Wednesday, December 15, 2010

কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে মনে হলো বাংলাদেশে ফিরেছি : অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম


মাহবুব মোর্শেদ
১৯৭১ সালে রফিকুল ইসলাম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ২৫ মার্চ দেখেছেন পাকিস্তানিদের বর্বরতম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। জুলাই থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে শেরেবাংলা নগরের ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে বন্দি রেখেছিল। সেপ্টেম্বরে স্থানান্তরিত করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বিচিত্র সেই অভিজ্ঞতা, অবরুদ্ধ ঢাকার ঘটনাবলি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
...................................
অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৪ সালে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ২৫ মার্চ তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায়। জুলাই মাসে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে রাখে, সেপ্টেম্বরে তাকে স্থানান্তর করে কেন্দ্রীয় কারাগারে, নভেম্বরে মুক্তি পান, ডিসেম্বরের প্রথম দিকে চলে যান আত্মগোপনে। বিচিত্র সেই অভিজ্ঞতা, অবরুদ্ধ ঢাকার ঘটনাবলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ

সমকাল : ২৫ মার্চ আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় ছিলেন। সে রাতে সেখানে কী ঘটেছিল?
রফিকুল ইসলাম : সে সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত অঞ্চলে থাকতাম। বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের পাশে তখন ৩টি বাড়ি (২৩, ২৪ ও ২৫ নম্বর) ছিল। আমি ২৪ নম্বর বাড়িতে থাকতাম। ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী সারারাত গোলাগুলি করার পর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। ইকবাল হলের ঘরে ঘরে ঢুকে শিক্ষক-ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে। ২৩ নম্বর বাড়িতে ড. ফজলুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। তার বাড়ির ছাদে আরও ৪৪ জন নিহত হয়। পাক হানাদার বাহিনী নীলক্ষেত বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দিলে এসব মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য ওই বাড়ির ছাদে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। এখানে এসে তাদের অনেকে নিহত হয়। ইয়াহিয়া খান তখন ঢাকায়। মিন্টো রোডের পুরনো গণভবনে ছিলেন তিনি। কিছু ইপিআর সৈন্য ইয়াহিয়া খানের বাড়ি পাহারা দিচ্ছিল। তারা কেউ কেউ সেখান থেকে পালিয়ে আসে। পালিয়ে আসা ইপিআর সদস্যদের রমনা মাঠে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাদের কয়েকজন ২৩ নম্বর বাড়িতে এসে মারা পড়েন। হানাদার বাহিনী আমাদের ২৪ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতেও অনেককে হত্যা এবং আহত করে রেখে চলে যায়। ২৫ নম্বরের সিঁড়িতেও অনেক নিহত লোক পাওয়া যায়। ২৫ মার্চ সারারাত, ২৬ মার্চ সারাদিন ও রাত এই আক্রমণের মধ্যেই আমরা ছিলাম। জাহানারা ইমাম আমার ছাত্রী ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালবেলা তিনি ও রুমী এসে একটি ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে আমাকে আমার পরিবার-পরিজনসহ ধানমণ্ডিতে ওর মায়ের বাড়ি নিয়ে যান। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছিল ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মনিরুজ্জামান, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ড. ফজলুর রহমানসহ আরও অনেক শিক্ষককে। আবার যুদ্ধ শেষে আত্মসমর্পণের আগে তারা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, পাক হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে এবং শেষও করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে। প্রথম হত্যাকাণ্ডটি পাকবাহিনী নিজেরাই ঘটায়। আর শেষ হত্যাকাণ্ডটি তারা ঘটিয়েছিল তাদের এদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে। তারাই খুঁজে খুঁজে বের করে বুদ্ধিজীবীরা কে কোথায় আছেন।
সমকাল : আপনারা ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করেছেন?
রফিকুল ইসলাম : আমার বাবা থাকতেন আর কে মিশন রোডে। একদিন রাতে ওখানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। খাট থেকে নিচে শুতে গিয়ে আমার বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার ভাই-বোন (আতিকুল ইসলাম এবং মাসুমা খাতুন) তখন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে থাকত। কারফিউর মধ্যে গাড়ি চালিয়ে এসে ওরা বাবাকে মেডিকেলে ভর্তি করায়। আমি লুকিয়ে ছিলাম। বাবাকে দেখাশোনা করার জন্য আমাকে বেরুতে হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে চলে এলাম, যাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি বাবাকে দেখাশোনা করতে পারি। মেডিকেলে তখন মাঝে মধ্যেই আর্মিরা আসত। সবসময় একটা ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করত। আর্মিরা এসে সবকিছু চেক করত। সেখানে তখন কিছু অবাঙালি ডাক্তার ছিল। তারাই পরে ডা. ফজলে রাব্বী এবং ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীকে ধরিয়ে দেয়। আর্মি এসে চেক করত কারা রোগী এবং কারা ভিজিটর। বাবাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। তিনি মারা যাওয়ার পর জুলাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৪ শিক্ষকসহ আমি গ্রেফতার হই। আমার সঙ্গে যারা গ্রেফতার হন তারা হলেন ইতিহাস বিভাগের ড. আবুল খয়ের, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সা'দ উদ্দিন, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আহসানুল হক এবং গণিত বিভাগের অধ্যাপক শহীদুল্লাহ। আর্মি সদস্যরা এসে মধ্যরাতে আমাদের ধরে নিয়ে যায়। ডা. ফজলে রাব্বী আমার বাবার চিকিৎসা করতেন। তিনি আমাকে বলতেন, চলুন আমরা বর্ডার ক্রস করে চলে যাই। আমি বললাম, বাবাকে এ অবস্থায় রেখে কী করে যাব? বাবা মারা যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা গ্রেফতার হয়ে যাই। কাজেই আমরা বর্ডার ক্রস করতে পারিনি।
সমকাল : আপনাদের কোথায় রেখেছিল?
রফিকুল ইসলাম : শেরেবাংলা নগরে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডো ইউনিট ছিল। তার মাঝখানে ছিল তাদের ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টার। সেখানে ধরে নিয়ে গিয়ে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করত। সেখানে আমাদের মাসের পর মাস বন্দি রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমাদের আলাদা আলাদা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ওটাকে তখন বলা হতো ভিআইপি কেজ বা ভিআইপি খাঁচা। ওখানে কিছু আর্মি অফিসার, কিছু সিএসপি অফিসার_ যারা ডিসি অথবা এসপি ছিলেন, রাজনীতিবিদ, বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ জনের মতো আমরা সেখানে বন্দি ছিলাম। এসও কোম্পানির কর্মকর্তা আলমগীর রহমান, ফরিদপুরের ডিসি ইউসুফ, কুষ্টিয়ার এসপি মিহির, টেলিকমিউনিকেশন্সের প্রধান লোকমান হাকিম এবং আরও অনেকেই সেখানে ছিলেন। পরে আমাদের মুক্তির জন্য একটা আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়। সে কারণেই সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাসে তারা আমাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করে। যার ফলে আমরা প্রাণে বেঁচে যাই। শেরেবাংলা নগরের ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে থাকলে আমরা হয়তো বেঁচে নাও থাকতে পারতাম। ডিসেম্বরে ভারতীয় বিমানের হামলায় ভবনটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও নিয়মিত তেজগাঁওয়ে আর্মির কার্যালয়ে গিয়ে হাজিরা দিতে হতো।
সমকাল : জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা কী জানতে চাইত?
রফিকুল ইসলাম : শুরুর দিকে প্রতিদিন জিজ্ঞাসাবাদ করত। সারাদিন একটা ঘরে দাঁড় করিয়ে রেখে কয়েকজন মিলে জিজ্ঞাসাবাদ করত। তারা সবাই ছিল সিভিল ড্রেসে। কখনও আর্মি অফিসার, নেভি অফিসার, এয়ারফোর্স অফিসার, পাঞ্জাব পুলিশের অফিসার এবং কখনও স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করত। নানা বিষয়ে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করত। তবে জিজ্ঞাসাবাদে বঙ্গবন্ধুর বিষয়টি ছিল কমন। এছাড়া জঘন্য কিছু বিষয়ে তারা প্রশ্ন করত, যা বলার মতো নয়। গালি দিত। তারা যে অসভ্য ও বর্বর তা তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভাষায় ফুটে উঠত। ওরা উর্দুতে জিজ্ঞাসাবাদ করত আর আমরা ইংরেজিতে উত্তর দিতাম। এতে ওরা ভীষণ বিরক্ত হতো। ওরা ওদের পক্ষে একটা স্টেটমেন্টে সাইন করাতে চেয়েছিল। কাগজে কী লেখা আছে সেটি আমাদের পড়তে দিত না, শুধু সাইন করতে বলত। শত চাপ সত্ত্বেও তারা সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত শান্তি কমিটির মৌলবি ফরিদ আহমদকে পাঠায়। সে এসে বলল, মাস্টার সাহেব আপনারা এত কষ্ট করছেন কেন। একটা সাইন দিলেই তো আমি আপনাদের বাড়িতে পেঁৗছে দিতে পারি। তখন আমি বললাম, আপনি এসেছেন এজন্য ধন্যবাদ। তবে আমরা চাই না যে আমাদের সন্তানরা জানুক তাদের পিতারা দালাল ছিল। আমরা তো ধরেই নিয়েছি আপনারা আমাদের মেরে ফেলবেন। কাজেই আমরা পাঁচজন শিক্ষক কোনো কাগজে স্বাক্ষর করিনি। তারা আমাদের শারীরিক নির্যাতন করেছে। কিন্তু তারপরও আমাদের দ্বারা কোনো কাগজে স্বাক্ষর করাতে পারেনি।
সমকাল : ভিআইপি কেইজ থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে কী দেখলেন?
রফিকুল ইসলাম : শেরেবাংলা নগর থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার সময় আমাদের মনে হচ্ছিল যেন দোজখ থেকে বেহেশতে যাচ্ছি। কেন্দ্রীয় কারাগার তখন মানুষে ভরে গিয়েছিল। বন্দিদের মধ্যে মূলত রাজনৈতিক কর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাই ছিল বেশি। আমরা সেখানে পেঁৗছলে ছাত্ররা আমাদের মাথায় তুলে নিল। আমাদের পেয়ে তারা অনেক যত্ন করল। হৈ-হুল্লোড় জুড়ে দিল। কেন্দ্রীয় কারাগারে পেঁৗছে মনে হলো বাংলাদেশে ফিরেছি। মনেই হয়নি যে আমরা জেলে আছি।
সমকাল : জেলখানা থেকে বের হয়ে ঢাকার পরিস্থিতি কী দেখলেন?
রফিকুল ইসলাম : নভেম্বরের সে সময়টিতে ঢাকা শহরের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। গোটা শহর ছিল বিরানভূমির মতো। কেউ এক ঠিকানায় দু'তিন দিনের বেশি থাকছে না। ভারতীয় বাহিনীর বোম্বিং শুরু হওয়ার পর অবস্থা আরও ভয়াবহ আকারে রূপ নিল। হানাদাররা কখন, কোথায় কাকে হত্যা করছে, তুলে নিয়ে যাচ্ছে, বন্দি করছে তার কোনো ঠিক ছিল না। হানাদার আর্মিদের চেয়েও বেশি অত্যাচার করত বিহারি রাজাকাররা।
সমকাল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি কেমন ছিল?
রফিকুল ইসলাম : যুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। তবে জুন মাসে জোর করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলানো হয়েছিল। ইউনিভার্সিটি খোলার পর সেখানে প্রতিদিন গ্রেনেড হামলা হতো। ইসলামী ছাত্র সংঘের কিছু ছাত্র ক্লাসে আসত। কিছু মুক্তিযোদ্ধাও ক্লাস খোলা থাকার সুযোগে ঢুকে যেত। বাথরুমে কিংবা অন্য কোনো ছলে বাইরে গিয়ে তারাই ওপর থেকে নিচে বোমা ফেলত। খুব বিকট আওয়াজ হতো সেসব বোমার। বোমা হামলার পর আর্মি আসত। কিন্তু কারা বোমা হামলা করল সেটা তারা কোনোদিন বের করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেউই নিজেদের বাড়িতে থাকতেন না। সবাই এদিক-সেদিক থাকতেন।
সমকাল : আবাসিক হলগুলোর পরিস্থিতি কেমন ছিল?
রফিকুল ইসলাম : একটি বিশেষ ঘটনার কথা আমার মনে আছে। নভেম্বর শেষ দিকে পাক আর্মি রোকেয়া হলে তল্লাশি চালায়। সেখানে কয়েকজন মেয়েকে ধর্ষণ করে। আমার মনে হয় ওরা হলে থেকে গিয়েছিল এবং সম্ভবত ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে জড়িত ছিল। ঘটনাটি সবাই একেবারে চেপে যায়। ওয়াশিংটন ডিসিতে লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে ডন পত্রিকার ফাইল থেকে খবরটি আমি বের করেছিলাম পরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ঘটনাটি চেপে গেছে। মেয়েদের পরে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। মিসেস আলী ইমাম তখন ছিলেন হাউস টিউটর। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমার কাছে কোনো কিছু বলেননি। আমার এক ছাত্রী আরবি বিভাগের শিক্ষিকা ও হাউস টিউটর ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমার কাছে ঘটনাটি স্বীকার করেন।
সমকাল : বাংলাদেশবিরোধী শিক্ষকদের তৎপরতা কেমন ছিল?
রফিকুল ইসলাম : উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী তখন লন্ডনে ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনকে উপাচার্য করে নিয়ে আসা হয়। তিনি পাকিস্তানিদের বিশ্বস্ত ছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ড. হাসান জামান পাকিস্তানিদের খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশনের (বিএনআর) পরিচালক ছিলেন। টিক্কা খান এটাকে ইনস্টিটিউট ফর পাকিস্তান স্টাডিজ নামে একটি ইনস্টিটিউটে পরিণত করে। এর অফিস ছিল তখন আবদুল গনি রোডের ১ নম্বর বাড়িতে। ওই জায়গাটা তখন ছিল দালাল শিক্ষকদের আখড়া। পাকিস্তান আর্মি সব সময় হাসান জামানের বাড়ি পাহারা দিত। সে ছাড়া আরেকজন ছিল ইতিহাস বিভাগের ড. মোহর আলী। তারা পাকিস্তানের পক্ষে টেলিভিশনে নানা রকম অনুষ্ঠান করত। শিক্ষকদের সম্পর্কে পাকিস্তানিদের খোঁজখবর দিত তারাই। পরে এরা দেশত্যাগ করে চলে যায়। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন পরে দেশে আসেন। হাসান জামান সম্ভবত মারা গেছেন এবং মোহর আলী সম্ভবত সৌদি আরবে আছেন।
সমকাল : আর্মিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করেছিল?
রফিকুল ইসলাম : টিএসসির দিকে তাদের একটা ক্যাম্প ছিল। সবসময় জিপে টহল দিত। আমরা তখন নিজ দেশে পরবাসী ছিলাম। দেশটা ছিল একটা মৃত্যুপুরী।
সমকাল : কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর সেনানিবাসে হাজিরা দিতে গেলে তারা আপনাদের কী জিজ্ঞেস করত?
রফিকুল ইসলাম : আর্মি অফিসাররা আমাদের দু'একটা প্রশ্ন করত। নিজেদের মধ্যেই তারা কথা বলত বেশি। পরিস্থিতি নিয়ে তারা আলোচনা করত। না জানি কী হয়ে যায়, এমন কথাও আমার কানে এসেছিল। ওদের মধ্যে তখন ভয় ঢুকে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা ঘেরাও করে ফেলেছিল। পাকিস্তানি অফিসারদের তখন খুব নার্ভাস মনে হতো।
সমকাল : সর্বশেষ হাজিরা দিয়েছেন কবে?
রফিকুল ইসলাম : সর্বশেষ হাজির দেই ডিসেম্বরের ৯ তারিখে। ১০ ডিসেম্বর আমার বোন মাসুমা খাতুন আমাকে একটা ঠিকানা দিয়ে বলল, এখনই তুমি এই ঠিকানায় চলে যাও। পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলছে, পালাও। এরপর আমি সপরিবারে পুরান ঢাকার কাছে চুড়িহাট্টায় এক গ্যারেজে গিয়ে আশ্রয় নিলাম।
সমকাল : কত দিন থাকলেন?
রফিকুল ইসলাম : যুদ্ধের শেষ চার দিন আমরা ওখানেই ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর আমি ছিলাম চুড়িহাট্টায়। সেদিন বের হতে পারিনি। আমি বের হই ১৭ তারিখে।
সমকাল : ঢাকায় ফিরে কী দেখলেন?
রফিকুল ইসলাম : ঢাকায় ফিরেই জানলাম, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, গিয়াস উদ্দিন আহমদ_ তারা নেই। আমাদের কোনো বিজয় উৎসব ছিল না। আমরা তখন লাশের সন্ধানে ব্যস্ত। আমাদের ডিসেম্বর কেটেছে সহকর্মীদের লাশ খুঁজে। কখনও মিরপুর আবার কখনও মোহাম্মদপুরে ছুটে গেছি। যেখানেই খবর পেয়েছি একটা লাশ পাওয়া গেছে সেখানেই আমরা ছুটে গিয়েছি।
সমকাল : রায়েরবাজারে গিয়ে কী দেখেছিলেন?
রফিকুল ইসলাম : রায়েরবাজার গিয়ে খুব কম লোককেই আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। কারণ, ততক্ষণে লাশগুলো শিয়াল, কুকুর এবং শকুন খেয়ে ফেলেছে। কাউকে ঠিকমতো চেনা যাচ্ছিল না। অনেককে মিরপুর নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের লাশ কোনোভাবেই পাওয়া যাচ্ছিল না। যে বাসে করে তাদের মিরপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই বাসের ড্রাইভারকে টাঙ্গাইল থেকে ধরে আনার পর সে আমাদের জায়গাটি দেখিয়ে দেয়। সেখানে আমরা কাদা লেপা একটি বাসও দেখেছিলাম। মিরপুরে আমরা ১১টি লাশ পাই। লাশগুলো শনাক্ত করে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে দাফন করা হয়।
সমকাল : ডিসেম্বরের শেষ দিকের পরিস্থিতি কেমন ছিল?
রফিকুল ইসলাম : ১৬ ডিসেম্বরের পর সব মানুষ ঢাকায় ফিরতে শুরু করে। কে বেঁচে আছে, কে মারা গেল, মুক্তিযুদ্ধে যারা গেছে তারা ফিরল কি-না এসব নিয়ে খোঁজখবর শুরু হতে থাকে। মানুষের মনে আরেকটি জিজ্ঞাসা ছিল_ বঙ্গবন্ধুর কী হলো? তিনি কবে দেশে ফিরবেন? ১০ জানুয়ারির আগে একদিন গুজব রটল বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরছেন। তখন গোটা ঢাকা শহরের মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি শুরু হলো। মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের দিকে অস্ত্র তাক করে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করল। বঙ্গবন্ধু যেদিন ধানমণ্ডিতে ফিরে আসেন বিজয় উৎসবটা সেদিনই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বিজয় তখন পরিপূর্ণ ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া মানুষ বিজয় উৎসব করেনি।
সমকাল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক গতি ফিরে এলো কবে?
রফিকুল ইসলাম : আমার যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে। মোজাফফর আহমদ চৌধুরী উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ১৬ ডিসেম্বরের পরপরই শিক্ষক-ছাত্ররা ফিরতে শুরু করেছিলেন। তখন থেকেই কোন বিভাগের কোন কোন ছাত্র-শিক্ষক ফিরল আর কে কে ফিরল না সেসব সম্পর্কে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছিল।

Tuesday, December 14, 2010

বঙ্গবন্ধুবিহীন স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ : তোফায়েল আহমেদ


মাহবুব মোর্শেদ
১৯৬৯ সালে তোফায়েল আহমেদ ছিলেন ডাকসু ভিপি এবং ছাত্রলীগ সভাপতি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে ২৭ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের পরের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, তখনও স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ। কারণ বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব, ২৫ মার্চের ঘটনাবলি, মুজিব বাহিনীর কর্মতৎপরতা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৫
...............................................
সমকাল : সমকালের আয়োজন মূলত ১৯৭১-এর ডিসেম্বর নিয়ে, ডিসেম্বরের ঘটনাবলি নিয়েই আপনাকে প্রশ্ন করব।
তোফায়েল আহমেদ : ডিসেম্বরের ঘটনাবলির কথা বলতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে একাত্তরের ডিসেম্বরের আগের কিছু উজ্জ্বল সময়ের কাছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে ধাপে ধাপে তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি ২১ দফা পেশ করেন। ২১ দফায় স্বায়ত্তশাসনের দাবি ফুটে উঠেছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে সংগ্রাম তিনি করেছিলেন- ১৯৬০-এর দশকে তা মোটামুটি সমস্ত বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল। আমার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশের দিনগুলো। ৬ দফা পেশ করার পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠকে যখন স্তব্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেদিন আমরা আবার জেগে উঠেছিলাম। আমরা ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করি। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিলের জন্য আমরা আন্দোলন শুরু করি। আমি তখন ডাকসুর ভিপি, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র। ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে মাত্র ৫০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলাম, ২০ জানুয়ারি আসাদ শহীদ হওয়ার পর হাজার হাজার মানুষের সামনে আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ নিয়ে বলেছিলাম, আসাদ তুমি চলে গেছ, তোমার এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টনে বিশাল জনসমুদ্রে সভাপতি হিসেবে ভাষণ দেওয়ার পর স্লোগান উঠেছিল_ শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করব। শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মাগো তোমায় মুক্ত করব। অনেক রক্ত_ আসাদ, মতিউর, মকবুল, রুস্তম, ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের রক্ত, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহার রক্তের মধ্য দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি জনসভা থেকে যখন আলটিমেটাম দিলাম, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের নেতা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে, তখন ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান বাংলার জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিল। রেসকোর্সে ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম ঐক্যপরিষদের ১০ লক্ষাধিক লোকের জনসভায় জাতির পক্ষ থেকে আমিই 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম। '৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করল না। তারপর এলো ১ মার্চ। সেদিন হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু সভা করেন। আমিও ২৭ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় উপস্থিত থেকেছি। ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের পর ভোলা থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন_ প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্ধাহারে-অনাহারে আমাদের লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে, এবার যদি রক্ত দেই আমরা বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দেব। ৭ মার্চ ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিরীহ বাঙালিকে সশস্ত্র বাঙালিতে পরিণত করেছিলেন একথা বলে_ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।
সমকাল : ৭ মার্চের ভাষণের পর কি আপনাদের প্রস্তুতি শুরু হলো?
তোফায়েল আহমেদ : ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের দায়িত্ব দিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং আমাকে। পরে এটি মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত হয়। আমরা চারজন নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নিই। কেউ ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, কেউ যুব সমাজকে সংগঠিত করা, কেউ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের একত্র করার দায়িত্ব পেলেন। আতাউল গনি ওসমানী সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আমাকে ট্যাগ করে দিলেন। ১৭ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যে আলোচনা করতেন আমাদের তার সবকিছুই অবহিত করতেন। আমাদের তিনি সবসময় বলতেন_ তোমরা প্রস্তুত হয়ে যাও। ইয়াহিয়া খান সময় নষ্ট করছে। সে সময় নিচ্ছে। আমারও সময় দরকার। এ আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। তখন আমরা কেরানীগঞ্জসহ সারা বাংলাদেশে অস্ত্র ট্রেনিং শুরু করলাম। নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ ছাত্রনেতা ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেন আর আমরা যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করি। একত্রে বসে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এরপর এলো ২৫ মার্চ।
সমকাল : ২৫ মার্চ আপনি ৩২ নম্বরে ছিলেন?
তোফায়েল আহমেদ : ২৫ মার্চ দিনের বেলা আমি ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়িতে সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই ছিলাম। সবাইকে তিনি বিদায় করে দিয়ে যার যার কাজে যেতে বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, একজন মানুষ হিসেবে জাতিকে যা দেওয়া দরকার তা আমি দিয়েছি। সেদিন ছিল হরতাল। সফলতার সঙ্গে আমরা হরতাল পালন করি।
সমকাল : আপনাকে কিছু বললেন?
তোফায়েল আহমেদ : আমাকেও বললেন, তোমার মনে হয় চলে যাওয়া উচিত। আমি বললাম, আপনি যাবেন না? তিনি বললেন, আমিই-বা যাব কেন? আমি তো নেতা। আমি তো যেতে পারি না। ওরা এসে যদি আমাকে না পায় তাহলে ওরা সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যাবে। ঢাকা শহরকে পুড়িয়ে ওরা ছারখার করে দেবে। লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করবে। বরং আমি থাকব। তোমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জায়গায় চলে যাও। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে অনেক তৃপ্ত মনে হয়েছিল। বলেছিলেন, আজ একটা সফল হরতাল হয়েছে। এই প্রথমবার বাঙালিদের কথামতো বাংলাদেশ চলছে। আমি যা বলেছি, মানুষ তা গ্রহণ করেছে। এরপর আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
সমকাল : কখন?
তোফায়েল আহমেদ : এরপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমি এবং মনি ভাই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আবার গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি তার ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন। আমাদের দেখে বললেন, আবার তোমরা এসেছ? আমাকে তিনি পাঁচ হাজার টাকা দিলেন। আরও প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশ দিয়ে তিনি বললেন, তোমরা যাও। আমি দোয়া করি। আমরা তাকে সালাম করলে তিনি আমাদের বুকে টেনে নিলেন।
সমকাল : আপনাদের সঙ্গে আর কেউ দেখা করতে গিয়েছিলেন?
তোফায়েল আহমেদ : ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করা শেষ ব্যক্তি ছিলাম আমরা দু'জন। আমাদের আগে ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ওরা যখন ক্র্যাকডাউন করবে আমি তখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেব।
সমকাল : ৩২ নম্বর থেকে বেরিয়ে?
তোফায়েল আহমেদ : ওখান থেকে গিয়ে মনি ভাইয়ের ফকিরাপুলের বাসায় আমরা থাকলাম। রাত ১২টা ১ মিনিটে আর্মি যখন ক্র্যাকডাউন শুরু করল বঙ্গবন্ধু তখন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। বললেন, আজ থেকে আমার দেশ স্বাধীন। যতক্ষণ পর্যন্ত হানাদারমুক্ত করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। পাক আর্মি এরপর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল।
সমকাল : আপনারা ঢাকা ছাড়লেন কবে?
তোফায়েল আহমেদ : ২৭ তারিখে ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করার পর মনি ভাইয়ের বাসা থেকে আমরা বের হই। এ ইউ আহমদের ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে আমরা রওয়ানা হয়েছিলাম। গুলিস্তান পর্যন্ত যেতে পেরেছি। তারপর আর যেতে পারিনি। রাস্তা ছিল মানুষে পরিপূর্ণ। এরপর হেঁটে গেলাম সদরঘাট। নদী পার হয়ে গেলাম কেরানীগঞ্জের বোরহানউদ্দিন গগন সাহেবের বাড়িতে। ২৯ তারিখ গগন সাহেবের বাড়ি থেকে আমরা প্রথমে নবাবগঞ্জ, তারপর মানিকগঞ্জ গেলাম। সেখান থেকে ইঞ্জিনের নৌকায় করে আমরা সিরাজগঞ্জ গেলাম। ড. আবু হেনা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি যে পথে কলকাতা গিয়েছিলেন সে পথেই আমরা এগোতে থাকলাম।
সমকাল : কলকাতা যাওয়ার কোনো নির্দেশনা কি বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন আপনাদের?
তোফায়েল আহমেদ : ১৯৭১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু তার চার কলিগ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামানকে ডেকেছিলেন। আমাদের চারজনকেও; শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং আমাকে। ডেকে তিনি একটা ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ঠিকানাটি হলো চিত্তরঞ্জন ছুতার, ভবানীপুর, ২১ নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, কলকাতা। এই ঠিকানায় তিনি আমাদের উঠতে বলেছিলেন। তখন কলকাতা, বনগাঁ এবং আগরতলায় আমাদের জন্য বাড়ি ঠিক করা হয়েছিল। হিলি বর্ডার পার হয়ে ফারাক্কা ব্যারাজের ওপর দিয়ে আমরা এপ্রিলের ৪ তারিখে কলকাতায় পেঁৗছেছিলাম।
সমকাল : কলকাতায় আপনারা প্রাথমিকভাবে কী কাজ করলেন?
তোফায়েল আহমেদ : কলকাতায় গিয়ে আমরা বিএলএফকে চার ভাগে ভাগ করলাম। আমাদের প্রশিক্ষণ হতো দেরাদুনের তান্দুয়ায়।
সমকাল : বিএলএফে আপনার দায়িত্ব কী ছিল?
তোফায়েল আহমেদ : আমার অধীনে ছিল ৭টি জেলা_ পাবনা, বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল এবং পটুয়াখালী। আমি থাকতাম কলকাতা হেডকোয়ার্টারে। যা রসদ আসত তা সেক্টরগুলোতে বণ্টন করতাম। কোনো ভুল বোঝাবুঝি যাতে না হয় সেজন্য বিএলএফ ও এফএফের মধ্যে কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করতে হতো আমাকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। তিনি আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে আমরা ভারতীয় কূটনীতিক ডিপি ধরের সঙ্গে বহুদিন মিটিং করেছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ উপদেষ্টা ডিপি ধর মুজিবনগর সরকার এবং আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করতেন। আমাদের প্রয়োজন এবং চাহিদা সম্পর্কে অবগত হতেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দেরাদুনে আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন জেনারেল এস উবান। আর কলকাতায় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন মি. নাথ। আমাদের তিনি টাকা-পয়সা দিয়ে যেতেন। আর্মির তরফ থেকে আমাদের সঙ্গে কোঅর্ডিনেট করতেন জেনারেল সরকার। ভারত আমাদের অর্থ, অস্ত্র এবং আশ্রয় দিয়েছে। এজন্য ভারতের কাছে আমরা ঋণী।
সমকাল : মুজিব বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যে কি কখনও কোনো দ্বিমত হয়েছিল?
তোফায়েল আহমেদ : না এমনটি হতো না। আর হলেও সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে বসে আমরা সেটা সমাধান করতাম।
সমকাল : কখন আপনারা বুঝলেন দেশ মুক্তির দ্বারপ্রান্তে?
তোফায়েল আহমেদ : নভেম্বর থেকেই আমরা বুঝতে পারলাম সময় আর নেই। ডিসেম্বর মাস আমাদের আকাঙ্ক্ষার মাস। ডিসেম্বর মাসেই আমরা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করলাম, দেশ স্বাধীন হবেই। বাংলা মাকে মুক্ত করার যে স্লোগান আমরা দিয়েছিলাম ১৬ ডিসেম্বর তা বাস্তবায়িত হলো।
সমকাল : ১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণ হচ্ছে এ খবরটা আপনি কখন পেয়েছিলেন?
তোফায়েল আহমেদ : ৬ ডিসেম্বর আমরা মুক্ত যশোরে আসি। পাকবাহিনী যখন একের পর এক বিভিন্ন জায়গায় পর্যুদস্ত হচ্ছিল, তখন আমরা ধরেই নিয়েছি ওরা আত্মসমর্পণ করবে। সপ্তম নৌবহর প্রেরণকেও আমরা ভয় পাইনি। পাকবাহিনী যদি আরও দেরি করত তাহলে তাদের ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি হতো। তাই বাধ্য হয়ে ওরা আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের সময় আমি তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে ছিলাম।
সমকাল :আপনারা সবাই তখন থিয়েটার রোডে ছিলেন?
তোফায়েল আহমেদ : না। নিজ নিজ সেক্টর মুক্ত হওয়ার পর বিএলএফের অন্য নেতারা নিজ নিজ সেক্টরে অবস্থান করছিলেন। শুধু আমি কলকাতায় ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বরের পর আমরা মিলিত হই।
সমকাল : আপনারা ঢাকা ফিরেছিলেন কবে?
তোফায়েল আহমেদ : ১৮ ডিসেম্বর আমি এবং রাজ্জাক ভাই হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এলাম।
সমকাল : ঢাকায় এসে?
তোফায়েল আহমেদ : সোজা চলে গেলাম শ্রদ্ধেয়া ভাবী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে। ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রোডে যেখানে তাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তখনও আমাদের স্বাধীনতা অপূর্ণ। কারণ বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি তিনি। প্রকৃতপক্ষে আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম ১০ জানুয়ারি, যেদিন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসেছিলেন।

Sunday, December 12, 2010

বিজয় মিছিলে আমি পাগলের মতো আলীমকে খুঁজেছি : শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী


মাহবুব মোর্শেদ
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আ ফ ম আবদুল আলীম চৌধুরী একাত্তরে যুদ্ধের পুরো সময়টা ছিলেন ঢাকার পুরানা পল্টনে। ক্যামোফ্লেজ ক্লিনিক তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন নানা প্রক্রিয়ায়। প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর সদস্যরা। তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী সমকালকে জানিয়েছেন সেই দুঃসহ স্মৃতি, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, '৭১-এর ঢাকার কথা। ষ বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৫
.......................................................
শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর জন্ম ১৯৪২ সালে। স্বামী শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আ ফ ম আবদুল আলীম চৌধুরীর সঙ্গে একাত্তরে ছিলেন ঢাকার পুরানা পল্টনে। ডা. আলীম মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন, তাদের জন্য টাকা তুলেছেন, ক্যামোফ্লেজ ক্লিনিক তৈরি করে চিকিৎসা দিয়েছেন, শ্যামলী নাসরিন তখন তাদের জন্য সোয়েটার বুনেছেন। অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন ডা. আলীমের কাজে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের এ সমর্থনের কারণেই পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর সদস্যরা। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী জানিয়েছেন, শেষ ডিসেম্বরের দুঃসহ সেই স্মৃতি, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, '৭১-এর ঢাকার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ


সমকাল : মার্চে সবাই ঢাকা ছাড়ল কিন্তু আপনারা থেকে গেলেন কেন?
শ্যামলী নাসরিন : মার্চে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা বারবার ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম দেশে একটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। ডা. আলীম কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২৫ মার্চের আগে থেকেই ডা. আলীম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা তৎপরতা শুরু করেন। তখন তার চেম্বার ছিল ৬২/২ পুরানা পল্টনে। আমাদের বাসা ছিল ২৯/১ পুরানা পল্টনে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি তার চেম্বার স্থানান্তর করে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। এটা তিনি করেছিলেন কাজের সুবিধার জন্য। বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার স্বামীর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তখন তিনি থাকতেন মগবাজারের একটি বাসায়। ২৫ মার্চ রাত ১১টার সময় আমার এক ভাগ্নে ফোন করে বলল, আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। এখন সৈয়দ নজরুল সাহেবকে কোথায় লুকানো যায়? খুব তাড়াতাড়ি করে ঘটনাটি আমি আমার স্বামীকে বললাম। এক মুহূর্তও চিন্তা না করে তিনি বললেন, এখনই ওনাকে আমাদের বাসায় দিয়ে যেতে বল। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি আমাদের বাসায় এলেন। উনি তখন ছিলেন প্রায় উদভ্রান্তের মতো। মনটা খুব খারাপ। ওনাকে নিয়ে আমরা অস্থির হয়ে পড়লাম। আমাদের বাসার তৃতীয় তলায় ছোট্ট একটি ঘর ছিল। সেখানে আমরা তাকে রাখলাম। তিনি তখন ছিলেন খুব অস্থির। ঘরে চুপ করে বসে থাকতে পারছিলেন না। পরে আমরা তাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখলাম। বোম্বিং শুরু হওয়ার পর আমরা নিজের কথা ভাবিনি। শুধু ভেবেছি কী করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে রক্ষা করা যায়। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হওয়ার পর আমরা ওনাকে বের করার চেষ্টা করলাম। কারণ, এখানে থাকলে ওনাকে বাঁচানো যাবে না। আর তাকে বাঁচানোটাও ছিল খুব জরুরি। কারণ, রাজনৈতিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর পরই তার অবস্থান। আর বঙ্গবন্ধুর কী হয়েছে সেটা তখন পর্যন্ত আমরা জানি না। খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা চলল। পরে সৈয়দ নজরুল সাহেবকে শাড়ি-বোরকা পরিয়ে রিকশায় করে হোসনী দালানে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেখান থেকে তাকে ঢাকার বাইরে পাঠানো হলো। মনে আছে ২৫ মার্চ অনেক রাতে আমার স্বামী বাসায় ফিরেছে। কারণ, ওনার চেম্বারে অনেক মানুষ আটকা পড়েছিল। তখন তিনি তার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাইকে তাদের বাড়ি বাড়ি পেঁৗছে দিয়ে এসেছেন। এদিকে আমাদের বাসাতেও অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। কারফিউ শিথিল হলে ডাক্তার সাহেব গাড়িতে করে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে পেঁৗছে দিয়ে আসতেন। ডাক্তার সাহেব বলতেন, ভেতর থেকে আমরা যদি গেরিলা যোদ্ধাদের সাহায্য না করি তাহলে তারা আশ্রয় পাবে কোথায়? তাদের সাহায্য করার জন্যই আমাদের ঢাকায় থাকতে হবে।
সমকাল : ডা. আলীমের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন বলে জেনেছি আমরা।
শ্যামলী নাসরিন : ওনার কাছে তখন মুক্তিযোদ্ধারা আসত। তিনি তাদের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি গাড়িতে করে তাদের নিরাপদ জায়গায় পেঁৗছে দিতেন। ক্যামোফ্লেজ হাসপাতাল খুলেছিলেন তখন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য। গোপন কোনো একটা জায়গায় হাসপাতালটি ছিল। ডা. ফজলে রাবি্বর সঙ্গে সেখানে গিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতেন। হাসপাতাল কোথায় সেটি তিনি আমাকেও বলতেন না। আমি স্কুলে যেতাম, আলাপে আলাপে যদি কারও কাছে প্রকাশ করে দিই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ডাক্তারদের কাছে গিয়ে তিনি চাঁদা সংগ্রহ করতেন। বন্ধুদের কাছে শুনেছি তখন ডাক্তার আলীম চৌধুরীর গাড়ি দেখে অনেক ডাক্তারই দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিতেন। ওষুধ ফ্যাক্টরিগুলোতে গিয়ে তিনি ওষুধ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি পেঁৗছে দিতেন। চেম্বারে বসে যে টাকা তিনি পেতেন অর্ধেকেরও কম নিজের কাছে রেখে বাকি টাকা মুক্তিযুদ্ধের জন্য দিয়ে দিতেন।
সমকাল : আপনাদের বাসার ক্লিনিকটা বন্ধ হয়ে গেল কখন?
শ্যামলী নাসরিন : জুলাইয়ে মাওলানা মান্নান আমাদের বাসার নিচে আসার পর ক্লিনিকটা বন্ধ হয়ে গেল। পল্টনের চেম্বারটা ছিল। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়। আমাদের বাসার ক্লিনিকটা মোটামুটি খালি। পিডিপির মতিন সাহেব তখন আমাদের পাশের বাসায় থাকত। বৃষ্টি পড়ছে, এমন সময় তিনি একজন লোককে নিয়ে আমাদের বাসায় উপস্থিত হলেন। এসে বললেন, এক ভদ্রলোক খুব বিপদে পড়েছেন। তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে আশ্রয় দিতে হবে। দু'দিন থেকেই তিনি চলে যাবেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি এত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি, কাউকে দেখে আমার কখনো খারাপ লাগেনি। কিন্তু ওই লোকটাকে দেখামাত্রই আমার খারাপ লাগল। তাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। পরে তিনি গিয়ে আমার শাশুড়িকে বিষয়টি বললেন। আমার শাশুড়ির কথা আর উপেক্ষা করতে পারলাম না। লোকটি আর গেল না। বাড়িওয়ালার সঙ্গে ইতিমধ্যেই সে যোগাযোগ করে ফেলেছে। তারপর থেকে আমাদের বাড়িতে আর্মি আসতে শুরু করল। অ্যাশ কালারের প্যান্ট এবং খাকি শার্ট পরা আলবদরের লোকজন আসতে লাগল। তারা বন্দুক নিয়ে বাড়ির সামনে পাহারা বসাল। ডাক্তার সাহেব তখন ঘাবড়ে গেলেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা? লোকটি বলল, এরা তো আলবদর। আমি আলবদরের অর্গানাইজার। এরা আমাকে পাহারা দিতে এসেছে। মান্নান বলল, মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে চিঠি দিয়েছে আলীম ভাই ওপরে না থাকলে কবেই তোকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতাম। তখন আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে বুঝতে পেরেছি বাঁচার জন্য আলীমকে সে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে।
সমকাল : ডিসেম্বরে যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এলো তখনকার কোনো স্মৃতি আপনার মনে পড়ে কি?
শ্যামলী নাসরিন : হ্যাঁ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমি যুদ্ধের কথা শুনতাম। প্রত্যেক দিন পাক বাহিনীর পরাজয়ের খবর শুনতাম। আশপাশের কোথাও বোমা পড়লে আমরা সিঁড়ির নিচে চলে যেতাম। ১৪ তারিখে গভর্নর হাউসে বোমা হামলার সময় আমাদের বাসা কেঁপে উঠেছিল।
সমকাল : আপনি কি বাইরে বের হতেন?
শ্যামলী নাসরিন : হ্যাঁ, বিভিন্ন কাজের জন্য আমাকে বাইরে বের হতে হতো। আমি তখন ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে চাকরি করতাম। বাজার করা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের কাজের জন্য আমাকে বাইরে বের হতে হতো। রাস্তায় আর্মি জিপ টহল দিত। একবার দেখলাম, বেশ কিছু মানুষকে ট্রাকে করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। খুব ভীতিকর একটা পরিস্থিতি ছিল।
সমকাল : মুক্তিযুদ্ধের জন্য আপনি কী কী কাজ করতেন?
শ্যামলী নাসরিন : লুকিয়ে পত্রিকা বিতরণ, চাঁদা, ওষুধ সংগ্রহ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সোয়েটার বুনতাম।
সমকাল : মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা দেখেছেন?
শ্যামলী নাসরিন : আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের হামলার শব্দ বুঝতে শিখেছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের বোমার শব্দ পাকিস্তানিদের থেকে ভিন্ন ছিল। এ বোমার শব্দই ছিল তখন আমাদের জীবনী শক্তি। একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের বোমার শব্দ না শুনলে আমাদের মন খুব খারাপ হয়ে যেত।
সমকাল : ডা. আলীমকে ধরে নিয়ে যায় কবে?
শ্যামলী নাসরিন : ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায়। পিলখানায় মিত্রবাহিনী বোমা ফেলছে। আমরা বসে বসে দেখছি। পাকিস্তানিদের কাছে তখন বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র নেই। পাকিস্তানিদের দেখে আলীম হো হো করে হাসছে। বলছে, মিত্রবাহিনীকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। তখন একটা গাড়ি আসার শব্দ হলো। আমি দেখলাম কাদা লেপা একটা মাইক্রোবাস এলো। মাইক্রোবাসটি মাওলানার গেটে এসে থামল। কিছুক্ষণ পর আলবদর বাহিনীর ৩ জন সদস্য আমাদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে কড়া ভাষায় দরজা খুলতে বলল। এর আগে আমাদের বাড়িতে কেউ এমন করে দরজা খুলতে বলেনি। তখন ডাক্তার সাহেবের মুখ কালো হয়ে গেল। তখন তিনি আমাকে দরজা খুলে দিতে বললেন। তিনি দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাও? সে বলল, মাওলানা মান্নানের কাছে। কারণ, মাওলানা মান্নান তাকে বলেছিল আপনি আমার পরিবারকে রক্ষা করেছেন। আপনার পরিবারকে আমি বাঁচাব। আপনার কোনো ভয় নেই। কোনো সমস্যা হলে আপনি আমার কাছে চলে আসবেন। মাওলানা মান্নানের দরজায় গিয়ে তিনি অনেক ধাক্কাধাক্কি করলেন। কেউ দরজা খুলল না। ভেতর থেকে মাওলানা মান্নান বলল, আপনি যান আমি আছি। বাসায় ফেরার সময় তিনি যখন ওপরে উঠছিলেন তখন তাকে বলা হলো আমাদের সঙ্গে চলুন। ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায়? তারা বলল, গেলেই জানতে পারবেন। তিনি কাপড় পরে যেতে চাইলে তারা বলল, তার আর দরকার হবে না। যেভাবে আছেন সেভাবেই চলেন। আমি মাওলানার বাড়িতে ছুটে গিয়ে তাকে বললাম, আমার স্বামীকে কারা যেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দয়া করে আপনি দেখেন। মান্নান বলল, আপনি ঘাবড়াবেন না। ওরা আমার আলবদরের ছাত্র। ওরা নিয়ে গেছে। ওরা রাবি্বকেও নিয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন নিয়ে গেছে? মাওলানা বলল, চারিদিকে কী রকম বোম্বিং হচ্ছে, সেজন্য নিয়ে গেল। চিকিৎসা করানোর জন্য ওদের নিয়ে গেল। কখন ফিরে আসবে? মাওলানা বলল, কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবে। আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। তাকে যে মেরে ফেলা হবে সেটা আমি চিন্তাও করতে পারিনি। ডাক্তার সাহেব যার জীবন বাঁচালেন, পরিবারকে রক্ষা করলেন তার সাহায্যেই তাকে মেরে ফেলা হলো।
সমকাল : ১৬ তারিখের কথা আপনার মনে আছে?
শ্যামলী নাসরিন : ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকেই দেখি সবাই জয়বাংলা স্লোগান দিচ্ছে। বাইরে তাকিয়ে দেখি বাসার ছাদে ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। আমি সারাক্ষণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতাম। আলীমের চিন্তায় আর শুনতে পারিনি। স্বামীর জন্য আমি ছিলাম উদগ্রীব। বুঝতে পারলাম, পাক বাহিনী হয়তো আত্মসমর্পণ করবে। মনে হলো, পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে আমার স্বামী হয়তো ফিরে আসবেন। ১১টার দিকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এলেন। তাদের হাতে ছিল অস্ত্র। তারা এসে বললেন, সেই শয়তানটা কোথায় যারা আলীম ভাইকে মেরেছে। তখনই আমি প্রথম জানতে পেলাম, আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি তখনই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
সমকাল : বের হয়েছিলেন?
শ্যামলী নাসরিন : স্বাধীন বাংলার পতাকা টানানোর জন্য আমি আশা করে বসে ছিলাম। কিন্তু তা করতে পারিনি। আমি বিশ্বাস করিনি ডাক্তার সাহেবকে মেরে ফেলা হয়েছে। ১৬ তারিখ বিজয়ের দিন আমি তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। রিকশায় করে শহরের কত জায়গায় যে খুঁজেছি। আমার মনে হতো এই বুঝি তাকে দেখতে পাব। রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের স্লোগান দিতে দিতে আসছেন। মিছিল হচ্ছে। আশা করছিলাম ওই বিজয় মিছিলেই ডাক্তার সাহেবকে পাব। আমার মনটা তখন মিশে যেতে চেয়েছিল সেই মিছিলে। কিন্তু পারিনি। স্বামী হারানোর বেদনায় আমার মনটা ভারী হয়ে উঠেছিল। সেদিন ঢাকার অনেক রাস্তায় আমি পাগলের মতো ঘুরেছি। ভেবেছিলাম, হয়তো কোথাও তার সঙ্গে দেখা হবে।
সমকাল : মরদেহ পাওয়া গেল কখন?
শ্যামলী নাসরিন : ১৭ তারিখের পর।
সমকাল : মুক্তিযোদ্ধারা কি রায়েরবাজার গিয়েছিলেন?
শ্যামলী নাসরিন : আমি শুনিনি কীভাবে তারা জানতে পেরেছে।
সমকাল : আপনি রায়েরবাজার গিয়েছিলেন?
শ্যামলী নাসরিন : না, আমি রায়েরবাজার যাইনি। যাওয়ার মতো শক্তি তখন আমার ছিল না। ১৮ তারিখে ডাক্তার সাহেবের লাশ নিয়ে আসার পর তার লাশ দেখেছি। তার হাত দুটো রশি দিয়ে পেছনে বাঁধা ছিল। দু'চোখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। শরীরের অনেক জায়গায় বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন।

মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎ পেলে মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ত : সাদেক হোসেন খোকা


মাহবুব মোর্শেদ
১৯৭১ সালে সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন। জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সাহসী গেরিলা অপারেশনে। ১৬ ডিসেম্বর তিনি ও তার সহযোদ্ধারা মিলে টেলিভিশন ও রেডিওর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল, যুদ্ধে সাধারণ মানুষের সমর্থন ও ডিসেম্বরের ঢাকা নিয়ে ঢাকার বর্তমান মেয়র এবং মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৫
...........................................
সাদেক হোসেন খোকার জন্ম ১ অক্টোবর ১৯৫১ সালে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগে শেষ বর্ষের ছাত্র। যুক্ত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের সঙ্গে। ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন তিনি। ঢাকায় বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও ডিসেম্বরের ঢাকা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ

সমকাল : নভেম্বরে গেরিলারা ঢাকার চারদিকে একটা প্রতিরোধবলয় গড়ে তুলেছিল। সে সময় আপনাদের ক্যাম্প কোথায় ছিল?
সাদেক হোসেন খোকা : প্রকৃতপক্ষে নভেম্বরের শেষদিক থেকেই গেরিলারা ঢাকার চারদিকে অবস্থান গ্রহণ করে। বিশেষ করে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি গ্রামেই মুক্তিযোদ্ধারা খুব শক্ত অবস্থানে ছিল। তখন বেশিরভাগ সময়ই আমরা মুক্তাঞ্চলে অবস্থান করতাম এবং ঢাকায় এসে অপারেশন করে আবার সেখানে চলে যেতাম। আমাদের যুদ্ধ তো কনভেনশনাল ছিল না। গেরিলা যুদ্ধের নিয়মে এটিই ছিল আমাদের কৌশল। তখন ক্যাম্পগুলো অস্থায়ীভাবে তৈরি হতো। অপারেশন করে এবং পারিপাশর্ি্বকতার কথা বিবেচনা করে আমরা ক্যাম্পগুলো এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে সরিয়ে নিতাম। ক্যাম্পগুলো ছিল আমুলিয়া, মেন্দীপুর, মানিকদী_ এসব জায়গায়।
সমকাল : তখন কি দখলের উদ্দেশ্যে ঢাকার ভেতরে ঢোকার মতো পরিস্থিতি গেরিলাদের ছিল?
সাদেক হোসেন খোকা : সাধারণত দখলদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি থাকে রাজধানী শহরে। কারণ, সামরিক-বেসামরিক সব প্রতিষ্ঠানের হেডকোয়ার্টার থাকে। তাই রাজধানী শহরকে তারা শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। পাকিস্তানি দখলদাররাও তা-ই করেছিল। এছাড়া তাদের রেগুলার ফোর্সও ছিল অনেক বেশি। গেরিলা যুদ্ধের ধরনই হলো শত্রুর শক্ত ঘাঁটিতে চোরাগোপ্তা হামলার মধ্য দিয়ে তাদের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ঘটানো। তাদের পরাস্ত করা। এমন ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে হবে, যাতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমেও এটি গুরুত্বসহকারে প্রচার পায়। গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রচারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য তখন ঢাকা শহরের বাইরে অবস্থান নিয়ে আমরা গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনা করতাম। সে সময় ঢাকা শহরে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করি, প্রচারের দিক থেকে যেগুলো খুবই গুরুত্ব পায়। তাতে সারাদেশের মানুষসহ গোটা বিশ্ববাসী জানতে পারে পাকবাহিনী ঢাকায় দারুণভাবে পর্যুদস্ত হচ্ছে। তখন হানাদার বাহিনীর লক্ষ্য ছিল, বিশ্ববাসীকে দেখানো যে, সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে। আর আমাদের লক্ষ্য ছিল এখানে প্রশাসনসহ কোনো কিছুই সঠিকভাবে চলছে না সেটা দেখানো। তাই এ ধরনের প্রচারণা তখন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সমকাল : আপনাদের বড় অপারেশনগুলো কী কী?
সাদেক হোসেন খোকা : আমার মনে পড়ে ঢাকা হলের (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) কাছে এয়ার ফোর্সের যে রিক্রুটিং সেন্টার ছিল সেটি আমরা ধ্বংস করেছিলাম। এছাড়া শান্তিনগরের ডিএফপি ভবন, পিলখানাসহ ঢাকা শহরের আরও অনেক জায়গায় আমরা এ ধরনের গেরিলা অপারেশন করেছিলাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর যখন তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করল না তখন অনেক এমএনএ এবং এমপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তাঞ্চলে চলে যান। পাকিস্তান সরকার তখন সেই এমপিদের আসন শূন্য ঘোষণা করে। আসনগুলোতে উপ-নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে নির্বাচন ঠেকানো আমাদের একটি গ্রুপের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন আমরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উল্টো দিকে অবস্থিত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অফিস উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের অপারেশনের পর ভবনটা একেবারে ধসে পড়ে। তাতে নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মচারীও মারা যায়। এমন সুরক্ষিত জায়গায় এ ধরনের একটি বড় অপারেশন পরিচালনা করে আমরা প্রমাণ করতে পেরেছিলাম, মুক্তিযোদ্ধারাও ঢাকায় শক্ত অবস্থানে আছে। প্রচারের দিক থেকেও এটি বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই বিভিন্ন গ্রুপ ঢাকায় এসে এ ধরনের অপারেশন করেছে। এ ধরনের অপারেশনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল পাক হানাদার বাহিনীকে এখানেই ব্যস্ত রাখা। যাতে তারা বাইরের দিকে মনোযোগ কম দিতে পারে।
সমকাল : কোন ক্যাম্প থেকে আপনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন?
সাদেক হোসেন খোকা : মেলাঘর ক্যাম্প থেকে। সম্ভবত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি মেলাঘরে যাই। আমি ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমাদের গ্রুপ থেকে অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এপ্রিলের প্রথম দিকে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার নেতৃবৃন্দের দিকনির্দেশনা নেওয়া, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং গ্রুপিংয়েরও প্রয়োজন ছিল। এসব করতে করতে একটু দেরি হয়ে যায়। কমিউনিস্ট পার্টি তখন চীন এবং রাশিয়াপন্থি_ এই দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। আমাদের মধ্যেই অনেকগুলো দল ছিল। কেউ কেউ পাকিস্তানি বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী উভয়কেই প্রতিরোধ করতে শুরু করে। সিরাজ শিকদাররাও এক রকম লাইন নেয়। মতিন সাহেব, আলাউদ্দিন ভাই তারা এক রকম লাইন নেন। মেনন এবং জাফর ভাইরা ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।
সমকাল : প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর?
সাদেক হোসেন খোকা : প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর আমি কর্নেল গাফফারের নেতৃত্বে তিন সপ্তাহ সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। তারপর সেখান থেকে ভাগ করে আমাদের ঢাকায় পাঠানো হয়।
সমকাল : ঢাকায় অন্য যে গেরিলা গ্রুপগুলো কাজ করত, তাদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ বা পারস্পরিক সমন্বয় কীভাবে হতো?
সাদেক হোসেন খোকা : ২ নং সেক্টরে আমরা যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছি তারা একে অপরকে জানতাম। কোন গ্রুপে কে কে আছে, কমান্ডার কে_ এসব আমরা জানতাম। তাছাড়া আমাদের নিজেদের মধ্যেও পারস্পরিক যোগাযোগ তো ছিলই। পারস্পরিক যোগাযোগের ভিত্তিতেই একটা শক্তিশালী অবস্থান গড়ে উঠেছিল। শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী দু'একবার পূর্বাঞ্চলে ঢোকার চেষ্টা করেছে। তখন আমাদের গেরিলা গ্রুপগুলো তাদের সে চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য সম্মিলিত প্রয়াস চালায়।
সমকাল : ঢাকায় আপনারা যাওয়া-আসা করতেন কীভাবে?
সাদেক হোসেন খোকা : যেহেতু এটা ছিল গেরিলা যুদ্ধ। তাই আমাদের আলাদা কোনো পোশাক বা ইউনিফর্ম ছিল না। সাধারণ মানুষের মতোই আমরা যাতায়াত করতাম।
সমকাল : ঢাকার অধিবাসীরা আপনাদের কীভাবে সাহায্য করত?
সাদেক হোসেন খোকা : ঢাকার শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষ যুদ্ধের পক্ষে ছিল। ডিএফপি ভবনে যখন আমরা অপারেশন করি তখন সেখানকার এক কর্মচারী আমাদের সাহায্য করে। এমন সাহায্য প্রচুর পেয়েছি। নির্বাচন কমিশন অফিসে অপারেশন করার সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। অপারেশন শেষ করে শান্তিবাগের দিকে গিয়ে আমরা একটি মেসে আশ্রয় নিই। তারাও সেখানে আমাদের সানন্দে বরণ করে। তখন আকাশবাণী কিংবা বিবিসিতে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা প্রচারিত হতো। মানুষ সেসব শুনে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্পিত ছবি আঁকত মনে মনে। হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎ পেলে মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ত। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কী করবে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। সেই অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। তাই গেরিলা যুদ্ধে আমাদের যে সফলতা এর ক্রেডিট যদি কাউকে দিতে হয় তা এ দেশের সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে। তাদের সমর্থন না পেলে আমাদের এই অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সদ্ভাব রাখার জন্য আমাদেরও নানা নির্দেশনা দেওয়া হতো। আমাদের ওপর কঠোর নির্দেশ ছিল, যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটে। সাধারণ মানুষের সামান্যতম ক্ষতির কারণ যেন আমরা না হই।
সমকাল : ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার পর পরিস্থিতিতে কী পরিবর্তন এলো?
সাদেক হোসেন খোকা : যুদ্ধ তখন একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছে। পাকিস্তানি বাহিনী একেবারে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। তারা কোনো অস্ত্র নিয়ে আসতে পারছিল না। বিমানও বন্ধ ছিল। গেরিলাদের আক্রমণে তারা বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কোনো ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে যে সামরিক শক্তি দিয়ে দমানো যায় না তারই বড় প্রমাণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। শুরু থেকেই সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যেভাবে যুদ্ধ করেছে, তাদের সাহসিকতার কাছে পাকবাহিনীর শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আর ডিসেম্বরের শুরুতে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারতের সামরিক অস্ত্রের সাপোর্ট আমরা পাই এবং যুদ্ধ আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তির দিকে এগোতে থাকে। যে কারণে মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই তারা সাড়া দেয়।
সমকাল : ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা আপনার মনে আছে?
সাদেক হোসেন খোকা : আমার মনে পড়ে, আত্মসমর্পণের পর রেডিও-টেলিভিশন এগুলোর নিয়ন্ত্রণ আমরা গ্রহণ করি। শাহাদাত চৌধুরী, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, এখলাসউদ্দিন আহমদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় টেলিভিশন অন এয়ারে আসে। পরে সেদিন রাতে মেজর হায়দার ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদান করেন। টেলিভিশন ভবনে আমি যখন প্রথম লোক পাঠাই তখন দু'একজন কর্মী সেখানে ছিল। তারা ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের একত্র করে অন্যদের সহযোগিতায় টিভি চালানো সম্ভব হয়।
সমকাল : প্রথম কী অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়?
সাদেক হোসেন খোকা : মেজর হায়দারের ভাষণ দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। বারবার সে ভাষণ প্রচার করা হয়।
সমকাল : রেডিওতেও আপনি গিয়েছিলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, রেডিওতেও আমরা যাই এবং সেখানকার নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করি। সাভারের মেইন টাওয়ারের যন্ত্রপাতি তখন কে বা কারা খুলে নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো খুঁজে বের করে সেটিকে আমরা আবার চালু করার ব্যবস্থা করি।
সমকাল : আত্মসমর্পণের খবর আপনি কখন শুনলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব একটা নেটওয়ার্ক ছিল। সেই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা অবগত হই যে, ১৬ তারিখ পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করছে। আমি তখন মানিকনগরের দিক দিয়ে আসছি ঢাকার দিকে। সেখানে অনেক রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। আমার যতদূর মনে পড়ে, ওইদিন সকাল থেকেই আমরা ঢাকায় ছিলাম।
সমকাল : ভারতীয় সেনারা ততক্ষণে ঢাকায় এসে পেঁৗছেছিল?
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, ভারতীয় সেনারা ততক্ষণে ঢাকায় এসে পেঁৗছেছে।
সমকাল : আত্মসমর্পণের সময় আপনি কি রেসকোর্স ময়দানে ছিলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : না, তখনও আমি রেসকোর্স ময়দানে পেঁৗছতে পারিনি।
সমকাল : রেডিও-টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য আপনারা কখন থেকে অপারেশন শুরু করলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : মেজর হায়দারের নির্দেশেই আমরা অপারেশনটা শুরু করি। তখন ঢাকার অভ্যন্তরে আমাদের বাহিনী ছিল সবচেয়ে বেশি সুসংগঠিত এবং বেশি জনবল সম্পন্ন। তিনি আমাদের রেডিও-টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিলেন। আমরা রেডিও-টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে মেজর হায়দারকে আহ্বান জানাই। তিনি এসে মুক্তিযোদ্ধাদের করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। যাতে লুটপাট এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিশৃঙ্খলা এড়ানো সম্ভব হয়।
সমকাল : ওইদিন কি ঢাকা শহরে গোলাগুলি হয়েছিল?
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, বিভিন্ন দিকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গোলাগুলি হয়েছিল। আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে অনেক বেসামরিক লোক কিছু গোলাগুলি করেছিল। আতঙ্কিত হয়ে পাকিস্তানি আর্মিও কিছু গুলি করেছিল। ১৬ তারিখ বিকেলেই আমরা জানতে পারি রায়েরবাজারে কিছু মানুষকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছে।
সমকাল : আপনি সেখানে গিয়েছিলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, সেখানে আমি গিয়েছিলাম। আমার তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাজাহান, বদিউজ্জামান এবং মনিরুজ্জামানের মৃতদেহ সেখান থেকে উদ্ধার করি। পরে আমরা তাদের বাড়িতে মৃতদেহ পেঁৗছে দিই।
সমকাল : রায়েরবাজারে গিয়ে আপনি কী দেখলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : সেখানে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। তখন খবর সবেমাত্র ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ দেখার জন্য, তাদের হারানো স্বজনদের লাশ খোঁজার জন্য সেখানে ছুটে আসছে। পরে ১৭ তারিখ সবাই জেনে যায়।

৭ মার্চের ভাষণ শুনে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম :: লে. কর্নেল (অব.) এসআইএম নূরুন্নবী খান, বীরবিক্রম

বাম থেকে পঞ্চম অবস্থানে বাইনোকুলার সহ নূরুন্নবী খান

মাহবুব মোর্শেদ
ক্যাসেটে ধারণ করা ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন আর নয়, এবার দেশে ফিরতে হবে। পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমী থেকে পালিয়ে আসেন ঢাকায়। যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৫ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন। পরিচালনা করেছেন দুঃসাহসিক সব অভিযান। যুদ্ধের সেই অভিজ্ঞতা, চূড়ান্ত যুদ্ধ ও ডিসেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। ষ বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৫
............................................................................
এসআইএম নূরুন্নবী খানের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৮ অক্টোবর। ১৯৬৫ সালে তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ইউকসুর ভিপি হিসেবে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল করপস-এ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৫ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন। পরিচালনা করেছেন দুঃসাহসিক সব অভিযান। যুদ্ধের সেই অভিজ্ঞতা, চূড়ান্ত যুদ্ধ ও ডিসেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার
নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ


সমকাল : কীভাবে আপনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন?
নূরুন্নবী খান : বাঙালি সেনা কর্মকর্তা হিসেবে আমি প্রথম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ প্রদান করেন সেই ভাষণের একটা ক্যাসেট মেজর মুজিবুল হক চৌধুরী লোক মারফত গোপনে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্টে। ক্যাসেটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ২৬ মার্চ বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন আমি পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবর শুনে আমি সেখান থেকে পালিয়ে আসি। পাকিস্তান আর্মির সিক্সটিন ডিভিশন তখন ছিল কোয়েটাতে। ওটি ছিল একটি রিজার্ভ ডিভিশন। প্রতিদিনই আমরা খবর পেতাম সিক্সটিন ডিভিশনের সব ইউনিট প্লেনে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে। এভাবে এক সময় পুরো ডিভিশনই নিয়ে আসা হলো পূর্ব পাকিস্তানে। সামরিক পরিভাষায় রিজার্ভ সৈন্য মুভ করার অর্থই হলো যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া। আমারও আর বোঝার বাকি রইল না। কোন দিক দিয়ে কীভাবে সেখান থেকে পালিয়ে আসব সেই পরিকল্পনাই তখন করছিলাম। বেলুচিস্তানের বর্ডারে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে আমি কথা বলে রাখি। ২৫ মার্চ রাতে বিবিসির খবরে শুনতে পেলাম, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ। আগেই আমি একটি মুভমেন্ট অর্ডার নিয়ে রেখেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত কোথাও ধরা পড়লে ডকুমেন্ট হিসেবে যাতে সেটি দেখাতে পারি। সেই সুযোগে আমি তখন ট্রেনে করে করাচি চলে আসি। করাচি এসে আমি সিভিলিয়ান হিসেবে পিআইএ ফ্লাইটে ঢাকা যাওয়ার চেষ্টা করলাম। তারা জানাল, এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত শুধু আর্মির জন্য বুকিং আছে। তারা আমাকে পরামর্শ দিল স্টেশন হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সিভিলিয়ান হিসেবে যেতে হলেও আমাকে মিলিটারির অনুমতি নিয়েই যেতে হবে। এরপর স্টেশন হেডকোয়ার্টারে গিয়ে আমি এক মেজরের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে ২৭ তারিখে রিপোর্ট করতে বললেন। বললেন, পূর্ব পাকিস্তানগামী কোনো এক ইউনিটের সঙ্গে আমাকে সংযুক্ত করে দেবেন। ভাবলাম, ইউনিটের সঙ্গে গেলে আমার মিশন সফল হবে না। সেখান থেকে চলে গেলাম ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে দেখি, একটি সেকেন্ড কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ঢাকা যাচ্ছে। সেখানে ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম নামে একজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। তিনি সুবেদার সাদেক নামে আরেকজন বাঙালি অফিসারকে দেখিয়ে দিলেন। তিনি সেকেন্ড কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার জন্য আমার টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। ২৮ মার্চ সকালে ঢাকায় এসে পেঁৗছলাম।
সমকাল : সিভিলিয়ান হিসেবে?
নূরুন্নবী খান : না, সেকেন্ড কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সঙ্গে এলাম। প্লেনে সবাই ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। আমার আইডি কার্ড দেখতে বা পরিচিতি কেউ জানতে চাইল না।
সমকাল : ঢাকায় এসে?
নূরুন্নবী খান : ঢাকায় এসে এখানকার বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। দেখলাম তারা সবাই হতাশাগ্রস্ত। সবাইকে বোঝালাম, এভাবে বসে থাকলে চলবে না। তাদের বিদ্রোহ করার প্রস্তাব করলে কেউ রাজি হলো না। তখন আমি জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার সুবেদার ওয়াহেদকে খুুঁজে বের করলাম। তাকে বললাম, অন্য বাঙালি অফিসারদের একত্র করা যায় কি-না। সব অফিসারকে একত্র করে বিদ্রোহ করে কুর্মিটোলা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করলাম। তিনি আমাদের প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হলেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন। ধীরে ধীরে খবর পেলাম, বিভিন্ন বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং পুলিশরা বিদ্রোহ করেছে। পিলখানাতেও বিদ্রোহ হয়েছে।
সমকাল : ঢাকা থেকে বের হলেন কীভাবে?
নূরুন্নবী খান : ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় আমার মাথায় আইডিয়া এলো, পদ্মার ওপারের অঞ্চলটা তাড়াতাড়ি স্বাধীন করা সম্ভব। কেননা ওখানে একটাই মাত্র ক্যান্টনমেন্ট। ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টও ছিল সেখানে। তবে তাদের বিদ্রোহের খবর আমি তখনও পাইনি। আমার বিশ্বাস ছিল, অন্য বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো যেহেতু বিদ্রোহ করেছে, সেহেতু তারাও করবে। তাদের পাশাপাশি আনসার, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় যশোর ক্যান্টনমেন্টটা দখল করতে পারলে ওই অঞ্চলটা তাড়াতাড়ি মুক্ত করা সম্ভব। তখন আমি যশোর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এপ্রিলের ২ তারিখে নড়াইল গিয়ে পেঁৗছলাম। সেখানে গিয়ে ক্যাপ্টেন হালিম এবং ক্যাপ্টেন রহমানের সঙ্গে আমার দেখা হলো। তারা তখন যশোরে প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তাদের কাছে রিপোর্ট করলে তারা আমাকে সাদরে গ্রহণ করল। বিরামহীনভাবে যুদ্ধ করে তারা তখন ক্লান্ত। তারা আমাকে ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিতে বলল। আমাকে তারা দিল একটি স্টেনগান এবং ৭.৬২ পিস্তল। সেখানেই আমি প্রথম দেশের স্বাধীনতার জন্য পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলাম।
সমকাল : সীমান্তের দিকে এগোলেন কবে?
নূরুন্নবী খান : এপ্রিলের ৬ তারিখে পাক হানাদার বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে খুলনার দিকে মুভ করল। মংলা বন্দরে প্রায় ৮ হাজার টন অস্ত্র নিয়ে একটি পাকিস্তানি জাহাজ অপেক্ষা করছিল। পাক আর্মিরা বিরামহীনভাবে মর্টারের গোলাবর্ষণ করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ৮ তারিখের মধ্যেই তারা কয়েকশ' ট্রাকভর্তি করে প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ক্যান্টনমেন্টের ভেতর নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সেদিনই নড়াইল শহরে হেভি এয়ার স্ট্রাইকিং হয়। ফাইটার বিমানগুলোও স্ট্রাইকিং করতে থাকে। ফ্রন্টে এসে দেখি কেউ নেই। পুরো নড়াইল শহর ফাঁকা। খবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম, বিএসএফ কোনো ফিজিক্যাল হেলপ করছে কি-না। জানতে পারলাম, বিএসএফ কোনো ফিজিক্যাল হেলপ করছে না তবে আশ্রয় দিচ্ছে। আমরা সুবেদার জলিলসহ তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, মেইন ট্রুপস মাগুরা হয়ে মুভ করবে বর্ডারের দিকে আর আমি কিছু লোক নিয়ে সাতক্ষীরা হয়ে বর্ডারের দিকে অগ্রসর হবো। তখন এপ্রিলের ১৫-১৬ তারিখ। বর্ডার ক্রস করে কলকাতায় পেঁৗছলাম। সেখানে সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদসহ অনেক পুরনো ছাত্রনেতার সঙ্গে দেখা হলো।
সমকাল : আবার দেশে ফিরলেন কবে?
নূরুন্নবী খান : এপ্রিলেই দিনাজপুরের বিরলে চলে এলাম। সেখানে এসে খবর পেলাম ইপিআরের পুরো সেক্টর বিদ্রোহ করেছে এবং সুবেদার মেজর রবের নেতৃত্বে তারা ওই বেল্টে বেশ ভালো লড়াই করছে। বাঙালিরা একবার দখল করলে পাক হানাদাররা সেটা পুনরুদ্ধার করে, পরে বাঙালিরা আবার সেটা দখল করে। এভাবেই লড়াই চলছিল বিরল বেল্টে। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র তো তখন তেমন কিছু ছিল না। সে সময় প্রশিক্ষিত জনবলেরও খুব প্রয়োজন ছিল আমাদের। সেখানে আমি তাদের কমান্ড নিয়ে নিলাম। যুদ্ধ চলাকালে খবর পেলাম, ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করেছে। তখন আমি প্রবাসী সরকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য সুবেদার মেজর রবকে দায়িত্ব দিয়ে পুনরায় কলকাতা রওয়ানা হলাম। সেখানে গিয়ে আমি সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে প্রবাসী সরকারের হেডকোয়ার্টারে গেলাম। প্রবাসী সরকারের হেডকোয়ার্টার তখন ৫৭/২ বালীগঞ্জে। সেখানে ওসমানী সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাকে তার এডিসি হিসেবে দায়িত্ব দিলেন। মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ছিলাম। কিন্তু কলকাতায় বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই খানিকটা লবিং করেই ফিরলাম যুদ্ধক্ষেত্রে।
সমকাল : কোন ফ্রন্টে?
নূরুন্নবী খান : মেজর শাফায়াত জামিলকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধান করে কলকাতায় নেওয়া হলে আমি তাকে বললাম, যুদ্ধ করার জন্য আমি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছি। কলকাতায় থাকলে তো আমার যুদ্ধ করা হবে না। তখন আমাকে তার সঙ্গে নেওয়ার অনুরোধ জানালাম। তিনি রাজি হলেন। পরে তার সঙ্গে বালুরঘাটে চলে এলাম। তিনি আমাকে তৃতীয় বেঙ্গলকে রিঅ্যারেঞ্জ করার দায়িত্ব দিলেন। আমি বিভিন্ন জায়গা ঘুরে প্রশিক্ষিত জনবল সংগ্রহ করে সেখানে একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তুললাম।
সমকাল : আপনাদের অপারেশনগুলো সম্পর্কে বলুন।
নূরুন্নবী খান : জুন মাসের ১৭ তারিখে আমাদের ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ে নিয়ে আসা হলো। সেখানে তিনটি বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে এসে একত্র করে নাম দেওয়া হয় ওয়ান ইবি ব্রিগেড। পরে এটিকে ওয়ান আর্টিলারি নাম দেওয়া হলো। সেপ্টেম্বরে এটিকে জেড ফোর্স নাম দেওয়া হলো। জিয়াউর রহমান এসে কমান্ড নিলেন। বিভিন্ন বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় অপারেশনে পাঠানো হলো। আমাদের তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দেওয়া হলো বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনের জন্য। সেখানে আমি এসাল্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
সমকাল : অপারেশনটি হয়েছিল কোন মাসে?
নূরুন্নবী খান : জুলাইয়ের ৩১ তারিখে। বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনে আমাদের একজন শহীদ হয়। সেখান থেকে আমরা দেওয়ানগঞ্জ অপারেশন করি। বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে চিলমারী পর্যন্ত ছিল তখন মুক্ত। এরপর ৪ আগস্ট পাকিস্তানি আর্মি এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। সে সময় রৌমারীর কোদালকাটি নামে একটি চর তারা দখল করে। সুবেদার আলতাফ ছিলেন তখন সেখানকার কমান্ডার। তখন তিনি আমার কাছে এলেন। সেখানে আমরা খবর পেলাম, ১৪ আগস্ট সেখানে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো হবে। সেদিনই আমরা সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টার খুললাম। তখন রৌমারীতে আমরা সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ওপেন করি।
সমকাল : সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কী কী কাজ করত?
নূরুন্নবী খান : সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তখন সবরকম কাজ করত। তাদের কাজ ছিল বিভিন্ন পজিশনে সৈন্যদের কাছে খাবার পেঁৗছানো, টোল কালেকশন, পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট, হাসপাতাল, থানা_ এরকমভাবে সব বিভাগ আমরা সেখানে খুলি। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এগুলো চালু ছিল।
সমকাল : ভারতীয় সাহায্য আসা শুরু করল কখন?
নূরুন্নবী খান : জুন মাসের শুরু থেকে। ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে, দিকনির্দেশনা দিয়ে তারা আমাদের সাহায্য করত। ফিজিক্যাল কোনো হেলপ তারা তখনও আমাদের করত না।
সমকাল : ফিজিক্যাল হেলপ শুরু হলো কখন?
নূরুন্নবী খান : জুলাই-আগস্ট থেকে। এ সময় তারা আমাদের গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করে।
সমকাল : ভারতীয় সৈন্যরা সরাসরি যুদ্ধ করতে শুরু করে কখন?
নূরুন্নবী খান : ২১ নভেম্বর যৌথ বাহিনী গঠিত হওয়ার পর। তবে সেটা বর্ডার এলাকার মধ্যেই সীমিত ছিল।
সমকাল : আর কোন কোন অপারেশনে আপনি অংশগ্রহণ করেন?
নূরুন্নবী খান : ছাতক, রাধানগর, গোয়াইনঘাটসহ আরও অনেক জায়গায় অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। তামাবিল বেল্টে অপারেশন করার সময় আমি তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। প্রায় ১৫টি উল্লেখযোগ্য অপারেশনের ওপর আমার আলাদা আলাদা বই আছে।
সমকাল : ৩ ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে কী কী পরিবর্তন এলো?
নূরুন্নবী খান : নভেম্বর শেষ দিক থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী বর্ডার এলাকাগুলোতে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। তাদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলোতেও তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে তারা ঘাঁটিগুলো গড়ে তুলেছিল। শক্ত ঘাঁটিগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাক হানাদার বাহিনী মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়ে।
সমকাল : ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য ছাড়া কি এত দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হতো?
নূরুন্নবী খান : একটি জায়গা দখল করাই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো সেটির দখল ধরে রাখা। ডিসেম্বর নাগাদ পুরো বাংলাদেশেই তো আমাদের অবাধ বিচরণ ছিল, কিন্তু দখল ধরে রাখার জন্য সে রকম অস্ত্র আমাদের ছিল না। এয়ার সাপোর্ট, নেভাল সাপোর্ট ছিল না। লং রেঞ্জে আমরা হামলা করতে পারতাম না। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী ছিল ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। সারা বাংলাদেশ তখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তা ধরে রাখা আমাদের জন্য কষ্টকর হতো। ভারতীয় বাহিনী সহায়তা না করলে অনেক দিন ধরে গেরিলা যুদ্ধ চলত। কিন্তু তারপরও চূড়ান্ত যুদ্ধে এ রকম সাহায্য আমাদের দরকার হতো।

Thursday, December 9, 2010

আক্রমণ যদি করতে হয় তবে ইন্টারকন্টিনেন্টালেই : মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীরবিক্রম


মাহবুব মোর্শেদ
১৯৭১ সালের জুনে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয়েছিল বিশেষ মিশন নিয়ে। তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার আশপাশে ৩-৪ কিলোমিটারের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটানোর। কিন্তু ঢাকা পেঁৗছে তারা সিদ্ধান্ত নেন, আক্রমণ যদি করতেই হয় তবে দূরে কেন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই করবেন। দুর্ধর্ষ সে অভিযান, ক্র্যাক প্লাটুন, মেলাঘর ক্যাম্পের কার্যক্রম ও ডিসেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৪
........................................
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জন্ম ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে। ১৯৭১ সালে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পড়তেন বাংলাদেশ মিউজিক কলেজে। এপ্রিলে চলে যান সীমান্তে_ প্রথমে মতিনগর, পরে মেলাঘর ক্যাম্পে। মেলাঘর ক্যাম্পেই ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেন। গঠিত হয় ক্র্যাক প্লাটুন। মায়া ও সহযোদ্ধারা মিলে অনেক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেছেন ঢাকা ও এর
পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। ক্র্যাক প্লাটুন গঠন, চাঞ্চল্যকর অভিযান ও ডিসেম্বরের ঘটনাবলি
নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
মাহবুব মোর্শেদ



সমকাল : ২ নম্বর সেক্টরে কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন?
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া : ২৫ মার্চ যখন পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে তখন আমি সেগুনবাগিচা মিউজিক্যাল কলেজে ছিলাম। আমি বি মিউজের ছাত্র ছিলাম। সেতার শিখতাম। আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন বারীণ মজুমদার। ক্র্যাকডাউন হলে আমরা দেখলাম, আর্মিরা রমনা পার্কের দিকে গাড়ি নিয়ে আসছে। মিন্টো রোডের দিক দিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে এসে তারা ট্যাঙ্ক নিয়ে মুভ করছে। ট্যাঙ্কের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। লোকজন রাস্তায় বেরিয়ে এসে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া শুরু করে। আমরাও মিউজিক কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে ব্যারিকেডে অংশগ্রহণ করি। কিন্তু তাদের সামরিক শক্তির মুখে বেশিক্ষণ টিকে থাকা গেল না। কলেজে ফিরে এসে ছাদে অবস্থান নিলাম আমরা। পাকসেনারা ট্রেসার রাউন্ড ছুড়ে আমাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছিল। এক পর্যায়ে তারা আমাদের কলেজের গেটে এসে লাথি দিতে শুরু করে। তখন আমরা হোস্টেল ত্যাগ করি পেছনের দেয়াল টপকে। দেয়াল টপকে পার হওয়া সহজ ছিল না। বারীণ মজুমদারের স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা, বাপ্পা মজুমদার বৌদির পেটে। আমরা দরজা ভেঙে দুই দেয়ালের মধ্যে সেতু তৈরি করলাম। আশ্রয় নিলাম আওয়ামী লীগ নেতা কালু মিয়ার ফাঁকা বাসায়। সে বাসাতেই ২৬ তারিখ থাকলাম। ২৭ তারিখ সকাল ৭টা থেকে ৯টা_ দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। কারফিউ শিথিল হলে ঢাকা থেকে স্রোতের মতো মানুষ ছুটতে শুরু করে। ২৮ তারিখ ৪ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করল। ২৯ তারিখ সকালে আমরা জিঞ্জিরা যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। সেদিন ৬ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হলো। সেগুনবাগিচা থেকে রিকশায় করে আমরা গেণ্ডারিয়ায় গেলাম। সেখান থেকে নৌকায় জিঞ্জিরা গেলাম। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকার জিঞ্জিরা থেকে আমরা ১২ জন একসঙ্গে রওয়ানা দিই ৪ এপ্রিল। বর্ডার অতিক্রম করে ভারতের মতিনগর ক্যাম্পে উঠি। এ ক্যাম্পটি কুমিল্লা বর্ডারের খুব কাছে ছিল। আমাদের ট্রেনিংটা মূলত মতিনগরেই হয়েছিল।
সমকাল : মেলাঘর তখন চালু হয়নি?
মায়া : এর মধ্যে পাকিস্তান আর্মি মতিনগর ক্যাম্পে শেলিং শুরু করে। শেলগুলো আমাদের ক্যাম্পের কাছে আধা কিংবা এক কিলোমিটার দূরে এসে পড়ত। তখন আমরা ভাবলাম, তারা যদি আরেকটু এগিয়ে এসে আমাদের ক্যাম্পের ওপর শেলিং করে তাহলে ক্যাম্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রাতেই আমরা ক্যাম্পের জায়গা পরিবর্তন করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সন্ধ্যায় খাওয়ার পর আমাদের বলা হলো, রাতে আপনাদের একটা মিশন আছে। যার যা কিছু আছে সবকিছু নিয়ে সেখানে যেতে হবে। নিয়ম ছিল যার যা মালপত্র আছে সেটা তাকেই বহন করতে হবে। কারও জিনিস কেউ বহন করবে না। রাত ১টার দিকে আমরা মতিনগর থেকে রওয়ানা হলাম। সারারাত হেঁটে ভোরে মেলাঘরে পেঁৗছলাম।
সমকাল : বর্ডার থেকে মেলাঘর ক্যাম্পের দূরত্ব কত ছিল?
মায়া : আমার যত দূর মনে পড়ে, বর্ডার থেকে প্রায় ৩০-৩২ কিলোমিটার দূরে। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত আমাদের ট্রেনিং, আসা-যাওয়া সবকিছু মেলাঘর থেকেই পরিচালিত হতো।
সমকাল : মেলাঘরে কী ধরনের ট্রেনিং দেওয়া হতো?
মায়া : মূলত গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হতো। গ্রেনেড কীভাবে ছুড়তে হয়, থ্রি ইঞ্চ মর্টার কীভাবে চালনা করতে হয়, এলএমজি কীভাবে চালনা করতে হয়, এসএমজি কীভাবে চালাতে হয়, ডেটোনেটর কীভাবে ফিট করতে হয় সবকিছুর ট্রেনিং মোটামুটিভাবে সেখানে দেওয়া হতো।
সমকাল : কোন মাস থেকে ট্রেনিং শুরু হলো?
মায়া : এপ্রিল মাসে শুরু হয়ে মে মাস পর্যন্ত চলল।
সমকাল : ঢাকায় আপনাদের মিশন শুরু হলো কীভাবে?
মায়া : আর্মি অফিসাররা বিদ্রোহ করে সীমান্তে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের পরিবার তখনও বিভিন্নভাবে এদিক-সেদিক রয়ে গেছেন। খালেদ মোশাররফ, নুরুল ইসলাম শিশু, উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ, ব্রিগেডিয়ার মতিন প্রমুখের পরিবার তখন ঢাকায়। আমরা ঢাকা শহরের অলিগলি চিনতাম। ঢাকা থেকে সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা ভালো চেনা ছিল। আমাদের ওপর অফিসারদের পরিবারগুলোকে সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল। এ কাজে বেশ কয়েকবার আমরা ঢাকায় এসেছিলাম।
সমকাল : হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন কীভাবে হয়েছিল?
মায়া : মেলাঘরে ট্রেনিংয়ের সময় আমরা একদিন খবর পেলাম খালেদ মোশাররফ আসছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমরা তার অপেক্ষায় রইলাম। তিনি এসে অনেক কথা বললেন। বললেন, এখনই তোমাদের একটা অপারেশনে যেতে হবে। সেটা হবে এক দুঃসাহসী অপারেশন। ধরে নিতে হবে, তোমরা আর ফিরতে পারবে না। কে কে যেতে চাও স্বেচ্ছায় হাত উঠাও। আমরা যে ১২ জন একসঙ্গে ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলাম ঠিক করেছিলাম, যেখানেই আমরা যাই সবাই একসঙ্গে যাব। তখন সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। কে আগে হাত ওঠাবে। আমরা ১২ জন হাত উঠানোর পর আশপাশের সব মিলিয়ে ৬০-৬২ জন হাত উঠাল। আমাদের বলা হলো, যাদের বাড়ি ঢাকায় তারাই শুধু এই অপারেশনের জন্য উপযুক্ত। আমাদের নাম লিখে নেওয়া হলো। তিনি বললেন, তোমরা সন্ধ্যার পর আমার ক্যাম্পে দেখা কর। ওই সময় সেখানে ৬টি পল্গাটুন ছিল। অন্যদের নিজ নিজ ক্যাম্পে ফিরে যেতে বলা হলো। সব মিলিয়ে অপারেশনের জন্য শেষ পর্যন্ত ৪০-৪২ জন থাকল। সন্ধ্যায় ক্যাম্পে গেলে তিনি আমাদের ব্রিফ করলেন। জুন মাসের ৬-৮ তারিখে প্রিন্স করিম আগা খান আসবেন। তার সঙ্গে থাকবে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং বিশ্বের নামিদামি সাংবাদিকরা। পাকিস্তানিরা তাদের দেখাতে চায় দেশের মধ্যে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা নেই। আওয়ামী লীগের কর্মীরা যাওয়ার সময় বাড়িঘর পুড়িয়ে গেছে। এখন ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসিত করতে হবে। কমিটমেন্ট ছিল পরিস্থিতি অতিথিদের বোঝাতে পারলে তারা পাকিস্তানকে ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেবে। আমাদের তখনও পূর্ণ ট্রেনিং সমাপ্ত হয়নি। আমাদের বলা হলো, ডেলিগেটরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকবে না। আমাদের এক্সপেল্গাসিভ নিয়ে এসে ঢাকার ৩-৪ মাইল দূরবর্তী এলাকায় বিস্টেম্ফারণ ঘটাতে হবে। যাতে বিস্টেম্ফারণের শব্দ বিদেশিদের কানে পেঁৗছায়। শব্দ শুনলেই তারা বুঝতে পারবে দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়। যে ৩ দিন তারা থাকবে সে কয়েক দিন এ ধরনের বিস্টেম্ফারণ ঘটাতে হবে। ১০ জনের একেকটি গ্রুপ তৈরি করে আমাদের প্রত্যেককে দেওয়া হলো ৩০ পাউন্ড এক্সপেল্গাসিভ।
সমকাল : ঢাকায় কি আপনারা এক সঙ্গে এলেন?
মায়া : ভিন্ন ভিন্ন দল ভিন্ন ভিন্নভাবে এলো। আমরাও এসে এক জায়গায় থাকতাম না। কে কোথায় থাকতাম সেটা নিজেদের মধ্যেও আলোচনা হতো না। ঠিক করা ছিল, ঢাকায় পেঁৗছানোর পরদিন স্টেডিয়ামের সামনে আল ইসলাম হোটেলে সকাল ১০টা-সাড়ে ১০টার মধ্যে একত্র হবো। একত্র হওয়ার পর আমরা বললাম, আক্রমণ যদি করতেই হয় তাহলে ঢাকা থেকে দূরে কেন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই আক্রমণ করব। আক্রমণ করার জন্য আমাদের একটি গাড়ির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমাদের কোনো গাড়ি ছিল না। অনেক কষ্টে একটা গাড়ি জোগাড় করে ৭ তারিখ সন্ধ্যা ৭টা-সাড়ে ৭টার দিকে আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে উপস্থিত হই। বিদেশি ডেলিগেটদের দুটি গাড়ি তখন লবির সামনে দাঁড়িয়ে। ক্যামেরা ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে লোকজন নামছে। তখন গেটের দিকে লক্ষ্য করে আমরা দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করি। কয়েক সেকেন্ড পরে আরও দুটি। সবাই হুড়মুড় করে হোটেলের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু সবাই ঢুকতে পারেনি। দ্রুতগতিতে কাকরাইল রোড ধরে আমরা পালিয়ে যাই। বাড়িতে এসে বিবিসির ৮টার খবরে শুনলাম, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গেরিলা আক্রমণে ১৮-২২ জন মারা গেছে এবং ৩০-৩২ জন আহত হয়েছে। সেবার আমাদের সঙ্গে আর যাদের অপারেশনে পাঠানো হয়েছে তাদের সবারই অপারেশন ব্যর্থ হয়। খালেদ মোশাররফ বলেন, দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল। বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে। তিনিই আমাদের ক্র্যাক আখ্যা দেন। তখন থেকেই আমাদের পল্গাটুনটি 'ক্র্যাক পল্গাটুন' নামে পরিচিত হয়।
সমকাল : ঢাকার আশপাশের এলাকায় আপনারা কোনো ক্যাম্প করেছিলেন?
মায়া : ত্রিমোহনী, ভুলতা এবং ইছাপুরা বাজারে আমাদের ক্যাম্প ছিল। ইছাপুরা বাজারে আমাদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। সে ঘাঁটি রক্ষা করতে গিয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে বড় যুদ্ধ করতে হয়েছিল।
সমকাল : ঢাকায় অপারেশন চালানোর সময় এখানকার মানুষ আপনাদের কী ধরনের সাহায্য করত?
মায়া : তখন রাজাকার, আলবদর ছাড়া সবাই আমাদের সাহায্য করত। তারা সকলে আমাদের জন্য দোয়া করত। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করত। যে বাড়িগুলোতে আমরা আশ্রয় নিতাম তারা নফল নামাজ পড়ে এবং কোরআন তেলাওয়াত করে আমাদের জন্য দোয়া করত। সবার সহযোগিতায় আমরা ঢাকা শহরে সর্বমোট ৮২টি অপারেশন পরিচালনা করেছিলাম। আমাদের আক্রমণে পাকিস্তানিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।
সমকাল : ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনী গঠিত হওয়ার পর কী ঘটল?
মায়া : যৌথ বাহিনী আমাদের সঙ্গেই ঢাকায় প্রবেশ করেছিল। ৩ ডিসেম্বরের পর ভারতীয় বাহিনীর ১২ জনের একটি দল আমাদের এসে বলল, তাদের পাঠানো হয়েছে এই নির্দেশনা প্রদানের জন্য যে, যে কোনো সময় ওপর থেকে নির্দেশ এলেই তারা আমাদের সঙ্গে ঢাকার মধ্যে ঢুকে পড়বে। ঢাকায় ঢোকার রাস্তাটা আমাদের তৈরি করতে হবে। ডিসেম্বরের ৬-৭ তারিখে ধলেশ্বরী নদীর তীরে কয়েকজন ভারতীয় অফিসার এসে আমাকে বললেন পাকিস্তানি আর্মিদের সম্পর্কে সঠিক এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে। তাদের অবস্থান, ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র_ এসব সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। তারা আমাদের কাছে ৮ জন চাইলেন। দু'জন করে ভাগ হয়ে আমরা এগোলাম তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য। তারা আমাদের অস্ত্র দিয়ে ফায়ার করতে বলেছিল। আমরা ফায়ার করলে পাকিস্তানিরাও কাউন্টার ফায়ার করবে। সে ফায়ারের শব্দ শুনলেই তারা বুঝবে পাকিস্তানি আর্মির কাছে কী কী অস্ত্র আছে। কিছু দূর এসে আমরা দু'বার ফায়ার করে তাদের পক্ষ থেকে কোনো পাল্টা জবাব পেলাম না। তৃতীয়বার ফায়ার করার পর থেকেই তারা আমাদের লক্ষ্য করে বিরামহীনভাবে ব্রাশফায়ার এবং ট্রেসার রাউন্ডের গুলি শুরু করল। এভাবে তারা দু'ঘণ্টা ফায়ার করল। এ সময় ভারতীয়রা ফায়ারিংয়ের শব্দ রেকর্ড করে পাক আর্মির কী কী অস্ত্র আছে তা সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করল। সে অপারেশনে আমিসহ ৮ জন প্রায় মরতে বসেছিলাম। আমাদের রাইফেলে ট্রেসার রাউন্ড ছিল। ফলে পাকিস্তানিরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছিল এবং বিরামহীনভাবে গুলি করেছিল। ধানের জমিতে কাদার মধ্যে মাথাসহ পুরো শরীর ডুবিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলাম আমরা।
সমকাল : ১৬ তারিখে আপনারা ঢাকায় ঢুকলেন কখন?
মায়া : তখন ত্রিমোহনী, ভুলতা, ইছাপুরা বাজার, মাতুয়াইল, কমলাপুর রেলস্টেশন এই অঞ্চলটি মুক্ত ছিল। বিকেল ৪টার সময় আমরা ঢাকায় প্রবেশ করি। বিকেল ৩টা-সাড়ে ৩টার দিকে ভারতীয় আর্মি হেলিকপ্টার দেখতে পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, এগুলো পাকিস্তানিদের হেলিকপ্টার। আমাদের কাছে একটা বাইনোকুলার ছিল। বাইনোকুলারে দেখলাম এক ঝাঁক হেলিকপ্টার। সেগুলোতে ভারতীয় মনোগ্রাম। এগুলো আসছিল আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য। হেলিকপ্টারগুলোকে অনুসরণ করে আমরাও দৌড়াতে দৌড়াতে ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা হই। কিন্তু হেলিকপ্টারের সঙ্গে কুলাতে পারা গেল না। বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট কিংবা পৌনে ৫টার দিকে আমরা ডিআইটি বিল্ডিংয়ে পেঁৗছাই। সেখানে প্রথম স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়াই আমি। এর একটু আগে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ হয়ে গেছে।
সমকাল : আপনাদের সঙ্গে ভারতীয় যে বাহিনীটি ছিল, তারা?
মায়া : তারা আমাদের অনুসরণ করে ঢাকায় ঢুকেছে।
সমকাল : ১৬ তারিখের পর ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল?
মায়া : ঢাকা শহর ছিল উৎফুল্ল। লোকজন ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল রাস্তায়। রাজাকার, আলবদরদের খুঁজছিল তারা। আমি তখন ২০-২২ বছরের যুবক। আমাকে পায়ে হাঁটতে হয়নি। মানুষ কাঁধে করে আমাদের বাড়ি পেঁৗছে দিয়েছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়, মিত্রবাহিনীকেও মানুষ যে যেভাবে পেরেছে বরণ করেছে। একদিকে হাসি-কান্নার রোল, অন্যদিকে ফুলের পাপড়ি। স্বাগত জানানোর জন্য যত রকম আয়োজন করা যায়, সবকিছুই করেছে তারা। এ দৃশ্য না দেখলে ধারণা করা কঠিন। চারদিকে ছিল একটাই স্লোগান_ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

Wednesday, December 8, 2010

মিসেস আহমেদ ছদ্মনাম নিয়েছিলাম : এডলিন মালাকার


মাহবুব মোর্শেদ
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভিন্ন এক কাহিনী শুনিয়েছেন এডলিন মালাকার। স্বামী যুদ্ধে চলে যাওয়ার পর দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি থেকে যান ঢাকায়। নিজের বাড়িতে নিরাপদ নন বলে অন্যদের বাড়িতে থেকেছেন পুরো মার্চ থেকে ডিসেম্বর। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। চলাফেরার সুবিধার্থে জোগাড় করেছিলেন মিসেস আহমেদ ছদ্মনামে একটি আইডি কার্ড। ঢাকা শহরের তখনকার আতঙ্ক, অস্থিরতা ও যুদ্ধপরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৫
.............................................
সমকাল : ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে আপনি কোথায় ছিলেন?
এডলিন মালাকার : তখন আমি ঢাকা ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে (এখনকার উদয়ন স্কুল) চাকরি করতাম। আমার বাসা ছিল ফার্মগেট এলাকায়। ২৫ মার্চে আমাদের বাড়ির চারপাশে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছিল। এলাকাটি নিরাপদ ছিল না। আমার স্বামীও মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলেন। তিনি দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। সেই সূত্রে পার্টির লোকদের সঙ্গে আমারও কিছু যোগাযোগ ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধে চলে যাওয়ার পর বাড়ি ছাড়লাম আমরা। আমার ছোট্ট দুটি সন্তান ছিল। স্বামীর বন্ধু নুরুর রহমান তার ধানমণ্ডির বাসায় নিয়ে যান আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় আরও ক'টি পরিবার তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে অনেকেই সংখ্যালঘু ছিলেন। ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত সে-বাড়িতেই ছিলাম। ঢাকার ওপর যৌথবাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে আমাদের মনে হলো, ঢাকায় থাকা নিরাপদ নয়। তখন সে-বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলাম আমরা।
সমকাল : আপনি তো ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ঢাকায় চলাফেরা করতে হতো আপনাদের। এ সময় কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেন?
এডলিন মালাকার : আমরা তো নন-মুসলিম। বাসা থেকে আমাকে বলল, তোমার একটা কার্ড করা দরকার। তখন আমরা নাম পরিবর্তন করে স্কুল থেকে কার্ড করলাম। আমার দু'ছেলের নাম শাহীন এবং শামীম। চলাফেরার সুবিধার্থে আমি মিসেস আহমেদ ছদ্মনামে একটি আইডি কার্ড বানিয়ে নিয়েছিলাম। কার্ড সঙ্গে রাখতাম। স্কুল ও বাসা ছাড়া আর তেমন কোথাও যেতাম না। খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হতো আমাদের। একবার খুব বিপদে পড়তে হয়েছিল। সে সময় আমাদের কাজ ছিল সীমান্তের ওপার থেকে আসা পত্রিকাগুলো ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের ওপর এসব পত্রিকা আমরা আঁচলের নিচে লুকিয়ে বিতরণ করতাম। একবার পত্রিকা বিতরণ করতে যাচ্ছি। পথে আলবদরের এক কর্মী গাড়ি আটকালো। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ড্রাইভার আগেই বলে দিয়েছিল স্বাভাবিক থাকতে হবে। সেই আলবদরটির সঙ্গে কথা বলেছিল। আইডি কার্ড আর দেখাতে হয়নি। পত্রিকা বিতরণ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতাম। এমনিতে রিকশায় চলাফেরা করতাম, ঢাকা শহরে তখন বাস চলত খুবই কম।
সমকাল : স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গেছেন বলে কি বাড়তি সতর্কতা নিতে হতো?
এডলিন মালাকার : হ্যাঁ, সতর্ক থাকতে হতো যাতে কেউ না জানে। আমার ছেলেদের শিখিয়ে দিয়েছিলাম, কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, তুমি বলবে বাবা নানাবাড়ি গেছেন। নুরুর রহমানের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াত ছিল। তার দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। তাদের বন্ধুরা আসত। তবে তাদের এই যাতায়াত খুব গোপনে হতো। এত সতর্কতার মধ্যেও একবার ঢাকার মুক্তিযোদ্ধারা গ্রীন রোডে একটা অপারেশন করলেন। তখন সবাই বলল, এবার ধানমণ্ডি এলাকায় রেইড হবে। সে রাতে রেইড না হলেও পরদিন সকালে দেখা গেল ঠিকই আর্মি জিপ পেঁৗছে গেছে। তবে তারা বাসার ভেতর ঢোকেনি। গেটে গিয়ে নুরুর রহমান সাহেব তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা চলে গিয়েছিল।
সমকাল : মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কারা কারা ওই বাড়িতে আসতেন?
এডলিন মালাকার : নাসিরউদ্দিন ইউসুফরা আসত, আর্টিস্ট শাহাবুদ্দিন আহমেদ এসেছিল। আরও কয়েকজন; কিন্তু সবার নাম এখন আর আমার মনে নেই।
সমকাল : কার্ড করার পর রাস্তাঘাটে আপনাকে কি কেউ আটকিয়ে ছিল?
এডলিন মালাকার : কার্ডটি আমরা করেছিলাম মূলত নিরাপত্তার জন্য। এক দিন এক রাজাকার আমাদের পথরোধ করেছিল। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেই সে আমাকে ছেড়ে দিল। তবে কার্ড দেখানোর প্রয়োজন হয়নি। অমুসলিমদের ভয়টা তখন বেশি ছিল। আর যাদের লোকজন বেশি চিনত তাদের সমস্যাটা ছিল আরও বেশি। মেয়েদের ক্ষেত্রে সে সমস্যাটা আরও বেশি হতো।
সমকাল : ধানমণ্ডি এলাকায় লোকজন তখন কেমন ছিল?
এডলিন মালাকার : আমরা থাকতাম ৭ নম্বর রোডে। তখন সেখানে একটা বড় পুকুর ছিল। আশপাশে ছিল অনেক কোয়ার্টার। মানুষের জীবনযাপন যে খুব স্বাভাবিক ছিল, তা নয়। স্বাভাবিক জীবনযাপন করাটা সে সময় অনেক কঠিন ছিল।
সমকাল : স্কুলে বাচ্চারা আসত?
এডলিন মালাকার : প্রথমে তো স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে সামরিক নির্দেশে স্বাভাবিক অবস্থা দেখানোর জন্য স্কুল খুলে দেওয়া হলো। চারদিকে ভীতিকর পরিস্থিতি। আমাদের স্কুলে তখন খুব বেশি বাচ্চা ছিল না। কিছু কিছু বাচ্চা আসত। ক্লাসও হতো।
সমকাল : তখন তো আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতেন। ওখানে কী দেখতেন?
এডলিন মালাকার : লোকজনের চলাচল খুব কম ছিল। ক্লাস হতো কি-না সেটি এখন আমার মনে নেই।
সমকাল : ধানমণ্ডি এলাকা ছাড়লেন কবে?
এডলিন মালাকার : ঢাকায় বিমান আক্রমণ বেড়ে গেলে আমরা বাড়ি পরিবর্তন করে জিগাতলায় আমার স্বামীর এক বন্ধুর বাড়িতে গেলাম। নভেম্বরের দিকে আমরা বাড়ি পরিবর্তন করে বংশালে চলে গেলাম। সে বাড়িতে অনেক মুক্তিযোদ্ধার যাওয়া-আসা ছিল। পাকিস্তানিরা তখন ছোট বিমানে করে বোমা ফেলছিল। মাঝে মাঝে হেলিকপ্টারও উড়ছিল। তখন কেউ কেউ বলছিলেন, এটা কি ভারতীয় বাহিনীর কাজ? পরে বোঝা গেল, এগুলো পাকিস্তানিদেরই কাজ। এ অবস্থায় বংশালে আমরা নিরাপদ বোধ করলাম না। সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা ঢাকার কাছেই বাঘৈরে গেলাম।
সমকাল : আপনারা বাঘৈর গেলেন কবে?
এডলিন মালাকার : এটা সম্ভবত ৩ ডিসেম্বরের পর।
সমকাল : পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
এডলিন মালাকার : বাঘৈরে থাকতেই খবর পেলাম। খবরটি রেডিওতে প্রচারিত হওয়ার পর সবার মুখে মুখে ফিরছিল। আমিও সেভাবেই শুনেছিলাম। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণে সবাই ছিল উৎফুল্ল। আমরাও বাড়ির ছাদে উঠে উল্লাস প্রকাশ করেছিলাম। অনেক দিন পর খুব মজা হয়েছিল।
সমকাল : ঢাকায় ফিরলেন কবে?
এডলিন মালাকার : ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে, বিকেলের দিকে। আমরা সবাই একসঙ্গে ঢাকা অভিমুখে রওনা হয়েছিলাম। মনে আছে, অনেকে মিলে ফিরেছিলাম।
সমকাল : ঢাকায় এসে কী দেখলেন?
এডলিন মালাকার : ঢাকায় এসে দেখলাম বেশ আনন্দঘন পরিবেশ। কিছু আতঙ্ক ছিল। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ছিল আনন্দ। পরে রায়েরবাজারে বুদ্ধিজীবী হত্যার খবর পেয়ে হতবাক হয়েছিলাম। ডা. আলিম চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল আলবদররা। আমার বড় ছেলে অনেক দিন আলিম চৌধুরীর বাসায় ছিল। ঢাকায় এসে খবর শুনে আমরা আলিম চৌধুরীর বাসায় গেলাম। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ছিলেন। সেখানে কান্নার রোল পড়ে গেল।
সমকাল : রায়েরবাজারে গিয়েছিলেন?
এডলিন মালাকার : গিয়েছিলাম, কয়েক দিন পর। কোনো লাশ বোধহয় ছিল না। কিন্তু সেখানে তখনও অনেক লোক। অনেক মানুষ তখনও নিখোঁজ। তারা স্বজনদের খুঁজছিলেন।
সমকাল : আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে সাহায্য করতেন?
এডলিন মালাকার : আমি শ্যামলী নাসরিন এবং আমার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কাজ করতাম। শ্যামলী নাসরিনের মাও মুক্তিযুদ্ধে অনেক কাজ করেছেন। অর্থ সংগ্রহ, ওষুধ সংগ্রহ এবং তা পেঁৗছানো, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করা_ এভাবেই ঢাকা শহরের নারীরা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। অনেকে নার্সিংয়ে চলে গিয়েছিলেন। কবি সুফিয়া কামাল (আমাদের সুফিয়া খালা) নানাভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। সুলতানা কামাল এবং সাঈদা কামাল কলকাতায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নার্স হিসেবে কাজ করেছেন। আয়শা খানম, নার্গিস, রত্না, ফৌজিয়া, রোকেয়া কবীর_ তারা সবাই সীমান্তের ওপারে থেকে কাজ করেছেন। সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও এটা কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এটাও ছিল বড় একটা যুদ্ধ। আর যেসব নারী তখন ঢাকা শহরে ছিলেন, তাদের জীবনও ছিল অনেক বড় ঝুঁকির মধ্যে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করতাম। শীতকাল চলে এসেছিল। পরিচিত বাড়ি ঘুরে অনেক কাপড় জোগাড় করেছিলাম। এক দিন শিল্পী হাশেম খানকে বললাম, মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু কাপড়-চোপড় লাগবে। হাশেম খান এক রিকশা বোঝাই করে কাপড় নিয়ে আসতে গিয়ে এক দিন হঠাৎ আর্মির গাড়ি সামনে পড়ে। তখন বুদ্ধি করে হাশেম খান পাশের একটি লন্ড্রিতে ঢুকে পড়ে। পরে লন্ড্রি থেকে সে কাপড় উদ্ধার করা হয়েছিল।

৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিমান বাহিনীই প্রথম আক্রমণ করে : এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার, বীরউত্তম

সবার বামে কালো সোয়েটার শাদা শার্ট পরা এ কে খন্দকার

মাহবুব মোর্শেদ
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে ঢাকার আকাশে ঢুকে পড়ে মিত্রবাহিনীর বিমান। সে আক্রমণে পাকবাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হয়। মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক এ কে খন্দকার জানান, প্রথম আক্রমণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পাইলটরা ছিলেন। ৩ ডিসেম্বরের পরের যুদ্ধপরিস্থিতি, যৌথ বাহিনীর কার্যক্রম, ১৬ ডিসেম্বরে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং বিমান বাহিনীর তৎপরতা নিয়ে বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৫
......................................
এ কে খন্দকারের জন্ম ১ জানুয়ারি, ১৯৩০ সালে। মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কমিশন লাভ করেন তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন উইং কমান্ডার। প্রবাসী সরকার তাকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি দেয়। পরে তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক হিসেবে তার কাজ, ডিসেম্বরের চূড়ান্ত যুদ্ধ ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ


সমকাল : বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠিত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী ও এর নেতৃত্বের কর্মতৎপরতায় কি পরিবর্তন এসেছিল?
এ কে খন্দকার : যৌথ বাহিনী বলতে বোঝায় দুটি বাহিনীর এক হয়ে যুদ্ধ করা। সত্য কথা বললে, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই এটা চলছিল। আমরা যুদ্ধ করছিলাম আর ভারতীয় বাহিনী আমাদের সাহায্য করছিল। এই প্রক্রিয়াটা চলছিল সমানভাবে। পরে দুই সরকারের মধ্যে আলোচনা করে যৌথ বাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী মিলে যৌথ বাহিনী গঠন করে। যৌথ বাহিনী সক্রিয় হওয়ার পর আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলাম। অনেক জায়গায় তারা আমাদের সাপোর্ট দিতে আরম্ভ করল। কোনো কোনো জায়গায় তারা এবং কোনো কোনো জায়গায় আমরাও নতুনভাবে আক্রমণ করতে আরম্ভ করলাম। এভাবে ৪ ডিসেম্বর থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হলো। একটি কথা বলে রাখা দরকার, এই অভিযান শুরু হওয়ার অনেক আগেই যুদ্ধ করার মতো মানসিক এবং শারীরিক সামর্থ্য পাকিস্তানের ছিল না। কারণ, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে তারা এমনভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল যে, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। তাছাড়া তাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা খুব বেশিদিন ছিল না। ভারত মিত্রবাহিনী হিসেবে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেওয়ার ফলে যুদ্ধের গতিটা অনেক বেড়ে গেল। ৩ ডিসেম্বর শেষ রাতে যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়, তাতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীই প্রথম আক্রমণ করে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বাংলাদেশের ভেতরে পাকিস্তানি টার্গেটে প্রথম আক্রমণ করে। তারা নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে এবং ফিউয়েল ডাম্পে আক্রমণ করে দুটিকে এমনভাবে ধ্বংস করে যে, পাকিস্তানি বাহিনীর যেখানে-সেখানে যাওয়া-আসার ক্ষমতা কমে যায়। তাদের তেল সরবরাহ ধ্বংস হয়ে যাবে এটা তারা চিন্তা করতে পারেনি। ৩ তারিখ শেষ রাতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৪, ৫, ৬ তারিখের মধ্যেই যশোরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পতন হলো। ওদিকে ঠাকুরগাঁও স্বাধীন হয়ে গেছে। ৭ তারিখেই পাকিস্তানিরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রথম জানাল, যুদ্ধ থামিয়ে আলোচনা করতে হবে। ইয়াহিয়া তাদের কথায় পাত্তা দিলেন না। তাদের ধারণা ছিল, উত্তর থেকে চীন এবং দক্ষিণ থেকে আমেরিকা উভয়েই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত যৌথ বাহিনীকে পরাজিত করবে। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ তাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল, তাদের সমর্থন করলেও যুদ্ধে জড়াতে তারা রাজি নয়। আর এদিকে ৯ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে আসা শুরু করল। এ নিয়ে যে আমাদের চিন্তা ছিল না তা নয়। আমাদের চিন্তা ছিল তারা যদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, তাহলে এটি একটি বড় যুদ্ধে পরিণত হবে। তখন পাকিস্তান ছিল আনন্দে উৎফুল্ল। তাদের মনোভাবটা ছিল এমন_ এই বুঝি যুদ্ধ শেষ হলো। যুদ্ধ শেষে তারাই জিতবে। কিন্তু সপ্তম নৌবহর যখন ইন্দোনেশিয়ায় পেঁৗছেছে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু সাবমেরিন এবং যুদ্ধজাহাজ ভারত সাগরে উপস্থিত হয়। সুতরাং সপ্তম নৌবহরের পক্ষেও কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধে নেমে পড়া সহজ ছিল না এবং শেষ পর্যন্ত তারা বঙ্গোপসাগরে আসেনি। যৌথ বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর এই যে যুদ্ধ চলল, সত্যিকার অর্থেই এটি ছিল একটি অসম যুদ্ধ। কারণ আগেই বললাম, পাকিস্তানিদের যুদ্ধ করার মতো শক্তি ছিল না। না মানসিক, না শারীরিকভাবে।
সমকাল : লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব তার বই 'স্যারেন্ডার অ্যাট ঢাকা'য় দাবি করেছেন_ পাকিস্তানি ফরমেশন ও ক্যান্টনমেন্ট এড়িয়ে সরাসরি ঢাকায় আসার আইডিয়াটা তার ছিল। মানেকশ তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন।
এ কে খন্দকার : এ সম্পর্কে তাদের মধ্যে কী আলাপ হয়েছিল কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে মতদ্বৈধতা তৈরি হয়েছিল বলা কঠিন। তবে জ্যাকব এটাকে সমর্থন করতেন যে, পাকিস্তানিদের সামরিক অবস্থানগুলো এড়িয়ে যাওয়া। তিনি নিজেও তখন এটি বলেছেন। শক্ত ঘাঁটিগুলোতে সম্মুখ সমরে লিপ্ত না হয়ে তাদের এড়িয়ে যেতে পারাটাই ভালো হবে, এটা তিনি বলেছিলেন।
সমকাল : আপনারা এই পরিকল্পনা জানতেন এবং সমর্থন করতেন?
এ কে খন্দকার : আমরা তো যৌথ বাহিনীতে ছিলাম। ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতর_ ফোর্ট উইলিয়ামসে গিয়ে আমি তো তাদের সঙ্গে আলোচনা করতাম।
সমকাল : সেখানে কী ধরনের আলোচনা হতো?
এ কে খন্দকার : যুদ্ধকৌশল নিয়ে আলোচনা হতো। কোন কোন টার্গেটে আক্রমণ চালানো হবে সেসবও আলোচনা হতো। কীভাবে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে সে আলোচনাও হতো। সুতরাং আমার পক্ষে জানাটা অনেক সহজ ছিল।
সমকাল : ওই সভায় মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আর কে কে থাকতেন?
এ কে খন্দকার : আমি একাই থাকতাম। সে সময় জেনারেল এমএজি ওসমানী অতটা ইনভলভ ছিলেন না।
সমকাল : জেনারেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গে তখন আপনার আলোচনা হতো?
এ কে খন্দকার : হতো না। তিনি তখন একটু নিশ্চুপ ছিলেন। আর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমি ব্যস্ত থাকতাম।
সমকাল : সামরিক যেসব সিদ্ধান্ত আপনারা গ্রহণ করতেন সেগুলো জানার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ আগ্রহী ছিলেন?
এ কে খন্দকার : হ্যাঁ। এসব জানার জন্য তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন। তিনি আমার কাছে শুনতেন, যুদ্ধ কেমনভাবে চলছে, কতদিন লাগবে, আমরা জয়লাভ করব কি-না_ এরকম অনেক প্রশ্ন তিনি আমাকে করতেন। আমি পরিষ্কারভাবে তাকে বলতাম, স্যার আমরা জিতবই। জয়ের ব্যাপারে আমার মনে কোনোরকম সন্দেহ ছিল না।
সমকাল : আপনার কি মনে হতো যুদ্ধ ৯ মাসে শেষ হবে?
এ কে খন্দকার : আমি মে মাসে এই কথাটা আমার বন্ধুদের বলতাম যে, ডিসেম্বর মাসে আমরা দেশে ফিরে যাব। কারণ, আমি ভাবতাম এক কোটি শরণার্থীকে খুব বেশিদিন রাখা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, ডিসেম্বর মাস হবে শীতের মাস। তখন চীন আসতে পারবে না। কারণ, বরফ পড়বে। পাকিস্তানিরা পশ্চিম সীমান্ত থেকে এসে এখানে যুদ্ধ করতে পারবে না। অথচ ভারতে সমস্ত সুবিধা থাকবে। সে জন্য ভারত মিত্র হিসেবে আমাদের সঙ্গে যখন যোগ দেবে তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে এত বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়বে যে, তাদের পক্ষে যুদ্ধ বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই এ যুদ্ধে জয়লাভ করে ডিসেম্বরেই আমরা দেশে ফিরে যাব।
সমকাল : আত্মসমর্পণের সময় আপনি রেসকোর্সে উপস্থিত ছিলেন। আপনি কখন জানলেন যে, ১৬ তারিখ আপনাকে ঢাকায় আসতে হবে?
এ কে খন্দকার : ১৬ তারিখ সকালে আমি একটা কাজে বের হই। সকাল ১০টার দিকে ফিরে এসে দেখি সবাই আমাকে খুঁজছে। জানতে পারলাম, বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা জেনারেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু তারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হননি। জেনারেল এমএজি ওসমানী তখন সিলেট চলে গিয়েছিলেন। তিনি কোথায় আছেন সেটা কেউ জানত না। তখন মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেয়, রেসকোর্স ময়দানে যে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে, সেখানে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করব আমি। আমাকে তখনি বলা হলো, তুমি এখনি চলে যাও। দমদম এয়ারপোর্টে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন ভারতীয় প্রতিনিধিরা।
সমকাল : কোথায় এসে আপনি এটা শুনলেন?
এ কে খন্দকার : কলকাতার থিয়েটার রোডের অফিসে। সেখানেই আমাদের হেডকোয়ার্টার ছিল।
সমকাল : আপনার সঙ্গে তখন কেউ ছিল?
এ কে খন্দকার : আমার সঙ্গে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা ও শিশু।
সমকাল : কীভাবে আপনারা দমদম পেঁৗছলেন?
এ কে খন্দকার : তৎক্ষণাৎ একটা জিপে চড়ে আমরা দমদমে পেঁৗছলাম। গিয়ে দেখি, একটা উড়োজাহাজ প্রস্তুত হয়ে আছে। অনেক সিনিয়র অফিসার ভেতরে অপেক্ষা করছেন। আমি উড়োজাহাজে উঠতে যাব এমন সময় দেখি আরেকটি জিপ খুব দ্রুতবেগে জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে। দেখতে পেলাম সেই জিপে জেনারেল অরোরা এবং তার স্ত্রীও আসছেন। তারা যখন জিপ থেকে নামলেন, তখন আমি জাহাজে ওঠার সিঁড়ি থেকে একটু পিছিয়ে গেলাম। কারণ, তিনি ছিলেন আমার থেকে অনেক সিনিয়র একজন অফিসার। অথচ তিনি এসে আমার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, না না। তুমিই আগে যাবে। কারণ, তুমি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। আমি তোমাকে পেছন থেকে অনুসরণ করব। তার এই ভদ্রতাটুকু আমার চিরদিন মনে থাকবে। এই সম্মান মুক্তিবাহিনীর। তারা স্বীকারও করেছেন, মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে কীভাবে পর্যুদস্ত করেছে। তারা সবাই বলেছেন, যুদ্ধটা এত তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার একটাই কারণ, মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে একেবারেই কোণঠাসা করে ফেলেছিল।
সমকাল : তারপর?
এ কে খন্দকার : এরপর আমরা উড়োজাহাজে করে আগরতলা গেলাম। ঢাকার ওপর দিয়েই আমরা গেলাম।
সমকাল : ঢাকায় সরাসরি নামলেন না কেন?
এ কে খন্দকার : ঢাকার রানওয়ে তখন এত বিধ্বস্ত ছিল যে নামা যেত না। আগরতলায় গিয়ে দেখি ৭-৮টি হেলিকপ্টার দাঁড় করানো। হেলিকপ্টারে আমরা ঢাকা বিমানবন্দরে এসে পেঁৗছলাম। বিমানবন্দরে এসে দেখি জেনারেল নিয়াজি, জ্যাকবসহ অন্য জেনারেলরা আমাদের রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছেন। তারপর জিপে করে আমরা সোজা চলে গেলাম রমনা ময়দানে।
সমকাল : রমনা ময়দানে যাওয়ার পথে কী দেখলেন?
এ কে খন্দকার : দেখলাম, হাজার হাজার মানুষ রাস্তার দু'পাশে অপেক্ষা করছে।
সমকাল : ততক্ষণে কি আত্মসমর্পণ হওয়ার খবরটি ছড়িয়ে পড়েছে?
এ কে খন্দকার : হ্যাঁ। কিছু একটা হচ্ছে এ ধরনের একটি খবর ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষের মধ্যে ছিল উৎফুল্ল একটা ভাব।
সমকাল : রমনা ময়দানে পেঁৗছে?
এ কে খন্দকার : সেখানে পেঁৗছে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হলো। অনুষ্ঠানটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। দুটি চেয়ার ও একটা টেবিল পাতা ছিল। জেনারেল অরোরা এবং জেনারেল নিয়াজি দু'জনেই স্বাক্ষর করলেন। তারপর জেনারেল নিয়াজি এবং অন্য পাকিস্তানি অফিসারদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। কারণ, সে সময় তাদের জীবন ছিল একেবারেই অনিরাপদ। চারদিকে জনগণ চিৎকার করছিল। এতদিন তারা যে অত্যাচার বাঙালিদের ওপর করেছে তাদের সেই শাস্তি দাবি করছিল তারা। কিন্তু সেটা তখন সম্ভব ছিল না। আত্মসমর্পণ করার পর আমাদের দায়িত্ব ছিল তাদের রক্ষা করা। কোনো ক্ষতি হতে না দেওয়া।
সমকাল : এরপর তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো?
এ কে খন্দকার : এরপর ক্যান্টনমেন্টে যেখানে তাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, সেখানে তাদের নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা সবাই আবার বিমানবন্দরে চলে গেলাম।
সমকাল : সেদিনের বিশেষ কোনো কথা মনে পড়ে?
এ কে খন্দকার : আমার মনে পড়ে, সেদিন অনেক মানুষ আমাকে আলিঙ্গন করেছে। কত মানুষ যে আমার সঙ্গে আলিঙ্গন করেছে তার হিসাব নেই। আলিঙ্গন করে তারা বলেছে, আজ থেকে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব।
সমকাল : তখন আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
এ কে খন্দকার : আমি আল্লাহর কাছে হাজার শুকর করলাম। আমি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা দিতে পেরেছি এটিই ছিল আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।
সমকাল : এয়ারপোর্ট থেকে আপনারা কোথায় গেলেন?
এ কে খন্দকার : এয়ারপোর্ট থেকে আমরা আবার গেলাম আগরতলায়। আগরতলা থেকে ওই প্লেনে চড়ে আবার এলাম কলকাতায়।
সমকাল : স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার প্রক্রিয়া কী ছিল?
এ কে খন্দকার : আমার ইচ্ছা ছিল পরদিনই চলে আসার। তখন ওসমানী সাহেব আমাকে আসতে দিলেন না। তিনি বললেন, না ওখানে এখনও বিপদ রয়েছে। আগে সবকিছু ঠিক হোক তারপর যাব। কিন্তু ওখানে থাকতে আমার ভালো লাগছিল না। ১৮-১৯ তারিখে তাজউদ্দীন সাহেবকে বলে আমি একাই চলে এলাম। এসে যারা ছিল তাদের সবাইকে একত্র করে পরদিন সকাল থেকেই আমি কাজ শুরু করলাম, যাতে বিমান বাহিনী পুনরায় দাঁড়াতে পারে। তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর যেসব বিমান ছিল পাকিস্তানিরা গুলি করে সেসব বিমান নষ্ট করে রেখে গিয়েছিল, যাতে আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে না পারি। কিন্তু আমরা টেকনিশিয়ানদের মাধ্যমে অন্য বিমানের ছোট ছোট যন্ত্রাংশ খুলে যে বিমানটি সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটি ঠিক করলাম। সেটিতে আমি এবং অন্য একজন ফ্লাই করলাম। তারপর ধীরে ধীরে এয়ারফোর্স গড়ে উঠল।
সমকাল : আপনি অফিস নিয়েছিলেন কোথায়?
এ কে খন্দকার : আমার অফিস ছিল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের ছোট্ট একটি ঘর। এটি ছিল মাটির নিচে।
সমকাল : ১৬ ডিসেম্বর কতদিন পর ঢাকা ফিরেছিলেন?
এ কে খন্দকার : আমি ঢাকা ছেড়ে ছিলাম ১০ মে। এর আগে আরও দু'বার আমি যাওয়ার চেষ্টা করি। প্রথমবার এপ্রিল মাসের ১-২ তারিখে। কিন্তু গফরগাঁওয়ে পেঁৗছে আমরা দেখি যে নদীতে পানি নেই। লঞ্চ আর সামনের দিকে যাচ্ছে না। আমাদের ফিরে আসতে হলো। দ্বিতীয়বার এপ্রিলের ১৭-১৮ তারিখে আবার আরিচা দিয়ে রাজশাহী হয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করলাম। আরিচা পেঁৗছে আমরা দেখলাম, আরিচা পাকিস্তানি সৈন্যে বোঝাই। দেখলাম, ওখান দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফিরে এলাম। ফিরে এসে চিন্তা করলাম, এতগুলো বাঙালি পাইলট যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত। আমি একা চলে যাচ্ছি কেন? পাইলটরা যুদ্ধ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত কি-না তা আমি জানতাম না। তখন আমি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজার মারফত উইং কমান্ডার বাশারের কাছে খবর পাঠালাম। জুনিয়র অফিসারদের কাছে জানতে চাইলাম, বিদ্রোহ করে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত কি-না। তখন এয়ারফোর্স থেকে বিদ্রোহ করে বের হয়ে যুদ্ধে যাওয়া খুব বড় একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার ছিল। বাশার এবং রেজা জুনিয়র অফিসারদের কাছে জানতে পেল তারা সবাই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তখন একজনকে আমরা পাঠালাম কোন রাস্তা নিরাপদ তা যাচাই করার জন্য। দু'দিন পর সে ফিরে এসে আমাদের জানাল। তখন আমরা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হলাম। এটা এ জন্য যে, এক গ্রুপ ধরা পড়লেও অন্য গ্রুপ যাতে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। এরপর ১০ মে পুরো গ্রুপ মিলে আমরা রওনা হলাম। সৌভাগ্যবশত আমরা দু'দলই আগরতলায় গিয়ে পেঁৗছলাম।
সমকাল : আপনি বললেন, ৩ ডিসেম্বর প্রথম যে বিমান আক্রমণ হয়েছিল ঢাকার ওপর তা আমাদের বিমান বাহিনী করেছিল। এটা ঠিক কোন সময়ে?
এ কে খন্দকার : এটা হয়েছিল ৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ২টা ৩০ মিনিটে কিংবা ৩টার দিকে। এখানে একটি বিষয় আমি গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করতে চাই তা হলো, আমাদের পাইলটরা রাতেই ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে এসে আক্রমণ করেছিল। ওপর দিয়ে ফ্লাই করে এসে আক্রমণ করলে রাডারে ধরা পড়ার ভয় ছিল। তাই তারা গাছের ওপর দিয়ে এসে আক্রমণ করেছিল। অন্ধকার রাতে গাছের ওপর দিয়ে আসা যে কত বিপজ্জনক তা একমাত্র পাইলটরাই বুঝবে। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে তারা আক্রমণ করেছিল।
সমকাল : বিমান তো দিয়েছিল ভারত?
এ কে খন্দকার : হ্যাঁ। নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে একটি পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড ছিল। ওই এয়ারফিল্ডে গিয়ে আমরা প্রশিক্ষণ আরম্ভ করলাম। আমি গিয়ে ওদের সঙ্গে ফ্লাইও করতাম। তারা কেমন করছে, টার্গেটে ঠিকমতো অ্যাটাক হচ্ছে কি-না, তাদের কোনো অসুবিধা আছে কি-না এসব পর্যবেক্ষণ করতাম। সে সময় ছিল খুব বৃষ্টি। আমরা সবাই ডিমাপুরে একত্র হই ২৮ সেপ্টেম্বর। সেদিন থেকেই বাংলাদেশ এয়ারফোর্র্সের জন্ম। সেখানে আমাদের আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না। আমরা শুধু ম্যাপ এবং টাইমিংয়ের ওপর নির্ভর করে ফ্লাই করতাম। আমাদের তো তখন টার্গেট নির্ধারণ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে আমরা কীভাবে টার্গেট নির্ধারণ করব? তখন পাহাড়ের ওপর উঠে আমরা একটা সাদা প্যারাসুট ফেলে দিলাম। যাতে ওই সাদা চিহ্ন দেখে আমরা আক্রমণ করতে পারি। আমরা যখন আক্রমণ করতাম তখন সাদা প্যারাসুটটাকে মনে হতো ছোট্ট একটা বিন্দু। ওই বিন্দু দেখে আমরা আক্রমণ করতাম। ওখানে চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়। গাছপালা চারদিকে প্রচুর। কেউ যদি প্লেন থেকে পড়ে যেত তাকে আর উদ্ধার করা যেত না। আগেই বলেছি, সে সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। গাছের ওপরে ছিল মেঘ। মেঘ এবং গাছের মাঝখানে ফ্লাই করে পাইলটদের ট্রেনিং নিতে হয়েছে। তাদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম না থাকলে এটা করা সম্ভব হতো না। পাইলটদের মধ্যে ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল, পিআইএর ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন সাহাব প্রমুখ। এরা ৩ ডিসেম্বরের আক্রমণে ফ্লাই করেছিলেন।

Tuesday, December 7, 2010

ঢাকার চারদিকে মুক্তাঞ্চল :মোস্তফা মহসীন মন্টু


মাহবুব মোর্শেদ
ঢাকার আশপাশ এলাকায় শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ২ নম্বর সেক্টরের যোদ্ধারা এলাকাবাসীর
সহযোগিতা নিয়ে বেশকিছু শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছিলেন। কেরানীগঞ্জকেন্দ্রিক ঘাঁটির নেতৃত্বে ছিলেন মোস্তফা মহসীন মন্টু। তার মতে, ঢাকার চারপাশের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা ছিল বলেই মিত্রবাহিনীর পক্ষে সরাসরি ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়েছিল ৩ ডিসেম্বরের পর। ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় দুঃসাহসিক নানা অভিযান, ডিসেম্বরের চূড়ান্ত যুদ্ধ ও গেরিলাযুদ্ধ কৌশল নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৪
...........................................
ঢাকার চারদিকে মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছিল


সমকাল : ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আপনাদের বাহিনীর অবস্থান কোথায় ছিল?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : ৩ ডিসেম্বর যখন এয়ার রেইড হয় সে সময়টায় আমি ছিলাম সাভার থানার কাছাকাছি। এর আগে ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমাদের বড় ধরনের একটি যুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটি হয়েছিল সোনাকান্দা, সৈয়দপুর, মরিচাঘাটে। এক রাত এবং দু'দিন স্থায়ী হয়েছিল সে যুদ্ধ। কেরানীগঞ্জের রুইৎপুর ইউনিয়নের তুলসীখালী, মরিচাঘাট, ধলেশ্বরী নদীর এপার-ওপারে এ যুদ্ধ হয়েছিল। পাক হানাদাররা মানিকগঞ্জ থেকে নবাবগঞ্জ হয়ে কেরানীগঞ্জ আসছিল। তারা নবাবগঞ্জে থাকার সময়ই আমরা তাদের আসার খবর পেয়ে যাই। আমি তখন কেরানীগঞ্জেই ছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল প্রায় ৩শ' জন মুক্তিযোদ্ধা। কেরানীগঞ্জের অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও আমি তখন খবর পেঁৗছে দেই। ঢাকা শহরের উপকণ্ঠেই কেরানীগঞ্জের অবস্থান। মূলত এখান থেকেই আমরা ঢাকা শহরের অপারেশনগুলো পরিচালনা করতাম। ধলেশ্বরী নদীর দু'দিকে আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য ওত পেতে ছিলাম। এদিকে ধলেশ্বর নদীর ঘাটে দুটি নৌকা রেখে বাকি নৌকাগুলো আমরা বন্ধ করে দিই। ওই দুটি নৌকাকে ফেরি বানিয়ে পাক হানাদাররা নদী পার হচ্ছিল। আমরা এটা করেছিলাম তাদের মুভমেন্টকে ধীরগতি করার জন্য। ভোরবেলা তারা ওই নৌকাতে পার হচ্ছিল। সঙ্গে তাদের গোলাবারুদ পার করছিল। এভাবে তারা অর্ধেকেরও বেশি রসদ ও কিছু সৈন্য পার করে ফেলার পর আমরা তাদের আক্রমণ করি। এর আগে আমরা তাদের বুঝতেও দিইনি। নভেম্বর মাস, জায়গায় জায়গায় মাটি ছিল শুকনো এবং ওই জায়গাটা ছিল একটু উঁচু ধরনের। জমিতে রবিশস্য লাগানো হয়েছিল। কথা ছিল, তারা অর্ধেকের বেশি রসদ পার করলেই সংকেত দেওয়া হবে। তখন দু'দিক থেকে আমরা আক্রমণ করব। সিগন্যাল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফায়ার শুরু হলো। প্রথম ফায়ার ওপেন করেছিল আমার ছোট ভাই। ফায়ার করেই সে বাঙ্কারে চলে গেল। পাক হানাদার বাহিনী তার অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি শুরু করল। আর এদিকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের লোকজনও গাছ থেকে নেমে পড়ল। তারপর আমরা সে অবস্থান থেকে আমাদের লোকজন নিয়ে পাকিস্তানিদের ঘেরাও করি। এ যুদ্ধে তাদের প্রায় ১৫-২০ জন মারা গেল এবং আমাদের হাতে ধরা পড়ল ২৭ জন।
সমকাল : যারা ধরা পড়ল তারা কারা?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : তারা পাঞ্জাব আর্মি। এর মধ্যে একজন ক্যাপ্টেন ছিল।
সমকাল : যুদ্ধ দু'দিন চলল?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : আমরা সারারাত তাদের ঘেরাও করে পজিশন নিয়েছিলাম। পরের দিন তাদের দিক থেকে গুলি কমে এলো। তখন শত্রুর অবস্থান জানার জন্য আমরা এলএমজিতে ৫ রাউন্ড পরপর একটা করে ট্রেসার রাউন্ড সেট করতাম। এই বুলেটটি যাওয়ার সময় আলো ছড়ায়। এভাবে ওরাও ট্রেসার রাউন্ড হিট করছে, আমরাও করছি। সকালের দিকটা একটু ঠাণ্ডা। তখন পাকিস্তানিদের দিক থেকে ওদের ওয়্যারলেস বার্তার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ওরা জোরে জোরে বলছে, রেসকিউ রেসকিউ। ওদের বাকি সিগন্যালগুলো আমরা বুঝতে পারছিলাম না। সে সময় আমরা খবর পেলাম, পাক হানাদাররা এসে বাড়িঘরের দরজা ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। তখন আমি অনুমান করলাম, তারা এটা করছে লাশ অথবা আহতদের সরানোর জন্য স্ট্রেচার তৈরির কাজে। তখন আমি কিছু ছেলেকে গ্রামের দিকে পাঠিয়ে দিলাম। তখন ১০-১৫ জন গিয়ে গ্রামে পজিশন নিল। যখনই তারা গ্রামে ঢুকতে যায় তখনই তারা ফায়ার করে। তবে এই সময়ের মধ্যে তারা ১০-১২টি বাড়ির দরজা ভেঙেছিল। সকাল থেকে সারাদিন আমরা ফায়ার করলাম এবং ওখান থেকে আমরা একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৫-১৬ জন পাক আর্মিকে গ্রেফতার করলাম। দুপুর ২টার দিকে দুটি পাকিস্তানি স্যাবর জেট এবং একটি হেলিকপ্টার আকাশে কয়েকবার চক্কর দিল। তখন তারা নিজেদের অবস্থান জানানোর জন্য আটকেপড়া সৈন্যরা দুটি ভেরি লাইট পিস্তল থেকে আকাশের দিকে গুলি করল। আমাদের কাছে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট কোনো অস্ত্র ছিল না। ছিল এলএমজি এবং একটা এমএমজি। সেটা দিয়ে তাদের সঙ্গে ফাইট করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবু ৩টা পর্যন্ত যুদ্ধ হলো। ৫টার দিকে আমি আমার ফোর্স নিয়ে হযরতপুর ইউনিয়নের দিকে গেলাম। রাস্তার মাঝখানে আরেকটি সমস্যা তৈরি হলো, গ্রেফতারকৃত সৈন্যরা হাঁটতে চায় না। আস্তে হেঁটে তারা আমাদের মুভমেন্টটাকে স্লো করে দিতে চাচ্ছিল। তখন আমি ক্যাপ্টেনকে বললাম, আমি তো তোমাকে এখন মেরে ফেলব। ক্যাপ্টেন বলল, তুমি তো এখন আমাকে মারবেই। আমি হলেও তোমাকে তাই করতাম। কারণ, আমি তো বন্ধু না। আমরা তো ইচ্ছা করে এখানে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমাদের এখানে জোর করে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছে। কারণ, আমরা জানি সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে যুদ্ধ করে আমরা জয়লাভ করতে পারব না। আর নির্বাচনে তোমরা জয়লাভ করেছ। তার সঙ্গে আমার বেশ কিছু কথাবার্তা হয়েছে। আমার পরিচয় পাওয়ার পর অবাক হয়ে সে আমাকে জিজ্ঞেসা করে_ তুমি ঢাকায়? ইয়াহিয়া সরকার না তোমাকে '৭০-এ ফাঁসির আদেশ দিল। তুমি কনভিকটেড। তুমি জেল থেকে পালিয়ে গেছ। তোমাকে তো খোঁজা হচ্ছে। তোমরা মোস্ট ওয়ান্টেডরা যখন ঢাকায় বসে যুদ্ধ করছ, তখন ঢাকা শহর তো আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। ঢাকা শহরে ইতিমধ্যেই তখন অনেক অপারেশন হয়ে গেছে। এটা ২৮ তারিখের ঘটনা। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী তখনও বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি। তারপর চরের কাছে এসে দু'জন ছেলেকে বললাম, এদের মেরে ফেল। তখন ক্যাপ্টেন আমাকে বলল, যেহেতু তুমি এদের নেতা। মারলে তুমিই আমাকে মার। তখন আমি ক্যাপ্টেনকে গুলি করলাম। আর আমার সঙ্গের ছেলে দু'জন বাকি সৈন্যদের মেরে ফেলল। মানুষ মারতে খারাপ লাগে। কিন্তু যখন আমি দেখেছি, আমার মা-বোন ধর্ষিত, আমার চোখের সামনে আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে, তখন পাগল হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সমকাল : ঢাকায় আপনারা অপারেশন চালাতেন কীভাবে?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : এটা অনেক লম্বা ইতিহাস। আসলে কেরানীগঞ্জে যুদ্ধ শুরু হয়েছে কিন্তু ৩ মার্চ, ১৯৭১ থেকে। সেদিন আমরা কেরানীগঞ্জের নেক্রোসবাগে প্রথম ট্রেনিং ক্যাম্প উদ্বোধন করি। সেখানে সুবেদার রফিক নামের বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসারকে আমরা নিয়ে আসি। তারপর ৯ তারিখে বোরহান উদ্দিন আহমেদ গগনের বাড়ি পলাউসিয়ায় আরেকটি ট্রেনিং ক্যাম্প উদ্বোধন করা হয়। ২৫ মার্চের আগেই নেক্রোসবাগের মাঠে আমি প্রায় ১০০-১৫০ জন ছেলেকে ট্রেনিং দিয়েছি। ৩-৪টি ব্যাচকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে।
সমকাল : কী ট্রেনিং দেওয়া হতো?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : অস্ত্র ট্রেনিং।
সমকাল : তখন আপনাদের কাছে অস্ত্র ছিল?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : হ্যাঁ, তখন আমাদের কাছে কিছু অস্ত্র ছিল।
সমকাল : অস্ত্রগুলো আপনারা পেলেন কীভাবে?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে যেদিন মতিউর মারা যায়, সেদিন মতিউরের লাশ দেখার জন্য আমাদের ছেলেরা যাচ্ছিল। ছেলেরা পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মন্ত্রী সুলতান আহমাদ চৌধুরীর বাড়িতে ঢুকলে নিরাপত্তা রক্ষীরা গুলি করে। তখন তার বাড়িতে ভাংচুর চালানো হয়। আমাদের ছেলেরা তখন পুলিশের অস্ত্রগুলো লুট করে নিয়ে আসে। আমি, কামরুল আলম খসরু অস্ত্রগুলো নিয়ে এসে ইকবাল হলে লুকিয়ে রেখেছিলাম। সেখানে আমাদের ৭-৮টি রাইফেল ছিল। পরে ঢাকা শহরের যেসব সিভিল মানুষের বন্দুক ছিল সেগুলোও আমরা নিয়েছিলাম।
সমকাল : অস্ত্রগুলো নিয়েই কেরানীগঞ্জে গিয়েছিলেন?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে আমরা রাত সাড়ে ৯টার দিকে বেরিয়ে এলাম। রাত পৌনে ১২টার দিকে ট্যাঙ্ক মুভ করল এবং সে সময় এসএম হলের গম্বুজে একটি শেল পড়ল। তারপর ট্রেসার রাউন্ডের ফায়ার শুরু হলো। তখন ইকবাল হলে আমাদের যেসব অস্ত্র ছিল সেগুলো দুটি গাড়িতে উঠাচ্ছি। যখন হামলা বেড়ে গেল তখন আমরা বুঝলাম আর পালানোর সুযোগ নেই। আমি প্রথম গাড়িতে। পেছনের গাড়িতে আরেকজন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে এবং জগন্নাথ হলের পাশের রাস্তা দিয়ে আমরা সোজা রমনা পার্কের দিকে চলে গেলাম। অনেক ট্যাঙ্ক তখন গড়গড় করে আসছিল। আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে দু'চারটি গুলিও হয়েছে। কিন্তু গুলি ওভারলুক করে আমরা চলে গেলাম। নবাবগঞ্জে গিয়ে বাড়ি থেকে পরিচিত-অপরিচিত লোকজনকে ধরে নিয়ে এসে আমরা বললাম, আমাদের এগুলো পার করে দাও। তারপর সেই অস্ত্রগুলো নৌকায় করে নিয়ে আমরা নেক্রোসবাগে আসি। এগুলো করতে করতে প্রায় ৩টা-সাড়ে ৩টা বেজে গেল। ঢাকা শহর তখন দাউদাউ করে জ্বলছে। ভাবলাম, যুদ্ধ করার জন্য আমাদের আরও অনেক অস্ত্র প্রয়োজন। তখন আমরা কেরানীগঞ্জ থানার অস্ত্র লুট করার পরিকল্পনা করলাম। থানার কাছে আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব ছিল। তাদের সহায়তায় আমরা থানা ঘেরাও করি। সকাল ৬টার দিকে আমরা থানা আক্রমণ করি। সে সময় ওখানকার ওসি তার বাড়ি থেকে দৌড়ে এসে আমাদের চাবি দিলেন। তালা খুলে আমরা থানার সব অস্ত্র নিজেদের কাছে নিয়ে নিই। সকাল ৬টায় থানার যেখানে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো হতো, সেখানে আমরা বাংলাদেশের পতাকা ওড়াই। আমাদের কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে সেখানে জাতীয় সঙ্গীতও গায়। এ অস্ত্রগুলোসহ আমরা কেরানীগঞ্জের নেক্রোসবাদে আসি।
সমকাল : ঢাকার ভেতরে অপারেশন করেছেন?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : রমনা মাঠে এবং ঢাকা ক্লাবে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প ছিল। সেখানে আমাদের ছেলেরা অপারেশন চালিয়েছে। এছাড় গ্রীন রোড, নিউ মার্কেট এবং যাত্রাবাড়ীতেও আমাদের ছেলেরা অপারেশন চালিয়েছে।
সমকাল : অপারেশন চালাতে গিয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা কি আপনার মনে পড়ে?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : একবার অপারেশন চালাতে গিয়ে আমাদের দু'জন ছেলে গ্রেফতার হয়। পাক হানাদাররা তাদের ওপর নিদারুণ নির্যাতন চালায়। গায়ে গরম পানি ঢেলে দেওয়ায় তাদের সমস্ত গায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল। পরে আমরা রাজাকারদের ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে এনেছিলাম।
সমকাল : ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ হতো কীভাবে?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : ২নং সেক্টরের যোদ্ধাদের সঙ্গে আমরা একসঙ্গে অপারেশন পরিচালনা করতাম। আমাদের কোনো বিভেদ-বিভাজন ছিল না। যে কোনো অপারেশন হলে সবাই একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।
সমকাল : নভেম্বর নাগাদ মুক্তিযোদ্ধারা পুরো ঢাকা ঘিরে ফেলেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কি ঢাকা দখল করা সম্ভব ছিল?
মোস্তফা মহসীন মন্টু : আমাদের হাইকমান্ড থেকে নিষেধ করা হয়েছিল। সে কারণে আমরা দখল করার উদ্দেশ্যে বড় অপারেশন চালাইনি ঢাকায়। আমাদের বলা হয়েছিল, শক্তি বৃদ্ধি করে শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। যুদ্ধ এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে এটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হয় বছরের পর বছর। ১০-২০ বছরেও একটা বিজয় আসে না। আমরাও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম যে, আমরা স্বাধীনতা দেখে যাব না। হয়তো আমাদের পরের প্রজন্ম স্বাধীন দেশ পাবে।