারণ দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য বলেও বিবেচিত হতে পারে। তবু কিছু গল্প প্রেরণাদায়ক। সে গল্পগুলোও বলা যায়, শোনা যায়। সত্যি কথা বলতে, নতুন প্রজন্মের কাছে কোটিপতি হওয়ার ভালো গল্পগুলো পেঁৗছানো দরকার। শচীন বনশাল ও বিনি্ন বনশালের গল্প এ দেশের কোটিপতিদের উৎসাহিত করতে পারে। গল্পটি ছাপা হয়েছে ইকোনমিস্টের চলতি সংখ্যায়_ ভারতের বাণিজ্য নিয়ে বিশেষ আয়োজনে। এ দু'জন ভাই নন, আত্মীয়ও নন। কিন্তু দু'জনের মিল দারুণ। দু'জনেই বড় হয়েছেন চণ্ডীগড়ে, দিলি্ল আইআইটিতে পড়েছেন, একটি আমেরিকান ফার্মে কাজ করেছেন। দুই বছর কাজ করার পর নিজেদের ১০ হাজার ডলারের সঞ্চয় নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে শুরু করেছেন ই-কমার্সের একটি উদ্যোগ। ব্যবসা শুরুর সাল ২০০৫। অ্যামাজন ডটকমের মতো একটি সাইট শুরু করেছিলেন তারা। নাম ফ্লিপকার্ট। বই বিক্রি দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে আরও পণ্য যুক্ত হয়েছে তাদের তালিকায়। এখন ওয়েবসাইটের রেজিস্টার্ড ইউজার ১০ লাখ। আর মাসে বিক্রি এক কোটি ডলার। এমন অবস্থানে পেঁৗছাতে দীর্ঘ একটি পথ পাড়ি দিয়েছে ফ্লিপকার্ট। ভারতের ই-কমার্সের অবস্থা এখন কিছুটা উন্নত হলেও পাঁচ বছর আগে আমাদের দেশের মতোই ছিল। অনলাইনে কেনাকাটা প্রায় অসম্ভব কাজ। অনলাইনে কেনাকাটার জন্য অনলাইন ব্যাংকি বা ক্রেডিট কার্ড সিস্টেম উপযুক্ত নয়। পে-পালের মতো নিরাপদ কেনাকাটার সাইট ভারতে চালু কিন্তু খুব বেশি মানুষ এটি ব্যবহার করেন না। অনলাইনে কিছু বিক্রি করে টাকা আয় করা কঠিন। শুধু পেমেন্ট বা ব্যাংকিংই নয়, ক্রেতা যে জিনিসটি কিনলেন সেটি ক্রেতার কাছে পেঁৗছানোও কঠিন। কেননা, ভারতে ডিএইচএলের মতো কুরিয়ার সার্ভিস নেই। স্থানীয় কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর ওপর শেষ পর্যন্ত নির্ভর করতে পারেনি ফ্লিপকার্ট। ফলে তারা চালু করেছে এক অভিনব পদ্ধতি_ পিওডি_ পেমেন্ট অন ডেলিভারি। ফ্লিপকার্ট ডটকমে কেউ কোনো বইয়ের অর্ডার করলে দুই থেকে চারদিনের মধ্যে ফ্লিপকার্টের কর্মী পেঁৗছে যাবে ক্রেতার বাড়িতে, বই বুঝিয়ে দিয়ে দাম নিয়ে আসবে। এভাবে অনলাইন পেমেন্টের জটিলতা এবং পেঁৗছানোর সমস্যা দুটিকেই জয় করেছে ফ্লিপকার্ট। অবশ্য যারা ক্রেডিট কার্ড বা অনলাইন ব্যাংকিং বা পে-পালের মাধ্যমে কিনতে চান তাদেরও সুব্যবস্থা আছে। কিন্তু মাল পেঁৗছানোর দায়িত্ব ফ্লিপকার্টের কর্মীদের। আর তাদের তৎপরতা দেখে বড় গ্রুপ ও কোম্পানিগুলোও এখন ফ্লিপকার্টের মাধ্যমে বিকিকিনি করতে উৎসাহী হচ্ছে। ফ্লিপকার্টকে বলা হচ্ছে, আরেক ইনফসিস। ভারতীয় উদ্যোগে বিশাল এক আইটি সংস্থা ইনফসিস। প্রশ্ন হলো, শচীন ও বিনি্নর মতো উদ্যোগ কি বাংলাদেশে শুরু হতে পারে? ভারতের সঙ্গে তুলনীয় হলেও আমাদের অবস্থা অনেক খারাপ। এখানে কেউ যদি একটি ওয়েবসাইট খুলতে চান তবে সোজাসুজি ডোমেইন হোস্টিং পর্যন্ত কিনতে পারবেন না। কিছু কিনে দেশের বাইরে টাকা পাঠাবার সহজ উপায় নেই। অনলাইন ব্যাংকিং বলে যে ব্যাপারের কথা শোনা যায় তার সঙ্গে ই-কমার্সের যোগাযোগ সামান্য। পে-পাল চালু হয়নি হাজার দাবি সত্ত্বেও। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে অনলাইনে কেনাকাটার নজির খুব কম। এ অবস্থায় অ্যামাজনের মতো সাইট এখানে চালু করা মুশকিল। সে ক্ষেত্রে ফ্লিপকার্ট বিশেষ সহায়ক হতে পারে। বিশেষ করে পিওডি সিস্টেম জ্যামের শহরে জনপ্রিয় হতে পারে।

Monday, October 24, 2011

আরব রাজনীতির পিকাসো

লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির পতন তখন আসন্ন। সবাই ভাবছেন ক্ষমতার চূড়া থেকে পতনের পর এখন কী করবেন কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি? গণমাধ্যমে জোর গুজব দেশ ছেড়ে সপরিবারে পালাচ্ছেন গাদ্দাফি। সে সময়ও তিনি বলেছেন, 'আমি এই ভূমি ছেড়ে কোথাও যাব না। এখানেই যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হব।' দেশবাসীর উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন, যাতে তারা ঘর ছেড়ে ময়দানে, রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ করেন বিদ্রোহী সেনাদের। দীর্ঘদিনের অপশাসনে ক্লান্ত, ত্যক্ত-বিরক্ত মানুষ তার পক্ষে নেমে আসেনি। বরং বিদ্রোহীদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে। কিন্তু কথা রেখেছেন গাদ্দাফি। ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের (এনটিসি) যোদ্ধারা যখন একের পর এক শহরের পতন ঘটিয়ে গাদ্দাফির জন্মস্থান সিরতের দিকে এগোচ্ছিল, তখনও তিনি দেশে ছিলেন। সিরতের চূড়ান্ত পতনের সময়ও তিনি যুদ্ধরত ছিলেন। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, সিরতেই তিনি আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকৃত অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এনটিসির শীর্ষ মুখপাত্র মাহমুদ শাম্মাম বলেছেন, কর্নেল গাদ্দাফি মারা গেছেন। 'আজ নতুন এক লিবিয়ার জন্ম হলো। এটাই প্রকৃত মুক্তির দিন। আমরা তার বিচার করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলাম। আল্লাহর হয়তো অন্য ইচ্ছা ছিল।' এভাবেই তার মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেছেন শাম্মাম। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর পর আরব বিশ্বে তিনিই ছিলেন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর চক্ষুশূল একমাত্র জীবিত নেতা। ১৩ ডিসেম্বর ২০০৩-এ গ্রেফতারের পর বিচারের মাধ্যমে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর ২০০৬ তারিখে। কর্নেল গাদ্দাফি কোনো বিচারের মুখোমুখি হতে পারলেন না। ২০ অক্টোবর ২০১১ তারিখটিই ইতিহাসে তার মৃত্যুদিন হিসেবে লেখা
থাকবে। তবে, অনেক বিষয়ে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তার মিল। সাদ্দামের মতো গাদ্দাফিও আত্মরক্ষা ও পলায়নের জন্য পাতালপুরী ও পাতালপথ তৈরি করেছিলেন। সেগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে আসেনি। ধরা পড়ার মুহূর্তে দুই নেতাই গর্তে লুকিয়ে আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা করেছেন_ এও এক আশ্চর্য মিল।
সংবাদমাধ্যম তাকে বলে লিবীয় একনায়ক। কেউ কেউ বলে লিবীয় নেতা। লিবিয়ায় সীমিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর তার পদবি হয় 'ব্রাদার লিডার অ্যান্ড দ্য গাইড অব রেভলিউশন'_ অর্থাৎ নেতাভাই ও বিপ্লবের পথপ্রদর্শক। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য গণআন্দোলন শুরু হলে গাদ্দাফি বলেছিলেন তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট নন। তিনি লিবীয়দের স্বাভাবিক নেতা। দেশের সবাই তাকে ভালোবাসে। তাই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়।
কেউ তাকে বলেছেন খামখেয়ালি, গোঁড়া, কেউ বলেছেন পাগল। তার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কও তৈরি করেছেন অনেক নেতা। সম্পর্কের প্রয়োজন ফুরালে আবার তাকেই পাগল বলে গালি দিয়েছেন। গাদ্দাফি বহু বছর পশ্চিমাদের কাছে শত্রু বলে বিবেচিত হলেও নাইন ইলেভেনের পর তার ও পশ্চিমাদের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটে। তিনিই প্রথম ওসামা বিন লাদেনের গ্রেফতার দাবি করেছিলেন। লিবিয়ার গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছিলেন। রীতিমতো প্রেমে পড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসের। তাকে প্রিয় আফ্রিকান নারী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। লিবিয়ার এই পরিবর্তিত মনোভাবকে স্বাগত জানিয়েছিল ওয়াশিংটন, লন্ডনসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছিল। এনটিসির যোদ্ধারা আগস্টে গাদ্দাফির প্রাসাদের পতন ঘটানোর পর বেশ কিছু নথিপত্র মিলেছে যাতে বোঝা যায় শেষ সময়ে পাশ্চাত্য শক্তিগুলো তাকে রক্ষার চেষ্টাও করেছিল।
নিজের ও নিজের দেশের জন্য পৃথক একটি রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করেছিলেন গাদ্দাফি। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ক্ষমতা দখল করার পর নিজেকে মরুর বেদুইন দার্শনিক ও রাজা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি লিবিয়ার নতুন নাম দিয়েছিলেন_ দ্য গ্রেট সোশালিস্ট পিপলস লিবিয়ান জামাহিরিয়া। আরবি জামাহিরিয়ার অর্থ গণপ্রজাতন্ত্র। তার দর্শন অনুসারে জনগণ ক্ষমতাশালী হলে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তিনি স্থায়ী বিপ্লবের দর্শন প্রচার করেছিলেন যা বাস্তবায়িত হলে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র বিতাড়িত হবে।
দেশের মানুষের অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে মাও সে তুংয়ের রেড বুকের আদলে লিখেছিলেন গ্রিন বুক। তাতে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের নানা কৌশল ছিল, সঙ্গে ছিল দেশ গড়ার স্বপ্নও।
ভিন্নধর্মী পোশাক-আশাক ও কথাবার্তার কারণে নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে অভিহিত করেছিল বৃদ্ধ রকস্টার বলে। যে কোনো আন্তর্জাতিক আসরে সবার নজর কাড়ার মতো ব্যক্তিত্ব ছিল তার। ব্যতিক্রমধর্মী পোশাক, সোজাসাপ্টা কথাবার্তা আর চমকে দেওয়ার মতো ব্যবহার ছিল তার। প্যারিস, রোম এমনকি নিউ ইয়র্ক যেখানেই যেতেন সেখানেই সাদা তাঁবু সঙ্গে নিতেন তিনি। তাঁবু খাটিয়ে তাতে থাকতেন। তাঁবুর দেয়ালে মরুর খেজুর গাছ, উট এবং গাদ্দাফির বাণী থাকত।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। জাতিসংঘে ২০১০ সালে শেষ যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ আর দুনিয়াজুড়ে তাদের দখলদারিত্বে তীব্র বিরোধিতা ছিল। লিবীয়দের মধ্যে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে তীব্র ঘৃণা ছিল তার মূর্ত রূপ ছিলেন গাদ্দাফি। পশ্চিমের দেশগুলো গাদ্দাফির প্রতিটি পদক্ষেপ খেয়াল করত। তিনি তো বটেই, তার রাজনৈতিক দর্শন, তার দেশে প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীরা পৃথিবীতে অনেক হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত হয়েছে। বিশেষত লকারবি বোমা হামলার জন্য তাকে দায়ী করা হয়। অভিযোগ যাই থাকুক। তিনি যে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সাহসী ছিলেন এ বিষয়ে তার চরম শত্রুও সন্দেহ পোষণ করবে না। একজন আরব বিশ্লেষকের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, তাকে সম্প্রতি আরব রাজনীতির পিকাসো হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। বিশ্বখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোর শিল্পী জীবনে যেমন ছিল ব্লু, রোজ, কিউবিস্ট নানা কালপর্ব তেমনি গাদ্দাফির জীবনেও ছিল প্যান-আরব, ইসলামিস্ট এবং প্যান-আফ্রিকান পর্ব। ৪২ বছরের অধিক সময়ে ক্ষমতায় থাকাকালে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলেছেন গাদ্দাফি। আরব ঐক্য, মুসলিম ঐক্য, আফ্রিকান ঐক্যের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের ধুয়াও তুলেছিলেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে গোপন ও প্রকাশ্য বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৪২ সালে সিরতের কাছে এক আরব বেদুইন তাঁবুতে গাদ্দাফির জন্ম। তিনি ছিলেন গাদ্দাফা নামে আরবদের ছোট এক গোত্রের সন্তান। শৈশবেই তিনি দেখেছেন ইসরায়েলের কাছে আরব বিশ্বের পরাজয়ের নানা নজির। তখন কিশোর হিসেবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার কাছে তখনকার নেতা ছিলেন মিসরের গামাল আবদুল নাসের। ১৯৬১ সালে বেনগাজি মিলিটারি একাডেমীতে প্রশিক্ষণ নেন, ১৯৬৬ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন যুক্তরাজ্যে। যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন তিনি ছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট।
লিবিয়ার ক্ষমতা দখলের উদ্যোগের পেছনেও ছিল কৈশোরের গুরু গামাল আবদুল নাসেরের প্রেরণা। ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর তরুণ অফিসারদের সংগঠিত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন গামাল আবদুল নাসের। তরুণ অফিসারদের তৎপরতা 'ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট' হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। সে আদলেই ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তরুণ অফিসারদের নিয়ে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন গাদ্দাফি।
ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বহুদিন পর্যন্ত আরব জাতিগুলোর মধ্যে ঐক্যের উদ্যোক্তা ছিলেন গাদ্দাফি। তিনি আরব নেতাদের একত্র করার বহু চেষ্টা নিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে পশ্চিমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবে। শেষ পর্যন্ত সে আশা পূর্ণ হয়নি। পশ্চিমাদের কৌশলের কারণেই হোক আর নিজেদের মধ্যকার বিবাদের কারণেই হোক আরব নেতারা একত্র হতে পারেননি। তবে আরব দেশগুলোর বহু মানুষ তাকে স্বাধীনচেতা আরব নেতা হিসেবেই গণ্য করেছে। শুধু আরব দেশগুলো নয়, আরব দুনিয়ার বাইরেও মুসলমানরা তাকে সাদ্দামের মতোই সাহসী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখতেন।
আরব বিশ্বের ঐক্যের স্বপ্ন বিফল হলে তিনি মুসলিম ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। তাতেও তেমন সাড়া মেলেনি। শেষ পর্যন্ত তার উপলব্ধি হয় যে আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার নেতা হিসেবে তার কথা আরবরা শুনবে না। ফলে, আফ্রিকার ঐক্যের দিকেই তার মনোযোগ সরে যায়। তিনি বলেন, আরব ঐক্যের কথা তো অনেক বললাম গত ৪২ বছরে, কেউ বুঝল না। এখন আফ্রিকান ঐক্যই আমার লক্ষ্য। এ উপলব্ধি থেকে তিনি আফ্রিকান জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন এবং তাতে কিছুটা সফলও হন। সাম্প্রতিক সংকটে আফ্রিকার নেতা ও গোত্রপ্রধানদের অনেকেই তার পাশে ছিলেন। তার একটি স্বপ্ন আফ্রিকান জাতিগুলো পূরণ করতে পারেনি। তিনি চেয়েছিলেন পুরো আফ্রিকার রাজাদের রাজা হতে। সে আশা পূরণ হয়নি।
যখন তিনি হতে চেয়েছিলেন আফ্রিকার রাজাদের রাজা, তখন নিজের দেশেই তার সিংহাসন টলোমলো। ৪২ বছর তিনি লিবিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ১৯৫৯ সালে তেলের খনি আবিষ্কারের আগে লিবিয়া দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু তেল আবিষ্কারের এক দশক পর্যন্ত তাদের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থানের পর লিবীয় সরকার তেল কোম্পানিগুলোতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য করে। লিবিয়ার সাফল্য তখন অন্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকেও উৎসাহিত করেছিল। রাজস্ব আয় বেড়ে যাওয়ার পর রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুল, বাড়িঘর বানাতে শুরু করে গাদ্দাফি সরকার। দেশকে সবুজায়ন করার বিপুল উদ্যোগ নেয়। ১৯৬৯ সালে লিবীয়দের গড় আয়ু ছিল ৫১ বছর, এখন সেটি ৭৪-এ উন্নীত। স্বাক্ষরতার হার এখন ৮৮ শতাংশ। মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১২ হাজার ডলারে পেঁৗছেছে। কিন্তু গণতন্ত্র, আধুনিকতা আর মুক্তির স্বাদ দিতে পারেনি লিবিয়ার জনগণ। এজন্য একা গাদ্দাফিকে দোষারোপ করছেন না বিশ্লেষকরা। আরব বিশ্বের অধিকাংশ দেশ গণতন্ত্রবঞ্চিত। গণতান্ত্রিক অধিকার সেখানে সীমিত। ফলে, নতুন যুগের হাওয়া লেগে যখন তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়া পর্যন্ত লণ্ডভণ্ড হতে থাকল তখন গাদ্দাফির লৌহশাসন অবসানের বীণাও বেজে উঠল। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি গাদ্দাফি। নতুন যুগের চাওয়া অনুসারে নিজেকে ও দেশকে পরিচালনা করতে পারেননি। লিবিয়ায় কোনো সংসদ নেই, একক সামরিক নেতৃত্ব নেই, রাজনৈতিক দল নেই, কোনো গণসংগঠন নেই, নাগরিক সমাজ নেই, এমনকি কোনো এনজিও-ও নেই। একক শাসন পাকাপোক্ত করতে দীর্ঘদিন সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছেন তিনি। দেশবাসীর গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিহত করতে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছেন। সেই যুদ্ধের পরিণতিতেই বিদায় নিতে হলো তাকে, হাজারো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। কেননা, মুক্তির জন্য দেশবাসীর চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রামে প্রধান শত্রু তিনি। আরব বেদুইন তাঁবুতে যে ইতিহাসের শুরু হয়েছিল একদিন সেই তাঁবুর কাছে সে ইতিহাসের যবনিকাপাত ঘটল। গাদ্দাফির পর নতুন যুগের সূচনা ঘটল বটে কিন্তু লিবিয়া কী মুক্ত হলো নাকি নতুন শৃঙ্খলে জড়িয়ে পড়ল সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে এখনই।

Wednesday, October 19, 2011

মহাবন্যা

বন্যাপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের বিশেষ পরিচয় আছে। শোনা যায়, এক সময় দেশের বাইরে বাংলাদেশের অধিবাসী বলে পরিচয় দিলেই বিদেশিদের মুখে মেঘ করে আসত। মুহূর্তেই তারা ভেবে বসতেন এ লোক নিশ্চয়ই বানভাসি, নয়তো সাইক্লোনতাড়িত, নয়তো কোনো ঝড়ে এর ভিটেমাটি উচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখনও এই পরিচয় পুরোটা ঘোচেনি। তবে দুর্যোগতাড়িত বাঙালির আরও নানা পরিচয় জুটেছে বিশ্বের দরবারে। আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিচয় আছে। সঙ্গে আছে প্রবাসী, অনাবাসীদের নানা সুকৃতিও। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বললে বন্যায় প্লাবিত সেই বিস্তীর্ণ ভূভাগের কথা সহসা চোখে ভাসে না। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যা কম হয়েছে। কিন্তু বন্যার বাস্তবতা তিরোহিত হয়েছে বলে মনে হয় না। এ দেশে সবাই জানেন, বর্ষা মৌসুমে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। তাতে জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতিও হতে পারে। দেখার মতো প্রস্তুতি না থাকলেও মনে মনে সবাই প্রস্তুত থাকে। নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই নানা আশঙ্কায় সকলে দিন গুনতে থাকে। এমন বন্যাপ্রবণ দেশ হিসেবে পৃথিবীর কোথায় বন্যা হচ্ছে তার খোঁজখবর রাখাটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিককালের কয়েকটি মহাবন্যার খবরও এ দেশের মানুষকে তেমন দোলা দিয়েছে বলে মনে হয় না। মহাপ্লাবনের কথা আমরা ধর্মগ্রন্থ, পুরাণ, পুরনো সাহিত্য থেকে জানি। সাম্প্রতিক এ ঘটনাগুলোকে অনেকে মহাপ্লাবনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু আপাতত মহাবন্যা বললেই বোঝা যাবে এগুলোর আকার-প্রকার। থাইল্যান্ডের মহাবন্যা প্লাবিত করেছে চাও ফারিয়া নদীর দুই কূল। বন্যা এখনও চলছে। ছড়িয়েছে মেকং নদীতেও। সেপ্টেম্বরে শুরু হয়ে অক্টোবরে বন্যা বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবনকে প্লাবিত, পর্যুদস্ত করে তুলেছে। সেখানকার বন্যার সচিত্র খবর প্রতিদিনই বাইরের পত্রিকাগুলোতে দেখা গেলেও আমাদের পত্রপত্রিকাগুলোতে কিন্তু এখনও দেখার মতো করে ছাপা হচ্ছে না। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার মহাবন্যার তেমন খবরও আমরা দেখিনি। কুইন্সল্যান্ড ও ভিক্টোরিয়ার বিপুল অঞ্চল ২০১০-১১তে পুরো তলিয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি, প্লাবন ও ঢলে মানুষের জীবন অচল হয়ে গিয়েছিল। তখন বাইরের পত্রিকাগুলোতে এ বন্যাকে মহাপ্লাবন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এমনকি সার্কভুক্ত পাকিস্তানের বন্যাও আমাদের এখানে বড় খবর তৈরি করতে পারেনি। প্রায় ৩০ লাখ বর্গমাইল এলাকা প্লাবিত হয়েছিল ২০১০ সালে। জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। পাকিস্তানে বোমা বিস্ফোরণ বা এমন কিছু ঘটলে তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায়। অথচ বন্যায় ২০ মিলিয়ন মানুষ প্রচণ্ড দুর্বিপাকে কাটাল সে খবর আমরা নিলামই না। বন্যা এবারও হয়েছে পাকিস্তানে। ২০১০-এর মতো না হলেও এবারের বন্যার ভয়াবহতাও কম নয়। কিন্তু রাজনৈতিক নানা খবরকে ছাড়িয়ে সে বন্যার খবর আমাদের কানে পশতে পারেনি। পৃথিবীতে বড় ঘটনা ঘটলে তা প্রচার পাওয়ার কথা। এর নিজস্ব রীতি আছে। পাঠক পড়তে চায়। কিন্তু বন্যার ব্যাপারটা আলাদা। আমরা যখন পাশের দেশে এশিয়ায় বন্যার খবর নিচ্ছি না, বিচলিত হচ্ছি না তখন আমাদের দেশে বন্যা, সাইক্লোন হলে পাশের দেশগুলোর মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচার হবে এটি কীভাবে আশা করব? আমরা কি তখন বলব, বাংলাদেশের খবর বিশ্বমিডিয়ায় উপেক্ষিত? আমরা যখন দায়িত্ব পালন করি না তখন অন্যদের দায়িত্ববোধ কীভাবে আশা করব?

Monday, October 17, 2011

সে আগুন ছড়িয়ে গেল

টাইম ম্যাগাজিন সাধারণত তাদের প্রকাশিতব্য সংখ্যাটি ছাপা কাগজে প্রকাশের আগেই ইন্টারনেটে প্রকাশ করে। ইন্টারনেটের সুবিধা হলো সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া, ইউরোপ এবং সাউথ প্যাসিফিকের চারটি সংস্করণই পরপর দেওয়া থাকে। চাইলে যে কেউ যে কোনো সংস্করণ পড়তে পারেন। ছাপা কাগজে যারা টাইম ম্যাগাজিন পড়েন তাদের সে সুযোগ থাকে না। এশিয়ার দেশগুলোর পাঠকরা এশীয় সংস্করণই সাধারণত বাজারে কিনতে পারেন। ইন্টারনেটের সুবিধা হলো, প্রতিটি সংস্করণ মিলিয়ে পড়া যায়। তাতে সূক্ষ্ম ও স্থূল অনেক পার্থক্য থাকে। যেমন, একবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সংস্করণের একটি লেখার শিরোনাম দেওয়া হয়_ 'আফগানিস্তানে আমরা কী করছি?' আবার এশিয়া ও সাউথ প্যাসিফিক সংস্করণে একই লেখার শিরোনাম_ 'আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র কী করছে?' পার্থক্যটা খেয়াল করার মতো। ২৪ অক্টোবর টাইম ম্যাগাজিনের যে সংখ্যা প্রকাশ হবে তার তিনটি সংস্করণের বিষয় একই, সেই আফগানিস্তান_ 'কেন যুক্তরাষ্ট্র কখনও আফগানিস্তানকে বাঁচাবে না?' কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রকাশিত সংস্করণের বিষয়_ 'নিশ্চুপ সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রত্যাবর্তন'। 'দ্য রিটার্ন অব দ্য সাইলেন্ট মেজরিটি'। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে অনেকের আগ্রহ আছে। সবাই বুঝতে চান কী ঘটছে। বোঝার ক্ষেত্রে টাইমের পর্যবেক্ষণ অবশ্যই প্রভাব ফেলে। তারা যেভাবে বিষয়টাকে নিশ্চুপ সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রত্যাবর্তন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তাকে অনেকেই যথার্থ মনে করবেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করপোরেট কোম্পানিগুলোর যে একাধিপত্য তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিতে তাদেরই রমরমা। সাধারণের মতের বিশেষ গুরুত্ব নেই। মত দেওয়ার সুযোগও নেই। সেখানকার সমাজে জনমত বলে যে বিষয়টির অস্তিত্ব তাও করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে বহুকাল সাধারণের কথা সেখানে শোনা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের মন্দার সময় সাধারণ লোকে ভুগেছে, চাকরি হারিয়েছে, কষ্টে দিনযাপন করেছে। কিন্তু খুব বেশি প্রতিবাদ রাস্তায় দেখা যায়নি। কিন্তু এবার মন্দার পূর্বাভাসেই রাস্তা ফুঁসে উঠেছে। মার্কিনরা ওয়ালস্ট্রিট দখলের কর্মসূচি দিয়েছে। ওয়ালস্ট্রিট সেখানে করপোরেট কোম্পানি, ব্যাংক-বীমার আখড়া। ওয়ালস্ট্রিটমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে বার্তা দিতে চাইছে মানুষ। সরকার, রাজনীতি ও দেশ পরিচালনায় করপোরেট আধিপত্যের অবসান চাইছে। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট বা ওয়ালস্ট্রিট দখলের কর্মসূচি যারা পালন করছে তাদের অধিকাংশই তরুণ। কোনো কোনো পত্রিকায় তাদের কিডস বা নিতান্তই বাচ্চা বলে অভিহিত করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, বাচ্চা ছেলেদের আন্দোলন কিন্তু বাচ্চা থেকে ক্রমে বড় হচ্ছে। আমেরিকার আন্দোলন ইউরোপ ছাড়িয়ে আফ্রিকা পর্যন্ত দোলা দিয়েছে। সর্বত্র করপোরেটবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট মুভমেন্ট দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, এবার টুইটার ফেসবুকের ঘরেই আগুন লাগল। টুইটার ফেসবুকের মতো সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর জন্মস্থান আমেরিকা। কিন্তু এ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আরব বিশ্বে একটির পর একটি দেশ স্বাধীন হচ্ছে। তরুণরা বড় বড় আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছে। এমনকি ভারতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানেও প্রযুক্তির বিপুল প্রভাব। এসব দেখে উৎসাহিত হয়েছে আমেরিকার তরুণরা। তারা প্রশ্ন করেছে, ওখানে হলে এখানেও সম্ভব নয় কেন? লেডি গাগার ভক্ত, জাস্টিন বেইবারের অনুরক্ত, ঘরকুনো স্বভাবের, চ্যাটে মগ্ন একটি প্রজন্ম ভার্চুয়াল বাস্তবতার পর্দা ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসছে। পরস্পরের সঙ্গে আগুন ভাগ করে নিচ্ছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তারা কি আনতে পারবে নতুন যুগ? এই পৃথিবীর মধ্যে আরেকটি পৃথিবীর উত্থানের সম্ভাবনা কি আসন্ন?

Tuesday, October 11, 2011

তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী

গায়কদের নিয়ে সাধারণের বিস্ময়ের সীমা নেই। শুধু সাধারণ কেন, অসাধারণ গীতিকার, কবি ও বিদগ্ধ একজন মানুষও যখন প্রশ্ন করেন, তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, তখন বোঝা যায় সুরের এক অদেখা ক্ষমতা আছে। কবির মতো সকলেই অবাক হয়ে গান শোনে। দেখে, সুরের আলো ভুবন ছেয়ে ফেলছে, পাষাণ ছিন্ন করে ব্যাকুল বেগে সুরের সুরধুনী বয়ে চলেছে। অমন সুরে গাইবার আকাঙ্ক্ষা জাগলেও কণ্ঠে সবার সুর মেলে না। কথা বলতে গিয়েও বেধে যায়। ফলে প্রাণ কাঁদে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মানুষও যখন ভাবেন গানের গুণী তার চারধারে সুরের জাল বুনে তাকে এক ফাঁদে ফেলেছেন তখন সাধারণ শ্রোতাদের হাল কী তা বলাই বাহুল্য। আমাদের প্রিয় কবির এ গানের কথা আবারও মনে পড়ে গেল সঙ্গীতগুরু জগজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর খবরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার গানে মজেছে, তার সুরে সুর ভেজেছে_ তার বাণীতে নিজেদের মর্মবেদনার প্রকাশ দেখেছে। এক প্রজন্ম চলে গেলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও তার আবেদন একটুকু কমেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পরিবর্তিত হয়েছেন। গজলের পরবর্তীকালের গায়করা তাকে গুরু মেনেই গেয়েছেন। এমনকি যে বাংলা ভাষায় গজলের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য নেই, সে ভাষাতেও গজল গেয়ে তিনি দর্শকদের মোহিত করেছেন। জগজিৎ সিং বললেই বহু বাঙালির কাছে সেই মধুর বাণী গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে_ বেদনা মধুর হয়ে যায়, তুমি যদি দাও। কিংবা আজ কিছু হতে চলেছে, বেশি কিছু আশা করা ভুল, তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে...। এসব গান বহু বছর ধরে শোনার পরও কারও কি মনে হয়েছে, এ শিল্পী পাঞ্জাবি? এ প্রশ্ন আজও শুনিনি। তাতেই অবাক লাগছে। গায়করা কেমন গুণী? যে ভাষা তার নয়, সে ভাষাতেও তারা হিল্লোল তোলেন কীভাবে? শুধু বাংলাই তো নয়_ মাতৃভাষা পাঞ্জাবির বাইরে তিনি গেয়েছেন হিন্দি, গুজরাটি, উর্দু, সিন্ধি এমনকি নেপালি ভাষাতেও। ভারতের শিল্পীদের মধ্যে যারা বড় তারা সাধারণত এক ভাষায় আটকে থাকতে চান না। এক ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে বহু ভাষায় ছড়িয়ে যেতে চান। তারা সর্বভারতীয় বলে আখ্যায়িত হন। জগজিৎ সিং অবশ্য সর্বভারতীয় শুধু নন, তিনি ভারতের গণ্ডি ছড়িয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সমান জনপ্রিয়। তার মৃত্যুর খবরে ভারতের মতো শোকগ্রস্ত হয়েছেন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মানুষও। কেউ স্মরণ করছেন তার বাংলা গানের কথা। কেউ বলছেন, মির্জা গালিব টিভি সিরিয়ালে গালিবের কথায় তার গানের কথা। কেউবা ভাজছেন হিন্দি সিনেমায় গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর স্মৃতি। ৭০ বছর খুব কম সময় নয়, তার কাজের ব্যাপ্তিও কম নয়। তবু এই সেদিন পর্যন্ত যিনি সচল ছিলেন, স্টেজে লাইভ পারফরম্যান্সে মাতিয়েছেন সবাইকে তার চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কঠিন। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। মানব কী? গায়কের মৃত্যু হলে গান থাকে, কবিদের মৃত্যু হলে কবিতা থাকে। মানব কি তবে মানুষের কর্মের সারাৎসার? যারা জগজিৎ সিংয়ের গান শুনেছেন সরাসরি, দেখেছেন তাকে_ তাদের বাইরে বিপুলসংখ্যক শ্রোতার কাছে তিনি শুধুই গান। এক প্রজন্মের কাছে তিনি গ্রামোফোনের গান, আরেক প্রজন্মের কাছে ক্যাসেট প্লেয়ারের গান, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কমপ্যাক্ট ডিস্কের গান। গান শুনে শুনেই তার সম্পর্কে একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছেন শ্রোতারা। তার মৃত্যু হলেও তিনি থাকবেন তেমনি। তার গান থাকবে। শিল্পের, কল্পনার, অনুভবের জগৎ ফুরাবে না। কিন্তু বাস্তবের যে জগজিৎ সিং তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। আর কোনো দিন লাইভ আসরে তাকে দেখতে পাবে না কেউ।

Wednesday, September 21, 2011

পশ্চিমের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার ৭শ' বছর আগে নালন্দা স্থাপিত হয়েছিল

অমর্ত্য সেনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৩ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তি নিকেতনে। অমর্ত্য সেনের পরিবারের নিবাস ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। কৈশোরে কিছুকাল ঢাকায় থেকেছেন তিনি। এখানেই তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বাংলার সংস্কৃতি, জীবন, মানুষ, অভাব, দুর্ভিক্ষ অমর্ত্য সেনের পরবর্তী কর্মকাফ্ফে বিশেষ ভহৃমিকা পালন করেছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন একাধারে দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, সমাজতাত্ত্বিক হিসেবেও খ্যাত। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও দর্শনের অধ্যাপক তিনি। কয়েক বছর আগে পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা পুনর্গঠনের কাজ হাতে নিয়েছেন তিনি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও ইতিহাসের দায় থেকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৮ সালে নোবেল বিজয়ী এ অর্থনীতিবিদের কাছে নালন্দা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রেরণা। বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম কেন্দ্র নালন্দা পুনর্গঠনে ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি এশীয় দেশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। নালন্দা ভারতের বিহারে অবস্থিত। অতীতে বৌদ্ধ মতবাদ শিক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জ্যোতির্বিদ্যা, রাজনীতি, ওষুধশাস্ত্র এবং শিল্পকলা বিষয়ে পাঠ দেওয়া হতো। ১১৯৭ সালে ধ্বংসের আগে এ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বেরর নানা প্রান্ত থেকে আসা ১০ হাজার শিক্ষার্থী পাঠ গ্রহণ করেন। নালন্দা পুনর্গঠন নিয়ে এশিয়া সোসাইটি পত্রিকায় ড. সেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শ্রেয়া সিনহা। সাক্ষাৎকারটি সমকালের পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করা হলো।  ভাষান্তর : মাহবুব মোর্শেদ


 প্রাচীন নালন্দায় অমর্ত্য ও সহযোগীরা
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্টতা কী ছিল?
প্রাচীন নালন্দা ছিল পুরোপুরি বিদ্যার অনুধ্যানে নিয়োজিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য নিবেদিত। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন ও তা রক্ষার এমন এক ঐতিহ্য নালন্দা তৈরি করেছিল যে চীন, জাপান, কোরিয়া ও পৃথিবীর অন্যান্য স্থান থেকে এখানে শিক্ষার্থীরা আসতে উদ্বুদ্ধ হতেন। শুরুতে বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে এটি চালু হলেও নালন্দা শিক্ষা কার্যক্রম শুধু বৌদ্ধ মতবাদে আবদ্ধ ছিল না। সেক্যুলার বিষয়, যেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ভাষাতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির সুখ্যাতি ছিল। নালন্দা গুপ্তদের মতো হিন্দু রাজাদের আনুকূল্য পেয়েছে, বাংলার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারাও বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সহায়তা দিয়েছেন। কোনো অর্থেই এটি বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না, বরং এটি জ্ঞান ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ঐতিহ্য ধারণ করে মানবিক অশান্তি থেকে মুক্তির পথ খুঁজত। একই সঙ্গে এটি ছিল আধুনিক প্রতিষ্ঠান। নালন্দা সে সময়ে অবশ্যই আধুনিক ছিল। ধর্মের বাইরের বিষয়, যেমন জ্যোতির্বিদ্যা। মানুষের কাজে লাগে এমন বিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হতো, যেমন স্বাস্থ্যসেবা।
নালন্দার ভবিষ্যৎ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?
এ বিশ্ববিদ্যালয় মানবজাতির সামনে যে রূপকল্প হাজির করেছিল তা ছোটবেলায় প্রথম নালন্দা দেখার দিন থেকেই আমার মধ্যে আত্মস্থ হয়ে গিয়েছিল। একদিন এ মহান বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনর্জীবন দেওয়ার স্বপ্ন আমি লালন করতাম। কৈশোরে আমি বারবার নালন্দায় গিয়েছি, প্রতিবারই ভারতীয় সভ্যতার কেন্দ্র বিহারে অবস্থিত এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আমাকে আচ্ছন্ন করেছে। যখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার প্রস্তাব দিলেন আমি তার স্বপ্নের সঙ্গে আমার আকাঙ্ক্ষার মিল দেখে খুব আশ্বস্ত হয়েছিলাম। তারা চেয়েছিলেন পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়টির পাশে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় হোক। আমি সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন দেখতে চাই_ অন্তত এর সূচনা দেখতে চাই। সত্য হলো, বিহার অমোচনীয় দারিদ্র্যসহ প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সংকটে পতিত। এ অবস্থায় নতুন নালন্দা তাদের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি তথ্যপ্রযুক্তি, পরিবেশবিদ্যা, ব্যবস্থাপনার মতো কার্যকর শিল্পগুলো শেখানো হয় তবে তা তাদের কাজে আসবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর বেছে নেওয়া হয়েছে কীভাবে? কোন ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা আপনারা চাচ্ছিলেন?
পূর্ব এশিয়া সম্মেলনের সদস্য দেশগুলোর জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর পদটি উন্মুক্ত থাকার কথা। তারপরও মেন্টর গ্রুপ প্রথম ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে একজন ভারতীয়কেই প্রাধান্য দিয়েছে, যার কাজ করার ও প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। মেন্টর গ্রুপের পক্ষ থেকে সিলেকশন কমিটির কাছে যে চারটি চাওয়া ছিল তা হলো_ ১. প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা ২. প্রশাসনিক সক্ষমতা ৩. নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প বিষয়ে আগ্রহ ও দায়বোধ ৪. নালন্দায় নতুন ক্যাম্পাসে অবস্থান ও এখানে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনের প্রত্যয় এবং বিহারের সমস্যা ও সম্ভাবনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।
সিলেকশন কমিটির সদস্যরা অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরামর্শ মোতাবেক সত্যিই যখন বিশ্ববিদ্যালয়টি কাজ শুরু করবে, তখন নালন্দায় থাকার সম্ভাব্যতা নিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। সময়ে সময়ে যে কোনোভাবেই হোক ভারতীয় পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে নানা খবর বেরিয়েছে। আবাসিক ভাইস-চ্যান্সেলরের বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও পত্রিকাগুলো নানাজনের কাছে অফার পেঁৗছানোর খবর দিয়েছে। সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কমিটি ড. গোপা সাবহারওয়ালকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে এমন তিন ব্যক্তির নাম ভারত সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। ড. সাবহারওয়ালের প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা অসাধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে আমাদের পরামর্শক ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত সমাজতাত্তি্বক আন্দ্রে বেতেই। তার প্রশাসনিক যোগ্যতাও সুগভীর। তিনি নালন্দা প্রকল্পের প্রতি দায়বদ্ধ। তিনি বিহারের সঙ্গে জড়িত। নালন্দায় অবস্থানের ব্যাপারে তার আগ্রহ অন্যদের থেকে তাকে এগিয়ে দিয়েছে। ভাইস-চ্যান্সেলর নির্বাচনে ক্ষমতার অধিকারী নালন্দা মেন্টর গ্রুপ ড. সাবহারওয়ালসহ তিনজনের নাম সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছে। সরকার ওই পদের জন্য মনোনীত করে ড. সাবহারওয়ালকে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। মেন্টর গ্রুপ খুশি যে প্রস্তাব পাওয়ার পর তিনি তা গ্রহণ করেছেন।
আমি বুঝতে পেরেছি, কিছু গণমাধ্যমে এ প্রশ্ন উঠেছে যে যিনি পূর্ণ অধ্যাপক নন তিনি কীভাবে ভাইস-চ্যান্সেলর পদের জন্য নির্বাচিত হন। আমার মনে হয়, পদ ও মর্যাদার দ্বারা আচ্ছন্ন সমাজে কিছু মানুষ ব্যক্তিকে তার পদ ও সামাজিক অবস্থান দিয়েই বিচার করতে চান_ তার যোগ্যতা ও গুণ দিয়ে নয়।
ড. গোপা সাবহারওয়াল কি কাজ শুরু করেছেন? বৃহৎ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে তিনি কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?
বিহার সরকারের সহায়তায় ড. সাবহারওয়াল ইতিমধ্যে একটি ক্যাম্পাস স্থাপন করেছেন। আইনগত, প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনাও এগিয়ে নিচ্ছেন। প্রথম দুটি বিভাগ হবে পরিবেশবিদ্যা ও ইতিহাসবিদ্যাকেন্দ্রিক, এরপরই হবে তথ্যপ্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ। এই বিভাগগুলো চালুর কাজ ইতিমধ্যে অনেক এগিয়েছে। তার নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরের নালন্দা-শ্রীবিজয় সেন্টার, থাইল্যান্ডের চুলালঙকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। প্রফেসর ওয়াঙ বাঙওয়েই-এর মাধ্যমে চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইনফরমাল সম্পর্কও স্থাপিত হয়েছে। প্রফেসর ওয়াঙ নালন্দা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত, মেন্টর গ্রুপের অন্যতম সক্রিয় সদস্য। কোরিয়া, জাপান ও আমেরিকার নেতৃস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গেও পারস্পরিক অংশীদারিত্বমূলক সহযোগিতার পথ খুলবে। এই সম্ভাবনাগুলোর অনুসন্ধান এখনও চলছে। বিহার সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে যে জমি দিয়েছে তা দেখভাল করার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাস ও ভবনের স্থাপত্য-পরিকল্পনা এখন জোরেশোরে শুরু হয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ড. সাবহারওয়াল এখনও প্রকৃত ভাইস-চ্যান্সেলর না হয়ে মনোনীত ভাইস-চ্যান্সেলর রয়ে গেছেন। এর পেছনে ভারত সরকারের প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতাই দায়ী। এটি না হলে তিনি আরও দক্ষতার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ড আশা করে শিগগির এই দীর্ঘসূত্রতার অবসান ঘটবে। তাতে কাজে গতি আসবে। মেন্টর গ্রুপের পরামর্শ মোতাবেক গত নভেম্বরে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
এ মুহূর্তে পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে ভারত সরকারই সব ব্যয়ভার বহন করছে। সরকার প্রশাসনিক জটিলতাগুলো দূর করার চেষ্টাও করছে। বাইরে থেকে অনুদানের প্রতিশ্রুতি আছে। চীন, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, লাওসসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও বেসরকারি খাত থেকে সহায়তা মিলবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।
বৈশ্বিকভাবে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে নালন্দার ভূমিকা কী হবে?
আন্তঃএশীয় সহযোগিতা ও জ্ঞান অর্জনে পুরাতন নালন্দার একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। এখানকার শিক্ষা কার্যক্রম ও গবেষণা শুধু ধর্মশিক্ষার সঙ্গেই জড়িত ছিল না, ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রায়োগিক বিজ্ঞানের সঙ্গেও এর সম্পর্ক ছিল। সে সময়কার শিল্পবোধের প্রতিফলন ছিল এর কার্যক্রমে। নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাম্প্রতিক শিক্ষাঙ্গন হিসেবে গড়ে উঠবে। আজকের সাম্প্রতিক বিষয় পরিবেশ সমস্যা ও তথ্যপ্রযুক্তি। এই ক্ষেত্রগুলোতে আন্তঃএশীয় সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়গুলোতে সহযোগিতা বাড়বে। বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশেষ অবদান আছে, বৈশ্বিক জ্ঞানক্ষেত্র তৈরিতে তারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু মনে রাখার মতো বিষয় হলো, পশ্চিমের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার ৭শ' বছর আগে নালন্দা স্থাপিত হয়েছিল। এটি ছিল ইউরোপের বোলঙনা বিশ্ববিদ্যালয়। নালন্দা তখনই এটি পুরো এশিয়ার মধ্যে একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে পেরেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে একই ধরনের যোগাযোগ নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও হবে।
বিহারের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কী?
প্রায় এক হাজার বছর ধরে বিহার ছিল ভারতীয় সভ্যতার কেন্দ্র। এটি পাটনা বা পাটালিপুত্র থেকে শুরু হয়েছিল। এখানেই প্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল। বিহারেই প্রথম বৌদ্ধ পণ্ডিতদের সভায় নাগরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিরল উদাহরণ তৈরি হয়েছিল। নাগরিক আলোচনাই গণতন্ত্রচর্চার কেন্দ্রীয় বিষয়। বিহারেই প্রথম জনস্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছিল। যা নালন্দা পড়তে এসে ফা হিয়েন ও ইৎ সিঙ আমাদের জানিয়েছিলেন। পাটালিপুত্রের কুসুমপুরেই আদি ভারতীয় গণিতচর্চার শুরু হয়েছিল। বিহার আধুনিক ইতিহাসে পশ্চাৎপদ একটি জনপদ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে, কিন্তু এর রয়েছে উজ্জ্বল ইতিহাস। ইতিহাস এখানকার শিক্ষা কার্যক্রমকে প্রণোদনা দিতে পারে এবং তা দ্রুতলয়ে ঘটছেও।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প গ্রহণের আগে বিহার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতেও এমন প্রণোদনার ভাবনা ছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এর ভিত্তিভূমির পুনর্জাগরণের ব্যাপারে পুরোপুরি দায়বদ্ধ। নালন্দা বিশুদ্ধ একাডেমিক শিক্ষার দিকে ঝুঁকে থাকবে না। তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিবেশবিদ্যার মতো ব্যবহারিক বিষয়ের মধ্য দিয়ে বিহারের মানুষের জীবনযাত্রার দিক পরিবর্তনের চেষ্টাও থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তারের সঙ্গে যেমন নালন্দার নিরাপদ অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি হবে, তেমনি আন্তঃএশীয় সহযোগিতার মাধ্যমে সর্বভারতীয় বিস্তারও ঘটবে বিশ্ববিদ্যালয়টির। বিহার নালন্দাকে সমর্থন দিয়েছে, প্রত্যুত্তরে আমরা চাই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বিহারকে সমর্থন জোগাবে।

Friday, September 16, 2011

শুধু আসা শুধু আশা

চেক লেখক মিলান কুন্ডেরা বলেন, নগর হলো শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ থাকার স্থান। কথাটা অনেকটা রূপকার্থে বলা। প্রকৃত নগরে, মানে যেখানে নাগরিক সংস্কৃতি মেট্রোপলিটন স্তরে উন্নীত সেখানে কেউ কারো জাত জানতে চায় না, অপরিচিত লোকদের দেখলে জেরা করে না। শুধু শরণার্থী নয়, নানা বর্ণের, নানা ধর্মের, নানা মতের মানুষের অস্থায়ী আবাস পৃথিবীর নগরগুলো। নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে তদারকি ছাড়া নিউইয়র্কে কোনো বাঙালি, কোনো চীনা কিংবা কোনো নাইজেরিয়ানকে দেখলে সাধারণ নাগরিকদের মনে এ প্রশ্ন উঠবে সে কী করছে এখানে, কেন এসেছে, কয়দিন থাকবে। কিন্তু ঢাকায় একটু অচেনা বর্ণের, অচেনা মতের মানুষের চলাচল দেখলেই সাধারণ মানুষই প্রশ্ন তুলবে, এ কে? বৈরিতা হোক কি বন্ধুত্ব কোনো অর্থেই এ প্রশ্ন ওঠা নাগরিক সংস্কৃতি-সম্মত নয়। কিন্তু ঢাকায় এ প্রশ্ন ওঠে। আর প্রশ্ন ওঠার অর্থই হলো, আমাদের নাগরিকতা প্রকৃত নাগরিকতা হয়ে ওঠেনি। আর্থসামাজিক সূত্রে গ্রামের টান সেখানে রয়ে গেছে। নগরের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো, সেখানে সবসময় কর্মক্ষম তরুণদের ভিড় থাকবে। তরুণরা বৃদ্ধ হলে অবসর নিয়ে একসময় নগর ছেড়ে দূরের শহরে কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত গ্রামে চলে যাবে। নতুন প্রাণোচ্ছল তরুণরা এসে নগর দখল করবে। কিন্তু ঢাকায় মানুষের আসাটা একমুখী। এখানে মানুষ আসে শুধু, এখান থেকে মানুষ যায় না। আরও শুদ্ধ করে বললে, যেতে চায় না। বাধ্য হলে কেউ কেউ যায়, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ একবার নগর জীবনে অভ্যস্ত হলে আর গ্রামে ফিরতে চায় না। গ্রামের ছেলেটি শহরে পড়তে এসে চাকরি করে, পয়সা জমায়, পয়সা জমিয়ে নগরেই থেকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। পরবর্তী প্রজন্মের উন্নততর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার তাগিদে ঢাকায় বা আশপাশে বাড়ি করে। থেকে যায়। গত চলি্লশ বছরে থেকে যাওয়ার হার এতটাই বেশি যে, ঢাকার আশপাশের জেলা শহরগুলো, কৃষিজমি, অকৃষিজমি, বনবাদাড় সব উজাড় করে তৈরি হচ্ছে মানববসতি। এই বসতিগুলোর আকুতি একটাই, ঢাকার পাশে থাকা। অবস্থাপন্ন মানুষরা তো আসন গেড়ে বসেছেনই। ঢাকায় একবার ঢুকলে এর বিকল্প ভাবেন না শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাও। ঋণ করে, কষ্ট করে একটা ফ্ল্যাটের কথা মাথা থেকে কিছুতেই বাদ যায় না। যারা শেষ পর্যন্ত বাড়ি কিনতে পারেন না, তাদেরও অনেকে ভাড়া বাড়িতেই থেকে যান। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে, নারায়ণগঞ্জের এক স্থায়ী বাসিন্দা একটি লেখায় লিখেছিলেন, রাজধানীর চাহিদা মেটাতে গিয়ে আশপাশের আদি অধিবাসীদের টিকে থাকাই দায় হয়ে উঠেছে। খুব গভীর এক সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে ঢাকা। আগামীতে যারা ঢাকায় থেকে যেতে চান তাদের অধিকাংশ চাইলেও থাকতে পারবেন না। জায়গা হবে না। কিন্তু ঢাকার বাইরে যদি নাগরিক সুবিধা-সম্পন্ন শহর থাকত। জেলা শহরগুলোর পরিকল্পিত উন্নয়ন যদি নিশ্চিত করা যেত, গ্রামে যদি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যেত তাহলে কিন্তু লোকে এভাবে ঢাকার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতেন না। একজন আর্মি অফিসার অবসর নিয়ে চলে যেতেন গ্রামে। একজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন অধ্যাপক মফস্বলে থাকতেন। তাদের মাধ্যমে মফস্বল-গ্রাম আলোকিত হতো। জ্যামের শহরে, নাগরিক জীবনের দুর্বিপাকের চক্রে তাদের অবসর জীবন কাটাতে হতো না। এমন হলে মানুষ বিকল্প ঠিকানার জন্য প্রস্তুত হতে পারত। নাগরিক জীবনের সুবিধার জন্য প্রাণান্ত সংগ্রামের বদলে অন্য কিছু তখন চোখে পড়ত আমাদের।

আমার 'দেহ' বই নিয়া চঞ্চল আশরাফের সমালোচনা

মাহবুব মোর্শেদের দেহতত্ত্বদেহ_মাহবুব মোর্শেদ। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ। প্রকাশক : ঐতিহ্য, প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১১। মূল্য : ১৫০ টাকাচঞ্চল আশরাফমাহবুব মোর্শেদের 'দেহ' গল্পগ্রন্থটিকে ভুল বোঝার কারণ যথেষ্ট রয়েছে। প্রধানত মনে হতে পারে, এটি ফ্রয়েডীয় যৌন সর্বস্বতাবাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। মনে হতে পারে, বেশির ভাগ গল্পের বিষয় শরীর বা সে সম্পর্কিত প্রসঙ্গগুলো। আমি মনে করি, যাঁরা এই ফাঁদে পড়বেন, তাঁরা গ্রন্থটির সম্ভবত প্রকৃত পাঠক নন। কেন নন, তা পরে আলোচ্য কিংবা এই আলোচনা থেকে কিছুটা বুঝতে পারা যাবে।
শরীরসংক্রান্ত যে থিসিস বইটির গল্পগুলোয় পাই, তাতে শেষ পর্যন্ত এটা নিশ্চিত যে 'দেহ' আদৌ ফ্রয়েডভাবিত গল্প সংকলন নয়। লোকদর্শনের অন্তর্গত দেহতত্ত্বের প্রতিনিধিত্বও এটি করছে না। হতে পারে ফ্রয়েডের অনুরসদ মাত্র; কিন্তু এর আসল জিনিসটি হলো সমকালীন বাস্তবতার পটভূমিতে মানুষের (নারী-পুরুষের) সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতার ভাষা। 'জিসম' গল্পটি এর একটি উদাহরণ। এর থিসিসটি হলো, শরীর শেষ পর্যন্ত একটা সংস্কার, যাকে আত্মস্থ ও অতিক্রম করতে হয়; নইলে এটি আচ্ছন্ন ও অধিকার করে ফেলে ব্যক্তিকে। করে ফেললে, সমষ্টি উপেক্ষিত হয়, যা সমাজবদলের প্রধান বাধা। গল্পকার পরোক্ষে একটি বার্তাও দিয়েছেন : সমাজ পরিবর্তনে সব কিছুর আগে দরকার শরীরসংক্রান্ত সংস্কার ভেঙে ফেলা। তা করতে গেলে জানা চাই শরীর কী জিনিস; তবে সেই জ্ঞান পুস্তকনির্দেশিত হলে চলবে না। হাতে-কলমে তা হওয়া চাই। গল্পটি পড়তে পড়তে হার্বাট মার্কুইসের একটি প্রত্যয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছেন, মুক্তযৌনতা আসলে সামাজিক প্রতিবাদের অংশ। 'জিসম' ধারণ করেছে মুক্তযৌনতার প্রত্যয়টি, এর মধ্যে প্রতিবাদ আছে; এবং একে সমষ্টিতে সঞ্চারের অভিপ্রায়ও দুর্লক্ষ্য নয় (পড়ুন ১০৩ পৃষ্ঠায় : শোনো, ও যখন যৌন সম্পর্ক করে তখন নিজের জীবনের ব্যর্থতা, গ্লানি, আমার মৃত স্বামীর প্রতি ক্ষোভ, এই ব্যবস্থা_সব কিছুর বিরুদ্ধে তার শারীরিক প্রতিবাদ জানায়। অ্যান্ড আই এনজয় ইট)। মনে হতে পারে, বিষয়টি ব্যক্তিক। কিন্তু গল্পের মধ্যেই সমষ্টির সূত্রটি প্রণয়ন করা হয়েছে। তিন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী তিনজনের পার্টি দিয়ে শুরু, শরীরসংক্রান্ত সংস্কার ভাঙার তথা প্রতিবাদও এই তিনে মিলেই ঘটানো হয়েছে। এসব নিয়ে 'জিসম' হয়ে উঠেছে প্রচলিত সংস্কার ও সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শারীরিক ভাষা। শুধু এতেই গল্পটির মর্ম নিঃশেষিত নয়; এর আরো ব্যাখ্যাসাপেক্ষ প্রান্ত রয়েছে। সেসব নিয়ে অন্যত্র আলোচনার আশা রাখি। গ্রন্থের প্রথম গল্প 'রাখী' এক ধরনের প্রতিবাদ আর প্রত্যাখ্যানের গল্প। 'আজ রাতে কোথায় ঘুমাব'ও প্রচলিত সমাজকে অস্বীকারের ভাষাকে মর্মে ধরেছে। তবে বইয়ের কোনো গল্পই চিন্তা বা আইডিয়ার দিক থেকে জিসমের মতো এত উচ্চাভিলাষী নয়; যদিও সেগুলো কোনো না কোনোভাবে সমকালীন বাস্তবতার পটভূমিতে মানবসম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতার রূপক হয়ে উঠেছে। 'লোলিতা রিলোডেড', 'লুক থ্রু সি থ্রু', 'ঘর মন জানালা, লাইফস্টাইল, আপনার রাশিফল', 'মেলানকলি', 'রুখসানার হাজব্যান্ড'_এই গল্পগুলো এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তবে 'সি পেই' গ্রন্থটির মান ও বৈশিষ্ট্যকে খানিকটা ক্ষুণ্ন করেছে বলে মনে হয়। রচনাটি দুর্বল, কারণ সেটা নয়; কারণ এটিও_বইয়ের অন্যান্য গল্পের সঙ্গে এর তাৎপর্যগত কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না।
মাহবুব মোর্শেদের 'দেহ' গল্পগ্রন্থের মূল অভিনিবেশ সময় ও সমাজের সমালোচনায় এবং বোঝা যায়, বেশ ভালো করে বোঝা যায়_গল্পকার প্রচলিত সমাজব্যবস্থা, বিশ্বাস, সংস্কার, রাজনীতি_এসবের প্রতি মোটেও সন্তুষ্ট নন। এই অসন্তোষ তাঁর গল্পভাষায়ও সঞ্চারিত হয়েছে। ব্যঙ্গ, বক্রোক্তি, পরিহাসে তা স্পষ্ট। প্রায় সব গল্পে চরিত্রের আত্মবিশ্লেষণই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সময়ের স্থবিরতা প্রামাণ্য করতে অবতারণা ঘটেছে অ্যাবসার্ডিটির (বিশেষ দ্রষ্টব্য 'অর্ডার অব থিংস'), তাতে সমাজ সম্পর্কে লেখকের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্য হয়ে গেছে; গল্পের মধ্যে রচয়িতার সরাসরি অংশগ্রহণও রয়েছে; কিন্তু তা বিশ্বস্ততায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে বলে মনে হয় না। বলা প্রয়োজন, মাহবুব মোর্শেদের গল্পের প্রধান সম্পদ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রভুত্ব করে চরিত্র কিংবা চরিত্র নির্বাচনের ওপর, ভাষায়ও করে; কিন্তু জবরদস্তি হয়ে তা দেখা দেয় না। এমনটি মনে হওয়ার কারণ, লেখক চরিত্রগুলোকে তাদের মতো করে কথা বলতে দেন; তাদের আচরণ সময়ের চেহারায় নির্দেশিত হলেও ঘটনাগুলো পূর্বনির্দিষ্টভাবে ঘটে না। শ্রেণীচরিত্রও গল্পে উপেক্ষিত নয়। তবে বোঝা যায়, লেখকেরও শ্রেণীগত একটি অবস্থান রয়েছে। সেটি কী? 'জিসম' গল্পের শিষ্যটির দিকে মনোযোগ দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।


কালের কণ্ঠে প্রকাশিত   

আমার বই ‌'দেহ' নিয়া নিজের লেখা

'দেহ' শব্দটি আমাদের ভাষায় কিছুটা মরমি আবহ সঙ্গে নিয়ে উচ্চারিত হয়। আমাদের দর্শনের ইতিহাসে দেহতত্ত্ব বলে এক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় আছে। আমাদের কবিরা দেহ
বিষয়টিকে রূপক, প্রতীক, উপমা ও উৎপ্রেক্ষার অন্তরালে বর্ণনা করেছেন। কবি-দার্শনিকের কাছে দেহ কখনো রূপকাঠের নৌকা, কখনো যন্ত্র, কখনো মেশিন, কখনো বা খেলার মাঠ। দেহ শব্দটিকে আড়াল করতে গিয়ে যত রূপকের ব্যবহার হয়েছে তা বোধহয় অনেক ক্ষেত্রেই ঘটেনি।
‘দেহ’ নিয়ে এই দর্শন ও কবিতার উত্তরাধিকার আমাদের চেতনে যেমন অবচেতনেও তেমনি ক্রিয়া করে। একে অস্বীকার করার উপায় কোথায়? কিন্তু এই রূপকের দেহের বাইরে এক পার্থিব দেহ নিয়েও আমাদের চলতে হয়। এ দেহ আমরা ধারণ করি, এ দেহ আমরা পালন করি, এ দেহ আমরা ত্যাগ করি। এ দেহের সাহায্যে আমাদের সঙ্গে অপর মানুষের এবং বস্তু পৃথিবীর সম্পর্ক তৈরি হয়। এ দেহের কথাও আমাদের কবিরা বলে গেছেন। রচনা করেছেন আখ্যান। আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানে গানে যে দেহের কথা বলেছেন, সে দেহ কখনো রূপকের, রূপকাঠের, কখনো বা দুনিয়াবি শরীর। কাব্য অনেক সময়ই খোলাসা করে না, কী নিয়ে সে বলছে। কিন্তু গদ্যের জগতে খোলাসা না করে উপায় নেই। আমাদের ফিকশনের জগতে দেহ খানিকটা আড়ষ্ঠ, খানিকটা ইতস্তত-ভিক্টরীয় নৈতিকতায় আচ্ছন্ন। তবুও তো মানুষ বলছে, গল্প রচিত হচ্ছে। রচিত হচ্ছে শরীরের আখ্যান, দেহের ভাষ্য। দেহই আমাদের ক্ষুধা, নিদ্রা, নিরাপত্তা, বসবাস ও জৈবিকতার আধার। ফলে, ‘দেহ’ আমার বইয়ের নাম। গত ১০ বছরে বিভিন্ন সময় লেখা গল্পগুলো থেকে বেছে নেওয়া গল্পগুলো এতে গ্রন্থিত হয়েছে।
দেহ-নাম, বিষয়-সম্পর্ক। আমাদের যাপনের মধ্যে মানবিক সম্পর্কগুলো কদর্যতা ও মাধুর্য, আমাদের নাগরিক জীবনের সংশয়-সন্দেহ, অতিসাম্প্রতিক বোধ ও মূল্যবোধগুলোকে পর্যবেক্ষণ করার সামান্য চেষ্টা এ বইয়ে থাকতে পারে। লেখক হিসেবে এর বেশি দাবি আমার নেই।
‘দেহ’ আমার দ্বিতীয় গল্পের বই। প্রথম বইটি ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কাগজ প্রকাশনী থেকে। ২০১০ সালে একটি উপন্যাস ছেপেছিল ভাষাচিত্র প্রকাশনী। ‘দেহ’ প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য প্রকাশনী। বইটি মেলায় এসেছে ৫ ফেব্র“য়ারি। দাম ১৫০ টাকা। বইটি উৎসর্গ করেছি আমার ছেলে নিভৃত অনুরণনকে। সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় আমি লক্ষ করেছি, পোশাক নয়-যাকে আমরা আদিম বলি সেই শরীরেই আসলে আমরা নির্মাণ করি সভ্যতা। শরীরের বেড়ে ওঠার সঙ্গে বেড়ে ওঠে সভ্যতাও।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত

আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশ

পার্বত্য দার্জিলিংয়ের একটি স্থানের নাম 'ঘুম'। সেখানে আছে একটি ছোট রেলওয়ে স্টেশন। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭ হাজার ৪০৭ ফুট ওপরের এ স্টেশনটি ভারতের সবচেয়ে উচ্চতম রেলওয়ে স্টেশন। দার্জিলিংয়ে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে ঘুম অন্যতম। জায়গাটির নাম ঘুম বলে নয়, ঘুমের কাছের টাইগার হিলই বরং পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। টাইগার হিল থেকে সুন্দরতম পার্বত্য চূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যায়। আকাশ ফরসা থাকলে মাউন্ট এভারেস্টের দেখাও মেলে। অবশ্য সবার কাঞ্চনজঙ্ঘা বা এভারেস্ট দেখার ভাগ্য হয় না। কারণ ঘুম মেঘের রাজ্য। সুউচ্চ এই পার্বত্য এলাকায় মানববসতির গায়ে গা ঘেঁষে মেঘ থাকে। চাইলেই ছোঁয়া যায় এমন সব মেঘ। পাশ দিয়ে মেঘ উড়ে গেলেও লোকে ভিজে যায়। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি হয়। আর দৃষ্টিপথকে আচ্ছন্ন করতে ঘুমের মেঘের কোনো জুড়ি নেই। তাই মেঘই ঠিক করে দেয় কে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে, কে দেখবে না।
আমি কখনও দার্জিলিং যাইনি, ঘুম দূরের কথা। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় দার্জিলিং দেখেছি। কলকাতার পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি সিনেমার নাম 'তিতলি'। তিতলি মানে বর্ষার প্রথম দিন। হিন্দিতে তিতলি মানে অবশ্য প্রজাপতি। মিঠুন চক্রবর্তী, কঙ্কনা সেনশর্মা, অপর্ণা সেন অভিনীত সেই সিনেমায় ঘুম নামের জায়গাটিতে মিঠুন চক্রবর্তীর গাড়ি থেমে গিয়েছিল। বাংলা অঞ্চলে ঘুম নামে যে একটি জায়গা আছে সেটি জানা হয়ে যায় ওই সিনেমা দেখতে দেখতে। ঘুম শব্দটি তখন থেকেই আমার কাছে একটি স্থানের নাম। সুউচ্চ পার্বত্য দার্জিলিংয়ের নির্জন একটি জায়গা। যেখানে মেঘের নিবাস। চাইলেই, হাত বাড়ালেই মেঘ ছোঁয়া যায়। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি এসে পথিককে ভিজিয়ে দেয় যেখানে। ঘুম বললে একটি দৃশ্যহীনতা তৈরি হওয়ার কথা। বড়জোর পাতা বন্ধ দুটো চোখের দৃশ্য ভাসতে পারে। কিন্তু ঘুম বলতে যে একরাশ বৃষ্টিভেজা সবুজ চোখে ভাসতে পারে তার কৃতিত্ব ঘুম জায়গাটিকেই দিতে হবে। কিন্তু জায়গাটির নাম কীভাবে ঘুম হলো? হয়তো পর্যটকের ভিড় লাগেনি যখন, যখন নীরবতাই ছিল স্থানটির আবহসঙ্গীত, তখন এর নামকরণ হয়েছিল ঘুম। নৈঃশব্দ্য জায়গাটিকে ঘুমের তুলনীয় করে তুলেছিল।
কিন্তু ঘুম কি নীরবতা? আমাদের কবির কাছেও ঘুম অরব অন্ধকারের ব্যাপার। কোন কবি? প্রশ্নটা কি খুব কঠিন? কে ঘুম শব্দটাকে বাংলায় বহুবর্ণিল তাৎপর্যে ও গভীর দ্যোতনায় ব্যবহার করেছেন সবচেয়ে বেশি? জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দীয় ঘুম আসলে মৃত্যুরই আরেক নাম। 'আট বছর আগে একদিন' কবিতার সেই বিখ্যাত ঘুমের কথা অনেকের কণ্ঠস্থ। একবার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল কবিতার চরিত্রটির। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত জাগরণের কালে জ্যোৎস্নায় সে হয়তো কোনো ভূতকেই দেখে ফেলেছিল। এর পর থেকে প্রেম, আশা, সন্তান, বধূসহ জীবনের সব আয়োজন থাকার পরও তার মরিবার সাধ হয়। অশ্বত্থের শাখায় উদ্বন্ধনে আত্মাহুতি দেয় সে। অবশেষে আকাঙ্ক্ষিত ঘুম আসে তার। লাশ কাটা ঘরে টেবিলের 'পরে শুয়ে ঘুমায় এবার। কিন্তু কখন মানুষ এই ঘুম চায়? 'নারীর হৃদয়_ প্রেম-শিশু-গৃহ_ নয় সবখানি;/অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়_/আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/খেলা করে;/আমাদের ক্লান্ত করে;/ক্লান্ত ক্লান্ত করে ;/লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই,/তাই/লাশকাটা ঘরে/চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।' তবে কি এক ধরনের বিদগ্ধ ক্লান্তি, জীবনের নেতিবাচক উপলব্ধি থেকে পলায়নের জন্য ঘুমকে আশ্রয় করে লোকে। কোনোদিন জাগিবে না জেনেও, সেই ঘুমকে আবাহন করে। কেননা সে জাগিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম অবিরাম ভার আর সহিবে না বলে সিদ্ধান্তে এসেছে। তাই এই চিরঘুম, চিরনীরবতা। অবশ্য 'অন্ধকার' কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিতে চিরঘুম থেকে জাগবার ক্ষীণ আশা দেখা গিয়েছিল। সেখানে শুরুতেই কবি বলেছেন, 'গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার'। কিন্তু পাঠক এই জাগরণকে স্বাগত জানাবার আগেই কবি জাগরণের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। বললেন, কোনোদিন জাগবেন না জেনেই পৌষের রাতে ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে শুয়েছিলেন। কিন্তু জেগে উঠে দেখলেন পাণ্ডুর চাঁদ কীর্তিনাশার দিক থেকে অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে। অবশ্য এই চাঁদের ক্ষমতা সামান্য। হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে, রয়েছে যে অগাধ ঘুম, সে ঘুম নষ্ট করার শেল তীব্রতা এ চাঁদের নেই। দোষ শুধু চাঁদের নয়। অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকার পর হঠাৎ আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে পৃথিবীর জীব বলে নিজেকে শনাক্ত করতে পারলেও কবি ভয় পেয়েছেন, বেদনাবিদ্ধ হয়েছেন, ঘৃণা ও আক্রোশে তার হৃদয় ভরে গেছে। তাই আবারও ঘুমকেই_ শ্রেয়তর মনে হয়েছে তার। 'গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;/আমাকে কেন জাগাতে চাও?/হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া/আমাকে জাগাতে চাও কেন।/অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর;/তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে/অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে/কীর্তিনাশার দিকে।/ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব-ধীরে-পউষের রাতে।/কোনদিন জাগব না জেনে-/কোনোদিন জাগব না আমি_ কোনোদিন আর।'
আমাদের প্রিয় কবির কাছে ঘুম হলো জীবনের প্রতি নির্মম প্রতিশোধের উপায়_ মৃত্যু। মৃত্যুর উপমা হিসেবে ঘুমের ব্যবহারে জীবনের প্রতি প্রত্যাখ্যান আছে; আশাহীন, দিশাহীন জীবন থেকে পলায়নের বার্তাও আছে।
বিশ শতকের আধুনিক এক কবির ঘুম চেতনায় হয়তো কেউ বিস্মিত হবেন না বা চমকে যাবেন না। নেতির এ আয়োজন আধুনিকোচিত বলেই বিবেচিত হয়। কিন্তু কোনো ধর্মীয় আচারে যদি ঘুমকে মৃত্যুর সমতুল্য বলা হয় তবে হয়তো অনেকেই চমকে যাবেন। মুসলমানরা দৈনন্দিন প্রায় সব কাজের আগে দোয়া পড়ে আল্লাহকে স্মরণ করেন। ঘুমের আগে তারা যে দোয়াটি পড়েন তা হলো, 'আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া'। আরবি এ দোয়ার অর্থ_ 'হে আল্লাহ তোমার নামে আমি মৃত্যুকে বরণ করলাম, তোমার নামেই জেগে উঠব আবার।' এখানে কি ঘুম মৃত্যুর উপমা, নাকি মৃত্যুই ঘুম এখানে?
ঘুমকে অন্য এক তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হতে দেখা যায় সুরা কাহফে। কোরআনের তাফসিরকারীদের মতে, ঘটনাটি এফসুস অঞ্চলের। রোমান শাসক সিজার দাকিয়ানুস বা ডিসিয়াসের সময়কার। তখন রোমে অনেকে ঈসা নবীর প্রচারে ধর্মান্তরিত হলেও সম্রাট ডিসিয়াস ছিলেন প্রচণ্ড বিরোধী মনোভাবাপন্ন। তার সাম্রাজ্যের কয়েকজন যুবক ঈসা নবীর অনুসারী হয়েছে জানতে পেরে তিনি তাদের ডেকে পাঠান এবং ধর্মমত পরিবর্তনের জন্য তিন দিন সময় বেঁধে দেন। তিন দিনের অবকাশের সুযোগে যুবকরা পাহাড়ের পথ ধরেন। তারা চেয়েছিলেন পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে থেকে রাজার রুদ্ররোষ থেকে বাঁচতে। পথে একটি কুকুর তাদের সঙ্গী হয়। পাহাড়ে গিয়ে একটি গুহায় লুকিয়ে পড়েন তারা। সঙ্গী কুকুরটি গুহার দরজায় পাহারার দায়িত্ব নেয়। যুবকরা জেগে ওঠার পর পরস্পরের মধ্যে কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। তাদের কেউ বলেন, একদিন, কেউ বলেন দিনের একটি অংশ বড়জোর ঘুমিয়েছেন তারা। ক্ষুধার্ত থাকায় সঙ্গীদের একজনকে খাবার আনতে শহরে পাঠান তারা। সঙ্গী খাবার আনতে গিয়ে দেখেন শহরে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। মূর্তিপূজা ছেড়ে সবাই এক স্রষ্টার অনুসারী হয়েছে। এতে তিনি ভীষণ অবাক হয়ে যান। দোকানে খাবারের বিনিময়ে মুদ্রা দিতে গেলে দোকানদার তাকে অবাক করে দিয়ে বলেন, এ মুদ্রা তো দুশ' বছর আগেকার। গুহাবাসী যুবক তখন বলেন, কালই তারা শহর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন। দোকানদার ও আশপাশের লোকেরা যুবককে সম্রাট তেযোসিস বা সিজার দ্বিতীয় থিয়োডসিসের কাছে নিয়ে যান। সম্রাটসহ লোকেরা গুহা পর্যন্ত তার সঙ্গী হন। গিয়ে দেখেন সত্যিই সেখানে দুশ' বছর আগের যুবকরা অবস্থান করছে। তখন মৃত্যুর পরের জীবনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিকে হয়ে আসছিল। আসহাবে কাহফের অভিনব ঘটনায় মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও পরকালের প্রতি সবার বিশ্বাস ফিরে আসে। লোকদের বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়ে যুবকরা আবার গুহায় গিয়ে শুয়ে পড়েন এবং সেখানে তাদের মৃত্যু হয়। আসহাবে কাহফ বা গুহার মানুষদের এ ঘটনা ঘুমের অন্য এক তাৎপর্য হাজির করে। ঘুম মৃত্যুর সমান_ এ কথা যেমন বলা হয়েছে; তেমনি ইসলামী বিশ্বাসে মৃত্যুর তুলনা হিসেবেও ঘুম ব্যবহৃত হয়েছে। ঘুমের পর যেমন আছে জাগরণ, তেমনি মৃত্যুর পরও আছে পুনরুত্থান ও পরকাল।
আসহাবে কাহফের ঘটনা ঈসা নবীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘটিত হলেও বাইবেলে এ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। জেমস সারোজি নামের একজন খ্রিস্টান জাজক ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ষোড়শ শতকের প্রোটেস্টান্ট সাহিত্যে এবং সিরিয়ান সাহিত্যে এ ঘটনার উল্লেখ আছে। কোরআনে ঘুমন্ত ব্যক্তিদের নিশ্চিত কোনো সংখ্যা বলা না হলেও পাশ্চাত্যের সাহিত্যে সাত সংখ্যাটি পরিচিত। পরবর্তীকালে পাহাড়ের সাত ঘুমন্ত ব্যক্তির দীর্ঘ ঘুমের ধারণা অবলম্বন করে আধুনিক সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে আমেরিকান লেখক ওয়াশিংটন আরভিংয়ের 'রিপ ভ্যান উইঙ্কেল' ব্যাপকভাবে পরিচিত। উপন্যাসে রিপ ভ্যান উইঙ্কেল একজন আমুদে, অলস ব্যক্তি। শহরে সবাই তাকে পছন্দ করে। কিন্তু বউ তাকে খোঁটা দেয়। বউয়ের খোঁটা সইতে না পেরে একদিন সে অপরিচিত কিছু লোকের সঙ্গী হয়। এবং সঙ্গীদের সঙ্গে নেশা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে ওঠার পর বাড়িতে গিয়ে কিছুই আর চিনতে পারে না। শহরে গিয়েও দেখে সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কেননা ঘুমের মধ্যেই অনেক বছর কাটিয়ে জেগে উঠেছিল রিপ ভ্যান উইঙ্কেল। রিপ ভ্যানের মতোই আরেক অলস চরিত্র অবলোমভ। রিপ ভ্যানের মতো বিখ্যাত না হলেও অবলোমভই বেশি অলস। তবে দীর্ঘস্থায়ী ঘুমের চক্করে অবলোমভকে পড়তে দেখি না আমরা। অবলোমভ বরং দীর্ঘস্থায়ী আলস্যের চক্করে পড়ে থাকে। অবলোমভ রাশিয়ান চরিত্র। তার আলস্য এতটাই সিরিয়াস ছিল যে, ১৯২২ সালে রাশিয়ার বিপ্লবী নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ ইলিয়ানভ লেনিন একটি বক্তৃতায় বলেন, 'রাশিয়া তিন-তিনটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু অবলোমভরা এখনও রয়ে গেছে, এদের ধুয়ে দিতে হবে, পরিষ্কার করে ফেলতে হবে, এদের মূলোৎপাটন করতে হবে। নতুনভাবে জেগে ওঠার আগে এদের ঝাড়েবংশে নির্মূল করতে হবে।' লেনিনের ঘোরতর শত্রু অবলোমভরা কিন্তু প্রতাপশালী জার, সামন্ত প্রভু বা বুর্জোয়া নয়। এরা একান্তই আলস্যের প্রতিভূ। তাও আবার বাস্তবের অলস নয়, উপন্যাসের চরিত্র। ইভান গনচারভের জনপ্রিয় উপন্যাস অবলোমভের মূল চরিত্র অবলোমভ। রাশিয়ার অভিজাত পরিবারের সদস্য অবলোমভ উদ্যমহীনতা, কর্মহীনতা, উদ্যোগহীনতা সর্বোপরি আলস্যের প্রতীক। রাশিয়ায় তরুণদের মধ্যে, বিশেষত অবস্থাপন্ন ঘরের তরুণদের মধ্যে একসময় আলস্য প্রবণতা প্রচণ্ড জাঁকিয়ে বসেছিল। এদের মাথায় রেখেই অবলোমভ উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল। পরে এ ধরনের লোকদের অবলোমভ হিসেবে আখ্যায়িত করা হতে থাকে। এবং অবলোমভিজম নামে একটি মতবাদেরও জন্ম হয়। অবলোমভিজমের প্রভাব কতদূর বিস্তৃত তা বলতে গিয়ে এক সমালোচক লিখেছেন, এমনকি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণও এই অবলোমভিজম। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, রাশিয়া তার জগৎ বিখ্যাত আলস্য কোথায় পেল? উত্তরও এসেছে। তা হলো পূর্বদিক বা প্রাচ্য থেকে এই আলস্য এসেছে। পূর্বদিক মানে আমাদের অঞ্চল। আমাদের অঞ্চল থেকে যদি আলস্য রাশিয়ায় রফতানি হয়ে থাকে তবে এখানে আলস্য ব্যাপারটা কতটা শক্তিশালী তা সহজেই অনুমেয়। একসময় আমাদের অঞ্চলে আলস্য ব্যাপারটি দর্শনের পর্যায়ে পেঁৗছে গিয়েছিল। মহাযান বৌদ্ধ মতবাদে জেন বলে একটি ঘরানা আছে। তাতে 'আর্ট অব ডুয়িং নাথিং' শেখানো হয়। অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিছু না করা তো শিখতে হয় না, কিছু না করলেই হয়। কিন্তু জেন মতবাদে বলা হচ্ছে, 'নিশ্চিতভাবেই আমরা সবাই জানি কীভাবে কিছু না করতে হয়। আমরা সবাই জানি কীভাবে বসে থেকে সময় নষ্ট করতে হয়। আমাদের অনেকেই এই কিছু না করতেই ব্যস্ত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমরা যখন কিছু করি না তখন আমাদের মন ব্যস্ত থাকে অন্যত্র, সে কিছু না করায় স্থিত থাকে না। আমরা আসলে আরাম করতে এবং কিছু না করাকে উপভোগ করতে পারি না।' জেন কিছু পালনীয় নিয়মের কথা বলছে যেগুলোর মাধ্যমে কিছু না করা একেবারে কিছু না করায় পর্যবসিত হতে পারে। রাশিয়ানরা যদি আরামের ব্যাপারটি জেনদের কাছে শিখে থাকে তাহলে তারা অনেকটা ভুল শিখেছে তা নিশ্চিত। জেনে যেমন আর্ট অব ডুয়িং নাথিং বলে একটি ব্যাপার আছে, তেমনি আর্ট অব সাউন্ড স্লিপিং বলে একটি ব্যাপারও আছে। নিরাপদ নিরবচ্ছিন্ন ঘুম কতটা প্রয়োজনীয় তা সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারেন অনিদ্রা রোগে আক্রান্ত মানুষেরা। অনিদ্রা রোগে আক্রান্তদের জন্য বহু আগে থেকে এক শান্তিদায়ক তেল তৈরি হয় এ দেশে। তেলটির নাম মোহনীয়_ নিদ্রাকুসুম। নিরাপদ ও নিরুপদ্রব আরাম ও ঘুমের মতো কি শান্তিময় মৃত্যুও আছে নাকি? একসময় কি শিখতে হবে কীভাবে নিরাপদে মরা যায়? তা যদি না হবে তাহলে আমাদের সমাজে কেন 'নিরাপদ মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই' দাবিটি দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে?

Wednesday, September 14, 2011

বৃহত্তম চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান

পৃথিবীর বৃহত্তম চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান কোনটি? প্রশ্নটি শোনার পর অনেকেই হিসাব মেলানোর চেষ্টা করবেন। স্বভাবতই প্রাইভেট সেক্টরের উদ্যোক্তাদের কথাই প্রথমে মাথায় আসবে অনেকের। বিশ্বে এখন প্রাইভেট সেক্টরের জয়জয়কার। মাল্টিন্যাশনাল, ট্রান্সন্যাশনাল কোম্পানির দাপট অনেক। তারা বিশ্বজুড়ে প্রচুর মানুষকে চাকরি দিচ্ছে। কিন্তু চাকরি নিয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা করেন তারা বলছেন, প্রাইভেট সেক্টর কাজ দিতে কার্পণ্য করে। কাজ তৈরির ক্ষেত্রে তাদের পূর্বাপর ভাবনায় অনেক সময় চলে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, মুনাফা যখন প্রধান লক্ষ্য তখন তারা কাজ তৈরির চেয়ে কাজ কমানোর চিন্তাই বেশি করে। ফলে যখন মন্দা দেখা দেয়, যখন দ্রুত সক্ষম নাগরিকদের জন্য কাজ সৃষ্টির প্রয়োজন দেখা দেয় তখন প্রাইভেট সেক্টর খুব বেশি ভরসা জাগাতে পারে না। প্রাইভেট সেক্টরের ভরসা না পেয়ে সরকারগুলো পাবলিক সেক্টরের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই প্রাইভেট সেক্টরের রমরমার এই যুগেও পাবলিক সেক্টরই শেষ ভরসা। সম্প্রতি পৃথিবীর বৃহত্তম চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ তালিকা দেখে অনেকেই ভিরমি খাবেন। কেননা, শীর্ষ ১০ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের ৭টিই সরকারি। তার চেয়ে বড় কথা, এগুলো খুবই ট্রাডিশনাল প্রতিষ্ঠান। অন্তত প্রথম দুটি প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্কই নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানে ৩.২ মিলিয়ন (৩২ লাখ) মানুষ। আর এ প্রতিষ্ঠানটির নাম ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। অর্থাৎ মার্কিন সেনাবাহিনীই সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের ১ শতাংশ মানুষ। দ্বিতীয় চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ২৩ লাখ মানুষ। চীনের আরও তিনটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পঞ্চম, ষষ্ঠ ও নবম অবস্থানে আছে। চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে কাজ করে ১৭ লাখ লোক। আর স্টেট গ্রিড করপোরেশন অব চায়নাতে কাজ করে ১৬ লাখ মানুষ। চায়না পোস্ট গ্রুপে কর্মী সংখ্যা ৯ লাখ। যুক্তরাজ্যে আর্মি নয়, রাষ্ট্রীয় হেলথ সেক্টরে সবচেয়ে বেশি লোক কাজ করে। সংখ্যায় তারা ১৪ লাখ আর শতাংশের হিসাবে মোট জনগোষ্ঠীর ২.৫%। ভারতেও সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চলে। এর নাম ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ। এতে কাজ করে ১৪ লাখ লোক। পৃথিবীর শীর্ষ দশ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানে প্রাইভেট সেক্টরের প্রতিষ্ঠান মাত্র তিনটি। চেইন শপ ওয়ালমার্ট, চেইন ফুডশপ ম্যাকডোনাল্ডস, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির প্রতিষ্ঠান হ্যানহুই। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীসংখ্যা যথাক্রমে ২১ লাখ, ১৭ লাখ ও ৮ লাখ। তথ্যগুলো নিশ্চয় বিশদ আলোচনা ও মনোযোগ দাবি করে। কোন দেশ কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয় এবং কোথায় নাগরিকদের নিয়োজিত রাখে তাও এ থেকে বোঝা যায়। তবে আজকের পৃথিবীতেও যে শীর্ষ চাকরিদাতা দুটি প্রতিষ্ঠান দুটি দেশের সেনাবাহিনী এ তথ্যটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে এ ধরনের গবেষণা হয় কি-না জানা নেই। হলেও গণমাধ্যম পর্যন্ত পেঁৗছায় না। কেন হয় না এবং কেন পেঁৗছায় না সেটি কঠিন প্রশ্ন। কিন্তু এ দেশে শীর্ষ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান কোনটি? এ প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই তত কঠিন নয়।

Wednesday, September 7, 2011

দিল্লিতে নাশতা, চট্টগ্রামে লাঞ্চ মান্দালয়ে রাতের খাবার



কয়েক বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আশা প্রকাশ করেছিলেন- দিল্লিতে নাশতা, লাহোরে লাঞ্চ আর কাবুলে রাতের খাবার খাবেন। ভারতের পশ্চিমের দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে মনমোহন এমন স্বপ্ন ব্যক্ত করেছিলেন। ভারত আশা করেছিল, শান্তি আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে একটা চমৎকার সম্পর্কে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু মুম্বাইয়ে হোটেল তাজে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা তার সে আশার গুড়ে বালি ফেলে দেয়। এখন ঢাকা সফরের আগে ভারতের কয়েকজন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী তার সে ইচ্ছার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য সি. রাজা মোহন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় দুটি কলাম লিখে এ বিষয়ে মনমোহন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন তিনি। বলেছেন, পশ্চিম সীমান্তে যা হয়নি পুবে তা হতে দোষ কি? মনমোহন দিল্লিতে নাশতা, চট্টগ্রামে লাঞ্চ আর মান্দালয় বা কুনমিংয়ে রাতের খাবারের কথা ভাবছেন না কেন? ভারতীয় বিশ্লেষকদের মধ্যে পূর্বদিকে সম্পর্কোন্নয়নের এই আইডিয়া আসার পেছনে বড় একটি কারণ চীন। বেশ কয়েক দশক ধরে প্রতিবেশীদের বেলায় চীন যে নীতি অনুসরণ করছে তা শুধু এশিয়াতে নয়, পুরো বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে প্রতিবেশীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চীন। তাদের সঙ্গে উন্নয়ন, অগ্রগতি ভাগ করে নিতে চেয়েছে। বিনিয়োগ, ব্যবসা, বাণিজ্য, যোগাযোগে তাদের সহায়তা করেছে। এর ফল হয়েছে দারুণ। দেখা গেছে, সীমান্তজুড়ে চীনের বন্ধুর শেষ নেই। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অগ্রগতি হয়েছে সত্য, কিন্তু প্রতিবেশীদের তাতে কোনো ভাগ নেই। ভারতের চারদিকে বিরোধিতাই মূল আবহসঙ্গীত হিসেবে বেজে চলেছে। বিশ্বে শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে গেলে এটা সুখকর কোনো অবস্থান হতে পারে না। তাই ক্ষীণ হলেও ভারতে এখন সমঝোতার কূটনীতি জায়গা করে নিয়েছে। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তো আছেই। নিজেদের স্বার্থেও ভারতের এখন এটি দরকার। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে এ মনোভাবের ছাপ পড়তে পারে বলে আশা করছিলেন কেউ কেউ। সি. রাজা মোহন মনে করেন, এ সফরটি 'গেম চেঞ্জার' বা 'খেলার বদল ঘটানো' উদ্যোগ। রাজা মোহন বলেছেন, মনমোহনের এই সফর শুধু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের জন্যই একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এবং চীন পর্যন্ত এ সফরের প্রভাব পড়তে পারে। তার মতে, ভারতের জন্য এটি একটি সুযোগ। বাংলাদেশও মনে করে ট্রানজিটকে বাংলাদেশ- ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিস্তৃত করা দরকার। ট্রানজিট থেকে ভারত যেমন তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে তেমনি বাংলাদেশেরও উপযুক্ত ট্রানজিট মাশুল পাওয়া উচিত। দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের বাইরে নেপাল-ভুটান পর্যন্ত ট্রানজিট সুবিধা বিস্তৃত হওয়া উচিত। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরেই উপমহাদেশের পূর্বাংশের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে চীন উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এতে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সঙ্গে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল এবং পূর্ব ভারতের আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ইউনান থেকে মিয়ানমার-বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত রেল সংযোগ স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। ব্রিটিশরাজ যা পারেনি তা এবার সম্ভব হচ্ছে। মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল ট্রানজিটের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। রাজা মোহন মনে করেন, এই সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উচিত শেখ হাসিনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে দক্ষিণ এশীয় রেল নেটওয়ার্কে ভারতের যুক্ত হওয়ার পথে শক্ত অবস্থান নেওয়া। রাজা মোহনের মত যে খুব গৃহীত হচ্ছে তা নয়। বরং এখনও রক্ষণশীল প্রতিবেশী নীতিই ভারতে প্রধান। মনমোহন সেই রক্ষণশীলতা কাটিয়ে চীনের মতো ভারতকেও আঞ্চলিক নেতার মর্যাদায় নিয়ে যেতে পারবেন কি-না, প্রতিবেশীদের ছাড় দিয়ে, সুযোগ দিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করতে পারবেন কি-না সেটি ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।

Tuesday, September 6, 2011

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক :: অমীমাংসিত ইস্যু দীর্ঘ তালিকা :পথের শেষ কোথায়


বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইতিহাসে বন্ধুত্ব, শান্তি, সহযোগিতা, বাণিজ্য ও অংশীদারিত্বের বেশ কয়েকটি উদ্যোগ অতীতে এসেছে। কখনও ভুল বোঝাবুঝি, কখনওবা আন্তরিকতার অভাব কিংবা রাজনৈতিক পালাবদলে অনেক উদ্যোগ পথ হারিয়েছে। টানাপড়েনের সম্পর্কও তৈরি হয়েছে বহুবার। বিবদমান বিভিন্ন ইস্যুতে চাপান-উতোর চলেছে দু'দেশের মধ্যে। এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক পৌঁছাতে চাইছে নতুন দিগন্তে। নতুন যুগে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দু'দেশই বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, বাণিজ্য ও কানেকটিভিটির অর্থপূর্ণ কর্মসূচির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, ট্রানজিট, সহযোগিতার সমন্বিত রূপরেখা, ১৯৭৪ সালের সীমান্ত নির্ধারণ, সুন্দরবন ও বাঘ রক্ষা, রেলওয়ে সহযোগিতাসহ বারোটি সম্মতিপত্র, চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক এ সফরে স্বাক্ষরিত হবে। তবে, সব পক্ষই স্বীকার করে বরফ গলতে শুরু করেছে মাত্র। সব সমস্যার সমাধান এক সফরেই হবে না। সন্ত্রাসবাদ, পানি বণ্টন, সমুদ্রসীমানা নির্ধারণ, বাণিজ্য ঘাটতি, ভিসা জটিলতা, আস্থার সংকটসহ বহু ইস্যু এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। দু'দেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্কই পারে ক্রমান্বয়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে।

 
অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন
ভারত ও বাংলাদেশ ৫৪টি অভিন্ন নদীর অংশীদার। বাংলাদেশ আশা করে, আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে উজানের দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা দেবে। বাস্তবে সেটি ঘটেনি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ৩০ বছর মেয়াদি এ চুক্তির ফলে পদ্মায় পানিপ্রবাহ বেড়েছে। বাকি নদীগুলোর ক্ষেত্রে এমন চুক্তির প্রত্যাশা থাকলেও এতকালে তা হয়নি। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল উত্তরাঞ্চলের সেচকাজের সঙ্গে জড়িত তিস্তা ব্যারাজের স্বার্থে তিস্তা চুক্তি হোক। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে পূর্বনির্ধারিত থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত এ সফরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না।
ভবিষ্যতে বহুল আলোচিত টিপাইমুখ প্রকল্পটি আবার আলোচনায় আসতে পারে। ভারত যদি বৃহৎ এ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জলাধার প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নেয়, তবে দু'দেশের নদ-নদীর পানির হিস্যা নিয়ে নতুন সংকট দেখা দেবে। বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকায় নতুন প্রতিবেশগত সংকটও ঘনীভূত হবে।
 
 
বাণিজ্য ঘাটতি 
বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানির ক্ষেত্রে ৪৮০টি পণ্য স্পর্শকাতর হিসেবে তালিকাভুক্ত আছে। গত রোববার ভারতের বাজারে ৪৮০টি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চেয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। ৬২টি সুনির্দিষ্ট পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিতে রাজি হয়েছে ভারত। এ পণ্যের ৪৭টি বস্ত্র খাতের। আশা করা হচ্ছে, মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। ৩ সেপ্টেম্বর ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে বিবিসি জানিয়েছে, বাংলাদেশের ৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআই সভাপতি এ. কে. আজাদ জানিয়েছেন, ২০১০-১১ অর্থবছরে ভারত থেকে ৪৫৭ কোটি ডলার আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে মাত্র ৫১ কোটি ২৫ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। দুই দেশের বাণিজ্য বাড়ছে, সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়ছে।
সুষম সম্পর্কের স্বার্থেই ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। এ প্রসঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ১২ জুলাই তারিখের সম্পাদকীয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আনন্দবাজার লিখেছে, 'বাংলাদেশের জন্য শর্তহীনভাবে ভারতীয় বাজার খুলিয়া দিতে হইবে যাহাতে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতকে স্বাভাবিক বাজার হিসাবে বিবেচনা করিতে পারেন। বাংলাদেশি পণ্যের উপর কোনও আমদানি শুল্ক আরোপ করা চলিবে না। বাংলাদেশের নিকট ইহার প্রতিদান চাহিবার প্রশ্নই নাই। তাহাতে ভারতের কোনও ক্ষতি নাই। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের মোট রফতানির পরিমাণ ১৫০০ কোটি ডলার, আর ভারতের মোট আমদানির পরিমাণ ৩২,১০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের সমস্ত পণ্যও যদি ভারতীয় বাজারে পৌঁছায়, তাহারও প্রভাব ভারতীয় অর্থনীতির উপর নামমাত্র।'
ভারতের বাজারের ধারণ ক্ষমতা অনুসারে তারা বাংলাদেশের জন্য যে ছাড় দিতে যাচ্ছে তাকে রক্ষণশীলতাতাড়িত সামান্য ছাড় বলতে হয়। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দু'দেশের অংশীদারিত্বের অনেক ইস্যু মনমোহন সিংয়ের সফরের পরও অমীমাংসিত থেকে যাবে। ২০১১ সালে দু'দেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ঘটনা হলো, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশে তৈরি ১ কোটি পিস শুল্কমুক্ত পোশাক ভারতের বাজারে রফতানি করা সম্ভব হয়েছে। এর আগে ২০০৯ ও ২০১০ সালে ৩১ লাখ ও ৪৫ লাখ পিস পোশাক রফতানির সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। সুযোগগুলো কাজে লাগেনি অশুল্ক (নন-ট্যারিফ) বাধার কারণে। এবার রফতানির ক্ষেত্রে শুল্ক দিতে হয়নি, আবার অশুল্ক বাধাও ছিল না। এ অভিজ্ঞতা থেকে রফতানিকারক, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুল্ক বাধা দূর করার সঙ্গে অশুল্ক বাধাগুলোও দূর করা দরকার।
 
ট্রানজিট 
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পেঁৗছানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে ট্রানজিটের দাবি করে আসছে ভারত। এ দাবির সঙ্গে জড়িত মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের প্রশ্নও। অতীতমুখী মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে অগ্রসর ভূমিকা নিয়েছে। বাংলাদেশ শুধু ভারত-বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিটই নয়, ভুটান-নেপাল এমনকি চীন পর্যন্ত ট্রানজিটের ব্যাপারে উৎসাহী। ড. সিংয়ের সফরে ট্রানজিট নিয়ে সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে দরকষাকষির মূল ভিত্তি ট্রানজিট। ফলে প্রস্তুতি নিয়েই চূড়ান্ত চুক্তি করতে হবে। অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এখনও সন্তোষজনক নয়। এমন পরিস্থিতিতে ট্রানজিট থেকে মাশুলসহ অর্থনৈতিক লাভের বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে ভারতের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। এতে উভয় দেশ অতীতে লাভবান হয়েছে। দিলি্লভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সিনিয়র ফেলো সি. রাজা মোহন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় লিখেছেন, মনমোহনের এই সফর শুধু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের জন্যই একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এবং চীন পর্যন্ত এ সফরের প্রভাব পড়তে পারে। ট্রানজিট থেকে ভারত যেমন পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে, তেমনি বাংলাদেশেরও উপযুক্ত ট্রানজিট মাশুল পাওয়া উচিত। দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের বাইরে নেপাল-ভুটান পর্যন্ত ট্রানজিট সুবিধা বিস্তৃত হওয়া উচিত।
 
 
সমুদ্রসীমা
বাংলাদেশ ও ভারতের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর অন্যতম সমুদ্রসীমা। বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ। দুঃখজনক হলেও সত্য, দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার পথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পথ সুগম হয়নি। সরকার তাৎক্ষণিকভাবে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন ফর ল' অব সি (ইউএনসিএলওএস) অনুসারে হেগভিত্তিক পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেকেই মনে করেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। সালিশ আদালতে বাংলাদেশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও মিয়ানমারও তাদের দাবি জানিয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, গভীর সমুদ্রের প্রায় পুরো এলাকাই নিজেদের বলে দাবি করেছে দেশ দুটি। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বাংলাদেশ এখন সমুদ্রের ন্যায্য অংশ পাবে বলে আশা করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যাটির সমাধান কেন বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর মধ্যে সম্ভব হলো না এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রতিবেশী অনেক দেশই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে পরস্পরের মধ্যে চুক্তি করেছে। বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষেত্রে তা হবে না কেন, এ প্রশ্ন সবার। সমুদ্রসীমা নির্ধারণ ছাড়াও দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা, হাড়িভাঙা নদীপ্রবাহের দাবি অমীমাংসিত সমস্যার তালিকা দীর্ঘদিন ধরেই ভারী করে রেখেছে।
 
ছিটমহল ও সীমান্ত পুনর্নির্ধারণ 
ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশে, আর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল আছে ভারতে। সীমান্ত নির্ধারণের জটিলতায় দেশভাগের সময় থেকেই এসব ছেঁড়া ভূখণ্ড তৈরি হয়েছে। 'না ঘরকা না ঘাটকা' অবস্থানে ছিটমহলবাসী একরকম বন্দি জীবন-যাপন করেন। তিন বিঘা করিডোরের মানুষের যাতায়াত সমস্যা বহুল আলোচিত। একটি ওভারব্রিজ নির্মাণ করে এ ছিটমহলে বাংলাদেশিদের যাতায়াত সুগম করার ব্যবস্থা এবার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিছু ছিটমহলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও বেশ কয়েকটি কোনোভাবেই স্বাভাবিক যোগাযোগের আওতায় আসবে না। ফলে ছিটমহল বিনিময়ই যথার্থ সমাধান দিতে পারে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের কথা থাকলেও তা সীমিত আকারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাস্তবায়িত হয়েছে। ভারত পার্লামেন্টে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি রেটিফাই করেনি বলে তাদের দিক থেকে চুক্তি বাস্তবায়িত হতে পারেনি। এবার আশা করা হচ্ছে, দু'দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। ছিটমহলবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হবে বলেও সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। বাংলাদেশে ভারতের ছিটমহল আছে ১৭ হাজার ১৫৮ একর আর বাংলাদেশের ভারতে ছিটমহলের মোট আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর। ইতিমধ্যে ভারতের বিজেপি, আসামের উলফাসহ বিভিন্ন কট্টর রাজনৈতিক দল ভূমি বিনিময়ের বিরোধিতা করেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ টিম ইতিমধ্যে ৪০৯০ কিলোমিটার অপদখলীয় ভূমি সমস্যা সমাধান ও অনির্ধারিত সীমান্ত পুনর্নির্ধারণের কাজ শুরু করেছে।
 
 
সন্ত্রাসবাদ-বিচ্ছিন্নতাবাদ ও অপরাধ 
২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের সময় যৌথ ইশতেহারে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও অপরাধীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যৌথ অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশ এ অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অতিদ্রুত সক্রিয় হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খুঁজে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দিলি্ল-ঢাকা সম্পর্কের ব্যারোমিটার ইতিহাসে বহুবার ওঠানামা করেছে এ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কেন্দ্র করে। এবার ঢাকার অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা দিলি্লকে আশ্বস্ত করতে পেরেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতে লুকিয়ে থাকা অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের হস্তান্তরের দাবি আছে। ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর সাজাপ্রাপ্ত দুই খুনিকে ফেরত চায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা সীমান্ত পেরিয়ে যাতে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য ভারতের মনোযোগও বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে। পাশাপাশি সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে মানব পাচার, মাদক পাচার বন্ধের বিষয়গুলোও বিশেষ গুরুত্ব দাবি করছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদাম্বরমের সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে সন্ত্রাসী, অপরাধী ও সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ফেরত প্রদানের আশ্বাস পাওয়া গেছে। আশা করা হচ্ছে, পারস্পরিক স্বার্থেই দু'দেশ সন্ত্রাসবাদী ও অপরাধীদের বিষয়ে সজাগ থাকবে।
 
 
সীমান্তে রক্তপাত 
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দীর্ঘদিনের সমস্যা ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে বেসামরিক ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানি। অতীতে এ সমস্যার কারণে বহুবার দু'দেশের মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। বিএসএফ, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্তে প্রাণহানি বন্ধের আশ্বাস দিলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। প্রাণঘাতী নয়, এমন রাবার বুলেট ব্যবহারের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। তাতেও হত্যাকাণ্ড কমেনি। অবশ্য ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদাম্বরমের বাংলাদেশ সফরের পর সীমান্তে হত্যাকাণ্ড কমে এসেছে। সাধারণত গ্রামবাসী, কৃষক, রাখালরা অসাবধানতাবশত সীমান্ত অতিক্রম করে গুলির মুখে পড়ে। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাও গুলির শিকার হন। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে অসাবধানতাবশত সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দও করা যায়। তা না করে গুলি করাকে সমাধান হিসেবে মানতে নারাজ বাংলাদেশের মানুষ। সমস্যা সমাধানের জন্য প্রাণহানির বিকল্প কোনো পথ বের হলে দু'দেশের জন্য তা স্বস্তির কারণ হবে।
 
 
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিনিময় 
স্মরণাতীত কাল থেকে বাংলাদেশ ও ভারত একই ইতিহাসের অংশীদার। ঐতিহাসিক কারণেই দু'দেশের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক বিনিময় চালু আছে। স্বাভাবিক এই যোগাযোগ কখনও কখনও রাষ্ট্রীয় গণ্ডিকেও অতিক্রম করতে চায়। ভারত ও বাংলাদেশে এমন বহু ভাঙা পরিবার আছে যাদের এক অংশ থাকে বাংলাদেশে আরেক অংশ পশ্চিমবঙ্গে। এ পরিবারগুলোর মধ্যে যোগাযোগ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। এছাড়া শিক্ষাগত প্রয়োজন, ব্যবসা, পর্যটন, চিকিৎসাসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা কারণে দু'দেশে মানুষের যাতায়াত আছে। রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে এ যোগাযোগের ওপর। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা আছে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা পদ্ধতি সম্মানজনক নয়। সম্প্রতি অনলাইনে আবেদনের ব্যবস্থা হয়েছে কিন্তু তাতে ভিসা ভোগান্তি কমেনি। বাংলাদেশিরা এ ক্ষেত্রে সম্মানজনক ও সহজ একটি ব্যবস্থা আশা করে।
সড়ক ও রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা আছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাস যোগাযোগ সহজতর হয়েছে। দু'দেশের মধ্যে মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু হয়েছে। শ্লথগতির কারণে মৈত্রী এক্সপ্রেস যাত্রী আকৃষ্ট করতে পারছে না। অথচ ট্রেনকে জনপ্রিয় করতে পারলে দু'দেশের যোগাযোগ সহজ ও সুলভ হতে পারত। বাংলাদেশের মানুষ আশা করে ট্রেনের মধ্যেই কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হোক। তাতে ভোগান্তি কমবে, সময়ও বাঁচবে।
দু'দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা আছে। বিশেষত বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভারতে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে যে বাধা আছে তা অপসারণ করার দাবি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। দু'দেশের সরকারের মধ্যে চুক্তি করে বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে করেন। ভারতীয় কেবল অপারেটর ও ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গেই বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের চুক্তি করতে হবে। কিন্তু এমন যোগাযোগ শিগগিরই হয়ে উঠছে না। আছে বই আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রেও জটিলতা। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ভাষা এক হলেও বই বা পত্রিকা বিনিময় এত বছরেও একপক্ষীয় রয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রকাশকদের দাবি এ দেশের পর্যাপ্ত বই ভারতে রফতানির ব্যবস্থা হোক। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধানের প্রক্রিয়া ইতিবাচক গতি পাক, এটাই এদেশের সচেতন নাগরিকদের আশা।