Friday, December 30, 2011

সংলাপ

হাওয়া কোনদিকে তা বোঝা বড় ভার। দেশে আবহাওয়া অফিস আছে। তারা সারাক্ষণই হাওয়ার গতিবিধি খেয়ালে রাখে। কখন ঝড় হবে, কখন বৃষ্টি হবে, কখন শৈত্যপ্রবাহ হবে তার খবর রাখে। খবর রাখলেও সবসময় যে সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারে_ তা নয়। কেননা, খবর রাখাটাই জরুরি নয়, খবর নিয়ে সম্ভাব্য ভবিষ্যদ্বাণীটিই জরুরি। আমাদের দেশে অবশ্য আবহাওয়া অফিসের দিকে তাকিয়ে থাকার রেওয়াজ নেই। কেউ আবহাওয়া অফিসের সংকেত মেনে ছাতা নিয়ে বেরিয়েছেন ঘর ছেড়ে_ এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না। কিন্তু পাশ্চাত্যে লোকে রেডিও, টিভি, ইন্টারনেটে আবহাওয়ার সংবাদ শুনে, দেখে, পরে ঘর থেকে বের হন। সবসময় মিলতে হবে তা নয়, কিন্তু কিছুটা মিললেও প্রস্তুতির সার্থকতা মেলে। খবর যা মেলে তাতে বোঝা যায়, পাশ্চাত্যের লোকেরা আবহাওয়ার সংবাদে খুশি। আমাদের অবশ্য তত খুশির অবকাশ নেই। পাশ্চাত্যের আবহাওয়া দফতরগুলো মারফত খবর মিললে তা আমাদের আবহাওয়ায় ফলে বটে। কিন্তু দেশীয় আবহাওয়া দফতরের খবরে ভরসা অনেকেরই নেই। আবহাওয়া দফতরগুলোর তরফেও ভরসা আনার উদ্যোগ নেই। খুব চাপাচাপি করলে তারা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির অভাবের কথা জানিয়ে দেয়। সত্যিই তো, আগামীকাল কী ঘটবে তা জানার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কি আমাদের আছে? আবহাওয়ায় যেমন, তেমনি রাজনীতিতেও_ আগামীকাল কী ঘটবে তা জানার উপায় নেই।
এখন রাজনীতিতে চলছে শীতকাল, সংলাপের মৌসুম। শীতের শুরুতে অবশ্য মনে হয়েছিল আবহাওয়া শীতল থাকলেও রাজনীতি গরম থাকবে। বিরোধী দল একটু গরম কর্মসূচি নিয়েছিল; সরকারও গরম হয়েছে। ভাংচুর-অগি্নসংযোগ, ধরপাকড় সব ঘটবার পর একেবারে সব নিশ্চুপ। কোনো কোনো তরফে বলা হচ্ছে; না, এখনও সময় আসেনি। কেউ বলছেন, ধ্বংসের পথ নয়, সৃষ্টির পথে থাকুন। এসব কথায় কাজ হচ্ছে। বিরোধী দল ঠাণ্ডা হয়েছে। কতটা ঠাণ্ডা হয়েছে তা আবহাওয়া অফিস বলতে পারবে। কিন্তু কিছুটা ঠাণ্ডা যে হয়েছে তা নিশ্চিত। রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপে তারা যেতে রাজি হয়েছে। বলেছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবেই যাচ্ছে আলোচনায়। দাবি জানানোই মূল উদ্দেশ্য। মুখে যাই বলুক, যাচ্ছে_ সেটাই বড় কথা। রাষ্ট্রপতি ডাকলে যাওয়াটাই শ্রেয়। এর মধ্যে অবাক করার আরেক কথা শোনা গেল। পরিবেশ পেলে বিরোধীরা নাকি সংসদেও যাবেন। বেশ! সহসা কি রাজনীতির হাওয়া উল্টে গেল তাহলে? কোথায় লোকে ভেবেছিল, বিরোধীরা মাঠ গরম করবে; উল্টো সংসদ-সংলাপ শুরু হলো? রাজনীতির হাওয়া বদলের এসব চিহ্ন দেখে কিছু বোঝা যায়? শীত ঋতুতে বৃষ্টি হবে, নাকি শৈত্যপ্রবাহ, তাও কি বলা সম্ভব? যাই হোক, সংলাপ চলছে। বিষয় নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন। একে একে সবাই যাচ্ছেন। কেউ বলছেন, আইন করুন। আইন করে নিয়োগ দিন। কেউ বলছেন, এখনকার নিয়মেই চলুক। কেউ বলছেন, এই কমিশনই থাকুক। কেউ বলছেন, নতুন লোক আনুন। কেউ বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া হবে না। কেউ বলছেন, ওটি ছাড়াই কাজ সারুন। সবার কথাই শোনা হচ্ছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না_ শেষে কী হবে? নানা মুনির নানা মত উজিয়ে সিদ্ধান্ত কীভাবে হবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবু তো সংলাপ হচ্ছে। দু'বছর বাদে নির্বাচন। সময় তো চোখের পলকে চলে যায়। দেখতে দেখতে দু'বছর কেটে যাবে। তার চেয়ে বড় কথা, এখনই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ না দিলে চলবে না। নির্বাচন কমিশন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই দুই নিয়েই তো চিন্তা। দেশে তো আর কোনো বিষয় নেই। থাকলেও রাজনীতিকদের সেসব নিয়ে ভাবতে নেই। কথা বলতেও নেই। টম অ্যান্ড জেরির মতো তারা পঞ্চবার্ষিক তত্ত্বাবধায়ক খেলা খেলে যাবেন। আন্দোলন করবেন, মারপিট করবেন, ধরপাকড় করবেন, সংলাপ করবেন। সংসদ ছেড়ে রাজপথ, রাজপথ ছেড়ে সংসদ_ এই নিয়ে কাটিয়ে দেবেন। বেশ তো! রাজনীতি এখন অনেক ভালো। হরতাল কম, জ্বালাও-পোড়াও কম। ষড়যন্ত্র অল্প। এতেই নাগরিকদের স্বস্তি পাওয়া উচিত। নাগরিকদের সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় কারও কি আছে? না থাকুক। তবু রাজনীতি ভালো থাকুক। ভালো নির্বাচন কমিশন হোক, নির্বাচন নিয়ে ভালো ব্যবস্থা হোক। নাকি শেষে দেখা যাবে, এসব কিছুই হচ্ছে না। ফাইনাল খেলা রাজপথেই হচ্ছে! সে আমরা চাই না। আমরা চাই, রাজনীতিকরা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সংলাপ করে একটা সমাধান করুন। রাজনীতিকরা সুখে থাকলে দেশের মানুষও সুখে থাকবে নিশ্চিত।

Friday, December 23, 2011

তেল ও জলের দর

দুধ বেচে মদ খাওয়ার কথা আমাদের লোকপ্রবাদে আছে। মূল্যজ্ঞান লোপ হয়েছে এমন ব্যক্তির পরিস্থিতি বর্ণনা করতে দুধ বেচে মদ খাওয়ার উদাহরণ দেওয়া হয়। আমাদের সামাজিক ধারণায় মদ্যপান অহিতকর, পরিত্যাজ্য। পুষ্টির জন্য দুগ্ধপান উৎসাহিত করা হয়। ফলে বাজারে মদ যে দামেই বিক্রি হোক, কেউ যদি দুধ বেচে মদ খায় তবে তার মূল্যজ্ঞান লোপ পেয়েছে বলে ধরা হয়। দুধ বেচে যে মদ খায় সে নিশ্চিত উচ্ছন্নে গিয়েছে। অবশ্য ভ্রমণপিপাসু লোকদের কাছে শুনেছি, কোনো কোনো দেশে নাকি পানি, ওয়াইন আর দুধের মূল্য এক। কোথাও কোথাও নাকি একগ্গ্নাস পানির দর এক পেগ হুইস্কির চাইতে বেশি। বাজারে কোন জিনিসের দাম বেশি হবে তা ওই জিনিসের প্রাপ্যতা ও উৎপাদন খরচের ওপর নির্ভর করে। যেখানে মদের চাইতে পানির দাম বেশি সেখানে পানি উৎপাদনের খরচও নিশ্চয় বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে এটি জানবার মতো খবর বটে। কেননা মদ এখানে দুর্মূল্য। অন্যদিকে সস্তায় কোনো জিনিস বিক্রি হলে আমরা বলি_ পানির দরে বিক্রি হচ্ছে, বোঝা যায় পানির দাম কত কম। অবশ্য ক্রমশ পানির দাম বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে পানির দাম, দুধের দাম, মদের দাম কখনও এক হবে বলে মনে হয় না। কেননা, বাজারই শুধু মূল্য নির্ধারণ করে না। সমাজও মূল্য তৈরি করে, এমনকি মূল্যবোধও তৈরি করে। আমরা কথায় কথায় বলি, অমুক আর অমুক এক পঙ্ক্তিতে বসতে পারে না। পঙ্ক্তি মানে কবিতার লাইন নয়, বসার লাইন। খাবার আসরে একই মর্যাদার মানুষের একই পাতে বা লাইনে বসার রেওয়াজ। অসম মর্যাদার ব্যক্তিরা একই পঙ্ক্তিতে বসলে তাতে মূল্যের হানি ঘটে বলে সামাজিক ধারণা। অনেক সময় বলা হয়, অমুক ও অমুককে একই পাল্লায় মেপো না। পাল্লাও এখানে মর্যাদারই স্মারক। যে পাল্লায় চাল মাপা হয়, একই পাল্লায় মিষ্টি মাপার রেওয়াজ নেই। একইভাবে বলা হয়, তেল ও জলের দাম এক করো না। সমাজের মূল্যবোধ বদলের সঙ্গে বহু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন এক পঙ্ক্তিতে বসার ক্ষেত্রে মর্যাদার প্রশ্ন ওঠে না। আকবর বাদশাহ আর হরিপদ কেরানীকে এক পাল্লায় মাপলে কেউ সমালোচনার তর্জনী বাড়িয়ে দেন না। জলজ পানীয়গুলোর সমমূল্য কোনো দেশে থাকলে তা বিস্ময়কর হলেও, অগ্রহণযোগ্য খবর নয়। কিন্তু তেল ও জলের দাম এক হওয়া কঠিন। মাঝে মধ্যে দেশে অভিনব কিছু খবর মেলে, তাতে তেলের বদলে পানি, কচুরিপানা, খড় দিয়ে গাড়ি চালনার মতো বিস্ময়কর আবিষ্কারের কথা বলা হয়। এত আবিষ্কারের পরও তেলের মূল্য আর পানির মূল্য এক হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বোঝা যায়, তেল ও পানির ক্ষেত্রে বাজার ও সমাজের মূল্যবোধ এখনও অটুট। ভবিষ্যতে বহুদিন তা থাকবে। তবে সম্প্রতি ভারত সরকার তেল ও জলের মূল্য এক করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। তারা পেট্রোলের দাম খুব বেশি কমায়নি, আপাতত রাজনৈতিক কৌশলের কারণে স্থিতিশীল রেখেছে। কিন্তু ভারত-রত্ন পুরস্কারকে গণচরিত্র দিয়েছে। ভারতের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাবটি এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের রথী-মহারথীদের বাইরের লোকদের মধ্যেও বিতরণ করা হবে। ক্রিকেটার ও চলচ্চিত্র অভিনেতারাও পুরস্কৃত হবেন। এ নিয়ে ভারতের পত্রপত্রিকায় শোর উঠেছে। নাগরিক সমাজও সোচ্চার হয়েছে। তারা বলছেন, ক্রিকেট জনপ্রিয়, বলিউডের ফিল্মও জনপ্রিয়। কিন্তু বিদ্যা-জ্ঞান ও সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এগুলোর অবদান কী? শচীন টেন্ডুলকার কি সিভি রমণ রাধাকৃষ্ণনের মতো পণ্ডিতদের পঙ্ক্তিতে বসতে পারেন? ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মার্কন্ডেয় কাটজু বলেছেন, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মির্জা গালিবকে ভারত-রত্ন দেওয়ার কথা বলে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এখন ফিল্মস্টার আর ক্রিকেট স্টারদের পুরস্কার দেওয়ার কথা হচ্ছে। এটা করা হলে তার কোনো সামাজিক গুরুত্ব থাকবে না, এটা হবে স্রেফ একটা পরিহাস। ক্রিকেটারদের দোর্দণ্ড প্রতাপের মধ্যে ভারতীয় পত্রিকাগুলো যেভাবে কথা বলছে ভারত-রত্নের মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে তা প্রশংসনীয় বটে। জনপ্রিয়তাই যদি একমাত্র মানদণ্ড হয় তবে তো সমাজে কোনো দণ্ডই স্থির থাকতে পারে না। ফলে তেল ও জলের দাম কখনও এক হওয়া উচিত নয়। জলের কাছে তেলের কাজ আশা করাও ভুল কিংবা তেলের কাছে জলের কাজ। ভারতের সৌভাগ্য যে, সে দেশে তেল ও জল সকলে চেনে। আমাদের দেশে সমাজের জ্ঞানী-বিদ্বানদের চিহ্নিত করার ব্যবস্থাই নেই। ফলে এসব কথা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয় বলেই মনে হয়।

Sunday, December 11, 2011

পৃথিবীর সীমাহীন নিঃসঙ্গতা ও কেপলার-২২বি

আমাদের কবি একদা লিখেছিলেন, 'বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।' পৃথিবীকে সত্যিই কতটুকু জানা হয়েছে মানুষের? দেশে দেশে কত নগর, কত রাজধানী অলক্ষ্যে পড়ে রয়েছে। অনাস্বাদিত, অশ্রুত ও অদৃষ্ট সেসব নগর-বন্দর-রাজধানীকে জানার নিরন্তর প্রক্রিয়া চলছে। আজ অনেকেই বলেন, হাতের মুঠোয় এসে গেছে পৃথিবী। ধারণাগত দিক থেকে হাতের মুঠোয় এলেও বাস্তবে কিন্তু পৃথিবীতে জানা ও বোঝার জন্য জ্ঞান এবং তথ্য আহরণের প্রচেষ্টা চলছে নিরন্তর। শুধু পৃথিবী নয়, জানার প্রক্রিয়া পৃথিবীর বাইরে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। পৃথিবীকে যদি কবির ভাষায় বলতে হয় বিপুলা, তবে পৃথিবীর বাইরের পুরো বিশ্বজগৎকে বলতে হবে মহা মহা বিপুলা। কত নক্ষত্র, কত গ্রহ, কত ছায়াপথ সেখানে। আমাদের আরেক কবি লিখেছিলেন, "মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া,/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর।" বিশ্ববিধাতৃর বিস্ময় উৎপাদনের মতো পদক্ষেপ এখন মানুষের আয়ত্তে আসেনি। মানুষের পদধূলি সৌর জগতের বাইরে এখনও পড়েনি। কিন্তু দূরবীক্ষণের সাহচর্য নিয়ে মানুষের চোখ চলে গেছে অনেক দূর কোটি আলোকবর্ষেরও ওপারে। মহাবিশ্বজুড়ে মানুষ খুঁজে চলেছে অনেক কিছু। দেখে চলেছে যা দেখা যায়। কিন্তু অনুসন্ধানী মানুষের প্রথম ও প্রধান প্রশ্ন শুরুতে যা ছিল এখনও তা-ই। মহাবিশ্বে কি পৃথিবী একটাই, বুদ্ধিমান প্রাণী বলতে কি মানুষই একমাত্র? এ প্রশ্নে পৃথিবী সৌরজগতের একটি গ্রহ নয় শুধু, পৃথিবী হলো উপযুক্ত তাপ, চাপ, জলবায়ুর সমন্বয়ে গঠিত প্রাণধারণ উপযোগী গ্রহ। পৃথিবীতে বসে আরেক পৃথিবীকে খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রাণের সামান্যতম সম্ভাবনা কোথাও দেখা দিলে সমস্বরে ঘোষণা করছেন, হ্যাঁ মঙ্গলে মিললেও মিলতে পারে প্রাণ। বা অন্য কোথাও_ অন্য কোনোখানে। কিন্তু মানুষের নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে পারে এমন তথ্য এখনও মেলেনি। সবার বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারে এমন কথা এখনও কেউ বলেনি। তবু এবার আশা একটু বেশি। নাসার বিজ্ঞানীরা এবার একটু ভেবেচিন্তে, অপেক্ষা করে ঘোষণা দিলেন। বললেন, আছে আরেক পৃথিবী। আমাদের পৃথিবীর বোন। তার নাম কেপলার-বি২২। আমাদের গ্রহ থেকে দুই কোটি বিশ লাখ আলোকবর্ষ দূরে। অনেক দূরের সেই গ্রহ আমাদের পৃথিবীর মতোই আরেক সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সেখানেও দিন হচ্ছে, রাত হচ্ছে। তবে সেখানে কি প্রাণ আছে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর মতো অনুকূল তাপ আছে সেখানে। যুক্তি মোতাবেক, প্রাণ থাকার কথা। প্রাণ যদি থাকে তবে বিবর্তনের পথ ধরে সে প্রাণ কি মানুষের মতো বুদ্ধি সঞ্চয় করেছে? এখনও কেউ জানে না। তবে নাসার বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। তবে কি মানুষের সীমাহীন নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে যাচ্ছে কেপলার-বি২২? হয়তো। আরও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ যদি জানতে পারে যে সেখানে প্রাণ আছে; তবে পৃথিবীর সন্তানদের সঙ্গে কেপলার বি২২-এর সন্তানদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? ধরা যাক, সেখানে সভ্যতার পর সভ্যতা ধ্বংস হয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীরা এখন উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে। নয়তো, তারা আছে আদিম কোনো অবস্থানে। বিকশিত হতে হতে একদিন উন্নতির শীর্ষে উঠবে। আবিষ্কার করবে প্রযুক্তি। দূরবীক্ষণে তাকিয়ে দেখবে আকাশ, নক্ষত্রলোক। আমাদের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হবে। ভাববে, এখানে আছে প্রাণের সম্ভাবনা। মহাবিশ্বে তারা আর একা নয়। কিন্তু তারা কি আরেক গ্রহের প্রাণের সন্ধানে যাত্রা করবে? দুই কোটি ২০ লাখ বছর পর এসে পেঁৗছাবে? অথবা আমাদের পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানীরা কি রওনা হবেন সুদূর ভবিষ্যতের কোনো একদিন সেই পৃথিবীর উদ্দেশে? প্রযুক্তি এখনও সে শক্তি অর্জন করেনি। আপাতত তাই কবির কথা দিয়ে শেষ করি, 'আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি/সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ।' বিশ্বজগতে পৃথিবীর মতোই আরেক গ্রহ আছে, আপাতত এই আমাদের সুখের খবর।

Thursday, December 1, 2011

নতুন ঢাকা, পুরান ঢাকা

ঢাকার অধিবাসীদের কাছে শহরটি বহুদিন ধরেই দুই ভাগে বিভক্ত। সিটি করপোরেশন ভাগ নিয়ে তুমুল বিতর্কের মধ্যে এই সাধারণ তথ্যটির দিকে কারও মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি বলেই মনে হয়। তীব্র রাজনৈতিক তর্কের মধ্যে অত্যন্ত সাধারণ তথ্যটিও অনেক সময় সবার অলক্ষ্যে থেকে যায়। সেটা স্বাভাবিকও। ঢাকার অধিবাসীদের কাছে শহরের পুরাতন অংশটি পুরান ঢাকা আর নতুন অংশটি নতুন ঢাকা বা ঢাকা বলে পরিচিত। একদা বুড়িগঙ্গার তীরে এ নগরীর পত্তন ঘটেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা মোটামুটিভাবে পুরাতন অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। স্বাধীনতার পর ঢাকা উত্তরে বিস্তৃত হয়েছে_ টঙ্গীর সীমান্ত উত্তরা পর্যন্ত। স্বাধীনতার পরের চার দশকে যে ঢাকা তৈরি হয়েছে তাকে সহজে চেনা যায়। পুরান ঢাকাকেও আলাদা করে চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ২৯ নভেম্বর সংসদে বিল পাস হয়ে ঢাকা দু'ভাগ হলো। আর এ বিলে ঢাকা ভাগের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে ঢাকার ওই ধারণাগত বিভক্তিটাই সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেল। ঢাকা দক্ষিণ মোটাদাগে স্বাধীনতার আগের শহুরে জনবসতি। আর ঢাকা উত্তর স্বাধীনতার পরের জনবসতি। বিভক্ত ঢাকার ম্যাপের দিকে তাকালে এ সত্যটি সহজেই সবার চোখে ধরা দেওয়ার কথা। আর যারা সচক্ষে প্রতিদিন এ শহরকে দেখেন তারা সহজেই এ দুই ঢাকার গুণগত পার্থক্যের কথা জানেন। এ কথা সত্য, পুরান ঢাকার উত্তরাংশে অর্থাৎ ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুরে কিছু উন্নয়ন ঘটলেও, এর অধিকাংশ এলাকাই অবহেলিত। ঠিক যেন মেট্রোপলিটন শহর হয়ে উঠতে পারেনি। এক রাইডে উত্তরার রাস্তা থেকে চলমান একটি গাড়ি ওয়ারির রাস্তায় এসে পড়লে সহজে বোঝা যেতে পারে গুণগত পার্থক্যটি। সরকার ঢাকাকে দু'ভাগ করে ফেলায় এখন বুঝতে সুবিধা হবে। শহরের দুই অংশে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের সমতা বিধানের জন্য যদি ইতিবাচক প্রতিযোগিতা হয় তবে নিশ্চয়ই নাগরিকরা তাকে স্বাগত জানাবেন। দুটি সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পার্থক্যও বোঝা যাবে সহজে।
সবচেয়ে ভালো হতো যদি উত্তর-দক্ষিণ দিকনির্দেশ না করে পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকা নাম দেওয়া হতো। ভারতের রাজধানী দিলি্লর ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ আছে। তবে দিলি্ল বলতে যে পুরনো শহরের কথা আমরা জানি তা কিন্তু রাজধানী নয়। রাজধানী হলো নয়াদিলি্ল। দিলি্লর নতুন ও পুরাতনের সঙ্গে ঢাকার নতুন ও পুরাতনের বেশ মিল আছে। তবে দিলি্ল শুধু শহর নয়, শহরভিত্তিক একটি রাজ্যও। দিলি্লর পথ অনুসরণ করে ঢাকা নামটি শহরের পুরনো অংশকে দিয়ে নতুন অংশের আলাদা একটি নাম খোঁজা হলে আরও ভালো হতো। ঢাকার এই বিভক্তি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে এক ধরনের সংশয় কাজ করেছে আগাগোড়া। সত্যি কথা বলতে, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, রাজনৈতিক দল সবাই ঢাকা ভাগের বিপক্ষে। বলা যায়, সরকারি দলের গুটিকয় মানুষ ছাড়া প্রকাশ্যে কেউ ভাগ সমর্থন করেননি। তবু সংসদে বিল পাস হয়েছে। এখন দ্বিখণ্ডিত সিটি করপোরেশন নগরবাসীর জন্য বাস্তবতা। ঢাকা শুধু সিটি করপোরেশন নয়, বাংলাদেশের রাজধানীও। সিটি করপোরেশন দু'ভাগ হলেও রাজধানী নিশ্চয়ই দু'ভাগ হতে পারবে না। সঙ্গত কারণেই যে কোনো এক ভাগকে রাজধানী ঘোষণা করতে হবে, নয়তো বলতে হবে উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে পুরোটাই রাজধানী। অর্থাৎ শুধু সিটি করপোরেশনের সেবা দু'ভাগ হলো, রাজধানী নয়। তবে ঢাকা শহরের যে বাস্তবতা তাতে রাজধানীটিকে যে কোনো একটি অংশে ফেললেই ভালো হতো। যদিও পুরান ঢাকা রাজধানী নয় তবু রাজধানী ঐতিহ্যের কাছাকাছি থাকল। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সব ভবন পুরাতন অংশে স্থানান্তর করে ফেলা যেতে পারে। আবার নতুন ঢাকাতেও রাজধানী আসতে পারে, নতুন রূপ নিয়ে নতুন কোনো জায়গায় প্রশাসনিক ভবনগুলো স্থাপন করা যেতে পারে। শহরের দুই অংশের আলাদা চরিত্রও দাঁড় করানো যেতে পারে। এসব গঠনমূলক চিন্তা_ অবশ্যই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে। আমাদের রাজনীতি যেভাবে চলে সে ধারায় ঢাকা চললে, যে ঢাকা সেই ঢাকাই থাকবে। দুই কেন চার ভাগ করলেও কোনো পরিকল্পিত, আধুনিক ও উন্নত শহর অদূর ভবিষ্যতে আমরা পাব না।