Wednesday, May 29, 2019

মোফাখখারের বউ


মাহবুব মোর্শেদ
বিষয়টা এখন মোটামুটি ক্লিয়ার।  আর কেউ না হউক, নিধি এই বিষয়ে নিশ্চিত।  সোমবার দুপুর বেলা ডালে বাগাড় দিতে গিয়া প্রথম তার মনে হয়- ডাল মে কুচ কালা হ্যায় ডালের মধ্যে ভাসতে থাকা বেরেস্তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকায়ে নিধি উচ্চারণ করে- ডাল মে জরুর কুচ কালা হ্যায়।  ডালটা তখন তেল আর বেরেস্তার ঝাঁঝ সয়ে আসছে, ঘন ডালের ওপর হালকা তেলের কণা ছোট ছোট শিশির বিন্দুর মতো ভাসতেছে।  বেরেস্তার গন্ধ কিছুটা ডালের ভেতর, কিছুটা বাতাসে উড়তে উড়তে মিহি হয়া আসছে।  এমন সময় নিধির মাথায় চিন্তাটা খেলে।
নিধি প্রশ্ন করে, ডাল মে কালা কেয়া হ্যায়? প্রশ্নটা তাকে ক্রমে পেরেশান করতে থাকলেও সে বের করতে পারে না সমস্যা কোথায়? সারা দুপুর সে চিন্তা করে, কিন্তু ভেতরে ঘনায়ে উঠা টেনশনের আগামাথা পায় না।  উদ্বেগটা তাকে বেমক্কা চেপে ধরে, কিন্তু কীসের জন্য টেনশন সেইটাই বুইঝা উঠতে পারে না।  একবার মনে হয়- রাতে ঘুম হয় নাই, তাই এইরকম হইতেছে।  আবার সাইনাসের ব্যথাটা উঠার ভয়ও হয়।  ডালটা ঢাকা দিয়া সে আয়নায় সামনে গিয়া দাঁড়ায়, খুঁটায়ে দেখে বুঝার চেষ্টা করে ঘুমের ব্যাঘাতজনিত কারণে চোখের নিচে কালো দাগ পড়ছে কি না। নাহ, কোনো দাগ নাই।  চোখের নিচে কালো দাগ না থাকার পরও অনেকটা সময় ফাও ফাও সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়ে থাকে, দিকদিশাহীন চিন্তা করে সময় কাটায়।  এমনকি দুপুরে টিভি পর্যন্ত ছাড়তে ভুলে যায়, ‘কিউকি সাস ভি কাভি বহু থি’ সিরিয়ালের এপিসোডটা মিস করার আধাঘণ্টা পরও সে বুইঝা উঠতে পারে না যে এপিসোডটা মিস হয়ে গেল।  নিজের জন্য দু’মুঠা ভাত চুলায় চাপানোর কথাও তার মনে থাকে না।  ফ্রিজ থেকে চিংড়ির মালাইকারিটা বের করে গরম করতেও ভুলে যায়।  এমনকি না-জানা টেনশনের আক্রমণে হালকা হালকা ঘামে ত্বক চিটচিট করতে থাকলেও গোসলে যাওয়ার কথা তার মনে হয় না।  সময় যাইতে যাইতে বিকাল ৪টা বাজলে মোফাখখারের আনা দেওয়াল ঘড়ির ঘণ্টাটা ঢং ঢং করে বেজে উঠে আর তখনই নিধি সমস্যাটা বুঝতে পারে, সহসা তার উপলদ্ধি হয় যে- মোফাখখার ইজ ইন লাভ।
মোফাখখারের বিরক্তিকর আউটডেটেড ঘড়িটা পেণ্ডুলামে ঢং ঢং আওয়াজ তুইলা যে তারে গোপন কথাটা বইলা দেয়, তা না।  এমনও না যে দুইটা তিনটার সময় না বাইজা খালি ৪ টার সময় হঠাৎ কইরা ঘড়িটা বাজে।  বরং ঘড়ির সঙ্গে তার ভেতরের বুঝাবুঝির সম্পর্ক প্রায় নাই বললেই হয়। মোফাখখারের ঘড়ির ঘণ্টার আওয়াজটা কমতে কমতে শেষ সীমানায় পৌঁছানোর আগেই নিধির ফোনে একটা মেসেজ আসে।  নিধি অবশ্য মেসেজটা দেখে না, পড়ার প্রয়োজনও মনে করে না।  কারণ সে মোটামুটি নিশ্চিত, এইটা কোনো কামের মেসেজ না।  এইসময় সাধারণত ফোন কোম্পানি নিজেই মেসেজ দেয়।  হ্যানা ত্যানা অফার দেয়, সরকারের পক্ষ থেকে টিকা দিতে কয়।  কিন্তু মেসেজটা আসাতেই কথাটা নিধির মনে পড়ে।  কয়টা বিচ্ছিন্ন ঘটনা পরপর জোড়া লাগতে থাকে।  মনে পড়ে, গত রাতে ৪টার সময় তার এবং মোফাখখারের ঘুম যে একসঙ্গে ভেঙে গেছলো তার কারণ ফোন।  ঠিক ফোনও না, মেসেজ।  ওই সময় মোফাখখারের ফোনে একটা মেসেজ আসলে নিধির ঘুম ভেঙে যায়।  নিধির ঘুম ভেঙে গেছলো এইটা মোফাখখার জানে না।  কিন্তু সে ফোনে এসএমএস ইনকামিং টোন হিসাবে এমন একটা রিং টোন সেট কইরা রাখছিল যে, মেসেজ আসলে আশপাশের মানুষের ঘুম না ভাইঙা কোনো উপায় নাই।  শরীর না নড়িয়েই নিধি আলতো করে চোখ খুলেছিল।  তার ঘুম পাতলা না, এক ঘুমেই রাত কাবার করার অভ্যাস।  সবচেয়ে বড় কথা, স্বপ্ন হউক কি বাস্তব ঘুমের ভেতরের কোনো ঘটনা তার মনে থাকে না।  সে সহসা মনে করতে পারে না- মেসেজটা আসার সময় নাকি মেসেজ আসার কিছু পরে মোফাখখার যখন অন্ধকার ঘরে মেসেজটা পইড়া ডিলিট দিতেছিল তখন সে বিষয়টা খেয়াল করে।  কিন্তু সে দেখতে পেয়েছিল মোফাখখার একটা মেসেজ ডিলিট দিতেছে।  রাতে আসা একটা মেসেজ ডিলিট দেওয়ার ঘটনাটা আধো ঘুমে আধো জাগরণে দেখে ফেলার ঘটনাটা একেবারে স্মৃতির তলানিতে চইলা গেছিল।  নিধি আর মনে করতে পারতেছিল না।  কিন্তু মনে পড়তেই তার মাথাটা চিনচিন করে ব্যথা করতে শুরু করলো।  চিনচিনে ব্যথা নিয়া সে ওয়্যারড্রোবের ওপর রাখা ফোনটা হাতে নিল।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা হইলো, মেসেজটা ফোন কোম্পানির না।  বড় মামা মোফাখখারের নাম্বার হারায়ে ফেলছে।  এখন মেসেজ দিয়া নাম্বারটা এসএমএস করে দিতে বলছে।  মেসেজটা দেইখা নিধির মনে হয়, এমন কিপটাও কি মানুষ হয়! ভাগনি-জামাইর নাম্বার নিতেও ফোন দিতে কষ্ট লাগে মামার, মেসেজ দিছে।  নিধি ভাবে, মামার হয়তো জরুরি ভিত্তিতে নাম্বার দরকার, কিন্তু নাম্বারটা সে এখনই এসএমএস করবে না।  বিকালে মামারে ফোন দিয়া কিছু কথা শোনাবে।  বলবে, মা মারা যাওয়ার পর হিসাবে আপনিই তো মায়ের দিকের একমাত্র জীবিত আত্মীয়। আমার লোকাল গার্জিয়ান।  তাছাড়া আমি তো আপনের দুঃসম্পর্কের ভাগনিও না, তাই না? কিন্তু মামা, আপনি ভাগনিটারে বছরে ছয়মাসেও যে একবার মনে করেন না সেইটা কেমন? ফোন করতে কয় টাকা লাগে? মোফাফখারের নাম্বার বড় মামার কেন লাগে সেইটা সে জানে।  শিক্ষাভবনে বড় মামার ছেলে রঞ্জু রেগুলার টেন্ডার সাবমিট করে।  টেন্ডার ফেললেই মোফাখখাররে ফোন দেওয়ার কথা মনে হয় তার।
মামা বিষয়ে আর বেশি চিন্তা না করে নিধি দ্রুত মোফাখখার বিষয়ে মনোনিবেশ করে।  মোফাখখাররে রিঙ দেয়। ‘দি নাম্বার ইউ আর কলিং ইজ বিজি নাউ, প্লিজ ট্রাই এগেইন লেটার। ‘ নেটওয়ার্ক সমস্যা? নিধি আবার ফোন দেয়।  পরপর চারবার ফোন দেওয়ার পরও মেয়ে কণ্ঠে সেই একই কথা ‘দি নাম্বার ইউ আর কলিং....’।  পরপর চারবার কল দেওয়ার পরও মোফাখখার যখন ধরে না তখন নিধির মনে হয়, মোফাখখার নিশ্চয়ই প্রেমিকার সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ফোনালাপে ব্যস্ত।  নইলে এখন তার ফোন বিজি থাকবে কেন? অফিস তো শেষ দিকে, এইসময় নরমালি ফোন নিয়া ব্যস্ত থাকার কথা না।
চিন্তাটা চালাতে চালাতেই নিধি বারান্দার রোদে শুকাতে দেওয়া তোয়ালেটা নেয়।  বারান্দায় এখনও এক চিলতে রোদ।  তোয়ালেটা রোদ লেগে মুচমুচে পাপড়ের মতো হয়া আছে।  শুকনা তোয়ালে খুব পছন্দ তার, আর পছন্দ বাথরুমের শুকনা মেঝে।  তোয়ালেটা নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়ে নিধি।  শাওয়ার নিতে নিতে প্রথম তার মনে পড়ে আজকে ‘কিউকি সাস ভি...’ দেখা হয় নাই।  সমস্যা নাই।  রাত দেড়টায় রিপিট হবে, তখন দেখে নেওয়া যাবে।  গোসল করতে করতে তার আরও মনে পড়ে, ভাত রান্ধে নাই।  ভাতের কথা মনে হইতেই খিদাটা আচমকা মোচড় দিয়া ওঠে।  এসিডিটির ভয় হয়।  ফ্রিজ থেকে চিংড়িটা বের করলে এতক্ষণে রুম টেম্পারেচারে চলে আসতো।
আনডান কাজগুলার কথা মনে করতে করতে সে ভাবে, আচ্ছা মোফাখখারের সঙ্গে প্রেম করবেটা কে? মোফখখার ও প্রেম শব্দ দুইটার মধ্যে মোফাখখারের চেহারাটা এসে হাজির হয়।  ঠিক চেহারা না, তার বড় ভুড়িটা।  এইটা অবশ্য ইচ্ছা করে সে মাথায় আনে না।  এমনেই আসে। বাড়িতে যতক্ষণ  মোফাখখার থাকে ততোক্ষণ এই ভুড়িটা দেখতে বাধ্য নিধি।  অফিস থেকে ফিরেই কোমরে একটা লুঙ্গি বেঁধে সে এই ভুড়িটা নিয়ে সারা বাসা ঘুরে বেড়ায়।  দেখতে বিশ্রী লাগে।  একেক সময় বিরক্ত হয়া নিধি বলে, আচ্ছা তুমি একটা টিশার্ট গায়ে দিয়ে থাকতে পারো না? মোফাখখার তার মোটা চিবুক অলা মুখে একটা লাজুক হাসি আনে। হাসলেও দেখতে ভাল লাগে না।  হাসলে তার মোটা ভ্রু দুইটা পরস্পরের কাছাকাছি চইলা আসে।  হাইসা মোফাখখার বলে, দেখ না কেমন গরম পড়ছে।  গরমের মধ্যে মানুষ টিশার্ট কেমনে পরে।  এক্কেবারে গায়ের লগে আঁইটা থাকে।  ঢিলাঢালা একটা শার্ট তো অন্তত পরতে পারো? মোফাখখার শার্টের বিরুদ্ধে কিছু বলে না।  কিছুক্ষণ বিরতি নিয়া বলে, ঘরের মধ্যেও শার্ট পইরা থাকবো? তাইলে ঘর আর কী জন্য? বিয়ার পর থেকেই দেখছে, মোফাখখার খালি গায়ে থাকে।  নিধি গজগজ করে, হ ঘর তাইলে খালি গায়ে থাকার জন্য।  আগে অতো খারাপ লাগতো না।  কিন্তু একটু একটু করে ভুড়িটা এমনভাবে বাড়তে থাকলো যে নিধির আর সহ্য হয় না।  প্রথম প্রথম নিধি বলতো একটু ব্যায়াম-ট্যায়ামও তো করলে পারো।  একটু হাঁটাহুটি করলে সমস্যা কী? মোফখখার এইসবের ধারে কাছে দিয়া যায় না।  মাঝে মাঝে টেলিভিশনে ডায়েট টি বা সওনা বেল্টের বিজ্ঞাপন দেখে বলে- নিধি, ডায়েট টি কিনলে কেমন হয়? তোমার কি মনে হয় এইগুলায় কাজ হয়?
ভুড়ির কথা বাদ দিলেও অবশ্য প্রেম করার লোক মোফাখখার না।  কত ভুড়িঅলা লোকও তো প্রেম করে।  প্রেম করা লোক কেমন হয়? নিধির ভাবনায় প্রেম করা লোকদের শার্টের কলার সবসময় ফকফকা থাকে। একদিন পরা শার্ট দ্বিতীয় দিন পরে না।  দামি বডি স্প্রে ইউজ করে।  মাথায় জেল মাখে।  শার্ট পরে ইন করে।  ছুটির দিন জিন্স-টিশার্ট পরে ফুরফুরা আমেজে ঘুরে।  তাদের শরীর চিকনা আর মানিব্যাগ মোটা।  বান্ধবী বা বউদের মোটর সাইকেলের পিছনে বসায়া শহর ঘুরে।  সবচেয়ে বড় কথা, বাসাবাড়িতেও তারা শার্ট বা টিশার্ট পরে থাকে।  লুঙ্গির বদলে থ্রি কোয়ার্টর পরে।  কিন্তু মোফাখখারের মধ্যে এইগুলার কোনোটাই নাই।  শার্ট ক্যালেন্ডার করা না থাকলেও তার অসুবিধা নাই।  মাসে ছয় মাসেও শ্যাম্পু করে না।  মাথায় হালকা নারকেল তেল দিয়া বামে সিঁথি কইরা সে অফিসে যায়।  নরমালি এইরকম ভুড়ি অলা লোকের টাক পড়ে- কিন্তু মোফাখখারের টাক পড়ে নাই।  টাকটা পড়ূক এইটা নিধি খুব চায়।  টাক পড়লে অন্তত চুলে তেল দেওয়াটা অন্তত বন্ধ হবে। 
মোফাখখার কোনোদিন লোশন মাখে না।  শীতকালে শুধু এক ডিব্বা পেট্রোলিয়াম জেলি কেনে।  সেই জেলি সবসময় পকেটে রাখে আর সময় সময় বাইর কইরা সবার সামনে মুখে-ঠোঁটে মাখে।  চলতি পথে সাধারণত সিএনজি বা রিকশা নেয় না।  মোড়ে দাঁড়ায়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য ওয়েট করে।  আর মন্ত্রী-মিনিস্টারদের গালি-গালাজ করে।  প্রতি শুক্রবার সেলুনে চুল কাটতে গিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিন মুখস্ত কইরা আসে।  এই ধরনের লোকের সাথে প্রেম করবে কে?
বাথরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালে বাধা চুল নিয়া ভাত উঠায় নিধি। আপনমনেই মাথা নাড়ে।  তার উপলদ্ধি হয় যে, মোফাখখারের সাথে কেউ প্রেম করতে পারে না।  পরক্ষণেই সে ভাবে কিন্তু মেয়েটা যদি মোফাখখাররে না দেখে তাইলে তো পইটা যাইতেও পারে।  হয়তো ফোনে ফোনেই আলাপ-পরিচয়।  দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই, ভার্চুয়াল রিলেশন চলতেছে।  এইটা ভেবে নিধি একটু কিনারা পায়  মনে করার চেষ্টা করে, ফোনে মোফাখখারের গলাটা কেমন লাগে।  সাধারণত ফোনে মোফাখখার শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে।  কিছু আঞ্চলিক টোন আসলেও শুনতে একদম খারাপ লাগে না।  ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে সময় কণ্ঠশীলনেও তো গেছলো কিছুদিন।  ওর সাথে আলাপ করে মেয়েটা হয়তো ভাবতেছে, হেভি স্মার্ট একটা লোক পাইছে।  হালকা লিকলিকে।  জিন্স পরে, বাসায় থ্রি কোয়ার্টার আর টিশার্ট পরে, সিএনজি কইরা ঘুরে।  মেয়েগুলা দুনিয়ার বোকা! মেয়েটা যে কী রকম বোকা আর মোফাখখাররে ভালোবাইসা কীরকম ঠকছে- এইটা ভেবে নিধি একটু শব্দ কইরা হাসে।  কিন্তু এইভাবে কেউরে বোকা বানানোর মানে হয়? মোফাখখার যদি এইভাবে কাউরে বোকা বানায় তাইলে তো সে একটা ফ্রড।  মোফাখখাররে দেখলে কেউ ভাবতে পারবে গাবদাগোবদা লোকটা এইভাবে দিনের পর দিন একটা চিকন ব্লাফ দিয়া যাইতেছে মেয়েটারে? দিনের পর দিন কথাটা ভাবতেই মুখে এসিডিটি টের পায় নিধি।  খাবারের টাইমিংয়ের ব্যাপারে তার আরও সাবধান হওয়া দরকার।
আর মেয়েটাই বা কী? আবার মোফাখখারকে ফোন দেয় নিধি।  এখনও বিজি। ‘দি নাম্বার ইউ আর কলিং ইজ বিজি নাউ, প্লিজ ট্রাই এগেইন লেটার। ‌‌ হারামজাদি, দুপুর থিকা এক কথা।  সহসা নিধির মনে হয়, এই মেয়েটার মতো কোনো একটা মেয়েই হয়তো মোফাখখারের লগে প্রেম করতেছে।  ফোনটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে নিধি চিন্তা করে- আজকেই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে।  ভাতটা প্রায় ফুটে আসতে থাকলে, পানিতে টান পড়লে চিংড়িটা অল্প আঁচে দিয়ে সে আবার ঘরে আসে।  মাথা থেকে তোয়ালে খুলে বারান্দায় দেয়।  শুকাতে দেওয়ার আগে তোয়ালে খুঁটিয়ে দেখে কয়টা চুল বাঁধলো।  চুলপড়ার হার কম।  আশ্বস্ত হয়া চুলটা ছেড়ে দেয় নিধি।  চুলের মাথা কোমর ছুঁলে নিধি গর্বভরে বলে, আপনা খায়াল রাখনা, গার্নিয়ের।  নিধি ভাবে, কাল গোসলের আগে আমলার গুঁড়া মেখে কিছুক্ষণ বসে থাকবে।  তারপর ঘণ্টাখানেক ধরে শ্যাম্পু করবে।  নিধি সাধারণত খেতে খেতে টিভি দেখে না, এইভাবে খাইলে মেদ জমে।  খাওয়া হইলো একটা আর্ট, অল্প খেলেও সময় ও মন দিয়া কাজটা করা উচিত।  ডাইনিং টেবিলে বসে প্লেটের মাঝে সামান্য একটু ভাত নিয়ে চিংড়িটা মেখে খায়।  ওইটুকু ভাতের শেষ মুঠো ডাল দিয়ে খেয়ে টেবিল থেকে উঠে পড়ে।
এখন একটু ঝিমুনি আসবে তার।  দেরি করে খেলে ঝিমুনিটা আসে।  কিন্তু নিধির কড়া সিদ্ধান্ত- দুপুরে কিছুতেই ঘুমাবে না।  জোর করে হলেও জেগে থাকবে।  শরীরে একটু এক্সট্রা ফ্যাট জমলেও সে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। বারান্দায় ছায়া পড়লে একটু একটু হাঁটবে।  হাঁটার আগ পর্যন্ত টিভি দেখবে।  জীবন মানে জি বাংলা।  রিমোর্টটা খুঁজে পাচ্ছে না।  মোফাখখার যে কই রাখে জিনিশপত্র, বিশেষ করে রিমোর্ট কন্ট্রোল।  বাধ্য হয়ে জি বাংলায় সাধক ব্যামাখ্যামাও দেখে সে কিছুক্ষণ।  এবার দুইকাপ চা’র জন্য পানি চাপাবে সে।  মোফাখখার আসার সময় হয়েছে।  এতক্ষণে সে হয়তো কোনো একটা ডাবলডেকারের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে পড়েছে।  ঘামতে ঘামতে শার্ট ভিজায়ে ফেলছে।  ঘরে ঢুকেই লুঙ্গি পরে প্যান্ট আন্ডারওয়্যার শার্ট সব ডাই করে রাখবে সোফার ওপর।  তারপর ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে ধাপ করে মেঝেতে বসে  বাতাস খাবে।  আর বলবে, এই দেশে আর থাকা যাবে না, বুঝলা।
কেন কী হইছে?
রাস্তায় এত মানুষ!
এইটুকুই তার সমস্যা।  একসময় সে ভুলে যাবে জনসংখ্যা সমস্যার ভয়াবহতার কথা।  টিভির রিমোর্টটা হাতে নিয়ে একটার পর একটা চ্যানেলে নিউজ দেখবে- কোন চ্যানেল আওয়ামী লীগ আর কোন চ্যানেল বিএনপি এইটা বাইর করবে।
শনিবারের রাশিফলে কী লিখছে কে জানে।  রবিবার মোফাখখারের দিন খারাপ।  ঘরে ঢুকতেই নিধি মুখটা ঝামা দিয়া উঠে।
তোমার ফোনের কী হইছে?
কী হইছে মানে?
বলেই পকেটে হাত ঢোকায় মোফাখখার।
ওহ হো, ডিডি স্যারের লগে মিটিং ছিল।  সেই যে বন্ধ করছি আর খোলার কথা মনে আছিল না।
ডিডি স্যারের সাথে মিটিং না অন্যকিছু?
সয়্যার অন গড।  দেখ।  ফোন বন্ধ।
নিধি দেখলো ফোন আসলেই বন্ধ।
ফোন বন্ধ থাকলে কি নাম্বার বিজি দেখায়?
আগে হইলে মনে করতো ঘটনা সত্য, কিন্তু এখন মোফাখখারের চিকন বুদ্ধির খোঁজ সে পেয়ে গেছে।  এই চিকন বুদ্ধি তাকে পেরেশান করে তুলতে থাকে।  সে ভাবে, হয়তো বাসায় আসার আগে মোফাখখার ফোনটা বন্ধ করছে।  তার তো জানার কথা যে, নিধি তাকে দুপুরে ফোন দিবে। একবার না পেলে বারবার ট্রাই করবে।  তাই ঘরে ঢোকার আগ দিয়া সুইচ অফ করে ডিডি স্যারের মিটিংয়ের কথা বানাইছে।
ঘরে ঢুকে মোফাখখার যথারীতি লুঙ্গি পরে।  নিধি অবাক হয়ে দেখে শার্ট প্যান্ট সবই সে আলনায় রাখছে।  মোফাখখারের এই উন্নতিতে ভ্রু কুচকে ওঠে তার।
ডিডি স্যারের সাথে এত কিসের মিটিং?
কেন কালকে বললাম না? মাধ্যমিকের রেজাল্ট হবে।
রেজাল্ট হবে তো তোমার কী?
মোফাখখার এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়া বাথরুমে ঢুকে যায়।  অনেক সময় নিয়া হাতমুখ ধোয়।  এমনভাবে হাতমুখ ধোয় যে মনে হয় গোসল করতেছে।  মোফাখখার কোনোদিনই সন্ধ্যায় গোসল করে না।  ঠিক গোসল করে না তাও না।  হাতমুখ গোসল করার মতো করেই ধোয়, কিন্তু চুল ভিজায় না।  তেলমাখা চুলে ধুলাবালি পইড়া একেবারে কিচকিচ করে।  কিন্তু সকালের আগে সে চুল কিছুতেই ধোয় না।  সকালে উইঠা প্রথমে জানোয়ারের মতো শব্দ করতে করতে দাঁত ব্রাশ করে।  তারপর গরমপানি দিয়া গার্গল করে।  ব্রাশ ও গার্গলের সময়টা নিধির মনে হয় এইভাবে আর সম্ভব না।  এই গলাখাকারির শব্দ শুনলে সে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার চিন্তাও মাঝে মাঝে করে।  যায়ও।
সে খুব চেষ্টা করে পারতপক্ষে এই সময়টা ঘরে না থাকতে।  মোফাখখার ঘুম থেকে উইঠা বেসিনের দিকে যাওয়ার আগেই সে মর্নিংওয়াকের নাম কইরা বাইর হয়।  ঘরে ঢুকার আগে শব্দ শুনে বোঝার চেষ্টা করে, মোফাখখারের গলাখাকারি দেওয়া শেষ, না চলতেছে।  গাবদাগোবদা মোফাখখার ইশারা-ইঙ্গিত বুঝে না।  ফলে এতদিনেও সে আবিষ্কার করতে পারে নাই কেন তার দাঁতব্রাশের সময়টাতেই নিধি মর্নিংওয়াকে যায়। মোফাখখার ভাবে, হয়তো এই সময়টাই হাঁটার জন্য ভাল।  নিধি যে স্লিম থাকে, সারাদিন পানি খায়, শসা খায়, সালাদ আর সব্জি খায়।  গায়ে নানা কিসিমের গুঁড়া মাখে, চুলে আমলা আর হরিতকির গুঁড়া মেখে বইসা থাকে সেই সবের অংশ হয়তো এইসময় হাঁটতে যাওয়া।  নিধিও তাকে খুলে বলে না যে সে এই গলাখাকারি জিনিশটা তার মারাত্বক অপছন্দ।
না বলা, না বুঝার মধ্যেই অনেক ব্যাপার চইলা যাইতেছিল।  কিন্তু আজকে ঘরে ঢোকার মুখেই নিধি যেমনে মোফাখখারকে ছাই দিয়া ধরলো, ফোনের খবর নিলো, তাতে যে ইশারাটুকু আছে সেইটুকু কিন্তু মোফাখখার ঠিকই বুঝে।  হাতমুখ ধুইতে ধুইতে সে চিন্তা করে।  নিধি যে খুব চালু মাল, এইটা মনে কইরা সে একটু তটস্ত হয়।
এইগুলা রবিবারের কথা। ওই দিন থেকেই ঘরে একটা স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হইছে। ঘরে ঢুকার সময়ের জেরাটুকু ছাড়া নিধি আর কিছু বলে নাই।  কিন্তু মোফখখার বুঝে, নিধি একটা কিছু সন্দেহ করতেছে।  নিধি যে এত সহজে জায়গামতো সন্দেহটা করতে পারলো, এইটা ভেবে মোফাখখারের মনে একটা টেনশন তৈরি হয়।  একটা তৃপ্তিও কাজ করে।  নিধির ব্রেন শার্প- এই বিষয়ে সে আরও নিশ্চিত হয়।  ঘরে ব্রেইনি বউ থাকাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা- এইটা ভাইবা তার মন চনমন কইরা উঠে।
এই বিষয়ে আলাপ করতে পরের দিন সে সুলতানারে ফোন দেয়। সুলতানারে ফোন দিতে গেলে প্রতিবারই পালস বিট বেড়ে যায়।  বুক ধকপক করে।  গলা কাঁপে।  গলা কাঁপলেও সে সুলতানার সঙ্গে গুছিয়ে গুছিয়ে কথা চালায়ে যায়।
সুলতানা, বউ তো সব জেনে গিয়েছে।
বলো কী? তুমি বাসায় ঢোকার আগে কল লিস্ট ডিলিট দেও না?
দেই তো।  কিন্তু তুমি তো জানো না, সে কত ব্রেইনি।  অল্পতেই বুঝে ফেলে।  আমাকে খুব ভালোবাসে তো।  মেয়েদের সাইকোলজি খুব অদ্ভুত, বুঝলে? ভালোবাসার মানুষ অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেললে মেয়েরা খুব সহজেই বুঝতে পারে।
মোফাখখারের বউপ্রীতি দেখে সুলতানার পিত্তি জ্বলে যায়।  বিবাহিত লোকগুলা কেমন? একজনের সাথে প্রেম করে, একজনের সাথে ঘুমায়। ভাবে আরেক জনের কথা।
আচ্ছা সত্যি করে বলো তো তুমি আসলে বউরে ভালোবাসো না ভয় পাও?
সুলতানার কথাটা নিয়া মোফাখখার সারা দুপুর ভাবে।  ভয় না ভালোবাসা? দাম্পত্যের মূল সূত্র হইলো ট্রান্সপারেন্সি।  মোফাখখারের ধারণা হয়, ঘটনাটা জানলেও নিধি কিছু বলবে না।  সে ঠিক করে যা হয় হবে-  নিধিকে বলবে ঘটনা। এই স্নায়ুযুদ্ধ তার ভাল লাগতেছে না।  বলার সিদ্ধান্ত নিলেও কোনোভাবে কথা শুরু করতে পারে না।  একদিন যায়।  চা খায়, কিন্তু এক চুমুকের পরের চুমুক দিতে গিয়া দেখে কাপ ঠাণ্ডা হয়া গেছে।  খবর দেখে কিন্তু কোন চ্যানেলের প্রধান খবর কী সেইটা আর পরে মনে করতে পারে না।  নিধি দূর থেকে তারে ফলো করে, কিন্তু ডায়ালোগে আসে না।  বারান্দায় হাঁটে, রাতের রান্নার প্রস্তুতি নিতে থাকে।  আলনা গোছায়, বিছানা গোছায়।  অনেক সময় নিয়া চুল আঁচড়ে টাইট করে বড় একটা খোঁপা বান্ধে। মোফাখখার তার দিকে সোজা কইরা তাকাইতে পর্যন্ত পারে না, আলাপ পাড়া দূরের কথা।  এইভাবে দুই দিন গেলে মঙ্গলবার রাতে এক বিছানায় পাশাপাশি বালিশে শুয়ে পড়ার পর নিধি বলে, তোমার সমস্যাটা কী বলো তো।
মোফাখখারের শিরদাঁড়ার গরম উত্তর মেরুর বরফ সহসা হিমবাহের মতো সরসর করে নামতে থাকে।  জলবায়ু পরিবর্তনের আলামত টের পেয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে সে।
আই অ্যাম সরি, নিধি।  আমি ভুল কইরা ফেলছি।
নিধি কিছু বলে না, মুখটা শক্ত করে তাকায় মোফাখখারের দিকে। মোফাখখার অনেকক্ষণ চুপ কইরা থাকে।  আর কিছু বলে না।  কিছুই বলে না।  মোফাখখার ভাবে, ভুল করছি বলাটা মনে হয় ঠিক হয় নাই।  ভুল মানে কী? নিধি কি ভাবতেছে? ভুল করা মানে কতদূর আগানো বুঝায়? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পুরা গল্পটা সাজায় মোফাখখার।  
নিধি বলে, মেয়েটা কে?
কোন মেয়ে?
প্রেম করতেছো না তুমি? কার সাথে প্রেম করতেছো?
মোফাখখার এইবার সন্দেহের চোখে তাকায় নিধির দিকে।  তাইলে কি রাত জেগে নিধি তার ফোন নিয়া ঘাঁটাঘাটি করে? ফোনের কললিস্টে ইনকামিং, আউটগোয়িং দেখে।  সে যখন সুলতানার সঙ্গে কথা বলে তখন ঘন ঘন ফোন দিয়া চেক করে।  তা না হলে এত শিওর হয়ে সে কীভাবে বলে।
মোফাখখার একটা হাসি দেয়, আরে প্রেম না।  তুমি কীভাবে ভাবলা প্রেম করবো? তোমারে রাইখা? কোনোভাবেই তুমি এইটারে প্রেম বলতে পারবা না।  ফ্রেন্ডশিপ।  জাস্ট ফেন্ডশিপ।
ফেন্ডশিপ হইলে এত রাখঢাক কিসের?
রাখঢাক দেখলা কই? তোমারে বলবো বলবো করতেছিলাম।
গুড। বলো।
বলতে পারো মেয়েটা কলিগই।  মানে একটা কলেজে কাজ করে। শিক্ষাভবনে মাঝে মাঝে আসে।  ঢাকায় বদলির জন্য তদবির করতেছে।
নাম কী?
সুলতানা নামটা কোনোভাবে বলতে চায় না।  কী নাম দেওয়া যায় ভাবে মোফাখখার। তৎক্ষণাত কোনো নাম পায় না।
জেরিন।
নামটা তো ভাল।  এত সুন্দর নাম মনে রাখতে পারো না? এই মেয়ে তোমার প্রেমে পড়ছে, না তুমি পড়ছো?
এই সময় মোবাইল বেজে ওঠে।  এত রাইতে কে হঠাৎ ফোন দেয় ভেবে উঠতে পারে না মোফাখখার।  বালিশের নিচে রাখা ফোনটা বের করে তার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।  ডিডি স্যার।  মানে সুলতানা।  সুলতানার নাম্বারটা ডিডি স্যার নামে সেভ করা।  নিধি উঁকি মেরে ডিডি স্যার লেখা দেখে। বলে তোমার বস এত রাইতে কী চায়?
মোফাখখার বলে, সরকারি চাকরির এই এক সমস্যা।  কইলাম না, মাধ্যমিকের রেজাল্ট।
দেও আমি ধরি।
ফোনটা নিয়া নিধি ধরে।  ওপার থেকে হ্যালো শোনার পর কেটে দেয়। তারপর ফোনটা ঘরের একদিকে ছুঁড়ে দিয়ে লাইট নিভায়ে শুয়ে পড়ে।
মোফাখখার আইসা নিধির হাত ধরে, পা ধরে।  সরি বলে।  কিন্তু নিধি গুম মেরে থাকে।
মোফাখখার একসময় হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ে।  বিছানার একদিকে নিধি আরেক দিকে তার স্বামী দুইজনেই নির্ঘুম।  মোফাখখার বুইঝা উঠতে পারে না, সুলতানা কী মনে কইরা এত রাইতে ফোন দিল।  সে কি জানে না এইসময় সে কোন ক্রিটিকাল অবস্থায় থাকে।  নাকি কোনো বিপদে পড়লো মেয়েটা?
এমনে শুয়া থাকতে থাকতে ঘণ্টা দুই কাইটা গেলে নিধি বলে,
আচ্ছা, তুমি যে এইরকম একটা প্রতারণা করলা।  আমি যদি এইরকম করতাম তাইলে তুমি কী ভাবতা?
নিধি কথা বলে ওঠায় মোফাখখার আবার আশা দেখে।  তার মনে হয়, ঠিকই তো, নিধি যদি প্রেম করে তাইলে সে কী ভাবতো? সে তো অফিস করে, বাইরে যায়।  কত লোকের সঙ্গে আলাপ হয়।  কাজের সূত্রে কত লোক আসে তার কাছে।  নিধির সেই সুবিধা নাই।  কিন্তু যদি থাকতো, আর নিধি যদি কারো সাথে প্রেম করতো তাইলে কী হইতো।  মোফাখখার অবশ্য ভাল করেই জানে, নিধির দৌড় কতটুকু।  বাসার বাইরে তার আর জগৎ নাই।
কী ভাবতাম? তুমি আজকালকার নারী।  কাউকে তোমার ভাল লাগতে পারে না? বন্ধু হইতে পারে না?
সত্য কইতেছো? আমি প্রেম করলে তোমার কিছু মনে হবে না?
কী মনে হবে?
আচ্ছা তাইলে ঘুমাও।
নিধির অভ্যাস হইলো দেরি করে ঘুমাইলেও ঠিক সময় মতো ওঠা।  ঘুম থেকে উঠে সে মোফাখখারকে ডাকে।  দেরি করে ঘুমাইলে মোফাখখারকে ডেকে তুলতে হয়।  ডাকার আগে মর্নিংওয়াকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। রাতে ঘুমের অনিয়ম হইলেও সকালে সবকিছু রুটিন মতোই হয়। মোফাখখার বেরিয়ে গেলে নিধি ভাবে, এইবার সে মোফাখখারকে একটা উচিত শিক্ষা দিবে।  ওর মতো গাবদাগোবদা ভুড়িঅলা একটা লোক যদি প্রেম করতে পারে তাইলে সে কী দোষ করলো?
আয়নার সামনে দাঁড়ায় নিধি।  চুল খুলে দেয়।  নিজের স্লিম ফিগারের দিকে তাকায়া গর্ব হয় তার।  চাইলে যে কারো সাথেই প্রেম করতে পারে সে।
কার সাথে? নিজেকে প্রশ্ন করে।
সহসা কারো কথা মনে হয় না।  তার নিজের বন্ধু-বান্ধব কেউ নাই ঢাকায়। মোফাখখার বন্ধু-বান্ধব কাউরে ঘরে আনে না।  তাইলে উপায়? উপায় ভাবতে ভাবতে সকাল কেটে যায়।  সনিতে ‘জব উই মেট’ দেখাইতেছে। দেখতে দেখতে পুরা নেশা ধরে যায় তার।  শহীদ কাপুরের মতো স্লিম, বড় লোকের রোমান্টিক ছেলে পাইলে কেমন হয়?
আজকে মোফাখখার উল্টা ফোন দেয়।  ইন ফ্যাক্ট, গভীর রাতে ফোন দেওয়া নিয়া সুলতানার সঙ্গে একদফা ঝগড়া করার পর তার মনে হয়- নিধি অন্তত সুলতানার মতো কুটনা না।  সে যদি নিধির মতো মেয়ের সাথে প্রেম করতো তাইলে সে অন্তত বউয়ের কাছে ধরা খাওয়ানোর জন্য অতো রাইতে ফোন দিতো না।  সো জেলাস।
ফোন বাজলেও নিধি ধরে না।  একবার দুইবার তিনবার বাজে।  নিধি ফোন দেখে।  কিন্তু ধরে না।  ১৫ বার রিং হইলে ধরে।
ফোন ধরো না কেন?
একটা ফোন আসছিল।  কথা বলতেছিলাম।
রিং তো হলো দেখলাম।  ওয়েটিংও তো দেখাল না।
কী জানি।
কে ফোন করেছিল?
আমার বন্ধু শহীদরে চিনো না? আমেরিকা থাকে।  কলেজের বন্ধু ছিল। দেশে আইসা কার কাছে জানি নাম্বার পাইছে।  ফোন দিয়া পুরানা অনেক কথা কইলো।
মোফাখখার কনফিউজড হয়া যায়।  বলে,
বাসায় এসে শুনবো।  তুমি খেয়ে নিও।
শহীদের চিন্তাটা মোফাখখারের মাথায় ঢুকে গেলে সে মনে মনে তার চেহারা আঁকতে থাকে।  নিধির কলেজ-ফেন্ড।  আমেরিকা থাকে।  সহজেই ছিমছাম একটা চেহারা ভাসে।  বাসায় ফিরলে, শহীদ শহীদ করে নিধি তাকে পাগল করে দেয়।
শহীদ কি বিয়া করছে নাকি?
কেন, হাতে পাত্রী আছে?
নিধি হাসে।
শহীদ কী কয় জানো, নিধি তোমার মতো দেখতে একটা মেয়ে বিয়ে করতে চাই।  বলে, এখন তুমি দেখতে কেমন হইছো নিধি? একদিন দুপুরে খেতে আসবো।  তোমাকে দেখেও যাবো।
শহীদের চিন্তায় মোফাখখারের ঘুম হারাম হয়ে যায়।  সারারাত নির্ঘুম অবস্থায় বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকে।  নিধি বুঝে।  মোফাখখারের পাশে শুয়া তৃপ্তির ঘুম দেয়।  প্রসন্ন মনে সকালে হাঁটতে বের হয়।  সকাল-দুপুর-রাতের জন্য রান্ধে।
ফোনে কল এলে বারান্দায় যায়।  দীর্ঘ সময় কথা বলে।  মোফাখখার খালি ভাবে, শহীদ লোকটা দেখতে কেমন? নিধিকে জিগায়,
শহীদ তোমার কোন বন্ধুটা বলো দেখি।  আমি দেখছি?
তোমার দেখার কথা না।  আমাদের বিয়ার আগে সে আমেরিকা চলে গেছলো।  ওখানে একটা পাবে কাজ করে।  ফটফট করে ইংরেজি বলে। রেগুলার জিমে যায়।  আসলে দেখবা।  তোমার পছন্দ হবে।
একদিন রাতে খাইতে বলো।  আমেরিকা থেকে আসছে, একদিন তো দাওয়াত দেওয়া লাগে।
ও যে বাসায় উঠছে সেখানে গেট তাড়াতাড়ি বন্ধ কইরা দেয়।  কয়, রাতে না।  দিনের বেলা আসবে।
তাইলে শুক্রবার বলো।
শুক্রবার? শুক্রবার কেন?
আমি থাকবো। তুমি একা রান্না-বান্না করবা, না কথা বলবা?
দেখি ও কী বলে।
এইভাবে যাইতে যাইতে মোফাখখার বুঝে যে, নিধি ইজ ইন লাভ। শহীদের প্রেমে পইড়া গেছে।  সুলতানার সঙ্গে তার প্রেমের প্রতিশোধ নিতেছে।  মোফাখখার জিনিশটা কিছুতে মেনে নিতে পারে না।  তার মনে হয়, ঘটনাটা হয়তো অনেকদূর গড়াইছে।  হয়তো এর মধ্যে শহীদ বাসায়ও আসছে।  অবিবাহিত ছেলে, দেশে আসছে বিয়ে করার জন্য।  তার ভয় হয়, যদি নিধিকেই বিয়ের প্রস্তাব দেয়।  আমেরিকা-টামেরিকা নিধি খুব পছন্দ করে।  ওই দেশে খুব বরফ পড়ে।  মানুষজন জুতামুজা পইরা বরফের মধ্যে হাঁটে আর বরফের গোল্লা বানায়া খেলে।  অ্যারিজোনায় ছেলের নিজের বাড়ি।  নিধি তো এইগুলাই চায়।
মোফাখখার ভাবে, একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলবে।  যেমন করেই হোক নিধিকে ঠেকাতে হবে।  রাতে খাওয়ার পর সে মিন মিন করে কথা পাড়ে।
এইগুলা কি ঠিক নিধি।
নিধি তার দিকে তাকায়।
এই যে, আমি জেরিনের লগে প্রেম করতেছি সন্দেহ কইরা তুমি..
আমি কী করছি?
আমার উপর প্রতিশোধ নিতেছো।
কীয়ের প্রতিশোধ।
তুমি যদি আমার উপর রাগ কইরা প্রেম করবা বইলা ভাইবা থাকো তাইলে সংসারটা টিকবে? এত সুন্দর একটা সংসার।
তুমি না কইলা প্রেম করলে তোমার সমস্যা নাই। 
তাইলে আমি কথা দিলাম, আর কোনো দিন কারো সাথে ফেন্ডশিপ পর্যন্ত করবো না।
সত্যি করে বলতো জেরিনের সঙ্গে কতদূর আগাইছো?
জাস্ট ফ্রেন্ড কইলাম না? জাস্ট ফ্রেন্ড।  বিশ্বাস করো।  তুমি চাইলে এখনই ফোনলিস্ট থেকে ওর নাম বাদ দিয়া দিবো।
গুড।
কিন্তু তোমার ঘটনাটা কী?
কোন ঘটনা?
শহীদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক?
কইলাম না কলেজ ফ্রেন্ড।
কলেজ ফ্রেন্ড তো কী?
তো কী মানে? মানুষের স্কুল-কলেজের বন্ধু থাকে না?
থাকে...
অনেক দিন পর দেখা হইলে মানুষ কথাবার্তা বলে না? দেখাসাক্ষাৎ করে না?
দেখা-সাক্ষাৎ হইছে নাকি?
মানে কী? তুমি জেরিনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করছো কি না এইটা আমি জিগাইছি কোনোদিন?
নিধি, তুমি খুব সরল একটা মেয়ে।  একটা জিনিশ মনে রাখবা, বাংলাদেশ আর আমেরিকা এক জিনিশ না।  ওইখানে ওরা কী কালচার লালন করে, কী তাদের চিন্তা তুমি বুঝো না, আমিও বুঝি না। ওই দেশে থাকলে কেউ ভাল থাকতে পারে না।  সে তোমার কলেজ-ফ্রেন্ড হইতে পারে, তাই বইলা তারে বিশ্বাস করা যায় না।
মানে কী?
মানে আবার কী? আমার সাফ কথা, তুমি শহীদের লগে কখনোই দেখা করবা না।
বন্ধুর লগে দেখা করবো না?
করলেও আমার উপস্থিতিতে করবা।
মোফাখখার রাগে কাঁপতে থাকে।  নিধির মনে হয়, আরেকটু কথা আগাইলে মোফাখখার তাকে হয়তো মারতেই আসবে।  সে কাঁদে।  হু হু করে কাঁদে আর শহীদের কথা ভাবে।  রাগে ফুঁসতে থাকা মোফাখখার বাথরুমে গিয়া হাতমুখ ধুয়া আসে।  নিজের কথাগুলা পরিষ্কারভাবে নিধিকে জানিয়ে দিতে পেরে তার এক ধরনের আরাম লাগে।  নিশ্চিত মনে ঘুম দেয় সে। সপ্তাহ ঘুরে রাতটা আবার গভীর ঘুমে কাটে তার।
...  

  



Thursday, March 14, 2013

ব্রোকেন নিউজ, ব্রেকিং নিউজ

খবরের মাহাত্ম্য আমরা সবাই জানি। সকালবেলা গরম চায়ের সঙ্গে সংবাদপত্রের পাতা ওল্টাতে না পারলে অনেকেরই স্বস্তি লাগে না। সকালবেলা সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাস অবশ্য নতুন নয়, আর এ নিয়ে আলোচনারও বিশেষ গুরুত্ব নেই। এখন আলোচনা প্রতি মুহূর্তের সংবাদ নিয়ে। সম্প্রতি দেশে যে উত্তপ্ত অবস্থা তৈরি হয়েছিল তাতে অনেককেই দেখেছি প্রতি মূহূর্তের খবর জানতে উদগ্রীব। যাদের ইন্টারনেটে অবাধ যাতায়াত আছে তারা তো পারলে প্রায় সব পত্রিকা আর অনলাইন নিউজ পেপারের সাইট খুলে বসে থাকেন। শুধু পত্রিকা কেন, ফেসবুকে বন্ধুরা কী শেয়ার করছেন, ব্লগে কী লেখা হচ্ছে_ এসব নিয়ে সবার মধ্যে তুমুল আগ্রহ। টিভি খুলে স্ক্রলের টিকআর-এ নিউজ ফিডে চোখ রাখছেন অনেকে। আর যাদের এসব সুযোগ নেই তারা মোবাইলেই জানার চেষ্টা করছেন কখন কোথায় কী হচ্ছে। বন্ধুদের ফোন করে সর্বশেষ অবস্থা জানার রেওয়াজ তো আছেই। আবার পত্রিকা বা অনলাইন নিউজ পেপারের সার্ভিস থেকেও সরাসরি এসএমএসে খবর পাওয়ার উপায়ও আছে। এসব দেখে মনে হয়, খবরের প্রতি মানুষের আগ্রহ একেবারে তীব্র। প্রতি মুহূর্তের তাজা খবর চাই। এত খবর পত্রিকাগুলো পাবে কোথায়? তাই ছোট-বড় সব বিষয়ই খবর হচ্ছে। অগুরুত্বপূর্ণ অনেক খবর ব্রেকিং নিউজের মর্যাদা পাচ্ছে। ব্রেকিং নিউজ নিয়ে কিছুদিন আগে কিছু বিতর্ক চোখে পড়েছিল। তাতে দেখা গেল, প্রথিতযশা অনেক সাংবাদিকই ব্রেকিং নিউজের বাড়াবাড়িতে বিরক্ত। কোনটা ব্রেকিং নিউজ আর কোনটা নয়, সে বিবেচনা যে অনেকেরই নেই_ সে বিতর্কও উঠেছে। তর্কটা শুরু হয়েছিল পশ্চিমের টেলিভিশন ও অনলাইন পোর্টালের ব্রেকিং নিউজ দেওয়ার তীব্র আগ্রহ থেকে। এখন অবশ্য অনেকে ব্রেকিং না বলে লেটেস্ট বলছেন। সর্বসাম্প্রতিক, তাজা খবর, সদ্য সংবাদ ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করা হচ্ছে এসব নিউজকে। নামে যাই বলা হোক, উপস্থাপনের ভঙ্গি কিন্তু ব্রেকিং নিউজের মতোই। কিন্তু কেউ কি প্রশ্ন করছেন, এত খবর দরকার পড়ছে কেন হঠাৎ করে? আগেও তো মানুষ শহুরে জীবনযাপন করত। সকালবেলা পত্রিকা পড়ার সঙ্গে টেলিভিশনে টুকটাক খবর দেখার মধ্যেই তাদের আগ্রহ তৃপ্ত হতো। এখন প্রতি মুহূর্তের খবর দরকার হচ্ছে কেন? এ কথা সত্য যে, জীবনযাপনের পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মোবাইল এমন এক জায়গা করে নিয়েছে জীবনে যে, মোবাইল যখন ছিল না তখন যোগাযোগ কীভাবে হতো তা রীতিমতো ভুলেই যেতে বসেছে সবাই। কেউ কেউ বলেন, মোবাইল আর ইন্টারনেটের কারণে ডিটেইলের দিকে মানুষের নজর আর সেভাবে যায় না। অনেকেই বিস্তারিত নিউজ পড়তে চায় না। লোকে খণ্ড খণ্ড নিউজ পড়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। একেবারে নতুন বাস্তবতা এটা। ব্রেকিং নিউজ না বলে আসলে একে বলা উচিত ব্রোকেন নিউজ। খণ্ড খণ্ড খবর জোড়া দিয়েই নতুন সময়ের নতুন পাঠক জেনে যান ঘটনাবলি সম্পর্কে। কী এবং কেন ঘটছে তা নিয়ে জানতে বিশেষ সময় ব্যয় করার মনোযোগই অনেকের নেই। এক কথায় জানাতে পারলে তারা জানল নয়তো ওদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে রওনা হলো। খবরের এত দরকার কি শুধু আমাদের দেশেই পড়েছে? সংঘর্ষ দেখা দিলেই কি খবর নিয়ে বাড়তি আগ্রহ দেখা দেয়? বিশেষ পরিস্থিতিতে খবর নিয়ে আগ্রহ বেড়ে যায় সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিস্থিতি যখন শান্ত থাকে তখনও লোকে খবর চায়। আর এটা শুধু বাংলাদেশের বাস্তবতা নয়, পুরো পৃথিবীতেই এ অবস্থা। পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায়, আমাদের আগের প্রজন্ম পর্যন্ত সাংবাদিকরা খবরকে যেভাবে দেখতেন সেভাবে হয়তো ভবিষ্যতে দেখা হবে না। ব্রোকেন নিউজ বদলে দেবে অনেক কিছুই। আর অনলাইন নিউজ মিডিয়া, ফেসবুকসহ নানা সামাজিক মাধ্যম নিউজকেও ভেতরে ভেতরে পাল্টে দিতে চলেছে।

Thursday, February 28, 2013

আইটেম সঙ :::মাহবুব মোর্শেদ

২২ ফেব্রুয়ারির টাইমস অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, ভারতের 'সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশনে'র কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক অফিসগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে, তারা যেন সিনেমার আইটেম সঙগুলোকে 'এ' ক্যাটাগরিভুক্ত করেন। 'এ' ক্যাটাগরিভুক্ত হলে আইটেম সঙগুলো অ্যাডাল্ট উপাদান হিসেবে গণ্য হবে। ফলে আইটেম গান আছে এমন চলচ্চিত্র শুধু প্রাপ্ত বয়স্করাই দেখতে পারবেন। তবে আইটেম গানের 'এ' প্রাপ্তির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে টিভিতে। টিভি যেহেতু সবাই দেখে, সেহেতু সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে টিভিতে আইটেম সঙ প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে। আইটেম সঙ ও মুভি নির্মাতাদের জন্য এটি দুঃসংবাদ নিঃসন্দেহে। কেননা আইটেম সঙের জনপ্রিয়তা টিভিই তৈরি করে। টিভিতে গান দেখেই দর্শকরা হলে যান সিনেমা দেখতে। টিভিতে প্রচার বন্ধ হলে যে এর প্রভাব হলেও পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য সেন্সরের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের করারই-বা কী আছে? সাম্প্রতিক সময়ে আইটেম সঙগুলো এতটাই দুষ্ট হয়ে উঠছিল যে, এগুলো নিয়ন্ত্রণের একটা উপায় বের করা খুব দরকারি হয়ে পড়েছিল। মুম্বাইয়ের সিনেমার দর্শকমাত্রই জানেন আইটেম সঙ কী বস্তু। সিনেমার কাহিনীর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই সাধারণত থাকে না। রসাল গান, ইঙ্গিতপূর্ণ লিরিক বিখ্যাত কোনো নায়িকাকে দিয়ে রসাল ভঙ্গিতে পরিবেশন করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, ভালো-মন্দ নির্বিশেষে মুম্বাইয়ের সিনেমায় আইটেম গানের একটা বিশেষ জায়গা তৈরি হয়েছে। উইলিয়াম শেকসপিয়রের ওথেলো অবলম্বনে তৈরি ওমকারার মতো বুদ্ধিদীপ্ত সিনেমায় যেমন আইটেম সঙ আছে, তেমনি এমনও সিনেমা আছে যাতে একটা হিট আইটেম সঙ ছাড়া বিশেষ আর কিছুই থাকে না। সে গানের জোরেই সিনেমা হিট এমনকি সুপারহিট হয়ে যায়। সাধারণত যেসব হিন্দি গান সচরাচর চারদিকে বাজতে শোনা যায় সেগুলো আইটেম গানই। এগুলোকে আইটেম নম্বরও বলা হয়। বিনোদনপিয়াসী দর্শকরা মুভিতে কয়টি আইটেম নম্বর আছে সে হিসাব জেনে নিয়েই হলে ঢোকেন। যে নায়িকারা আইটেম গানে অংশ নেন তারা আইটেম গার্ল। আইটেম গার্লদের পারিশ্রমিক বেশি। একটা আইটেম গানে অংশ নিয়েই তারা বড় সম্মানী পান। আইটেম গানের বাজার মূল্যের কারণে মুভি নির্মাতারা একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলছিলেন। আর তাই লাগামটা টানা হলো। এখন নিশ্চয়ই মুভি নির্মাতারা সতর্ক হবেন। বোম্বে সিনেমার হুম্মা হুম্মা, দিল সের ছাইয়া ছাইয়া, বান্টি আউর বাবলির কাজরা রের মতো গান যদি আর তৈরি না হয় তবে দর্শকদের জন্য তা দুঃখের ঘটনাই হবে। আইটেম সঙের এই আকস্মিক অন্তর্ধান নিয়ে কভার স্টোরি প্রকাশ করেছে আউটলুক পত্রিকা। আইটেম গানের পূর্বাপর বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন তারা। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কেন আইটেম সঙ নিয়ন্ত্রণের জন্য সার্টিফিকেশন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে, তা জানা গেল আউটলুক থেকেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মনে করে, নারী নির্যাতন বাড়িয়ে দিচ্ছে আইটেম সঙ। বলিউডের ডিরেক্টর দিবাকর ব্যানার্জির মতে, সমাজের আরও বড় বড় সমস্যার দিকে না তাকিয়ে আইটেম সঙকে দোষারোপ করে এর সমাধান হবে না। পিতৃতন্ত্র, সামন্ততন্ত্রসহ নানা সমস্যাই তো আছে। সেগুলোর সেন্সর কে করবে? অন্যদিকে রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা মনে করেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটাই নেওয়া হয়েছে। আইটেম সঙ সিনেমার জন্য নেতিবাচক। মুম্বাইতে একটি মত প্রবল হয়ে উঠছে যে, বহু বছরের চর্চায় এখানকার সিনেমা-সংস্কৃতি যথেষ্ট পরিপকস্ফ। কিন্তু গানসহ কিছু মেলোড্রামাটিক উপাদান মুম্বাইয়ের সিনেমার অগ্রযাত্রার পথে বাধা। একটা বাঁধা ছকের বাইরে সিনেমাকে বের করে নিয়ে আসার জন্য বাজার মাত করার সনাতন পদ্ধতিগুলো থেকে বের হয়ে আসা উচিত। আইটেম সঙ বন্ধ হলে, সে পথ যে খুলে যাবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু দর্শকরা কী করবেন। বিনোদন যাদের মূল লক্ষ্য তারা 'এ' পাওয়া সিনেমাগুলো দেখবেন হয়তো। কিন্তু যে সিনেমা শুধু আইটেম গানের জন্য 'এ' পেল সে সিনেমা পরে সর্বার্থে এ পাওয়ার চেষ্টা করবে না তো?

Friday, February 22, 2013

ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং

বিখ্যাত এক লেখক স্মৃতিকথায় জানিয়েছিলেন, আজ ভ্যালেন্টাইন বলতে যেমন আয়োজন বোঝায়, তেমনটা তারা কৈশোরে সরস্বতী পূজায় পেতেন। পড়াশোনার চাপের চেয়ে বেশি ছিল অভিভাবকদের চাপ। তাই পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে দেখা হওয়া দূরের কথা, ভালোমতো চোখাচোখিই হতে পারত না। সরস্বতী পূজার দিনে একটা স্বাধীনতা পাওয়া যেত। আর সেই অবকাশে মন দেওয়া-নেওয়া হয়ে যেত। এখন অবশ্য সেকালের মতো অত চাপ নেই। এখন ভালোবাসার জন্য বছরভর অপেক্ষার বালাই নেই। ফেসবুকে বা সেলফোনে স্রেফ মনের কথা জানালেই হলো। যুগ বদলেছে। বদলের সঙ্গে সঙ্গে অনেক দিবসও তৈরি হয়েছে। যেমন, পহেলা ফাল্গুন ও ভ্যালেন্টাইনস ডে। বৈশাখের প্রথম দিনের মতো বসন্তের প্রথম দিনটি বেশ ঘটা করেই পালিত হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। বাংলাদেশে বাংলা সনের যে ক্যালেন্ডার, তাতে বসন্তের দ্বিতীয় দিনেই ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস। এবার তৃতীয় দিনে পড়েছে সরস্বতী পূজা। পরপর তিন দিনের উৎসব। অবশ্য ঢাকায় এখন অন্য বসন্ত। অনেকে একে বাংলা বসন্ত বলে ডাকছেন আরব বসন্তের অনুকরণে। শাহবাগের প্রতিবাদে পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস সব ম্লান হয়ে গেছে। গণমাধ্যমের চোখও এখন শাহবাগে। তরুণরাও সেখানে। ফলে, আলাদা করে পালন করার অবকাশ না রেখে প্রতিবাদের মেলবন্ধনেই সব পালিত হচ্ছে। এবার অবশ্য ভ্যালেন্টাইস ডে একটু ভিন্নমাত্রায় পালিত হওয়ার কথা ছিল। ১৫ তারিখের বিদেশি সব পত্রপত্রিকা জুড়ে ওয়ান বিলিয়ন রাইজিংয়ের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। পাশের দেশ ভারত-শ্রীলংকাতেও ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং পালিত হলো দারুণ উৎসাহে। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে জমজমাট আয়োজনের তেমন ছবি চোখে পড়ল না। যা হলো তাকে রুটিন কর্মসূচির বাইরে কিছু বলা যায় কি-না, সে প্রশ্নও থাকল। অথচ এ আন্দোলনের উদ্যোক্তা ঈভ এন্সলার ক্যাম্পেইন নিয়ে ঢাকা ঘুরে গেছেন গত মাসেই। ঈভ ও তার সহকর্মীরা দাবি তুলেছিলেন, এবারের ভ্যালেন্টাইন ডে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হোক। শুধু ফুল, ক্যান্ডি আর উপহার নয়। বিশ্বব্যাপী নারীর ওপর যে নির্যাতন চলছে , তার বিরুদ্ধে পথে নামুক এক বিলিয়ন মানুষ। ভালোবাসা জানানোর সঙ্গে পুরুষরা কথা দিক_ নারীর পাশে থাকবে। নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। প্রস্তাবটা দারুণ। আমাদের নারী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা এ প্রস্তাব নিয়ে শাহবাগে গেলে সাড়া নিশ্চয়ই পড়ত। কিন্তু তেমন হলো না। অবাক হয়ে দেখছিলাম, বিশ্বব্যাপী ওয়ান বিলিয়ন রাইজিংয়ের কর্মসূচি। বিপুল উৎসাহে নেচে-গেয়ে সমবেত হয়ে নারীরা পালন করছেন ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং। নারীদের সঙ্গে মিলে পুরুষরাও একত্র হয়েছেন। এমন ভালোবাসা দিবসই তো দরকার। এমনিতেই ভালোবাসা দিবস যার যার কাছে তার তার মতো। কারওটা কারও সঙ্গে মেলে না। কেউ হয়তো ভালোবাসা বলতে বোঝেন নর-নারীর সম্পর্ককে। কেউ সেটিকে পারিবারিক, সামাজিক এমনকি দেশের প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে সম্পর্কিত করেন। ফলে, একেক বছর যদি একেকভাবে দিবস পালনের প্রস্তাব আসে, মন্দ হয় না। অন্তত, গতানুগতিকতার বাইরে অন্য তাৎপর্য তৈরি হয় তাতে। গতানুগতিকতা কী? যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক ম্যাগাজিন যে তথ্য দিয়েছে, তা শিউরে ওঠার মতো। তারা জানাচ্ছে, এ বছর ভ্যালেন্টাইন ডেতে শুধু আমেরিকাতেই খরচা হয়েছে কুড়ি বিলিয়ন ডলার। এ খরচার বড় অংশ গেছে বাইরে খেতে গিয়ে। প্রায় সাড়ে নয় বিলিয়ন ডলার। বাকি খরচ গেছে কার্ড, ক্যান্ডি, ফুল, পোশাক, অলঙ্কার ইত্যাদি খাতে। খরচাটা দিন দিন বাড়তির দিকে গড়াচ্ছে। আমাদের দেশে কী হচ্ছে, সে হিসাব আপাতত নেই। কখনও হবে_ এমন আশাও নেই। তবে, আমেরিকার হিসাব দেখে কিছু অনুমান করে নেওয়া চলে। কিন্তু অনুমানে কি পুরো তুষ্টি আসবে? অনুমান না পোষালে অবশ্য আমরা একটা হাজারো, লাখো বা কোটি শব্দ জুড়ে দিতে পারি। আপত্তি নেই তাতে কারও। সঠিক পরিসংখ্যান যখন
নেই, তখন তো অনুমানেই কাজ চালাতে হয়।

Saturday, January 12, 2013

ঐতিহাসিক শীত

ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?' কবির ইচ্ছা_ শীতকাল এলে তিনি তিন মাস ঘুমিয়ে থাকবেন। শীতনিদ্রা যাপন করবেন, আলস্য যাপন করবেন ব্যাঙের মতো। আমাদের দেশ শীতপ্রধান নয়, বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাসের শীতেই এখানে জনজীবনে স্থবিরতা নেমে আসে। রাস্তাঘাটে ভিড় কমে যায়, সকাল ও সন্ধ্যায় ঘরের বাইরে চলাচল কমে যায়। শীত এখানে মূলত আলস্যপ্রধান ঋতু। শীতপ্রধান দেশগুলোর থেকে চিত্রটা একেবারেই আলাদা। যেখানে বছরভর শীত সেখানে লোকের আলাদা করে শীতের প্রস্তুতির দরকার পড়ে না। শীত উপলক্ষে জনজীবনে বিশেষ স্থবিরতাও নেমে আসে না। তুষারপাত, তুষারঝড়ে কিছু সমস্যা হয়। তাপমাত্র মাইনাসে নামতে নামতে এমন পর্যায়ে পেঁৗছায় যে বাধ্য হয়ে বাইরের কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মতো অল্প শীতে তারা কাতর হয় না। অবশ্য শীতে কাতর না হওয়ার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। শীতপ্রধান দেশগুলো শীতের হাত থেকে স্থায়ীভাবে বাঁচতে নানা ব্যবস্থা তৈরি করে নিয়েছে। তাদের অফিস, আদালত, বিপণি বিতান, বাড়িঘর, যানবাহন_ সবই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেমের বাইরে খুব কম সময়ই তাদের থাকতে হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের বিশেষ পরিচয় আছে কি? আতপ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। শীতকালে কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বন্ধই থাকে। অর্থাৎ শীত নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা তার জানা নেই। সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেমের কোনো উদাহরণ পাওয়া যায় না। ফলে স্বল্পকালীন শীত কোনোরকমে শীতের কাপড়ে পার করে দেওয়াই এখানে রেওয়াজ। শীত নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা এখানে বাস্তবসম্মতও হয়তো নয়। এ বছর শীত পড়েছে বেশ, কিন্তু গত কয়েক বছরে শীত ততটা পড়েনি। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বছরের কিছু সময় তীব্র শীত পড়ে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয় তাতে, শীতার্ত মানুষের মৃত্যুও ঘটে। কিন্তু অনেক স্থানে শীত এসেই বলে যাই। শীতের কাপড় নামাতে নামাতেই তুলে ফেলতে হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। তখন অনেকেই শীতে কবির মতোই উচ্চারণ করেছেন, শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা? এবার শীত একটু বেশিই পড়েছে। পত্রিকা বলছে এমন শীত গত চলি্লশ বছরে পড়েনি। সেদিক থেকে এ শীত ঐতিহাসিকও বটে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। লোকে শীতে কাতর হয়ে পড়েছে। বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। শীতের সময় শীতার্ত মানুষের কাছে শুধু শীতের কাপড় নয়, প্রয়োজনীয় খাবার পেঁৗছানোও জরুরি। কেননা, প্রবল শীতে শরীর দ্রুত তাপ হারাতে থাকে, প্রয়োজনীয় ক্যালরি তৈরি না হলে শরীর দুর্বল হতে হতে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। শীতের এই তীব্রতায় অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছে, এবার এমন শীত পড়ল কেন? কেউ কেউ বরফ পড়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করছেন। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় শীতের তীব্রতা। বিগত বছরগুলোতে শীত কম পড়ার পর প্রশ্ন উঠেছিল, কেন এমন হলো। তখনও বলা হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এসব ঘটছে। দুই ক্ষেত্রেই নিশ্চয়ই জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী। কিন্তু এমন শীত তো আমাদের দেশে নজিরবিহীন নয়, অতীতে যখন এমন শীত পড়েছে তখন এবার পড়তে দোষ কী? আমাদের সমুদ্র আছে, সমুদ্র থাকলেই জলোচ্ছ্বাস, ঝড়-তুফান থাকবে। একে মেনে নিয়েই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের শিয়রের কাছে হিমালয় পর্বতমালাও আছে। হিমালয়ের পাদদেশের সব দেশেই তো বরফ পড়ে। আমরা একটু দূরে বলে বরফের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি। তাই বলে শীত মেনে নিতে পারব না? শীত আমাদের জলবায়ুতে সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নাকি এ নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু করা দরকার, তা নিয়ে নিশ্চয় আবহাওয়াবিদরা কোনো নির্দেশনা দেবেন। আপাতত, নগদে আমরা শীতকেই পাচ্ছি। আসুন, আমরা শীত মেনে নেই। সাবধান থেকে একে উপভোগ করি। যারা কষ্টে আছেন খাবার ও বস্ত্র নিয়ে তাদের কাছে যাই।