Wednesday, May 5, 2010

সেলিম আল দীনের শাপলা, মহুয়া আর মুনিয়া পাখিগুলো


তলস্তয় নাকি নিজের সম্পর্কে বলতেন, এই যে মানুষগুলো দেখছ এরা আমার। চারপাশের বিল-ঝিল, ক্ষেত-খামার দেখছ, এগুলো আমার। এমনকি জানালার ধারে যে দোয়েল পাখিটিকে দেখছ সেও আমার।
রাশিয়ার তুলা অঞ্চলে ইয়াস্নাইয়া পলিয়ানায় জন্ম হয়েছিল লেভ নিকোলাইয়েভিচ তলস্তয়ের। তিনি ছিলেন সামন্তপ্রভু। জমিদার হিসেবে তার অধিকারে একটি এলাকা ছিল। ভূমিদাস, বিল-ঝিল, ক্ষেত-খামারের অধিকারও নিশ্চয় তারই ছিল। কিন্তু জানালার ধারে বসে থাকা স্বাধীন দোয়েল পাখিটির মালিকানা যখন তিনি দাবি করে বসেন, তখনই থমকে দাঁড়াতে হয়_ ভাবতে হয় এ তো তাহলে শিল্পীর কথা, জমিদারের নয়। যে শিল্পী সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, গল্পকার হিসেবে স্বীকৃত, যিনি মানবজীবনের এমন সব আখ্যান রচনা করেছেন, যার সামনে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে থমকে দাঁড়াতে হয় তার এমন অধিকারবোধে হয়তো ক্ষুণ্ন হবেন না অনেকেই। কিন্তু একালে যদি কেউ মুনিয়া পাখির দখল দাবি করে বসেন? যদি বিলে ফোটা শাপলার স্বত্বাধিকার দাবি করে বসেন? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে সেলিম আল দীনের সঙ্গে কেটেছিল আমাদের অনেক সময়। নাটক ও নাট্যতত্ত্বের শিক্ষক ছিলেন তিনি। আমরা অন্য বিষয়ে পড়তাম। কিন্তু ক্যাম্পাসে কেউ সাহিত্যচর্চা করলে তিনি সহজে এই অধ্যাপক ও নাট্যকারের ছাত্রত্ব নিতে পারতেন। তার সঙ্গে অবাধ আড্ডা, আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের সুযোগ মিলত।
সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, এ আড্ডাগুলো স্রেফ আড্ডা ছিল না। সেলিম আল দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যের বাইরে আরেক সমান্তরাল বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের পথে-প্রান্তরে। সেখানে তরুণ সাহিত্যিক, শিল্পী, কবিদের শিক্ষক, অগ্রজ হিসেবে তিনি শিক্ষা ও সঙ্গ দিতেন। খুব সচেতনভাবে চলত না এই সমান্তরাল শিক্ষায়তন, অবচেতনে_ সবার জানাশোনার বাইরে এই আড্ডাগুলোতে সমবেত হতেন তরুণ সাহিত্যিক-কবিরা। তারা নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠতেন, আবার সেলিম আল দীনের কাছ থেকেও শিখতেন। শুধু জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থী নন, ঢাকার তরুণরাও বঞ্চিত হননি এসব আড্ডা-আলোচনা থেকে।
রবীন্দ্রনাথ, তলস্তয়ের মতো বড় সাহিত্যিকদের সেলিম আল দীন বলতেন, অমরগণ। অমরদের শিল্প ও জীবনাদর্শ অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। মাঝে মধ্যে বলতেন_ এ রকম বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ঢাকা থেকে দূরে প্রশান্ত প্রকৃতির এক জনপদে শান্তিনিকেতনের মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বপ্নের কথা। সেখানে ক্লাস হবে গাছের তলায়, দেশ-বিদেশের সাহিত্যিক, শিল্পীরা পড়াতে আসবেন। লেখকরা লিখবেন, শিল্পীরা আঁকবেন সেখানে বসে। এসব স্বপ্নের কাছে পেঁৗছাবার অনেক আগে ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তার মৃত্যু হলো। মৃত্যুর পর তার সাহিত্য নিয়ে পাঠকমহলে নতুন কৌতূহল জন্মেছে। বাংলা নাটকে তার অবদান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মূল্যায়নের এ আয়োজনগুলো চলতে থাকবে এ আশা করা যায়। পাশাপাশি তার শিক্ষকতা জীবন নিয়ে, জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীদের প্রভাব নিয়েও বিস্তর আলাপ হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগরে মহুয়া ফুল ফোটার উৎসব হলে, সেলিম আল দীনের কথাই সবার আগে মনে পড়ে। কারণ উৎসবটি তিনি চালু করেছিলেন। তিনিই খবর রাখতেন জাহাঙ্গীরনগরে ক'টা মহুয়া গাছ আছে। বসন্তে কোন গাছে ফুল ফুটবে আর কোন গাছের নিচে আলো জ্বালিয়ে ফুল ফোটার উৎসব পালন করা হবে। বর্ষায় শিরীষের গাছে ফুল ফুটলে তিনি আমাদের শিরীষের তলায় নিয়ে গিয়ে ফুলের ঘ্রাণ নিতে বলতেন। কোথাও লেবু ফুল ফুটে তীব্র গন্ধ ছড়ালে তার সান্ধ্যভ্রমণের গতি স্লথ হয়ে আসত। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, বলো, এ কোন ফুলের ঘ্রাণ! ঘাসে ঘাসে পা ফেলে এমন অনেক প্রাকৃতিক সন্ধ্যা-সকাল আমাদের কেটেছে। প্রকৃতিপ্রেমিক ছিলেন খুব। উপভোগকে তিনি বলতেন, আস্বাদন বা সম্ভোগ। চারপাশের সৌন্দর্যকে সম্ভোগ করার এক মানবিক আর্তি ছিল তার মধ্যে। শিল্পীর জন্য এসব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু একদিন তিনি হঠাৎ জাহাঙ্গীরনগরের জঙ্গলে বসবাসরত মুনিয়া পাখিগুলোর স্বত্ব দাবি করে বসলে খুব অবাক হলাম। বললেন, আগে জাহাঙ্গীরনগরে কোনো মুনিয়া পাখি ছিল না। তিনি মানিকগঞ্জ থেকে দুই জোড়া মুনিয়া পাখি এনে ছেড়ে দিয়েছিলেন জঙ্গলে। সেগুলোই এখন জাহাঙ্গীরনগরে বংশবিস্তার করে অনেক পাখিতে পরিণত হয়েছে। আমরা একটু অবিশ্বাসের সঙ্গে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। এক সকালে জাহাঙ্গীরনগরের লেকে অসংখ্য লাল শাপলা ফুটতে দেখে আমরা যখন বিস্মিত তখন তিনি বলেছিলেন, এ শাপলাগুলোও তার। আগে জাহাঙ্গীরনগরের লেকে শাপলা ফুটত না। তিনি চাঁদপুর থেকে শাপলা এনে লেকের পানিতে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেগুলোই এখন লেকে লেকে ছড়িয়ে শত পুষ্প ফোটাচ্ছে। তার দাবি নিয়ে আমরা খুব মজা করতাম। কিন্তু কখনও কোনো বিষণ্ন মুহূর্তে মনে হতো, এমন যার প্রকৃতিপ্রেম তার জন্যই হয়তো শাপলা ফোটে, মহুয়া গন্ধ ছড়ায়, মুনিয়া পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায়। তার জন্যই হয়তো তলস্তয়ের দেশ সাইবেরিয়া থেকে পাখিরা উড়ে এসে জাহাঙ্গীরনগরের লেকে বসে থাকে। সেলিম আল দীনের মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণ করতে গিয়ে শাপলা আর মুনিয়া পাখির জন্য তার দাবির কথা মনে হলো। মনে হলো, তলস্তয়ও একদিন বলেছিলেন, জানালার ধারে বসে থাকা দোয়েল পাখিটি তার।

No comments:

Post a Comment