Saturday, January 12, 2013

ঐতিহাসিক শীত

ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?' কবির ইচ্ছা_ শীতকাল এলে তিনি তিন মাস ঘুমিয়ে থাকবেন। শীতনিদ্রা যাপন করবেন, আলস্য যাপন করবেন ব্যাঙের মতো। আমাদের দেশ শীতপ্রধান নয়, বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাসের শীতেই এখানে জনজীবনে স্থবিরতা নেমে আসে। রাস্তাঘাটে ভিড় কমে যায়, সকাল ও সন্ধ্যায় ঘরের বাইরে চলাচল কমে যায়। শীত এখানে মূলত আলস্যপ্রধান ঋতু। শীতপ্রধান দেশগুলোর থেকে চিত্রটা একেবারেই আলাদা। যেখানে বছরভর শীত সেখানে লোকের আলাদা করে শীতের প্রস্তুতির দরকার পড়ে না। শীত উপলক্ষে জনজীবনে বিশেষ স্থবিরতাও নেমে আসে না। তুষারপাত, তুষারঝড়ে কিছু সমস্যা হয়। তাপমাত্র মাইনাসে নামতে নামতে এমন পর্যায়ে পেঁৗছায় যে বাধ্য হয়ে বাইরের কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মতো অল্প শীতে তারা কাতর হয় না। অবশ্য শীতে কাতর না হওয়ার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। শীতপ্রধান দেশগুলো শীতের হাত থেকে স্থায়ীভাবে বাঁচতে নানা ব্যবস্থা তৈরি করে নিয়েছে। তাদের অফিস, আদালত, বিপণি বিতান, বাড়িঘর, যানবাহন_ সবই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেমের বাইরে খুব কম সময়ই তাদের থাকতে হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের বিশেষ পরিচয় আছে কি? আতপ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। শীতকালে কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বন্ধই থাকে। অর্থাৎ শীত নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা তার জানা নেই। সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেমের কোনো উদাহরণ পাওয়া যায় না। ফলে স্বল্পকালীন শীত কোনোরকমে শীতের কাপড়ে পার করে দেওয়াই এখানে রেওয়াজ। শীত নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা এখানে বাস্তবসম্মতও হয়তো নয়। এ বছর শীত পড়েছে বেশ, কিন্তু গত কয়েক বছরে শীত ততটা পড়েনি। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বছরের কিছু সময় তীব্র শীত পড়ে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয় তাতে, শীতার্ত মানুষের মৃত্যুও ঘটে। কিন্তু অনেক স্থানে শীত এসেই বলে যাই। শীতের কাপড় নামাতে নামাতেই তুলে ফেলতে হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। তখন অনেকেই শীতে কবির মতোই উচ্চারণ করেছেন, শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা? এবার শীত একটু বেশিই পড়েছে। পত্রিকা বলছে এমন শীত গত চলি্লশ বছরে পড়েনি। সেদিক থেকে এ শীত ঐতিহাসিকও বটে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। লোকে শীতে কাতর হয়ে পড়েছে। বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। শীতের সময় শীতার্ত মানুষের কাছে শুধু শীতের কাপড় নয়, প্রয়োজনীয় খাবার পেঁৗছানোও জরুরি। কেননা, প্রবল শীতে শরীর দ্রুত তাপ হারাতে থাকে, প্রয়োজনীয় ক্যালরি তৈরি না হলে শরীর দুর্বল হতে হতে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। শীতের এই তীব্রতায় অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছে, এবার এমন শীত পড়ল কেন? কেউ কেউ বরফ পড়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করছেন। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় শীতের তীব্রতা। বিগত বছরগুলোতে শীত কম পড়ার পর প্রশ্ন উঠেছিল, কেন এমন হলো। তখনও বলা হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এসব ঘটছে। দুই ক্ষেত্রেই নিশ্চয়ই জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী। কিন্তু এমন শীত তো আমাদের দেশে নজিরবিহীন নয়, অতীতে যখন এমন শীত পড়েছে তখন এবার পড়তে দোষ কী? আমাদের সমুদ্র আছে, সমুদ্র থাকলেই জলোচ্ছ্বাস, ঝড়-তুফান থাকবে। একে মেনে নিয়েই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের শিয়রের কাছে হিমালয় পর্বতমালাও আছে। হিমালয়ের পাদদেশের সব দেশেই তো বরফ পড়ে। আমরা একটু দূরে বলে বরফের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি। তাই বলে শীত মেনে নিতে পারব না? শীত আমাদের জলবায়ুতে সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নাকি এ নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু করা দরকার, তা নিয়ে নিশ্চয় আবহাওয়াবিদরা কোনো নির্দেশনা দেবেন। আপাতত, নগদে আমরা শীতকেই পাচ্ছি। আসুন, আমরা শীত মেনে নেই। সাবধান থেকে একে উপভোগ করি। যারা কষ্টে আছেন খাবার ও বস্ত্র নিয়ে তাদের কাছে যাই।

Friday, January 4, 2013

অতিথি সৎকার

বাঙালি সম্পর্কে যেসব কথা প্রচলিত তার মধ্যে একটি হলো বাঙালির মতো অতিথিবৎসল জাতি খুঁজে পাওয়া ভার। বাঙালি কতটা অতিথিপ্রিয় তা নিয়ে নানা রসিকতাও প্রচলিত। বিশেষত কলকাতার বাঙালিদের অতিথিবাৎসল্য নিয়ে বাংলাদেশের বাঙালিরা প্রায়ই রঙ্গরস করেন। এই রঙ্গরস দেখে মনে হয় বিপুলসংখ্যক বাঙালি হয়তো ততটা অতিথিবৎসল নাও হতে পারেন। তবু অতিথিবৎসল বলে বাঙালির খ্যাতি। বাঙালির ভাষা অবশ্য তার অতিথিবাৎসল্যের পক্ষে যুক্তি দেয় না। ইংরেজি ভাষায় অতিথির প্রতিশব্দ গেস্ট, আর যিনি আতিথ্য দান করেন তার প্রতিশব্দ হোস্ট। মজার ব্যাপার, বাঙালির অভিধানে হোস্ট শব্দটির প্রতিশব্দ নেই। যিনি আতিথ্য দান করেন বললে ঘুরিয়ে বলা হয়। অনেকে আপ্যায়ক বলতে চান। কিন্তু হোস্ট শব্দটির সমার্থক কোনো একক বাংলা শব্দের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভার। তাহলে বাঙালির অতিথিবাৎসল্যের ভাষাগত প্রমাণ কী? একথা ঠিক, বাংলায় অনেক বিদেশি শব্দ ঢুকেছে। মজার ব্যাপার, গেস্ট শব্দটি যতটা সহজে ব্যবহৃত হয় তত সহজে হোস্ট শব্দটির ব্যবহার হতে দেখা যায় না। ফারসি থেকে বাংলায় এসেছে মেহমান। বাংলাভাষাভাষী মানুষরা মেহমান শব্দটিও বেশ ব্যবহার করেন। কিন্তু মেজবান অর্থাৎ হোস্ট শব্দটির ব্যবহার এ দেশে নেই। বাংলাদেশের অল্প কিছু অঞ্চলে মেজবান শব্দটির ব্যবহার আছে। কিন্তু ব্যাপক অর্থে মেজবান শব্দটি প্রচলিত হয়নি। তবে কি বাঙালি নিজেকে অতিথি হিসেবে দেখতেই পছন্দ করে, আতিথ্যদানকারী হিসেবে নয়? আর সে জন্যই কি ভাষায় এক কথায় প্রকাশযোগ্য কোনো শব্দই তারা তৈরি করেনি? এ নিয়ে নিশ্চয় সমাজতাত্তি্বক ও ভাষাতাত্তি্বকরা কিছু বলতে পারবেন। আপাতত অতিথি সেবা নিয়ে বাঙালির সংস্কৃতিই আমাদের আলোচ্য। অতিথি সেবায় বাঙালির কুকীর্তির তালিকা দীর্ঘ। যেসব মাইগ্রেটরি বার্ড শীতপ্রধান দেশ থেকে বাংলাদেশে আসে তাদের আদর করে বাঙালি অতিথি পাখি বলে ডাকে। মুসাফির পাখিগুলোকে অতিথি পাখি বলা হচ্ছে তা নিশ্চয় ভালো। কিন্তু আতিথ্য তো দিতে হবে। কিন্তু আতিথ্যের দিকে তেমন মন নেই বাঙালির। তারা অতিথি নিধনে ওস্তাদ। সম্প্রতি অতিথি নিধন ও সৎকারের নানা খবর দেখে মনে হয়, আতিথ্য ব্যাপারটাই এ দেশে দুর্লক্ষ্য। বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক অভিধানে সৎকার শব্দটির যেসব অর্থ দেওয়া আছে সেগুলো হলো সম্মান, সমাদর, খাতির সেবা। সৎকারের আরেক অর্থ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, মৃতদেহের শেষকৃত্য। বাঙালি সম্মান বা সমাদর অর্থে পাখির সৎকার করছে বলে মনে হয় না। তারা শেষকৃত্য অর্থেই সৎকার চালাচ্ছে। এমন ঘটলে যে অতিথি আসবে না তা বলাই বাহুল্য। ফলে বাঙালিকে আতিথ্যদানের রীতিটা রপ্ত করতে হবে। পাখিদের দিয়ে শুরু হোক, পরে মানুষের কথা ভাবা যাবে।