Sunday, May 2, 2010
সমুদ্রশাসন
নদীশাসনের কথা অহরহ শোনা যায়। কখনও সেচের জন্য, কখনও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নদী শাসন করেছি আমরা। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং চীন নদীশাসনে রীতিমতো ওস্তাদ। তাদের বিদ্যুৎ যেমন দরকার তেমনি দরকার পানিও। এসব নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। বলা হয়ে থাকে, নদী শাসন করে জলাধার বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করার ধারণাগুলো এখন বড়মাত্রায় চীন ও ভারতেই প্রচলিত। পরিবেশের ওপর এর সার্বিক নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় ইউরোপ-আমেরিকায় নদীশাসনের উদ্যোগগুলো বন্ধ হতে চলেছে। নতুন উদ্যোগের কথা শোনা যায় কম, বরং বেশি শোনা যায় পুরনো জলাধার বা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিত্যক্ত ও বন্ধ হওয়ার খবর। নদীশাসন দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু সমুদ্রের বেলায় অনেকটাই ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। কী ভারতে কী বাংলাদেশে কেউ সমুদ্রশাসনের কথা ভাবতে পারেন না। অথচ এই ভারতের রাজা রামচন্দ্র একদা বানরদের সহায়তায় সমুদ্রে বিশাল সেতু নির্মাণ করে লঙ্কায় পাড়ি দিয়েছিলেন। সমুদ্রশাসনের এই ইতিহাস হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সেতুরও ইতিহাস। কিন্তু আধুনিককালে ভারতীয়রা সমুদ্রশাসনের কথা ভাবতে পারে না। মাঝে মধ্যে ভারতের কিছু উদ্যোগের কথা শোনা যায় বটে, কিন্তু উদ্যোগগুলো আর সামনে এগোয় না। বাংলাদেশে আমরা সমুদ্রের ইচ্ছার সামনে নতজানু। সমুদ্র, এই সেদিন বাংলাদেশের দ্বীপ তালপট্টি খেয়ে নিল। আমরা চুপ করে বসে থাকলাম। বললাম শুধু, ভাসা তালপট্টি আমাদের, ডোবা তালপট্টিও আমাদের। উত্তর মেরুর বরফ গলবে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। বাংলাদেশ কি ডুববে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, একবার ডুববে। দক্ষিণাঞ্চলের বহু মানুষ পরিবেশ-শরণার্থী হয়ে পড়বে। আরেকবার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডুববে না। নতুন ভূমি মিলবে বরং। দেশের আকার বাড়বে। বিজ্ঞানীদের গবেষণার অলৌকিক পেন্ডুলামে এখন বাংলাদেশের ডোবা-ভাসার আশঙ্কা ও আশা দুলছে এদিক-ওদিক। কিছুই করার নেই আমাদের। হয়তো ডোবা ও ভাসার যে কোনো একটি হলে তবেই আমরা বুঝব, আসলে কী ঘটল। এসবই মনে পড়ল, দক্ষিণ কোরিয়ার সমুদ্রশাসনের এক সংবাদ পড়ে। অবশ্য সংবাদ না বলে একে এক গল্প বলতে হয়। এখন পর্যন্ত সায়িমানজিয়াম সমুদ্র দেয়ালই মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় বাঁধ। পীত সাগর বা হলুদ সমুদ্রের বুকে ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বাঁধ দিয়ে কোরীয়রা সমুদ্রের ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে বেঁধে ফেলেছে। সমুদ্র বেঁধে দেশের আকৃতি একটু বাড়িয়ে নিল কোরীয়রা। এখন তারা এই স্থানে চাষবাস, কারখানা ও পর্যটনের বিকাশ ঘটাবে। এমনকি মিঠাপানির উৎসও নাকি হবে এই জায়গা। দক্ষিণ কোরিয়া বলছে, তাদের পশ্চিম উপকূলের শিল্প এলাকার দরজা হবে এই দেয়াল প্রকল্প। এর সঙ্গে যুক্ত হবে চার নদী প্রকল্প। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, সামান্য নদীশাসন নিয়ে আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সীমা থাকে না যেখানে, সেখানে বিশাল সমুদ্রকে বেঁধে ফেললে কি পরিবেশবাদীরা চুপ করে থাকে? না। এর দেয়ালের বিরুদ্ধেও তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
সুপ্রিম কোর্ট দুই দফা এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করেছিল। শেষ পর্যন্ত ২৭ এপ্রিল এর উদ্বোধন হলো। এমন সমুদ্রশাসনে কোরিয়ানরা প্রথম নয়, হয়তো শেষও নয়। সায়িমানজিয়াম সমুদ্র দেয়াল নেদারল্যান্ডসের অফসলুটডিক দেয়ালের চেয়ে মাত্র ৫০০ মিটার লম্বা। সমুদ্র দেয়ালের আরও উদাহরণ আছে। কিন্তু সমুদ্র শহর? কৃত্রিম এক সমুদ্র শহর হতে যাচ্ছে আরব আমিরাতে। প্রকল্পটির নাম পৃথিবী। পৃথিবীর ভূভাগের ম্যাপ অনুসরণ করে তৈরি করা এ প্রকল্পটির কাজ এগিয়ে চলেছে। খণ্ড খণ্ড দ্বীপ নিয়ে তৈরি এ পৃথিবী সমুদ্রশাসনের অনেক বড় প্রকল্প। যখন প্রকল্পটি শেষ হবে, তখন নাকি ৩২১ মিলিয়ন কিউবিক মিটার বালু আর ৩১ মিলিয়ন টন পাথর জমা হবে দ্বীপগুলোতে। বিশ্বমন্দার কবলে পড়ে, পৃথিবী প্রকল্পের কাজ আপাতত ধীরে চলছে। কিন্তু প্রকল্প শেষ হলে তা এক বিস্ময় তৈরি করবে নিশ্চিত। কিন্তু আপাতত সবচেয়ে বড় দেয়াল তৈরির জন্য কোরিয়ানদের বাহবা দিতে হবে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment