Tuesday, January 31, 2012

বইমেলা

শীত বাংলাদেশে উৎসবের ঋতু। আগে উৎসব ছিল প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক। এখন গ্রামের মেলা, পুতুল নাচ, যাত্রার শীতকালীন আয়োজনগুলোয় ভাটা পড়েছে। গ্রামের মানুষ যেমন জীবন ধারণের প্রয়োজনে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছে, তেমনি গ্রামের উৎসবগুলোও রূপ ও রঙ পরিবর্তন করে শহরে এসেছে। যেমন পহেলা বৈশাখের ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনি সত্যি বাণিজ্যমেলা ও বইমেলার ক্ষেত্রেও। বছরের শুরুতে বাণিজ্যমেলা রাজধানীবাসীর জন্য রীতিমতো উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। রাজধানীর বাইরে থেকেও অনেকে বাণিজ্যমেলাকে উপলক্ষ করে ঢাকায় আসেন। বাণিজ্যমেলা শেষ হতে না হতেই আসে বইমেলা। ফেব্রুয়ারির এই অমর একুশে বইমেলাই এদেশে একমাত্র বইকেন্দ্রিক বড় উৎসব। পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় বই নিয়ে আয়োজন প্রতিদিন লেগে থাকে। সেখানকার অধিবাসীরা চলার পথে, অবসরে, ছুটিতে বইয়ের সঙ্গ পছন্দ করেন। প্রযুক্তির বিপুল বিকাশের মধ্যেও সেখানে বই পড়ার সংস্কৃতি ফিকে হয়ে যায়নি। আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে হা-হুতাশ প্রকাশ করি, কিন্তু বই পড়া নিয়ে আমাদের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করি না। আমাদের দেশে কেউ চলতি পথে পড়বে বলে বই বহন করছে এমন দৃশ্য দেখা যায় না কেন, সে প্রশ্ন কি আমরা করি? পাশ্চাত্যে হয়তো বই পড়ার সংস্কৃতিতে ভাটা পড়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে সে সংস্কৃতি কখনও গড়েই ওঠেনি। ইতিহাসে এমন কোনো স্বর্ণযুগের উল্লেখ পাওয়া যায় না যখন আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে জ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার প্রাচুর্য দেখা দিয়েছিল। আধুনিক যুগেও এমন কোনো নজির নেই। এদেশে এখনও জনসংখ্যার অর্ধেকই সাক্ষরতার বাইরে। যারা সাক্ষর, তাদের অনেকেই পড়ার অভ্যাসের মধ্যে নেই। যে ছোট অংশটি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, তাদের কতজন বিদ্যাচর্চার সঙ্গে জড়িত সে প্রশ্নও মাঝে মাঝে ওঠে। শিক্ষিত লোকেরা যদি পড়াশোনা ও জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখেন তাহলে সম্পর্ক রাখবেন কে? বইয়ের সঙ্গে শোচনীয় এই সম্পর্কের কারণে বই নিয়ে আমাদের প্রায় একমাত্র আয়োজনে পরিণত হয়েছে ফেব্রুয়ারির বইমেলা। এ মেলার সঙ্গে বিপণনের সম্পর্ক রয়েছে। বই প্রকাশের সম্পর্ক রয়েছে। রয়েছে ভাষা নিয়ে আমাদের জাতিগত আবেগের সম্পর্কও। কিন্তু সেই আবেগ কি আমাদের জ্ঞানগত উত্থানে প্রেরণা জোগাতে পেরেছে? ফেব্রুয়ারি মাস গেলে বই বিক্রি কতটা হয় সে খবর কি রাখার অবকাশ আছে আমাদের? ফেব্রুয়ারি গেলে লেখক-প্রকাশকরা কী করেন সে খবরই বা কে রাখে। পাশ্চাত্যের পত্রপত্রিকাগুলোয় প্রতিদিনই বই নিয়ে কোনো না কোনো আয়োজনের খবর থাকে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া লেখক ও বইকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করে। কিন্তু আমরা শুধু ফেব্রুয়ারিতেই সেটা করি। এটি বলে দেয়_ ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমাদের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও এটি একটি মৌসুমি আয়োজন। আমাদের সারা বছরের চিন্তাচর্চার সঙ্গে এর সম্পর্ক সামান্যই। শীতকাল উৎসবের মৌসুম বলেই হয়তো বইমেলা জমজমাট হয়। কিন্তু এ মেলা কি পাঠকের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক তৈরি করতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। আর জরুরি বই নিয়ে আমাদের অনীহা দূর করা। অগ্রগতির জন্য যে প্রজ্ঞা দরকার তা বই থেকেই আসতে পারে, সেটি যেন আমরা ভুলে না যাই।

নিয়ন্ত্রণ নাকি উদ্বুদ্ধকরণ?

আমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন। বাংলায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন। প্রতিষ্ঠানটির সংক্ষেপিত নাম বিটিআরসি। নামের মধ্যে কাজের যে ইঙ্গিত তাতে নিয়ন্ত্রণ শব্দটিই প্রধান। নিয়ন্ত্রণ বলতে কী বোঝায়? বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে_ নিয়ন্ত্রণ অর্থ শাসন, নিয়মন, সংযমন, নিবারণ, প্রশমন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় যখন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রযুক্তির প্রসার দরকার, তখন টেলিযোগাযোগ বিষয়ক একটি স্বায়ত্তশাসিত কমিশনের নামে কেন নিয়ন্ত্রণ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হবে? প্রশ্নটি ওঠা উচিত। গত দেড় দশকে দেশের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। এ অগ্রগতির জন্য বেসরকারি খাতের উদ্যোগগুলোই বাহবা পায়। কেন এসব ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগগুলো পিছিয়ে থাকে? অনেক সমস্যার কথাই ওঠে। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের মূল সুর নিয়ন্ত্রণ, নিবারণ, বাধা দান তারা অগ্রগতিতে অবদান রাখবে কীভাবে? প্রতিষ্ঠানটির নাম যদি হতো টেলিযোগাযোগ উদ্বুদ্ধকরণ কমিশন, তাহলে হয়তো উন্নয়নকামী একটি দেশের কমিশন হিসেবে তাদের অবদান অনেক ভালো হতো। বিটিআরসির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক বোধকরি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ২৫ জানুয়ারি বিডিনিউজ খবর দিয়েছে, বিটিআরসি সম্প্রতি বাংলাদেশ কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম, সংক্ষেপে_ সিএসআইআরটি নামে একটি দল গঠন করেছে। টিমটি সাইবার অপরাধ শনাক্তকরণে কাজ করবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে নিরাপত্তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগী হতে পারে। সাইবার জগতে ক্রমবর্ধমান পর্নোগ্রাফি, জালিয়াতি, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি লঙ্ঘন ঠেকাতে এ ধরনের টিমের অবদান থাকতে পারে। অগণতান্ত্রিক, স্বার্থান্বেষী শক্তিকে প্রতিহত করার জন্যও এ টিমের অবদান থাকতে পারে। কিন্তু এই টিমের মূল কাজ হিসেবে যা জানা যাচ্ছে তা কতটা সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িত আর কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কেননা বিটিআরসি বলছে, সিএসআইআরটির মূল কাজ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায় এমন ওয়েবসাইটগুলো শনাক্ত করা এবং টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া। প্রশ্ন হলো, সাইবার জগতে এত অপরাধ থাকতে কেন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষের দিকেই বিটিআরসির বিশেষ নজর পড়ল? বাংলাদেশ ধর্মীয় সহাবস্থানের অনন্য এক স্থান, সামাজিকভাবেও শান্তিপূর্ণ একটি দেশ। কিন্তু রাজনৈতিক বিদ্বেষ বলতে কী বোঝায়? বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিকভাবে পরস্পরের প্রতি বিদ্বিষ্ট। এসব দলের নেতারা অনেক সময় শালীনতার তোয়াক্কা না করে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ান। এ বিদ্বেষ কমানোর দায়িত্ব কি বিটিআরসির? আর রাজনীতির মাঠের এই বিদ্বেষ বাদ দিয়ে হঠাৎ অনলাইন জগতেই কেন রাজনৈতিক বিদ্বেষ খোঁজা হবে? আর রাষ্ট্রীয় বিদ্বেষ বলতে কী বোঝায়? রাষ্ট্র মত-বর্ণ-ধর্ম-জাতি-পেশা নির্বিশেষে সকলের জন্য। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থাকবে কেন? অনলাইন জগতের অনেক নাগরিক মনে করছেন, বিটিআরসির এই উদ্যোগ আসলে ভিন্নমত, সমালোচনা ও গণতান্ত্রিক তর্ক-বিতর্কের পথ রুদ্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছে। নইলে, সাইবার জগতের এত অপরাধ বাদ দিয়ে হঠাৎ করে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ ছড়ানোর যুক্তি তাদের মাথায় আসত না। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, বিটিআরসি অনলাইন জগতে অগণতান্ত্রিক ও স্বার্থান্বেষী শক্তির তৎপরতা ঠেকাতেই এই টিম গঠন করেছে, তাহলেও রাজনৈতিক ভিন্নমতের বিরুদ্ধে তাদের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হবে না। অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ঠেকাতে হলে গণতন্ত্রকেই মজবুত করতে হবে। আর গণতন্ত্রকে মজবুত করতে হলে মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে। মানুষের কথা শুনতে হবে। সরকার ও বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। তেমনি ভিন্নমত ছাড়াও গণতন্ত্র হয় না। ভিন্নমতকে বিদ্বেষ বলে আখ্যায়িত করার কোনো অবকাশ গণতান্ত্রিক সমাজে নেই। মানুষের মুক্তমতকে বাধাগ্রস্ত করে গণতন্ত্র রক্ষার উদ্যোগ কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি নিতে পারে না। ফলে বিটিআরসির উদ্যোগ যাতে দেশের ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মুক্তমতকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। ইন্টারনেট মানুষের সামনে গণতন্ত্র, অধিকার ও মতপ্রকাশের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ইন্টারনেটকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন উদ্যোগ কখনোই আসা উচিত নয়। গণতান্ত্রিক সরকারের তরফে এমন উদ্যোগ এলে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না।

Saturday, January 21, 2012

দুই নৌকা

অগ্রজ এক কবি অনুজ কবির কবিতার আলোচনায় লিখছেন_ কবিতায় ছন্দের প্রখরতা আছে, উপমা ও শব্দ প্রয়োগে নতুনত্বও আছে কিন্তু 'দাহ' নাই। আলোচনাটি পড়তে পড়তে দাহ শব্দটায় এসে থমকে দাঁড়াতে হলো। দাহ বলতে কবি কী বলেছেন বুঝতে চাইলাম। সাহিত্যে অনেক কথাই আকারে-ইঙ্গিতে, আরেঠারে হয়। সাধারণ কথার মধ্যেও থাকে দ্ব্যর্থকতা। খুব সিরিয়াস ভঙ্গির বর্ণনার মধ্য দিয়ে কেউ হয়তো পরিহাসই করতে চাইছেন, কিংবা দেখা যায় পরিহাস করতে করতে পাঠককে কাঁদিয়ে চলেছেন ক্রমাগত। যেমন একজন লেখক একটি উপন্যাসের আলোচনা করতে গিয়ে লিখলেন_ আখ্যান অত্যন্ত শক্তিশালী, চরিত্র চিত্রণ ভালো, কাহিনীর পরম্পরাও সঠিকভাবে অনুসৃত হয়েছে কিন্তু কাব্যগুণে কমতি আছে। পড়ে কেউ বাঁকা প্রশ্ন করতেই পারেন_ উপন্যাসে কাব্যগুণ থাকবে কেন? কাব্যগুণ প্রসঙ্গে একজন অভিজ্ঞ সাহিত্যিককে বলতে শুনেছি, সাহিত্যের যে কোনো আঙ্গিকই কাব্য। এটা নাকি অনেকটা তরকারির লবণের মতো। রান্না যত ভালো হোক, যত পুষ্টিকর হোক, পরিবেশন যত সুন্দর হোক না কেন লবণের মাত্রা ঠিক না থাকলে চূড়ান্ত বিচারে রান্নাকে ভালো বলা যায় না। সাহিত্যেও তেমনি লাবণ্য_ অর্থাৎ কাব্যগুণ।
লবণ বা লাবণ্যের মতো কি কোনো আবশ্যিক ব্যাপার দাহ বা দহন? দহন যদি না থাকে তবে কি কবিতা অপূর্ণ থেকে যায়? হয়তো তা-ই। কবিতায় দাহ থাকে যখন সমাজ-সংসারের আগুন কবিকে স্পর্শ করে। কবি দগ্ধ হন বলেই কবিতায় দাহ প্রকাশিত হয়। সবচেয়ে প্রখর অনুভূতি-সম্পন্ন বলে কবিদের দগ্ধ হতেই হয়। অথচ বিদগ্ধদের তালিকায় কবিদের নাম সবসময় পেছনের সারিতে। কথায় কথায় আমরা বিদগ্ধ শব্দটা ব্যবহার করি। কালে কালে শব্দটা এমন অর্থ পেয়েছে যে, কবিকে নয়_বরং প্রাবন্ধিককে বিদগ্ধ বলার রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে। বলা যায়, বিদগ্ধ শব্দটাই যথেষ্ট দগ্ধ নেই আর। ফলে, বিদগ্ধ হওয়া দূরের কথা, প্রাবন্ধিক কখনো দগ্ধ হন কি-না তা নিয়েও সংশয় আছে। কিন্তু তাকে বিদগ্ধ বলাই রেওয়াজ। কিন্তু প্রকৃত অর্থে যদি দগ্ধ বা বিদগ্ধ কোনো মানবগোষ্ঠীর উল্লেখ করা হয় তবে তাতে কবিদের রাখতেই হবে। ফলে, কবি যখন বলেন, কবিতায় তিনি দাহ ব্যাপারটি খুঁজে পাচ্ছেন না তখন বুঝতে হবে আবশ্যিক উপাদানেরই কমতি পড়েছে। তবে, 'দাহ' কবিতায় একটা অনুভূতি মাত্র নাকি অনিবার্য গন্তব্য সেটি ভিন্ন তর্ক।
আমাদের এক কবি পরবর্তী প্রজন্মের আরেক কবির কবিতায় আবিষ্কার করেছিলেন তাকিয়ে দেখার আনন্দ। বস্তুবিশ্বের দিকে তাকিয়ে থেকে কি আনন্দ লাভ সম্ভব_ যদি বিস্ময়, আবিষ্কার, ভালোবাসা এমনকি ঘৃণাও না থাকে? কবির চোখের সামনে যদি ক্রমাগত অনূদিত না হতে থাকে রহস্যের পৃষ্ঠাগুলো তবে কেবলই তাকিয়ে থেকে তিনি আনন্দ পেতে পারেন কিংবা সেই তাকিয়ে দেখার আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন?
অনেকেই মনে করেন, কবিতার মূল শক্তি ভালোবাসা, ঘৃণা, বিস্ময় ও আবিষ্কার। জীবনের চিরচেনা দৃশ্যের গভীর থেকে অনির্ণেয়-অনির্দেশ্য আরেক সত্য আবিষ্কারের মধ্যেই কবিতার জন্ম। ফলে, কবিকে চেনা জগতের দিকেই বিস্ময় নিয়ে তাকাতে হয়। দেখা বস্তুকেই নতুন করে দেখতে হয়। জানা বস্তুকে নতুন করে জানতে হয়। স্থিতিশীল পৃথিবী অস্থিতিশীল হয়ে যায় তার ভাবনার জগতে। পায়ের নিচে ফুটপাথ বদল হয়ে যায়। যাকে ভালোবাসা যায় না তাকে ভালোবাসতে হয়, যাতে ঘৃণা করা যায় না তাকে ঘৃণা করে দেখতে হয়। বিদগ্ধ কবিমাত্রই চেনা জগতের মধ্যেই এমন আরেক জগতকে চিনিয়ে দেন। সকলে একদিন না একদিন স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তারা এ জগৎকে এভাবে আর কখনোই জানেননি, দেখেননি কিংবা আস্বাদন করেননি।
কবিতাকে পিঠ দেখিয়ে যদি আখ্যানের দিকে তাকাই তবে কী ঘটে? আখ্যানের জন্ম কোথায়, কীভাবে, কোন অনুভূতি থেকে? কেউ কেউ বলেন, আখ্যানের জন্ম স্বর্গে। মানুষের স্বর্গবিচ্যুৎ হওয়ার কিছু আগে। যখন আদি মানব ভাবছেন, শয়তানের প্ররোচনায় তিনি নিষিদ্ধ ফলটি খাবেন কি খাবেন না, তখনই তার চিন্তার সমান্তরালে একটি আখ্যানের জন্ম হয়েছে। এজন্যই অনেকে আখ্যানকেই 'দ্বিধা' বলে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত, আদি মানবের অন্তরের সেই দ্বিধা শুধু স্বর্গ থেকে মানুষকে বিচ্যুৎ করলো না, জন্ম হলো আরও অনেক দ্বিধার। স্বর্গের বাইরে আরেক জগৎ সৃষ্টি হলো। ফলে, যদি প্রশ্ন ওঠে কথাসাহিত্যের আদিমতম অনুভূতির নাম কী? তবে অনেকেই সঠিকভাবে বলবেন 'দ্বিধা'। পরবর্তীকালে আমরা দেখবো, আখ্যানগুলো কাব্যের ওপর ভর দিয়ে এগিয়ে চলেছে কিন্তু দ্বিধান্বিত মানুষের সঙ্গে ঘন ঘন শয়তানের দেখা হচ্ছে। ভালো ও মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণ, পাপ ও পুণ্যের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ লেগেছে। অভিধানে আছে, দ্বিধা অর্থ_ দুই ধারা, দুই ভাগে, দুই রকমে বা রীতিতে। দ্বিধার পরেই যে শব্দটি বসে তার নাম বিভক্ত। দ্বিধা মানে দোটানা, সংশয়, সংকোচ, ইতস্তত ভাব। আদি মানবের দ্বিধাজনিত একটি সিদ্ধান্ত থেকে দুটি জগতের জন্ম হলো_ একটি স্বর্গ, আরেকটি পৃথিবী। পৃথিবীর দ্বিধাজনিত কর্মকাণ্ড থেকে এলো কৃতকর্মের প্রসঙ্গ। জন্ম হলো নরক। আমরা দেখবো, সাহিত্যে বারবার শয়তানের সঙ্গে দেখা হচ্ছে মানুষের। গ্যয়টের ফাউস্ট কাব্যে মহামতি ফাউস্টের সঙ্গে দেখা হচ্ছে মেফিস্টোফেলিসের। মেফিস্টোফেলিসের প্ররোচনায় আত্মবিক্রয়ে রাজি হয়ে যাচ্ছেন জ্ঞানী ফাউস্ট পর্যন্ত। ক্রিস্টোফার মার্লোর ডক্টর ফস্টাসের কাহিনীও অনুরূপ। এরপর আমরা দেখবো, হ্যামলেটের মধ্যে দ্বিধার তীব্র ও গভীর বসতি তৈরি হচ্ছে। প্রেতাত্মা মারফত হ্যামলেট জেনে যাচ্ছেন, তার পিতার হত্যাকারী আসলে তার চাচা ক্লদিয়াস। হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত তার মা গারট্রুডও। এই সত্য জেনে হ্যামলেটের মধ্যে প্রবল হচ্ছে প্রতিশোধ বোধ। কিন্তু প্রতিশোধ কীভাবে নেবেন তিনি? আসলেই কি নেবেন? হ্যামলেট দ্বিধাগ্রস্ত। দ্বিধা তাকে ক্রমশ আত্মমুখী, নির্জন করে তুলছে।
লক্ষ্য করবো, দ্বিধার মতো মানবিক এক অনুভূতির প্রেক্ষাপট তৈরি করার জন্য আমাদের সেরা লেখকদের অনেকেই দারস্থ হয়েছেন শয়তান বা প্রেতাত্মা বা দুষ্ট লোকের। কেন? শয়তানের প্ররোচনা ছাড়া কি মানুষের মনে দ্বিধার জন্ম হতে পারত না? তখন বিশ্বাস ছিল, অপশক্তির প্ররোচনা ছাড়া দ্বিধার জন্ম হতে পারে না। কেননা দ্বিধা হলো মানুষের অসুখ। দ্বিধার বিপরীত অনুভূতির নাম একাগ্রতা। একান্তই স্বর্গীয় এ অনুভূতির বাইরে দাঁড়িয়ে যখন কেউ ভাবে সামনে দুটো পথের কোন দিকে যাবে তখন শয়তান ছাড়া আর কে তাকে প্ররোচনা জোগাবে? কার এত গরজ?
কথিত আছে মুক্তা হলো ঝিনুকের দুরারোগ্য ব্যাধি। রোগগ্রস্ত হলে ঝিনুকের মধ্যে মূল্যবান রত্ন_ মুক্তার উন্মেষ ঘটে। তেমনি দ্বিধা নামক অসুখ থেকে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে আখ্যান, কথাসাহিত্য। উপন্যাসের লেখকরা যেন হ্যামলেটের মতোই ভাগ্যবিড়ম্বিত ও দ্বিধান্বিত। সত্য জেনে কীভাবে তার প্রতিবিধান করবেন, ভাবছেন হ্যামলেট। কিন্তু লোকে ভাবছে, হ্যামলেটের আত্মমগ্নতা আসলে গভীর প্রেমের ফসল। অন্যদিকে, লেখককে কেউ প্ররোচনা দেয় না, কিন্তু লেখক তার অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টিতে দগ্ধ হয়ে জেনে যান কী কেন কীভাবে। কার্য ও কারণ একই সঙ্গে। তিনি যখন রচনা করেন আখ্যান, তখন সেখানে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, কল্যাণ-অকল্যাণের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। কখনও কখনও মনে হয়, আখ্যানকার যেন বা অন্যায়ের প্রতিনিধি, কখনও বা ন্যায়ের। এই যে বিদ্যমান সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে নতুনভাবে সত্য নির্মাণের প্রক্রিয়া_ এরই নাম উপন্যাস। উপন্যাস মাত্রই বিনির্মাণ। উপন্যাসিক ঘটনাবলিকে উপন্যাস্ত করেন। বিদ্যমান বিন্যাস বা ন্যাস থেকে ঘটনা ও চরিত্রাবলিকে অন্যত্র প্রতিস্থাপন করে নানা দিক থেকে দেখে তিনি ঘটনাবলিকে নতুন করে পরখ করেন। সত্যাসত্য পুনর্নির্ণয় করে। ফলে, কেউ যদি বলেন ঔপন্যাসিকের মূল হাতিয়ার ভাষা। তবে তিনি ঠিক বলছেন। কেউ যদি বলেন_ আখ্যান, চরিত্র, বর্ণনা, ঘটনাবলীর উত্থান-পতন তবে তাও সত্য। কিন্তু ঔপন্যাসিকের মূল অবলম্বন অবশ্যই দ্বিধা। আমরা শেক্সপিয়ারের নাটকগুলোর আখ্যানের দিকে খেয়াল করলে দেখব_ তিনি মুখ্যত মানব চরিত্রের দ্বিধা নিয়েই কাজ করেছেন। আধুনিকতম কোনো উপন্যাসের মূল সুরও যদি খেয়াল করতে চাই তবে দেখব সেখানেও এক অনিবার্যভাবে দ্বিধাই সক্রিয়। টু বি অর নট টু বি... প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আয়োজন চলছে সর্বত্র। ফলে, লেখককে কেউ যদি 'দ্বিধার কারবারি' বলেন তবে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে এমনও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে যে, লেখক নিজেই নিজেকে দ্বিধার কারবারি আখ্যা দিচ্ছেন। তবে অতি সাম্প্রতিক দ্বিধার সঙ্গে পূর্বতন দ্বিধার মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে। আগের আখ্যানগুলোতে প্ররোচক বা অনুঘটকের কাজ করত ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী শয়তান। কখনও প্রেতাত্মা বা দুষ্ট লোকেও পাপটি জাগিয়ে তুলত। কিন্তু কালের বিবর্তনে আমরা দেখব, প্রেক্ষাপট থেকে শয়তান অন্তর্হিত হয়েছে। মানুষের মনে দ্বিধা আপনা-আপনি জাগছে। মানুষ নিজেই খুলতে পারছে নিজের সামনে দুটি পথ। কোনটি বেছে নিয়ে এগোবে সে সিদ্ধান্তও একান্তই তার।
বাংলা ভাষায় খুব সুন্দর একটি কথা আছে, দ্বিধান্বিত পরিস্থিতি বোঝাতে_ দুই নৌকায় পা। দুই নৌকায় পা দিলে নাকি দুর্ঘটনার সমূহ আশঙ্কা। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, কার নেই দুই নৌকায় পা? তবে উত্তর মেলা ভার। কেননা, সকলেরই পা দুই নৌকায়। ইতি আর নেতির নৌকা তো আছেই। আছে বুদ্ধি ও আবেগের নৌকাও। কেউ কেউ বলেন, বুদ্ধি দিয়ে নয়, অন্তরাত্মার পরামর্শ মেনে চলো। কেউ বা বলেন, আবেগ দিয়ে নয় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করো। এই পৃথিবীতেই আমরা দেখছি, হাজার হাজার মানুষ ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে ট্যাঙ্কের সামনে নেমে পড়ছে খালি হাতে যুদ্ধ করতে। কিংবা দেখছি বছরের পর বছর সামরিক শাসনের জাঁতাকলে জর্জরিত হয়েও কেউ পথে নামছে না। কখন কীভাবে কেন নামবে সে হিসাব মিলছে না তাদের। আবেগে যে নেমে পড়ছে রাস্তায় তাকে ঠিক বলবো নাকি তাকে ঠিক বলব যে বুদ্ধি দিয়ে চলতে চলতে বসে পড়ছে রাস্তায়? মূল্যবোধ ও বাস্তবতার দুই নৌকাও তো আছে। মূল্যবোধ বলে এটা করো, বাস্তবতা বলে বিপদ হতে পারে। প্রবৃত্তি বলে, নাও। নীতি বলে নিও না। প্রয়োজন বলে চলো, আদর্শ বলে থামো। দ্বিধা মানুষের দুরারোগ্য এক ব্যাধি। জোসেফ ক্যাম্পবেল লিখেছিলেন, মানুষের কী করা উচিত তা জানতে হলে বাইবেল পড়ূন। আর মানুষ কী করছে তা জানতে হলে পড়ূন সংবাদপত্র। ধর্মগ্রন্থগুলো বলে, ধর্মপথে চললে সে পথের একাগ্রতাই মানুষকে নিয়ে যাবে সেই স্বর্গে, যেখান থেকে সে বিচ্যুৎ হয়েছিল দ্বিধার খেসারত দিতে গিয়ে। কিন্তু স্বর্গে ফিরে যাবার ইচ্ছা কি সত্যিই মানুষের আছে? দুই নৌকা থেকে পা উঠিয়ে একটি নৌকা বেছে নেবার সামর্থ্য অর্জন করতে পারবে কি মানুষ কখনও? দ্বিধাহীনতা মানুষকে মানবোত্তীর্ণ করে বটে, কিন্তু দ্বিধা ছাড়া মানুষ হয় না। সত্যি কথা বলতে, দ্বিধা না থাকলে পৃথিবীই হতো না। দ্বিধা আছে বলেই, আছে_ পৃথিবী, সভ্যতা, যুদ্ধ, গ্গ্নানি, নশ্বরতা, পাপ, কামনা, প্রবৃত্তি। আর আছে কথাসাহিত্য।

Tuesday, January 17, 2012

ভারত চীন নয়

সম্পাদকীয়, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৪ জানুয়ারি ২০১২, শনিবার
দিল্লির একটি নিম্ন আদালতের রায়ের পর দিল্লি হাইকোর্টের শরণাপন্ন হলে আদালত ফেসবুক ও গুগলসহ ২১ কোম্পানির কর্মকর্তাদের এই মর্মে হুশিয়ারি দিয়েছেন যে, 'আপত্তিকর' উপাদান না সরালে সাইটগুলো একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিচারক সুরেশ কাইতের ভাষায় : 'আপনাদের তদারকি ব্যবস্থায় কড়াকড়ি আনতে হবে। নয়তো, চীনের মতো আমরাও এ ধরনের সব ওয়েবসাইট বন্ধ করার আদেশ দেব।' সরকারকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তারা এই ধরনের মামলা (যার অনেক অভিযোগই জামিন অযোগ্য) চালানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করে কি-না। সরকার মামলায় সম্মতি দিয়েছে। আইটি ও এইচআরডিমন্ত্রী কপিল সিবাল সামাজিক মাধ্যমের 'আপত্তিকর' উপাদানের উলেল্গখ করে ভারতের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ উপাদান সরিয়ে ফেলার ঘোষণা দেওয়ার মাসখানেক পর এমন ঘটনা ঘটল।
ওয়েবের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণার অভাবেই সামাজিক মাধ্যম সম্পর্কে সাম্প্রতিক আলোচনার উদ্ভব ঘটেছে। পেশাদার সংবাদপত্র ও সম্প্রচার মাধ্যমের মতো নয়, বরং গুগল, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি পোস্ট অফিসের মতো মধ্যবর্তী অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তারা সরল অর্থে কোটি মানুষের জন্য এমন একটি পল্গাটফর্ম তৈরি করে যেখানে লোকেরা পরস্পরের মধ্যে কথা বলতে পারে। সামাজিক মাধ্যম সরলার্থে আমাদের ধ্যান-ধারণার প্রকাশ ঘটায়, এর মাধ্যমে যেমন ঘৃণার বাক্য ও পর্নো এবং ধর্মবিদ্বেষ ছড়ানো সম্ভব তেমনি উদ্দীপনামূলক কথা ও শুভেচ্ছাবাণীও বিনিময় করা যায়। ব্যবহারকারীরা যদি কোনো উপাদানকে সমস্যাজনক মনে করে অভিযোগ দাখিল না করেন তবে নিজে থেকে সাইটগুলো সব কথোপকথন মডারেশন করতে পারে না_ অপরাধীকে শনাক্ত করে শাস্তিও দিতে পারে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, যুগপৎভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে আপত্তিকর উপাদানগুলোকে চিহ্নিত করা যায় না_ এ বিষয়ে সল বেলোর সেই উক্তিটি স্মরণীয়, যেখানে তিনি বলেছেন, 'দমননীতির চূড়ান্ত বা যথাযথ অবস্থা বলে কিছু নেই_ কেউ যদি কানকে দমন করতে যায় তবে আবশ্যিকভাবে মাথাটিও দমিত হবে।'
এটা সত্য যে, অনলাইন বা অফলাইন যেখানেই ঘটুক_ সহিংসতার উস্কানি বা অপরাধে মদদের ঘটনা ঘটলে এর আইনি পরিণতি থাকে। কিন্তু গভীর উদ্বেগের বিষয় যে, আমাদের স্বাধীন আদালত এবং গণতান্ত্রিক সরকার এ বিষয়ে চীনের সমকক্ষ হওয়াকে গর্বের বিষয় মনে করে। চীন সরকার আইএসপি ও কনটেন্ট প্রোভাইডারদের অনলাইন উপাদান তদারক করতে বাধ্য করেছে, 'সাইবার ভিন্নমতাবলম্বীদের' কারারুদ্ধ করেছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের এই বার্তা দিয়েছে যে, তারা তদারকি ও শাস্তির আওতায় আছে। তারপরও তাদের প্রক্সি সার্ভার, বিকল্প পদ্ধতি ও একই ধরনের চীনা ওয়েবসাইটগুলোর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। ওয়েবে সেন্সর আরোপের যে প্রযুক্তিগত বাধা আছে তার বাইরেও ভারত অপরিহার্যভাবে পরিপকস্ফ গণতন্ত্রের অধিকারী। ভারতের উচিত ওয়েব নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ধরনের অভিপ্রায় প্রত্যাখ্যান করা, কেননা ভারত চীন নয়।

Sunday, January 15, 2012

চীন হওয়ার সহজ উপায়

ভারতের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী কপিল সিবাল গত মাসে ফেসবুক ও গুগল নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য দিয়ে রীতিমতো বিপদে পড়ে গেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারীরা তো বটেই, গণতান্ত্রিক ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোও রীতিমতো তোপ দেগেছে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদকীয় প্রকাশ করে মন্ত্রীর সমালোচনা করেছিল। এ সম্পাদকীয়গুলোর মধ্যে একটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। তারা বলেছিল, ভারতের মধ্যে চীন হওয়ার বাসনা কাজ করছে। চীন ও ভারতকে আগামী বিশ্বের বড় দুই অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চীনের প্রবৃদ্ধি, বাজার ও উন্নয়নের গতি ভারতকে নিত্যই তাড়া করে ফেরে। ভারতের সরকার, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা সবসময় চীনকে চোখে চোখে রাখেন। ফলে ভারতে বহু উচ্চারিত শব্দ চীন, হয়তো চীনেও ভারত বেশ আলোচিত প্রসঙ্গ। ভারত যে অর্থনৈতিক নিরিখে চীন হওয়ার বাসনা পোষণ করে সেটি অনেকের গ্রহণযোগ্য বিষয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভারত যদি গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে চীনের মতো দমননীতি অবলম্বন করে তবে প্রথমত তা পরিহাসের বিষয়, পরে উদ্বেগের বিষয়ও হয়ে উঠতে পারে। একদলীয় অর্থাৎ কমিউনিস্ট শাসনের আদর্শে দীক্ষিত চীনে স্বাধীন গণমাধ্যম নেই, জনগণের মতপ্রকাশের অধিকারও নেই। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার আছে বটে কিন্তু ফেসবুক, গুগল সেখানে নিষিদ্ধ। চীনের নাগরিকরা ইচ্ছা করলেই কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে বা মত জানাতে পারেন না। কিন্তু ভারতে উল্টো পরিস্থিতি। বহু বছরের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কারণে ভারতে শক্তিশালী গণমাধ্যম গড়ে উঠেছে। জনমতের শক্তিও সেখানে ব্যাপক। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশটির নাগরিকরা নিজেদের মত ব্যক্ত করছেন, সংগঠিত হচ্ছেন। এই ভারতে যদি কোনো অজুহাতে কেউ গুগল-ফেসবুক নিষিদ্ধ করার দাবি জানায় তবে তাতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। হয়েছেও তাই। মন্ত্রীর উক্তির পর কেউ কেউ বলেই ফেলেছেন, ভারত কি জনমত রূদ্ধ করে চীনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে? যদি তাই হয় তবে চীন হওয়ার দরকার আমাদের নেই। এই চীন হয়ে আমরা কী করব? যদি নাগরিকদের স্বাধীনতাই না থাকে তবে অর্থনীতি দিয়ে কী হবে? তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, ইন্টারনেটের ওপর কড়াকাড়ি আরোপই কি চীনের উন্নয়নের মন্ত্র? যাই হোক, কপিল সিবালের মন্তব্যের পর অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়ে গেছে। কিন্তু সরকার দমেনি। তারা গুগল ও ফেসবুকের কর্তাদের ডেকেছেন। ডেকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য সরানোর উপায় নিয়ে চীনা স্টাইলে চাপ দিয়েছেন। গুগল, ফেসবুকের বড় বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে ভারতে। তারাও সরকারের ডাকে সাড়া দিয়েছে। ফেসবুক ও গুগল হরহামেশা বিভিন্ন সরকারের আহ্বানে কনটেন্ট সরায় বা লুকিয়ে ফেলে। ভারত সরকার তাদের সাম্প্রদায়িক উস্কানি বা অন্য কোনো ক্ষতিকর উপাদান সরিয়ে ফেলার অনুরোধ জানাতে পারে। যদি জানায় তবে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু গুগল বলে, বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের কাছে সরকারবিরোধী উপাদান সরানোর আহ্বান জানায় এবং তারা সেগুলো সরায়। অনুরোধের দলে ভারত অন্যতম দেশ। ফেসবুকও অনুরোধে ঢেঁকি গেলে। যদি তাই হয়, তবে আর এ সাইটগুলো বন্ধ করার হুমকি উঠবে কেন? মাথায় ব্যথা হলে ব্যথার ওষুধ দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু মাথা কাটা হবে কেন? ভারতের একটি আদালত সম্প্রতি ফেসবুক ও গুগলের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, আপনাদের অবশ্যই কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। নইলে আমরা চীনের মতো এ ধরনের সাইট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো। আপত্তিকর উপাদান থাকলে তা সরানোর নির্দেশ আসতেই পারে। একেবারে নিরাময় অযোগ্য ব্যাধি হলে সাইটও বন্ধ করে দেওয়ার উদাহরণ আছে। তাই বলে চীনের মতো? ভারত চীনের মতো হতে চাইলে তাতে দুঃখের যথেষ্ট কারণ আছে। কথায় আছে, পুঁজিবাদে পেঁৗছানোর সবচেয়ে দীর্ঘতম পথের নাম সমাজতন্ত্র। আর সমাজতন্ত্রে পেঁৗছানোর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ হলো মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করা। লোকে ভেবেছিল, ভারতের নব উত্থানে তাদের যাত্রা হবে গণতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো। সে আশায় বুঝি এবার বালি পড়ল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বদলে চীন যাত্রা শুরু হলো তার।

Thursday, January 12, 2012

ইউক্যালিপটাস

ইউক্যালিপটাস বৃক্ষ দেখতে মনোহর। আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকা এমন বৃক্ষ দেশীয় জাতের মধ্যে দুর্লভ। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষের মধ্যে একমাত্র গগন শিরিষের সঙ্গেই এর তুলনা চলে। ইউক্যালিপটাস গাছ বাড়ে দ্রুত। ইউক্যালিপটাস শোভিত অঙ্গনের সৌন্দর্যও অন্যরকম। অনেক সময় আশপাশের কোনো এলাকায় মনোহর সৌন্দর্য দেখে আমরা আপন মনে বলে উঠি, ছবির মতো সুন্দর। অথবা এমন দৃশ্য শুধু বিদেশেই দেখতে পাওয়া যায়। যেন সুন্দর হতে হলে কোনো দৃশ্যকে ছবিতে স্থান পেতে হবে কিংবা বিদেশি হতে হবে। ইউক্যালিপটাস শোভিত অঙ্গনগুলো এমন ছবির মতো কিংবা বিদেশি দৃশ্যের মতো হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য দেখতে সুন্দর হলেও কাজে খাটো নয়। কাঠ যথেষ্ট ভালো, ইলেকট্রিক খুঁটি তৈরিতে নাকি ইউক্যালিপটাসের জুড়ি নেই। অল্প সময়ে কেজো কাঠের উৎপাদন করতে হলে ইউক্যালিপটাস যথার্থ নির্বাচন। এত ভালো একটা গাছ হলেও ইউক্যালিপটাসের মধ্যে অহিতকর উপাদানও কম নয়। ইউক্যালিপটাস নিজে বাড়ে সত্য, কিন্তু বাড়তে গিয়ে সে অন্য গাছের জীবনীশক্তি শোষণ করে। আশপাশের বৃক্ষরাজিকে বাড়তে দেয় না। এ গাছে পাখি বাসা বানাতে পারে না। ফলে বাগানের মধ্যে এ গাছ নিতান্তই অনাহূত বলে বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে বিদেশ থেকে আমদানি করে লাখ লাখ ইউক্যালিপটাস গাছ আমাদের দেশে লাগানো হয়েছে। শুধু ইউক্যালিপটাস নয়, অ্যাকাশিয়া এমনকি যে চেরি গাছের ফলন এ দেশে হতেই চায় না, সে চেরিও শত শত লাগানো হয়েছে। অনেকে বলেন, এটা পরজীবিতার লক্ষণ। বিদেশের অনেক শহরে ইউক্যালিপটাস, অ্যাকাশিয়া-শোভিত রাস্তা আছে। ফলে কেউ কেউ নাকি চেয়েছিলেন আমাদের রাস্তাগুলোর পাশে বিদেশি গাছ থাকুক। শুধু রাস্তায় নয়_ প্রাঙ্গণে, চত্বরে, মাঠেও বিদেশি গাছের বনায়ন হয়েছে। নিশ্চয় এটি অপরিপকস্ফতা ও অপরিকল্পনার ফল। আমাদের দেশীয় হাজার জাতের গাছ আছে। এসব গাছ ফল দেয়, ফুল দেয়, ছায়া দেয়, কাঠও দেয়। খুঁজলে লম্বা-উঁচু এবং সুদর্শন গাছও মিলতে পারে। কিন্তু দেশি গাছ বিসর্জন দিয়ে আমরা বিদেশি গাছ দিয়ে বনায়ন করেছি। প্রকৃতিতে তার কুফলও ফলেছে যথেষ্ট। কিন্তু শোধরাতে গিয়ে দেরি হচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা, মূলত ইউক্যালিপটাস অ্যাকাশিয়া নিধন করে দেশি গাছ লাগানোর পক্ষে মত দিলেও কোনো এক অজানা কারণে এখনও দেশজুড়ে এসব ক্ষতিকর গাছের রাজত্ব। অবশ্য ধীরে ধীরে কিছু অগ্রগতি হচ্ছে। যেমন সম্প্রতি সংসদ ভবন এলাকায় ৪৭২টি ইউক্যালিপটাস গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গাছ কাটার এমন সিদ্ধান্ত সাধুবাদযোগ্য। আরও আশার কথা যে, এসব গাছ কেটে ফলদ গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ দৃষ্টান্ত সংসদ কর্তৃপক্ষের বাইরে অন্যরা অনুসরণ করলে শুভ ফল মিলবে। আমাদের দেশে রাস্তার পাশে কিংবা পাবলিক প্লেসে নিষ্ফলা বৃক্ষ লাগানোর পক্ষে যুক্তিগুলো খুব অদ্ভুত। বলা হয়ে থাকে, ফলদ বৃক্ষ লাগালে সে ফল লোকে খেয়ে ফেলবে, তাই নিষ্ফলা বৃক্ষ লাগানো হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ফল লোকে খেয়ে ফেললে অসুবিধাটা কোথায়? লোকে খেয়ে পুষ্টি পাবে। লোকে যদি নাও খায় তবে পাখি খাবে। এ রকম এক স্বার্থবাদী সংকীর্ণ চিন্তা কার মাথায় এসেছিল কে জানে। কিন্তু সে চিন্তা আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। এখন এজমালি জায়গায় ফলদ গাছ দেখাই যায় না। এখন সংসদের সিদ্ধান্তের পর অন্যরাও ইউক্যালিপটাস কেটে ফলদ গাছ লাগালে সেটি ধীরে ধীরে ভালো ফল দিতে পারে।