Wednesday, May 5, 2010

বিমানবন্দর বিভ্রাট


লালন সাঁইয়ের গোষ্ঠ গানে শ্রীকৃষ্ণ মাকে বলছেন, গোষ্ঠে আর যাব না মা। কারণ কী? দাদা বলরামের সঙ্গে গরুর পাল নিয়ে গোষ্ঠে যায় রাখাল বালকেরা, সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ যান। কিন্তু গোষ্ঠে গেলে দাদা বলরাম তাকে মারে। কৃষ্ণ মায়ের কাছে তাই বিচার দিচ্ছেন, বলাই দাদার প্রাণে দয়া নেই বলে কৃষ্ণ কানাইয়া মার কাছে আবদার করেছেন যে আর গোষ্ঠে যাবেন না। কিছুদিন আগে আমেরিকার এক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা হুজ্জতির শিকার হয়ে বলিউডের নায়ক শাহরুখ খানও বলেছিলেন, আমেরিকায় আর যাবেন না। বিমানবন্দরের রাখালেরা তাকে ধরে জেরা করেছে, আটকে রেখেছে আর কত কি-না হয়েছে। আমজনতার জন্য এ না হয় নিত্যকার ব্যাপার কিন্তু শাহরুখ তা সইবেন কেন? তাই অভিমান করে তিনি বলেছেন, এ রকম হলে আর আমেরিকায় যাবেন না। কিন্তু একালে আমেরিকায় না গেলে কি চলে? আর কারও চলুক না চলুক শাহরুখ খানদের চলবে না তা বলাবাহুল্য। শুধু শাহরুখ নন, তার আগে ভারতের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামকেও আমেরিকার বিমানবন্দরে নানা হুজ্জতি পোহাতে হয়েছিল। ভারতের মতো দেশের রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, সেলিব্রেটি হওয়ার পরও কেন এই ভোগান্তি? আমেরিকার নিরাপত্তা কর্মীরা বলবেন, এ তো রুটিনওয়ার্ক। কিন্তু বাঁকাদৃষ্টির লোকেরা বলেন, মুসলিম না হলে এমন হতো না। ভারতীয় নাগরিকদের জন্য হয়তো কিছু রেয়াত দেন নিরাপত্তা কর্মীরা। কিন্তু কিছু দেশ একেবারে কালো তালিকায়। তাদের নাগরিকরা বিমানবন্দরে কেমন বিপত্তিতে পড়েন তা বর্ণনা করবার বিষয় নয়। সাপে নাকি যাকে দংশায়নি সে সাপের বিষের মর্ম বুঝতে পারে না। কাস্টমসের কাহিনী যাকে ধরেনি তিনিও নাকি কাস্টমসের মর্ম বুঝতে পারবেন না।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বহু সংস্কৃতির দেশ। আফ্রিকান আমেরিকান, এশিয়ান আমেরিকান, লাতিন আমেরিকান কত শত নাম নিয়ে ঘোরাফেরা করেন এসব সংস্কৃতির লোকেরা। নানা মহাদেশ থেকে সমুদ্র, বনপথ পাড়ি দিয়ে তারা স্বপ্নের দেশে পেঁৗছেছেন। এই তো সেদিনও বলা হতো, এ দেশ হলো স্বাধীনতার, ফ্রিডমই এর মূলমন্ত্র। কিন্তু নাইন-ইলেভেন স্বাধীনতার মূলে হানা দিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমেরিকানরা এখন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতেও রাজি। দুষ্ট লোকেরা বলত, আমেরিকার রাষ্ট্র পরিচালনায় আগে-পরে সবসময়ই বিগ ব্রাদারের বিশাল ভূমিকা। বিগ ব্রাদার জর্জ অরওয়েলের সেই চরিত্র যে নাকি নাগরিকদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি চালায়। এ ব্যবস্থা আগে-পরে ছিল আমেরিকায়। কিন্তু নাইন-ইলেভেনজনিত নিরাপত্তাহীনতায় সব নজরদারি, তল্লাশি আর তদারকিকে মার্কিন নাগরিকরা খোলাখুলি মুখ বুজে সয়ে নিয়েছেন। ফ্রিডম জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও জঙ্গিবাদ ঠেকাও এই হয়েছে মূলমন্ত্র। তাতে রাষ্ট্রের সুবিধা হয়েছে। এতসব নজরদারির মধ্যে জঙ্গিবাদ ঠেকানো যাক না যাক, নজরদারির আয়োজন চলছে বেশ। বছরে দু'বছরে হয়তো একজন জঙ্গি আটক হচ্ছে কিন্তু জঙ্গি সন্দেহে সবাইকে তল্লাশি করে ছাড়া হচ্ছে। মুসলিমদের ধরে মুসলিম হওয়ার বেদনাটা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিছুদিন আগে নাইজেরিয়ার জঙ্গি ওমর ফারুককে নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে গেল। এক ধাক্কায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কঠোরতম অবস্থায় চলে গেল। এ নিয়ে একটি কার্টুন এঁকেছেন ক্লে বেনেট। কার্টুন দেখে ফেলুদার গল্পের কথা মনে পড়ল। সত্যজিৎ রায় বইয়ের নাম দিয়েছিলেন গ্যাংটকে গণ্ডগোল। বিমানবন্দরে তল্লাশি নিয়ে বেনেটের কার্টুন দেখে মনে হলো, বিমানবন্দরে বিভ্রাট নিয়ে কাহিনী লেখার সময় এসে গেছে। এ অবশ্য গোয়েন্দা গল্প হবে না। এ হবে স্বপ্নের দেশের দরজায় অতিথি অভ্যাগতদের নাকাল হওয়ার ট্র্যাজিক কাহিনী।

No comments:

Post a Comment