Tuesday, May 4, 2010

একটি ভাষার মৃত্যু


ভাষার জন্য লড়াইয়ের দীর্ঘ ও রক্তাক্ত ইতিহাস আমাদের। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ সূচিত হয়েছিল। অনেকে মনে করেন, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত ফল হিসেবে আমরা মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলাদেশ কায়েম করতে পেরেছি। স্বাভাবিকভাবে ভাষা-প্রশ্নে আমাদের স্পর্শকাতরতা বেশি। আমরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি, একে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা মনে করি। 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি' আমাদের প্রিয় গান। নিজের দেশকে সবাই সকল দেশের সেরা মনে করেন। কিন্তু সেই দিন আর নেই যে, নিজের দেশকে সেরা মেনে চোখ বন্ধ করে সুখে থাকব। বিশ্বের দুয়ার খোলা। আমাদের দেশের চেয়ে সুন্দর না হোক, আমাদের দেশের মতো সুন্দর কত দেশ আছে পৃথিবীতে। তেমনি ভাষাও। বাংলার মতো শ্রুতিমধুর কত ভাষা আছে। আমরা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছি বলে পৃথিবীর সব মানুষের ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা থাকা খুব স্বাভাবিক। আমরা রক্ত দিয়ে ভাষার গুরুত্ব অনুভব করেছি, সে কারণেই এ আশাবাদ। কিন্তু কাজে তেমন একটা সচেতনতা দেখা যায় না। আমাদের দেশে সব মানুষের ভাষা বাংলা নয়, অন্য ভাষার বহু মানুষ এ দেশে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীগুলো তো আছেই, সমতলেও আছে ভিন্ন ভাষার কত মানুষ। কিন্তু ভাষার জন্য রক্ত দিলেও এ ভাষাভাষী মানুষের ভাষার বিকাশে আমাদের অবদান সামান্য। বলতে হয়, আমাদের আধিপত্য ও অবহেলার কারণে বাংলাদেশের আদিবাসী-অভিবাসী নানা ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে। একটি ভাষার টিকে থাকার গুরুত্ব কী? এটি বোধহয় ২০ কোটি মানুষের একটি ভাষার মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। যেমন বোঝা কঠিন, কীভাবে একটি ভাষায় কথা বলা শেষ মানুষটির মৃত্যু ভাষাপ্রেমিক মানুষকে কতটা কষ্ট দিতে পারে সেটি। এমনই এক ঘটনা ঘটে গেল সম্প্রতি। বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ আন্দামানে বো ভাষাভাষী শেষ মানুষ বোয়া সর ৮৫ বছর বয়সে মারা গেলেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বো ভাষাটির বিলুপ্তি ঘটল। বো ভাষা পুরোপুরি বোঝার মতো, সে ভাষায় কথা বলা ও গান করার মতো কোনো লোক আর রইল না। বো ভাষা পৃথিবীর প্রাচীন ভাষাগুলোর একটি। মানুষ যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসতি গাড়ছিল, তখনকার সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল এ ভাষার। ফলে ভাষাটির প্রতি নৃতাত্তি্বক, ভাষাতাত্তি্বক, ইতিহাসবিদ, মনোবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী সবার নজর ছিল। বলা হচ্ছে, বোয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। আন্দামানের আদিবাসীরা বহু ঝড়ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে টিকে ছিলেন। সুনামি তো সাম্প্রতিক ঘটনা। এর আগে তাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে ব্রিটিশ বসতি স্থাপনকারীদের; মিশনারিদের হাত থেকে ধর্মরক্ষা করতে হয়েছে। এমনকি ডকুমেন্টারি পরিচালকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য জঙ্গলে পালিয়ে থাকতে হয় তাদের। সঙ্গে আছে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অত্যাচার। নানা রোগব্যাধি তো আছেই। এত কিছুর পরও বোয়া যে বেঁচেছিলেন, এটাই এক বিস্ময়। এখন তার মৃত্যুর পর সবাই বলছেন, ঘটনাটা দুঃখজনক। এমন ঘটনা যেন না ঘটে, তার জন্য সচেতন হতে হবে। প্রশ্ন হলো, মৃত্যুকে রোধ করার ক্ষমতা তো মানুষের নেই। কিন্তু মানুষ চাইলে ভাষা বাঁচাতে পারে। ভাষা শিখতে পারে। ভাষার ডকুমেন্টেশন করতে পারে। সেটুকু হলেও কিছু সংযোগ থেকে যায়। অবশ্য এ সামান্য ঘটনায় তেমন কিছু হয় না। কারণ একটি জনগোষ্ঠী চার হাজার বছর আগের সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী একটি শব্দ যখন বলে আর যখন সেটি আমরা কাগজে তুলে নিই, তখন অর্থের তারতম্য ঘটবেই। এ জন্য নৃবিজ্ঞানীরা বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগোষ্ঠীগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার দিকে গুরুত্ব দেন। ভাষাভাষী মানুষকে বাঁচাতে পারলে তাদের ভাষাকেও বাঁচানো সম্ভব। মানুষ হারিয়ে যাওয়ায় আফ্রিকা মহাদেশ থেকে অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। অনেক ভাষা, অনেক সংস্কৃতি, অনেক গান, অনেক কবিতা আর কখনও ফিরে আসবে না। এসব হারিয়ে যাওয়া ভাষার কান্না কি আমরা বুঝতে পারব? হয়তো পারব। কারণ আমরা ভাষাকে ভালোবেসে যুদ্ধ করেছি। শুধু বাংলা নয়, পৃথিবীর সব ভাষা, বিশেষত হারিয়ে যেতে থাকা ভাষাগুলোর প্রতি আমাদের মমত্ব যদি কাজে পরিণত হয়, তবে তা হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ জন্য আন্দামানে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের দেশেই যে আদিবাসী নৃগোষ্ঠীগুলো আছে, তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলেই চলবে।

No comments:

Post a Comment