Sunday, May 23, 2010

সমকালের নিউজ কভারেজ : ভায়া টাইমস অব ইন্ডিয়া : ভারতে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ধ্বংস


টাইমস অব ইন্ডিয়ার শিরোনাম : সত্য হারিয়ে গেল?
মুক্তিযুদ্ধের দলিল খোয়া গেছে ভারতে
মাহবুব মোর্শেদ
রোববার সকালেই দুঃসংবাদটি জানালো ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া। কয়েক ঘণ্টা পত্রিকাটির ওয়েবসাইটে শীর্ষ সংবাদ হিসেবে জ্বলজ্বল করছিল 'সত্য হারিয়ে গেল? বাংলাদেশ যুদ্ধের অধিকাংশ সামরিক দলিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।' পত্রিকাটি জানাচ্ছে, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পগুলোর বিস্তারিত তথ্য খুঁজছিল। সাম্প্রতিক এ অনুসন্ধানের ফলে এ স্পর্শকাতর তথ্যটি জানাজানি হয়ে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানান, 'আমরা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পগুলোর বিস্তারিত তথ্য খুঁজছিলাম। এই ক্যাম্পগুলো কোথায় ছিল, কারা এগুলোর দায়িত্বে ছিলেন_ এ তথ্যগুলো জানতে চাচ্ছিলাম। ফাইলগুলো খুঁজে না পাওয়ায় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড একটি ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। এরপরই জানতে পারি, দলিলপত্রগুলো খোয়া গেছে।' পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সাবেক দুই প্রধানের মতে, সুপরিকল্পিতভাবেই এই দলিলপত্র ধ্বংস করা হতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ ছিলেন লে. জেনারেল এফ আর জ্যাকব। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা জেনারেল জ্যাকবের বই 'স্যারেন্ডার অ্যাট ঢাকা : বার্থ অব এ নেশন' এবং বিভিন্ন ভারতীয় সূত্র থেকে জানা যায়, তিনিই ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে শুরু হওয়া চূড়ান্ত যুদ্ধে ঢাকা বিজয়কে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। এ বিষয়ে তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম
মানেক শ'র দ্বিধা সত্ত্বেও তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। জেনারেল জ্যাকব ১৯৭৪ সালের আগস্টে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হন। জেনারেল জ্যাকব টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হওয়ায় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র চেয়ে পাঠান। তখন তাকে জানানো হয়, দলিলপত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তবে কে দলিল ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়ে থাকতে পারেন সে আলোচনা করতে তিনি রাজি হননি বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। তবে পত্রিকাটি বলছে, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সাবেক প্রধানদের সঙ্গে আলোচনার সূত্রে বোঝা যায়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই দলিলগুলো ধ্বংস করা হতে পারে। তখন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, যদি এটি সত্য হয় তবে তা হবে অরোরার ইমেজের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় ও পাকিস্তান বাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের নায়ক হিসেবে অরোরা বাংলাদেশ ও ভারতে বীর হিসেবে খ্যাত।
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। পত্রিকাটির অনলাইন পাঠকরা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এ-রকম একটি খবর প্রকাশের জন্য কেউ কেউ পত্রিকাটিকে বাহ্বা দিয়েছেন। কেউ বা প্রশ্ন করেছেন কেন ভারতীয় সেনাবাহিনী এরকম গুরুত্বপূর্ণ দলিল ধ্বংস করে দিল? কোনো স্পর্শকাতর সামরিক তথ্য কি তারা লুকাতে চেয়েছিল? বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো অনলাইন সংস্করণে টাইমস অব ইন্ডিয়ার বরাতে সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। 'কেন' এ প্রশ্নটি এখন সবার মুখে মুখে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া সন্দেহ পোষণ করে বলেছে, এসব দলিল হারিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হয়তো কখনো লেখা সম্ভব হবে না। ভারতের এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, ভারতের সেনাসদর ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সেনা দফতরেও কিছু দলিল থাকতে পারে। কিন্তু এগুলো থেকে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধের শুরু থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন, যোদ্ধাদের অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত যুদ্ধে নেতৃত্বদান পর্যন্ত অনেক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে ছিল পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের গুরুত্বপূর্ণ এসব অবদান গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকার করা হয়। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এ খবরটি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। তার মতে, ভারতে আর্কাইভাল ডকুমেন্ট সংগ্রহের শক্ত বিধান আছে। ফলে, হুট করে কোনো ডকুমেন্ট ধ্বংস করে দেওয়া সেখানে সম্ভব নয়। বলতে গেলে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একমাত্র বিজয়ের ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ঘটেছে। কেন তারা এমন একটি বিজয়ের দলিল ধ্বংস করবে, এ প্রশ্ন তুলেছেন মুনতাসীর মামুন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও এস ফোর্সের প্রধান, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ (অব.) বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা আমাদের সর্বতোভাবে উপকৃত করেছে এবং সেটি আমাদের স্বার্থেই হয়েছিল। আমরা পাকিস্তানিদের কাবু করে ফেললেও আমাদের বিমান শক্তি ছিল না, দূরপাল্লার অস্ত্রও ছিল না। ফলে, ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য অর্জন কঠিন হতো, আরও রক্ত ক্ষয়ের আশঙ্কা ছিল। জেনারেল শফিউল্লাহর মতে, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প বা প্রশিক্ষণ শিবির সংক্রান্ত তথ্য আমাদের কাছে সংরক্ষিত থাকার কথা। মুক্তিযুদ্ধের পর এ দলিলগুলো সেনা সদরে আনা হয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরেক সাবেক মেজর জেনারেল জানিয়েছেন, আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রয়োজনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সব প্রশিক্ষণ শিবিরের বিস্তারিত তথ্য আনা হয়েছিল। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী ও নেতাদের তালিকা তাতে আছে। মুক্তিযুদ্ধের অপারেশনাল ডকুমেন্টেশন মিলিটারি অপারেশন ডিরেক্টরিতে সংরক্ষিত আছে। পরবর্তীকালে এ ডকুমেন্টগুলো ঢাকা সেনানিবাসে স্থাপিত বিজয় কেতন জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। আশির দশকে পাওয়া প্রশিক্ষণ শিবির-সংক্রান্ত ডকুমেন্টগুলো ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সূত্রে পাওয়া গেছে কি-না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ডকুমেন্টগুলো দিলেও এগুলো পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সূত্রে পাওয়া গেছে কি-না তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
একজন সামরিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সামরিক দলিলপত্র নষ্ট করে দেওয়ার ঘটনা রহস্যময় বলেই মনে হচ্ছে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ ঘোষণার আগে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড অষোষিত যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছিল। অঘোষিত যুদ্ধের দলিলপত্র হয়তো তারা সংরক্ষণ করতে চাননি। ফলে, যুদ্ধের পর পরই দলিলপত্র নষ্ট করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। তবে, ভারতীয় সেনাবাহিনী যে ৩ ডিসেম্বরের আগেও অংশ নিয়েছিল তা এখন স্বীকৃত বিষয়। জেনারেল জ্যাকব তার বইয়ে এ সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি জানিয়েছেন অক্টোবরের শুরু থেকেই পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ এ প্রস্তুতির বড় অংশ হলেও সেনাবাহিনীতেও সমান্তরাল প্রস্তুতি চলছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মঈদুল হাসান তার 'মূলধারা: '৭১' বইয়ে অক্টোবর-নভেম্বরে এমন প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজিও তার 'দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান' বইয়ে লিখেছেন, ভারতীয় বাহিনী নভেম্বরেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের ভেতরে অভিযান পরিচালনা করেছে।
ইতিহাসের অনেক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তথ্যগুলো স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পরে এগুলো স্পর্শকাতর বলে বিবেচিত হতে পারে। আর এ কারণেই এগুলো ধ্বংস করা হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে, তিনি মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্যাবলী সযত্নে সংরক্ষণ করে এবং নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর সেগুলো প্রকাশ করে তেমন নীতি উপমহাদেশের দেশগুলোতেও অনুসৃত হওয়া উচিত। কারণ, একদিন মানুষকে প্রকৃত ইতিহাসের সামনে দাঁড়াতে হয়। ইতিহাসের পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ তথ্যগুলো বিচার না করলে প্রকৃত ইতিহাস রচনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এদিকে বিবিসির শুভজিত বাচ্চি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল অশোক মেহতার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। মেহতা বলেন, '৭১ সালের যুদ্ধে তিনি ভালোভাবে জড়িত ছিলেন। ওই নথিতে সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, সে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। ওই তথ্যগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। এই দলিল কেন বিনষ্ট করা হলো, সে ব্যাপারে জেনারেল মেহতা বলেন, পাকিস্তান সম্পর্ক ভবিষ্যতে প্রভাবিত হতে পারে, এ জন্য এসব দলিল বিনষ্ট করে ফেলা হয়। তিনি বলেন, এটা ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতিতে করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের তথ্য ধ্বংস করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কিছু জানে না বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম। তিনি গতকাল বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকালে এ মন্তব্য করেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য ধ্বংস করা হলেও ইতিহাস বিষয়ক কোনো তথ্য ধ্বংস করা হয়নি বলে তিনি মনে করেন। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করব।
তিনি বলেন, যদি এগুলো সত্যি ধ্বংস করা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
সমকাল


মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ধ্বংস ঘটনার তদন্ত দাবি ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ধ্বংস করার খবরে ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিজেপি, কংগ্রেস ও সিপিআই ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে। গত রোববার ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছিল, কলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কাছে রক্ষিত ১৯৭১ সালের যুদ্ধবিষয়ক ফাইলপত্র নষ্ট করা হয়েছে।
ভারতীয় জনতা দল বিজেপির মুখপাত্র রবি শংকর প্রসাদ দলিলপত্র হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম সুস্পষ্ট বিজয় অর্জন করেছিল ভারত। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার ঘটনা ভারতের
ইতিহাসের গৌরবজনক অধ্যায়। সে সময় ভারতের কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশল ছিল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বিজেপি দলিল নষ্ট হওয়ার ঘটনার সরেজমিন তদন্ত দাবি করেছে। দলিল কেন ধ্বংস করা হলো_ এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সরকারকে জনসমক্ষে হাজির হতে হবে।' অবশ্য ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি সামরিক বাহিনীর মনোভাবের সঙ্গে একই মত পোষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, কিছু দলিল প্রকাশিত হলে তা 'ক্ষতিকর' হতো।
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই) এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহকে উল্টে দেওয়ার জন্য এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হতে পারে।
অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির (এআইসিসি) মুখপাত্র শাকিল আহমেদ বলেছেন, 'এটি বিস্ময়কর একটি তথ্য। ভারতের মহান বিজয়ের ইতিহাসে এ দলিলগুলো মহামূল্যবান হিসেবে বিবেচিত। ১৯৭১ সালে ঢাকায় প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। দলিল হারানোর ঘটনা যদি সত্য হয় তবে সরকারের উচিত ঘটনা খতিয়ে দেখা এবং ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নেওয়া।'
দলিল খোয়া যাওয়ার এ ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সংরক্ষণ ও প্রকাশের ব্যাপারে সুস্পষ্ট আইনের প্রয়োজনীয়তা নতুন করে অনুভূত হচ্ছে বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। তারা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো ভারতেও ২৫-৩০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রকাশযোগ্য দলিল উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
উল্লেখ্য, ভারতে বেশ কিছু দিন ধরে তথ্য অধিকার নিয়ে আলোচনা চলছে। সেখানকার গণমাধ্যম ও নাগরিকরা তথ্য অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তারা মনে করেন, স্পর্শকাতর সামরিক তথ্য ছাড়া ইতিহাসের স্বার্থে ভারত-পাকিস্তান যুুদ্ধের সব তথ্য প্রকাশ করা উচিত। এর ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। ইতিহাসের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হয়। সামরিক নথিপত্র, যুদ্ধবিষয়ক তথ্যাবলির প্রকাশযোগ্য অংশগুলো অবমুক্ত করার জন্য ভারতে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। সে কমিটি '৬২, '৬৫ ও '৭১ সালের যুদ্ধের বিভিন্ন দলিল প্রকাশের পক্ষে মত দিলেও তা মানা হয়নি। ৩০ বছর পার হওয়ার পর নথিপত্র অবমুক্ত করার ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধা না থাকলেও সাম্প্রতিককালে ভারত কোনো দলিলপত্র অবমুক্ত করেনি বলে জানিয়েছে সেখানকার পত্রপত্রিকাগুলো।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান দলিলপত্র হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আবারও পুরনো ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন নথিপত্র প্রকাশের ব্যাপারে গণমাধ্যম ও নাগরিকদের দাবি সামনে চলে এসেছে।
সমকাল


১৯৭১ সালের নথিপত্র ধ্বংস একটি অপরাধ : ভারতের প্রধান তথ্য কমিশনার
মাহবুব মোর্শেদ
ভারতের প্রধান তথ্য কমিশনার ওয়াজাহাত হাবিবুল্লাহ বলেছেন, সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কাছে রক্ষিত ১৯৭১ সালের যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্যের ধ্বংস সাধন একটি অপরাধমূলক কাজ। এ ধরনের বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি এড়াতে নথিপত্র অবমুক্ত করার ব্যাপারে সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া।
বাংলাদেশ যুদ্ধের নথিপত্র ধ্বংসের ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে হাবিবুল্লাহ বলেন, 'এ বিষয়ে আইন খুব স্পষ্ট। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ২০ বছরের পুরনো সব নথিই প্রকাশ করতে হবে।' তিনি বলেন, আইনগত অনুমোদন ছাড়া কোনো নথির ধ্বংস সাধন অপরাধমূলক কাজ। 'ধ্বংস সাধনের জন্য আইন আছে।' তবে সে ক্ষেত্রে ধ্বংস করা দলিলপত্রের বিস্তারিত বিবরণ
সরকারের কাছে থাকতে হবে।
এদিকে সেনা সূত্রগুলো টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছে, ১৯৭১ সালের দলিলপত্র ধ্বংসের কোনো লিখিত অনুমোদন ছিল না।
প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বলেছেন, পুরো ঘটনাটির বিস্তারিত তদন্ত হওয়া উচিত। 'আমাদের জানানো উচিত_ কেন, কোথায় এগুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং তা কার স্বার্থে হয়েছে।'
কুলদীপ নায়ার ঢাকার সহযোগিতা নিয়ে পুরো দলিল দ্রুত পুনর্গঠন করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। যুদ্ধের সৈনিকদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার তাগিদও দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, 'এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দলিল।'
তিনি আরও বলেন, ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্ধের সংরক্ষিত দলিলগুলো প্রকাশ করার জন্য সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। তার ভাষায়, 'সরকার অযথাই কাগজের স্তূপের ওপর বসে আছে। ১৯৪৮, ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭১-এর নথিপত্র ছেড়ে দেওয়া উচিত। এমনকি ১৯৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের দলিলপত্রও আমাদের জাতীয় মহাফেজখানায় নেই।'
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দফতরেই ৩০ হাজার ফাইল বন্দি হয়ে আছে। এ ফাইলের অনেকটিই ভারতের সমান বয়সী। সরকারের দফতরগুলো এ নথিপত্র অবমুক্ত বা মহাফেজখানায় পাঠানোর ব্যাপারে গড়িমসি করে।
অতিরিক্ত গোপনীয়তার কারণে বিভিন্ন দফতরের স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থে নথিপত্র বেছে ধ্বংস বা নষ্ট করে দেওয়ার সুযোগ পায়। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সূত্র বলছে, ১৯৭১ সালের দলিলপত্র ধ্বংসের ঘটনাও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়।
আরেকটি প্রতিবেদনে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, বর্তমান ও সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন, মুক্তিবাহিনী গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত দলিলগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার ঘটনায় তারা বিস্মিত নন। কারণ এ দলিলগুলো প্রকাশিত হলে এটি বেরিয়ে আসত যে, ভারতীয় বাহিনী ডিসেম্বরের ঘোষিত যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা একজন সেনা কর্মকর্তা যিনি পরবর্তীকালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হয়েছিলেন তিনি বলেন, 'আমি দলিলপত্র ধ্বংসের ব্যাপারে জানি না। আমি তখন ক্যাপ্টেন ছিলাম। যদি এটি করা হয়, তবে সেটি সরকারের পরামর্শেই হয়েছে। ঘোষিত যুদ্ধের অনেক আগেই যে ভারতীয় সেনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে গিয়েছিল তা এখন সবার জানা বিষয়। সঙ্গত কারণেই সামরিক বাহিনী এ সম্পর্কিত দলিল সংরক্ষণ করতে চাইবে না।' ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সাবেক কর্নেলও বলেছেন, 'যুদ্ধ ঘোষণার অনেক আগেই ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনী সংগঠনের কাজে জড়িত হয়েছিল। ঘোষিত যুদ্ধের অনেক আগে আমি নিজে বাংলাদেশের ভেতরে ছিলাম।'


সমকাল



পাকিস্তানি সাবমেরিন ধ্বংসের তথ্য নথিপত্রও নষ্ট
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কাছে রক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক দলিলপত্র ধ্বংস করার খবরের পর এবার মিলেছে যুদ্ধে নৌবাহিনীর নথিপত্র ধ্বংস করার খবর। ধারণা করা হচ্ছে, গাজি ডুবিয়ে দেওয়া সংক্রান্ত দলিল নষ্ট করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের সূত্রে এ দুঃসংবাদটি বেরিয়ে এসেছে। গত রোববার টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ১৯৭১ সালের যুদ্ধের নথিপত্র ধ্বংসের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতের রাজনৈতিক দল, সরকার, সামরিক ও বেসামরিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়। বেরিয়ে আসতে থাকে নানা বিস্ময়কর তথ্য।
১৯৭১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রথম বড় বিজয় ছিল পাকিস্তানি সাবমেরিন গাজি ধ্বংস করা। ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সাবমেরিন গাজি ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘোষিত যুদ্ধের প্রথম দিনই, ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বিশাখাপত্তমের কাছে গাজি ডুবে যায়। মারা
যায় গাজির ৯২ জন ক্রু। ভারতীয় নৌবাহিনী দাবি করে, আইএনএস রাজপুত থেকে তীব্র গোলাবর্ষণের মাধ্যমে গাজির পতন ঘটানো হয়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণের কারণে অথবা বিশাখাপত্তম পোতাশ্রয়ে গাজি যে মাইনগুলো স্থাপন করেছিল তারই আকস্মিক বিস্ফোরণে গাজি ধ্বংস হয়।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার কাছে নৌবাহিনীর নানা সূত্র নিশ্চিত করেছে, তাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের সূত্র ধরে তারা এই গুরুতর সত্যে উপনীত হয়েছে যে, গাজি ধ্বংসের ফাইলগুলো নেই। গাজি
ধ্বংসের পর ভারতীয় নৌসেনারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু দলিলপত্র সাবমেরিনটি থেকে উদ্ধার করেছিল। সাবমেরিনটির ধ্বংসাবশেষ এখন বিশাখাপট্টনামের সমুদ্রের নিচে আছে।
ভাইস অ্যাডমিরাল হিরানন্দানি ভারতীয় নৌবাহিনীর দাফতরিক ইতিহাস লিখেছেন। ১৯৯৮ সালের ২২ জুন তখনকার পূর্বাঞ্চলীয় নৌকমান্ডের প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল কে মোহনরাও তাকে বলেন, 'বিভিন্ন অফিস ও সংস্থায় অনুসন্ধান চালানোর পরও আমি গাজি সংক্রান্ত দলিলপত্র পাইনি। অথচ এর আগে কাজ করার সময় সেগুলো আমি দেখেছি।'
মোহনরাও জানিয়েছিলেন, ডকুমেন্টগুলো পাওয়া গেলেই তা হিরানন্দানির কাছে পাঠানো হবে। কিন্তু মোহনরাও কমোডর পিএস বাওয়ার একটি চিঠির বিষয়ে কিছু বলেননি হিরানন্দানিকে। এই চিঠি বাওয়া ১৯৮০ সালে লিখেছিলেন। ১৯৮০ সালের ২০ ডিসেম্বর বাওয়া লিখেছিলেন, 'ভয়াবহ ব্যাপার হলো বীরবাহুতে আমি গিয়ে জেনেছি গাজি সংক্রান্ত দলিল, সিগন্যাল ও গাজির বিভিন্ন সামগ্রী এ বছরই ধ্বংস করা হয়েছে। এখন সেখানে আর কিছুই নেই।' বিশাখাপট্টনামের বীরবাহুতে গাজি সংক্রান্ত দলিলপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তিনি এই চিঠি নৌবাহিনীর সদর দফতরের চিফ অব পার্সোনেল এমপি আওয়াতিকে লিখেছিলেন।
শেষ পর্যন্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর কোনো দাফতরিক ইতিহাস প্রণেতাই গাজির ফাইলপত্র হাতে পাননি। ১৯৭১ সালে নৌবাহিনীতে যুক্ত এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, গাজির দলিলপত্র থেকে শুরু করে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের ফাইলপত্র হারানোর সব ঘটনাই যুদ্ধের ইতিহাসকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ধারাবাহিকতায় হয়েছে। অথচ এটাই ছিল ইতিহাসের ঘটনাবলিকে জনসমক্ষে আনার সবচেয়ে ভালো সময়।

সমকাল

Saturday, May 22, 2010

ক্লিওপেট্রা অত সুন্দর ছিলেন না!


উইলিয়াম শেক্সপিয়র তার সৌন্দর্য প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'বয়স তাকে বাঁধতে পারে না, প্রথাও তার অনিঃশেষ রূপমাধুরীকে ম্লান করতে পারে না।' চসার তার তুলনা করেছেন, মে মাসের গোলাপের সঙ্গে। মিকেল অ্যাঞ্জেলো থেকে শুরু করে বিশ্বখ্যাত চিত্রকররা তাকে এঁকেছেন ভয়ঙ্কর সুন্দর হিসেবে। এখনও শিল্পীরা কল্পনার ক্লিওপেট্রা আঁকেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। পৃথিবী বিখ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন, এলিজাবেথ টেলর থেকে শুরু করে বহু দেশের বহু সুন্দরী অভিনেত্রীই তার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। কবি ও শিল্পীর কল্পনায় ক্লিওপেট্রা হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের অন্যতম সুন্দরী। কিন্তু কেউ যদি বলে, যেমন ভাবা হয় তেমন সুন্দর ছিলেন না ক্লিওপেট্রা! আর নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তিতর্ক হাজির করেন? এমনই কাণ্ড ঘটিয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। ওয়েবসাইটে সম্প্রতি তারা একটি অডিও প্রকাশ করেছে। অডিওতে তারা জানাচ্ছে, কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের একজন কিওরেটর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন, আধুনিককালে আমরা যাকে সুন্দর বলি সে অর্থে সুন্দর ছিলেন না ক্লিওপেট্রা। তাহলে কেমন ছিলেন ক্লিওপেট্রা? প্রত্নতাত্তি্বকরা বলছেন, তিনি ছিলেন মোটাসোটা, বেঢপ কাপড়-চোপড় পরিহিত নারী। নাক ছিল মোটা আর ঝোলানো, দাঁত ছিল নষ্ট, চোখ ছিল তীক্ষষ্ট আর গলা ছিল ছড়ানো। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক জানাচ্ছে, যখন এ গবেষণার কথা সবাইকে জানানো হয়েছিল, তখন সারাবিশ্বের পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ক্লিওপেট্রার এই রূপের কথা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী? ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক জানাচ্ছে এক নতুন খবর, এতসব জানাজানি হওয়ার পরও ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। তাকে নিয়ে মানুষের কল্পনা যেন বাগ মানতে চাইছে না। এখনও তিনি শিল্প আর ফ্যাশনের রানী। ক্লিওপেট্রা এখনও উজ্জ্বল, ত্রূক্রর এবং অবশ্যই মোহনীয় নারী।
কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কিওরেটর ক্লিওপেট্রার রাজকীয় স্ট্যাচু এবং মুদ্রায় ছাপাঙ্কিত তার ছবি বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছিলেন, রানীর এই সৌন্দর্যহীনতার কথা। খ্রিস্টপূর্ব ৩২ অব্দের এক রৌপ্য মুদ্রায় ক্লিওপেট্রার ছবি বিশ্লেষণ করেছেন প্রত্নতাত্তি্বকরা। মুদ্রার এক পাশে মার্ক অ্যান্টনির ছবি, অন্যপাশে ক্লিওপেট্রার। রোমান জেনারেল ও রাজনীতিক মার্ক অ্যান্টনি তার দীর্ঘকালীন প্রেমিক ছিলেন। অ্যান্টনিই এ মুদ্রার উদ্যোক্তা। ফলে আধুনিককালে যে ক্লিওপেট্রার দেখা আমরা পাই তা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা বলেই মনে হয়। নিউক্যাসেল ইউনিভার্সিটির প্রত্নতাত্তি্বক মিউজিয়ামের পরিচালক বলেছেন, 'রোমান লেখকরা ক্লিওপেট্রার প্রজ্ঞা ও ক্যারিশমার কথা বলেছেন। বলেছেন, তার কণ্ঠস্বর ছিল মোহনীয়।' কিন্তু লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হলো, কেউই তার সৌন্দর্য বিষয়ে কিছু বলেননি। ক্লিওপেট্রার রমণীয় ও মোহনীয় ইমেজটা অতিসাম্প্রতিককালের নির্মাণ বলেই মনে হয়। বলা হচ্ছে, মার্ক অ্যান্টনি সম্ভবত তার প্রজ্ঞার প্রেমে পড়েছিলেন। আর সেটিই ছিল ক্লিওপেট্রার আসল সৌন্দর্য। ক্লিওপেট্রা ছিলেন মিসরের শেষ ফারাও। তার সময়েই মিসর রোমানদের অধীনে একটি প্রদেশে পরিণত হয়। তিনি মিসরের টলেমি ডাইনেস্টির সদস্য ছিলেন। প্রথমে তিনি পিতা ও ভাইদের সঙ্গে যৌথভাবে দেশ শাসন করেন। পরে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর হন। এবং জুলিয়াস সিজারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে নিজের ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করেন। বলা হয়ে থাকে, রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিলেন ক্লিওপেট্রা। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ অব্দে তিনি রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারকে কাবু করেন। সিজারের এক সন্তানের মা হন। পরে মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে ঘর বাঁধেন এবং তিন সন্তানের মা হন। শেষ পর্যন্ত অক্টাভিয়ানের সঙ্গে যুদ্ধে অ্যান্টনির পরাজয়ের পর ৩১ খিস্টপূর্বাব্দে অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা দু'জনেই আত্মহত্যা করেন। ক্লিওপেট্রা মিসরীয় কোবরা এসপের দংশন খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। ক্লিওপেট্রা রহসময়ী, তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে বহু মিথ, নাটক, কবিতা, গান, চিত্র, চলচ্চিত্র। তিনি বহু মানুষের প্রিয়। তিনি দুটি সভ্যতার মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন অপরিসীম বুদ্ধিমত্তা আর কর্মতৎপরতা দিয়ে। বুদ্ধিই তার সৌন্দর্য। কিন্তু মানুষ তার শারীরিক সৌন্দর্যকেই এতকাল তার শক্তি ভেবে এসেছে। প্রত্নতাত্তি্বকদের ভুল ভাঙানোয় তাই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বরং এখানেই আশাবাদের শুরু।

Sunday, May 16, 2010

সাদা সাদা আরও সাদা


ছোটবেলায় স্কুল পাঠ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি আপ্তবাক্যের ব্যাখ্যা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের করতে হয়। বাক্যটি হলো, 'অর্থই অনর্থের মূল।' এই অর্থ মিনিং বা মানে নয়, এই অর্থ হলো মুদ্রা বা টাকা। ছোটবেলায় অর্থকে অনর্থের মূল জানলেও ক্রমেই শিক্ষার্থীরা এ বিদ্যা অর্জন করতে পারে যে, টাকা জগতের অন্যতম আরাধ্য। লেখাপড়া করে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার সৌভাগ্য হয় এ-ও স্কুল পাঠ্যেরই শিক্ষা। গাড়ি-ঘোড়ায় চড়তে টাকা প্রয়োজন, একথা ছোটরা বুঝতে না পারলেও বড়রা বেশ ভালো করে বোঝেন। ফলে বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থাকে বড়রা এমনভাবে সাজিয়েছেন যে, এর মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে টাকা উপার্জন। অভিযোগ আছে, আমাদের বিদ্যায়তনে নৈতিক শিক্ষাকে অনেক নূ্যনতম গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে আমাদের প্রজন্মগুলো নৈতিক, মানবিক ও সামাজিক দায়িত্বের শিক্ষা ছাড়াই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। এমনকি ছাত্রাবস্থাতেই তারা টাকা উপার্জনের জন্য মূলধারার রাজনীতি ও রাজনীতির উপসর্গ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, দুর্বৃত্তপনায় হাত পাকিয়ে তুলছে। ফলে অর্থের অনর্থ উপলব্ধির আগেই কিংবা টাকার রঙ বোঝার আগেই তারা টাকা উপার্জন করে টাকার শক্তি ও প্রতিপত্তি উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। সম্প্রতি টাকার সাদা, টাকার কালো নিয়ে এক প্রস্থ তর্ক হয়ে গেল আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে। কেউ বলতে পারেন, খারাপ টাকাকে কালো বলা বর্ণবাদী ব্যাপার। সাদা মানে ভালো আর কালো মানে খারাপ_ এ ধারণা থেকে বের হতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আপাতত বিতর্কটি তোলা থাকুক। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে কালো টাকার গ্রহণযোগ্য একটা নামও আবিষ্কৃত হয়ে যাবে। সরকারি দলের একজন নেতার অভিযোগ, বিরোধীদলীয় নেত্রী কালো টাকা সাদা করেছেন। খবর নতুন নয়, বিস্ময়করও নয়। আমাদের রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলাদের অনেকেই কালো টাকাকে সাদা করেছেন। বৈধভাবে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা আমাদের আছে। তারপরও লোকে কালো টাকা কালোই রাখেন। সাদা করে ঝামেলা বাড়াতে চান না। কিন্তু অর্থনীতিতে কালো টাকা সাদা করাটাকে ভালো চোখেই দেখা হয়। ফলে বিরোধীদলীয় নেত্রী কালোকে সাদা করলে সেটি ভালোই করেছেন। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এক বিরোধীদলীয় নেতা বললেন, নেত্রী সাদা টাকাকেই সাদা করেছেন। এখানেই তর্কের সূত্রপাত। সাদাকে সাদা করার দরকার পড়ে না। তবে তিনি কেন করলেন? মনে পড়ল, জনপ্রিয় অভিনেতা রিয়াজের সেই দেশব্যাপী বিজ্ঞাপনী অভিযানের কথা। সার্ফ এক্সেল ব্যবহার করে দেশের লোকেরা সাদাকে আরও কত সাদা করে তুলছেন তা দেখতে রিয়াজ দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরছেন সাদা মাপার যন্ত্র সঙ্গে নিয়ে। দেখাচ্ছেন, এক সাদার চেয়ে আরেক সাদা কত সাদা। হয়তো বিরোধীদলীয় নেতা তেমনি আরও সাদার কথা বোঝাচ্ছেন। বলা হয়ে থাকে, আমাদের অর্থনীতিতে নাকি সাদার চেয়ে কালো বেশি। কালো টাকা বন্ধ হলে নাকি অর্থনীতি থমকে যাবে। এমন এক পরিস্থিতিতে সাদাকে আরও সাদা করার উদ্যোগ নিশ্চয়ই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু সত্যিই কি সাদাকে সাদা করার কোনো উদ্যোগ কখনও চালু হয়েছিল দেশে? ভাবতে হবে। তবে হ্যাঁ, সব কালো তো একই রকম কালো নয়। রোজগারের টাকা থেকে কেউ যদি আয়কর না দেন তবে সেই টাকাও যেমন কালো টাকা হিসেবে গণ্য হয়, তেমনি উৎকোচের টাকাও কালো টাকা আবার লুটের টাকাও কালো টাকা। কোন কালো সবচেয়ে বেশি কালো সেটি নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলবে। বিরোধীদলীয় নেত্রী কালো টাকাকে সাদা করেছেন, নাকি অল্প সাদাকে সাদা করেছেন_ সে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ব্যাংক বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডই ভালো বলতে পারবে। তবে তর্কটা রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির ব্যাপারই এখন পর্যন্ত। এর পেছনে কারও কোনো সৎ উদ্দেশ্য দেখা যাচ্ছে না। যদি সৎ উদ্দেশ্য থাকত, তবে কে কবে টাকা সাদা করেছেন সে প্রশ্নের চেয়ে অন্য প্রশ্ন উঠত বেশি করে। তা হলো, সরকারদলীয় মন্ত্রী, এমপি, বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব স্পষ্ট করে জনগণের সামনে হাজির করত। মেয়াদ শেষে আবার আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়েই প্রস্থান করত। সেসব এ দেশে দূর ভবিষ্যতে হবে কি-না জানি না_ তবে এমন হাস্যকর বিতর্ক যে আরও হবে তা বলাই বাহুল্য।

Thursday, May 13, 2010

এ জার্নি বাই ছাদ!


ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ নিশ্চয়ই এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি তৈরি করে। অ্যাডভেঞ্চার, রুদ্ধশ্বাস ভ্রমণের নাম ট্রেনের ছাদ। এ কারণে মুম্বাইর অ্যাকশন ছবিগুলোতে প্রায়ই দ্রুতগতিতে ছুটে চলা ট্রেনের ছাদে নায়ক আর ভিলেনকে মারপিট করতে দেখা যায়। পুরনো দিনের ছবিতে ট্রেনের ছাদে মারপিট পরিচিত দৃশ্য ছিল। নতুন ছবিগুলোও কম যায় না। হালের ধুম-টুতেও দেখা গেল এমন মারপিটের দৃশ্য। শুধু মুম্বাইর ছবি কেন বাংলাদেশের ছবিতেও ট্রেনের ছাদে মারপিটের দৃশ্য বেশ পরিচিত। তবে ট্রেনের ছাদের সবচেয়ে আকর্ষক দৃশ্য বোধহয় ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া 'দিল সে' সিনেমার সেই 'ছাইয়া ছাইয়া' গানটি। শাহরুখ খান ও মালাইকা অ্যারোরা একদল নারী-পুরুষ সঙ্গে করে পুরো একটি গানের দৃশ্যায়ন করেছেন চলন্ত ট্রেনের ছাদে উঠে। বলতে গেলে চলন্ত ট্রেনের ছাদে দৃশ্যায়িত এ গানটি রোমাঞ্চকর ভ্রমণের এক প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এআর রহমানের সুরের এ গান ভারত বাংলাদেশ তো বটেই, বিবিসির টপ চার্টেও উঠেছিল। আর এর প্রভাব এতটাই বিস্তৃত হয়েছিল যে হলিউডের পরিচালক স্পাইক লির সিনেমা ইনসাইড ম্যানে ছাইয়া ছাইয়া গানটি টাইটেল সং হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের এমন সব ফিল্মি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেল ৬ মে ২০১০ তারিখে বিবিসি ওয়েবসাইটের একটি সংবাদ পড়ে। সংবাদটি অবশ্য রোমাঞ্চের নয়, দুঃখজনক। বিবিসিতে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হলেও সংবাদটি দেশীয় সংবাদমাধ্যমের চোখ এড়িয়ে গিয়ে থাকবে কোনো কারণে। সেবামূলক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেন সূত্রে বিবিসি জানাচ্ছে, বাংলাদেশে বহু শিশু-কিশোর ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করে। অনেক সময় শিশুরা স্রেফ মজা করার জন্য কিংবা রোমাঞ্চকর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য ট্রেনের ছাদে উঠে পড়ে। কিন্তু রোমাঞ্চই শেষ কথা নয়। বাংলাদেশে যাত্রীর তুলনায় ট্রেনের সংখ্যা অপ্রতুল। ফলে সপ্তাহ শেষে যখন মানুষ বাড়ি ফেরে তখন মালপত্র নিয়ে শিশু-কিশোরদের ছাদেই তুলে দেওয়া হয়। অনেক সময় নিম্ন আয়ের মানুষেরা পুরো পরিবার নিয়েই ছাদে চড়ে বসে। এছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকে না। ছাদে ভ্রমণের ফলে একদিকে যেমন টাকা বাঁচে, অন্যদিকে ভিড় থেকে মুক্তি মেলে। কোনো ঈদ-উৎসবে বাড়ি ফেরার প্রসঙ্গ এলে তো কথাই নেই। বহু শিশু-কিশোর ও বয়স্ক মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ সময় ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করে। সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, এভাবে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের মাধ্যমে শিশুদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময়ই শিশুরা ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে বা কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অনেক সময় খোলা ইলেকট্রিক তারে লেগে গিয়েও করুণ মৃত্যুবরণ করেছে শিশুরা। সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে ট্রেনের ছাদে শিশুদের ভ্রমণ বন্ধ করার আবেদন জানিয়েছে। সরকার বলছে, একমাত্র ট্রেন কোম্পানিগুলোই পারে ছাদে শিশুদের ভ্রমণ বন্ধ করতে। তাদের মতে, রেলের লোকজনই এগুলো বন্ধ করতে পারে। কিন্তু এটি বন্ধ করা কঠিন। কারণ এটি ঝামেলার কাজ।
সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, পুরো বাংলাদেশেই শিশুদের ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করতে দেখা যায়। সেভ দ্য চিলড্রেন এমন নানা বিপদ থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা শিশুর পরিবারকে কাজে সুযোগ করে দিয়ে শিশুর স্কুলে ফেরার পথের বাধা দূর করে। প্রশ্ন হলো, সেভ দ্য চিলড্রেনের এমন আহ্বানের পরও কি ট্রেনের ছাদে এমন আনন্দময় মৃত্যুভ্রমণ বন্ধ হবে?

Wednesday, May 5, 2010

সেলিম আল দীনের শাপলা, মহুয়া আর মুনিয়া পাখিগুলো


তলস্তয় নাকি নিজের সম্পর্কে বলতেন, এই যে মানুষগুলো দেখছ এরা আমার। চারপাশের বিল-ঝিল, ক্ষেত-খামার দেখছ, এগুলো আমার। এমনকি জানালার ধারে যে দোয়েল পাখিটিকে দেখছ সেও আমার।
রাশিয়ার তুলা অঞ্চলে ইয়াস্নাইয়া পলিয়ানায় জন্ম হয়েছিল লেভ নিকোলাইয়েভিচ তলস্তয়ের। তিনি ছিলেন সামন্তপ্রভু। জমিদার হিসেবে তার অধিকারে একটি এলাকা ছিল। ভূমিদাস, বিল-ঝিল, ক্ষেত-খামারের অধিকারও নিশ্চয় তারই ছিল। কিন্তু জানালার ধারে বসে থাকা স্বাধীন দোয়েল পাখিটির মালিকানা যখন তিনি দাবি করে বসেন, তখনই থমকে দাঁড়াতে হয়_ ভাবতে হয় এ তো তাহলে শিল্পীর কথা, জমিদারের নয়। যে শিল্পী সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, গল্পকার হিসেবে স্বীকৃত, যিনি মানবজীবনের এমন সব আখ্যান রচনা করেছেন, যার সামনে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে থমকে দাঁড়াতে হয় তার এমন অধিকারবোধে হয়তো ক্ষুণ্ন হবেন না অনেকেই। কিন্তু একালে যদি কেউ মুনিয়া পাখির দখল দাবি করে বসেন? যদি বিলে ফোটা শাপলার স্বত্বাধিকার দাবি করে বসেন? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে সেলিম আল দীনের সঙ্গে কেটেছিল আমাদের অনেক সময়। নাটক ও নাট্যতত্ত্বের শিক্ষক ছিলেন তিনি। আমরা অন্য বিষয়ে পড়তাম। কিন্তু ক্যাম্পাসে কেউ সাহিত্যচর্চা করলে তিনি সহজে এই অধ্যাপক ও নাট্যকারের ছাত্রত্ব নিতে পারতেন। তার সঙ্গে অবাধ আড্ডা, আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের সুযোগ মিলত।
সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, এ আড্ডাগুলো স্রেফ আড্ডা ছিল না। সেলিম আল দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যের বাইরে আরেক সমান্তরাল বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের পথে-প্রান্তরে। সেখানে তরুণ সাহিত্যিক, শিল্পী, কবিদের শিক্ষক, অগ্রজ হিসেবে তিনি শিক্ষা ও সঙ্গ দিতেন। খুব সচেতনভাবে চলত না এই সমান্তরাল শিক্ষায়তন, অবচেতনে_ সবার জানাশোনার বাইরে এই আড্ডাগুলোতে সমবেত হতেন তরুণ সাহিত্যিক-কবিরা। তারা নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠতেন, আবার সেলিম আল দীনের কাছ থেকেও শিখতেন। শুধু জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থী নন, ঢাকার তরুণরাও বঞ্চিত হননি এসব আড্ডা-আলোচনা থেকে।
রবীন্দ্রনাথ, তলস্তয়ের মতো বড় সাহিত্যিকদের সেলিম আল দীন বলতেন, অমরগণ। অমরদের শিল্প ও জীবনাদর্শ অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। মাঝে মধ্যে বলতেন_ এ রকম বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ঢাকা থেকে দূরে প্রশান্ত প্রকৃতির এক জনপদে শান্তিনিকেতনের মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বপ্নের কথা। সেখানে ক্লাস হবে গাছের তলায়, দেশ-বিদেশের সাহিত্যিক, শিল্পীরা পড়াতে আসবেন। লেখকরা লিখবেন, শিল্পীরা আঁকবেন সেখানে বসে। এসব স্বপ্নের কাছে পেঁৗছাবার অনেক আগে ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তার মৃত্যু হলো। মৃত্যুর পর তার সাহিত্য নিয়ে পাঠকমহলে নতুন কৌতূহল জন্মেছে। বাংলা নাটকে তার অবদান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মূল্যায়নের এ আয়োজনগুলো চলতে থাকবে এ আশা করা যায়। পাশাপাশি তার শিক্ষকতা জীবন নিয়ে, জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীদের প্রভাব নিয়েও বিস্তর আলাপ হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগরে মহুয়া ফুল ফোটার উৎসব হলে, সেলিম আল দীনের কথাই সবার আগে মনে পড়ে। কারণ উৎসবটি তিনি চালু করেছিলেন। তিনিই খবর রাখতেন জাহাঙ্গীরনগরে ক'টা মহুয়া গাছ আছে। বসন্তে কোন গাছে ফুল ফুটবে আর কোন গাছের নিচে আলো জ্বালিয়ে ফুল ফোটার উৎসব পালন করা হবে। বর্ষায় শিরীষের গাছে ফুল ফুটলে তিনি আমাদের শিরীষের তলায় নিয়ে গিয়ে ফুলের ঘ্রাণ নিতে বলতেন। কোথাও লেবু ফুল ফুটে তীব্র গন্ধ ছড়ালে তার সান্ধ্যভ্রমণের গতি স্লথ হয়ে আসত। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, বলো, এ কোন ফুলের ঘ্রাণ! ঘাসে ঘাসে পা ফেলে এমন অনেক প্রাকৃতিক সন্ধ্যা-সকাল আমাদের কেটেছে। প্রকৃতিপ্রেমিক ছিলেন খুব। উপভোগকে তিনি বলতেন, আস্বাদন বা সম্ভোগ। চারপাশের সৌন্দর্যকে সম্ভোগ করার এক মানবিক আর্তি ছিল তার মধ্যে। শিল্পীর জন্য এসব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু একদিন তিনি হঠাৎ জাহাঙ্গীরনগরের জঙ্গলে বসবাসরত মুনিয়া পাখিগুলোর স্বত্ব দাবি করে বসলে খুব অবাক হলাম। বললেন, আগে জাহাঙ্গীরনগরে কোনো মুনিয়া পাখি ছিল না। তিনি মানিকগঞ্জ থেকে দুই জোড়া মুনিয়া পাখি এনে ছেড়ে দিয়েছিলেন জঙ্গলে। সেগুলোই এখন জাহাঙ্গীরনগরে বংশবিস্তার করে অনেক পাখিতে পরিণত হয়েছে। আমরা একটু অবিশ্বাসের সঙ্গে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। এক সকালে জাহাঙ্গীরনগরের লেকে অসংখ্য লাল শাপলা ফুটতে দেখে আমরা যখন বিস্মিত তখন তিনি বলেছিলেন, এ শাপলাগুলোও তার। আগে জাহাঙ্গীরনগরের লেকে শাপলা ফুটত না। তিনি চাঁদপুর থেকে শাপলা এনে লেকের পানিতে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেগুলোই এখন লেকে লেকে ছড়িয়ে শত পুষ্প ফোটাচ্ছে। তার দাবি নিয়ে আমরা খুব মজা করতাম। কিন্তু কখনও কোনো বিষণ্ন মুহূর্তে মনে হতো, এমন যার প্রকৃতিপ্রেম তার জন্যই হয়তো শাপলা ফোটে, মহুয়া গন্ধ ছড়ায়, মুনিয়া পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায়। তার জন্যই হয়তো তলস্তয়ের দেশ সাইবেরিয়া থেকে পাখিরা উড়ে এসে জাহাঙ্গীরনগরের লেকে বসে থাকে। সেলিম আল দীনের মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণ করতে গিয়ে শাপলা আর মুনিয়া পাখির জন্য তার দাবির কথা মনে হলো। মনে হলো, তলস্তয়ও একদিন বলেছিলেন, জানালার ধারে বসে থাকা দোয়েল পাখিটি তার।

বিমানবন্দর বিভ্রাট


লালন সাঁইয়ের গোষ্ঠ গানে শ্রীকৃষ্ণ মাকে বলছেন, গোষ্ঠে আর যাব না মা। কারণ কী? দাদা বলরামের সঙ্গে গরুর পাল নিয়ে গোষ্ঠে যায় রাখাল বালকেরা, সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ যান। কিন্তু গোষ্ঠে গেলে দাদা বলরাম তাকে মারে। কৃষ্ণ মায়ের কাছে তাই বিচার দিচ্ছেন, বলাই দাদার প্রাণে দয়া নেই বলে কৃষ্ণ কানাইয়া মার কাছে আবদার করেছেন যে আর গোষ্ঠে যাবেন না। কিছুদিন আগে আমেরিকার এক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা হুজ্জতির শিকার হয়ে বলিউডের নায়ক শাহরুখ খানও বলেছিলেন, আমেরিকায় আর যাবেন না। বিমানবন্দরের রাখালেরা তাকে ধরে জেরা করেছে, আটকে রেখেছে আর কত কি-না হয়েছে। আমজনতার জন্য এ না হয় নিত্যকার ব্যাপার কিন্তু শাহরুখ তা সইবেন কেন? তাই অভিমান করে তিনি বলেছেন, এ রকম হলে আর আমেরিকায় যাবেন না। কিন্তু একালে আমেরিকায় না গেলে কি চলে? আর কারও চলুক না চলুক শাহরুখ খানদের চলবে না তা বলাবাহুল্য। শুধু শাহরুখ নন, তার আগে ভারতের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামকেও আমেরিকার বিমানবন্দরে নানা হুজ্জতি পোহাতে হয়েছিল। ভারতের মতো দেশের রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, সেলিব্রেটি হওয়ার পরও কেন এই ভোগান্তি? আমেরিকার নিরাপত্তা কর্মীরা বলবেন, এ তো রুটিনওয়ার্ক। কিন্তু বাঁকাদৃষ্টির লোকেরা বলেন, মুসলিম না হলে এমন হতো না। ভারতীয় নাগরিকদের জন্য হয়তো কিছু রেয়াত দেন নিরাপত্তা কর্মীরা। কিন্তু কিছু দেশ একেবারে কালো তালিকায়। তাদের নাগরিকরা বিমানবন্দরে কেমন বিপত্তিতে পড়েন তা বর্ণনা করবার বিষয় নয়। সাপে নাকি যাকে দংশায়নি সে সাপের বিষের মর্ম বুঝতে পারে না। কাস্টমসের কাহিনী যাকে ধরেনি তিনিও নাকি কাস্টমসের মর্ম বুঝতে পারবেন না।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বহু সংস্কৃতির দেশ। আফ্রিকান আমেরিকান, এশিয়ান আমেরিকান, লাতিন আমেরিকান কত শত নাম নিয়ে ঘোরাফেরা করেন এসব সংস্কৃতির লোকেরা। নানা মহাদেশ থেকে সমুদ্র, বনপথ পাড়ি দিয়ে তারা স্বপ্নের দেশে পেঁৗছেছেন। এই তো সেদিনও বলা হতো, এ দেশ হলো স্বাধীনতার, ফ্রিডমই এর মূলমন্ত্র। কিন্তু নাইন-ইলেভেন স্বাধীনতার মূলে হানা দিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমেরিকানরা এখন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতেও রাজি। দুষ্ট লোকেরা বলত, আমেরিকার রাষ্ট্র পরিচালনায় আগে-পরে সবসময়ই বিগ ব্রাদারের বিশাল ভূমিকা। বিগ ব্রাদার জর্জ অরওয়েলের সেই চরিত্র যে নাকি নাগরিকদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি চালায়। এ ব্যবস্থা আগে-পরে ছিল আমেরিকায়। কিন্তু নাইন-ইলেভেনজনিত নিরাপত্তাহীনতায় সব নজরদারি, তল্লাশি আর তদারকিকে মার্কিন নাগরিকরা খোলাখুলি মুখ বুজে সয়ে নিয়েছেন। ফ্রিডম জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও জঙ্গিবাদ ঠেকাও এই হয়েছে মূলমন্ত্র। তাতে রাষ্ট্রের সুবিধা হয়েছে। এতসব নজরদারির মধ্যে জঙ্গিবাদ ঠেকানো যাক না যাক, নজরদারির আয়োজন চলছে বেশ। বছরে দু'বছরে হয়তো একজন জঙ্গি আটক হচ্ছে কিন্তু জঙ্গি সন্দেহে সবাইকে তল্লাশি করে ছাড়া হচ্ছে। মুসলিমদের ধরে মুসলিম হওয়ার বেদনাটা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিছুদিন আগে নাইজেরিয়ার জঙ্গি ওমর ফারুককে নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে গেল। এক ধাক্কায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কঠোরতম অবস্থায় চলে গেল। এ নিয়ে একটি কার্টুন এঁকেছেন ক্লে বেনেট। কার্টুন দেখে ফেলুদার গল্পের কথা মনে পড়ল। সত্যজিৎ রায় বইয়ের নাম দিয়েছিলেন গ্যাংটকে গণ্ডগোল। বিমানবন্দরে তল্লাশি নিয়ে বেনেটের কার্টুন দেখে মনে হলো, বিমানবন্দরে বিভ্রাট নিয়ে কাহিনী লেখার সময় এসে গেছে। এ অবশ্য গোয়েন্দা গল্প হবে না। এ হবে স্বপ্নের দেশের দরজায় অতিথি অভ্যাগতদের নাকাল হওয়ার ট্র্যাজিক কাহিনী।

পদবঞ্চিতদের মানভঞ্জন


খবর পড়ে নিধুবাবুর টপ্পার সেই বিখ্যাত লাইনগুলোর কথাই ঘুরেফিরে মনে আসছে। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে যারা নিধুবাবুর গানটি শুনেছেন, ছাপার অক্ষরে দেখলে তাদের সুরসমেত মনে পড়ার কথা। নিধুবাবু কার উদ্দেশে বলছেন কে জানে! কিন্তু বলছেন, 'অনুগত জনে কেন করো এত প্রবঞ্চনা?/ তুমি মারিলে মারিতে পারো/ রাখিতে কে করে মানা?' টপ্পার খোশমেজাজি তালে গানের যে রস তৈরি হয় তা তো লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু আকেলমন্দ কে লিয়ে ইশারা হি কাফি। বুঝমানের জন্য ইঙ্গিতই যথেষ্ট। গানটির কথা বিশেষ করে মনে হলো সোমবারের সমকালে ছাপা একটি খবর পড়ে। খবরে প্রকাশ, ১০ জানুয়ারি সকালে আওয়ামী লীগের তিন নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে দেখা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠান ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের। সেখানে তিন নেতাকে বক্তৃতা দেওয়ার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। নেতারা আসেন, বক্তৃতা দেন এবং নেতাকর্মীদের প্রশংসাও কুড়ান। শুধু তিন নেতাই নন, বিএনপির কাউন্সিলে গিয়ে জোটবিরোধী বক্তৃতা দেওয়ায় একটু পিছলে পড়েছিলেন অসীম কুমার উকিল, তিনিও ১০ তারিখের অনুষ্ঠানে সভা পরিচালনার দায়িত্ব পান। বেশ একটা ঐক্য ও সংহতির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু যারা রাজনীতির উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সমঝদার, তারা ভালো করেই জানেন, রাজনীতিতে মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ বলে কিছু নেই। ফলে মানভঞ্জনের বিষয়ও নেই। রাজনীতি শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের মতো কাব্য নয়, আবার রোমান্সও নয়। কোমল শিল্পকলায় পারদর্শী কবিমন রাজনীতিতে শিশুমাত্র। বলতে হয়, রাজনীতি কঠোর শিল্পকলা। ওয়ান-ইলেভেনের পর কতকিছুই না ঘটেছিল! সংস্কার সংস্কার রব উঠে মাঠ গরম করে দিয়েছিল। সংস্কার নিয়ে যারা সরব হয়েছিলেন, তাদের গায়ে সংস্কারপন্থির ছাপ পড়েছিল। তখন অনেকে ভেবেছিলেন, সংস্কারের ছাপ যাদের গায়ে পড়ল না তারা বোধহয় রাজনীতি থেকেই নাই হয়ে গেলেন। কিন্তু নজরুল বহু আগে গেয়ে গেছেন, 'চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।' সেদিন যারা ওয়ান-ইলেভেনের রথে শামিল হননি, তারা আজ গণতন্ত্রের রথে সওয়ার হয়েছেন। আর যারা সংস্কার করতে চেয়েছিলেন, তারা খানিকটা সংস্কার হয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর অনেকে বলেছিলেন, যা হয়ে গেছে তা তো ফেরানো যাবে না। এবার মিলেমিশে দেশগড়ার কাজ চলুক। কিন্তু নেত্রী বলেছেন, ক্ষমা করলেও ভুলে যাবেন না। দেখি কী হয়, দেখি কী হয় করে এক বছর গেল সরকারের। না দলে, না সরকারে কোথাও ভালো জায়গা হলো না সংস্কারপন্থিদের। সবশেষে পত্র-পত্রিকায় মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল_ মন্ত্রিসভা বাড়ছে, উনি মন্ত্রী হচ্ছেন, উনি অমুক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর আর ফুরাচ্ছে না। সংস্কারপন্থিদের শনি কাটছে না। মান-অভিমান করে তো আর রাজনীতি হয় না! রাজনীতি ক্ষমতা ও আনুগত্যের কঠোর হিসাবে চলে। ফলে নেতাদের আপাতত বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে, অনুশোচনা করে কাটাতে হবে হয়তো আরও কিছুদিন। বলছিলাম নিধুবাবুর টপ্পার কথা। এদেশে শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তার কথা কে না জানে! শিশুপাঠ্যে ছিল, একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, চারে বেদ। আমাদের রাজনীতিপাঠ্যে লেখা আছে, একে দেশ, দুইয়ে নেত্রী। এক-এগারোর সামান্য ধাক্কায় অনেকে ব্যাপারটা ভুলতে বসেছিলেন। নির্বাচনের পর বেশ মনে পড়েছে। কিন্তু তখন তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন যদি নেত্রী খুশি হন, যদি তার মনে ক্ষমা জাগে তো কখনও হয়তো পদবঞ্চিতদের জন্য পদ মিলতে পারে। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। ভারতের টিভিতে বিজ্ঞাপনের একটি কথা মনে পড়ছে, 'পাহেলে যদি পাতাহি থা, তো এস্তেমাল কিঁউ নেহি কিয়া?' যদি জানাই ছিল তবে আগে ব্যবহার করেননি কেন? জানা না থাকার তো কথা নয়। শেখ হাসিনার মতো নেত্রীকে টেক্কা দেওয়া সম্ভব নয়_ এ তো জানাই ছিল। তবে আর সংস্কারের কথা উঠিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার বাসনা অল্প হলেও প্রকাশ করেছিলেন কেন?

মোবাইল চালান, গাছ বাঁচান!


ভারতের মোবাইল অপারেটর হলেও 'আইডিয়া সেলুলারে'র সঙ্গে বাংলাদেশে অনেকেই কমবেশি পরিচিত। ঢাকায় ক'দিন আগে যে আইডিয়া কাপ ত্রিদেশীয় ক্রিকেট হলো বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলংকার মধ্যে, সেটির স্পন্সর ছিল আইডিয়া সেলুলার। ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে আইডিয়ার বিজ্ঞাপনগুলো অভিনবত্বের জন্য বিশেষ আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে। সম্প্রতি 'ওয়াক হোয়েন ইউ টক' স্লোগানটি ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। মোবাইল বা সেলফোনে কথা বলার সময় হাঁটুন এই ছিল ওই বিজ্ঞাপনের মর্মবাণী। সুস্বাস্থ্যের জন্য হাঁটতে হবে। কিন্তু হাঁটার সময় কোথায়? তাই ফোনে কথা বলার সময় হাঁটুন, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলুন। আইডিয়ার এই বিজ্ঞাপন ফোনে কথা বলতে অভ্যস্ত মানুষেরা কতটা অনুসরণ করেছিলেন জানা ভার। কিন্তু বিজ্ঞাপনের আইডিয়া হিসেবে যে খুব অভিনব ছিল সেটা সবাই স্বীকার করেছেন। 'ওয়াক হোয়েন ইউ টক'কে টেক্কা দিয়ে আইডিয়া এখন নতুন স্লোগান নিয়ে বাজারে এসেছে। নতুন এই স্লোগানটি হলো_ 'ইউজ মোবাইল, সেভ পেপার।' টিভিতে মোবাইল ব্যবহার করে গাছ বাঁচানোর এই অভিনব বিজ্ঞাপন দেখে বলতে হয়, 'হোয়াট অ্যান আইডিয়া স্যারজি!' বলতে হয়, এভাবে তো ভেবে দেখিনি। বিজ্ঞাপন বিষয়ে একটু খোঁজখবর নিতে আইডিয়ার ওয়েবসাইটে গেলাম। ওয়েবসাইটের ওয়েলকাম পেজ বা শুরুর পাতাতেই ওরা লিখে রেখেছেন, ১০ লাখ না ছাপা কাগজের পাতা ৮৫টি গাছ বাঁচাতে পারে। সবারই জানা, মূলত গাছ থেকেই কাগজ তৈরি হয়। আসবাব তৈরি থেকে নির্মাণযজ্ঞ সর্বত্রই কাঠের ব্যবহার চলে। জ্বালানির কথা তো আসে সবার আগে। গাছ সাবাড় করার বাহানার অভাব নেই। আর এই করতে করতে বিশ্বের বন-জঙ্গল সব ধ্বংস হতে চলল। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ এই বৃক্ষনিধন। এও জানা কথা। কিন্তু মানতে পারছেন ক'জন? কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু জিনিসই গাছ থেকে আসে। যেমন এই কাগজ। সকালবেলা খবরের কাগজ দিয়ে শুরু। অফিসে, বিদ্যালয়ে, আদালতে কত শতভাবে কাগজ ব্যবহার করছি আমরা। কিন্তু সাদা কাগজই হোক আর ম্লান নিউজ পেপারই হোক কাগজের দিকে তাকিয়ে কি একবারের জন্যও মনে হয়, এটি বহুল প্রয়োজনীয় গাছ থেকেই আসে? যে গাছ আমাদের বাতাসের দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়, যে গাছ বেঁচে থাকলে আমাদের পরিবেশকে আরেকটু সহনীয় করতে ভূমিকা রাখতে পারত। কেন কাগজ ব্যবহারের সময় গাছের কথা সহজে মনে হয় না কে জানে। কিন্তু আইডিয়ার বিজ্ঞাপন মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার। আইডিয়া বলছে_ যদি পত্রিকা পড়ার কাজ, এমনকি লেখার কাজও মোবাইলে করা সম্ভব হয় তবে আর কাগজ কেন? মোবাইলেই কাগজের বেশিরভাগ কাজটা সেরে ফেলুন। মোবাইল চালান, গাছ বাঁচান। কাগজ তো শুধু মোবাইল ব্যবহার করেই বাঁচানো যায় না। কম্পিউটার ব্যবহার করেও করা যায়। বেশ কিছুদিন আগে, আমাদের বন্ধু একটি ব্লগের উদ্যোক্তা হিসাব দিয়েছিলেন ব্লগে কয়েক লাখ লেখা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে তিনি কত কাগজ বাঁচিয়েছিলেন। শুনে একটু পরিহাসবোধ করেছিলাম। এ হয়তো তার ব্লগের বাজার তৈরি করার আইডিয়া, আইডিয়া হয়তো মোবাইল বিক্রি করার জন্যই গাছ বাঁচানোর কথা চাউর করছে। ব্যবসায়িক এই উদ্দেশ্য সত্ত্বেও কিন্তু বিজ্ঞাপনের মর্মবাণীটা ফুরিয়ে যাচ্ছে না। মোবাইল তো আমাদের জীবনসঙ্গী। কম্পিউটারও। বলা হয়, এই মোবাইল-কম্পিউটার তৈরি করতে গিয়েও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিন্তু তাই বলে তো মোবাইল-কম্পিউটার তো আমরা ছাড়তে পারছি না। এখন যদি সেগুলো ব্যবহার করে গাছ বাঁচানো যায় তাহলে সমস্যা কোথায়? আমাদের দেশে হয়তো আইডিয়াটা নতুন মনে হবে। কেউ কেউ কম্পিউটারে অভ্যস্ত হলেও মোবাইলে খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস এখনও জমেনি। কিন্তু পশ্চিমে ইতিমধ্যে ছাপা কাগজের খবরের কাগজের দিন নাকি ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে। পাঠকরা নিজেদের সুবিধা অনুসারেই ইন্টারনেটে খবরের কাগজ পড়ছেন। দ্রুতলয়ের জীবনে এ হলো রথ দেখা এবং কলা বেচা একই সঙ্গে। খবরও মিলল, গাছও বাঁচল। হোয়াট অ্যান আইডিয়া স্যারজি!

জ্যোতি থেকে মমতায়


২০০০ সালের কথা। জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিচ্ছেন। দায়িত্ব নিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০০১ সালের নির্বাচন সামনে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, লাল দুর্গে পতন এবার আসন্ন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দায়িত্ব নিয়েছেন বটে, কিন্তু এ ক্ষণস্থায়ী, মন্তব্য করছিলেন কেউ কেউ। পশ্চিমবঙ্গে একটা রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটবার অপেক্ষায় অনেকে। তখন একটা বই বেরিয়েছিল বাংলায়, নাম জ্যোতি থেকে মমতায়। ইংরেজিতে সাবটাইটেল ছিল, ফ্রম এনলাইটমেন্ট টু ইমোশনাল বন্ডেজ। বইয়ের লেখক কলিম খান। পশ্চিমবঙ্গের লেখক। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেন। ভাবিয়ে দেওয়ার মতো নানা প্রবন্ধ লেখেন। তার এই আইডিয়াটা মনে ধরেছিল। পশ্চিমবঙ্গে শাসনভার জ্যোতি থেকে মমতায় যাচ্ছে এমন একটা আভাস নির্বাচনের আগে এভাবে দেওয়াটা অভিনব বটে। জ্যোতি বসু এনলাইটমেন্ট বা আলোকদীপ্তির সন্তান বটে। কলকাতা শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মনে উনিশ শতকে যে রেনেসাঁ ঘটেছিল, সেই রেনেসাঁর সন্তান জ্যোতি বসুর প্রজন্ম। সেদিক থেকে তিনি এনলাইটেন বটে, নামেও তাই। পশ্চিমবঙ্গে তার শাসনকাল, বিশেষত বামপন্থি শাসন এক প্রকার সামাজিক-অর্থনৈতিক এনলাইটমেন্ট ঘটিয়েছিল, সেও সত্য। কিন্তু বুদ্ধদেব? ভাবগত অর্থে জ্যোতি যা বুদ্ধও তাই। একদিন এক ক্ষ্যাপাটে জ্ঞানী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বলো তো, বুদ্ধ কী? আমি বললাম, বুদ্ধি হতে যদি বুদ্ধ হয় তবে বুদ্ধ ইনটেলেক্ট বা রিজন (জ্ঞান বা যুক্তি) ধারণকারী ব্যক্তি। তিনি বললেন, যার মধ্যে জ্ঞান বা রিজনের বসতি তিনি কে? আমি উত্তর না দিতে পেরে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বললেন, তিনি এনলাইটেন্ড ওয়ান। বুদ্ধ তিনি যিনি জ্যোতির্ময়। তাই ভাবগত অর্থে জ্যোতি ও বুদ্ধ এক ব্যাপার। এনলাইটমেন্ট, রেনেসাঁ, রিজন, ইনটেলেক্টও সমার্থক ধারণা। বাস্তবে জ্যোতি বসুর অনুসারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অনেকে বলবেন, একটু দুর্বল অনুসারী। কেউ বলবেন, জ্যোতির বদলে শুধু বিষয়-বুদ্ধি।
জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর এই কথাগুলো বিশেষভাবে মনে পড়ল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়। জ্যোতি বসুর শেষ যাত্রায় মমতা যাননি। বাংলাদেশের রাজনীতির যমজ ভাই যেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। এই রেষারেষি, খুনোখুনি দেখে তাই মনে হয়। কিন্তু মমতা কি আসলেই ইমোশনাল বন্ডেজ? নামে মমতা তিনি। কিন্তু জ্যোতি বসুর শেষ যাত্রায় যাওয়ার মতো মায়া-মমতা তার হৃদয়ে জন্মাল না দেখে নামটিকে কেউ কেউ অর্থহীন বলছেন। বলছেন, মমতাহীনা। জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা নাটক করেছেন। সোনিয়া গান্ধী যখন শোকবার্তায় জ্যোতি বসুকে কমরেড সম্বোধন করলেন, তখন নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেহারা বেশি রেড হয়ে গিয়েছিল। এত কিছুর পরও মমতা শেষ যাত্রায় যাননি।
জ্যোতি থেকে মমতায় কত সুন্দর আইডিয়া। দীপ্তি থেকে অনুভূতি। কিন্তু মায়া-মমতা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছে। প্রতিদিন খুনোখুনি, সংঘর্ষ। কংগ্রেস-তৃণমূল-সিপিএম লেগে আছে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে। আছে মাওবাদী, আছে স্বায়ত্তশাসিত নানা রাজ্যের বাদী। পশ্চিমবঙ্গ অগি্নগর্ভ। জ্যোতিবাবু সরে যাওয়ার পর আলো সরে গিয়ে আগুন লেগেছে। যুক্তি, বুদ্ধি, দীপ্তি কিছুই কাজ করছে না। সামনের নির্বাচনে বামপন্থিদের ভরাডুবি হবে বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু তাতে কি সমাধান আসবে? মমতা পশ্চিমবঙ্গে হাল ধরলে আবারও কি স্থিতিশীলতা প্রত্যাবর্তন করবে? উত্তর আপাতত জানা নেই।
কিন্তু একটি বিষয় সবার জানা। পশ্চিমবঙ্গের ভ্রাতৃঘাতী পরিস্থিতিতে মমতার খুব দরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়োজনীয় মমতা দিয়ে শান্তি ফেরাতে পারবেন কি-না কে জানে?

ঢেলে সাজানো


খবরের কাগজের একেবারে নিত্যকার শব্দ 'ঢেলে সাজানো'। আজকের সমকালের একটি সংবাদের শিরোনামে আছে, 'বিএনপিকে ঢেলে সাজাতে নানা পরিকল্পনার কথা জানালেন মির্জা ফখরুল।' ঢেলে সাজানো কী বস্তু বা কেমন আইডিয়া? প্রশ্ন উঠলে বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক অভিধান ঘাঁটতে থাকলাম। 'ঢেলে সাজা' স্থানে বলা হয়েছে 'ঢালা' দেখুন। ঢালিয়া থেকে ঢালা, ঢালা থেকে ঢেলে আসতে পারে বলে অনুমান করি। ঢালা বড় চমৎকার শব্দ। অভিধানে বলা হচ্ছে, এর অর্থ_ এক পাত্র থেকে অন্যপাত্রে পাতিত করা (পানি ঢালা, দুধ ঢালা), ধাতু গলিয়ে নির্দিষ্ট আকার দেওয়ার জন্য পাতিত করা (ছাঁচে ঢালা), বহুল পরিমাণে নিয়োগ করা বা ছড়িয়ে দেওয়া (ব্যবসায়ে টাকা ঢালা)। শব্দার্থগুলোর দিকে আকুল হয়ে তাকিয়ে একটি জিনিস বেশ বুঝতে পারি, ঢালা ব্যাপারটি বিশেষভাবে তরল পদার্থের সঙ্গে জড়িত। লোহাও ঢালা যায়, তবে ঢালার আগে লোহাকে গলাতে হয়। কিন্তু পানি, চা, দুধের মতো তরল পদার্থই সচরাচর আমরা ঢালি। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য মন ঢালার কথা বলেছিলেন, লিখেছিলেন, 'প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন...।' প্রমোদে মন ঢালা খুব সুখকর ব্যাপার এমনকি কেউ যখন প্রাণ ঢেলে দিয়ে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানান তখনও ঢালার ব্যাপার নিয়ে তেমন চিন্তায় পড়তে হয় না। কিন্তু ঢেলে সাজানোর কথা উঠলে একটু ভাবতে বসতে হয়। ঢালিয়া সাজাইবার উপায় কী? তরল পদার্থকে পাতন করে আরেক পাত্রে নিলে তরল সেই পাত্রের আকার ধারণ করে। এখন প্রশ্ন হলো, তরলকে সাজায় কেমনে? অবশ্য কঠিন হলে কথা নেই। যেমন_ টাকা, টাকা যদি ঢালা যায় তাহলে দল, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকেও ঢেলে সাজানো সম্ভব। কেউ ফোড়ন কেটে বলবেন, তরল টাকা না হলে কেউ কি সাধে টাকা ঢালে নাকি? মন ও প্রাণের মতো বায়বীয়, টাকার মতো কঠিন পদার্থ, পানির মতো তরলের ঢালার গল্প মানলাম। কিন্তু রাজনৈতিক দলের মতো দাহ্য পদার্থ কি ঢেলে সাজানো সম্ভব? গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংস্কারের নামে কত কিছুই না ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হয়েছিল। সরকারের দু'বছরে ঢেলে দেওয়ার কাজ বেশ হয়েছিল, যা কিছু ঢালা হয়েছিল তা ঢাল বেয়ে গড়িয়েও পড়ছিল। কিন্তু সাজানোর কাজ তেমন জমেনি। ফলে ঢেলে সাজানো যায়নি শেষ পর্যন্ত। নির্বাচনের মাধ্যমে যে পাত্র থেকে যা ঢালা হয়েছিল, তা সেই পাত্রে ফিরে গিয়েছিল। এখন আবার কেউ কেউ নতুন করে ঢেলে সাজানোর কথা বলছেন। ধারণাটা জটিল হলেও আমাদের সমাজে ঢেলে সাজানোকে মোটামুটি ইতিবাচক ব্যাপার হিসেবেই দেখা হয়। কেউ কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানোর কথা বললে বাহবা পান। কিন্তু কে কবে কী ঢেলে সাজিয়ে সফল হয়েছেন তা বিশেষ গবেষণা করে বের করতে হবে। আর রাজনৈতিক সংগঠনের মতো বস্তু ঢেলে সাজানো বোধহয় সবচেয়ে কঠিন। কারও অভিমানে লাগবে, কারও মানে লাগবে। সংঘর্ষ বাধবে। কোথাও দুর্নীতি বাছতে গাঁ উজাড় হবে। একটা গোলমাল লাগবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। একটু ঢেলে সাজাতে গেলে প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান মিলে টেনে ধরবে। তাই তো, অনেক আশার পরও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঢেলে সাজানো গেল না। রাজনীতি ক্রমে সেই পুরনো ধারাতেই ফিরছে। যেটুকু বাকি আছে, সবাইকে আশাহত করে সেটুকুও ফিরবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অবশ্য ঢেলে সাজানো যদি ফাঁকা আওয়াজ হয়, তবে কোনো সমস্যাই নেই। মনে মনে ঢেলে মনে মনে সাজালে, ঢেলে সাজানোর একটা খবর হয় বটে। কেউ তো আর বলবে না যে, কী ঢেলে কী সাজালেন আর কী তাতে চেঞ্জ হলো, একটু দেখান তো দেখি।

বিড়াল-মন্দির


গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে বিড়ালের সম্পর্ক নিবিড়। সুদীর্ঘকাল ধরে মানুষের বাসস্থানের পাশে বিড়াল বাস করছে। কিছুটা বন্য, কিছুটা পোষা এ প্রাণী শহরের যান্ত্রিক জীবনের সঙ্গেও অনায়াসে মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। কেউ কেউ বিড়াল বিশেষত কালো বিড়ালকে দেখেন ভয়ের চিহ্ন হিসেবে। কারও কাছে আবার অত্যন্ত প্রিয় প্রাণী। বলা হয়ে থাকে, অত্যন্ত আরামপ্রিয় এই প্রাণীর কাছ থেকে মানুষ শিখতে পারে সুখ কেমন ব্যাপার আর চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কীভাবে সুখে থাকতে হয়। মানুষের কাছের এ প্রাণীটিকে নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। আধুনিক সাহিত্যের প্রত্যেক বড় কবিই বোধহয় বিড়াল নিয়ে এক বা একাধিক কবিতা লিখেছেন। অ্যাডগার অ্যালান পো থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ কেউ বাদ দেননি বিড়ালের প্রসঙ্গ। বিড়াল নিয়ে সাহিত্যকর্ম একজোট করলে তা বিশাল এক বিড়াল-রচনাবলির আকার ধারণ করবে বলেই ধারণা করা যায়। বিড়াল নিয়ে সাহিত্য আছে, বিড়াল নিয়ে রহস্য আছে, আমাদের ঘরের পাশে বিড়ালেরাও আছে বহাল তবিয়তে। কিন্তু কেউ কি বিড়ালের মন্দিরের কথা ভাবতে পেরেছিলেন? আমরা ভাবতে পারি না পারি, খ্রিস্টপূর্ব ২৪৬ থেকে ২১১ অব্দে মিসরের লোকেরা ঠিকই বিড়ালের মন্দিরের কথা ভাবতে পেরেছিল। শুধু ভাবা নয়, বিড়ালের মন্দিরও তৈরি করেছিল। মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়ার আধুনিককালের এক সড়কের নিচে সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে এমন এক বিড়াল-মন্দির। মিসরীয় বিড়াল-দেবী ব্যাসটেটের উদ্দেশে নির্মিত এ বিড়াল-মন্দিরে কম করে ৬০০ বিড়ালমূর্তি পাওয়া গেছে। যারা এই মন্দির আবিষ্কার করেছেন তারা বলছেন, মিসর শাসনকারী গ্রিক সম্রাট তৃতীয় টলেমির স্ত্রী দ্বিতীয় বেরেনিক এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন। প্রাচীন মিসরে বিড়াল ছিল খুবই আদুরে পোষা প্রাণী। নানা গার্হস্থ্য সামগ্রীতে বিড়ালের ছবি খোদাই করা হতো। প্রত্নতাত্তি্বকরা বলেছেন, গত একশ' বছরে আলেক্সান্দ্রিয়ায় এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বলছে, বিড়াল-দেবী নাকি আনন্দেরও প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতেন প্রাচীন মিসরে। উইকিপিডিয়া বলছে, প্রাচীন মিসরীয় সমাজে বিড়ালের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। প্রাচীন মিসরে এদের ডাকা হতো ম্যাও বলে। শুরুতে বন্য অবস্থাতেই ছিল বিড়ালেরা। বন্য অবস্থাতেই মানুষের নানা উপকার করত। বেজি, ইঁদুর মেরে শস্যক্ষেতের উপকার করত। তাদের উপকারে খুশি হয়ে মানুষ তাদের পুষতে শুরু করে। উচ্চ ও নিম্নভূমির মিসরে একদা নানা প্রাণীর পূজা চালু হয়েছিল। বিড়াল-পূজা ছিল এসবের অন্যতম। বিড়াল-দেবী কালে কালে উর্বরতা ও মাতৃত্বের দেবী হিসেবেও গণ্য হয়েছিলেন। পরিস্থিতি এত দূর গড়িয়েছিল যে, রাজা-ফারাওদের মতো বিড়াল মরলে তাদেরও মমি করে রাখা হতো। সাড়ম্বরে বিড়ালের কবর দেওয়া হতো। এরকম মমি করা মৃত বিড়ালের সন্ধানও মিলেছে। পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়, ইঁদুরের প্রচণ্ড উপদ্রব থাকলে বিড়ালের কদর কতটা বাড়তে পারে তার নমুনা মিলেছে মিসরে। মন্দির তৈরির ভাবনা অভিনব হলেও তখনকার বাস্তবতায় দরকারি ছিল বলে অনুমান করা যায়। বিড়ালের মন্দির তৈরির কথায় যারা চমকে উঠছেন তারা নিশ্চয় অধিবিদ্যার রহস্যময় বিড়ালের বিষয়ে আরও কিছু দার্শনিক ভাবনা ভাবার অবকাশ পাবেন। হাজার বছর ধরে বিড়াল মানুষকে ভাবিয়েছে। এমনকি মানুষের সশ্রদ্ধ পূজাও আদায় করে নিয়েছে। শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ানো অবহেলিত বিড়াল দেখে কে আর বিড়ালের সেসব উজ্জ্বল দিনের কথা মনে করবে?

Tuesday, May 4, 2010

'নিউজিয়াম'


১ ফেব্রুয়ারি ডেইলি স্টারের একটি ছোট খবরে চোখ আটকে গেল। দিলি্ল শহরে ভারতের প্রথম 'নিউজিয়াম' উদ্বোধন করা হবে। প্রথম দর্শনে নিউজিয়াম শব্দটি দেখে একটু খটকা লাগলেও দ্রুত নিউজ ও মিউজিয়াম শব্দ দুটি জুড়ে গিয়ে একটা অর্থ তৈরি করে ফেলল। সুকুমার রায় একদা ছেলে ভুলানো ছড়ায় হাঁসজারুসহ নানা মিশ্র ধারণা আমদানি করেছিলেন। হাঁস ও সজারুর মিলিত চেহারার অদ্ভুত দর্শন এক প্রাণীর ছবিও আমরা দেখেছি। খুব মজার ধারণা ছিল এই হাঁসজারু। সব বয়সের লোককেই বহুকাল ভাবিয়েছে এমন ধারণা। এখন অবশ্য জিন-প্রযুক্তির এমনই বিকাশ হয়েছে যে, হাঁসজারুকেও সম্ভব মনে করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এমন এক সময়ও নাকি আসতে পারে, যখন গাছ থেকে উড়ে এসে আপেল খাবার টেবিলে বসে পড়বে। জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ফুড বা জিএম ফুডের উচ্চ ফলনের কেরামতির সঙ্গে যারা পরিচিত তারা আর এসবে চমৎকৃত হন না। বরং তারা জিন পরিবর্তনের ফলে হাজার বছরের প্রাকৃতিক সম্পদে কী ক্ষতি হচ্ছে, সে নিয়েই বিশেষ চিন্তিত। শুধু জিন-প্রযুক্তিই নয়, আমাদের ভাষা-প্রযুক্তিতেও হাঁসজারু বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। দুটি শব্দ যতই দূরের হোক, তাদের এখন জোড়া লাগাতে সময় লাগে না। যেমন ইনফরমেশন এবং এনটারটেইনমেন্ট_ এ দুটি শব্দ মিলে হয়ে গেল ইনফোটেইনমেন্ট। এ এমন এক তথ্য যা নাকি বিনোদনও দেবে। এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে এন্তার। বাংলাভাষাতেও এমন জোড় শব্দের হাওয়া এসে লেগেছে। তবে সেগুলোর অধিকাংশই এখনও অচ্ছুৎ বলেই গণ্য। ভাষা নিয়ে তর্ক হতেই পারে; কিন্তু নতুন একটা শব্দ যখন অভিনব একটা আইডিয়ার জন্ম দেয় তখন একটু নড়ে না বসলে চলে না। যেমন এই নিউজিয়াম। খবরের জাদুঘর। আর্কাইভ। নিউজ মিউজিয়াম। ভেবেছিলাম, এ বোধহয় ভারতীয়দেরই আবিষ্কার। তারাই প্রথম চালু করতে যাচ্ছে এমন নিউজিয়াম। নেটে একটু সার্চ দিতে আরও নানা নিউজিয়ামের দেখা মিলল। ওয়াশিংটন ডিসির পেনসিলভানিয়া এভিনিউতে বড় এক নিউজিয়াম গড়ে উঠেছে। দাবি করা হচ্ছে, এটি সবচেয়ে মিথষ্ক্রিয়ামূলক নিউজিয়াম। মিথষ্ক্রিয়া বললে ইন্টারঅ্যাকটিভ শব্দটার গুরুত্ব ঠিক বোঝা যায় না। তবে ধারণাটা এমন, অডিও-ভিডিও-প্রিন্ট মিডিয়ার সম্মিলিত এ নিউজিয়াম ব্যবহারকারীদের অনেক কিছু করার থাকে। তাদের অংশগ্রহণে জীবন্ত হয়ে ওঠে নিউজিয়াম। ছবিতে দেখে নিউজিয়াম দেখার লোভ হলো; কিন্তু আমাদের জন্য দিলি্ল অনেক দূর, ওয়াশিংটন তো আরও দূরের ব্যাপার। ফিলিপ এল গ্রাহাম বলেছিলেন, নিউজ ইজ দ্য ফার্স্ট ড্রাফট অব হিস্ট্রি। খবর হলো ইতিহাসের প্রথম খসড়া। এ উপলব্ধি আমাদের গবেষকদের আছে। তাই জাতীয় আর্কাইভ থেকে পাবলিক লাইব্রেরি পর্যন্ত গবেষকরা ইতিহাসের সন্ধানে ছোটাছুটি করে গলদঘর্ম হন; কিন্তু ইতিহাসের প্রথম খসড়ার কোনো কার্যকর খোঁজ মেলে না। যারা হাতে-কলমে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের খবরের কাগজের সন্ধানে গিয়েছেন তারা আমাদের সংগ্রহের দুরবস্থা দেখে নিশ্চয়ই অবাক হবেন না। কথিত আছে, আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি। আমাদের ইতিহাসবোধ প্রখর নয়। যাদের ইতিহাসবোধ প্রখর নয়, তাদের জন্য ইতিহাসের খসড়া তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা নয়। হয়তো এ কারণেই কর্তাব্যক্তিরা একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। কিন্তু সময় তো বদলাচ্ছে। মানুষের মধ্যে ইতিহাস চেতনা জাগছে। মানুষ জানতেও চাইছে। তথ্যকে অধিকার হিসেবেও গণ্য করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, নতুন প্রজন্মের মানুষের জন্য একটি নিউজিয়াম কী ঢাকায় হতে পারে না? শুরু থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রকাশিত সব সংবাদপত্র যদি একটা জায়গায় পাওয়া যায়, তবে তা কতই না সুখের ব্যাপার হতো। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল নিউজিয়াম গড়ে তোলাও হয়তো কঠিন ব্যাপার নয়। অবশ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সংবাদপত্র একত্র করে নিউজিয়াম গড়তে বড় উদ্যোগ দরকার। আশাটুকু তোলা থাক। আপাতত আমরা ভাবতে থাকি শুধু ওই শব্দটির কথাই। নিউজিয়াম! পাশাপাশি শব্দ দুটি কিন্তু খুব অনায়াসে মানিয়ে গেছে।

মুম্বাই কার?


১৯৯৫ সালে শিবসেনা মহারাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসেই বোম্বের নাম পরিবর্তন করে মুম্বাই রেখেছিল। সে সময় অনেক ভারতীয় শহরের নামই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুম্বাইয়ের নামকরণটা সবার চোখে পড়েছিল বেশি। কারণ এর জৌলুস ও বিশ্বপরিচিতি। আদতে বোম্বে নামটা খারাপ ছিল না। বোম্বে নাম দিয়েছিল পর্তুগিজরা। পর্তুগিজ ভাষায় বুম মানে ভালো, বে মানে উপসাগর। ভালো উপসাগরের তীরবর্তী শহর বোঝাতে পর্তুগিজরা বোম্বে নাম দিয়েছিল। ইংরেজ-পর্তুগিজরা যতই বোম্বে ডাকুক, স্থানীয় মারাঠিরা একে ডাকত মুম্বাই বা মাম্বাই বলেই। মাম্বা বা মহাঅম্বা দেবীর নাম থেকে মুম্বা এসেছে। আর মারাঠি আই শব্দের অর্থ মা। তবে এ শহরের প্রাচীন নাম ছিল কাকামুচি। এখনও নাকি কেউ কেউ মুম্বাইকে কাকামুচি বলে ডাকেন। হিন্দি সিনেমার সূত্রে যে শহরটি আমাদের এত চেনা সে শহরের আদি অধিবাসী মারাঠিরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বিশেষভাবে গর্বিত ও চিন্তিত। স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করেন, হিন্দি সংস্কৃতি তাদের গ্রাস করছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের আন্দোলন নয়, গ্রাসের ভয় থেকে মুম্বাইতে এবং মহারাষ্ট্রে যে রাজনীতি চলছে তা হলো উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে শিবসেনা এবং তাদের নেতা বাল ঠ্যাকারে। পরিস্থিতি এতটাই গড়িয়েছে যে, কিছুদিন আগে টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় সোভান সাক্সেনা লিখেছেন, ভারতের উচিত সময় থাকতেই মুম্বাইয়ের মালিকানা দাবি করা। নইলে অতিদ্রুত বিজেপি, আরএসএস আর শিবসেনা মিলে মুম্বাইয়ের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে যাবে। আর তারা কর্তা বনে গেলে মুম্বাইয়ে ভারতের অন্য অঞ্চলের মানুষের, বিশেষ করে উত্তর ভারতীয়দের অবস্থান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। বাল ঠ্যাকারে তত্ত্ব দিয়েছিলেন যে মুম্বাই ফর অনলি মারাঠিজ, মুম্বাই শুধু মারাঠিদের জন্য। বাকিরা? এত ব্যবসা-বাণিজ্য, চলচ্চিত্র রেখে বাকিরা কোথায় যাবে? কেউ বলল, তারা চলে যাবে। কেউ বলল থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে মুকেশ আম্বানি বললেন, মুম্বাই ফর অল, মুম্বাই সবার জন্যই। তখন বাল ঠ্যাকারে বললেন, মানুষের কথা মানতে হবে। মানুষ চায় মুম্বাই শুধু মারাঠিদের হোক। মুকেশ আম্বানির জন্য যেমন রিলায়েন্স, মহারাষ্ট্রের মানুষের জন্য তেমনি মুম্বাই। তর্কে জড়িয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকারও। তিনি একজন গর্বিত মারাঠি হিসেবেই বলেছিলেন, মুম্বাই ভারতের সম্পত্তি, মুম্বাইতে সবার থাকার অধিকার আছে। শচীনের এই কথা শুনে বাল ঠ্যাকারে তাকেও ধমকে দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এমন এক জায়গায় এসে পেঁৗছাচ্ছে যে, সহজ সমাধানের রাস্তা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। শুধু উগ্র জাতীয়তাবাদ বললে বোধহয় আর সমাধান হচ্ছে না বিষয়টার। একটি বড় শহর যখন গড়ে ওঠে তখন তার উজ্জ্বলতার নিচে থেকে যায় অনেক অন্ধকার অঞ্চল। বঞ্চিত ভাগ্যহতরা তখন তাদের দুরবস্থার জন্য ওই শহরটিকে দায়ী করতে থাকে। খোদ মুম্বাইতেও তো বস্তি কম নয়। প্রশ্ন হলো, নিজেদের দুর্ভাগ্যের জন্য বঞ্চিতরা শহরের বহিরাগতদের দায়ী করছে কি-না, আর তাদের এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে শিবসেনা তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আখের গুছিয়ে তুলছে কি-না। বাল ঠ্যাকারে বলেছেন, মুম্বাইকে যেন বসার ঘর ভাবা না হয়। সবাই মুম্বাইতে আসবে এখানে থুথু মেরে চলে যাবে তা করতে দেওয়া হবে না। তার আরও অভিযোগ যে, মুম্বাই হামলার সময় উত্তর ভারতীয় শাসকরা যথেষ্ট মনোযোগের সঙ্গে বিষয়টির মোকাবেলা করেনি। অতএব, তারা বাইরের লোকদের প্রতিরোধ করবেন। শিবসেনা এখন যেনতেন কারণেই বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। শাহরুখ থেকে সালমান সবাইকে শাসিয়ে চলেছে। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে রাহুল গান্ধী বলেছেন, মুম্বাইতে সবার থাকার অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। কোনো ভারতীয়র ওপর আঘাত এলে জবাব দেওয়া হবে। পরিস্থিতি মঙ্গলবার পর্যন্ত এমনই ছিল। কিন্তু বুধবার বাল ঠ্যাকারে জবাব দিয়েছেন। ভাষা তার অশ্রাব্য। যুক্তির বালাই নেই। তিনি বলছেন, অনেক বয়স হয়ে যাওয়ার পরও রাহুলের যেহেতু বিয়ে হয়নি আর এর ফলে যেহেতু তার ভেতর হতাশা জেগেছে তাই তিনি এমন যুক্তিহীন কথা বলছেন। তার এই বক্তব্যের পর তার সঙ্গে তর্ক করতে যে কারও বাধো বাধো ঠেকবে। কিন্তু মুম্বাইকে তো রক্ষা করতে হবে? তর্ক করে, গালি খেয়ে সবকিছুর পরও উগ্রপন্থার হাত থেকে মুম্বাইকে রক্ষা করা যাবে কি-না সেটি বড় প্রশ্ন। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, মানুষের প্রকৃত সমস্যার দিকে তাকানো। কারণ মানুষ পেছন থেকে সরে গেলে উগ্রপন্থা কোনো কাজেই আসে না।

একটি ভাষার মৃত্যু


ভাষার জন্য লড়াইয়ের দীর্ঘ ও রক্তাক্ত ইতিহাস আমাদের। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ সূচিত হয়েছিল। অনেকে মনে করেন, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত ফল হিসেবে আমরা মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলাদেশ কায়েম করতে পেরেছি। স্বাভাবিকভাবে ভাষা-প্রশ্নে আমাদের স্পর্শকাতরতা বেশি। আমরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি, একে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা মনে করি। 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি' আমাদের প্রিয় গান। নিজের দেশকে সবাই সকল দেশের সেরা মনে করেন। কিন্তু সেই দিন আর নেই যে, নিজের দেশকে সেরা মেনে চোখ বন্ধ করে সুখে থাকব। বিশ্বের দুয়ার খোলা। আমাদের দেশের চেয়ে সুন্দর না হোক, আমাদের দেশের মতো সুন্দর কত দেশ আছে পৃথিবীতে। তেমনি ভাষাও। বাংলার মতো শ্রুতিমধুর কত ভাষা আছে। আমরা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছি বলে পৃথিবীর সব মানুষের ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা থাকা খুব স্বাভাবিক। আমরা রক্ত দিয়ে ভাষার গুরুত্ব অনুভব করেছি, সে কারণেই এ আশাবাদ। কিন্তু কাজে তেমন একটা সচেতনতা দেখা যায় না। আমাদের দেশে সব মানুষের ভাষা বাংলা নয়, অন্য ভাষার বহু মানুষ এ দেশে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীগুলো তো আছেই, সমতলেও আছে ভিন্ন ভাষার কত মানুষ। কিন্তু ভাষার জন্য রক্ত দিলেও এ ভাষাভাষী মানুষের ভাষার বিকাশে আমাদের অবদান সামান্য। বলতে হয়, আমাদের আধিপত্য ও অবহেলার কারণে বাংলাদেশের আদিবাসী-অভিবাসী নানা ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে। একটি ভাষার টিকে থাকার গুরুত্ব কী? এটি বোধহয় ২০ কোটি মানুষের একটি ভাষার মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। যেমন বোঝা কঠিন, কীভাবে একটি ভাষায় কথা বলা শেষ মানুষটির মৃত্যু ভাষাপ্রেমিক মানুষকে কতটা কষ্ট দিতে পারে সেটি। এমনই এক ঘটনা ঘটে গেল সম্প্রতি। বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ আন্দামানে বো ভাষাভাষী শেষ মানুষ বোয়া সর ৮৫ বছর বয়সে মারা গেলেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বো ভাষাটির বিলুপ্তি ঘটল। বো ভাষা পুরোপুরি বোঝার মতো, সে ভাষায় কথা বলা ও গান করার মতো কোনো লোক আর রইল না। বো ভাষা পৃথিবীর প্রাচীন ভাষাগুলোর একটি। মানুষ যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসতি গাড়ছিল, তখনকার সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল এ ভাষার। ফলে ভাষাটির প্রতি নৃতাত্তি্বক, ভাষাতাত্তি্বক, ইতিহাসবিদ, মনোবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী সবার নজর ছিল। বলা হচ্ছে, বোয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। আন্দামানের আদিবাসীরা বহু ঝড়ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে টিকে ছিলেন। সুনামি তো সাম্প্রতিক ঘটনা। এর আগে তাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে ব্রিটিশ বসতি স্থাপনকারীদের; মিশনারিদের হাত থেকে ধর্মরক্ষা করতে হয়েছে। এমনকি ডকুমেন্টারি পরিচালকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য জঙ্গলে পালিয়ে থাকতে হয় তাদের। সঙ্গে আছে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অত্যাচার। নানা রোগব্যাধি তো আছেই। এত কিছুর পরও বোয়া যে বেঁচেছিলেন, এটাই এক বিস্ময়। এখন তার মৃত্যুর পর সবাই বলছেন, ঘটনাটা দুঃখজনক। এমন ঘটনা যেন না ঘটে, তার জন্য সচেতন হতে হবে। প্রশ্ন হলো, মৃত্যুকে রোধ করার ক্ষমতা তো মানুষের নেই। কিন্তু মানুষ চাইলে ভাষা বাঁচাতে পারে। ভাষা শিখতে পারে। ভাষার ডকুমেন্টেশন করতে পারে। সেটুকু হলেও কিছু সংযোগ থেকে যায়। অবশ্য এ সামান্য ঘটনায় তেমন কিছু হয় না। কারণ একটি জনগোষ্ঠী চার হাজার বছর আগের সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী একটি শব্দ যখন বলে আর যখন সেটি আমরা কাগজে তুলে নিই, তখন অর্থের তারতম্য ঘটবেই। এ জন্য নৃবিজ্ঞানীরা বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগোষ্ঠীগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার দিকে গুরুত্ব দেন। ভাষাভাষী মানুষকে বাঁচাতে পারলে তাদের ভাষাকেও বাঁচানো সম্ভব। মানুষ হারিয়ে যাওয়ায় আফ্রিকা মহাদেশ থেকে অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। অনেক ভাষা, অনেক সংস্কৃতি, অনেক গান, অনেক কবিতা আর কখনও ফিরে আসবে না। এসব হারিয়ে যাওয়া ভাষার কান্না কি আমরা বুঝতে পারব? হয়তো পারব। কারণ আমরা ভাষাকে ভালোবেসে যুদ্ধ করেছি। শুধু বাংলা নয়, পৃথিবীর সব ভাষা, বিশেষত হারিয়ে যেতে থাকা ভাষাগুলোর প্রতি আমাদের মমত্ব যদি কাজে পরিণত হয়, তবে তা হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ জন্য আন্দামানে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের দেশেই যে আদিবাসী নৃগোষ্ঠীগুলো আছে, তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলেই চলবে।

এমপিদের বই পড়ার অভ্যাস


অনেকেরই মনে থাকার কথা সৈয়দ মুজতবা আলী কী লিখেছিলেন বই পড়া প্রসঙ্গে। বাজারে গিয়ে স্বামী বই কিনতে উদ্যত হলে স্ত্রী বলেছিলেন, বই? সেও তো ঘরে একখানা আছে। অর্থাৎ নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস দূরের কথা, নিদেনপক্ষে আসবাব হিসেবে ঘরে একখানা বই থাকাই যথেষ্ট। এ শুধু পরিহাসের কথা, নাকি সত্য সত্যই কেউ মনে করেন এমন, এ নিশ্চয়ই গবেষণার বিষয়। তবে আমেরিকার এক কাগজে একটা কৌতুক পড়েছিলাম জর্জ বুশের পাঠাভ্যাস প্রসঙ্গে। জর্জ বুশের হোয়াইট হাউস ত্যাগের সময় তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র পরিবহনের জন্য ট্রাক এলো। প্রেসিডেন্টদের অনেক বই থাকে। ফলে বড় ট্রাকই বরাদ্দ। কিন্তু মাল পরিবহনের লোকজন বুশের স্টাডিতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। পুরো স্টাডিজুড়ে পড়ে আছে শুধু দু'খানা বই। একটা স্পোর্টস ম্যাগাজিন আর এক কপি হাসলার। এও নিশ্চয়ই কৌতুক শুধু, সত্য নয়। তবে রাজনীতিকদের বই পড়ার অভ্যাস নিয়ে বিস্তর বাঁকা কথা চালু আছে। এমনকি তারা যখন বই লেখেন তখনও বেশ কথা হয়। সম্প্রতি সারাহ পলিনকে নিয়ে কথা হচ্ছে। বিল ও হিলারি ক্লিনটন এবং ওবামার কথা বোধহয় ভিন্ন। তারা লিখে বেস্টসেলার তালিকায় নাম উঠিয়েছেন। তাদের বই নিয়ে কথা হয়েছে। অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন তারা। পৃথিবীতে এমন অনেক রাজনীতিক আছেন যাদের প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তারা লিখলে মানুষ পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। তারা যে পড়েন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো নেতা যে জাতিতে জন্মেছেন তারা নিশ্চয়ই ভাগ্যবান। কিন্তু সাধারণভাবে রাষ্ট্রনায়কদের কাছে প্রজ্ঞা ও দার্শনিকতা প্রত্যাশা করা হয়। প্লেটো বলেছিলেন, তার আদর্শ রাষ্ট্রের প্রধান হবেন একজন দার্শনিক রাজা। বলেছিলেন, দার্শনিকদেরই রাজা হতে হবে কিংবা রাজাকে দার্শনিক হয়ে উঠতে হবে। ভারতবর্ষেও রাজর্ষি নামে এক ধারণা ছিল। যিনি রাজা হবেন তিনি আবার ঋষিও। এ ধারণাগুলোকে ইউটোপীয় বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। কারণ, অশোক, আকবরের উদাহরণ তো আমাদের ইতিহাসেই আছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের এখনকার রাজনীতিকদের পরিস্থিতি কী? জ্ঞানে, প্রজ্ঞায়, বিদ্যায় তাদের দৌড় কেমন? এসব প্রশ্ন উঠলে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেবেন। কারও কাছে এও মনে হতে পারে, রাজনীতিকের সঙ্গে পাঠাভ্যাসের সম্পর্ক কী? এসব প্রশ্নের সুরাহা হলেও অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না যে, আমাদের সংসদ ভবনে একটি লাইব্রেরি আছে, আর সেখান থেকে গুটিকয় এমপি পড়াশোনা করেন। এমনকি তারা বই ফেরত না দিতে পেরে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের নোটিশও খেয়েছেন। গতকালের পত্রিকায় এমন খবর পড়ে দুঃখের বদলে সুখই হলো। বলতে ইচ্ছা করছিল, পড়ূয়া যে সামান্য ক'জন এমপি আছেন তাদের নোটিশ নয়, ধন্যবাদ দিন। বই নিশ্চয় ফেরত নেবেন, কিন্তু ধন্যবাদ দিয়ে নিন। কারণ এই যুগে এমন এমপি খুঁজে পাওয়া ভার। মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় দেখি এমপিরা লাইব্রেরিতে যান না। এমনকি লাইব্রেরি থেকে কীভাবে বই ওঠাতে হয় জানেন না। কবে শুনব, লাইব্রেরি কোথায় তা-ই জানেন না অনেকে। কিন্তু আমাদের সংসদের লাইব্রেরি দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি বলে কথিত আছে। ইতিহাসের এক বাঁক ফেরার মুহূর্তে ১৯৭১ সালের মার্চের আগে এ লাইব্রেরিতে প্রচুর বই এসেছিল পাকিস্তান থেকে। সে বইগুলো থেকে গিয়েছিল। কিন্তু বইগুলো পতিত রইল, কেউ আবাদ করল না। এমপিদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তারা অপরিহার্য সংসদ অধিবেশনেই নাকি যেতে পারেন না। সচিবালয়, নির্বাচনী এলাকা, তদবির এসব তো আছে। এর মধ্যে আবার বই পড়ার আবদার? সবাই নিশ্চয়ই পড়বেন না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো পড়তে হবে। নইলে সংসদীয় আইন-কানুন, আলাপ-আলোচনা থেকে তো জ্ঞান-বিদ্যার ব্যাপার উঠেই যাবে। তেমন দিন না আসুক। আসুন, বই পড়ার প্রতি আগ্রহীদের প্রতি আমরা বিশেষ দৃষ্টি দেই। তাদের জন্য বই পড়া ভাতা চালু করি। এখন যদিও দশ-বিশজন পড়ূয়া এমপির নাম জানা যাচ্ছে, আগামীতে হয়তো এ সংখ্যা দু'তিন জনে নেমে আসবে। কিন্তু তাদের রক্ষা করতে হবে। তারা বইখেলাপি হোন, নোটিশ পান সমস্যা নেই। কিন্তু একজন দার্শনিক রাজা হয়তো ওই দু'একজনের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে।

দেখে যেন মনে হয় বোমা উহারে


তিলকে তাল বানানোর অভ্যাস আমাদের আছে। কিন্তু রাজনীতিতে বোধহয় দুটিই ঘটে। তিলকে যেমন চোখের নিমেষে তাল বানানো হয়, তালকেও তিল বা তিসিতে পরিণত করা সামান্য আয়াসেরই ব্যাপার। তালকে তিল আর তিলকে তাল বানাতে বানাতে আমাদের রাজনীতি ক্রমশ তিলোত্তমা বা তালোত্তমা হয়ে উঠছে। কোনো ত্রিকালদর্শী হয়তো এমন কাণ্ডে তালকানা হবেন না। বলবেন, এ তো রাজনীতির চিরাচরিত নিয়মই। কিন্তু আমজনতা দিশাহীন হয়ে যেতে পারে সহজেই। সোমবার বিরোধীদলীয় নেত্রীর গুলশান অফিসের সামনে থেকে বোমার মতোন দুটি জিনিস উদ্ধার করেছে পুলিশ। বোমা তো বোমাই। বোমাসদৃশ বা বোমার মতোন আবার কী জিনিস? নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে কেউ হয়তো বোমা ফেলে গিয়ে থাকবে। কিন্তু পুলিশ বলছে, এ তো ককটেল মাত্র। ক্ষতি করার তেমন ক্ষমতা নেই এ বোমার। নেহাতই ছোট বোমা। কিন্তু বিএনপি কি আর বিরোধী দলে থেকে পুলিশের বাণী শুনবে? তারা বলছে, এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত আরও কত কি। বিরোধীদলীয় নেত্রীর অফিসের সামনে পড়ে থাকা ককটেল রাজনীতির গুণে বোমা হয়ে যেতে পারে। আর পত্রিকার কল্যাণে তা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিতও হতে পারে। অন্যদিকে ভাবুন শেরপুরে পাওয়া গ্রেনেডের কথা। পত্রিকায় এমনভাবে ছাপা হবে, আর এমনভাবে আলোচনা হবে এ নিয়ে যে, বিধ্বংসী গ্রেনেড নয়, এ নেহাতই দু'চারটি ককটেল। এই হলো আমাদের পরিস্থিতি। কখনও বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাড়ি হয়ে পড়ে রাজনীতির কেন্দ্রীয় আলোচনা, কখনও কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন হয়ে পড়ে সরকারের প্রধান এজেন্ডা। রাজনীতির লীলা বোঝা বড় ভার! বোমা নিয়ে বিশেষ এক ধরনের রাজনীতিও আছে। কোথাও হয়তো বোমা পোঁতা হলো, কোথাও বোমা ফেলে রাখা হলো। সেদিকে মিডিয়ার প্রচার চলে গেল। সবাই বোমা নিয়ে ভেবে ভেবে মাথা ভার করে ফেলল। কেউ বলল, নাশকতার আশঙ্কা; কেউ বলল, হত্যার রাজনীতি; কেউ বলল, বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র। কিন্তু কাজের কথা অল্প লোকেই বলেন। যারা বলেন তারা জিজ্ঞেস করেন, এ বোমা কোথা হতে এলো? কোনো ক্লু না পেয়ে খোদ বোমাকে জিজ্ঞেস করেন বিশেষজ্ঞরা, বোমা তখন নিজেই ভাবতে থাকে, কোথা হতে এলেম আমি? কেউ বলেন, অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার রোধ করতে হবে। কেউ বলেন, সন্ত্রাসী, বোমাবাজরা কারও বন্ধু নয়, সকলের শত্রু। তবু কি বন্ধ হয় রাজনীতি। আমাদের দেশে তো এই সেদিনও কত গ্রেনেড ফুটল। কত লোকের প্রাণহানি হলো। বোমা যতক্ষণ না ফোটে ততক্ষণই এ নিয়ে রাজনীতি চলে। কিন্তু যখন ফোটে তখন তো সবাইকে নির্বাক করে দিয়ে যায়। এ তো ক'দিন আগে ভারতের পুনেতে বোমা বিস্ফোরণ হলো। ভারতীয় পত্রিকায় দেখলাম, পুলিশ বলেছে, কোথাও বোমার মতোন জিনিস দেখলে নাড়াচাড়া করবেন না। পুলিশ ডাকবেন। পুলিশ এসে দেখবে বোমা না অন্য কিছু। ফলে বোমা নিয়ে না খেলাই ভালো। বিশ্বে প্রতিদিনই কত বোমা ফুটছে, কত নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এসব কথা মনে করে, ককটেলগুলোকে বোমা করে তোলার চেষ্টা আপাতত ক্ষান্ত থাকুক। আমাদের সবার পরিচিত একটা গল্প আছে। এক রাখাল বালক ছিল। বাঘ বাঘ করে চিৎকার করত। শেষে একদিন সত্যি বাঘ এলো। কিন্তু সেদিন আর কেউ রাখালের কথা বিশ্বাস করল না। গল্পটি পুরো বললাম না। গল্প সবার জানা, মোরালও। একদা আমাদের এখানেও নেতা-নেত্রীরা বোমা বোমা বলে চিৎকার করতেন। শেষে দেখা গেল একদিন সত্যি বোমা ফুটল। সেদিন তো কতজনের কথাই বলা হলো। কত গবেষণা চলল। অবশেষে অনেক কষ্টে আমরা বোমার ভয় থেকে বের হয়েছি। আবার তাহারে কেন ডাকো? আমরা আর বোমার ভীতিকর জগতে ফিরতে চাই না। বোমাকে চিরবিদায় জানাতে চাই। আর এজন্য রাজনীতির লাঠালাঠি, বকাবকি, ব্লেমগেমের মধ্যে কিছুতেই যেন বোমা চলে না আসে সেই আমাদের প্রার্থনা।

Monday, May 3, 2010

নূহের নৌকা


ইসলাম ধর্মে হজরত নূহ (আঃ)-এর আমলের মহাপ্লাবনের উল্লেখ আছে। উল্লেখ আছে, তার সেই বৃহৎ নৌকার কথাও। লোকমুখে ওই নৌকা নূহের কিস্তি বলেও পরিচিত। বাইবেলেও আছে নূহের নৌকার কথা। হিন্দু শাস্ত্রেও নানা সূত্রে মহাপ্লাবনের উল্লেখ আছে। শতপথ ব্রাহ্মণে মহাপ্লাবনের উল্লেখ আছে। মনুকে মহাপ্লাবনের কথা জানানো হয়েছিল আর তাকে এ প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন মৎস্য অবতার। পৃথিবীর বহু ধর্মগ্রন্থ, পুরাণ ও লোককথায় মহাপ্লাবন ও নূহের কিস্তির অনুরূপ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয়, এমন একটি মহাপ্লাবন ঘটেছিল। কিন্তু সত্যিই এটি ঘটেছিল নাকি ধর্মগ্রন্থে প্রতীকীভাবে মহাপ্লাবনের উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন, এমনকি নূহের নৌকার সন্ধানে নানা স্থানে প্রত্নতাত্তি্বক অনুসন্ধানও চালিয়েছেন। এবার প্রত্নতাত্তি্বকদের একটি দল বলছেন তারা তুরস্কে আরারাত পর্বতে নূহের নৌকার সন্ধান পেয়েছেন, জানাচ্ছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থের বহু উল্লেখের সূত্র ধরে মহাপ্লাবন নিয়ে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা মোটামুটি একমত, একটি বড় প্লাবন ঘটেছিল। বিজ্ঞানীদের ধারণার সঙ্গে ধর্মগ্রন্থের বর্ণনার সম্পূর্ণ মিল নেই, কিন্তু বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান অনেক অজানা বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ৯ হাজার ৪শ' বছর আগে এক উষ্ণায়নের কালে ভূমধ্যসাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়েছিল বলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সাধারণ একটি মত চালু আছে। এর আগে কৃষ্ণসাগর সুপেয় পানির জলাধার ছিল। কিন্তু এই প্লাবনের ফলে কৃষ্ণসাগরে লবণাক্ত পানি ঢুকে যায়। প্রচলিত একটি মত বলছে, এ সময় কৃষ্ণসাগরের পানি ১৯৫ ফুট পর্যন্ত উঠেছিল। এতে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় বসতি ডুবে যাওয়ার কথা। পরবর্তীকালে ভূতাত্তি্বকরা অবশ্য পানির উচ্চতা বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে তারা নিশ্চিত হয়েছেন পানির উচ্চতা ১৫-৩০ ফুট পর্যন্ত উঠেছিল। পানির উচ্চতা নিয়ে যেমন তর্ক আছে, তেমনি তর্ক আছে প্লাবনের সময়কাল নিয়েও। আবার এসব তর্ক-বিতর্কের দিকে মানুষের নজর ফিরেছে তুরস্কের খবরে। ইভানজেলিকাল ক্রিশ্চিয়ান প্রত্নতাত্তি্বকদের একটি দল বলছেন, তারা বরফ ও আগ্নেয়গিরির ধ্বংসাবশেষের নিচে নূহের নৌকা খুঁজে পেয়েছেন। এর আগে ২০০৬ সালে খবর বেরিয়েছিল ইরানে এমন একটি নৌকার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। সেবার ইরানের এলবুর্জ পর্বতমালার সুলেইমান পর্বতে নৌকা আকৃতির একটি পাথরের স্থাপনা পাওয়া গিয়েছিল। পাথর হলেও দেখতে তা ছিল একেবারে কাঠের মতো। বলা হয়েছিল, এটি অশ্মীভূত কাঠ। আবার অনেকে মনে করেন, প্লাবনের পর নৌকাটি পানিতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এবারের অনুসন্ধানকারীরা বলছেন, তারা ১০০ শতাংশ নিশ্চিত না হলেও ৯৯.৯৯ শতাংশ নিশ্চিত, এটিই নূহের নৌকা। তারা বলছেন, ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে তারা সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৩ হাজার ফুট ওপরে আরারাত পর্বতের চূড়ার কাছে চাপা পড়া সাতটি কাঠের কম্পার্টমেন্ট পেয়েছেন। ২০০৯ সালে প্রত্নতাত্তি্বক উপাদানগুলো ফিল্মে ধারণ করা হয়েছে। ওই প্রত্নস্থানের কাঠের রেডিও কার্বন ডেটিংও করা হয়েছে। এই ডেটিংয়ে কাঠের বয়স বেরিয়ে এসেছে ৪ হাজার ৮শ' বছর। জীববিজ্ঞানী টড উড বলছেন, সময়টা একটু কম হয়ে গেল। তিনি নিজেও বিশ্বাসী একজন বিজ্ঞানী। তবু সময় নিয়ে তার দ্বিধা। কেউ কেউ বলছেন, নূহের নৌকা তুরস্কেই পাওয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু অন্য পাহাড়ে। ফলে, আরারাত পর্বতের নৌকা অনেকের বিস্ময় জাগিয়েছে। তুরস্কের সরকার চিন্তা করছে, নূহের এই নৌকাকে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেজন্য এখনও বেশ পথ পাড়ি দিতে হবে। কারণ পণ্ডিতরা এখনও নানা মতে, নানা পথে বিভক্ত। বোঝা যাচ্ছে, পণ্ডিত মহলে এ নিয়ে বেশ তর্ক হবে।

Sunday, May 2, 2010

সমুদ্রশাসন


নদীশাসনের কথা অহরহ শোনা যায়। কখনও সেচের জন্য, কখনও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নদী শাসন করেছি আমরা। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং চীন নদীশাসনে রীতিমতো ওস্তাদ। তাদের বিদ্যুৎ যেমন দরকার তেমনি দরকার পানিও। এসব নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। বলা হয়ে থাকে, নদী শাসন করে জলাধার বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করার ধারণাগুলো এখন বড়মাত্রায় চীন ও ভারতেই প্রচলিত। পরিবেশের ওপর এর সার্বিক নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় ইউরোপ-আমেরিকায় নদীশাসনের উদ্যোগগুলো বন্ধ হতে চলেছে। নতুন উদ্যোগের কথা শোনা যায় কম, বরং বেশি শোনা যায় পুরনো জলাধার বা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিত্যক্ত ও বন্ধ হওয়ার খবর। নদীশাসন দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু সমুদ্রের বেলায় অনেকটাই ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। কী ভারতে কী বাংলাদেশে কেউ সমুদ্রশাসনের কথা ভাবতে পারেন না। অথচ এই ভারতের রাজা রামচন্দ্র একদা বানরদের সহায়তায় সমুদ্রে বিশাল সেতু নির্মাণ করে লঙ্কায় পাড়ি দিয়েছিলেন। সমুদ্রশাসনের এই ইতিহাস হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সেতুরও ইতিহাস। কিন্তু আধুনিককালে ভারতীয়রা সমুদ্রশাসনের কথা ভাবতে পারে না। মাঝে মধ্যে ভারতের কিছু উদ্যোগের কথা শোনা যায় বটে, কিন্তু উদ্যোগগুলো আর সামনে এগোয় না। বাংলাদেশে আমরা সমুদ্রের ইচ্ছার সামনে নতজানু। সমুদ্র, এই সেদিন বাংলাদেশের দ্বীপ তালপট্টি খেয়ে নিল। আমরা চুপ করে বসে থাকলাম। বললাম শুধু, ভাসা তালপট্টি আমাদের, ডোবা তালপট্টিও আমাদের। উত্তর মেরুর বরফ গলবে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। বাংলাদেশ কি ডুববে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, একবার ডুববে। দক্ষিণাঞ্চলের বহু মানুষ পরিবেশ-শরণার্থী হয়ে পড়বে। আরেকবার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডুববে না। নতুন ভূমি মিলবে বরং। দেশের আকার বাড়বে। বিজ্ঞানীদের গবেষণার অলৌকিক পেন্ডুলামে এখন বাংলাদেশের ডোবা-ভাসার আশঙ্কা ও আশা দুলছে এদিক-ওদিক। কিছুই করার নেই আমাদের। হয়তো ডোবা ও ভাসার যে কোনো একটি হলে তবেই আমরা বুঝব, আসলে কী ঘটল। এসবই মনে পড়ল, দক্ষিণ কোরিয়ার সমুদ্রশাসনের এক সংবাদ পড়ে। অবশ্য সংবাদ না বলে একে এক গল্প বলতে হয়। এখন পর্যন্ত সায়িমানজিয়াম সমুদ্র দেয়ালই মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় বাঁধ। পীত সাগর বা হলুদ সমুদ্রের বুকে ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বাঁধ দিয়ে কোরীয়রা সমুদ্রের ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে বেঁধে ফেলেছে। সমুদ্র বেঁধে দেশের আকৃতি একটু বাড়িয়ে নিল কোরীয়রা। এখন তারা এই স্থানে চাষবাস, কারখানা ও পর্যটনের বিকাশ ঘটাবে। এমনকি মিঠাপানির উৎসও নাকি হবে এই জায়গা। দক্ষিণ কোরিয়া বলছে, তাদের পশ্চিম উপকূলের শিল্প এলাকার দরজা হবে এই দেয়াল প্রকল্প। এর সঙ্গে যুক্ত হবে চার নদী প্রকল্প। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, সামান্য নদীশাসন নিয়ে আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সীমা থাকে না যেখানে, সেখানে বিশাল সমুদ্রকে বেঁধে ফেললে কি পরিবেশবাদীরা চুপ করে থাকে? না। এর দেয়ালের বিরুদ্ধেও তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
সুপ্রিম কোর্ট দুই দফা এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করেছিল। শেষ পর্যন্ত ২৭ এপ্রিল এর উদ্বোধন হলো। এমন সমুদ্রশাসনে কোরিয়ানরা প্রথম নয়, হয়তো শেষও নয়। সায়িমানজিয়াম সমুদ্র দেয়াল নেদারল্যান্ডসের অফসলুটডিক দেয়ালের চেয়ে মাত্র ৫০০ মিটার লম্বা। সমুদ্র দেয়ালের আরও উদাহরণ আছে। কিন্তু সমুদ্র শহর? কৃত্রিম এক সমুদ্র শহর হতে যাচ্ছে আরব আমিরাতে। প্রকল্পটির নাম পৃথিবী। পৃথিবীর ভূভাগের ম্যাপ অনুসরণ করে তৈরি করা এ প্রকল্পটির কাজ এগিয়ে চলেছে। খণ্ড খণ্ড দ্বীপ নিয়ে তৈরি এ পৃথিবী সমুদ্রশাসনের অনেক বড় প্রকল্প। যখন প্রকল্পটি শেষ হবে, তখন নাকি ৩২১ মিলিয়ন কিউবিক মিটার বালু আর ৩১ মিলিয়ন টন পাথর জমা হবে দ্বীপগুলোতে। বিশ্বমন্দার কবলে পড়ে, পৃথিবী প্রকল্পের কাজ আপাতত ধীরে চলছে। কিন্তু প্রকল্প শেষ হলে তা এক বিস্ময় তৈরি করবে নিশ্চিত। কিন্তু আপাতত সবচেয়ে বড় দেয়াল তৈরির জন্য কোরিয়ানদের বাহবা দিতে হবে।