Monday, October 31, 2011

তাতা

তাতা বললে সহসা তাকে কারও চিনতে পারার কথা নয়। যদি বলা হয় মানিকের বাবা তাহলেও চেনা কঠিন। নামডাক ও ডাকনামের মধ্যে একটা সংঘর্ষ আছে। কারও নামডাক হলে তার ডাকনামটা সকলেই ভুলে যায়। যেমন সুকুমার রায়ের ডাকনাম যে তাতা সেটি তার নামডাকের পর অনেকেই ভুলে গেছে। তাকে যারা ডাকনামে ডাকতেন তাদের অনুপস্থিতি বড় কারণ বটে। কিন্তু শিশুদের কাছে ডাকনামের গুরুত্ব অনেক। ছোটরা ডাকনামেই অভ্যস্ত। ফলে তারা যখন শোনে যার ছড়া পড়ে তারা খুব পছন্দ করছে তার নাম তাতা, তবে নিজেদের একজন ভেবে নিতে সহজ হওয়ার কথা। তাতার কথা লোকে ভুলে গেলেও তাতার ছেলে মানিকের কথা অবশ্য অনেকেরই মনে থাকার কথা। চলচ্চিত্র অঙ্গনে এমন বহু মানুষ এখনও জীবিত যারা সত্যজিৎ রায়কে মানিকদা বলে ডাকতেন। তারা যখন সত্যজিৎ প্রসঙ্গে লিখেছেন তখন আমরাও জেনে গেছি যে ছোটদের প্রিয় চলচ্চিত্রকারের ডাকনাম মানিক। সুকুমার ও সত্যজিৎ দু'জনে বড়দেরও বেশ প্রিয়। সুকুমারের বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও ছোটদের বিশেষ পছন্দের নাম। রায় পরিবারের কথা বিশেষভাবে উঠছে, কারণ গতকাল ছিল তাতা অর্থাৎ সুকুমার রায়ের জন্মদিন। জন্মদিনের বাসি লেখা লেখার রেওয়াজ পত্রিকায় নেই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশে বোধহয় কারোই মনে ছিল না, কবে সুকুমার রায়ের জন্মদিন। আমারও মনে ছিল না। জন্ম ও মৃত্যুদিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের আয়োজন কয়েকটা তারিখকে কেন্দ্র করে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ২৫ বৈশাখ, ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২২ শ্রাবণ আমরা বেশ ঘটা করে পালন করি। এ দিনগুলোকে একেবারে জাতীয়ভাবে পালনীয় দিন বটে। কোনো কোনো দিবস ঘিরে মাস এমনকি বছরভর অনুষ্ঠানও হয়। মজার ব্যাপার, অনেকের অনেক পছন্দের কবি জীবনানন্দের জন্ম-মৃত্যুদিন কিন্তু অত ঘটা করে পালিত হয় না। এর কারণ কী? কেন বাৎসরিক রিচুয়ালের অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না স্মরণযোগ্য বাকি দিনগুলো? শুধু দু'চারজন বড় কবিকে স্মরণ করলেই কি দায় চুকে যায়? নতুন প্রজন্মের কাছে অন্যদের কথা পেঁৗছাবার দায় কার? সমালোচকরা বলেন, রিচুয়াল মেনে কাউকে স্মরণ করলে তাকে আত্মস্থ করা যায় না। এটা বহিরঙ্গের দিক। কিন্তু অন্তরে কোনো সাহিত্যিককে ধারণ করতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে, সাহিত্যকে ধারণ করতে হবে। কিন্তু রিচুয়ালের বহিরঙ্গেও কিন্তু অনেক মেসেজ থাকে। স্কুল পড়ূয়া শিক্ষার্থীরা কিন্তু এসব দেখে বুঝতে শেখে। তাদের কাছে, প্রিয় ও প্রয়োজনীয় মানুষগুলোকে তুলে ধরাও কিন্তু কর্তব্য। সেদিক থেকে সুকুমার রায় শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় সাহিত্যিক। প্রিয় তো বটেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় বলার পেছনে বিশেষ কারণ হলো, সুকুমার রায়ের গুরুত্ব ছোটদের জন্য এখনও সমান। অনেকেই বলেন, ছোটদের জন্য লেখা খুব বেশি এগোয়নি। কোথায় যেন থমকে আছে। অথচ শিশুদের জন্য তো ছড়া দরকার। গল্প দরকার। এখনও ছড়ার জন্য সুকুমারের কাছেই হাত পাততে হয়। ইংরেজি ভাষায় নার্সারি রাইমস বলে যে ছড়ার বিপুল সম্ভার আছে তার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন বাংলা ছড়া নেই।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ইংরেজি ছড়াগুলো ইংরেজি ভাষাভাষী সব দেশে এমনকি ইংরেজি মাধ্যমের সব স্কুলে ছড়িয়ে গেছে। তুলনায় বাংলা ছড়ার কী হাল? সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, শিশুদের জন্য সহজবোধ্য ছড়া কয়টি? তাই ছোটদের স্বার্থেই সুকুমার রায়কে স্মরণ করা দরকার। এখনও যদি ছোটদের জন্য সমৃদ্ধ সাহিত্যের ভাণ্ডার তৈরি না হয়, তবে কবে হবে? সুকুমার এখানে আমাদের অনেক কিছু শেখাতেও পারেন।

Thursday, October 27, 2011

কে হতে চায় কোটিপতি?

ভারতের সনি বা বাংলাদেশের দেশটিভিতে যারা 'কৌন বানেগা ক্রোড়পতি' বা 'কে হতে চায় কোটিপতি' অনুষ্ঠান দুটির নিয়মিত দর্শক, তাদের অনেকের কাছে হয়তো এমন কুইজ শোতে অংশ নিয়ে কোটিপতি হওয়াটাই সহজ পন্থা। কিন্তু কুইজ শো ছাড়া কোটিপতি হওয়ার আর উপায় কী? শোনা যায়, দেশে এখন হাজার হাজার কোটিপতি আছে। তাদের কাছে জেনে নেওয়া যেতে পারে কোটিপতি হওয়ার উপায়। কিন্তু কোটিপতিরা কোটিপতি হওয়ার গল্প কি সহজে বলেন? টাকা বানানোর জাদুর প্রদীপ যাদের হাতে তারা সহজে প্রদীপের রহস্য ফাঁস করতে চান না। ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়। যারা বাঁকা চোখে দেখতে অভ্যস্ত তারা বলেন, এমন অনেক কোটিপতি আছেন যারা কখনও কোটিপতি হওয়ার গল্পটি বলতে পারবেন না। কেননা, কোটিপতি হওয়ার অনেক পথই বন্ধুর, সাধারণ দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য বলেও বিবেচিত হতে পারে। তবু কিছু গল্প প্রেরণাদায়ক। সে গল্পগুলোও বলা যায়, শোনা যায়। সত্যি কথা বলতে, নতুন প্রজন্মের কাছে কোটিপতি হওয়ার ভালো গল্পগুলো পেঁৗছানো দরকার। শচীন বনশাল ও বিনি্ন বনশালের গল্প এ দেশের কোটিপতিদের উৎসাহিত করতে পারে। গল্পটি ছাপা হয়েছে ইকোনমিস্টের চলতি সংখ্যায়_ ভারতের বাণিজ্য নিয়ে বিশেষ আয়োজনে। এ দু'জন ভাই নন, আত্মীয়ও নন। কিন্তু দু'জনের মিল দারুণ। দু'জনেই বড় হয়েছেন চণ্ডীগড়ে, দিলি্ল আইআইটিতে পড়েছেন, একটি আমেরিকান ফার্মে কাজ করেছেন। দুই বছর কাজ করার পর নিজেদের ১০ হাজার ডলারের সঞ্চয় নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে শুরু করেছেন ই-কমার্সের একটি উদ্যোগ। ব্যবসা শুরুর সাল ২০০৫। অ্যামাজন ডটকমের মতো একটি সাইট শুরু করেছিলেন তারা। নাম ফ্লিপকার্ট। বই বিক্রি দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে আরও পণ্য যুক্ত হয়েছে তাদের তালিকায়। এখন ওয়েবসাইটের রেজিস্টার্ড ইউজার ১০ লাখ। আর মাসে বিক্রি এক কোটি ডলার। এমন অবস্থানে পেঁৗছাতে দীর্ঘ একটি পথ পাড়ি দিয়েছে ফ্লিপকার্ট। ভারতের ই-কমার্সের অবস্থা এখন কিছুটা উন্নত হলেও পাঁচ বছর আগে আমাদের দেশের মতোই ছিল। অনলাইনে কেনাকাটা প্রায় অসম্ভব কাজ। অনলাইনে কেনাকাটার জন্য অনলাইন ব্যাংকি বা ক্রেডিট কার্ড সিস্টেম উপযুক্ত নয়। পে-পালের মতো নিরাপদ কেনাকাটার সাইট ভারতে চালু কিন্তু খুব বেশি মানুষ এটি ব্যবহার করেন না। অনলাইনে কিছু বিক্রি করে টাকা আয় করা কঠিন। শুধু পেমেন্ট বা ব্যাংকিংই নয়, ক্রেতা যে জিনিসটি কিনলেন সেটি ক্রেতার কাছে পেঁৗছানোও কঠিন। কেননা, ভারতে ডিএইচএলের মতো কুরিয়ার সার্ভিস নেই। স্থানীয় কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর ওপর শেষ পর্যন্ত নির্ভর করতে পারেনি ফ্লিপকার্ট। ফলে তারা চালু করেছে এক অভিনব পদ্ধতি_ পিওডি_ পেমেন্ট অন ডেলিভারি। ফ্লিপকার্ট ডটকমে কেউ কোনো বইয়ের অর্ডার করলে দুই থেকে চারদিনের মধ্যে ফ্লিপকার্টের কর্মী পেঁৗছে যাবে ক্রেতার বাড়িতে, বই বুঝিয়ে দিয়ে দাম নিয়ে আসবে। এভাবে অনলাইন পেমেন্টের জটিলতা এবং পেঁৗছানোর সমস্যা দুটিকেই জয় করেছে ফ্লিপকার্ট। অবশ্য যারা ক্রেডিট কার্ড বা অনলাইন ব্যাংকিং বা পে-পালের মাধ্যমে কিনতে চান তাদেরও সুব্যবস্থা আছে। কিন্তু মাল পেঁৗছানোর দায়িত্ব ফ্লিপকার্টের কর্মীদের। আর তাদের তৎপরতা দেখে বড় গ্রুপ ও কোম্পানিগুলোও এখন ফ্লিপকার্টের মাধ্যমে বিকিকিনি করতে উৎসাহী হচ্ছে। ফ্লিপকার্টকে বলা হচ্ছে, আরেক ইনফসিস। ভারতীয় উদ্যোগে বিশাল এক আইটি সংস্থা ইনফসিস। প্রশ্ন হলো, শচীন ও বিনি্নর মতো উদ্যোগ কি বাংলাদেশে শুরু হতে পারে? ভারতের সঙ্গে তুলনীয় হলেও আমাদের অবস্থা অনেক খারাপ। এখানে কেউ যদি একটি ওয়েবসাইট খুলতে চান তবে সোজাসুজি ডোমেইন হোস্টিং পর্যন্ত কিনতে পারবেন না। কিছু কিনে দেশের বাইরে টাকা পাঠাবার সহজ উপায় নেই। অনলাইন ব্যাংকিং বলে যে ব্যাপারের কথা শোনা যায় তার সঙ্গে ই-কমার্সের যোগাযোগ সামান্য। পে-পাল চালু হয়নি হাজার দাবি সত্ত্বেও। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে অনলাইনে কেনাকাটার নজির খুব কম। এ অবস্থায় অ্যামাজনের মতো সাইট এখানে চালু করা মুশকিল। সে ক্ষেত্রে ফ্লিপকার্ট বিশেষ সহায়ক হতে পারে। বিশেষ করে পিওডি সিস্টেম জ্যামের শহরে জনপ্রিয় হতে পারে।

Monday, October 24, 2011

আরব রাজনীতির পিকাসো

লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির পতন তখন আসন্ন। সবাই ভাবছেন ক্ষমতার চূড়া থেকে পতনের পর এখন কী করবেন কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি? গণমাধ্যমে জোর গুজব দেশ ছেড়ে সপরিবারে পালাচ্ছেন গাদ্দাফি। সে সময়ও তিনি বলেছেন, 'আমি এই ভূমি ছেড়ে কোথাও যাব না। এখানেই যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হব।' দেশবাসীর উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন, যাতে তারা ঘর ছেড়ে ময়দানে, রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ করেন বিদ্রোহী সেনাদের। দীর্ঘদিনের অপশাসনে ক্লান্ত, ত্যক্ত-বিরক্ত মানুষ তার পক্ষে নেমে আসেনি। বরং বিদ্রোহীদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে। কিন্তু কথা রেখেছেন গাদ্দাফি। ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের (এনটিসি) যোদ্ধারা যখন একের পর এক শহরের পতন ঘটিয়ে গাদ্দাফির জন্মস্থান সিরতের দিকে এগোচ্ছিল, তখনও তিনি দেশে ছিলেন। সিরতের চূড়ান্ত পতনের সময়ও তিনি যুদ্ধরত ছিলেন। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, সিরতেই তিনি আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকৃত অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এনটিসির শীর্ষ মুখপাত্র মাহমুদ শাম্মাম বলেছেন, কর্নেল গাদ্দাফি মারা গেছেন। 'আজ নতুন এক লিবিয়ার জন্ম হলো। এটাই প্রকৃত মুক্তির দিন। আমরা তার বিচার করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলাম। আল্লাহর হয়তো অন্য ইচ্ছা ছিল।' এভাবেই তার মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেছেন শাম্মাম। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর পর আরব বিশ্বে তিনিই ছিলেন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর চক্ষুশূল একমাত্র জীবিত নেতা। ১৩ ডিসেম্বর ২০০৩-এ গ্রেফতারের পর বিচারের মাধ্যমে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর ২০০৬ তারিখে। কর্নেল গাদ্দাফি কোনো বিচারের মুখোমুখি হতে পারলেন না। ২০ অক্টোবর ২০১১ তারিখটিই ইতিহাসে তার মৃত্যুদিন হিসেবে লেখা
থাকবে। তবে, অনেক বিষয়ে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তার মিল। সাদ্দামের মতো গাদ্দাফিও আত্মরক্ষা ও পলায়নের জন্য পাতালপুরী ও পাতালপথ তৈরি করেছিলেন। সেগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে আসেনি। ধরা পড়ার মুহূর্তে দুই নেতাই গর্তে লুকিয়ে আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা করেছেন_ এও এক আশ্চর্য মিল।
সংবাদমাধ্যম তাকে বলে লিবীয় একনায়ক। কেউ কেউ বলে লিবীয় নেতা। লিবিয়ায় সীমিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর তার পদবি হয় 'ব্রাদার লিডার অ্যান্ড দ্য গাইড অব রেভলিউশন'_ অর্থাৎ নেতাভাই ও বিপ্লবের পথপ্রদর্শক। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য গণআন্দোলন শুরু হলে গাদ্দাফি বলেছিলেন তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট নন। তিনি লিবীয়দের স্বাভাবিক নেতা। দেশের সবাই তাকে ভালোবাসে। তাই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়।
কেউ তাকে বলেছেন খামখেয়ালি, গোঁড়া, কেউ বলেছেন পাগল। তার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কও তৈরি করেছেন অনেক নেতা। সম্পর্কের প্রয়োজন ফুরালে আবার তাকেই পাগল বলে গালি দিয়েছেন। গাদ্দাফি বহু বছর পশ্চিমাদের কাছে শত্রু বলে বিবেচিত হলেও নাইন ইলেভেনের পর তার ও পশ্চিমাদের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটে। তিনিই প্রথম ওসামা বিন লাদেনের গ্রেফতার দাবি করেছিলেন। লিবিয়ার গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছিলেন। রীতিমতো প্রেমে পড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসের। তাকে প্রিয় আফ্রিকান নারী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। লিবিয়ার এই পরিবর্তিত মনোভাবকে স্বাগত জানিয়েছিল ওয়াশিংটন, লন্ডনসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছিল। এনটিসির যোদ্ধারা আগস্টে গাদ্দাফির প্রাসাদের পতন ঘটানোর পর বেশ কিছু নথিপত্র মিলেছে যাতে বোঝা যায় শেষ সময়ে পাশ্চাত্য শক্তিগুলো তাকে রক্ষার চেষ্টাও করেছিল।
নিজের ও নিজের দেশের জন্য পৃথক একটি রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করেছিলেন গাদ্দাফি। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ক্ষমতা দখল করার পর নিজেকে মরুর বেদুইন দার্শনিক ও রাজা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি লিবিয়ার নতুন নাম দিয়েছিলেন_ দ্য গ্রেট সোশালিস্ট পিপলস লিবিয়ান জামাহিরিয়া। আরবি জামাহিরিয়ার অর্থ গণপ্রজাতন্ত্র। তার দর্শন অনুসারে জনগণ ক্ষমতাশালী হলে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তিনি স্থায়ী বিপ্লবের দর্শন প্রচার করেছিলেন যা বাস্তবায়িত হলে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র বিতাড়িত হবে।
দেশের মানুষের অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে মাও সে তুংয়ের রেড বুকের আদলে লিখেছিলেন গ্রিন বুক। তাতে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের নানা কৌশল ছিল, সঙ্গে ছিল দেশ গড়ার স্বপ্নও।
ভিন্নধর্মী পোশাক-আশাক ও কথাবার্তার কারণে নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে অভিহিত করেছিল বৃদ্ধ রকস্টার বলে। যে কোনো আন্তর্জাতিক আসরে সবার নজর কাড়ার মতো ব্যক্তিত্ব ছিল তার। ব্যতিক্রমধর্মী পোশাক, সোজাসাপ্টা কথাবার্তা আর চমকে দেওয়ার মতো ব্যবহার ছিল তার। প্যারিস, রোম এমনকি নিউ ইয়র্ক যেখানেই যেতেন সেখানেই সাদা তাঁবু সঙ্গে নিতেন তিনি। তাঁবু খাটিয়ে তাতে থাকতেন। তাঁবুর দেয়ালে মরুর খেজুর গাছ, উট এবং গাদ্দাফির বাণী থাকত।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। জাতিসংঘে ২০১০ সালে শেষ যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ আর দুনিয়াজুড়ে তাদের দখলদারিত্বে তীব্র বিরোধিতা ছিল। লিবীয়দের মধ্যে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে তীব্র ঘৃণা ছিল তার মূর্ত রূপ ছিলেন গাদ্দাফি। পশ্চিমের দেশগুলো গাদ্দাফির প্রতিটি পদক্ষেপ খেয়াল করত। তিনি তো বটেই, তার রাজনৈতিক দর্শন, তার দেশে প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীরা পৃথিবীতে অনেক হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত হয়েছে। বিশেষত লকারবি বোমা হামলার জন্য তাকে দায়ী করা হয়। অভিযোগ যাই থাকুক। তিনি যে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সাহসী ছিলেন এ বিষয়ে তার চরম শত্রুও সন্দেহ পোষণ করবে না। একজন আরব বিশ্লেষকের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, তাকে সম্প্রতি আরব রাজনীতির পিকাসো হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। বিশ্বখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোর শিল্পী জীবনে যেমন ছিল ব্লু, রোজ, কিউবিস্ট নানা কালপর্ব তেমনি গাদ্দাফির জীবনেও ছিল প্যান-আরব, ইসলামিস্ট এবং প্যান-আফ্রিকান পর্ব। ৪২ বছরের অধিক সময়ে ক্ষমতায় থাকাকালে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলেছেন গাদ্দাফি। আরব ঐক্য, মুসলিম ঐক্য, আফ্রিকান ঐক্যের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের ধুয়াও তুলেছিলেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে গোপন ও প্রকাশ্য বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৪২ সালে সিরতের কাছে এক আরব বেদুইন তাঁবুতে গাদ্দাফির জন্ম। তিনি ছিলেন গাদ্দাফা নামে আরবদের ছোট এক গোত্রের সন্তান। শৈশবেই তিনি দেখেছেন ইসরায়েলের কাছে আরব বিশ্বের পরাজয়ের নানা নজির। তখন কিশোর হিসেবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার কাছে তখনকার নেতা ছিলেন মিসরের গামাল আবদুল নাসের। ১৯৬১ সালে বেনগাজি মিলিটারি একাডেমীতে প্রশিক্ষণ নেন, ১৯৬৬ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন যুক্তরাজ্যে। যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন তিনি ছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট।
লিবিয়ার ক্ষমতা দখলের উদ্যোগের পেছনেও ছিল কৈশোরের গুরু গামাল আবদুল নাসেরের প্রেরণা। ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর তরুণ অফিসারদের সংগঠিত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন গামাল আবদুল নাসের। তরুণ অফিসারদের তৎপরতা 'ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট' হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। সে আদলেই ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তরুণ অফিসারদের নিয়ে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন গাদ্দাফি।
ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বহুদিন পর্যন্ত আরব জাতিগুলোর মধ্যে ঐক্যের উদ্যোক্তা ছিলেন গাদ্দাফি। তিনি আরব নেতাদের একত্র করার বহু চেষ্টা নিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে পশ্চিমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবে। শেষ পর্যন্ত সে আশা পূর্ণ হয়নি। পশ্চিমাদের কৌশলের কারণেই হোক আর নিজেদের মধ্যকার বিবাদের কারণেই হোক আরব নেতারা একত্র হতে পারেননি। তবে আরব দেশগুলোর বহু মানুষ তাকে স্বাধীনচেতা আরব নেতা হিসেবেই গণ্য করেছে। শুধু আরব দেশগুলো নয়, আরব দুনিয়ার বাইরেও মুসলমানরা তাকে সাদ্দামের মতোই সাহসী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখতেন।
আরব বিশ্বের ঐক্যের স্বপ্ন বিফল হলে তিনি মুসলিম ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। তাতেও তেমন সাড়া মেলেনি। শেষ পর্যন্ত তার উপলব্ধি হয় যে আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার নেতা হিসেবে তার কথা আরবরা শুনবে না। ফলে, আফ্রিকার ঐক্যের দিকেই তার মনোযোগ সরে যায়। তিনি বলেন, আরব ঐক্যের কথা তো অনেক বললাম গত ৪২ বছরে, কেউ বুঝল না। এখন আফ্রিকান ঐক্যই আমার লক্ষ্য। এ উপলব্ধি থেকে তিনি আফ্রিকান জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন এবং তাতে কিছুটা সফলও হন। সাম্প্রতিক সংকটে আফ্রিকার নেতা ও গোত্রপ্রধানদের অনেকেই তার পাশে ছিলেন। তার একটি স্বপ্ন আফ্রিকান জাতিগুলো পূরণ করতে পারেনি। তিনি চেয়েছিলেন পুরো আফ্রিকার রাজাদের রাজা হতে। সে আশা পূরণ হয়নি।
যখন তিনি হতে চেয়েছিলেন আফ্রিকার রাজাদের রাজা, তখন নিজের দেশেই তার সিংহাসন টলোমলো। ৪২ বছর তিনি লিবিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ১৯৫৯ সালে তেলের খনি আবিষ্কারের আগে লিবিয়া দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু তেল আবিষ্কারের এক দশক পর্যন্ত তাদের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থানের পর লিবীয় সরকার তেল কোম্পানিগুলোতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য করে। লিবিয়ার সাফল্য তখন অন্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকেও উৎসাহিত করেছিল। রাজস্ব আয় বেড়ে যাওয়ার পর রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুল, বাড়িঘর বানাতে শুরু করে গাদ্দাফি সরকার। দেশকে সবুজায়ন করার বিপুল উদ্যোগ নেয়। ১৯৬৯ সালে লিবীয়দের গড় আয়ু ছিল ৫১ বছর, এখন সেটি ৭৪-এ উন্নীত। স্বাক্ষরতার হার এখন ৮৮ শতাংশ। মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১২ হাজার ডলারে পেঁৗছেছে। কিন্তু গণতন্ত্র, আধুনিকতা আর মুক্তির স্বাদ দিতে পারেনি লিবিয়ার জনগণ। এজন্য একা গাদ্দাফিকে দোষারোপ করছেন না বিশ্লেষকরা। আরব বিশ্বের অধিকাংশ দেশ গণতন্ত্রবঞ্চিত। গণতান্ত্রিক অধিকার সেখানে সীমিত। ফলে, নতুন যুগের হাওয়া লেগে যখন তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়া পর্যন্ত লণ্ডভণ্ড হতে থাকল তখন গাদ্দাফির লৌহশাসন অবসানের বীণাও বেজে উঠল। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি গাদ্দাফি। নতুন যুগের চাওয়া অনুসারে নিজেকে ও দেশকে পরিচালনা করতে পারেননি। লিবিয়ায় কোনো সংসদ নেই, একক সামরিক নেতৃত্ব নেই, রাজনৈতিক দল নেই, কোনো গণসংগঠন নেই, নাগরিক সমাজ নেই, এমনকি কোনো এনজিও-ও নেই। একক শাসন পাকাপোক্ত করতে দীর্ঘদিন সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছেন তিনি। দেশবাসীর গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিহত করতে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছেন। সেই যুদ্ধের পরিণতিতেই বিদায় নিতে হলো তাকে, হাজারো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। কেননা, মুক্তির জন্য দেশবাসীর চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রামে প্রধান শত্রু তিনি। আরব বেদুইন তাঁবুতে যে ইতিহাসের শুরু হয়েছিল একদিন সেই তাঁবুর কাছে সে ইতিহাসের যবনিকাপাত ঘটল। গাদ্দাফির পর নতুন যুগের সূচনা ঘটল বটে কিন্তু লিবিয়া কী মুক্ত হলো নাকি নতুন শৃঙ্খলে জড়িয়ে পড়ল সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে এখনই।

Wednesday, October 19, 2011

মহাবন্যা

বন্যাপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের বিশেষ পরিচয় আছে। শোনা যায়, এক সময় দেশের বাইরে বাংলাদেশের অধিবাসী বলে পরিচয় দিলেই বিদেশিদের মুখে মেঘ করে আসত। মুহূর্তেই তারা ভেবে বসতেন এ লোক নিশ্চয়ই বানভাসি, নয়তো সাইক্লোনতাড়িত, নয়তো কোনো ঝড়ে এর ভিটেমাটি উচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখনও এই পরিচয় পুরোটা ঘোচেনি। তবে দুর্যোগতাড়িত বাঙালির আরও নানা পরিচয় জুটেছে বিশ্বের দরবারে। আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিচয় আছে। সঙ্গে আছে প্রবাসী, অনাবাসীদের নানা সুকৃতিও। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বললে বন্যায় প্লাবিত সেই বিস্তীর্ণ ভূভাগের কথা সহসা চোখে ভাসে না। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যা কম হয়েছে। কিন্তু বন্যার বাস্তবতা তিরোহিত হয়েছে বলে মনে হয় না। এ দেশে সবাই জানেন, বর্ষা মৌসুমে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। তাতে জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতিও হতে পারে। দেখার মতো প্রস্তুতি না থাকলেও মনে মনে সবাই প্রস্তুত থাকে। নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই নানা আশঙ্কায় সকলে দিন গুনতে থাকে। এমন বন্যাপ্রবণ দেশ হিসেবে পৃথিবীর কোথায় বন্যা হচ্ছে তার খোঁজখবর রাখাটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিককালের কয়েকটি মহাবন্যার খবরও এ দেশের মানুষকে তেমন দোলা দিয়েছে বলে মনে হয় না। মহাপ্লাবনের কথা আমরা ধর্মগ্রন্থ, পুরাণ, পুরনো সাহিত্য থেকে জানি। সাম্প্রতিক এ ঘটনাগুলোকে অনেকে মহাপ্লাবনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু আপাতত মহাবন্যা বললেই বোঝা যাবে এগুলোর আকার-প্রকার। থাইল্যান্ডের মহাবন্যা প্লাবিত করেছে চাও ফারিয়া নদীর দুই কূল। বন্যা এখনও চলছে। ছড়িয়েছে মেকং নদীতেও। সেপ্টেম্বরে শুরু হয়ে অক্টোবরে বন্যা বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবনকে প্লাবিত, পর্যুদস্ত করে তুলেছে। সেখানকার বন্যার সচিত্র খবর প্রতিদিনই বাইরের পত্রিকাগুলোতে দেখা গেলেও আমাদের পত্রপত্রিকাগুলোতে কিন্তু এখনও দেখার মতো করে ছাপা হচ্ছে না। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার মহাবন্যার তেমন খবরও আমরা দেখিনি। কুইন্সল্যান্ড ও ভিক্টোরিয়ার বিপুল অঞ্চল ২০১০-১১তে পুরো তলিয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি, প্লাবন ও ঢলে মানুষের জীবন অচল হয়ে গিয়েছিল। তখন বাইরের পত্রিকাগুলোতে এ বন্যাকে মহাপ্লাবন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এমনকি সার্কভুক্ত পাকিস্তানের বন্যাও আমাদের এখানে বড় খবর তৈরি করতে পারেনি। প্রায় ৩০ লাখ বর্গমাইল এলাকা প্লাবিত হয়েছিল ২০১০ সালে। জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। পাকিস্তানে বোমা বিস্ফোরণ বা এমন কিছু ঘটলে তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায়। অথচ বন্যায় ২০ মিলিয়ন মানুষ প্রচণ্ড দুর্বিপাকে কাটাল সে খবর আমরা নিলামই না। বন্যা এবারও হয়েছে পাকিস্তানে। ২০১০-এর মতো না হলেও এবারের বন্যার ভয়াবহতাও কম নয়। কিন্তু রাজনৈতিক নানা খবরকে ছাড়িয়ে সে বন্যার খবর আমাদের কানে পশতে পারেনি। পৃথিবীতে বড় ঘটনা ঘটলে তা প্রচার পাওয়ার কথা। এর নিজস্ব রীতি আছে। পাঠক পড়তে চায়। কিন্তু বন্যার ব্যাপারটা আলাদা। আমরা যখন পাশের দেশে এশিয়ায় বন্যার খবর নিচ্ছি না, বিচলিত হচ্ছি না তখন আমাদের দেশে বন্যা, সাইক্লোন হলে পাশের দেশগুলোর মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচার হবে এটি কীভাবে আশা করব? আমরা কি তখন বলব, বাংলাদেশের খবর বিশ্বমিডিয়ায় উপেক্ষিত? আমরা যখন দায়িত্ব পালন করি না তখন অন্যদের দায়িত্ববোধ কীভাবে আশা করব?

Monday, October 17, 2011

সে আগুন ছড়িয়ে গেল

টাইম ম্যাগাজিন সাধারণত তাদের প্রকাশিতব্য সংখ্যাটি ছাপা কাগজে প্রকাশের আগেই ইন্টারনেটে প্রকাশ করে। ইন্টারনেটের সুবিধা হলো সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া, ইউরোপ এবং সাউথ প্যাসিফিকের চারটি সংস্করণই পরপর দেওয়া থাকে। চাইলে যে কেউ যে কোনো সংস্করণ পড়তে পারেন। ছাপা কাগজে যারা টাইম ম্যাগাজিন পড়েন তাদের সে সুযোগ থাকে না। এশিয়ার দেশগুলোর পাঠকরা এশীয় সংস্করণই সাধারণত বাজারে কিনতে পারেন। ইন্টারনেটের সুবিধা হলো, প্রতিটি সংস্করণ মিলিয়ে পড়া যায়। তাতে সূক্ষ্ম ও স্থূল অনেক পার্থক্য থাকে। যেমন, একবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সংস্করণের একটি লেখার শিরোনাম দেওয়া হয়_ 'আফগানিস্তানে আমরা কী করছি?' আবার এশিয়া ও সাউথ প্যাসিফিক সংস্করণে একই লেখার শিরোনাম_ 'আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র কী করছে?' পার্থক্যটা খেয়াল করার মতো। ২৪ অক্টোবর টাইম ম্যাগাজিনের যে সংখ্যা প্রকাশ হবে তার তিনটি সংস্করণের বিষয় একই, সেই আফগানিস্তান_ 'কেন যুক্তরাষ্ট্র কখনও আফগানিস্তানকে বাঁচাবে না?' কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রকাশিত সংস্করণের বিষয়_ 'নিশ্চুপ সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রত্যাবর্তন'। 'দ্য রিটার্ন অব দ্য সাইলেন্ট মেজরিটি'। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে অনেকের আগ্রহ আছে। সবাই বুঝতে চান কী ঘটছে। বোঝার ক্ষেত্রে টাইমের পর্যবেক্ষণ অবশ্যই প্রভাব ফেলে। তারা যেভাবে বিষয়টাকে নিশ্চুপ সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রত্যাবর্তন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তাকে অনেকেই যথার্থ মনে করবেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করপোরেট কোম্পানিগুলোর যে একাধিপত্য তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিতে তাদেরই রমরমা। সাধারণের মতের বিশেষ গুরুত্ব নেই। মত দেওয়ার সুযোগও নেই। সেখানকার সমাজে জনমত বলে যে বিষয়টির অস্তিত্ব তাও করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে বহুকাল সাধারণের কথা সেখানে শোনা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের মন্দার সময় সাধারণ লোকে ভুগেছে, চাকরি হারিয়েছে, কষ্টে দিনযাপন করেছে। কিন্তু খুব বেশি প্রতিবাদ রাস্তায় দেখা যায়নি। কিন্তু এবার মন্দার পূর্বাভাসেই রাস্তা ফুঁসে উঠেছে। মার্কিনরা ওয়ালস্ট্রিট দখলের কর্মসূচি দিয়েছে। ওয়ালস্ট্রিট সেখানে করপোরেট কোম্পানি, ব্যাংক-বীমার আখড়া। ওয়ালস্ট্রিটমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে বার্তা দিতে চাইছে মানুষ। সরকার, রাজনীতি ও দেশ পরিচালনায় করপোরেট আধিপত্যের অবসান চাইছে। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট বা ওয়ালস্ট্রিট দখলের কর্মসূচি যারা পালন করছে তাদের অধিকাংশই তরুণ। কোনো কোনো পত্রিকায় তাদের কিডস বা নিতান্তই বাচ্চা বলে অভিহিত করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, বাচ্চা ছেলেদের আন্দোলন কিন্তু বাচ্চা থেকে ক্রমে বড় হচ্ছে। আমেরিকার আন্দোলন ইউরোপ ছাড়িয়ে আফ্রিকা পর্যন্ত দোলা দিয়েছে। সর্বত্র করপোরেটবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট মুভমেন্ট দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, এবার টুইটার ফেসবুকের ঘরেই আগুন লাগল। টুইটার ফেসবুকের মতো সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর জন্মস্থান আমেরিকা। কিন্তু এ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আরব বিশ্বে একটির পর একটি দেশ স্বাধীন হচ্ছে। তরুণরা বড় বড় আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছে। এমনকি ভারতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানেও প্রযুক্তির বিপুল প্রভাব। এসব দেখে উৎসাহিত হয়েছে আমেরিকার তরুণরা। তারা প্রশ্ন করেছে, ওখানে হলে এখানেও সম্ভব নয় কেন? লেডি গাগার ভক্ত, জাস্টিন বেইবারের অনুরক্ত, ঘরকুনো স্বভাবের, চ্যাটে মগ্ন একটি প্রজন্ম ভার্চুয়াল বাস্তবতার পর্দা ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসছে। পরস্পরের সঙ্গে আগুন ভাগ করে নিচ্ছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তারা কি আনতে পারবে নতুন যুগ? এই পৃথিবীর মধ্যে আরেকটি পৃথিবীর উত্থানের সম্ভাবনা কি আসন্ন?

Tuesday, October 11, 2011

তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী

গায়কদের নিয়ে সাধারণের বিস্ময়ের সীমা নেই। শুধু সাধারণ কেন, অসাধারণ গীতিকার, কবি ও বিদগ্ধ একজন মানুষও যখন প্রশ্ন করেন, তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, তখন বোঝা যায় সুরের এক অদেখা ক্ষমতা আছে। কবির মতো সকলেই অবাক হয়ে গান শোনে। দেখে, সুরের আলো ভুবন ছেয়ে ফেলছে, পাষাণ ছিন্ন করে ব্যাকুল বেগে সুরের সুরধুনী বয়ে চলেছে। অমন সুরে গাইবার আকাঙ্ক্ষা জাগলেও কণ্ঠে সবার সুর মেলে না। কথা বলতে গিয়েও বেধে যায়। ফলে প্রাণ কাঁদে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মানুষও যখন ভাবেন গানের গুণী তার চারধারে সুরের জাল বুনে তাকে এক ফাঁদে ফেলেছেন তখন সাধারণ শ্রোতাদের হাল কী তা বলাই বাহুল্য। আমাদের প্রিয় কবির এ গানের কথা আবারও মনে পড়ে গেল সঙ্গীতগুরু জগজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর খবরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার গানে মজেছে, তার সুরে সুর ভেজেছে_ তার বাণীতে নিজেদের মর্মবেদনার প্রকাশ দেখেছে। এক প্রজন্ম চলে গেলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও তার আবেদন একটুকু কমেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পরিবর্তিত হয়েছেন। গজলের পরবর্তীকালের গায়করা তাকে গুরু মেনেই গেয়েছেন। এমনকি যে বাংলা ভাষায় গজলের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য নেই, সে ভাষাতেও গজল গেয়ে তিনি দর্শকদের মোহিত করেছেন। জগজিৎ সিং বললেই বহু বাঙালির কাছে সেই মধুর বাণী গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে_ বেদনা মধুর হয়ে যায়, তুমি যদি দাও। কিংবা আজ কিছু হতে চলেছে, বেশি কিছু আশা করা ভুল, তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে...। এসব গান বহু বছর ধরে শোনার পরও কারও কি মনে হয়েছে, এ শিল্পী পাঞ্জাবি? এ প্রশ্ন আজও শুনিনি। তাতেই অবাক লাগছে। গায়করা কেমন গুণী? যে ভাষা তার নয়, সে ভাষাতেও তারা হিল্লোল তোলেন কীভাবে? শুধু বাংলাই তো নয়_ মাতৃভাষা পাঞ্জাবির বাইরে তিনি গেয়েছেন হিন্দি, গুজরাটি, উর্দু, সিন্ধি এমনকি নেপালি ভাষাতেও। ভারতের শিল্পীদের মধ্যে যারা বড় তারা সাধারণত এক ভাষায় আটকে থাকতে চান না। এক ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে বহু ভাষায় ছড়িয়ে যেতে চান। তারা সর্বভারতীয় বলে আখ্যায়িত হন। জগজিৎ সিং অবশ্য সর্বভারতীয় শুধু নন, তিনি ভারতের গণ্ডি ছড়িয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সমান জনপ্রিয়। তার মৃত্যুর খবরে ভারতের মতো শোকগ্রস্ত হয়েছেন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মানুষও। কেউ স্মরণ করছেন তার বাংলা গানের কথা। কেউ বলছেন, মির্জা গালিব টিভি সিরিয়ালে গালিবের কথায় তার গানের কথা। কেউবা ভাজছেন হিন্দি সিনেমায় গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর স্মৃতি। ৭০ বছর খুব কম সময় নয়, তার কাজের ব্যাপ্তিও কম নয়। তবু এই সেদিন পর্যন্ত যিনি সচল ছিলেন, স্টেজে লাইভ পারফরম্যান্সে মাতিয়েছেন সবাইকে তার চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কঠিন। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। মানব কী? গায়কের মৃত্যু হলে গান থাকে, কবিদের মৃত্যু হলে কবিতা থাকে। মানব কি তবে মানুষের কর্মের সারাৎসার? যারা জগজিৎ সিংয়ের গান শুনেছেন সরাসরি, দেখেছেন তাকে_ তাদের বাইরে বিপুলসংখ্যক শ্রোতার কাছে তিনি শুধুই গান। এক প্রজন্মের কাছে তিনি গ্রামোফোনের গান, আরেক প্রজন্মের কাছে ক্যাসেট প্লেয়ারের গান, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কমপ্যাক্ট ডিস্কের গান। গান শুনে শুনেই তার সম্পর্কে একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছেন শ্রোতারা। তার মৃত্যু হলেও তিনি থাকবেন তেমনি। তার গান থাকবে। শিল্পের, কল্পনার, অনুভবের জগৎ ফুরাবে না। কিন্তু বাস্তবের যে জগজিৎ সিং তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। আর কোনো দিন লাইভ আসরে তাকে দেখতে পাবে না কেউ।