Saturday, June 23, 2012

লক্ষ্মণ-রেখা

বাল্মীকি রামায়ণে লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ নেই। উত্তর ভারতে বহুল প্রচলিত রামচরিতমানসের অরণ্যকাণ্ডেও লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু রামচরিতমানের লঙ্কাকাণ্ডে রানী মান্দোদরী রাজা রাবণকে এই বলে তিরস্কার করেছেন যে, রাবণের বীরত্বের দাবি সম্পূর্ণ ফাঁপা। কেননা তিনি রামচন্দ্রের ছোট ভাই লক্ষ্মণের আঁকা ছোট একটি রেখা অতিক্রম করার সাহস পাননি। বস্তুত মূল রামায়ণে লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ না থাকলেও পরবর্তীকালের রামায়ণে অরণ্যকাণ্ডে লক্ষ্মণ-রেখার প্রসঙ্গ গুরুত্ব সহকারে উলি্লখিত হয়েছে। লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ পরবর্তীকালে বহুবার বহুভাবে হয়েছে। কিছুদিন আগে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গণমাধ্যমকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, আদালতের সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে গণমাধ্যম যেন লক্ষ্মণ-রেখার কথা বিস্মৃত না হয়। বস্তুতপক্ষে, ভারতে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রায়ই লক্ষ্মণ-রেখার কথা উলি্লখিত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রে সরকার, সেনাবাহিনী, গণমাধ্যম, আদালত, সংসদ, আমলাতন্ত্রসহ সকলেরই নিজ নিজ এলাকা ও এখতিয়ার থাকে। এই চৌহদ্দি কোনো কারণে কেউ লঙ্ঘন করলে রাষ্ট্রীয় আধুনিক রাষ্ট্রের সমতার নীতিতে ব্যত্যয় ঘটে। রাষ্ট্রের কোনো একটি অঙ্গ নিজের অতিরিক্ত শক্তি প্রকাশে প্রলুব্ধ হয়ে সফল হলে তাতে রাষ্ট্রের দুর্বলতা প্রকাশিত হয়। ফলে রাষ্ট্রের ব্যাপারে সীমা ও সীমা লঙ্ঘনের কথা মনে করিয়ে দিতে লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ ভারতে হরহামেশা দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে রামায়ণ কাব্য হিসেবে জনপ্রিয় হলেও এই মহাকাব্যে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ততটা পরিচিত নয়। তাই এখানে প্রাসঙ্গিক হলেও লক্ষ্মণ-রেখার উল্লেখ সেভাবে দেখতে পাওয়া যায় না। রামায়ণে রাবণ যখন সীতাকে অপহরণের পরিকল্পনা আঁটেন, তখন তিনি রাক্ষস মারিচের সহায়তা কামনা করেন। মারিচ স্বর্ণমৃগের রূপ ধরেন। স্বর্ণমৃগ সীতার সামনে উপস্থিত হয়ে তাকে প্রলুব্ধ করে। সীতা রামচন্দ্রকে বলেন, তাকে ওই স্বর্ণহরিণ এনে দিতে হবে। রামচন্দ্র বুঝতে পারেন ওটি মায়ামৃগ এবং অশুভ সংকেত। তারপরও সীতার অনুরোধে তাকে ওই মায়ামৃগ অর্থাৎ মারিচের পশ্চাদ্ধাবন করতে হয়। হরিণের পিছু ধাওয়া করে যাওয়ার বহু পরেও যখন রামচন্দ্র ফিরছিলেন না তখন সীতা লক্ষ্মণকে বলেন, তিনি যেন ভাইয়ের খোঁজে বের হন। কিন্তু সীতার নিরাপত্তার দায়িত্ব লক্ষ্মণের। তিনি কীভাবে তাকে অরক্ষিত রেখে ভাইকে খুঁজতে যাবেন? সীতার নিরাপত্তার জন্য লক্ষ্মণ গৃহের চারদিকে একটি রেখা অঙ্কন করলেন। এই রেখা অতিক্রম করার চেষ্টা করলে যে কেউ আগুনে ভস্মীভূত হবে। লক্ষ্মণ-রেখার নিরাপত্তায় সীতাকে রেখে লক্ষ্মণ ভাইয়ের খোঁজে বের হলেন। লক্ষ্মণ চলে যাওয়ার পর ভিখারির বেশে রাক্ষসরাজ রাবণ সেখানে উপস্থিত হলেন এবং সীতার কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করলেন। ভারতীয় ঐতিহ্যে অতিথি দেব ভবাঃ। অর্থাৎ অতিথি ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ফলে তাকে অগ্রাহ্য করা কঠিন। পুরাণকাররা বলেন, সীতা তখন অন্যমনস্ক ও উদ্বিগ্নও ছিলেন। ফলে লক্ষ্মণের নিষেধ বিস্মৃত হয়ে তিনি রেখাটি অতিক্রম করে ফেলেন। সীতা রেখার নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম না করে ভিক্ষা দিতে গেলে রাবণ তাকে বলেন, বেষ্টনীর ভেতরে থেকে ভিক্ষা দিলে দাতা সানন্দে ভিক্ষা দিচ্ছেন কি-না তা স্পষ্ট হয় না। এ কারণেও সীতা লক্ষ্মণ-রেখা অতিক্রম করে তাকে ভিক্ষা দিতে যান। সীতা লক্ষ্মণ-রেখা অতিক্রম করিবামাত্র রাবণ তাকে অপহরণ করেন। পুষ্পকরথে করে লঙ্কা নগরীতে নিয়ে অন্তরীণ করেন। সীতা অপহরণের পর রামচন্দ্রের লঙ্কা অভিযান শুরু হয়।

Thursday, June 14, 2012

আতিশয্য

আমরা কিছু ব্যাপারে বাড়াবাড়ি পছন্দ না করলেও অনেক কিছুতে আতিশয্য বেশ পছন্দ করি। উদাহরণ হিসেবে আসে শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রসঙ্গ। পৃথিবীব্যাপী শ্রদ্ধা নিবেদনের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। শহীদদের স্মরণের জন্য শহীদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে ফুল বা মোমবাতি দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের রেওয়াজ সর্বত্রই প্রচলিত। নানা দেশের আচার দেখে সে সম্পর্কে কিছু ধারণা করা চলে। টেলিভিশনে দেখি, লোকে একটা ফুল বড়জোর এক গোছা ফুল হাতে করে স্মৃতিস্তম্ভে হাজির হয়। ফুলটুকু রেখে নীরবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ফিরে আসেন। আমাদের দেশেও শ্রদ্ধা নিবেদনের রীতি আছে। শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধে আমরাও যাই। তবে এই যাওয়ার মধ্যে ব্যক্তিগত কোনো 'যাত্রা' আছে কি-না সন্দেহ। শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই_ হরেদরে আমরা সবাই মিছিল করে দলবল নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাই। একটি-দুটি ফুলে আমাদের প্রাণের নিবেদন সম্পূর্ণ হয় না। পারলে যেন বাগান উপড়ে নিয়ে যাই। বড় একটা ফুলের তোড়ায় সংগঠনের নাম লিখে হুড়োহুড়ি করে সেটি বেদিতে স্থাপন করতে গিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ লেগে যায়। শ্রদ্ধা নিবেদনের চাইতে ছবি তোলাটাই তখন মুখ্য উদ্দেশ্য। টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেখেছি, ফুল দেওয়ার হুড়োহুড়ির মধ্যে নিরুপায় হয়ে কেউ কেউ বেদিতে ফুল ছুড়ে মারছেন। শুধু যে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে এমন হয় তা নয়। বিশিষ্ট কেউ মারা গেলে মরদেহ যখন শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন শ্রদ্ধা নিবেদনের ওই একই রীতির অনুবর্তন ঘটে। বাঁধাই করা বড় তোড়া কফিনের ওপর না দিলে ঠিক যেন শ্রদ্ধা নিবেদন সম্পূর্ণ হয় না। একটি-দুটি ফুল কারও হাতে থাকলে হয়তো তাকে দীনহীন মনে করা হয়। অ্যাপলের কর্ণধার স্টিভ জবস মারা যাওয়ার পর দেখেছিলাম ভক্তরা একটি-দুটি ফুল স্টিভ জবসের ছবির সামনে রেখে দিয়েছেন। কেউবা অ্যাপলের কোনো গেজেট রেখে সম্মান দেখিয়েছেন। শ্রদ্ধ নিবেদনের জন্য মরদেহটাই সামনে রাখার খুব দরকার কারও পড়েনি। কিন্তু আমাদের এখানে মরদেহ উপস্থিত থাকবেই। আর তাতে মিছিল করে ফুলের বড় তোড়া দেওয়াটাই রেওয়াজ। এতে করে ফুল ব্যবসায়ীদের লাভ হয় বটে, কিন্তু অন্তরের শ্রদ্ধা কি যথার্থরূপে প্রকাশিত হয়? এ তো গেল ফুলের কথা। ভাষার কথা তুললে আরও নানা আতিশয্য চোখে পড়বে। বিশেষণ ছাড়া আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা ঠিক প্রকাশিত হয় না। তাও একটি-দুটি বিশেষণে কাজ চলে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষণের বন্যা বইয়ে দেওয়াই রেওয়াজ। বড় নেতা-নেত্রীদের ক্ষেত্রে বিশেষণেরও আবার প্রকারভেদ এমনকি দলও আছে। একজনকে এক বিশেষণে অভিহিত করলে অন্যজনকে ভিন্ন বিশেষণে অভিহিত করতে হবে। পাতিনেতাদের ক্ষেত্রেও বিশেষণের কমতি নেই। তাদের অনুসারীরাও বিশেষণ ঠিকই বের করে নেন। বিশেষণের এমনই আবশ্যকতা যে, কেউ যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের আগে কবিগুরু বা বিশ্বকবি না লেখেন তবে ভাবা হতে পারে যে, তাকে অসম্মান করা হলো। অন্য বড় ব্যক্তির বেলাতেও একই অবস্থা। কেউ মারা গেলে, তিনি অবশ্যই বিশিষ্ট। লেখক হলে বিশিষ্ট লেখক, উকিল হলে বিশিষ্ট উকিল। বলা হয়ে থাকে, যার তেমন কোনো পরিচয় স্পষ্ট নয় তার জন্য বরাদ্দ বিশিষ্ট সমাজসেবক। আগে মৃত্যু সংবাদে সম্ভ্রান্ত বংশের কথা হরদম লেখা হতো। ইদানীং বংশের প্রকোপ কিছুটা কমেছে। কিন্তু একদিকে কমলে অন্যদিকে আতিশয্য বাড়তেই থাকে। সংকটটা কোথায় সেটি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। হয়তো পরিমিতি বোধের অভাব আমাদের আছে। অথবা হয়তো কোনো ক্ষেত্রে সেটি রপ্তই হয়নি। নয়তো, এটাই আমাদের সংস্কৃতি। আমরা যখন কাউকে সম্মান করি তখন তাকে বিশিষ্ট বানিয়েই সম্মান করি। আর যখন কাউকে অসম্মান করতে হয় তখন তাকে তার আসন থেকে নামিয়ে গালি না দিয়ে হালকা কথার যুক্তিতে অপমান করতেও পারি না।

Thursday, June 7, 2012

ডায়মন্ড জুবিলি

ব্রিটেনের রানীর সিংহাসনে আরোহণের ষাট বছর পূর্তিতে রীতিমতো এক বিশাল উৎসব হয়ে গেল ব্রিটেনে। একদা যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, সে সাম্রাজ্যের অংশ ছিল বাংলাদেশও। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সে সাম্রাজ্যের হাত থেকে মুক্তি অর্জন করেছে এ অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বহু চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে এখানে। আমাদের আইন-আদালত, রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় যেমন; সংস্কৃতি-শিক্ষা-স্থাপত্য-যোগাযোগেও তেমন। যত দূরেই ভাবি না কেন, সাম্রাজ্যের স্মৃতিচিহ্নগুলো ক্ষণে ক্ষণে এসে তাদের অস্তিত্ব জাহির করে। সাম্রাজ্যের তিক্ত স্মৃতি আওড়ে মুখে বিপ্লবী বুলি কপচে আমরা সাম্রাজ্যের সব দাগ দূর করতে চাই বটে, কিন্তু বাস্তবে তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না। তবু কালের ধুলায় অনেক কিছুর মতো সাম্রাজ্যের স্মৃতিতেও ধুলা পড়েছে। যদি এ সবকিছু বাদ দিয়ে আমাদের মানস গঠনের কথা মনে রেখে সাম্রাজ্যের দিকে তাকাই, তবে ব্রিটিশ রাজা-রানীরাই আমাদের দেখা শেষ রাজা-রানী। সে রাজা-রানীদের প্রতি একটি সহজাত বিস্ময়-শ্রদ্ধা-ভয়-ভক্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। যদি সেটুকুও না থাকে, তবে একেবারে সর্বসাম্প্রতিক রাজনীতির কথাই তোলা যাক। আন্তর্জাতিক ক্ষমতাবিন্যাসে যুক্তরাজ্যের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পরেই। আমাদের নীতিনির্ধারণে তাদের প্রত্যক্ষ হোক, কি পরোক্ষ_ একটা ভূমিকা আছেই। সে কারণে এসব দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের আমরা শ্রদ্ধা-ভক্তি করি। ব্রিটেনের রানী হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথ শ্রদ্ধা-ভক্তি পান। বস্তুত তার ক্ষেত্রে পুরনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্মৃতি, কমনওয়েলথ বর্তমানের ব্রিটেন সব মিলেমিশে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। শুধু রানী কেন, পুরো রাজপরিবারের প্রতিই একটা আকর্ষণ চারদিকে খেয়াল করি। এ দেশে ব্রিটিশ রাজপরিবারের বিদ্রোহী বধূ প্রিন্সেস ডায়ানা কেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তা মনে করা যেতে পারে। এই সেদিন ডায়ানার ছেলে উইলিয়ামের বিয়েতে বাংলাদেশে কেমন আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, সেও মনে পড়ে। তুলনায় রানী এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের ষাট বছর কিন্তু একটু নীরবেই চলে গেল। ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিরা ঠিকই ফুর্তি করেছেন; ব্রিটিশদের সঙ্গে আনন্দ-উৎসবে মেতেছেন। ঢাকায়ও উৎসবের ছিটেফোঁটা লাগেনি, তা নয়। কিন্তু টেলিভিশনের সামনে বসে বিয়ে দেখার রুদ্ধশ্বাস আয়োজনের সঙ্গে এর তুলনা চলে না। উইলিয়াম আর কেটের বিয়ের সময় অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন, রূপকথা শুনতে যে কারণে আমরা ভালোবাসি, সে কারণেই ব্রিটিশরা রাজা-রানীর এই ঐতিহ্য সযত্নে টিকিয়ে রেখেছে। শুধু যে টিকিয়ে রেখেছে, তা নয়। এদের নিয়ে রীতিমতো সুখেই আছে তারা। দেশে চলছে দারুণ গণতন্ত্র। আধুনিক জীবনযাপন পদ্ধতি। কিন্তু ঐতিহ্যটাও দিব্যি রেখে দেওয়া হয়েছে। মাথায় তুলে রাখা হয়েছে জীবন্ত জাদুঘর। রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধানের পদ তো দরকার। রানীতে খারাপ কী? রানী এখনও 'নাইট' উপাধি দিচ্ছেন। কমনওয়েলথে অনেক উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে। এমন অনেক কিছুই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকারের তরফে, কিন্তু নাম ফলছে রানীর। তবে ব্রিটেনে রানীর একটা ধর্মীয় ভূমিকাও আছে। ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় লুকিয়ে রাখতে বেশ পারদর্শী। কিন্তু তাদের উৎসব আয়োজন খেয়াল করলে বোঝা যায়, ধর্মের একটা সম্মোহন আছে সেখানে। আনুষ্ঠানিক ধর্মে রানীর উচ্চ স্থান আছে। তবে ধর্মীয় কারণেই যে তারা উৎসবে মাতে_ সে দোষ তাদের দেওয়া যাবে না। ভিড়ের অনেক মুখ আছে, যারা স্রেফ উৎসবের জন্যই উৎসবে মেতেছে_ স্পষ্ট বোঝা যায়। আবার অনেকেই সাম্রাজ্যের স্মৃতিলিপ্ত। তাদের চোখেমুখে রানী ও রাজতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা। আর ইতিহাস তো মানুষকে বিস্মিত করে। ইতিহাস যদি সামনে এসে দাঁড়ায় তবে হতচকিত না হয়ে উপায় কী? তাই ইতিহাসের রাজা-রানী ও রাজকন্যা-রাজপুত্ররা বর্তমান পর্যন্ত টিকে থাকলে তো অসুবিধা কোথায়?

Sunday, June 3, 2012

দৃশ্যপটে বাংলাদেশ কোথায়?

সাকুল্যে যে দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ সীমান্ত তার একটি ভারত অন্যটি মিয়ানমার। যোগাযোগের নানা মাত্রার কারণে প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের অস্তিত্ব প্রতিনিয়তই আমরা টের পাই কিন্তু মিয়ানমার যেন সীমান্তে থেকেও বহুদূর। অথচ, ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমার অর্থাৎ বার্মার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক গভীর। বাংলার কবিরা একদা আরাকান রাজসভার সমর্থন নিয়ে সাহিত্যচর্চা করতেন। বহুকাল বাঙালি অভিবাসীরা বার্মাকে বসবাসের জন্য পছন্দ করেছে। সীমান্তে দুই দেশের সম্পর্ক কখনও অম্ল কখনও মধুর। মিয়ানমারের শাসকদের চাপে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখন বাংলাদেশে আশ্রিত। আছে নানা রকমের অনুমোদিত ও অননুমোদিত বাণিজ্য সম্পর্কও। এত নিকটবর্তী যে প্রতিবেশী তার সম্পর্কে খোঁজ পেতে আমাদের নির্ভর করতে হয় পাশ্চাত্যের সংবাদমাধ্যমের ওপর। বলতে গেলে ভৌগোলিক দূরত্ব কম হলেও মানসিক দূরত্ব যেন কয়েক হাজার কিলোমিটার। অবশ্য এর জন্য মিয়ানমার কম দায়ী নয়। দীর্ঘদিন রুদ্ধশ্বাস সামরিক শাসনাধীন মিয়ানমার প্রতিবেশীদের সঙ্গে রহস্যময় সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের সরকারগুলো মিয়ানমারের সামরিক শাসনের প্রতি মোটামুটিভাবে সহানুভূতিশীল ছিল। তবে দুই দেশের জনগণের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্ক কী তা বলা মুশকিল। বাংলাদেশেও বহু মানুষ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ দেশে অং সান সু চির বিপুল জনপ্রিয়তা। অবশ্য এ জনপ্রিয়তা প্রতিবেশী দেশের গণতান্ত্রিক নেত্রীর জন্য নাকি পাশ্চাত্যের পছন্দনীয় আইকনের প্রতি তা বলা মুশকিল। কাছে থেকে দূরের এ দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অতীতে যা-ই থাকুক, ভবিষ্যতে প্রতিবেশী হিসেবে সে দেশ যে এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মিয়ানমার সম্প্রতি তার দেশের দরজা খুলেছে। সে দেশের প্রেসিডেন্ট থান শোয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে নানা দেশে যাচ্ছেন যেমন, তেমনি নানা দেশের রাষ্ট্রনেতারা সে দেশে প্রবেশও করছেন। আগে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা ছিল। অং সান সু চির মুক্তির পর ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা উঠতে শুরু করেছে। নানা রকমের বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে, বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। বস্তুত, মিয়ানমারের দিকে দৃষ্টি এখন সবার। আগে কোনো কোনো দেশ গোপনে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত। সু চির মুক্তির পর আড়ালের দরকার পড়ছে না। এখন মিয়ানমারকে দেখে অনেকেই অবাক হচ্ছেন। যতটা খারাপ ভাবা গিয়েছিল ততটা খারাপ নয় মিয়ানমারের অবস্থা। বরং দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় একটি বড় শক্তি হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেশটির আছে। থান শোয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন। গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত থাকলে সু চির নেতৃত্বে দেশটি যে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বড় গুরুত্ব পাবে সন্দেহ নেই। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক আগে থেকেই উষ্ণ। সু চি মুক্তির পর প্রথম থাইল্যান্ড গেলেন। থাইল্যান্ডে যাওয়ার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের বিশাল বহর নিয়ে গিয়ে একগুচ্ছ চুক্তি করলেন মিয়ানমারের সঙ্গে। সু চিকে আমন্ত্রণ জানালেন। চীন, ভারত, থাইল্যান্ড বাদ দিলে মিয়ানমারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী বাংলাদেশ। মিয়ানমারে যখন পরিবর্তনের হাওয়া, তাকে কেন্দ্র করে যখন নানামুখী তোড়জোড় তখন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কোথায়? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ডিসেম্বরে মিয়ানমার সফর করেছেন। কিন্তু বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও চুক্তি বেশি আগায়নি। অং সান সু চি যদি বাংলাদেশে আসেন, তাকে সাদরে বরণ করে নেবে বাংলাদেশের জনগণ। যাওয়া-আসায় কার্পণ্য চলবে না। মিয়ানমারের সঙ্গে পুরনো, জটিল ও রহস্যময় সম্পর্কের ইতি টানতেই হবে। দুই দেশের বিবাদগুলো মিটিয়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগে আমরা যদি পিছিয়ে পড়তেই থাকি তবে সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?