Sunday, May 27, 2012

টেলিভিশনে মৃত মানুষের মুখ

কয়েকদিন ধরে মৃত্যু সংবাদ পড়লাম একের পর এক। ১৮ মে মারা গেলেন মিসরীয় সঙ্গীতশিল্পী ওয়ারদা আল জাজাইরিয়া। ১৯ মে মারা গেলেন শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ। ২০ মে মারা গেলেন লকারবি বোমা হামলায় অভিযুক্ত মেগরাহি। ২১ মে সঙ্গীতশিল্পী রবিন গিব। ২২ মে মারা গেলেন অর্থনীতিবিদ মোজাফ্ফর আহমদ। এই তালিকায় লকারবি বোমা হামলায় অভিযুক্ত মেগরাহি ছাড়া দু'জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আর দু'জন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বনামধন্য। বিবিসিতে রবিন গিবের মৃত্যুর সংবাদ দেখছিলাম। রবিন গিবের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশনের সঙ্গে দেখানো হচ্ছিল তার উচ্ছল ও প্রাণচঞ্চল কনসার্টের ছবি, আরও নানা স্মরণীয় ঘটনাবলি। শুধু রবিন গিবই নন, বিখ্যাত ব্যক্তিরা মারা গেলে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত টিভিগুলোতে মৃত ব্যক্তির লাশের ছবি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। রীতি মেনেই সেটি দেখানো হয় না। মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এ রীতি সর্বত্র প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশে একে মান্য করা হয় না। মনে পড়ে, প্রিয় ও বিখ্যাত এক ব্যক্তির মৃতদেহের ছবি টেলিভিশনের খবরে দেখে শিউরে উঠেছিলাম। আমার স্মৃতিতে আঁকা ছিল তার প্রাণোচ্ছল একটা ছবি। হতে পারে সেটা গণমাধ্যমে দেখে বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে। কিন্তু এখন তাকে মনে করতে গেলেই সেই মৃত মলিন মুখটাই মনে পড়ে। এর জন্য টিভিকেই দায়ী করতে হয়। প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যমে মৃত মানুষের মুখ দেখব কি দেখব না এ কি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয়? বিষয়টি শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামষ্টিক পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ও বটে। সমাজের শ্রদ্ধেয়, গুণী ও কৃতী একজন মানুষের চলচ্ছবি টেলিভিশনগুলোর কাছে থাকবার কথা। মৃত্যু সংবাদের সঙ্গে সে ছবি পরিবেশন করাই যুক্তিযুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের টিভিগুলো অকুস্থলে পেঁৗছে মৃত মানুষের মুখটাই প্রথম খোঁজে। সে মুখটাই দেখানো হয়। মৃত মুখ কি মৃত্যু সংবাদের চেয়ে কিছু জানান দেয়? বাড়তি কিছুই জানায় না মৃত মানুষের মুখ। বরং জনসমক্ষে এভাবে মৃতের মুখ দেখানোটা তার প্রতি অসম্মানজনক। মৃতের পরিবারগুলোর এই প্রদর্শনের প্রতি সায় থাকে না সবসময়। কিন্তু সায় থাকলেই কি দেখানো উচিত? অনেকেরই মনে হবে, এভাবে দেখানো অসঙ্গত। কিন্তু টিভিগুলোর তেমন দায়িত্বশীলতার নজির কোথায়? অবশ্য অনেকে বলেন, টিভিগুলো জীবিত অবস্থায় কীর্তিমানদের কাছে যায় না। ফলে প্রচার করবার মতো ফুটেজ থাকে না। আর তাই নিরুপায় হয়ে মৃতদেহের মাধ্যমেই মুখটা দেখানো হয়। বিখ্যাত, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের কফিনে ঢাকা মরদেহ দেখিয়েই হয়তো ক্ষান্ত হচ্ছে টিভিগুলো; কিন্তু বাকিদের বেলায় কী হচ্ছে। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর ছবি দেখানোর প্রশ্নই নেই। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ছবি অহরহ প্রচারিত হয় ছবিতে। সেগুলোর পরিবেশনা, সরাসরি মৃতদেহ পরিবেশন ইত্যাদি দেখলে কিন্তু রীতিমতো অশ্রদ্ধা জাগে। এ প্রশ্নও জাগে যে, কী ভেবে এই বীভৎস ছবিগুলো প্রদর্শন করা হচ্ছে? মৃতদের পরিবারের ওপর এই প্রচার কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে? এতে কি বীভৎসতার প্রতি মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে নাকি এই বীভৎসতাই গা সওয়া, মন সওয়া হয়ে উঠছে? টিভি কি শুধু অপরাধ-খুন-হত্যা পছন্দ করে এমন মানুষই দেখে? নাকি শিশুরাও দেখে। তারা মৃতদেহ, বীভৎস মৃতদেহ দেখবে কেন? এক সময় দৈনিক পত্রিকায় বীভৎস ছবি প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। কেউ কেউ বলতেন, বীভৎস ছবি সার্কুলেশন বাড়ায়। কেউ কেউ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার যুক্তিও দেখাতেন। কিন্তু কালে কালে প্রমাণিত হয়েছে, বীভৎস ছবি একদম প্রচার না করলেই সার্কুলেশন সবচেয়ে বাড়ে। আর বীভৎসতার ছবি দিয়ে বীভৎসতার সমালোচনা করা যায় না। বরং সৌন্দর্য দিয়েই কদর্যতার মোকাবেলা করাই রীতি। প্রিয় ও পছন্দের ব্যক্তির মরদেহের ছবি হোক কি অচেনা, অজানা কোনো ব্যক্তির অপঘাতে মৃত্যুর ছবিই হোক টিভিতে তা প্রচারের আগে কি আমাদের টিভি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একটু ভাববেন?

Thursday, May 24, 2012

নারীর জন্য বাসযোগ্য দেশ

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১১ বিডি নিউজে প্রকাশিত
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১। ডিএনএইনডিয়া ডট কমের একটি খবরে চোখ আটকে গেল। ডেইলি নিউজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস (ডিএনএ) ভারতের একটি অনলাইন সংবাদপত্র। সংবাদপত্রটি একটি জরিপের বরাত দিয়ে লিখেছে, পৃথিবীতে নারীর বসবাসযোগ্য ১৬৫ দেশের তালিকায় ভারতের অবস্থান ১৪১-এ। পৃথিবীর উদীয়মান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময়ে নারীদের জন্য বসবাসযোগ্য দেশের তালিকার শেষ দিকে ভারতের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ খবর বটে। কিন্তু, খবরটি ভারতীয় মিডিয়ায় তেমন কল্কে পায়নি। বাংলাদেশেও খুব বেশি মানুষের চোখে পড়েছে বলে মনে হলো না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি সুখবর হতে পারতো। কারণ, ডিএনএ লিখেছে, ভারত যে শুধু ১৪১ নম্বর অবস্থানে আছে তা-ই নয়, এমনকি বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, শ্রী লংকা, চীনও ভারতের থেকে এগিয়ে আছে। চীন এগিয়ে আছে একথা কার্পণ্য করে ডিএনএ লিখেছে বটে, কিন্তু তারা যে অনেক এগিয়ে এবং ২৩ নম্বরে সেটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার ছিল। ভারতের প্রতিযোগিতা তো চীনের সঙ্গেই হওয়ার কথা। এ বিষয়ে ডিএনএ কথা বলেছে একজন রাজনীতিকের সঙ্গে। ইউনিভার্সেল সোসাইটি অব হিন্দুইজমের প্রেসিডেন্ট রাজন জেড তাদের বলেছেন, ভারত বিশ্বশক্তি হওয়ার পথে থাকলেও এই নতুন সক্ষমতা ও সমৃদ্ধিতে অনেকেরই বিশেষ করে নারীদের অধিকার অবারিত নয়।
খবরটি পড়তে পড়তে মনে পড়ছিল গত সপ্তাহেই ইকোনোমিস্ট পত্রিকায় ‌’গ্রোথ ইজ নট এনাফ’ শিরোনামের একটি খবরের কথা। তাতে গ্রোথ বা প্রবৃদ্ধি যে নারীকে যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে পারে না, তার একটি ছোট বিবরণ দেওয়া হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও চীন প্রবৃদ্ধিতে চ্যাম্পিয়ন হতে চললেও অতিরিক্ত নারীমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি চীন ও ভারতেই। হিসাব পুরো দুনিয়ার। তাতে এক নাম্বারে চীন আর দুই নাম্বারে ভারত। প্রশ্ন উঠবে, প্রবৃদ্ধি যদি যথেষ্ট না হয়, তবে কী দরকার? প্রশ্নটা তোলা থাকুক।
নিউজউইক/ডেইলি বেস্টের জরিপ প্রসঙ্গেই ফেরা যাক। প্রথাগত জরিপ ঠিক নয়, একে বলতে হয়- জরিপ ও বিশ্লেষণ। বেস্ট অ্যান্ড ওর্স্ট প্লেসেস ফর উওমেন বা ‌নারীর জন্য ভাল ও খারাপ দেশ- জরিপ ও বিশ্লেষণের বিষয়। উদ্যোগটি নিউজউইক ম্যাগাজিন ও ডেইলি বেস্ট সংবাদপত্রের। নিউজউইকের ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় বিশ্লেষণ ও জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। ডেইলি বেস্টও একই দিন এটি প্রচার করেছে। পত্রিকা দুটির অনুসন্ধানের বিষয় ছিল- কোন দেশ নারীকে সবচেয়ে বেশি অধিকার দিচ্ছে এবং নারীর জীবনমান কোথায় বেশি। প্রথম দশটি দেশ হলো- ১. আইসল্যান্ড ২. সুইডেন ৩. কানাডা ৪. ডেনমার্ক ৫.ফিনল্যান্ড ৬ সুইজারল্যান্ড ৭. নরওয়ে ৮. যুক্তরাষ্ট্র ৯.অস্ট্রেলিয়া ১০. নেদারল্যান্ডস। তালিকার শেষ দশটি দেশ হলো- ১৬৫.চাদ ১৬৪. আফগানিস্তান ১৬৩. ইয়েমেন ১৬২. কঙ্গো ১৬১. মালি ১৬০. সলোমন দীপপুঞ্জ ১৫৯. নাইজার ১৫৮. পাকিস্তান ১৫৭. ইথিওপিয়া ১৫৬. সুদান।

ডেইলি বেস্ট লিখেছে বিশ্লেষণের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দুটি দেশ অনুসারে নারীর অবস্থা বোঝার জন্য এ আয়োজন করেছে। ন্যায়বিচার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি ও রাজনীতি- এই ৫টি বিষয়কে তারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এই ৫টি বিষয়ে তারা দেশগুলোতে ০ থেকে ১০০-এর মধ্যে নাম্বার দিয়েছে।
বিচার্য বিষয় ছিল-
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে
বয়সের আগে বিয়ের হার, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আইন আছে কি না, বিবাহ বা ঘনিষ্ট সম্পর্কের ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌননির্যাতনের বিচার হয় কি না, নাগরিক অধিকার : নারীরা মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারে কিনা। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে কি না। সম্পদ ও জমিতে তাদের অধিকার আছে কি না। উত্তরাধিকার ব্যবস্থায় নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি গুরুত্ব পায় কি না।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে
বয়ঃসন্ধি কালে প্রসব হার, প্রসবকালীন মৃত্যু হার, জন্মনিরোধক ব্যবস্থা, প্রসবকালীন স্বাস্থ্যসেবা, এইচআইভি সংক্রমণ, অ্যাবরশন বৈধ থাকলে তা কী উদ্দেশে প্রযুক্ত হয়।
শিক্ষা ক্ষেত্রে
বয়স্ক নারী শিক্ষার হার, তরুণ নারীদের স্বাক্ষরতার হার, ২৫ বছরের বেশি বয়সের নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীনতার হার, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিকে থাকা নারীর হার, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে লিঙ্গ বৈষম্য।
অর্থনীতি ক্ষেত্রে
মেয়েরা কারখানায় কাজ করতে পারে কি না
শ্রমিকদের মধ্যে কত শতাংশ নারী
নারীদের পারিশ্রমিক পুরুষদের তুলনায় কেমন
উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের সম্ভাবনা কতটা
রাজনীতিতে
মন্ত্রিসভায় নারীর সংখ্যা
সংসদে নারীর উপস্থিতি
উচ্চতর পদে নারীর হার
পুরুষের তুলনায় নারী আইন প্রণেতা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ম্যানেজারের হার কত।
নিউজউইক ও ডেইলি বেস্ট যেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে তা ন্যায্য বলেই মনে হয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন জরিপ নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক আমাদের দেশে তৈরি হয় তাতে মেঠো যুক্তিতে জরিপের ফল বাতিলের প্রবণতা থাকে। আবার কিছু ন্যায্য তর্কও ওঠে। যেমন, কখনো কখনো জরিপ ইওরোসেন্ট্রিক ধারণা থেকে করা হয়। ইওরোপ-আমেরিকার মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি তাতে অন্য দেশগুলোর পরিস্থিতি বিচারের টুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রশ্ন না তুলেই বিভিন্ন দেশের জীবনমানের তুলনা করা হয়েছে এমনও অনেক সময় ঘটেছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত যেসব জরিপ নিয়ে আমাদের দেশে তোলপাড় হয় তার কিছু নির্দিষ্ট ধরন আছে। রাজনীতির গতিপ্রকৃতির সাথেও সেগুলোর সংশ্লিষ্টতা থাকে। দুর্নীতি, গণতন্ত্র কখন মিডিয়ায় কত গুরুত্ব পাবে তা নির্ভর করে রাজনীতির হালচালের ওপর। অনেক সময় এদেশে জরিপকারী সংগঠনের প্রতিনিধিরা বিষয়টিকে ফোকাস করেন। জরিপের কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ তা যেমন বলে দেন, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোন বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষ মনোযোগী তাও বলে দেন। স্বাভাবিকভাবে করণীয় নির্ধারণের পরামর্শও তারা দিয়ে থাকেন।
কিন্তু কোনো পত্রিকা যখন জরিপ বা তথ্য বিশ্লেষণ করে তখন বোধগম্য কারণেই তাদের প্রতিনিধিরা ঢাকায় প্রেস কনফারেন্স করেন না। পাঠকদের চোখে পড়লে সেটি আলোচিত হয়, কোনো স্থানীয় পত্রিকা মনে করলে সেটি অল্প-বিস্তর প্রচারও পায়। ব্যক্তিগতভাবে এমন জরিপ ও বিশ্লেষণ পদ্ধতির প্রচারেই পাঠক হিসেবে আমি স্বস্তি বোধ করি।
নিউজউইক/ডেইলি বেস্টের তালিকা দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হয়, এতে পশ্চিমাদের প্রতি পক্ষপাতের ব্যাপার নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নারীর জন্য সন্তোষজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ দরকার। একটি দেশের অথনৈতিক সক্ষমতার সঙ্গে বরাদ্দ জড়িত। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা একটি দেশ এমন বরাদ্দ দিতে পারবে কেন? তালিকার শেষ দিকের অধিকাংশ দেশই অর্থনৈতিক মানদণ্ডে পিছিয়ে। কিন্তু ১৪৭ নম্বর দেশ সৌদি আরব কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে নেই। তবে কি সমস্যাটা মুসলিম অধ্যুষিত মানুষের দেশেই বেশি? তাহলে ভারতের অবস্থান ১৪১ নম্বরে থাকে কী করে? অর্থনৈতিকভাবে পেছনের সারির দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের মুখে থাকা মুসলিম অধ্যুষিত মালদ্বীপকে তাহলে কী বলা হবে? দেশটি তালিকার ৯২ তম অবস্থানে এসেছে। এমনকি সমস্যাটি গণতন্ত্রেরও মনে হয় না। কেননা, সামরিক শাসনের জন্য দুর্নাম কামানো মায়ানমার আছে ৯১ তম অবস্থানে। গণতন্ত্রের দীর্ঘ ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, মুসলিম অপ্রাধান্য সত্ত্বেও জাপান ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতায় আসতে পারে নি। তারা ৮৭ নম্বর অবস্থানে। মুসলিম অধ্যুষিত মালয়েশিয়া জাপানের থেকে এগিয়ে ৮১ নম্বরে। পূর্ব ইউরোপের দেশ হলেও, রিপাবলিক অব মলডোভা দেশটির কথা খুব বেশি লোকের জানা নেই, অথচ নারীর বসবাসযোগ্য দেশের তালিকায় তারা পশ্চিম ইওরোপ-উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর খুব কাছাকাছি ১৬ নম্বর অবস্থানে। আবার চীন যেখানে ২৩ নম্বরে জার্মানি কিন্তু সেখানে ৩০-এ। এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো তথ্যগুলোর দিকে সার্বিক দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। সেখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্য আছে। সত্যটি হলো- গণতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ভেদে নারীর অবস্থা একই হতে পারে, আবার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাও সবসময় ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে না, এমনকি ধর্মীয় নৈতিকতাও সবসময় প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে না। তবে, নারীকে পিছনে ঠেলে দিচ্ছে কী, আর সামনেই বা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোন ব্যাপারগুলো? আমি যতদূর বুঝলাম তাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে সরকারগুলো আন্তরিক হলেই নিউজউইক/ ডেইলি বেস্ট তালিকায় একটি দেশের ভাল অবস্থানে আসা সম্ভব। এর ভেতর আরও কোনো গভীর তত্ত্ব থাকলে তা আমরা ভবিষ্যতে খুঁজতে পারি।
তালিকাটি এশিয়ার জন্য রীতিমতো দুসংবাদ বয়ে এনেছে। নারীর বসবাসযোগ্য সেরা ১০ দেশের তালিকায় এশিয়ার কোনো দেশ নেই। একমাত্র এশীয় দেশ হিসেবে প্রথম ২০ তালিকার ১৭ নম্বরে আছে ফিলিপাইন ১৭ নম্বরে। সেরা ৩০-এ এশিয়ার একমাত্র দেশ চীন। কিন্তু শেষদিকে এশিয়া-আফ্রিকার রমরমা। শেষ ১০-এ এশিয়ার আফগানিস্তান-পাকিস্তান তো আছেই।

তালিকার শেষ দেশ চাদ। দেশটির গড় স্কোর ০.০। দেশটিতে নারীদের প্রায় কোনো আইনি অধিকার নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিয়ের বয়স ১১-১২ বছর। ন্যায়বিচারে : ২০.৭, স্বাস্থ্যে ০.০, শিক্ষায় ০.০, অর্থনীতিতে ৭০.৯, রাজনীতিতে ২২.২ স্কোর দেশটির। প্রথম অবস্থানে আইসল্যান্ড। দেশটির গড় স্কোর ১০০। ন্যায়বিচারে : ১০০, স্বাস্থ্যে ৯০.৫, শিক্ষায় ৯৬.৭, অর্থনীতিতে ৮৮.০, রাজনীতিতে ৯২.৮।
এবার এশিয়ার কয়েকটি দেশের স্কোর পাশাপাশি রাখা যাক।
আফগানিস্তান
গড় স্কোর : ২.০
ন্যায়বিচার : ৮.৪
স্বাস্থ্য : ২.০
শিক্ষা :৪১.১
অর্থনীতি : ৫৫.৩
রাজনীতি : ১৬.৬
পাকিস্তান
গড় স্কোর : ২১.৪
ন্যায়বিচার : ৪৯.৭
স্বাস্থ্য : ৪৯.৬
শিক্ষা : ৩৪.০
অর্থনীতি : ৫০.৭
রাজনীতি : ১৯.৩
ভারত
গড় স্কোর ৪১.৯
ন্যায়বিচার : ৫৪.০
স্বাস্থ্য : ৬৪.১
শিক্ষা : ৬৪.৯
অর্থনীতি : ৬০.৭
রাজনীতি : ১৪.৮
মায়ানমার
গড় স্কোর ৬৬.৫
ন্যায়বিচার : ৬৭.৯
স্বাস্থ্য : ৪৯.৫
শিক্ষা : ৯৪.০
অর্থনীতি : ৮৭.৯
রাজনীতি : ৭.৫
বাংলাদেশ
গড় স্কোর ৪২.১
ন্যায়বিচার : ৩৫.৫
স্বাস্থ্য : ৪৫.৭
শিক্ষা : ৬৯.২
অর্থনীতি : ৭৫.১
রাজনীতি : ২০.৪
তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯-এ। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ নারীদের জন্য অনেক বেশি বসবাসযোগ্য। ভারতের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে। কিন্তু তাতে খুব বেশি খুশী হওয়ার কারণ নেই। যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে তাতে কী কী করতে হবে তা সকলের জানা। কাজগুলো করতে বিপ্লবও করতে হবে না। আমাদের সরকারগুলো আন্তরিক হলেই সম্ভব।

সম্পর্কিত লিংক
মাহবুব মোর্শেদ: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

জুনিয়র হরলিক্স, কিড’স হিন্দি

জুলাই ২৪, ২০১১ বিডিনিউজে প্রকাশিত
বিজ্ঞাপনটি অনেকেরই দেখা। বিজ্ঞাপনের কথাগুলো এমন :
শুধু লম্বা হলেই- আকাশ ছোঁয়া যায় না
শুধু বুদ্ধির জোরে- সাংবাদিকতা হয় না
শুধু শক্তি থাকলেই- সাঁতারু হওয়া যায় না
তাহলে কী দরকার?
খুব জরুরি প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞাপনেই দেওয়া আছে। তবু আমরা নিজেদের মতো করে উত্তর খুঁজবো। উত্তর খোঁজার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু আলাপও পেড়ে নেব।

সবার আগে বলে রাখি, হরলিক্সের বিজ্ঞাপন নিয়ে অতীতে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। হরলিক্স কোম্পানিকে সম্প্রচারিত বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার পর্যন্ত করতে হয়েছে। এখানে তেমন পুষ্টিগত বিতর্ক তোলার উদ্দেশ্য নেই। যে বিজ্ঞাপনটার কথা বলছি সেটি বরং আমার বিশেষ পছন্দ। সাধারণত যারা টিভি বিজ্ঞাপনের মডেল হন তারা এতে মডেল হননি। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতায় পরিচিত কয়েকজন নারী এতে মডেল হয়েছেন। এদের একজন সাংবাদিক, একজন বৈমানিক, একজন সাঁতারু। কলকাতার বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোতে হরলিক্সের এই বিজ্ঞাপন অনেকবার দেখেছি। চলচ্চিত্র বা টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে নিজেদের পেশায় সফল নারীরা সাধারণত নাম ও পেশাগত পরিচয়সহ বিজ্ঞাপনে হাজির হতে পারেন না। কিন্তু এ বিজ্ঞাপনে সেটা ঘটতে পেরেছে। কিন্তু খটকা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতেও বিজ্ঞাপনটা দেখানোর পর। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে পেশাগত পরিচয় রেখে মডেলদের নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। কেন এমন করা হলো? বাংলাদেশে এদের পরিচিতি নেই বলে? নাম-পরিচয় রাখলে কেউ কি প্রশ্ন তুলতেন, এরা কোথাকার সাংবাদিক বা বৈমানিক বা সাঁতারু? এমন প্রশ্ন উঠলে উত্তর মেলা কি কঠিন হতো? ভারতে তৈরি অনেক বিজ্ঞাপনই তো অহরহ বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয়। হিন্দিভাষায় নির্মিত বিজ্ঞাপন স্রেফ বাংলায় ডাবিং করে প্রচার করার ঐতিহ্যই রীতিমতো গড়ে উঠেছে। সে বিজ্ঞাপনগুলো দেখে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেন না- ঐশ্বরিয়া, প্রিয়াঙ্কা, দীপিকা, শাহরুখ কোথাকার অভিনেতা। প্রশ্ন ওঠে না, কারণ সবাই কমবেশি এদের চেনেন। কিন্তু কলকাতার খানিকটা অপরিচিত সেলিব্রেটিদের নিয়ে খটকা বেধেছে। বাংলাদেশে, এবং সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গেও খুব বেশি মানুষের জানাশোনা নেই এদের সঙ্গে। তবু পশ্চিমবঙ্গে নামপরিচয়সহ কাজ চলেছে, বাংলাদেশে চলছে না। বিজ্ঞাপনটি এখানে প্রচারের আগে কী ভাবা হয়েছিল? মডেলদের নাম-পরিচয়সহ উপস্থাপন করা হলে বাংলাদেশে প্রশ্ন উঠবে? হয়তো দাবিও উঠবে, বাংলাদেশের এমন নারীদের নিয়ে আরেকটা বিজ্ঞাপন তৈরি করা হোক? দাবি উঠলে, সেটি করা কঠিন হতো না।
বাংলাদেশে হরলিক্সের বাজার ছোট নয়- শুধু হরলিক্স কেন কোনো কমোডিটির বাজারই ছোট নয়। তবু বিজ্ঞাপনগুলো আসে পাশের বড়বাজার থেকে তৈরি হয়ে। তাদের নায়ক-নায়িকাদের মুখশ্রী সে বিজ্ঞাপন আলোকিত করে। এসব দেখে কাউকে এমন দাবি তুলতে দেখা যায়নি যে- শাহরুখের বদলে তো শাকিব, ঐশ্বরিয়ার বদলে শাবনুর কিংবা আসিনের বদলে মোনালিসাকে নিয়ে বিজ্ঞাপনটি একান্তই বাংলাদেশের টিভি দর্শকদের জন্য প্রচার করা হোক।
যে যুক্তিতে ভারতে নির্মিত সব বিজ্ঞাপন সেগুলোর আলোছায়াসঙ্গীত সহকারে শুধু ভাষা পরিবর্তন করে বাংলাদেশে সম্প্রচারিত হতে পারে সেই একই যুক্তিতে ভারতের কোনো মেট্রপলিটন শহরের আইকনদের নামপরিচয়সহ একটি বিজ্ঞাপনও প্রচার করা সম্ভব। সেই যুক্তিটা কী?
অবশ্যই বাজার।
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো যখন দক্ষিণ এশিয়ার ম্যাপ নিয়ে বসে তখন নিশ্চয়ই তারা একে একটি সাংস্কৃতিক একক হিসেবে বিবেচনা করে। এই এলাকার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বার্মা-থাইল্যান্ড-ফিলিপাইন-চীনের মতো নয়, আবার ইরান-ইরাক-সিরিয়ার মতোও নয়। মধ্য এশিয়া বা পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে অমিল আছে বলে দক্ষিণ এশিয়া আলাদা একক। দক্ষিণ এশিয়াও সমরূপ কোনো এলাকা নয়। এখানে বহু দেশ, বহুজাতি, বহুভাষা, বহু নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। শুধু ভারতকে বিবেচনায় আনা হলেও বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। কিন্তু নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের প্রশ্ন তুলে রেখে বাজারের প্রশ্নকে সামনে আনা হলে বাজারের কেন্দ্র ভারতই। শুধু কেন্দ্র নয় পরিধির অনেকটা জুড়েও ভারত। ভারতের বাইরে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ এমনকি পাকিস্তানেও বাজার তুলনামূলকভাবে ছোট। কিন্তু সেটাও বাজার বটে। তাই মুম্বাই বা দিল্লিতে সাউথ এশিয়া অফিস খুলে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি চেষ্টা করে ভারতের বাইরের পরিধিকেও সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। ভারতের নিজস্ব প্রস্তুতি ও অবকাঠামো এক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক। যেমন- বলিউডের সিনেমা, শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাতেও গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশে বসে সহজেই বলিউডের সিনেমা উপভোগ করা যায়। ফলে, ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন ভারতের শুধু নয়, আমাদেরও আইকন। বাংলাদেশে অনেকেই তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের খবর রাখেন। যেমন বচ্চন পরিবারের পুত্রবধু এখন অন্তঃসত্ত্বা, তার গর্ভে যমজ দুটি মেয়ে বেড়ে উঠছে। মুম্বাইতে বসে ইউনিলিভার যখন হিন্দি ভাষায় লাক্সের একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করে এবং তাতে মডেল হন ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন তখন মারাঠি, তামিল, তেলেগু, নেপালি, বাংলা, উর্দুসহ যে কোনো দক্ষিণ এশীয় ভাষায় একে ডাবিং করে ভারতসহ যে কোনো দক্ষিণ এশীয় দেশে প্রচার করা সম্ভব। বাস্তবে তা ঘটেও। এ নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠে না। এক যুগ আগে এমন হতো কি না, হলেও প্রশ্ন উঠতো কি না তেমন তথ্য আপাতত হাতে নেই। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিকাশ, তথ্যপ্রযুক্তির বিপুল বিস্ফারের এ যুগে কেউ এমন প্রশ্ন তোলেন না। চ্যানেল ঘোরালেই, ডিভিডি চালালেই যাকে প্রতিনিয়ত দেখি- তাকে দেশের চ্যানেলে দেখলে প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত বটে, হিপোক্রেসিও।

দর্শক হিসেবে আমি বলিউডে নির্মিত হিন্দি সিনেমার অনুরক্ত। সেখানকার তরুণতর নির্মাতারা নিত্যনতুন আইডিয়া নিয়ে যেভাবে একের পর এক সিনেমা তৈরি করে চলেছেন তা চমকপ্রদ। শুধু বিনোদন ও জনপ্রিয়তাতেই নয়, শিল্পমানেও সমৃদ্ধ অনেক সিনেমা। বলিউড রীতিমতো একটি ইন্ডাস্ট্রি। তেমন ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গড়ে ওঠার বা চমকে-বৈভবে পরিপূর্ণ তেমন সিনেমা তৈরির সম্ভাবনা বাংলাদেশে নেই, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশেও নেই। ফলে, সে সিনেমাকে তার নায়ক-নায়িকা, ফ্যাশন, কমোডিটি, বাজার সম্ভাবনা সহকারে আমরা গ্রহণ করেছি। এতে আমরা অসুখী নই, বরং স্বস্তিতেই আছি বলা যায়। শুধু বলিউডের সিনেমাই নয়, বলিউডের সিনেমা যে ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যে সংস্কৃতি টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নির্মিত ও পুননির্মিত হয়ে চলেছে তারও স্বতঃস্ফূর্ত গ্রাহক আমরা। সত্যি বলতে, দিনের যে কোনো সময় কেউ যদি সিনেমা দেখতে চান, বাচ্চারা যদি কার্টুন দেখতে চায়, কারো যদি গান শোনার ইচ্ছা নয়, কিংবা কেউ যদি সোপ অপেরা দেখতে চান কিংবা কোনো হাসির অনুষ্ঠান যদি কেউ খোঁজ করেন তবে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর দারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এমনকি নিউজ কর্পোরেশন, সনি বা ওয়াল্ট ডিজনির মতো মাল্টিন্যাশনাল সম্প্রচারকদের টিভি চ্যানেলগুলোও এখন ভারতীয় রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯৯২ সালে ভারতে কেবল টেলিভিশন উন্মুক্ত হওয়ার পর বড়বাজারের আকর্ষণে রুপার্ট মারডকের স্টার টিভি নেটওয়ার্ক, এমটিভিসহ অনেক মাল্টিন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানি ভারতে ব্যবসা সম্প্রসারিত করে। স্টার টিভি নেটওয়ার্ক ভারতের বিভিন্ন ভাষার জন্য, বিভিন্ন গোষ্ঠীর দর্শকের জন্য ৩২টি চ্যানেল খুলেছে। সিএনএন, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকও ভারতে বাজার সৃষ্টির জন্য তৎপর। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে কেবল টেলিভিশন উন্মুক্ত হওয়ার পর দৃশ্যমানভাবে কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এখানে চ্যানেল খোলেনি, আগ্রহ দেখিয়েছে এমন তথ্যও নেই। তার কারণও বাজার- বাজার শুধু দর্শক নয়, বিজ্ঞাপনদাতারাও। আমরা যখন স্টার মুভিজে সিনেমা দেখি তখন সেটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এশিয়াস্যাটের মাধ্যমে সম্প্রচারিত হয় বটে কিন্তু সম্প্রচারের সময় যে বিজ্ঞাপন দেখা যায় তা একান্তই ভারতীয় দর্শকদের জন্য। বিজ্ঞাপনে আমরা এমন অনেক কিছু দেখি যা আমাদের বাজারে পাওয়া যায় না। যেমন- ডিটিএইচ টেকনলজি। টাটা স্কাই বা ডিশ টিভির বিজ্ঞাপন দেখি, কিন্তু এগুলো কী জানি না। সরাসরি ঘরে স্যাটেলাইট সম্প্রচারের প্রযুক্তি আমরা চিনি না, কিন্তু দেখতে দেখতে চাহিদা তৈরি হচ্ছে।
অবশ্য বিজ্ঞাপনে দেখা অধিকাংশ পণ্যই হাত বাড়ালে স্থানীয় বাজারে মেলে। বিজ্ঞাপন দেখে সেগুলো কিনতে প্ররোচিতও হই আমরা। যখন লাক্স সাবান কিনি তখন স্টার মুভিজ, বাংলাভিশন নাকি জিটিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে কিনলাম সেটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে নির্মিত পণ্যের অবস্থান আমাদের কেনাকাটার তালিকায় আছে কি? এখন থাকলেও এই ভিজ্যুয়াল অভ্যাসে আর কতদিন থাকবে?
শুধু কেনাকাটায় নয়, ভেতরে ভেতরে সমাজে-পরিবারে একটা সাংস্কৃতিক রূপান্তরও কি ঘটছে না?
আমার এক বন্ধু তার মেয়েকে নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত। ছোটবড় কোনো সমস্যা হলে তার চার বছরের মেয়ে লর্ড গণেশাকে ডাকে। ‌‌’মাই ফ্রেন্ড গনেশা, মুঝে বাঁচাও’ বলে গণেশার সাহায্য চায়। মেয়ে যে গণেশাকে ডাকে এতে সমস্যা নেই। কিন্তু মেয়ে গণেশার কাছে আবদার জানায় হিন্দি ভাষায়। ভাষা শিক্ষার জটিল একটি সময়ে বাচ্চা দিনের একটা বড় অংশ হিন্দি চ্যানেল দেখে ব্যয় করে। না, জিটিভি বা সনিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখে না। দেখে বাচ্চাদের চ্যানেলই। কিন্তু ডিজনি, কার্টুন নেটওয়ার্ক, পোগোসহ অনেক চ্যানেলই এখন ভারতের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচারে চলে এসেছে। এগুলো এখন হিন্দিতে সম্প্রচারিত হয়, একটি দুটি তেলেগুতেও সম্প্রচার করে। ডোরেমন-পোকেমন দেখার ফাঁকে ফাঁকে হিন্দি শিখছে মেয়ে। টুকটাক হিন্দি বলতে পারে, বুঝতে পারে প্রায় সবই। মুফতে একটি ভাষা শিখে ফেলছে- এতে অভিভাবকদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো ব্যাজার হচ্ছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, ইংরেজি তো শিখতেই হয়, বিকল্প নেই। কিন্তু ইংরেজির সঙ্গে বাংলার মৌলিক পার্থক্য আছে, বাচ্চারা বুঝে ফেলে এটি আলাদা ভাষা। কিন্তু হিন্দি তাদের কনফিউশনে ফেলে দেয়। কাছাকাছি ভাষা বলে বাংলা বোলে হিন্দি ঢুকে পড়ছে অনায়াসে। আর সবচেয়ে পছন্দের অনুষ্ঠানগুলো দেখতে দেখতে তারা যে বোল শোনে তা মনেও থাকে, গেঁথে যায়। ফলে, একটি জেনারেশন না চাইতেই তিন ভাষা শিখতে শিখতে বেড়ে উঠছে। এর বাইরে আর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না তা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।

অভিভাবকদের একটি বড় অংশ অবশ্য ঘরে হিন্দির বসতি ও বেড়ে ওঠা নিয়ে সচেতন নন। কিন্তু যারা সচেতন তারা কী করবেন? টিভি বন্ধ করে দেবেন? উপায় নেই। বাংলাদেশের চ্যানেল দেখাবেন? বাচ্চারা মজা পাবে না। উপায় হলো, অন্তত বাচ্চাদের চ্যানেলগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচার দাবি করা। হিন্দি বন্ধ করে ইংলিশ সম্প্রচারে ফিরে যাওয়ার যুক্তি আপাতত নেই। কিন্তু যেভাবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ডিসকভারি চ্যানেল, পিসটিভি বাংলায় সম্প্রচার শুরু করেছে- সেভাবে বাচ্চাদের চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো বাংলায় ডাবিং করে বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রচার করা যেতে পারে। তাতে বাচ্চারা আরও ভালভাবে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে। ডাবিং করার দায়িত্ব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো নিতে পারে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষগুলোকে তৎপর হতে হবে। সবার আগে বাংলাদেশের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচারের দাবি জোরেশোরে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের সরকার কি তেমন দাবি তুলতে পারবে? যেখানে আমরা স্বেচ্ছায় সানন্দে বলিউডের সিনেমা দেখছি, ভারতীয় টিভি চ্যানেলের ভক্ত হয়ে আছি, তাদের টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপিত পণ্যের ভোক্তা বনে আছি- সেখানে ভারতে বসে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল কেউ চাইলেও দেখতে পান না। কত বিনিময় হচ্ছে, কত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হচ্ছে- আমাদের টিভি চ্যানেলের দ্বার আর খুলছে না। পরিস্থিতি এখন যেখানে এসে ঠেকেছে তাতে মাল্টিন্যাশনাল ও ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য বরাদ্দ বিজ্ঞাপন ও বাজেট অচিরে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে পাঠিয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, বিজ্ঞাপনদাতাদের লোকসানও হবে না। কিন্তু আমাদের স্বার্থরক্ষার আলাপ-আলোচনা ও দাবি উত্থাপনে কোথায় যেন দ্বিধা আছে। এই দ্বিধা নিয়ে কি বাংলাদেশের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচার দাবি করা সম্ভব?
বিজ্ঞাপন বলে
‘শুধু লম্বা হলেই- আকাশ ছোঁয়া যায় না….’
কী দরকার?
দরকার আত্মবিশ্বাস, আত্মসচেতনতা আর আত্মপরিচয়ের বোধ। তার চেয়ে বড় কথা আমরা অতো লম্বাও তো হতে পারি নি।

মাহবুব মোর্শেদ : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

আমরা কি বুদ্ধিজীবীদের ভালোবাসবো না

জুন ২, ২০১১ বিডি নিউজে প্রকাশিত
‘কেন আমরা বুদ্ধিজীবীদের পছন্দ করি না?’ মে মাসের ৮ তারিখে গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখার শিরোনাম ছিল এটি। লেখক জন নটন। সাংবাদিক, বিদ্বান ও জনমানসে প্রযুক্তির ধারণা বিষয়ে অধ্যাপক। নটনের মতে, ব্রিটেনের সংস্কৃতির একটি দৃশ্যমান বিশিষ্টতা হলো- এখানে ‘বুদ্ধিজীবী/ইন্টেলেকচুয়াল’ শব্দটি একরকম অপমানসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। শুধু জনমানসেই যে এমন মনোভাব তা নয়- ডাব্লিউ এইচ অডেনের মতো কবিও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে রসালাপে মগ্ন হয়েছেন।
‘দুঃখজনক হলেও সত্য,
জীবনের নিবিড় একজন পর্যবেক্ষক
যাকে বুদ্ধিজীবী বলাই শ্রেয়
রাস্তার মানুষের কাছে তিনি
স্ত্রীর চোখে প্রতারক মানুষ একজন।‌’
এই হলো অডেনের কবিতার লাইন। শুধু অডেন নন, নটন জানাচ্ছেন, সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ পল জনসন ২০ শতকের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হিসেবে প্রমাণ করতে আস্ত একটা বই লিখে ফেলেছিলেন। বইয়ের নাম ‘ইন্টেলেকচুয়ালস : ফ্রম মার্কস অ্যান্ড টলস্তয় টু সার্ত্রে অ্যান্ড চমস্কি’। জন কেরি নামে একজন সাহিত্য সমালোচক ‘দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস অ্যান্ড দ্য মাসেস’-এ তর্ক তুলেছেন কয়েক শতক ধরে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে জনগণকে তুচ্ছজ্ঞান করে সাংস্কৃতিক উচ্চম্মন্যতাকে অবলম্বন করেছেন। নটন বলছেন, ব্রিটেনে বুদ্ধিজীবী শব্দটির সঙ্গে যে শব্দটি বেশ ব্যবহৃত হয় সেটি হলো ’তথাকথিত’। বুদ্ধিদীপ্ত লোকদের ‘অতিচালাক’, জ্ঞানী রাজনীতিকদের ‘দুই মগজের অধিকারী’, সৃজনশীল ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের ‘বফিন’ (চতুর ও হাস্যকর), কম্পিউটার ও গণিত বোদ্ধা ছোটদের ‘নার্ড’ (ঘরকুনো ও অসামাজিক) আখ্যা দেয়া হয়। নটন একটু উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, বুদ্ধিজীবীতার প্রতি এই পরিহাসমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ‘আইডিয়া’র প্রভাব তেমন দেখা যায় না।

জন নটনের লেখায় ব্রিটেনে বুদ্ধিজীবীতার যে বিবরণ পাওয়া গেল বাংলাদেশের সঙ্গে তার অনেক মিল। বহু বছরের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমাদের অমিলও নিশ্চয় অনেক। সেখানকার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিস্তীর্ণ ও ঐতিহাসিক প্রভাব আছে। পৃথিবীর সেরা বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, বড় বড় থিয়েটার, মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, প্রকাশনা ও সংবাদপত্রের জাগরুক চর্চা এখনও বহাল। ব্রিটিশদের মধ্য থেকে বেড়ে ওঠা চিন্তক ও মননশীল ব্যক্তিরাই শুধু নন, বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা শ্রেষ্ঠ চিন্তকদেরও বিচরণক্ষেত্র ব্রিটেন। ফলে, ব্রিটেনে বুদ্ধিজীবীতা নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তার সঙ্গে আমাদের গুণগত ও পরিমাণগত পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু উপরিস্তরের মিলটা দেখার মতো। আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবীদের ‘আঁতেল’ বলে ঠাট্টা করা হয়। বুদ্ধিজীবী শব্দটির সঙ্গে ’তথাকথিত’ শব্দটিও বেশ চালু। জানার আগ্রহ আছে এমন লোক বিরক্তিকর, একটু খতিয়ে দেখতে চাওয়া ব্যক্তি ‘বেশি বোঝে’। বুদ্ধিজীবীরা সাধারণভাবে জনবিচ্ছিন্ন, ভণ্ড, ধান্দাবাজ, অবিশ্বস্ত ও দালাল পরিচিতি পান।
কেন এমন হলো? প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু সহজ প্রশ্নের উত্তরটা মোটেও সহজ নয়। এদেশে বুদ্ধিজীবীতার ইতিহাস ও বর্তমানের মধ্যে নিশ্চয় এর উত্তর আছে। সঙ্গে এও সত্য, আমাদের বুদ্ধিজীবীতার ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। ব্রিটেনে বুদ্ধিজীবীতার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। বিগত শতকগুলোতে সেখানে বড় বড় বুদ্ধিজীবী এসেছে। বিগতকালের বড় বুদ্ধিজীবীরা সেখানে এতই গালিভারের সমান যে এখনকার বুদ্ধিজীবীরা ব্রিটিশদের কাছে নাকি লিলিপুটের মতো। তাই তাদের কদর কম। আবার এও সত্য, প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা তাদের কালে ও দেশে সম্মান পান না। পরবর্তীকালই নাকি তাদের মর্ম বুঝতে পারে, সে অনুসারে সম্মানও দেখায়। ব্রিটেনে আরেক মজার সমস্যা হলো- সেখানে গেঁয়ো যোগীর কদর কম। অর্থাৎ ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের চাইতে অব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের কদর সবসময়ই খানিকটা বেশি।
আমাদের বুদ্ধিজীবীতার হ্রস্ব ইতিহাসের দিকে তাকালে খুব বেশি এভারেস্টের দেখা মিলবে না। জনসমাজের মধ্যে বুদ্ধিজীবীর প্রভাব তৈরি হওয়ার জন্য যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীন পরিস্থিতি দরকার হয় তা এখানে নেই। তেমনি বুদ্ধিজীবীরা সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপান্তরের জন্য ইতিবাচক উদ্দেশ্যে জনসমাজকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন; জনগণের মুক্তির সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন এমন উদাহরণও এখানে তেমন নেই। কোনো বুদ্ধিজীবীর কথায়, লেখায়, অবস্থানে এদেশে মানুষের খুব বেশি যায় আসেনি। বলতে গেলে, পশ্চিমা সমাজে বুদ্ধিজীবীর যে ভূমিকা ছিল বা আছে তা আমাদের দেশে কখনো তৈরি হয়নি। ফলে, আধুনিকতা, ‘রেনেসাঁ’ ও স্বাধীনতার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীতার তৃষ্ণা আমাদের সমাজেও জেগেছিল। এ তৃষ্ণা এখনও জাগরুক। রাষ্ট্র ও সমাজে ‘আইডিয়া’র অভাবের কথা তেমন শোনা না গেলেও ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’র অভাবের কথা স্বাধীনতার পর শোনা গেছে। অনেকেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা বলেন। নানা কর্মকাণ্ডে মেধাবীদের অংশগ্রহণের কথা, রাজনীতিতে বিদ্বানদের প্রয়োজনীয়তার কথাও কানে আসে। তবে এগুলো কথার কথাই, আমাদের সমাজে বিদ্বান ব্যক্তিদের মূল্যায়নের রীতি স্মরণকালে তৈরি হয়নি। অন্যদিক থেকে বললে বিদ্বানরা সমাজে মূল্য তৈরি করতে পারেননি। রাষ্ট্রযন্ত্রে বুদ্ধিজীবীতার ভূমিকা স্পষ্ট হয়নি। ফলে পরিকল্পনা, রূপকল্পনা, দিকনির্দেশনা, অভীষ্ঠ, জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ইত্যাদি এখানে অনেকটাই অচেনা প্রসঙ্গ।
বুদ্ধিজীবী বলে একটা গোষ্ঠী শক্তভাবে গড়ে উঠতে পারলো না, রাষ্ট্র-সমাজে ভূমিকা রাখতে পারলো না তবুও বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে এমন একটা ঠাট্টা ও অবজ্ঞার মনোভাব তৈরির পেছনে রহস্যটা কোথায়? বিনয় ঘোষ ‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ বই লিখে এদেশে বুদ্ধিজীবীতার ইতিহাসের সূচনাপর্বটা আমাদের জানিয়েছেন। বিনয় ঘোষ চানক্যের উদ্ধৃতি টেনেছেন বইয়ে। চানক্য বলেছেন, ‘রাজা স্বদেশে পূজিত হন, বিদ্বান সর্বত্র হন পূজিত।‌’ বিনয় ঘোষ জানাচ্ছেন, ‘ইতিহাসে দেখা যায়, স্বদেশে পূজিত হন রাজা এবং বিদ্বান প্রথমে রাজার পূজা করে পরে দেশপূজ্য হন। রাজা যাকে সম্মানিত করেন, প্রজারাও তাকে মর্যাদা দেন। রাজসম্মান আগে, প্রজার সম্মান পরে।‌’ অতীতে যে বুদ্ধিজীবীরা এদেশে সম্মান পেয়েছেন তারা ছিলেন দরবারের বুদ্ধিজীবী। রাজার আকাঙ্ক্ষা অনুসারে তাদের বিদ্যা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ব্যবহৃত হতো। উনিশ শতকের রূপান্তরের সময় এদেশে যে বুদ্ধিজীবীতা তৈরি হয়েছিল তা ‘নবযুগের রাজা ইংরেজদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পোষকতায়’। কলকাতায় কীভাবে সেই অফিশিয়াল বুদ্ধিজীবীতার ধারা তৈরি হলো তার একটা প্রামাণ্য বিবরণ দিয়েছেন বিনয় ঘোষ। বাংলাদেশে যে বুদ্ধিজীবীতার দেখা আমরা পাই তা হরেদরে সেই অফিশিয়াল বুদ্ধিজীবীতারই অপভ্রংশ। এ বুদ্ধিজীবীতা দরবারি, অফিশিয়াল, সরকারি। এভাবেই এর বিকাশ ঘটেছে। আমাদের ইতিহাসে আমরা স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, নিজস্ব বুদ্ধিজীবীতা দেখি নি। উনিশ শতকের কলকাতা হোক, কি বিশ বা একুশ শতকের ঢাকা- বুদ্ধিজীবী বলে আমরা যে গোষ্ঠীটাকে জেনেছি, তারা সরকারি বুদ্ধিজীবী। শাসকের মতাদর্শ, কর্তৃত্বশীল দর্শন, প্রচলিত মনোভাবের বাইরে তাদের কথা বলতে দেখা যায়নি/যায় না। এদের কেউ কেউ সমাজের প্রচলিত চিন্তা বা মতাদর্শ থেকে খানিকটা ভিন্ন অবস্থান নিয়ে অগ্রসর বা প্রগতিশীল খেতাবও পেয়েছেন। কিন্তু তাদের চিন্তা রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণীর জন্য কোনো গুরুতর সংকট তৈরি করেছে এমন উদাহরণ নেই। জনসমাজও (এমনকি জনগোষ্ঠীর কোনো একটি শ্রেণী) কোনো অদৃষ্টপূর্ব ও নতুন চিন্তার স্পর্শে সহসা জেগে ওঠেনি। জনসমাজে এই বুদ্ধিজীবীর কদর হবে এটা আশা করাও ভুল। ফলে, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তবে এ হাসি-ঠাট্টার সবটাই নির্দোষ নয়। কারণ, কালেভদ্রে শাসক-বিরোধী, জনমনস্ক বুদ্ধিজীবীর আত্মপ্রকাশ ঘটলে তারা খুব সমাদৃত হয়েছেন এমন উদাহরণও পাওয়া যায় না। জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধির প্রতি সন্দেহ, তাচ্ছিল্য, সংশয়, অবিশ্বাস থেকে একটা সাধারণ নাকচের দেখা মেলে। ফলে, বুদ্ধিজীবীতার বিরুদ্ধে মানুষের মনোভাবকেও বুদ্ধিজীবীতার সঙ্গেই সন্দেহ করা দরকার।
শুধু পরিবর্তন, বিপ্লব, রেনেসাঁয় বুদ্ধিজীবী কাজে লাগবে এমন কথা নেই। সমাজে যখন বুদ্ধিহীনতা, আনপড় মনোভাব, আইডিয়াহীনতা শেকড় বিস্তার করে তখন বুদ্ধি, জ্ঞান ও বিদ্যার ব্যবহার বাড়ানো দরকার। আমাদের সমাজে এমন একটা চাহিদা গত দুই দশকে তৈরি হয়েছে। সমাজের একটা দৃশ্যমান ও বৃহৎ গোষ্ঠী এখন মনে করে- জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধির অংশগ্রহণ সমাজে-রাষ্ট্রে বাড়ানো দরকার। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন তারা চায়- কিন্তু বিপ্লব নয়, স্থিতাবস্থা বজায় রেখেই রূপান্তরের পক্ষে তারা। আমাদের দেশে ‘সিভিল সোসাইটি’ ধারণার মধ্য দিয়ে এই অভীপ্সা প্রকাশিত হতে চায়। সিভিল সোসাইটির নিজস্ব ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, ভূমিকাও আছে। বর্তমান দুনিয়ায় পলিটিকাল সোসাইটির বাইরে একটা গোষ্ঠী শুধু নয়- সিভিল সোসাইটি এখন আন্তর্জাতিক একটি গোষ্ঠী। পশ্চিমা ‘আদর্শ’ রাজনীতি ও সংস্কৃতির বার্তাবাহক এই গোষ্ঠীকে পশ্চিমারা ‘আমাদের লোক’ বলে ডাকে। আমাদের দেশে সিভিল সোসাইটি গঠনের পেছনেও আন্তর্জাতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সমাজের একটা অংশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অভীপ্সাও ব্যক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অভীপ্সা, রাজনৈতিক অভিলাষ পর্যন্ত গড়িয়েছে।
উনিশ শতকের বিদ্বৎসমাজ কীভাবে সিভিল সোসাইটির রূপ নিল, কীভাবে বিদ্বৎসমাজ সিভিল সমাজ পরিচয়ের মধ্যে পরিচয়ের স্বস্তি খুঁজে পেল তা পৃথক পর্যবেক্ষণের বিষয়। কিন্তু সিভিল সমাজের মধ্যেও বিদ্যা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বদলে ক্ষমতা, গোষ্ঠীগত উদ্দেশ্য সাধন ও সংগঠিত আকাঙ্ক্ষার প্রাধান্য এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো বিষয়।

নানা দিক থেকেই মনে হয়, আমাদের দেশে গোষ্ঠী বা সংগঠিত অস্তিত্বের বাইরে ব্যক্তি বুদ্ধিজীবীর অবস্থান কল্কে পায়নি। অর্গানিক বা ট্রাডিশনাল ইন্টেলেকচুয়াল ধারণা এখানে পরিচিত হলেও পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল ধারণাটি ততো জানা নয়। তবে, ইতিমধ্যে গুটিকয় পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের দেখা আমরা পেয়েছি। এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন, ‘সে পরিহাসময় ব্যক্তিটি বিব্রতকর প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য পরিচিত; প্রচলিত ও গোঁড়া মতাদর্শকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত; যাকে সরকার বা কর্পোরেশনগুলো সহজে কিনতে পারে না’ তিনিই পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। দেখা যাচ্ছে, মার্কসবাদী বা পুঁজিবাদী উদ্দেশে গঠিত সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবীতার চাইতে জনমনস্ক ব্যক্তি বুদ্ধিজীবীতা বা পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল ধারণাটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। পৃথিবীতে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালরাই মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছেন। আমাদের দেশেও পাবেন বলে মনে হয়।
মাহবুব মোর্শেদ: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

সাধুসঙ্গে সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক হামলা ও মধ্যবিত্তের হস্তিদর্শন

এপ্রিল ২৫, ২০১১ বিডি নিউজে প্রকাশিত
গত ৫ এপ্রিল রাজবাড়ির পাংশায় সাধুসঙ্গ উপলক্ষে সমবেত ২৮ লালনপন্থী সাধু-গুরুর ওপর হামলা চালায় দুবৃর্ত্তরা। গণতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার আছে সমবেত হওয়ার, বিশ্বাস অনুসারে কর্মসূচি পালন করার এবং আদর্শ ও ধর্মমত প্রচার করার। কেউ যদি নিজের ধর্মমত, বিশ্বাস, রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি হুমকি মনে করে অন্য ধর্মমত, বিশ্বাস ও রাজনৈতিক মতের ওপর শারীরিক বা মানসিকভাবে হামলা করে তবে প্রথমত তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বরখেলাপ। আক্রমণটি যদি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত হয় তবে তা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ- ধর্মান্ধদের দ্বারা সংগঠিত হামলা। আর যদি রাজনৈতিক শক্তির সমর্থনে তারা কর্মীদের দ্বারা সংগঠিত হয় তবে তা একই সঙ্গে রাজনৈতিক ভিন্নমতের প্রতি আক্রমণও। রাজবাড়িতে সাধু-গুরুদের ওপর হামলা হয়েছে- এ খবরটি আমরা জানি। এ নিয়ে দেশের সাধু-গুরুরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন, অবিলম্বে থানায় গিয়েছেন। দেশের শহরগুলোতেও নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে- শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা, অসাম্প্রদায়িক নাগরিকদের উদ্যোগে। আমরাও আর অনেকের মতো এমন ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা জানাই। কিন্তু আমরা যে বর্গের বা গোষ্ঠীর অংশ সেই শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা, অসম্প্রদায়িক বর্গের প্রতিবাদে কিছু অস্পষ্টতা ও দিশাহীনতা আছে বলে মনে হচ্ছে। আলোচনার খাতিরে এই বর্গটিকে সংক্ষেপে শহুরে প্রগতিশীল বর্গ নামে ডাকা যায়। প্রথম প্রশ্ন হলো, শহুরে প্রগতিশীলদের প্রতিবাদে হামলাকারীদের পরিচয় মুছে দেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা কি চলছে? যারা সাধু-গুরুদের ওপর হামলা চালিয়েছেন তাদের একটি রাজনৈতিক, ধর্মীয় এমনকি শ্রেণীগত পরিচয়ও এ সংক্রান্ত খবরের সূত্রে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সেসব পরিচয়কে আড়াল করার কোনো চেষ্টা কি সচেতনভাবে চলছে? বলা হচ্ছে, ধর্মান্ধ অপশক্তি বাউলদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ধর্মান্ধ অপশক্তি বললে আমরা যাদের সহজে চিনি তাদেরকেই হয়তো আমরা রাজবাড়ির হামলার জন্য দায়ী করতে চাই। ফলে, রাজনৈতিক পরিচয়ে যে তারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সেটি গোপন করতে চাই? আমরা কি মনে করি, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে রাজবাড়ির স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের রাজনীতির পার্থক্য আছে? তারা ভুলবশত আওয়ামী লীগের আদর্শের বাইরে গিয়ে হামলা চালিয়েছেন? ৮ এপ্রিল তারিখের কালের কণ্ঠ পত্রিকা খবর দিচ্ছে, ‘’ধর্মবিরোধী’ কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তওবা পড়ানো হলো ২৮ বাউলকে!’ শিরোনামে। খবরের বলা হচ্ছে-
‘রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে লালন ভক্ত ২৮ বাউলকে লাঞ্ছিত করার পর মাথার চুল ও গোঁফ কেটে দিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ‘ধর্মবিরোধী’ কর্মকাণ্ড চালানোর কারণ দেখিয়ে বাউলদের মসজিদে নিয়ে তওবাও পড়ানো হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ও অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে গত বুধবার রাতে পাংশা টেম্পোস্ট্যান্ডে সভা করেন স্থানীয় শাহ জুঁই বাউল শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা।

শাহ জুঁই বাউল শিল্পীগোষ্ঠীর উপদেষ্টা অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর জানান, হাবাসপুর ইউপির চর রামনগর গ্রামে গত ৫ এপ্রিল লালন ভক্ত প্রবীণ বাউল মোহম্মদ ফকিরের বাড়িতে সাধু সংঘের দুই দিনব্যাপী বার্ষিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ২৮ জন লালন ভক্ত আসেন। সমাপনী দিনে তাঁরা ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান করছিলেন। এ সময় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গিয়ে লালন ভক্তদের লাঞ্ছিত করে। মসজিদে নিয়ে গিয়ে বাউলদের গান না গাওয়ার বিষয়ে তওবা করানোর পাশাপাশি তাঁদের লম্বা চুল ও গোঁফ কেটে দেওয়া হয়।
নজরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর জানান, ঘটনার পরপরই লালন ভক্তরা তাঁর কাছে যান। তিনি সবাইকে নিয়ে পাংশা থানায় যান। এরপর বাউল মোহম্মদ ফকির ১৩ জনকে আসামি করে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন।

থানায় অভিযোগকারী বাউল মোহম্মদ ফকির বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো এবারও সাধু সংঘের উদ্যোগে আমাদের বাড়িতে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শেষ দিন মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে পাড়া বেলগাছী গ্রামের ইউনুছ কারি ও চর রামনগর গ্রামের করিম বাজারী, জিন্দার শেখ, জয়নাল শেখসহ প্রায় অর্ধশত লোক আমার বাড়িতে আসে। তাঁরা অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বলে একটি মাইক, তিনটি মাইক্রোফোন, তিনটি ব্যাটারি, তিনটি টিউব লাইট ও একজন শিল্পীর বাদ্যযন্ত্রসহ বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যায়। এরপর তারা ২৮ জন লালন ভক্তকে পাশের মসজিদের সামনে নিয়ে গিয়ে তওবা পড়ায় এবং কাঁচি দিয়ে এলোমেলোভাবে তাদের চুল ও গোঁফ কেটে দেয়।’
ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হামলাকারী দলের সঙ্গে ছিলেন পার্শ্ববর্তী কালিকাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিউর রহমান নবাব। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বাউলদের ‘অনৈসলামিক’ কর্মকাণ্ডকে দায়ী করেন। আতিউর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মুসলিম ধর্মীয় রীতি না মেনে বাউলরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জিন্দা ফয়তা ও এক ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ অনুষ্ঠানের নামে মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করছিল। এটা এলাকার মুসল্লিরা মেনে নিতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে বাউলদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় এলাকার কিছু যুবক তাদের চুল ও গোঁফ কেটে দেয়।’
বিষয়টি শুনে ঘটনাস্থলে যাওয়া হাবাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আবদুল আজিজ বলেন, যেসব বাউল ভক্তকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে তাঁদের কারো বয়স ৬০ বছরের নিচে নয়। অন্যদিকে থানায় অভিযোগকারী বাউল মোহম্মদ ফকিরের ছেলে জিন্না মোল্লার স্ত্রী হাসিনা বেগম জানান, ঘটনার পর থেকে লালন ভক্তরা চাপের মুখে রয়েছেন। এলাকার কথিত মাতব্বর ও প্রভাবশালী লোকজন তাঁদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
এ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা ও পাংশা থানার উপপরিদর্শক নাসির উদ্দিন গতকাল বৃহস্পতিবার মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে বিষয়টির সংশ্লিষ্টতা থাকায় খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য বুধবার দুইপক্ষকে থানায় ডাকা হয়, কিন্তু বাউলদের পক্ষের কেউ না আসায় সুরাহা করা সম্ভব হয়নি। আগামী রবিবার আবার দুইপক্ষকে ডাকা হয়েছে।’’
খবরে স্পষ্ট, মোল্লাদের সহায়তায় রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে বাউলদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এবং এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, ১১ এপ্রিলের মানবজমিন জানাচ্ছে, এই ক্ষমতাসীনদের চাপের কারণেই তৎক্ষণাত মামলা না নিয়ে ৫ দিন পর পুলিশ মামলা নেয়। এবং একই কারণে আক্রমণে জড়িত অপরাধীদের পুলিশ আইনের আওতায় নিয়ে আসতেও গড়িমসি করে। শেষ পর্যন্ত আসামীদের নিয়ে প্রভাবশালীদের চাপে অনেক বাহানার পর সংবাদমাধ্যমের মারফত আমরা জানতে পারছি, ‘রাজবাড়ীতে ২৮ বাউল নির্যাতনের ঘৃণ্য ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য আদালতের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে আকস্মিকভাবে শালিস বৈঠক ডেকে বিষয়টি আপোসরফা করে দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। রাজবাড়ী-২ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মোঃ জিল্লুল হাকিমের উদ্যোগে ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৮টায় পাংশা ডাকবাংলোয় বসে একটি সমঝোতা বৈঠক। বৈঠকে বাউল নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বাদী, ক্ষতিগ্রস্ত বাউলদের কয়েকজন ও মামলায় অভিযুক্ত ১৩ আসামিসহ উভয়পক্ষের কয়েকশ মানুষ উপস্থিত ছিলেন’।
অপরাধ সংগঠন থেকে শুরু করে আপোষ রফার শালিসি পর্যন্ত অপরাধীরা যাদের সমর্থন ও সঙ্গ পেয়েছেন তারা সরকার দলীয় ক্ষমতাবান। অপরাধীদের অধিকাংশ সরকার দলের সক্রিয় নেতাকর্মীও। এসব তথ্য উহ্য রেখে আমরা যখন অপরাধীদের স্রেফ ধর্মান্ধ বলে ঘটনার প্রতিবাদে নেমে যাই তখন আমরা অর্ধসত্যের ওপর দাঁড়াই বটে। হয়তো শহরে আমরা আওয়ামী লীগকে আমাদের মতোই অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিমনা বলে চিনি বা চিনতে চাই বলে গ্রামে আওয়ামী লীগের দ্বারা সংগঠিত অপরাধকে গোপন করে যেতে চাই। তাদের সঙ্গে ধর্মান্ধ শক্তির আঁতাত আমাদের পর্যবেক্ষণের বাইরে থেকে যায়। বাউলদের ওপর হামলা, বাউলদের মামলা অকার্যকর থাকা ও শেষ পর্যন্ত শালিসির পেছনে রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার আমাদের আলোচনার বাইরে থেকে যায়। ফলে, সাধু-গুরুদের ওপর হামলাকারীদের পরিচয়কে আমরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে সেই ধর্মান্ধদের পরিচয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি যারা নারী নীতির বিরোধিতা করে এমনকি যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের দলভুক্ত করে ফেলি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আপাত অর্থে এই ধর্মান্ধ ও সন্ত্রাসীদের দলভুক্ত নয় রাজবাড়ির সন্ত্রাসীরা। তারা শহুরে প্রগতিশীল বর্গের কাছের দল আওয়ামী লীগের লোক। যারা শহরে বাউলদের পক্ষে মানববন্ধন করেছেন তাদের অনেককে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা আসলেই রাজবাড়ির হামলাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ওয়াকিবহাল নন। তারা শুধু ধর্মীয় পরিচয়টুকু জেনেই মাঠে নেমেছেন।
শুধু হামলাকারীদের পরিচয়ের অস্পষ্টতা নয়। যাদের ওপর হামলা করা হয়েছে তাদের পরিচয় নিয়েও আরেক ধরনের অস্পষ্টতা আছে। শহুরে প্রগতিশীলরা যাদের বাউল বলে চেনেন, আখ্যায়িত করেন- বাউল অভিধায় তাদের অনেকেরই আপত্তি আছে। শুধু বাউল বলেই কথা থেমে যায় না। আমাদের সাহিত্যে, সংবাদপত্রে, কলামে, কথায় এই বাউলদের যে রূপ নির্মাণ করি তাতে তাদের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পুননির্মাণ করি। মনে করি, এরা হিন্দু-মুসলিমের দ্বন্দ্বে সেতুবন্ধের ভূমিকায় অবতীর্ণ। প্রথম কথা হলো, বাউল শব্দের মধ্যে এদের সবার পরিচয় নেই। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব ঘর বা ঘরাণা আছে। ঘর অনুসারে বিশ্বাস ও আদর্শের ভিন্নতাও আছে। দ্বিতীয়ত, এরা হিন্দু, মুসলিম ও অসম্প্রদায়িকদের চেয়ে প্রগতিশীল বটে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ নয়। ঘরগুলো একেকটি ধর্ম। ফলে, আমাদের পূর্বজ বিদ্বানদের কেউ কেউ এদের ধর্মসম্প্রদায় বা উপাসক সম্প্রদায় হিসেবে চিনেছেন। ধর্ম ও দার্শনিক সম্প্রদায় হিসেবে এদের নিজস্ব পালনীয় আছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে, গার্হস্থ্য, বৈরাগ্যের রীতি-পদ্ধতি আছে। এমনকি বিশেষ ইউনিফর্মও আছে। চুল-দাড়ি, জোব্বা সবই সেই ইউনিফর্মের অংশ। বাইরে থেকে তারা অন্য ধর্ম সম্প্রদায় বা অসাম্প্রদায়িকদের থেকে যেমন আলাদা তেমনি তেমনি ভেতর থেকেও। ভারতবর্ষে জৈন-বৌদ্ধ থেকে শ্রীচৈতন্য পর্যন্ত যে বেদ-বিরোধী/অবৈদিক/প্রতিবাদী ধর্মধারার বিকাশ ঘটেছে সে ধারা শতধাবিভক্ত হয়ে আজও সমাজে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সেই ধর্মধারার একটি লালন সাঁইয়ের ঘর। লালন সাই পর্যন্ত আসার পথে এ ধর্মধারায় ইসলামী উপাদানগুলো প্রবেশ করেছে। কিন্তু বেদপুরাণের ক্ষেত্রে যেমন ইসলামের ক্ষেত্রেও তেমন শরিয়ত/কেতাব/আচার/বেদ/পুরাণকে তারা শত্রুজ্ঞান করেই এগিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবাদী ধর্মধারার বৈশিষ্ট্য অনুসারে এরা সবসময় মূলধারার ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই এ দুইকে প্রশ্ন করেছেন। ধর্মগুলো থেকে অনেক উপাদান গ্রহণ করেছেন আবার অনেক কিছু বর্জন করেছেন। ধর্মের চৌহদ্দীর মধ্যে কৌশলগত অবস্থান শুধু নয়, ধার্মিকদের চৌহদ্দীর মধ্যে থেকে তারা যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি ধর্মকে ফেলেন তা ধার্মিকদের পক্ষে মোকাবেলা করা কঠিন। হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মসম্প্রদায়ই সে কারণে তাদের বিরোধিতা করেছে, তাদের ওপর হামলা করেছে। কিন্তু প্রতিবাদী ধর্মগুলো দুই ধর্মের ডিকশন, নবী-রসুল, অবতার, বেদ-পুরাণকে এমনভাবে ব্যবহার করেছে, আত্মস্থ করেছে যে তারা এই দুই ধর্মের চৌহদ্দীর বাইরে অবস্থান করেন কি না সেটি বোঝাও অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমন এক পরিস্থিতিতে আমরা যখন দু’একটি গানের সূত্রে তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীকে পরিণত করি তখন অনেকটা ভুল পাঠ হয়ে যায়। এককালে হিন্দু লালন গবেষকরা লালনকে হিন্দু, মুসলিম লালন গবেষকরা মুসলিম হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন এখন অসাম্প্রদায়িক আদর্শে লালনকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে। প্রায় হাজার বছর ধরে যে প্রতিবাদী ধর্মধারার বিকাশ এই ভূখণ্ডে হয়েছে তাকে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে উৎখাত করে শহুরে মিডলক্লাসের সেক্যুলার আদর্শে গুম করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ফলে, শহুরে মধ্যবিত্ত প্রগতিশীলরা যখন তাদের কথিত বাউলের সম্মান রক্ষার জন্য একাট্টা হন তখন ‘বাউল’দের মত, বিশ্বাস, আদর্শ ও আচারের বাইরে আমরা এমন পুননির্মিত বাউলদের দেখা পাই যারা সেক্যুলার মিডলক্লাসের গ্রামীণ সংস্করণ ছাড়া আর কিছু নয়।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, মধ্যবিত্ত অ্যাক্টিভিস্টরা তাহলে কী করবে? রাজবাড়িতে বাউলরা নির্যাতিত হলে তারা কি চুপ করে থাকবে? আজ তো তাদের প্রতিবাদের কারণেই হাই কোর্ট নির্দেশ জারি করলো। বাউলদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব বাতলে দিল। কথা সত্য, আর শহুরে প্রগতিশীলদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে কিন্তু তাদের প্রতিবাদ যে সৎ মানবতাবাদী প্রয়াস তাতে সন্দেহ নাই। ফলে, এই প্রতিবাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তথাকথিত বাউলদের ইতিহাসটাও একটু জেনে নিতে হবে।
বৈদিক ধর্মের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এই বাউলদের পূর্বসূরিরা লড়াই করেছেন শত শত বছর ধরে। প্রতিবাদী সহজ ধর্মধারার উত্থান ও জনপ্রিয়তার কারণে শ্রীচৈতন্যকে প্রাণ দিতে হয়েছে। লালন ও তার অনুসারিরা দীর্ঘদিন ধরে শরিয়তপন্থী মুসলিমদের ফতোয়া, আক্রমণ ও কুৎসার শিকার হয়েছেন। মীর মশাররফ হোসেনের মতো সাহিত্যিকও লালনপন্থীদের ইসলাম-বিদ্বেষী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। মুন্সি মেহেরুল্লাহ, মোহাম্মদ রেয়াজ উদ্দিন আহম্মদ, শেখ রেয়াজউদ্দিন আহম্মদ, মৌলানা আকরাম খাঁ, মুন্সি এমদাদ আলি থেকে শুরু করে বহু বিরোধীর মোকাবেলা তাদের করতে হয়েছে। ফতোয়ার সর্বশেষ প্রতিনিধি মুফতি রিয়াজ। দীর্ঘকাল ধরে শরিয়তপন্থীরা যে আক্রমণ করে এসেছে তা লালনপন্থীরা মোকাবেলা করেছেন নিজেদের সংঘশক্তি ও চিন্তা শক্তির দ্বারা। লালনের লাঠিয়াল বাহিনী ছিল। সে লাঠিয়াল শুধু ফতোয়ার হাত থেকে তাদের রক্ষা করতো না। ঠাকুর পরিবারের জমিদারি-জনিত অত্যাচার থেকে সাংবাদিক বন্ধু কাঙাল হরিনাথকে রক্ষার কাজেও যে শক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। কয়েশত বছর ধরে লালনের ধর্ম ও চিন্তা লড়াই করেই সমাজে টিকে আছে। ইসলামের বহু উপাদান নিয়ে তারা ধর্মের চৌহদ্দী ও ধার্মিকের উঠানে বসে ধর্ম-সমালোচনার যে রীতি পালন করে আসছে সে সাহস সেক্যুলার মধ্যবিত্তের মধ্যে নেই। মধ্যবিত্ত যেখান থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেক্যুলার আদর্শ পেয়েছে সে আদর্শের ইতিহাসের মধ্যে এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না। লালনের আদর্শ মধ্যবিত্তের সমর্থনের অপেক্ষায় কখনোই নিজের লড়াইকে অপেক্ষায় রাখেনি। ফলে, মধ্যবিত্ত যদি নিজেদের লালনের আদর্শের জিম্মাদার ভেবে তার পক্ষে দাঁড়ায় তবে লালনের আদর্শের আত্মশক্তিকে তারা ভুলভাবে বিচার করবে।
মুফতি রিয়াজদের সঙ্গে লালনপন্থীদের সংঘর্ষের ইতিহাস দীর্ঘ। অফিসিয়াল ইসলামের আক্রমণে লালনপন্থীদের দমানো যায়নি। বরং তাদের উত্থাপিত প্রশ্ন অফিসিয়াল ইসলামের ভিতকে বহুভাবে পর্যুদস্ত করেছে, তর্কে পরাস্ত করেছে। তর্কে জেতার সম্ভাবনা নাই বলেই তাই তারা শারীরিক আক্রমণের পথ অবলম্বন করে, তাদের সম্পর্কে অপপ্রচার ও কুৎসা রচনা করে। কিন্তু সাধুগুরুদের লড়াইয়ের নতুন সঙ্গীরা কী চায়? তারা কি সাধুসঙ্গ নাকি সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব-জনিত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়? আক্রমণকারীর রাজনৈতিক পরিচয়, আক্রান্তের ধর্ম ও আদর্শ ও দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস গোপন রেখে ‘বাউল’দের পক্ষাবলম্বন আরও বড় কোনো অসাধু রাজনীতি-জনিত কি না সে প্রশ্ন তাই করে রাখছি।
মাহবুব মোর্শেদ: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

ফলেই পরিচয়

'বৃক্ষ তোমার নাম কী'_ 'ফলেই পরিচয়'। এই প্রবাদ শত শত বছর ধরে আমাদের দেশে প্রচলিত। বৃক্ষের পরিচয় ফলে। পত্রসুশোভিত মনোহর বৃক্ষ উপকারী বটে, তার নানা ব্যবহারও আছে। কিন্তু পরিচয় দিতে গেলে ফলের খবর পড়ে। তবে সব বৃক্ষ ফল দেয় না। কিছু বৃক্ষ ফুলের জন্যই খ্যাত। কিছু আবার কাঠের জন্য কিংবা অন্য উদ্ভিজ গুণাবলির জন্য বিখ্যাত। ফল শুধু খাওয়ার উপযুক্ত বস্তু নয়। ফল মানে পরিণতিও। সেই অর্থে ফুলসহ অন্য সব বস্তুই চূড়ান্ত বিচারে ফল। আর ফলদ বৃক্ষের বেলায় তো কথাই নেই। মিষ্ট, টক বা কষা স্বাদ_ যা-ই হোক, ফল দিয়ে সে বৃক্ষ নিজের পরিচয় জ্ঞাপন করে। বলা যায়, ফল দেওয়ার ক্ষেত্রে বৃক্ষের কোনো কার্পণ্য নেই। উপযুক্ত পরিবেশ ও আবহাওয়া পেলে ফল ভালোই মেলে। বৃক্ষ নিজ থেকে ফলের স্বাদ, গন্ধ, তাৎপর্য কিছুই পরিবর্তন করে না। কিন্তু বৃক্ষের ফল পরিচয়ে বাদ সাধে মানুষ। এমনই বাদ সাধে যে, বৃক্ষের পরিচয়ই তাতে মুছে যাওয়ার জোগাড় হয়। বাংলাদেশে এখন ফলের মৌসুম। দেশি ফলে বাজারগুলোর রমরমা অবস্থা। কিন্তু ফলগুলোর দিকে তাকিয়ে বৃক্ষের পরিচয় জানতে যেন ক্রেতারা কুণ্ঠিত। কেননা, প্রাকৃতিকভাবে এ ফলে যে গুণাগুণ থাকার কথা, তা আর অবিকৃত নেই। এতে অনেক দোষ ঘটেছে। সে দোষ ফলগুলোকে বিষাক্ত করে তুলেছে। কখনও ফলে মিশছে কার্বাইড, কখনও ফরমালিন, কখনও-বা জীবনঘাতী নানা মন্দ রাসায়নিক। এই রাসায়নিকগুলো ফলের বিশিষ্টতাকে কেড়ে নিচ্ছে। বিনিময়ে ফলগুলোকে দিচ্ছে পচনরোধী স্থায়িত্ব। এর ফলে লাভবান হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে ক্রেতা ও ভোক্তারা। প্রথমত, বাজারের রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত ফল খেয়ে আসল ও প্রাকৃতিক ফলের স্বাদ ভুলতে বসেছে ক্রেতারা। দ্বিতীয়ত, রাসায়নিক মিশ্রিত ফলগুলো ভোক্তাদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব রাখছে। তৃতীয়ত, প্রতারিত হচ্ছে ক্রেতারা। যে ফলকে উপকারী, পুষ্টিকর বলে কেনা হচ্ছে, তা-ই যে শরীরের বিপুল ক্ষতির কারণ হচ্ছে_ তা অনেকেরই অজানা। কিন্তু ক্রেতাদের এই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য খুব বেশি উপায় বাজারে কার্যকর নয়। মাঝে মধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযানে ফলের ভেতর থেকে বৃক্ষ নয়, রাসায়নিকের পরিচয় বের হয়ে আসছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে ক্রেতাসাধারণ কিছুদিন বিমুখ হচ্ছেন বটে, কিন্তু পরে নিরুপায় হয়ে সেই ফলরূপী রাসায়নিকের কাছেই ফিরছেন। ক্রেতাদের প্রতারণা করার ক্ষেত্রে সাধারণ দোকান আর অভিজাত বিপণিবিতানের মধ্যে পার্থক্য খুব কমই দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষতির হাত থেকে ক্রেতাদের রক্ষা করতে হলে ক্রেতা অধিকারের যে আইন থাকা দরকার, তা এ দেশে কার্যকর নয়। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও আছে নানা শিথিলতা। আর আইন-কানুনের ফাঁক গলে বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে ভেজাল, রাসায়নিক মিশ্রিত ক্ষতিকর ফল। ফলাফল সবার জানা। তাই এখন সেই প্রবাদের দিন শেষ। এখন বোধ হয় ফলকেই জিজ্ঞেস করতে হবে, ফল তোমার নাম কী? ফল কি উল্টো বৃক্ষের পরিচয় বলবে? নাকি বলবে, রাসায়নিকে পরিচয়? কোন ফলে কোন রাসায়নিক মিশিয়ে তা বাজারজাত করা হয়, তার খবর জানাই এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

Wednesday, May 16, 2012

ফ্ল্যাশ ফিকশন দিবস



গতকাল অর্থাৎ ১৬ মে ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো পালিত হলো জাতীয় ফ্ল্যাশ ফিকশন দিবস। খবরটা পড়ার পর আবশ্যিকভাবে পাঠকের প্রথম প্রশ্ন হবে_ কী দিবস? হ্যাঁ, ঠিকই তো পড়েছি, লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় স্পষ্টভাবেই লিখেছে, ফ্ল্যাশ ফিকশন দিবস। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো_ কী বস্তু বা ঘটনা এই ফ্ল্যাশ ফিকশন? ফ্ল্যাশ ফিকশন কাহিনীভিত্তিক সাহিত্য আঙ্গিকেরই একটি ধারা। ইংরেজি ভাষায় ছোট গল্প, বড় গল্প, উপন্যাসের মতো ফর্ম বা সাহিত্য আঙ্গিকগুলোকে এককথায় ফিকশন বলা হয়। সাহিত্য মোটাদাগে তিন ভাগে বিভক্ত_ ফিকশন, নন-ফিকশন, কবিতা। নন-ফিকশন হলো, যা কাহিনী ও কবিতা নয় তা-ই। ফিকশনের ক্ষুদ্রতম শিল্প আঙ্গিকটিকে বলা হচ্ছে ফ্ল্যাশ ফিকশন। প্যারাবোল আঙ্গিকটি ইতিমধ্যেই পরিচিত। অধিকাংশ নীতিকাহিনী প্যারাবোল আঙ্গিকে লিখিত বলে পৃথিবীর বিখ্যাত প্যারাবোলগুলোর সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত। ফ্ল্যাশ ফিকশন আকারে প্যারাবোলের সমান হতে পারে। প্যারাবোলের চেয়ে বড় বা ছোটও হতে পারে। তবে ছোটগল্পের ধাঁচটা আত্মস্থ করেই তার বিকাশ। তাই এর আরেক নাম ছোট ছোট গল্প বা মাইক্রোফিকশন বা ক্ষুদ্র গল্প। এক ঝলকে যে গল্প পড়া যায় তার নামই ফ্ল্যাশ ফিকশন। উদাহরণ দেওয়া যাক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে থেকে। তিনি একদা ছয় শব্দের একটি গল্প লিখেছিলেন। সেটি আদর্শ ফ্ল্যাশ ফিকশন হিসেবে স্বীকৃত।For sale : baby shoes, never worn. 'বিক্রয়ের জন্য :বাচ্চাদের অব্যবহৃত জুতা।' অল্প কথায় অনেক কথা বলার এ পদ্ধতিতে অনেকেই গল্প লিখেছেন। বলা হয়ে থাকে, এ গল্পগুলো সবার পকেটে থাকে। শুধু বের করে লিখে ফেললেই হলো। ব্রিটেনে ক্ষুদ্র গল্পের এমন একটি দিবস কেন উদযাপিত হচ্ছে? আর্ট ফর্ম বিশেষত যেগুলো ক্ষীয়মাণ সেগুলোর চর্চা অব্যাহত রাখার জন্যই এমন উদ্যোগ। ঘটা করে মাইক্রো ফিকশনের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়েছে। লেখকদের উৎসাহিত করার জন্য আছে নানা আয়োজন। ফ্ল্যাশ ফিকশনের আয়তন কত বড় হতে পারে? এক শব্দ থেকে ১ হাজার শব্দ পর্যন্ত হতে পারে এর আয়তন। কীভাবে লেখা যায় এই বিশেষ ধরনের গল্প?
ডেভিড গ্যাফনে লেখার উপায় বাতলে দিয়েছেন।
গল্পের মাঝখান থেকে শুরু করুন। 

কেননা, এত ছোট গল্পে দৃশ্য ও চরিত্র প্রতিষ্ঠা করার মতো যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে না।
বেশি চরিত্র আনবেন না।
ছোট লিখতে গেলে অনেক চরিত্র আনলে চলবে না। এমনকি কোনো নাম ব্যবহারের প্রয়োজন নাও হতে পারে। নাম ব্যবহার করবেন তখনই, যখন এটা দিয়ে অনেক কিছু বোঝা যাবে।
গল্পের শেষটা যেন শেষে না থাকে।
ছোট বলে গল্পের শেষে মূল ঘটনা বলে দেওয়ার প্রবণতা লেখককে আচ্ছন্ন করে তুলতে পারে। পাঠক যেখানে পড়া শেষ করবেন, সেখানে গল্পটা থাকলে তা আকর্ষণীয় হবে না। তাই মাঝে গল্পটা বলতে হবে। অন্য স্থানগুলোতে গল্পের অনুষঙ্গ থাকতে পারে।
শ্রমসাধ্য শিরোনাম দিন, যাতে সেটি অর্থপূর্ণ হয়।
শেষ লাইনটা এমনভাবে লিখুন, যাতে সেটা ঘণ্টার মতো বেজে ওঠে।
শেষ লাইনে এমন একটা সিম্ফনি বেজে উঠুক, যাতে গল্পটা অন্য কোথাও নিয়ে যায়।
প্রথমে বড় করে লিখে পরে ছোট করুন।
প্রথমে বিস্তারিত লিখে তারপর ছোট করুন। যেভাবে একটি পাথর থেকে ভাস্কর্য তৈরি হয়, সেভাবে গল্পটা ছেঁকে তুলুন।

Tuesday, May 15, 2012

প্রাইভেট!

ঢাকা শহরে প্রাইভেট নামে একপ্রকার যান আছে। Private, privat, privet, প্রাইভ্যাট, প্রাইভাড ইত্যাদি বাহারি নামের যান আদতে সিএনজি অটোরিকশা। ঢাকা শহরে আদর করে এই যানটিকে সিএনজি বলে ডাকা হয়। সিএনজি নামের সবুজ যানটি পাবলিক পরিবহন বটে কিন্তু কার্যক্ষেত্রের একে যান না বলে অমাবস্যার চাঁদ বলা ভালো। পথচারী মাত্রই জানেন, সিএনজিচালককে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তিনি অমুক স্থানে যাবেন কি-না তবে উত্তর নিশ্চিতভাবেই ‘না’ মিলবে। প্রতিদিন রাস্তায় শত শত যাত্রী এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ‘না’ উত্তর পেয়ে ভাবতে বসতে পারেন, সিএনজি অটোরিকশাগুলো আসলে যায় কোথায়? যদিও বা পরমভাগ্যে কোনো সিএনজিচালক নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে রাজি হন, তাকে মিটারে যাওয়ার অনুরোধ করা পাপ। বড় অঙ্কের ভাড়া গুনেই তবে তাকে রাজি করানো সম্ভব। তবু সিএনজি আছে বলে জরুরি প্রয়োজনে রক্ষা। পকেট সাফ করে তবু গন্তব্যে যাওয়া চলে। ঢাকা শহর বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র রাজধানী শহর, যেখানে ট্যাক্সিক্যাব বলে কিছু নেই। কাগজে-কলমে হলুদ ও কালো/নীল ট্যাক্সিক্যাব চালু থাকলেও রাস্তায় তাদের পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হলুদগুলো রীতিমতো সোনার হরিণ। আর কালো ট্যাক্সিক্যাবগুলোর যে জীর্ণদশা তাতে উঠবার আগেই নিরাপত্তাহীনতা চেপে বসে। সবেধন নীলমণি ওই সবুজ সিএনজি। এ যানে মিটার থাকলেও কার্যকর নয়। আন্দাজে ভাড়া ঠিক করে পথ চলতে হয়। কেন এমন ব্যবস্থা জিজ্ঞেস করলে চালকরা মালিকের দোষ দেন। মালিকরা সরকারের দোষ দেন। রুট পারমিট নিতে যত লাখ লেগেছে তত লাখ তুলতে চান মালিকরা। আর তাই জমা বেশি। জমাটা তোলা হয় সরাসরি যাত্রীদের কাছ থেকে। যাত্রীদের টাকা প্রকারান্তরে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পকেটেই যাচ্ছে। বেশ। এ দেশে বড় কথা বলার লোকের অভাব নেই, কিন্তু পাবলিক পরিবহনের দুর্দশা নিয়ে কথা বলার লোকের দারুণ অভাব। কেন, কে জানে? এত বড় একটা শহর, ট্যাক্সিক্যাব তো নেই-ই, বৈধ সিএনজি অটোরিকশা আছে সাকল্যে ১৩ হাজার। অবৈধ কিছু আছে। আর আছে প্রাইভেট! শোনা যাচ্ছে, আরও ৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশা অনুমতি পাবে। প্রশ্ন হলো, সংখ্যাটা ১৩ হাজারে থেমে থাকল কেন? প্রতিদিন লোক বাড়ছে, প্রাইভেটকার বাড়ছে। অথচ অতিপ্রয়োজনীয় সিএনজি বৃদ্ধিই শুধু গলাটিপে ধরা হবে কেন? কেউ বলতে পারেন, এ শহরে শেষ সচ্ছল ব্যক্তিটিকে পর্যন্ত প্রাইভেটকার কিনতে বাধ্য করার জন্য এ ব্যবস্থা। কেউবা বলবেন, চাহিদা অনুসারে অটোরিকশা না ছেড়ে মানুষকে সংকটে ফেলতেই এ ব্যবস্থা। কেউ বলবেন, প্রাইভেট নামধারী পাবলিক সিএনজির রমরমা তৈরি করতেই এই নীতি। প্রাইভেটগুলোতে মিটার নেই। ভাড়া হাঁকে ইচ্ছামতো। তারও চেয়ে বড় কথা, ব্যক্তিগত কাজের জন্য কেনা এ যানটি অবৈধভাবে যাত্রী পরিবহন করে, যেটি কোনোভাবে মেনে নেওয়ার উপায় নেই। রোববারের ডেইলিস্টারে এই প্রাইভেট বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে জানা যাচ্ছে, প্রাইভেটগুলোর রমরমার পেছনে আছে উৎকোচ যোগ, আছে কিছু অসাধু কর্মকর্তার আশীর্বাদও। প্রাইভেট সিএনজি থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন করতে পারে না। বাণিজ্যিকভাবে পরিবহনের জন্য পাবলিক পরিবহনের সংখ্যাই বাড়াতে হবে। এজন্য ঢাকা শহরে ৫ হাজার নয়, অন্তত ২০ হাজার নতুন ট্যাক্সিক্যাব ও সিএনজি অটোরিকশা নামাতে হবে। আর বাধ্যতামূলকভাবে তাতে মিটার চালু করতে হবে। সিএনটি অটোরিকশা সুলভ হলে, প্রাইভেটকারের প্রয়োজন কমে যাবে। সেটি আখেরে শুভ ফল দেবে। আর সিএনজির মিটার চালু রাখতে হলে রাস্লায় ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব দিলেই শুধু চলবে না। যারা ৩-৪ লাখ টাকার সিএনজির দাম ১১ লাখে তোলেন তাদের ঠেকাতে হবে। রুট পারমিটজনিত উৎকোচে একটি সাধারণ পরিবহনের দাম ১১ লাখে ঠেকলে তাতে যে মিটার কায়েম করা যাবে না, তা বলাই বাহুল্য। আমাদের যোগাযোগমন্ত্রীর অনেক শুভ উদ্যোগ আছে। এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

Saturday, May 12, 2012

শান্তি

আমাদের কবি অনেক আগে অভিশাপ দিয়ে গেছেন, প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সঙ্গে ঠিকই কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না। কবির কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলছে বাংলাদেশে। প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে মিলন হলেও শান্তি মিলছে না। নির্বাচন হলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, গণতন্ত্র এলেও সরকারি সব কাজের কেন্দ্র হিসেবে সংসদ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। সংসদ বসলেও তিক্ত তর্কে অশান্তি বরং বাড়ছে। পথে বের হলে শান্তি নেই। ঘরে থাকলেও নেই। বেডরুম পাহারা দেওয়া যেমন অসম্ভব তেমনি রাস্তা পাহারা দেওয়া আরও অসম্ভব। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপারগতা বা অধিক পারঙ্গমতার সুযোগে চুরি-ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতি, গুম, খুন চলছে। অবশ্য বিগত আমলগুলোতে লোকে ভীষণ শান্তিতে ছিল তা বলা যাবে না। তখন যত্রতত্র বোমা ফাটার আশঙ্কা ছিল। গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ারও কম ছিল না। জানি না, যারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করেন পৃথিবীর নানা দেশে তাদের কাছে হয়তো আমাদের দেশ একটা যুদ্ধক্ষেত্রের মতোই। প্রবাস থেকে কেউ দেশে বেড়াতে এলে তিনি হয়তো সামান্য জ্যামযুদ্ধেই পরাজয় বরণ করে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে চান। শুধু জ্যামেই যুদ্ধ নয়, আমাদের জীবন সংগ্রামমুখর, নিত্যই আমরা জীবনযুদ্ধে শামিল। যদি রাজনীতির কথা ভাবি তবে সেখানে ঠাণ্ডা যুদ্ধ নয়, রীতিমতো উষ্ণ যুদ্ধের দেখাই মিলবে। কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে_ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। তো এই যুদ্ধের দেশে শান্তি পুরস্কার এসেছে। যেনতেন শান্তি পুরস্কার নয়, নোবেল শান্তি পুরস্কার। যথারীতি শান্তি পুরস্কার শান্তি আনতে পারেনি, বরং অশান্তিই বয়ে এনেছে। আমাদের মন্ত্রী প্রশ্ন রেখেছেন, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি কোন যুদ্ধে শান্তি এনেছেন। অবাক করার মতো প্রশ্ন বটে। আশপাশে তো কম যুদ্ধ চলছে না। এর যে কোনো একটিতে শান্তি আনলেই তো নোবেল শান্তি পুরস্কার জুটবার কথা। এর মধ্যে অনেকেই শান্তি আনার চেষ্টা করছেন। ফলে এ দেশে শান্তি পুরস্কার একটা কেন, দশটাও এসে যেতে পারে। আসাও উচিত। প্রফেসর ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালিয়েছেন, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছেন, বিশ্বের সামনে মডেল দিয়েছেন। এসবের কিছু না করে, এ দেশের চলমান যুদ্ধে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও তাকে নোবেল দেওয়া উচিত ছিল। দুই দলের মারামারিতে যোগ না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকা লোকদের পুরস্কৃত হওয়া উচিত। যারা এ সংঘাত মেটানোর সামান্য উদ্যোগ নিয়েছেন তাদেরও পুরস্কার প্রাপ্য। তেমন কিছু যে প্রফেসর ইউনূস করেননি তা নয়। তিনি বঙ্গরণাঙ্গনে শান্তি স্থাপনের জন্যও নোবেল পেতে পারতেন। ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি নোবেল কমিটি বাংলাদেশের চলমান যুদ্ধে তার অবদানের কথাও বলতে পারত। ড. ইউনূসের শান্তি পুরস্কার আবার যে অশান্তি সৃষ্টি করল তার পেছনে আছে হিলারি ক্লিনটনের সফর। এ সফরকে প্রথমে সফলতা হিসেবেই দেখা হচ্ছিল সরকারের তরফে। কিন্তু ক্রমেই খোলাসা হতে থাকে যতটা সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে, সফলতা তারও থেকে কিছুটা কম। এই বোধ থেকে মন্ত্রীরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। শুধু মুখ নয়, চশমা খুলে, চোখ খুলে তারা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, কঠোর সমালোচনায় অবতীর্ণ হচ্ছেন, খোলা মাঠে লড়াই করতে বলছেন। মানুষ ভেবেছিল, হিলারির সফরের পর শান্তি আসবে। অবস্থা বলছে, শান্তি নয়_ অশান্তিই আসছে। হিলারি অনেকের সঙ্গেই মিললেন; কিন্তু শান্তি এলো না, এলো না, এলো না। হিলারির পূর্বসূরিরা এ দেশে শান্তি স্থাপন করে দিয়ে গেছেন অতীতে। তাই হিলারির প্রতিও আমাদের আহ্বান, আপনি সামনের বার শান্তির বারতা নিয়ে আসুন। এই যুদ্ধক্ষেত্রে শান্তি স্থাপন করে নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করুন। নোবেল কমিটির কাছেও আমাদের আবেদন, এ দেশে শান্তি স্থাপনের ইস্যুকে যেন পুরস্কারের বিবেচনায় গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়। এছাড়া শান্তি স্থাপনের আর কোনো পথই খোলা নেই।

Friday, May 4, 2012

বইয়ের নতুন বাজার

২ মে কৌতূহলকর একটি খবর দিল গার্ডিয়ান পত্রিকা। যুক্তরাজ্যের পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের বরাতে তারা জানাল, ই-বুক বা ডিজিটাল বইয়ের বাজার বাড়ছে। এই বৃদ্ধির গতিটা কেমন তা জানলে রীতিমতো বিস্ময় জাগবে। ২০১১ সালেই ই-বুক বিক্রি বৃদ্ধির হার ৩৬৬%। ২৫০টি পাবলিশিং কোম্পানির সরবরাহকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা ইয়ারবুকে এ তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়েছে। ২০১১ সালে শুধু ফিকশন, নন-ফিকশন ও ছোটদের বইয়ের ই-ভার্সন বিক্রি হয়েছে ৯২ মিলিয়ন পাউন্ড। এই বিক্রি ছাপা কাগজের বইয়ের মোট বিক্রির ৬ শতাংশ। আর ওই বছরে ছাপা বইয়ের ৭ শতাংশ বিক্রি কমেছে। এখনও ব্রিটিশ পাঠকের পাঠ্যসূচিতে ছাপা বইয়েরই রমরমা। কিন্তু ই-বুক বিক্রির হারটা যেভাবে বাড়ছে তাতে ভবিষ্যতের বইয়ের বাজারের হাল কী দাঁড়াবে তা ভাবনার বিষয় বটে। ই-বুকের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। ১৯৪৬ সালে উল্লেখযোগ্য ই-বুক তৈরি হলেও, ই-বুকের বিকাশের সূচনা ধরতে হয় ১৯৭১ সালকেই। ওই বছর মাইকেল এস. হার্ট ই-বুকের উদ্যোগ প্রজেক্ট গুটেনবার্গ শুরু করেন। ফ্লপি-ডিস্ক, কমপ্যাক্ট ডিস্কে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ইন্টারনেট মাধ্যমেও ই-বুক জনপ্রিয় হতে থাকে। ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগে তৈরি হতে থাকে একের পর এক ই-বুক। আর সেগুলো পেঁৗছতে থাকে সারা পৃথিবীর পাঠকের হাতে। অনলাইনে ই-বুকের বিশাল সংগ্রহ গড়ে ওঠার পর ১৯৯২ সালে সনি বাজারজাত করে ই-বুক রিডার। আর ২০০০ সাল আসার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে আসতে থাকে বাহারি সব ই-বুক রিডার। অর্থাৎ পিসি অথবা ল্যাপটপেই যে ই-বুক পড়তে হবে না নয়। চলতি পথে ট্যাবলেট কম্পিউটার, ফোন, আইপ্যাড, ই-বুক রিডারে বই পড়ার ব্যবস্থা হয়েছে। পাঠকদের প্রয়োজন মতো ই-বুক রিডার তৈরি হচ্ছে, পাঠকরাও সেগুলো কিনছেন। ভারী বই বহন করার ঝক্কি নেই। একটা ছোট রিডারেই এঁটে যাচ্ছে শত শত বই। ঘরে রাখার সমস্যা নেই, ঘর বদলের সময় টানাটানির হ্যাপা নেই, বই সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সেই পরিশ্রম নেই। চাইলে কেনা যায়, মুফতেও পাওয়া যায়। রিডার খুলে যত্রতত্র পড়া যায়। বইয়ের সমান রিডারের এমন সুবিধায় পাঠকরা রিডারের দিকে ঝুঁকবেন তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে? তবে হা-হুতাশও কম নেই। ছাপা কাগজের বই হারিয়ে যাবে কি-না সে প্রশ্ন উঠছে। ছাপা কাগজের বই না থাকলে কী হবে? লেখাপড়ার চল উঠে যাবে? পাথরে লেখালেখির চল ছিল এককালে। পাথর উঠে গেছে বলে কি লেখাপড়ার চল হারিয়ে গেছে? তারও চেয়ে বড় কথা, বাস্তবতা। যুগ যেমন বইও হবে তেমন। যদিও বাংলাদেশে ই-বুক ততটা জনপ্রিয় নয়। তাতে অবশ্য বিস্ময়ের কিছু নেই। কেননা এখানে তো বই-ই জনপ্রিয় নয়। পড়ার লোকের বড় অভাব। তাই নতুন মডেলে আইফোন বের হলে ঢাকার বাজারে মুহূর্তেই চলে আসে। কিন্তু নতুন মডেলের কিন্ডেল চান, পাবেন না। কিন্তু এমন চলতে দেওয়া উচিত নয়। পাঠক বাড়াতে হবে, যে ছাপা কাগজের ঝক্কির মধ্যে যেতে চায় না, তার হাতে ই-বুক রিডারই তুলে দেওয়া হোক। ই-বুক তৈরি করে বিক্রি ও বিতরণের ব্যবস্থা হোক। অবশ্য অনলাইন উদ্যোগে বড় ফাঁড়াটা থাকতে সেটি ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। বাংলাদেশে অনলাইনে বসে কেউ কিনতেও পারে না, বেচতেও পারে না। দ্বার বন্ধ করে ব্যারিকেড দিয়ে বসে আছি আমরা। ফলে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সেখানে বই কেনা বা বেচার সামান্য দুঃখের কথার গুরুত্বই-বা কতটুকু?

Wednesday, May 2, 2012

কলাগাছ

কলার মতোই কলাগাছ নিয়েও বাংলায় নানা কথা প্রচলিত। তবে শিল্পের মতো কলাও এখানে দ্ব্যর্থবোধক। শিল্প বলতে এখানে আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি উভয়কে বোঝানো হয়। আবার কলা বলে ব্যানানা ও আর্ট দুটিকেই বোঝানো হয়। তাই আর্টকে এ দেশে বলা হয় শিল্পকলা। সমার্থক দুটি শব্দকে পাশাপাশি বসিয়ে দ্ব্যর্থকতা দমনের রীতিটি প্রশংসনীয়। কলা ও কলাগাছ বহুল আলোচিত হলেও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে কলা নিয়ে যে বিপুল আখ্যান তৈরি হয়েছে তা আমাদের দেশে ঘটেনি। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির দৌলতে লাতিন আমেরিকায় বিস্তর কলা আখ্যান তৈরি হয়েছিল। এই কোম্পানি সেখানে স্থাপন করেছিল কলার খামার। সে খামারগুলো থেকে সংগৃহীত কলা প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে আনা হতো বাহারি খাবার হিসেবে। খামারগুলো নিয়ে লাতিন আমেরিকার নানা দেশে তৈরি হয়েছিল আশা-হতাশা-দুঃখ-বিক্ষোভ। অনেক রক্তপাতের কারণও এই কলা চাষ। শেষ পর্যন্ত কলা হয়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক প্রতীক। লাতিন আমেরিকায় বিদেশি শক্তির অনুগত সরকার পরিচালিত দেশকে বলা হয় ব্যানানা রিপাবলিক। আমাদের ভাষায় অবশ্য দেশ বা সরকারকে কলা বিশেষণে অভিহিত করার মতো ঘটনা ঘটেনি। এ দেশে কেউ অবৈধ উপার্জন করে হঠাৎ বড়লোক হলে বলা হয় আঙুল ফুলে কলাগাছ। এ তো দুর্নীতির ব্যাপার। রাজনীতিতেও কলাগাছের উদাহরণ আছে। যেমন কোনো আসনে কোনো নেতা বা প্রতীকের রমরমা থাকলে বলা হয়, ওখানে অমুককে দাঁড় না করিয়ে একটা কলাগাছ দাঁড় করালেও জিতে আসবে। এই দুই উদাহরণে কলাগাছ কিছুটা অসম্মানিত হলেও প্রাচীন বাংলায় কলাগাছ কিন্তু সমৃদ্ধির প্রতীক। প্রবচনে আছে, কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত। কলা গাছ রোপণ করে পাতা কাটতে নিষেধ করা হয়েছে। এতে কলাগাছের ফলনক্ষমতা বাড়ে। আর ফলন বেশি হলে কলাই ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করবে। শুধু প্রাচীন বাংলা কেন, বর্তমান বাংলাতেও কলা-বাণিজ্যের রমরমা। তাই অনেক কৃষকই ক্ষেতে কলাচাষ করছেন। অনেক সময় ধান চাষ না করেও কলার চাষ করা হচ্ছে। কলার ফলন অনুসারে, দেশে উৎপাদিত কলা ততটা সুনাম অবশ্য অর্জন করেনি। এর কারণ পিটিয়ে ফল পাকানোর বাজে অভ্যাস। কলাগাছে কলা থাকলে একসময় পাকবেই। পাকার ঠিক আগে কলাগাছ কাটলেই ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু তা না করে ফল একেবারে কাঁচা থাকতেই গাছ থেকে কাটা হয়। অপরিপকস্ফ সে ফল রাস্তার ধারে মজুদ করা হয় শহরে পাঠানোর জন্য। শহরে এসে বা আসার পথে এ ফলে মেশানো হয় বিষাক্ত রাসায়নিক। উদ্দেশ্য জোর করে পাকানো। ফলে প্রাকৃতিকভাবে পরিপুষ্ট ও পাকা ফলের স্বাদ এতে মেলে না। এ কলা যেন কলা নামের কলঙ্ক। দুঃখের বিষয়, শুধু পাকানোর জন্যই না, ফল সংরক্ষণের জন্যও বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানোর রেওয়াজ আছে। এসব কারণে কলা যথেষ্ট দুর্নাম কুড়িয়েছে। লোকে এখন বাজারে ভালো কলা খোঁজেন হন্যে হয়ে। কিন্তু রাসায়নিক মেশানো কলার ভিড়ে ভালো কলা মেলা ভার। কলার মতো সুস্বাদু, দেশে উৎপাদিত সারা বছরের এমন একটি ফলের এমন দুরবস্থা নিয়ে কিছু করা উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে কলাগাছের মতোই।