Thursday, February 24, 2011

শেষ দিক থেকে দ্বিতীয়


তালিকাটি যদি দুর্নীতির ধারণাসূচক হতো তবে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। একদল বলত, দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয়নি। আরেক দল বলত, দুর্নীতির ক্ষেত্রে পিছিয়েও যায়নি দেশ, অর্থাৎ পরপর দুই বছর দুর্নীতির ধারণাসূচকে একই অবস্থানে থাকা একটা স্থিতিশীলতার লক্ষণ। এমন স্থিতিশীল অবস্থানে আমরা বেশ কয়েক বছর ছিলাম। দুর্নীতির ধারণাসূচকে একেবারে শীর্ষস্থানে থাকার সেই সময়ের কথা অনেকের মনে পড়বে এ প্রসঙ্গে। এবার দেশ নয় শহর। দুর্নীতি বিষয় নয়, বিষয় বসবাসযোগ্যতা। বসবাস অযোগ্যতার দিক থেকে গত বছর ঢাকা ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে, এবারও তালিকায় দ্বিতীয় রয়েছে। ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার গুরুদায়িত্ব যাদের কাঁধে তারা বলতে পারেন, পরপর দুই বছর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা স্থিতিশীলতার লক্ষণ। অবস্থা খারাপ হয়নি, এটাই তো স্বস্তির কথা। আগ বাড়িয়ে কেউ কেউ আবার ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটকে দোষারোপ করতে পারেন। বলতে পারেন, তাদের জরিপে ভুল ছিল, তারা ধারণার ওপর জরিপ করেছেন। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য এ ধরনের জরিপ চালানো হয়েছে, এমন কথাও উঠতে পারে। আরেকটু আগ বাড়িয়ে এ ধরনের জরিপের সঙ্গে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের সংযোগও খুঁজে দেখা যেতে পারে। কেউ বলতে পারেন, আমাদের শহর আমাদের মতোই। আমাদের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মতোই আমাদের শহরও। এ শহর বিদেশিদের কাছে যাই হোক, আমরা সুখে আছি। আশার কথা, এখনও এমন মেঠোতর্কের দেখা মিলছে না। বোঝা যাচ্ছে, দুর্নীতি সূচকের মতো বসবাসযোগ্যতার সুযোগ এখানে কল্কে পাচ্ছে না। এ কথা সত্য, দুর্নীতি যেভাবে সমাজের নানা স্তরে বসবাসরত মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলে দেয়, শহরের বাসযোগ্যতা ততটা করে না। শহরে বাস করে এমন কোটি মানুষের কাছে ঢাকাই একমাত্র শহর। পৃথিবীর অন্য কোনো শহর কতটা বাসযোগ্য তা তুলনা করে দেখার অবকাশ তাদের নেই। তুলনা করতে পারে শুধু তারাই যারা আর দশটা শহর দেখেছে, স্বচক্ষে না দেখলেও টিভি-ইন্টারনেটের কল্যাণে আর দশটা শহর সম্পর্কে ধারণা আছে। এমন মানুষের সংখ্যা কম। আমাদের অধিকাংশ মানুষ জানেন না নাগরিক সুবিধা, নিরাপত্তা, চলাচলের স্বাধীনতা, বসবাসের স্বস্তি কী জিনিস? সত্যি কথা বলতে, সর্বনিম্ন সুবিধা যা না থাকলে শহরটি বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে_ সেই গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতেই আমাদের ব্যবস্থাপকরা হিমশিম খেয়ে যান। আমাদের রাস্তার তুলনায় যান বেশি, যানের তুলনায় লোক বেশি। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। পরিস্থিতি এমন যে, যারা কোনোদিন অন্য শহর দেখেননি, কোনো শহর সম্পর্কে শোনেননি পর্যন্ত, তারাও এ শহরকে বসবাসের অনুপযুক্ত ভাবে। আর যারা জানেন, বোঝেন তারা একটু বেশি অস্বস্তিতে থাকবেন এটা স্বাভাবিক। বিদেশিদের ক্ষেত্রে কী হবে সেটি বলাই বাহুল্য। ফলে তারা যখন গবেষণা করে একটি তালিকা করবেন তাতে ঢাকা শহরের নাম শেষ দিকে থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই বলে যুদ্ধবিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষকবলিত হারারের পর? আমাদের চেয়ে অনেক অনুন্নত দেশের শহরও আমাদের থেকে উন্নত, অধিকতর বসবাসযোগ্য। সে দিকগুলো বিচার করলে মনে হয়, শহরের বাসযোগ্যতা শুধু অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা, সদিচ্ছা এমন কিছু জরুরি ব্যাপার অনুন্নত দেশের শহরকেও উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। সম্প্রতি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী হয়ে গেল। শহরকে ঘষে মেজে সাফ করে আমরা বিদেশিদের সামনে উপস্থাপন করতে চাইলাম। কোটি কোটি টাকা খরচ হলো শহর আলোকিত করতে গিয়ে। নানা আশাবাদ তৈরি হলো। মনে হলো, বিদেশিরা এবার পর্যটনের জন্য আসতে শুরু করবে। কিন্তু এখন ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ দেখে মনে হচ্ছে, সে আশা এখনও অনেক দূরের বিষয়। বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে একটু একটু করে এগোতে পারলে নাগরিকদের যেমন অতিথিদেরও তেমনি উপকার হতো। কৃত্রিম ঝাড়ফুঁকে শহর সাজিয়ে লাভ নেই।

Saturday, February 19, 2011

ব্রান্ডিং রিকশা


ক্রিকেট বিশ্বকাপ নিয়ে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই বাংলাদেশে। ঢাকার রাস্তা নানা বর্ণের আলোয় সেজেছে। একদিকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, অন্যদিকে শেরেবাংলা স্টেডিয়াম_ নগরবাসী গভীর রাত পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে আলো দেখছেন, আলোর ঝরনাধারার পাশে ছবি তুলছেন। ক্ষণে ক্ষণে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হচ্ছে রাস্তায়। বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাহারি স্যুভেনির বের হয়েছে_ বাচ্চাদের হাতে শোভা পাচ্ছে তেমন স্যুভেনির। অনেকেই বাংলাদেশের জার্সি পরে ঘুরছেন ও পতাকা বহন করছেন পরম উৎসাহে। রাতের রাস্তায় শুধু যে আলোর বাহার তা নয়, রাজনৈতিক প্রচারণা থেকে ক্রিকেটারদের প্রতি অভিনন্দন বাণী, নানা দেশের ক্রিকেটারদের ছবি, মাস্কট, নেতা-নেত্রীদের ছবিসহ অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে। ঢাকার রাস্তার সংস্কার হয়েছে চোখে পড়ার মতো। গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে রিকশা আগেও ছিল না, এখনও নেই। নতুন করে অনেক অগুরুত্বপূর্ণ রাস্তা থেকে রিকশা উধাও হয়ে গেছে। শহরের লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো হাওয়ায় মিশে গেছে। তবু রাস্তায় ভিড় নেই, বাসস্ট্যান্ডে মানুষের অধীর প্রতীক্ষা নেই। উদ্বোধনীর দিন আধাবেলা বন্ধ থেকে দু'দিনের বন্ধে বেশ একটা উৎসবের আমেজ এসেছে শহরে। রাস্তা সংস্কারের এই বিপুল আয়োজনের মধ্যে অল্প লোকই রাস্তায় বেরোনোর কথা ভাবছেন। এই অবসরে এখনও রাস্তার সমস্যা, চলাচলের সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে না। অতএব ভালয় ভালয় উদ্বোধনী থেকে প্রথম ম্যাচ পর্যন্ত সময় গড়াল তা স্বীকার করতেই হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি বেশ প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে রিকশায় করে অধিনায়কদের মঞ্চে আগমন বেশ নজর কেড়েছে। রিকশা যে আমাদের শহরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এটি আমরা গর্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছি, বিশ্ববাসী দেখে প্রশংসাও করেছে। শুধু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই নয়, ঢাকার রাস্তাগুলোর সজ্জাতেও দেখছি রিকশাকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বোঝা যায়, আয়োজকদের মাথায় রিকশা বেশ একটা জায়গা করে নিয়েছিল। বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে আমরা রিকশার একটা ব্রান্ডিং করে ফেললাম। রিকশার জায়গায় অনেক কিছুই থাকতে পারত। সুন্দরবনের বাঘ তো আছেই, সুন্দরবন, কক্সবাজারসহ অনেক কিছুই আরও গুরুত্ব পেতে পারত। কিন্তু সেসবকে ছাপিয়ে রিকশা যে বিশেষ একটা জায়গা জুড়ে এলো, তার কারণ কী? রিকশা ঢাকা শহরের অন্যতম যান, একথা ঠিক। যানটি পরিবেশসম্মত, জ্বালানিনির্ভর নয়_ ফলে এখন সমাদৃত হওয়ার মতো যানই বটে। কিন্তু আমাদের শহরে কি রিকশার সে কদর আছে? আমাদের শহরের সব সমস্যার প্রথম কারণ হিসেবে আমরা রিকশাকে দায়ী করে, একে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছি। শহরে রিকশা করে কোথাও থেকে কোথাও যাওয়ার উপায় খুব একটা নেই। রিকশা এখন মোটামুটি পাড়ার গলিতে চলার বাহন। শহরে রিকশার জন্য আমরা কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি, করতেও চাই না। তারপরও রিকশাকে যে বিশ্বসভার সামনে গর্বভরে উপস্থাপন করছি তার কারণ কী? হয়তো যানটি দৃষ্টিনন্দন, এটাই হয়তো মুখ্য কারণ। কিন্তু আমাদের অবচেতনে কি এমন মনোভাবও আছে যে, এ যানটি পরিবেশবান্ধব এবং জ্বালানি-সাশ্রয়ী। এমন দিন হয়তো আমাদের দেশেও খুব দূরে নয়, যখন জ্বালানি বাঁচাতে রিকশা বা রিকশার মতো বাহনকে বেছে নিতে হবে, তেমন মেসেজ কি এবারের বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে আমরা দিয়ে ফেললাম? আমাদের রিকশা আর্ট অনেক আগেই শিল্পবোদ্ধাদের কদর পেয়েছে। কেউ কেউ বলেন, মানুষের পায়ে টানা এমন যান অমানবিক। তারপরও এ কথা সত্য, আমাদের শহরে বহু মানুষের কাছে রিকশাই জীবিকার একমাত্র উৎস। রিকশার ব্রান্ডিংয়ে কে কী বুঝেছে জানি না। তবে খেটে খাওয়া মানুষগুলো যে বিশ্বকাপের সঙ্গে অধিকতর একাত্ম বোধ করেছে তা বলাই বাহুল্য।

Tuesday, February 15, 2011

আমার প্রথম উপন্যাস নিয়ে কয়েকটা আলোচনা


মাহবুব মোর্শেদের--`ফেস বাই ফেস' বইটি ভাল লেগেছে...তাই কিছু আলোচনা

মামুন ম. আজিজ

মাহবুব মোর্শেদ ভাই, মানে ব্লগার, মানে প্রথম আলো ব্লগের একসময়ের মডু, মানে বর্তমানে সমকালের সাহিত্য বিভাগে আছেন, সাথে যিনি একজন প্রাথমিক কালের ব্লগার (সামু যুগে আবির্ভাব) এবং একজন পাড় ফেসবুকিষ্টসেই বহুল গুণে বিভূষিত ব্যক্তিটি একটা লালটুকটুকে মোলাটের বই লিখেছেন এবারউপন্যাসনাম - ফেস বাই ফেসঅটোগ্রাফ সহকারে বাড়ীতে নিয়ে আসা বইটি পড়ে এককথায় বলব মজা পেয়েছিআর বেশী কথায় বললে:

মোট ১২০ পাতার বইটির প্রায় শেষের দিকে এই ১০১ পাতার শুরতেই পাওয়া যায়-কোথাও গিয়ে দুই বন্ধু প্রেমিকা হারানোর কথা শেয়ার করতে করতে গলা ধরে কান্দি”- এই ডায়ালোগ খানাপড়ে মনে হচ্ছে দুই বন্ধু মানে দুই যুবক প্রেমিকা হারানোর বেদনায় বেদনার্তআসলে এই দুই বন্ধুর একজন আবার নারী

চরম ক্লাইমেক্স

ক্লাইমেক্স শুধু এখানেই না, বইয়ের পরতে পরতে নানান বাঁকে নানান টুইস্ট খুঁজে পাওয়া যায়আর মূল উপজীব্য বিষয় মানে ফেসবুক এর পোষ্ট মর্টেম লেখক ভাই চরমভাবেই করেছেনপাতায পাতায় দেখেবেন ঠিক আপনি যে কাজটি একটু আগে ফেসবুকে করেছেন, ঠিক তাই হয়তো ঘটাচ্ছে আমাদের নায়ক শুভ

বাস্তবের ফেসবুকে মোর্শেদ ভাই যেমন ক্ষণে ক্ষণে চমকার চমকার ফেসবুক স্টাটাস দেন ঠিক তেমনি তিনি বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় এর কোন সাংখ্যিক ক্রম না করে ফেসবুক স্টাটাসের মত একটা একটা উরাধূরা জব্বর বাক্য ব্যবহার করেছেন পড়লেই ভাবনা পড়ে যায়মন--আসলে কি অর্থ সে সব বাক্যের

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে লোকে যেভাবে ডাব উঁচু করে রস খায় , সেভাবে সুপর্ণার মুখ উঁচু করে ওর মুখে চুমো খাইচুমু খাওয়ার এই উপমা ন্সিন্দেহে ভিনন্নতায় পাঠককে কিঞ্চি ভাবুক করে তোলে

এমন নানান টুকরো টুকরো ঘটনার বর্ননার ফাঁকে ফাঁকে বইটিতে একটু পরে পরেই এসেছে ফেসুবকের মাঝে শুভর সাথে নতুন বা পুরাতন চেনা বা অচেনা কোন ফেসবুক ফ্রেন্ডের কথোপকথনদু:খের ঝর্ণা ধারায় শেয়ারিং অথবা প্রেমের কথন

ফেসবুককে লেখক একজায়গায় নাম দিয়েছেন পেন্ডোরার বাক্স যথার্থ উপমাকি নেই আসলে ফেসবুকে লেখক ও তার এই ফেস বাই ফেসে সেইসব ভার্সেটাইল বৈচিত্র স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলিয়েছেনএমন চরিত্রের সাথে একদা শুভর আলাপ হয় যে কিনা ফেসবুকে পরবাসী এক মেয়ের সাথে অবাধ নিখাদ প্রেমে পড়ায় দুজনে ফেসবুকেই বিয়ে করে ফেলে, মিথ্যে বিয়ে, ভাবনার বিয়ে, কিন্তুফেসবুকের রিলেশনস্টি স্টাটাসে ম্যারিড টু ...সেই দুজন দুজনার নাম চিন্তার সূত্র লেখকের ফেসবুকের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পেড়েছে এখানেএক ব্যবসায়ী ভ্রদ্রলোক পৌঢ় ভদ্রলোক এর সাথে শুভর ফেসবুকে খুব জমে, সে তাকে তার বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয় তার প্রিয় এবং ব্যতিক্রম মনে হওয়া শুভর সাথেএকদা সেই গৃহবধূর সাথেও ভিন্ন এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে শুভরআমেরিকাতে একজন মেডিক্যাল এনথ্রপলজিস্ট এবং ডিভোর্সী স্বাধীনচেতা নারীর সাথে শুভর নানান আলোচনায় উপন্যাস চরম ভাবে সামনে এগানোর উপাত্য খুঁজে নিয়েছেপাঠকও সে সব পড়ে ফেসবুকের মূল মজাটার নির্যাস বুঝতে পারবেন এই চরিত্রটির সাথে আমি বাস্তবের সেলিনা শিকদার নামক একজন ব্লগার কবির মিল খুঁজে পাই

এই এক সমস্যা পাঠক কূলের , একটু মিল পেলেই কারও সাথে সেটা মিশিয়ে ফেলে আমিও ফেলতে ফেলতে ফেলি না মিল সামান্য , অমিলই আসলে বেশীহয়তো দেখা যাবে ফেসবুকে ঘটে যাওয়া লেখকের নিজের জীবনের অনেক ঘটনাই একটু একটু ভিন্ন আঙ্গিকে তিনি এখানে ফুটিয়েছেন

কোন এক ফেসবুক আইডির নারী চরিত্রের রগরগা প্রোফাইল পিকচার দেখে শুভর যখন মনে হয় সেটা ফেইক, সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, নারী চরিত্র তাকে প্রমান দেয়ার জণ্য বলে , আমার পিরিয়ড চলছেতারপর আলোচনা হয় পিরিয়গ হলে মেয়েদের কেমন লাগে সেই সব বিষয়েফেইক চরিত্রের কথায় নারীর ঐ গোপন বিষয়ে বিশদ জ্ঞান তার মেয়ে হবার প্রমাণ হিসেবে কাজ করেশুভর মনেও এই পিরিয়ডের রিয়েল অনুভিতি জানার তীব্র আকাংখা জেগে ওঠে ফেসবুকে শুভর সাথে দেখা যায় একজন সুফি সাধিকার ও পরিচয় হয়সে তাকে নানা পরামর্শ দিতে থাকে

মোট কথা ইটস এ কমপ্লিট ফেসবুক একটিভিটিস এখানে একই সাথে চরিত্র গুলোর মাধ্যমে বেশ মজার , রোমান্টিক এবং হৃদয়ঘন অনেক ঘটনাও ফটিয়ে তুলেছেন তিনি

তবে সরি টু সে একটা ছোট ইতিহাসজনিত ভুল করে ফেলেছেন মোর্শেদ ভাইসেটা বইয়ের ৮৫ পাতায়সেখানে উনি ভারতের জয়পুরের পিং সিটির আলোচনা করছিলেনতথায় জয়পুরের রাজা হিসেব টিপু সুলতানের কথা উল্লেখ করেছেনকিন্তু বাস্তবে জয়পুরে রাজত্ব করত রাজপুতরাআর টিপু সুলতানের রাজত্ব ছিল মহিশূরে যেটা ভারতের দক্ষিণেআর জয়পুরের অবস্থান উত্তরে

এই ছোট ঐতিহাসিক ভুলটা বাদে পুরো বইয়ের ভাষার সাবলিলতা পাঠককে খুব টানার কথাআমাকে টেনেছেফেসবুক জাতীয় হট এবং প্রচন্ড সমসাময়িক একটা বিষয় মাহবুব মোর্শেদ ভাই যে চমকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তারজন্য তাকে সাধুবাদ

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৩:২৮

http://www.somewhereinblog.net/blog/pothe_potheblog/29095087

..................................................................................

"ফেস বাই ফেস" - পেইজ বাই পেইজ

আনন্দময়ী

২০০৮ সালের এপ্রিল মাসের কথাফেসবুকের ইন বক্সে একটা মেসেজ আর একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেলামআমি অমুক, একসাথে স্কুলে পড়তাম, চিনতে পারছো?” চিনতে না পারার কোন কারন নেইনাম চেহারা সবই মনে আছেদ্রুত এ্যাক্সেপ্ট করে নিলামভার্সিটির ল্যাবে বসে এই অকস্যা বন্ধু আবিষ্কারের ঘোরে আমি চেঁচিয়ে উঠেছিলাম ও, গড বলেআশেপাশের সিরিয়াস ছাত্রছাত্রীরা তাকাতেই আমি কেটে পড়লামএভাবেই সুদীর্ঘ ২৩ বছর পর ফেসবুকের সুবাদে ফিরে পেলাম এক বন্ধুকেপ্রথম থেকেই ফেসবুক নিয়ে আমার মাতামাতি না থাকলেও সেদিন থেকে আমি কিছুটা উচ্ছসিতআর এভাবেই ধীরে ধীরে এই সাইটটি জীবনের এক অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে গেলোতবে ফেসবুক যে একটা গোটা উপন্যাসের প্লট হতে পারে সেটা ধারনা করিনিনামটা দেখেই সন্দেহ জাগেফ্ল্যাপ পড়ে তাই মাহবুব মোর্শেদেরফেস বাই ফেসনিয়ে আর চুপ করে থাকা গেলো নাপড়লাম ফেস বাই ফেস পেইজ বাই পেইজ

গল্পটা শুভকে নিয়েঐ যে শুভ, যে একটা নামকরা বায়িং হাউসে মার্চেন্ডাইজিংয়ের কাজ করেফরেন বায়ারদের সাথে যোগাযোগ রাখতে গিয়ে যাকে সাপ্তাহিক কাজের দিনগুলোতে প্রায় সর্বক্ষন অনলাইনে থাকতে হয়আর একারনেই সে ফেসবুকে পরিচিত মুখপরিচিত পুরনো বন্ধু, চেনা, অচেনা মানুষের সাথে একটা ভার্চুয়াল সম্পর্কে আবদ্ধ শুভর দিন কাটে এভাবেইকিন্তু শুভ কোন ভার্চুয়াল ক্যারেক্টার নয়রাগ দুঃখ আনন্দময় শুভর বাস্তব জীবনে ঘুরে ঘুরে আসে যে নামটি সেটা হলো তিন্নিভার্সিটি জীবনের বন্ধু তিন্নিকে শুভ ভালবাসে, ঠিক কবে কখন থেকে তা জানা নেইএকদিকে তিন্নির ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান; অন্যদিকে তিন্নির কলিগ অন্য ধর্মের সুপর্নার সাথে কিছুটা অপরিনামদর্শী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া; আর তা নিয়ে তিন্নি-শুভ-সুপর্নার সম্পর্কের টানাপোড়েন এই নিয়ে আবর্তিত উপন্যাসের কাহিনীএ পর্যন্ত বেশ সাদামাটাই মনে হয় গল্পটিকে কিন্তু বাস্তব জীবনের ঘাত প্রতিঘাত আর সমস্যার সমাধানে যখন শুভ হাত বাড়ায় ভার্চুয়াল বন্ধুদের কাছে তখনই চমকের সূচনা হয়

নিউইয়র্ক প্রবাসী নাজিয়া শুভর কাছে কোন সমস্যার সমাধান চায় না এক্সট্রা-ম্যারিটাল রিলেশনে আবদ্ধ স্বামী নাফিসের সাথে জীবন যাপন করা নাজিয়ার মত আত্মপ্রত্যয়ী মেয়ের পক্ষে সহজ নয়তবু চেষ্টা করে নাজিয়া, একসময় ঘুনে ধরা সম্পর্কের ইতি টানেকেটে ফেলা সম্পর্কের সূতো হয়ত জোড়া লাগে না কিন্তু তার অন্তহীন বেদনা ইথারে ভেসে স্পর্শ করে শুভকে পাঠককেএকরাতে নাজিয়ার স্টে উইথ মিতে সাড়া দিয়ে বন্ধু হয় দুজনেএই দুজন মানুষের মধ্যে এক কাপ ভার্চুয়াল কফি বিনিময়ের মাধ্যমে মানব সম্পর্কের যে দিকটি উম্মোচিত হয় তাকে কিন্তু কিছুতেই ভার্চুয়াল বলে উপেক্ষা করা যায় নাআর এই বিষয়টি নানাভাবে উঠে এসেছে উপন্যাসেযেমন, গল্পে নওরোজ ভাই আর রওনক ভাবীর সাথে শুভর ফেসবুকের পরিচয় একসময় বাস্তব-ভার্চুয়াল সীমারেখার বাইরে চলে গেছে রওনক ভাবীর মত আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের প্রতি মোহ শুভকে বাস্তবেই অনেক দূর টেনে নিয়ে গেছেপাহাড়ের মাথায় বকপুকুরের খোজে গিয়ে শেষ পর্যন্ত শুভর আকাঙ্খার কাছে রওনকের সমর্পন সে ইঙ্গিতই দেয়এই সবের পাশাপাশি জীবনের বহুমাত্রাকে প্রমান করতেই যেন তিন্নিকে লুকিয়ে সুপর্নার সাথে শুভর প্রেম চলতে থাকেকিন্তু শেষ রক্ষা হয় নাসুপর্নার বাবার কাছে সবকিছু বলে দেয় তিন্নিবাবাকে কষ্ট দিতে চায় না বলে শুভকে ভালবেসেও অন্য যায়গায় বিয়েতে মত দেয় সুপর্নাআর তিন্নির মধ্যে কাজ করে অপরাধবোধএবার আর তিন্নিকে ক্ষমা করে না শুভনিজের কর্তব্য স্থির করতে না পেরে ভার্চুয়াল বন্ধু সাবিনা মেহনাজ সুপ্তির পরামর্শ চায়, কথা বলে ফয়সাল ভাইয়ের সাথে ফয়সাল ভাই সোজা কথার মানুষতার পরামর্শ তিন্নিকে সরাসরি প্রপোজ অথবা সম্পর্কটাই শেষ করে দেয়া উচিত শুভরঅন্য দিকে সুপ্তি কথা বলে গভীর জীবনবোধ থেকেতার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিন্নির প্রতি শুভর আকর্ষনএমনকি সুপর্নার এপিসোডেও ডিসাইডিং ফ্যাক্টর হয়ে উঠে তিন্নি তাই সবকিছু মিলে তিন্নির কাছে ফিরে যাওয়া যেন শুভর নিয়তি

এই উপন্যাসের ছোট একটি চমকপ্রদ ঘটনা হল জীবন সাহা আর মাধবীর ভার্চুয়াল বিয়েফেসবুকে জীবনের সাথে পরিচয় হয় প্রবাসী মাধবীরচারদেয়ালে বন্দী মাধবী হাটতে পারে না, জানে না তার পারিপার্শ্বজীবন তাকে শেখায় প্রেম, সম্পর্ক জীবনকেই প্রথম পুরুষ হিসেবে পাওয়া মাধবী একসময় বিয়ে করতে চায় জীবনকেসে এক আশ্চর্য বিয়েফেসবুকে স্ট্যাটাস বদলে ভার্চুয়াল বিয়েতে হাসিকান্না হয় ফেসবুকের ওয়ালেজীবন স্বপ্ন দেখে একদিন সে সত্যিই বিয়ে করবে মাধবীকেসেটা সত্যি হয়েছিল কিনা সে কথা লেখক কোথাও আর বলেননি কিন্তু জীবন-মাধবীর অনুভূতির ভার্চুয়াল বিনিময়কে অবাস্তব মনে হলেও মিথ্যে মনে হয় নি একটুওবরং মনে হয়েছে এই রূপকথাটা যদি সত্যি হত!

উপন্যাসের শেষদিকে সুপর্নার বিয়ে হয়বিয়ের দিন তিন্নি আসে শুভর কাছে ব্যাঙ্গ করতে নয়, আজ যেন তিন্নি খুব নরম আর নাজুকযে কোন গল্প পড়ার সময় লেখকের লেখার সাথে পাঠকের কল্পনাও গতিময় হয়বলা হয়ে থাকে লেখকের কলম যদি পাঠকের কল্পনাকে ছাপিয়ে যায় তবেই কাহিনী চমকপ্রদ আর স্বার্থককিন্তু শুভর অফিসে সেদিন তিন্নির আগমনে গল্পে যে টুইস্টের সূচনা হয়েছে তার জন্য বোধ হয় কোন পাঠকই প্রস্তুত ছিলেননাসুপর্নার সাথে তিন্নির প্রেম তথা সমকামী সম্পর্কে আমারও কেবলই মনে হচ্ছিল - এটা কি হল! কিন্তু উপন্যাস যে কেবল পাঠকের বিনোদন নয়, বরং জীবনের অনেক অপ্রীতিকর সত্য অধ্যায়ের উপাখ্যানও সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে এখানেতবে এই গল্পের সবচাইতে বড় চমকের কথা বললে আমি অন্য একটা অংশের কথা বলবসাধারন ধারনা মতে তিন্নি-সুপর্নার সম্পর্কটি প্রকাশের পর তিন্নির প্রতি শুভর ভালবাসা শেষ হয়ে যাবারই কথা ছিলকিন্তু সবকিছু জানার পরও বাস্তবে তিন্নিকে পাবার ব্যাকুলতা শুভর বেড়েছে বৈ কমেনি শুভর চিন্তায় – “শুক্রবার আসার আগে শেষ তিনদিন যেতে তিনশ দিন সময় লাগে শুভর চরিত্রের এই বৈপরিত্যই তাকে সত্যের কাছাকাছি নিয়ে গেছেহয়তো এটাই লেখকের সেরা সাফল্যশেষ পর্যন্ত এই উপন্যাসে কাঙ্খিত পরিনতিও এসেছে, তবে অপরিচিত পথে, গল্পের আকর্ষন বজায় রেখে

গল্পের চরিত্রগুলোর কথা বললে আগে বলতে হয় সুপর্নার কথাস্মৃতি কাতর সুপর্নার সুন্দর শৈশবের সাথে পরিনত সুপর্নাকে মেলানো কঠিনসুপর্নার চরিত্রের প্রতি লেখকের যত পক্ষপাতই থাকুক না কেন, একই সাথে শুভ এবং তিন্নি দুজনের সাথে জড়িয়ে পড়ার কারনে সুপর্নার চরিত্রটিকে অনৈতিক বলে মনে হয়অথচ আমাদের চেতনার আলোকে সাধারন দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক সম্পর্কে আবদ্ধ তিন্নিকে কখনো হীন মনে হয় নাসুপর্নার সাথে সম্পর্কের কারনে শুভ কিংবা অন্য পুরুষকে অগ্রাহ্য করা আর শেষতক শুভর কাছে স্বীকারোক্তির কারনে তিন্নির প্রতিই পাঠকের সহানুভুতি ধাবিত হয়েছেতিন্নিকে ভালবেসে কিংবা ক্ষমা করে শুভও এক অর্থে মহান হতে পেরেছেকিন্তু রওনকের সাথে এক দুপুরের ঘনিষ্টতা শুভর চরিত্রটিকে যে কালিমা দিয়েছে তা শেষতক পাঠকের মাথায় রয়ে যাবে বলে মনে হয়

ছোট হলেও জীবন সাহা, মুন্না, সুপ্তি, রীনার চরিত্রগুলো ভাল লাগে; একটা বাস্তব অবয়ব তৈরী করেকিন্তু এই গল্পে সবচাইতে দূর্দশাগ্রস্থ চরিত্র হলো নাজিয়াচমকপ্রদ এবং বলিষ্ট এই চরিত্রের প্রতি কোন এক দূর্বোধ্য কারনে লেখক মাঝ পথে আগ্রহ হারিয়েছেনতাই নাজিয়ার চরিত্রও খেই হারিয়ে ঘুরতে থাকে, পাঠকও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়সব দিক বিচারে গল্পের সবচাইতে আকর্ষনীয় চরিত্র তিন্নিই; যাকে ঘুরে ফিরে সবকিছুর পরও ক্ষমা করতে, ভালবাসতে ইচ্ছে করে

বাস্তবে মানুষ দোষে-গুনে সৃষ্টি হলেও উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে আমরা নিখুত দেখতেই অভ্যস্তকিন্তু দোষে গুনে সৃষ্ট মানুষই যে সত্য মানুষ এই গল্পটা যেন সেই কথাই বলেগতানুগতিক প্রেম ভালবাসা কিংবা দাম্পত্যের বাইরে উপন্যাসটিতে আধুনিক নগর জীবনের অনুসঙ্গগুলো উঠে এসেছে পরতে পরতে; গতি পেয়ে সেটা ছড়িয়ে গেছে দেশের সীমা ছেড়ে দেশান্তরেমানুষের জীবনের গল্পগুলো যে জাতিভেদে আদতে একই ভাবে শেষ হয় তাকেও যেন টেনেছেন লেখক তবে শুরু থেকে মাঝ পর্যন্ত উপন্যাসের ব্যাপ্তি পরিনতির চাইতে অনেক ব্যপক ছিলযেন লেখকের আরো কিছু বলার ছিলসব মিলে মন্দ নয়, ভালই লেগেছে উপন্যাসটিলেখকের বর্ননার নিজস্বতা ছিল আকর্ষনীয়নতুনের আস্বাদ এবং সেই সাথে নতুন ধারার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফেস বাই ফেসরুচিশীল পাঠকের তৃষ্ণা মেটাবে হয়তো

http://prothom-aloblog.com/users/base/anandomoye/180

..........................................................................................................

মাহবুব মোর্শেদ ইনকামিং - হুমায়ুন আহমেদ আউটগোয়িং

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:২১

কৌশিক

আপনি কি জানেন সাভারের পাশে একটা পাহাড় আছেজঙ্গল ঘেরা সেই পাহাড়ের ভেতর একটা সরোবর আছেচারদিকে বাঁশঝাড় ঘেরা সেই সরোবরের চারদিকে হাজার হাজার বকপাখি উড়ে বেড়ায় কি ভয়ানক ব্যাপার! আগে শুনিনি কেন? সাভার বাসস্ট্যান্ড থিকা রিকশা কইরা রাজাশন যাইতে হয়রাজাশন থিকা নাইমা দশ কিলো পথ হাঁটতে হয়দেন, একটা ঘন জঙ্গল পড়ে, সেই জঙ্গলের মধ্যে পাহাড় এখনও উপরে ওঠার সিঁড়ি বলতে কিছু তৈরী হয় নাইতবে পাহাড়ে উঠতে পারলে নাকি বিশাল বিষ্ময়পাহাড়ের চুড়ার ঠিক মাঝখানে একটা লেকঢাকার এত কাছে পাহাড়ের মাথায় একটা বড় লেকচারদিকে বাঁশঝাড়ে হাজার হাজার বকপাখিহাজার হাজার সাদা বকপাখিআমি ভাবতেছি একদিন সাভার যাবট্রেকিংয়ে

ফেস বাই ফেস উপন্যাসে এমন একটা জায়গার কথা শুনে পুরোপুরি বিশ্বাস করে ফেললামগভীর রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সেখানে হাজিরও হলামরওনক এর বদলে......অন্য কেউ সঙ্গে.....এবং তারপর দিনেও মোটামুটি পূর্ব-প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম, এই ভ্যালেন্টাইনে কোনো রওনকের সাথে...মোটামুটি এমনই চলছিলো সন্ধ্যা অবধিবিশেষত উপন্যাসের লেখক মাহবুব মোর্শেদের সাথে দেখা হবার আগে পর্যন্ততারপরে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, সাভারের পাশে যে পাহাড়ের কথা লিখেছেন, সেটা সত্য তো?

শাংরিলা আচ্ছন্ন একটা প্রজাতি আছে রাজপুত্র গৌতমের অনুসারীদের মধ্যে চিরশান্তির এমন এক দেশের চিত্র - যা ইউরোপে ইউটোপিয়া নামে সমাধিক পরিচিত সম্পর্ককরণ ও গড়নের মধ্যে যোগাযোগ দ্রুতলয়ে হচ্ছে বলে আমাদের শাংরিলা এখন আরাধ্য হয়ে পড়েছে ফেসবুকেমাহবুব মোর্শেদের লেখার উপরে আমার আস্থা আছে গদ্য পড়তে ভালো লাগেমাহবুব মোর্শেদ কবি বলেই হয়তো তার গদ্যের মধ্যে গল্পচিত্র অনেক রূপকীয়

ফেস বাই ফেস পড়তে শুরু করে এক প্রেমিক শুভ ও দুই প্রেমিকা তিন্নি ও সুপর্নার ট্রাঙ্গুলারাইজেশনের মুখোমুখি হলাম - যেটা তাড়িয়ে নিয়ে গেলো শেষ পরিনতি দেখতেএকটা সময় নিশ্চিত হলাম সুপর্না আউট হয়ে গেলো ফোকাস থেকে, তিন্নি-ই বরণ করে নিচ্ছে শুভর দীর্ঘ সময় যাবত ঝুলে থাকা প্রণয় নিবেদন কিন্তু সকল হিসেব নিকেষ উল্টো করে দিয়ে টানটান উত্তেজনায় গল্প এগুলো তিন্নি ও সুপর্না ভেতরে ভেতরে চিরায়ত যৌনতার অরিয়েন্টেশনে আবদ্ধ - একটা দুর্দান্ত চমকই বটে

আবারও মনে করিয়ে দেই বইটির নাম ফেসবুক, উফ, ফেস বাই ফেস এবং উপন্যাসের সকল চরিত্র ফেসবুক সম্পর্কের আবাহনে সিক্ত, কেবলমাত্র ট্রাংগুলাভার ছাড়াশুভ কেবল চমকার স্টাটাস লিখে ভক্ত জুটিয়ে ফেলেছেফেসবুকের স্ট্রেন্জার নাজিয়ার সাথে নৈর্ব্যাক্তিক সঙ্গপ্রদান, মধ্যবয়স্ক নওরোজের ফেসবুক কেন্দ্রিক জীবনের পুনরুত্থিত স্বাদ প্রাপ্তি, সাধারণ গৃহিনী সাবিনা মেহনাজ সুপ্তির মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ, সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ মুন্নার ফেসবুকে উত্তেজক ছবি ও গল্পের অন্বেষণ, সাহসী রিনা কাউসারীর নারীত্ব বিষয়ক সন্দেহ, কানাডার নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা শেরীর ফেসবুক নির্ভরতা যার সন্তানরা বাস করে হাজার হাজার মাইল দূরে, কৈশোরে ক্ষণিক পরিচিতা তমাকে ফেসবুকে আবিষ্কার, টিভির ব্রেকিং নিউজ-খবরের টিকআর প্রস্তুতকারী জীবন সাহার ফেসবুক স্টাটাস চেঞ্জ করে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবন্ধী মাধবীর সাথে বিয়ে - এসব এখন জীবনের রিয়েলিটি যুক্তকরণের হাতিয়ারসম্পর্কনাস্ত্রউপন্যাসের প্রতিটা চাপ্টারে এসকল মানুষের প্রযুক্তি-নির্ভরতা আর একাকীত্বের মলিন চিত্র এত বর্ণিল বর্ণনায় উঠে এসেছে যে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম বহুকাল এক বসায় (শোয়ায়) একটা আস্ত উপন্যাস পড়িনি

কল্পনার উড়াল দিয়ে সুপর্নাকে নিয়ে শুভ জয়পুরে রুক্ষ্ম মরুভূমির বুকে প্রাচীন শহর দেখতে যায়ভার্চুয়াল এই ট্যুরের বৃত্তান্ত ফেসবুকের অবশ্যম্ভাবী গনিত, কিন্তু মাহবুব মোর্শেদ পুরো উপন্যাসে এমন অজস্র কল্পনার উড়ালে বিষ্ময়করভাবে আপনাকে সংগী করে নেবেযেমন সাভারের পাশে এক বকপুকুরের পাহাড়ে

সভারের পাশে আদৌ কোনো পাহাড় আছে কিনা প্রবল আগ্রহে যখন মাহবুব মোর্শেদকে জিজ্ঞেস করলাম - সে আমার এডভেঞ্চারের সাধটাকে পুরো নস্যাত করে পুরোটাই তার নির্মিত জানালোউপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে পাঠককে এভাবে নিবিষ্ট করার ক্ষমতা সমসমায়িক লেখকদের মধ্যে একমাত্র হুমায়ুন আহমেদেরই আছে বলে যাদের বিশ্বাস - সম্ভবত তারা এবার তার যোগ্য উত্তরসূরী পেয়ে গেছেন

বিঃদ্রঃ যারা হুমায়ুন-যুগের সমাপ্তি চান, অনুগ্রহ করে মাইনাস প্রদান করে সমর্থন জানাবার নির্দেশ জারি করা হলো

সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৪৪

http://www.somewhereinblog.net/blog/kowshikblog/29094014

......................................................................................................

মাহবুব মোর্শেদের ফেস বাই ফেস-নাগরিক বোলচাল

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৪৮

সালাহ্ উদ্দিন শুভ্র

মাহবুব মোর্শেদের ব্যক্তিগত বসন্তদিনের গল্প বনসাই শিল্পসেই গল্পেরও শুরু রবিবারেগল্পের স্থান কোন এক মফস্বল শহরআর ফেস বাই ফেস উপন্যাসের ঘটনাবলি সংঘটনের স্থান ঢাকা শহরকোন এক রবিবারে শুভ, যিনি গল্পের নায়ক চরিত্র, তার মোবাইলে পুরোনো বন্ধু মারুফের ফোন আসে তিনবারমারুফ থাকে মফস্বলে, শুভ ঢাকায়মারুফ আর শুভ একই বয়েসি হলেও আলাদা সময়ে বাস করে ব্যক্তিগত বসন্ত দিন আর ফেস বাই ফেস একই লেখকের কিন্তু পরিষ্কারভাবে আলাদা সময়ের-আঙ্গিকেরফেস বাই ফেসের পাঠক মারুফের ফোনের সূত্র ধরে ফেসবুকে প্রবেশ করেআর ফেসবুক নিয়েই বাংলা ভাষার প্রথম কোন উপন্যাস লিখেছেন মাহবুব মোর্শেদপুরো উপন্যাসের আদলটাই ফেসবুকের মতমুখের পর মুখ-একের পর এক চরিত্র, ঘটনানতুন কোন চরিত্র আসে আর তার প্রোফাইল বর্ণনা করে যান লেখক কোন চরিত্রই অবহেলিত নয়, অসম্পূর্ণ নয়সবাই নাগরিক এমনকি ইউএসএ-তে থাকে যে নজিয়া সেও নাগরিকনাজিয়ার বন্ধু শেরির আন্তর্জালিক বন্ধু বৃদ্ধা মারিয়াও আসলে আমাদের ঢাকা শহরেরই কোন এক নিঃসঙ্গ নারীসব মিলিয়ে ফেস বাই ফেস একটি নাগরিক উপন্যাস

শুভ তার বন্ধু মারুফের ফোন ধরতে পারে না কারণ অফিস ধরবার তাড়া-গাড়ি-জ্যাম এইসবএকটা বায়িং হাউজে কাজ করার সুবাদে তাকে সারাদিন অনলাইনেই থাকতে হয় আর অনলাইন মানেই ফেসবুকমারুফ তার অন্যান্য বন্ধুদের খবর জানতে চায় শুভর কাছেতখনই শুভ ফেসবুকের প্রসঙ্গ আনেআর এই ফেসবুকের চরিত্ররাই বিচরণ করে বেড়ায় উপন্যাসময়ঠিক অপর জগত নয় বাস্তব জগতেরই প্রতিরূপ, মানবিক সম্পর্কের নতুন প্ল্যাটফর্ম, যোগাযোগের মাধ্যমঢাকা শহরের অসহায়ত্বই হয়তো এই ফেসবুককিন্তু এরও শেষ আছেলেখক নিজেই বলেছেন, যন্ত্র মানবিক সৃষ্টিশীলতাকে আতিক্রম করতে পারে নাএক সময়ে মাইস্পেস, হাই ফাইভের যুগ ছিলএখন ফেসবুকএরপর হয়তো ফেসবুকও থাকবে নামানুষই নতুন করে আবার কোন নাগরিক যোগাযোগের উপায় খুঁজে বের করবেএবং মাহবুব মোর্শেদের গুণে ফেসবুকও মানবিক হয়ে ওঠেঅসংখ্য চরিত্র আসে সেখানে-শুভর সাথে তাদের আলাপ হয়, দেখা হয়আবেগের সম্পর্ক তৈরি হয়ফেস বাই ফেসের অন্যতম সফলতা হচ্ছে উপন্যাসটি জীবন বিচ্ছিন্ন থাকেনিশুভ মধ্যবিত্ত এবং শুভ পুরুষশুভ একইসাথে ভালো এবং প্রতারকশুভ ভিতু এবং বোকাআবার কাম কিংবা অন্য কোন প্রয়োজনে সে সাহসী আর লোভীশুভ প্রেমিক এবং কামুকতার চারপাশের অসংখ্য নারীদের নানা বৈচিত্রে সে অবাক হয়অসহায় বোধ করেতিন্নি তার অনেকদিনের বন্ধু কিন্তু তিন্নিকে সে বুঝতে পারে নালেখকও পাঠকের সামনে তিন্নিকে ব্যাখ্যা করেন না শুভকে কেন্দ্র করে পাঠক আবর্তিত হয়, চরিত্র থেকে চরিত্রে ঘুরে বেড়ায় তাদের পরিচয় হয় নওরোজ ভাই আর রওনক ভাবীর সাথেসাবিনা মেহনাজ সুপ্তির সাথে শাং-রি-লা বিষয়ে রওনক ভাবীর আগ্রহ পাঠকের মনেও ভর করেরওনক ভাবী খাপখোলা তলোয়ার- সময়ের জং তার গায়ে লাগে নাতার স্বামী নওরোজ এখানে সেখানে অনেক নারীর সাথে ঘুরে বেড়ানস্বামীকে উসাহ দিয়ে যান রওনককিন্তু তার ভেতরেও যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, অবদমন ছিলশুভর সাথে বক পাহাড়ে ঘুরতে যাবার ঘটনায় তা উন্মোচিত হয়সাবিনা মেহনাজ সুপ্তির সন্তান নাই-গাছপালা পালেন তিনি জীবন সাহার অষ্ট্রেলিয়ান বান্ধবী মাধবী, সে পঙ্গু, ভাইয়ের সাথে থাকে অষ্ট্রেলিয়াতেজীবনের সাথে তার ফেসবুকে যোগাযোগ হয়একটা সম্পর্ক কতোটা মানবিক হতে পারে এই ঘটনা তার প্রমাণতাদের মিছামিছি বিয়ে হয়হুইল চেয়ারে বসে থাকা মাধবীর করুণ আকুতি- ‌''তুমি হাঁটু গেড়ে বসে আছো সামনেআমাকে ধরে আছোআমার জন্য কি তোমার ভালোবাসা জাগছে? নাকি খুব করুণা হচ্ছে? আমাকে কি অর্ধেক মানুষ বলে মনে হচ্ছে? তুমি আমার পাতুমি আমাকে তোমার পা দিয়ে বিশ্ব ঘোরাও''এই অনন্য সম্পর্কটুকু নির্মাণের জন্য লেখককে ধন্যবাদ

এই বক পাহাড় আসলে বানানোসাভারের রাজাসনে এমন কোন জায়গা নেইতাহলে কেন লেখক এমন একটা বক পাহাড় পাঠকের সামনে হাজির করেনএই ঘটনা আরো একবার দেখি আমরাশুভর খন্ডকালীন প্রেমিকা সুপর্ণার সাথে কল্পনায় উটের কাফেলায় সওয়ার হয়ে পিংক সিটিতে যায় তাদের অভিসারের বর্ণনাকে মিথ্যা মনে হয় নাএটা লেখকের সফলতামরুভূমির বর্ণনা এবং চন্দ্রমুখী সেই অভিযানে বিহ্বলতা আছে, ঘোর আছেএই ঘোর থেকেই হয়তো বক পাহাড়ের জন্ম হয়শাং-রি-লা এমন এক জায়গা যেখানে চীরযৌবন পাওয়া যায়কিন্তু অনেক খুঁজেও কয়েকটা হোটেল ছাড়া সারা দুনিয়ায় এমন কোন জায়গা খুঁজে যাওয়া যায় নাচীরযৌবন আর মোক্ষ লাভের তাড়নাতেই হয়তো বক পাহাড়ের আবির্ভাবরওনকও তাই বলে, এটাই তাদের শাং-রি-লা শুভ নিজেও জানতো না এমন কোন জায়গা রাজাসনে আছে কি নাতার আরেক ফেসবুক ফ্রেন্ড নোমান তাকে জানায় এমন একটা স্থানের কথাশুভ বিশ্বাস করেশুভ এমন অনেক কিছুই বিশ্বাস করেআবার অবিশ্বাসের দোলাচালে দোলেএটাই মধ্যবিত্তের চরিত্রভালোভাবেই মধ্যবিত্তকে পাওয়া যায় ফেস বাই ফেস উপন্যাসে শাং-রি-লা আসলে মধ্যবিত্তের অপ্রাপ্তি, দিবাস্বপ্ন

মধ্যবিত্তের জীবন ক্রমশ মুক্তি চায়কিন্তু তার মুক্তির পথ বিদ্রোহের নয়, আপোষেরসাবিনা মেহনাজ সুপ্তি শুভকে সেই পথই বাতলে দেন, মোক্ষ লাভের কথা বলেন- '' কিন্তু মোক্ষ সম্ভবডোন্ট ট্রাই টু গেট আউট, স্টে হিয়ারএ জীবন কি সুন্দর নয়? রাস্তার ভিড়, জ্যাম, জীবন যাপনের জন্য মানুষের পরিশ্রম, তার ঘর্মাক্ত মুখ কি সুন্দর নয়? এসবই তো টিকিয়ে রাখছে পৃথিবীকেশত শত মানুষের বাঁচাকে সম্ভব করে তুলেছে এই রুটিনই তোআপনি এর থেকে মুক্তি নিয়ে কোথায় যাবেন? সেটা কি সম্ভব? আপনি বরং মোক্ষ খোঁজেন'' শুভ সেই মোক্ষই খুঁজে বেড়ায়পারে নাকখনো তিন্নি কখনো সুপর্ণা, নাজিয়া, রূপা, রওনক তাকে আঁকড়ে ধরেমোক্ষ লাভের আশায় বক পাহাড়ে গিয়ে পুরুষ বের হয়ে আসে শুভর ভেতর থেকে মোক্ষ লাভের কথা আর মনে হয় নাতার পৌরুষ রওনকের সরলতায় বিভ্রান্ত হয়রিনা কাওসারিও মধ্যবিত্ত শুভর পৌরুষকে নগ্ন করে দেনরিনার কাছে তার পিরিয়ডের বর্ণনা শুনেও বিভ্রান্ত হয় শুভফেসবুকের আড়ালে সে নারী না পুরুষ তা বুঝতে পারে নাতার বোধদয় ঘটে- ''পিরিয়ডের সময় ছেলেরা নাকি অদ্ভূত এক নীরবতা আর শত প্রশ্ন নিয়ে সঙ্গীনীকে পর্যবেক্ষণ করেকিন্তু কখনো জানতে চায় না, মেয়টির কেমন লাগেকেন তার শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে যেতে থাকে''

এমনিভাবে একের পর এক চরিত্র আসেযারা আসলে এই সমাজেরই নাগরিক মানুষযেমন মুন্না, শুভ ভাইকে যে ভালা পায়জীবন, যে শুভকে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেয়হস্তবিশারদ ফয়সাল ভাইনাজিয়ার সূত্র ধরে শেরি, বৃদ্ধা মারিয়াএমন অনেক চরিত্র ফেসবুকের মতোই উপন্যাসময় ঘোরাফেরা করেতাদের সাথে পরিচয় ঘটে শুভরশুভর স্বগতোক্তি- '' একেকটা মানুষ যেন একেকটা জনপদকত ঘটনা যে তাকে কেন্দ্র করে ঘটেএককথায় বোঝার উপায় নেইপরিচয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ একেকটা ইতিহাস বলতে থাকে'' শুভ এমন অনেক ইতিহাসের মুখোমুখি হয়আর যে ইতিহাসের প্রতি তার প্রধাণ ঝোঁক এবং যে ইতিহাস রহস্যময়ী, যাকে বুঝতে, যার সন্ধাণে সে এর কাছে তার কাছে ধরণা দিয়েছে- সে হল তিন্নিতাদের মধ্যকার অনেকদিনের বন্ধুত্ব এখন একটা পরিণতি চায়, তা আসলে আরো ঘনিষ্ট এবং স্থায়ী হতে চায়শুভ প্রেম করতে চায় তিন্নির সাথেকিন্তু তিন্নিকে সে বুঝতে পারে না সুপর্ণার সাথে শুভর সাময়িক প্রেমের ইতি ঘটে তিন্নির কারণেইসুপর্ণার বেদনা, শুভর অসহায়ত্ব সমস্তই মার খায় তিন্নির কাছেতিন্নিকে শত চেষ্টাতেও উপেক্ষা করতে পারে না শুভসুপর্ণার প্রতি সাময়িক প্রেমের সম্পর্কও আসলে তিন্নিকে না পাওয়ার শুণ্যস্থান পূরণের চেষ্টাসুপ্তির এই ব্যাখ্যাও শুভ বিশ্বাস করে কিন্তু তিন্নিকে তার পাওয়া হয় নাএড়াতেও পারে না তাকেএই যে ঝুলে থাকার জীবন মধ্যবিত্তের, তিন্নির ঘটনা শুভকে কেবলই হাস্যকর করে তোলেসুপর্ণার সাথে মিথ্যা শারীরিক সম্পর্কের কথা বলে শুভকে পরীক্ষা করে তিন্নিপ্রথমে ভয় পায় শুভকিন্তু সে উপায়হীনতিন্নিতে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা যেনএমন অনেক মিথ্যা বয়ানকে বিশ্বাস করেও সে তিন্নির কাছেই ফিরে যায়তিন্নিকে সে শরীরেও চায়তিন্নির শরীর নিয়েও তার কামনা জাগে বারবার একদিন ঘন ঘোর লাগা জ্বর আসে তার যখন পাশে আসে তিন্নিমধ্যবিত্ত আসলে তার প্রাপ্তিকেও মেনে নিতে পারে না

কোন নিম্নবিত্ত চরিত্র নেই এই উপন্যাসেআরো হয়তো সমালোচনা করা যেত সময় সুযোগ থাকলেতেমনি সময়ের অভাবে ফেস বাই ফেস উপন্যাসের ভাষা নিয়ে আলাদা প্রসংশাটুকুও করা যাচ্ছে নানাগরিক মেজাজ ধরে রাখার কাজটা ভালোই হয়েছে আরো অনেক বিষয় বলা হল নাসব মিলিয়ে ফেস বাই ফেস জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস সফলতা ব্যর্থতা এখনি বা হয়তো কখনোই বিবেচ্য নয়তবে সুখপাঠ্য আর ঝরঝরে একটা গতিশীল লেখা পড়তে পাঠকের ভালোই লাগবেশহুরে মাঘ পেরিয়েও শীত না আসুক, বন্ধু আসেমোক্ষ লাভের আলাপ আসে, শাং-রি-লার ডাক আসেএই উপন্যাসে ঘাম আছে, সেন্ডোগেঞ্জি আছেএমন অনেক কিছু নিয়েই তৈরি ফেস বাই ফেস, মাহবুব মোর্শেদের নতুন ধারার লিখাতার কবিভাবও জিইয়ে রেখেছনে তিনিএই উপন্যাসের একটা অন্যরকম স্বাদ আছে- গরম চায়ে পরোটা ভিজিয়ে খাবার স্বাদটা যেমন হয় গদ্য এবং কাব্যের মিশেলে ফেস বাই ফেস পাঠকের নিশ্চয়ই পছন্দ হবে

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১১:৪৮

http://www.somewhereinblog.net/blog/shuvroju/29098365

...................................................................................................

ফেস বাই ফেস- গরম চায়ে পরোটা খাওয়ার স্বাদ

by Salah Uddin Shuvro on Tuesday, February 16, 2010 at 12:13am

মাহবুব মোর্শেদের ব্যক্তিগত বসন্তদিনের গল্প বনসাই শিল্পসেই গল্পেরও শুরু রবিবারেগল্পের স্থান কোন এক মফস্বল শহরআর ফেস বাই ফেস উপন্যাসের ঘটনাবলি সংঘটনের স্থান ঢাকা শহরকোন এক রবিবারে শুভ, যিনি গল্পের নায়ক চরিত্র, তার মোবাইলে পুরোনো বন্ধু মারুফের ফোন আসে তিনবারমারুফ থাকে মফস্বলে, শুভ ঢাকায়মারুফ আর শুভ একই বয়েসি হলেও আলাদা সময়ে বাস করে ব্যক্তিগত বসন্ত দিন আর ফেস বাই ফেস একই লেখকের কিন্তু পরিষ্কারভাবে আলাদা সময়ের-আঙ্গিকেরফেস বাই ফেসের পাঠক মারুফের ফোনের সূত্র ধরে ফেসবুকে প্রবেশ করেআর ফেসবুক নিয়েই বাংলা ভাষার প্রথম কোন উপন্যাস লিখেছেন মাহবুব মোর্শেদপুরো উপন্যাসের আদলটাই ফেসবুকের মতমুখের পর মুখ-একের পর এক চরিত্র, ঘটনানতুন কোন চরিত্র আসে আর তার প্রোফাইল বর্ণনা করে যান লেখক কোন চরিত্রই অবহেলিত নয়, অসম্পূর্ণ নয়সবাই নাগরিক এমনকি ইউএসএ-তে থাকে যে নজিয়া সেও নাগরিকনাজিয়ার বন্ধু শেরির আন্তর্জালিক বন্ধু বৃদ্ধা মারিয়াও আসলে আমাদের ঢাকা শহরেরই কোন এক নিঃসঙ্গ নারীসব মিলিয়ে ফেস বাই ফেস একটি নাগরিক উপন্যাস

শুভ তার বন্ধু মারুফের ফোন ধরতে পারে না কারণ অফিস ধরবার তাড়া-গাড়ি-জ্যাম এইসবএকটা বায়িং হাউজে কাজ করার সুবাদে তাকে সারাদিন অনলাইনেই থাকতে হয় আর অনলাইন মানেই ফেসবুকমারুফ তার অন্যান্য বন্ধুদের খবর জানতে চায় শুভর কাছেতখনই শুভ ফেসবুকের প্রসঙ্গ আনেআর এই ফেসবুকের চরিত্ররাই বিচরণ করে বেড়ায় উপন্যাসময়ঠিক অপর জগত নয় বাস্তব জগতেরই প্রতিরূপ, মানবিক সম্পর্কের নতুন প্ল্যাটফর্ম, যোগাযোগের মাধ্যমঢাকা শহরের অসহায়ত্বই হয়তো এই ফেসবুককিন্তু এরও শেষ আছেলেখক নিজেই বলেছেন, যন্ত্র মানবিক সৃষ্টিশীলতাকে আতিক্রম করতে পারে নাএক সময়ে মাইস্পেস, হাই ফাইভের যুগ ছিলএখন ফেসবুকএরপর হয়তো ফেসবুকও থাকবে নামানুষই নতুন করে আবার কোন নাগরিক যোগাযোগের উপায় খুঁজে বের করবেএবং মাহবুব মোর্শেদের গুণে ফেসবুকও মানবিক হয়ে ওঠেঅসংখ্য চরিত্র আসে সেখানে-শুভর সাথে তাদের আলাপ হয়, দেখা হয়আবেগের সম্পর্ক তৈরি হয়ফেস বাই ফেসের অন্যতম সফলতা হচ্ছে উপন্যাসটি জীবন বিচ্ছিন্ন থাকেনিশুভ মধ্যবিত্ত এবং শুভ পুরুষশুভ একইসাথে ভালো এবং প্রতারকশুভ ভিতু এবং বোকাআবার কাম কিংবা অন্য কোন প্রয়োজনে সে সাহসী আর লোভীশুভ প্রেমিক এবং কামুকতার চারপাশের অসংখ্য নারীদের নানা বৈচিত্রে সে অবাক হয়অসহায় বোধ করেতিন্নি তার অনেকদিনের বন্ধু কিন্তু তিন্নিকে সে বুঝতে পারে নালেখকও পাঠকের সামনে তিন্নিকে ব্যাখ্যা করেন না শুভকে কেন্দ্র করে পাঠক আবর্তিত হয়, চরিত্র থেকে চরিত্রে ঘুরে বেড়ায় তাদের পরিচয় হয় নওরোজ ভাই আর রওনক ভাবীর সাথেসাবিনা মেহনাজ সুপ্তির সাথে শাং-রি-লা বিষয়ে রওনক ভাবীর আগ্রহ পাঠকের মনেও ভর করেরওনক ভাবী খাপখোলা তলোয়ার- সময়ের জং তার গায়ে লাগে নাতার স্বামী নওরোজ এখানে সেখানে অনেক নারীর সাথে ঘুরে বেড়ানস্বামীকে উসাহ দিয়ে যান রওনককিন্তু তার ভেতরেও যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, অবদমন ছিলশুভর সাথে বক পাহাড়ে ঘুরতে যাবার ঘটনায় তা উন্মোচিত হয়সাবিনা মেহনাজ সুপ্তির সন্তান নাই-গাছপালা পালেন তিনি জীবন সাহার অষ্ট্রেলিয়ান বান্ধবী মাধবী, সে পঙ্গু, ভাইয়ের সাথে থাকে অষ্ট্রেলিয়াতেজীবনের সাথে তার ফেসবুকে যোগাযোগ হয়একটা সম্পর্ক কতোটা মানবিক হতে পারে এই ঘটনা তার প্রমাণতাদের মিছামিছি বিয়ে হয়হুইল চেয়ারে বসে থাকা মাধবীর করুণ আকুতি- ''তুমি হাঁটু গেড়ে বসে আছো সামনেআমাকে ধরে আছোআমার জন্য কি তোমার ভালোবাসা জাগছে? নাকি খুব করুণা হচ্ছে? আমাকে কি অর্ধেক মানুষ বলে মনে হচ্ছে? তুমি আমার পাতুমি আমাকে তোমার পা দিয়ে বিশ্ব ঘোরাও''এই অনন্য সম্পর্কটুকু নির্মাণের জন্য লেখককে ধন্যবাদ

এই বক পাহাড় আসলে বানানোসাভারের রাজাসনে এমন কোন জায়গা নেইতাহলে কেন লেখক এমন একটা বক পাহাড় পাঠকের সামনে হাজির করেনএই ঘটনা আরো একবার দেখি আমরাশুভর খন্ডকালীন প্রেমিকা সুপর্ণার সাথে কল্পনায় উটের কাফেলায় সওয়ার হয়ে পিংক সিটিতে যায় তাদের অভিসারের বর্ণনাকে মিথ্যা মনে হয় নাএটা লেখকের সফলতামরুভূমির বর্ণনা এবং চন্দ্রমুখী সেই অভিযানে বিহ্বলতা আছে, ঘোর আছেএই ঘোর থেকেই হয়তো বক পাহাড়ের জন্ম হয়শাং-রি-লা এমন এক জায়গা যেখানে চীরযৌবন পাওয়া যায়কিন্তু অনেক খুঁজেও কয়েকটা হোটেল ছাড়া সারা দুনিয়ায় এমন কোন জায়গা খুঁজে যাওয়া যায় নাচীরযৌবন আর মোক্ষ লাভের তাড়নাতেই হয়তো বক পাহাড়ের আবির্ভাবরওনকও তাই বলে, এটাই তাদের শাং-রি-লা শুভ নিজেও জানতো না এমন কোন জায়গা রাজাসনে আছে কি নাতার আরেক ফেসবুক ফ্রেন্ড নোমান তাকে জানায় এমন একটা স্থানের কথাশুভ বিশ্বাস করেশুভ এমন অনেক কিছুই বিশ্বাস করেআবার অবিশ্বাসের দোলাচালে দোলেএটাই মধ্যবিত্তের চরিত্রভালোভাবেই মধ্যবিত্তকে পাওয়া যায় ফেস বাই ফেস উপন্যাসে শাং-রি-লা আসলে মধ্যবিত্তের অপ্রাপ্তি, দিবাস্বপ্ন

মধ্যবিত্তের জীবন ক্রমশ মুক্তি চায়কিন্তু তার মুক্তির পথ বিদ্রোহের নয়, আপোষেরসাবিনা মেহনাজ সুপ্তি শুভকে সেই পথই বাতলে দেন, মোক্ষ লাভের কথা বলেন- '' কিন্তু মোক্ষ সম্ভবডোন্ট ট্রাই টু গেট আউট, স্টে হিয়ারএ জীবন কি সুন্দর নয়? রাস্তার ভিড়, জ্যাম, জীবন যাপনের জন্য মানুষের পরিশ্রম, তার ঘর্মাক্ত মুখ কি সুন্দর নয়? এসবই তো টিকিয়ে রাখছে পৃথিবীকেশত শত মানুষের বাঁচাকে সম্ভব করে তুলেছে এই রুটিনই তোআপনি এর থেকে মুক্তি নিয়ে কোথায় যাবেন? সেটা কি সম্ভব? আপনি বরং মোক্ষ খোঁজেন'' শুভ সেই মোক্ষই খুঁজে বেড়ায়পারে নাকখনো তিন্নি কখনো সুপর্ণা, নাজিয়া, রূপা, রওনক তাকে আঁকড়ে ধরেমোক্ষ লাভের আশায় বক পাহাড়ে গিয়ে পুরুষ বের হয়ে আসে শুভর ভেতর থেকে মোক্ষ লাভের কথা আর মনে হয় নাতার পৌরুষ রওনকের সরলতায় বিভ্রান্ত হয়রিনা কাওসারিও মধ্যবিত্ত শুভর পৌরুষকে নগ্ন করে দেনরিনার কাছে তার পিরিয়ডের বর্ণনা শুনেও বিভ্রান্ত হয় শুভফেসবুকের আড়ালে সে নারী না পুরুষ তা বুঝতে পারে নাতার বোধদয় ঘটে- ''পিরিয়ডের সময় ছেলেরা নাকি অদ্ভূত এক নীরবতা আর শত প্রশ্ন নিয়ে সঙ্গীনীকে পর্যবেক্ষণ করেকিন্তু কখনো জানতে চায় না, মেয়টির কেমন লাগেকেন তার শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে যেতে থাকে''

এমনিভাবে একের পর এক চরিত্র আসেযারা আসলে এই সমাজেরই নাগরিক মানুষযেমন মুন্না, শুভ ভাইকে যে ভালা পায়জীবন, যে শুভকে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেয়হস্তবিশারদ ফয়সাল ভাইনাজিয়ার সূত্র ধরে শেরি, বৃদ্ধা মারিয়াএমন অনেক চরিত্র ফেসবুকের মতোই উপন্যাসময় ঘোরাফেরা করেতাদের সাথে পরিচয় ঘটে শুভরশুভর স্বগতোক্তি- '' একেকটা মানুষ যেন একেকটা জনপদকত ঘটনা যে তাকে কেন্দ্র করে ঘটেএককথায় বোঝার উপায় নেইপরিচয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ একেকটা ইতিহাস বলতে থাকে'' শুভ এমন অনেক ইতিহাসের মুখোমুখি হয়আর যে ইতিহাসের প্রতি তার প্রধাণ ঝোঁক এবং যে ইতিহাস রহস্যময়ী, যাকে বুঝতে, যার সন্ধাণে সে এর কাছে তার কাছে ধরণা দিয়েছে- সে হল তিন্নিতাদের মধ্যকার অনেকদিনের বন্ধুত্ব এখন একটা পরিণতি চায়, তা আসলে আরো ঘনিষ্ট এবং স্থায়ী হতে চায়শুভ প্রেম করতে চায় তিন্নির সাথেকিন্তু তিন্নিকে সে বুঝতে পারে না সুপর্ণার সাথে শুভর সাময়িক প্রেমের ইতি ঘটে তিন্নির কারণেইসুপর্ণার বেদনা, শুভর অসহায়ত্ব সমস্তই মার খায় তিন্নির কাছেতিন্নিকে শত চেষ্টাতেও উপেক্ষা করতে পারে না শুভসুপর্ণার প্রতি সাময়িক প্রেমের সম্পর্কও আসলে তিন্নিকে না পাওয়ার শুণ্যস্থান পূরণের চেষ্টাসুপ্তির এই ব্যাখ্যাও শুভ বিশ্বাস করে কিন্তু তিন্নিকে তার পাওয়া হয় নাএড়াতেও পারে না তাকেএই যে ঝুলে থাকার জীবন মধ্যবিত্তের, তিন্নির ঘটনা শুভকে কেবলই হাস্যকর করে তোলেসুপর্ণার সাথে মিথ্যা শারীরিক সম্পর্কের কথা বলে শুভকে পরীক্ষা করে তিন্নিপ্রথমে ভয় পায় শুভকিন্তু সে উপায়হীনতিন্নিতে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা যেনএমন অনেক মিথ্যা বয়ানকে বিশ্বাস করেও সে তিন্নির কাছেই ফিরে যায়তিন্নিকে সে শরীরেও চায়তিন্নির শরীর নিয়েও তার কামনা জাগে বারবার একদিন ঘন ঘোর লাগা জ্বর আসে তার যখন পাশে আসে তিন্নিমধ্যবিত্ত আসলে তার প্রাপ্তিকেও মেনে নিতে পারে না

কোন নিম্নবিত্ত চরিত্র নেই এই উপন্যাসেআরো হয়তো সমালোচনা করা যেত সময় সুযোগ থাকলেতেমনি সময়ের অভাবে ফেস বাই ফেস উপন্যাসের ভাষা নিয়ে আলাদা প্রসংশাটুকুও করা যাচ্ছে নানাগরিক মেজাজ ধরে রাখার কাজটা ভালোই হয়েছে আরো অনেক বিষয় বলা হল নাসব মিলিয়ে ফেস বাই ফেস জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস সফলতা ব্যর্থতা এখনি বা হয়তো কখনোই বিবেচ্য নয়তবে সুখপাঠ্য আর ঝরঝরে একটা গতিশীল লেখা পড়তে পাঠকের ভালোই লাগবেশহুরে মাঘ পেরিয়েও শীত না আসুক, বন্ধু আসেমোক্ষ লাভের আলাপ আসে, শাং-রি-লার ডাক আসেএই উপন্যাসে ঘাম আছে, সেন্ডোগেঞ্জি আছেএমন অনেক কিছু নিয়েই তৈরি ফেস বাই ফেস, মাহবুব মোর্শেদের নতুন ধারার লিখাতার কবিভাবও জিইয়ে রেখেছনে তিনিএই উপন্যাসের একটা অন্যরকম স্বাদ আছে- গরম চায়ে পরোটা ভিজিয়ে খাবার স্বাদটা যেমন হয় গদ্য এবং কাব্যের মিশেলে ফেস বাই ফেস পাঠকের নিশ্চয়ই পছন্দ হবে

http://www.facebook.com/note.php?note_id=284480282324&id=1445377116

..............................................................................................................



নাগরিক জীবনের কথা কাহিনি

সালাহ্ উদ্দিন | তারিখ: ১৪-০৫-২০১০

মন খাঁটি হলে পবিত্র স্থানে গমন নাকি অর্থহীনতাহলে কেন নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবনে পবিত্র স্থানে গমনের আকাঙ্ক্ষা বেয়াড়া রকমেরএর কারণ কি এই যে তাদের মনটাই আসলে একটা ফাঁকি? শহুরে ব্যস্ততা আর জীবনের ঘানি টানার জোয়াল কাঁধে অসহায় মধ্যবিত্তের ভালো লাগাটুকু হয়তো এই পবিত্র স্থানে গমনের চিন্তাতেই কিছুটা স্বস্তি পায়তাই হয়তো সে শাং-রি-লার খোঁজ করে শাং-রি-লা খুঁজে না পেলে বক পাহাড়অথবা কিছুই না পেলে সে অন্তত তার পথ চাওয়াতেই আনন্দ জেগে ওঠে

পরের গোয়ালের গরু খুঁজে বেড়ানোর আগ্রহ বাঙালির ষোলোআনাশহুরে জীবনের কানমলাতেও তার সেই স্বভাব যায় নাতবে খুঁজে বেড়ানোর উপায়টা ভিন্নএই নাগরিক মধ্যবিত্ত অন্তর্জালের পর্দায় আরেক দুনিয়া খুঁজে পেয়েছেঠিক অপর জগ নয়, বাস্তব জগতেরই প্রতিরূপ, মানবিক সম্পর্কের নতুন প্ল্যাটফর্ম ও যোগাযোগের মাধ্যমযেমন, ফেসবুকঢাকা শহরের অসহায়ত্বই হয়তো এই ফেসবুক কিন্তু এরও শেষ আছেমাহবুব মোর্শেদ তাঁর উপন্যাসেই বলেছেন, যন্ত্র মানবিক সৃষ্টিশীলতাকে অতিক্রম করতে পারে নাএকসময় মাইস্পেস, হাইফাইভের যুগ ছিল এখন ফেসবুকএরপর হয়তো ফেসবুকও থাকবে নামানুষই নতুন করে আবার কোনো নাগরিক যোগাযোগের উপায় খুঁজে বের করবেফেস বাই ফেস উপন্যাসের গায়ে লেখক ফেসবুকের জামা চাপিয়েছেনসেই জামার ভেতরে অস্থির, রুগ্ণ, লোভী আর দিকভ্রান্ত মধ্যবিত্তের গল্পউপন্যাসের আদলটাই ফেসবুকের মতোমুখের পর মুখ, একের পর এক চরিত্র, ঘটনানতুন কোনো চরিত্র আসে, আর তার প্রোফাইল বর্ণনা করে যান লেখকফেসবুকের মানুষেরা অন্তর্জালিক বন্ধু হয়ে ওঠেতাদের হয়তো কখনোই দেখা হয় নাএক অপরের খোঁজ নেওয়া আর বিচিত্র গল্প শুনতে শুনতে নাগরিক মধ্যবিত্তের সময় কাটেসেই গল্পে গল্পে অবাস্তব শাং-রি-লা আসে, বক পাহাড় আসে

মাহবুব মোর্শেদ মানবিক সম্পর্কের সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে ফেসবুকে এসে প্রবেশ করেছেন বলে তাঁর বইয়ের ফ্ল্যাপে জানিয়েছেনকিন্তু ফেসবুকে মানুষ খুঁজে পাওয়ার বিষয়টাই সংশায়িতউপন্যাসে সেই সংশয়ও ব্যক্ত আছেউপন্যাসের চরিত্র রিনা কাওসারি বলছে, ‘শোনেন, একটা আড়াল আপনার আর আমার মধ্যে আছে, তাই না? এই আড়ালটা যদি না থাকত, তবে আমি কথাগুলো বলতে পারতাম নাআপনি রিয়েল ক্যারেক্টারআপনি পুরুষআমি নারীহয়তো আপনার পরিচিত, হয়তো অপরিচিত হয়তো আমার এ ছবিটা নকলকিন্তু এই আড়ালটুকু না থাকলে আমি আপনাকে আমার পিরিয়ডের গল্পটা কিন্তু বলতে পারতাম নাএমন অনেক কিছুই তো হয়আপনি আমাকে একজন নারীই ভাবুন না কেনক্ষতি কী? ডু ইউ বিলিভ মি?’ এসকল প্রশ্ন এবং হয়তো এর ঘোলাজলে ফেসবুক যে মানুষকে হাজির করে তাদের মধ্যে সম্পর্কের চাইতে বিভ্রান্তি থাকে বেশিতাছাড়া বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ ও নোংরা বলে ফেসবুকে মানবিক সম্পর্কজনিত জটিলতার অনুসন্ধান আদতে গোলক ধাঁধাকে আরো জটিল করে তোলেফলে এই উপন্যাসের অভিনবত্ব বিভ্রান্তির পথে গমন করেআড়াল যখন আশ্রয় হয়ে যায়, তখন আর স্বরূপ খুঁজে পাওয়া যায় নাফেসবুক অনেকের জন্যই আড়াল, এই আড়ালে থাকার সুযোগ এবং হারানো সুঁই তালাশে আগ্রহী লোকদেরও জীবনযাপনের দার্শনিকতায় অভিনবত্ব আছে, স্বার্থ আছে এবং মুক্তির বাসনা আছে সেই মুক্তির পথও বন্ধউপন্যাসের চরিত্র সাবিনা মেহনাজ সুপ্তি শুভকে ভালো থাকার উপায় বাতলে দেন, মোক্ষ লাভের কথা বলেন—‘কিন্তু মোক্ষ সম্ভবডোন্ট ট্রাই টু গেট আউট, স্টে হিয়ারএ জীবন কি সুন্দর নয়? রাস্তার ভিড়, জ্যাম, জীবনযাপনের জন্য মানুষের পরিশ্রম, তার ঘর্মাক্ত মুখ কি সুন্দর নয়? এসবই তো টিকিয়ে রাখছে পৃথিবীকেশত শত মানুষের বাঁচাকে সম্ভব করে তুলেছে এই রুটিনই তো আপনি এর থেকে মুক্তি নিয়ে কোথায় যাবেন? সেটা কি সম্ভব? আপনি বরং মোক্ষ খোঁজেনফলে মাহবুব মোর্শেদ যে মধ্যবিত্তকে হাজির করছেন, তারা আচরণে ভাষায় এবং আদান-প্রদানের নির্দিষ্ট সংস্কৃতিতে আবদ্ধ

ফেস বাই ফেস উপন্যাসের ভাষাও নির্দিষ্ট, অল্পকিছু লোকজনের মুখেই আবদ্ধ ভাষার ব্যবহারে লেখক নিজস্ব আবহ তৈরি করতে চাইছেন হয়তোকিন্তু এই ভাষাও একই সঙ্গে শিক্ষিত এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে কয়েকজনের ভাষাএই ভাষার ব্যবহারকারীরা ফাস্টফুড খায়ফেসবুক ব্যবহার করে নাএমন কাউকে এই উপন্যাসে দেখা যায় নাফেসবুক ব্যবহারকারীদের ইতিহাস থাকে না, প্রতিবেশ থাকে না শুধু মনিটর আর নিজের হাত-চোখ-মাথার ব্যক্তিগত ব্যবহার হচ্ছে ফেসবুকযা একটা অদৃষ্টের সম্পর্ক তৈরি করেইতিহাস বিচ্ছিন্নতার যে রোগ মধ্যবিত্তের আছে, তার আশ্রয় এই ফেসবুকফলে একটু ভালো করে বেঁচে থাকার খোরাকি জোগাড় করার মাধ্যম হিসেবে ফেসবুককে উপস্থাপনের চেষ্টায় ফেসবুক-বিছিন্ন জীবনটাই বরং বেজে উঠেছেতাই শুভ এবং তিন্নি উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্রের সম্পর্ক ফেসবুক-বিচ্ছিন্নএমনকি শুভর বেঁচে থাকার জন্যও এই ফেসবুক জরুরি নয়জরুরি বরং শুভর জীবনকে উপন্যাসময় করে তোলার জন্যফলে মানবিক সম্পর্কের জটাজালের সূত্র সন্ধানে ফেসবুকে গমন বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠতে পারে

মাহবুব মোর্শেদ উপন্যাসের মেজাজ ধরে রাখতে পেরেছেনসব মিলিয়ে ফেস বাই ফেস জনপ্রিয় ধারার উপন্যাসসুখপাঠ্য আর ঝরঝরে একটা গতিশীল লেখা পড়ার আনন্দ আছে এ উপন্যাসেশহুরে মাঘ পেরিয়েও শীত না আসুক, বন্ধু আসে ফেসবুকেমোক্ষ লাভের আলাপ আসে, শাং-রি-লার ডাক আসেএই উপন্যাসে ঘাম আছে, সেন্ডোগেঞ্জি আছেএমন অনেক কিছু নিয়েই তৈরি ফেস বাই ফেসমাহবুব মোর্শেদ তাঁর কবিভাবও জিইয়ে রেখেছেনএই উপন্যাসের একটা অন্য রকম স্বাদ আছেগরম চায়ে পরোটা ভিজিয়ে খাওয়ার স্বাদটা যেমন হয়

http://static.prothom-alo.com/detail/news/63177

.........................................................................................................

হরফের স্তূপ

গ্লোবালের আড়ালে লোকাল

গৌতম চৌধুরী

ফেস বাই ফেস ।। মাহবুব মোর্শেদ ।। প্রকাশকাল: ফেব্রয়ারি ২০১০ ।। প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা ।। প্রকাশক: ভাষাচিত্র ।। মূল্য: ১৭৫ টাকা

কবিতাপাঠের রুচি যেন একপ্রকার নাছোড় ব্যাধি, যাহাদের আক্রমণ করে, সারা জিন্দেগির মতো তাহাদের ভোগাইয়া মারেগল্প-উপন্যাস পাঠের মহ অভ্যাসটি, তুলনায়, আগ্রাসী জ্বরের মতোকামড় বসাইলে রক্ষা নাই, কিছুদিনের জন্য ভিতর-বাহির তোলপাড় করিয়া ছাড়েকিন্তু একবার ছাড়িয়া গেলে সহসা আর ফিরিয়া আসে নাপ্রিয় পাঠিকা-পাঠকের নিকট পহেলাই একথা কবুল করিয়া নেওয়া ভালো যে, এ-ব্যাপারে বর্তমান কথকের অভিজ্ঞতা প্রকৃতই শোচনীয়একুশ শতকে প্রকাশিত বিভাগোত্তর প্রজš§র মাত্র দুইটি বাংলা উপন্যাস পাঠের সৌভাগ্য আমাদের ঘটিয়াছেÑ ১. নবারুণ ভট্টাচার্য কৃত কাঙাল মালসাট (২০০৩) এবং ২. সালমা বাণী রচিত ভাংগারি (২০০৪)অতঃপর আরও নবীন কোনও লেখকের রচনার সহিত পরিচিত না হইতে পারিলে বাংলা উপন্যাসের হাল-হকিকত সম্পর্কে এক প্রকার ভাসা ভাসা জ্ঞান (পড়-ন, পুস্তক পর্যালোচনা পাঠ প্রসূত জ্ঞান) লইয়াই ভবলীলা সাঙ্গ হইবে, এইরূপ একটি হীনমন্যতায় ভুগিতেছিলামএমতাবস্থায় জনৈক বন্ধুর বদান্যতায় হাতে আসিয়া পঁহুছিল একেবারে তরুণ এক গদ্যকার মাহবুব মোর্শেদ (জš§ ১৯৭৭) রচিত একটি উপন্যাসÑ ফেস বাই ফেস (প্রকাশ, একুশে বইমেলা ২০১০)

জমাটি গল্পকারের একটি বহুপরীক্ষিত কৌশল হইল, মোক্ষম তাসটি আস্তিনের নিচে চুপচাপ চাপিয়া রাখিয়া একেবারে অন্তিম মুহূর্তে পাঠকের টেবিলে ঠকাস করিয়া ফেলিয়া দিয়া তাহাকে কুপোকাত করাএ-ব্যাপারে গোয়েন্দা বা ভূতের গল্পের সাফল্য মনে হয় সব লোকপ্রিয় লেখককেই তাড়া করিয়া ফেরেগল্প বলিবার অন্য কিছু তরিকাও অবশ্য লেখকদের নিকট হইতে আমরা পাইয়াছিযেমন, ১) রহস্য যদি আদৌ কিছু থাকে, তাহা প্রথমেই ফাঁস করিয়া দিয়া পরে তাহা লইয়া প্যাচাল পাড়া (সাহিত্যের ভাষায়, রহস্যটি বিনির্মাণ করা)২) জীবনের কোথাও কোনও রহস্য যে নাই, রহস্যহীনতার সেই হাহাকার হইতে কথা বলা৩) কথা বলিতে বলিতে রহস্যকে আবিষ্কার করা, যেন পাঠক আর লেখক একইসাথে তাহার মুখোমুখি হইলেন, এইরূপ একটি আবহ সৃষ্টি করা ইত্যাদিদেখা গেল, মাহবুব মোর্শেদ তাঁহার প্রথম উপন্যাস ফেস বাই ফেস-এ, পাঠককে চূড়ান্তে চমক দিবার সনাতন ধারাটিকেই বাছিয়া লইয়াছেন তাঁহার আস্তিনে লুকানো সেই যাদু-তাসটি হইল, উপন্যাসের কথক-নায়ক শুভর অন্যতম ও প্রধানতম বান্ধবী তিন্নির সমকামিতাগল্পের একেবারে শেষে পঁহুছিয়া যে-তথ্যটি উদ্ঘাটিত হওয়ার সাথে সাথে পাঠকের সুনিশ্চিত বিস্ময়ের সম্ভাবনায় লেখকের ঠোঁটের কোণে ফুটিয়া উঠা তৃপ্তির হাসিটিও আমরা পড়িয়া লইতে পারি, যাহার অর্থ হইতেছে, কী, কেমন দিলাম

বছর পাঁচেক আগে একটি পশ্চিম-ইউরোপীয় ছবিতে (নাম মনে নাই) নারীর সমকামিতার এক আগ্রাসী ও মারমুখী মূর্তি দেখিয়াছিলাম, সঙ্গিনীর বিষমকামী হইয়া উঠিবার সামান্য সম্ভাবনা দেখা দিলে আদিম ঈর্ষাবশে যে-প্রেম রক্তারক্তি, খুনোখুনি অবধি গড়াইয়াছিলসম্পূর্ণ ভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত হইতে উঠিয়া আসা এক বাঙালি মেয়ে বলিয়াই এ-উপন্যাসের তিন্নি সেসব অতিরেকের ধারকাছ দিয়াও যায় নাইনা যাইবারই কথাসে শুধু তাহার সঙ্গিনী সুপর্ণার বিবাহের সম্ভাবনা একবার ভাঙিয়া দিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেকিন্তু তাহা যে স্রেফ একটি কুচুটেপনা মাত্র ছিল না, সে-বিষয়ে লেখক আমাদের পুরোপুরি নিঃসংশয় করিয়া তুলিতে পারেন নাকারণ, সুপর্ণার বিবাহসম্ভাবনাটি সে-যাত্রা ঘনাইয়া উঠিয়াছিল শুভর সহিত, যে-শুভ আসলে তিন্নিকেই কলেজজীবন হইতে ভালোবাসিয়া আসিয়াছে, কিন্তু বহু বছরের প্রতীক্ষাতেও কোনও ইতিবাচক সাড়া না পাইয়া শেষমেশ সুপর্ণার দিকে আগাইয়াছে ও জড়াইয়া গিয়াছেতাই এ-ধন্দ থাকিয়াই যায়, অমন বিবাহটি তিন্নি ভাঙিল কেন, নিছক সুপর্ণার প্রতি আসক্তিবশত? তাহা হইলে অল্পকিছুদিন বাদেই যখন পারিবারিকভাবে পুনরায় তাহার বিবাহ ঠিক হইল, তিন্নি তো তখন কোনওরূপ বাধা দিল না! বরং সে সেই বিবাহবাসরের নিমন্ত্রণও গ্রহণ করিলতাহা হইলে কি শুভকে অবিবাহিত রাখিয়া দিয়া, তাহার দুর্বলতার সুযোগ লইয়া তাহার উপর কর্তৃত্ব ফলানোর রাস্তাটাও তিন্নি খোলা রাখিতে চাহে নাই?

আসলে তিন্নির সমকামিতার আখ্যানটাই একটু নড়বড়ে, যেহেতু তাহা দাঁড়াইয়া আছে লেখকের ঐ একটি মাত্র যাদু-তাসের উপরউপন্যাসের শেষে তিন্নির ফ্যাঁচফ্যাঁচে কাঁদুনির মৌখিক বয়ানের উপরে ভরসা করিয়াই আমাদের ব্যাপারটি গিলিতে হয় প্রসঙ্গের কোনও পূর্বপ্রস্তুতি না রাখিয়া লেখক চমক দিতে চাহিয়াছেন, ভালো কিন্তু প্রবণতার দিক হইতে চরিত্রটি যখন এক সংখ্যালঘু মানসের অধিকারী, তখন, অন্তত রহস্যটি ফাঁস হওয়ার পর, তাহার সেই মানস-জটিলতার স্তরপরম্পরাগুলি পাঠকের কাছে আরও বিশদ হইবার অবকাশ থাকিয়াই যায়যেমন একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে সুপর্ণা ও তাহার পারিবারিক পটভূমির বিশ্বাসযোগ্য রূপায়ণের একটা আলাদা চেষ্টা লইয়াছেন লেখকতিন্নি চরিত্রের সেই অনুসন্ধানী বিশ্লেষণের অভাবে পাঠকের মনে কতকগুলি প্রশ্ন জাগেসুপর্ণা যেহেতু যুগপ তিন্নির সমকামী সঙ্গিনী এবং শুভর প্রেমিকা, তাহাকে আমরা এক উভকামী নারী বলিয়াই ধরিয়া লইতে পারিঅন্যদিকে, তিন্নি যদি নিরঙ্কুশ সমকামী, তাহা হইলে সুপর্ণার বিচ্ছেদে হয় সে বিরহ উদ্যাপন করিবে, নচে কোনও পুরুষ নহে, অন্য কোনও নারীরই প্রতি ধাবিত হইবেকিন্তু যেভাবে সে শেষ পর্যন্ত শুভকে মানিয়া লয়, তাহাতে তাহার এক উভকামী সত্তার পরিচয়ই জাগিয়া উঠেইহা কি তাহার ভিতরে একটি নূতন উপলব্ধি? যদি তাহাই হয়, সেই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার কোনও পরিচয় লেখক আমাদের দেন নাইআর সে যদি প্রথমাবধিই উভকামী ছিল, তাহা হইলে শুভ আর সুপর্ণা দুইজনের সহিতই সম্পর্ক বহাল রাখিয়া, গল্পকে একটা অন্যতর মাত্রায় লইয়া যাইতে পারিতকাজেই তিন্নির সমকামিতাটা শেষ পর্যন্ত একটা পড়িয়া পাওয়া চৌদ্দ আনা স্টান্ট হইয়াই থাকিয়া যায়

উপন্যাসটির উসর্গপত্রে উকলিত কবি উপলকুমার বসুর পঙ্ক্তিগুলি বলিতেছেÑ

তোমাদের মজার এক গল্প বলি শোনোকে যেন বলল ডেকে,

কোন গল্প, কাকে নিয়ে, সমস্ত ভুলেছিশুধু শালবনেÑ দূরে Ñ

জলার মতন এক স্বচ্ছ জল অন্তিম গোধূলি নিয়ে

আলো হয়ে ছিল

তথাপি, শেষ পর্যন্ত মাহবুব মোর্শেদ যে আমাদের কোনও অন্তিম গোধূলি আলোর মুখোমুখি দাঁড় করান না, তাহার জন্য পাঠক হিসাবে তো কিছুটা প্রতারিত বোধ করিবারই কথাকিন্তু সেটা ঘটে না, মুখ্যত লেখকের উপাদেয় লিখনভঙ্গিমা আর একাধিক বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রের সফল উপস্থাপনার কারণেসুনীল বা হুমায়ূনের রচনায় যে একধরনের সাবলীল সুখপাঠ্যতা থাকে, লেখক অনায়াসে সে-সাফল্য স্পর্শ করিয়াছেনতিনি যদি শুধু এইটুকুই চাহিয়া থাকেন, তাহা হইলে অচিরেই বাংলাবাজারে আরও একজন বেস্ট সেলার লেখকের অভিষেক ঘটিতে চলিয়াছে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়তবে বাণিজ্যসফলতাই যে এ-লেখকের একমাত্র কাক্সিক্ষত নিয়তি নয়, তাহারও ঢের পরিচয় বর্তমান উপন্যাসটির পাতায় পাতায় ছড়ানো রহিয়াছে যেকোনও স্বপ্নদর্শী তরুণের মতোই, জীবনের প্রথম উপন্যাসের করণকারিত্বে কিছু একটা অভিনবত্ব আমদানি করার কথা ভাবিয়াছেন তিনিআর তাহা করিতে গিয়া, তৃতীয় বিশ্বের সমাজবাস্তবতার গহন ঘূর্ণিপাকে ডুব দিয়া নাকানিচুবানি খাওয়ার বদলে, তিনি বাছিয়া লইয়াছেন পৃথিবীর নানাপ্রান্তে গহন দ্বীপের মতো ছড়ানো কিছু মানবহৃদয়সেইসব ছিন্নবিচ্ছিন্ন হৃদয়ের ঐক্যের পটভূমি হইল তাহাদের এক হইতে বহুতে পৌঁছানোর আকাক্সক্ষা, আর সেই দূরসঞ্চারের অবলম্বন হইল আন্তর্জাল

আখ্যানের কথক শুভ যেহেতু কর্মসূত্রে আন্তর্জালের ব্যবহারকারী, অবসরের মন্থরতা কাটাইতে সে প্রায়শই ঢুকিয়া পড়ে বদনবই (ফেসবুক) নামের সামাজিক জালবুনটের জগতেতাহার ল্যাপটপের পর্দায় জাগিয়া উঠে একের পর এক নানা দূরাগত অভিব্যক্তিএইসব ধারাবাহিক মুখচ্ছবির ব্যঞ্জনা হইতেই উপন্যাসটির নাম হইয়া উঠে ফেস বাই ফেসযেখানে একের পর এক নানা বয়সের নানা বাঙালি নারীপুরুষ কথা বলিয়া উঠে হরফের ভাষায়মুছিয়া যায় শারীরিক ব্যবধান, কখনও কখনও যে-দূরত্ব হয়তো ভূগোলের মাপে কয়েক হাজার কি.মি.এই উপন্যাসে মাহবুব মোর্শেদের সর্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব হইল এই ভার্চুয়াল চরিত্রগুলির সৃষ্টিনাজিয়া, সাবিনা মেহনাজ, শেরি, মারিয়া, মাধবীÑ প্রতিটি চরিত্র এত আলাদা, অথচ প্রতিটিই এমন বিশ্বাসযোগ্য হইয়া উঠিয়াছে যে, লেখকের সহিত আমরাও চরিত্রগুলির শ্বাসপ্রশ্বাস অনুভব করি

কিন্তু লেখক বিলক্ষণ জানেন, নিছক চমকপ্রদ কিছু চরিত্র সৃষ্টি করিয়া ফেলিলেই পাঠকের মন পাওয়া যাইবে এমন নহেতাহার জন্য গপ্পো ফাঁদিতে হইবেলেখক কাজেই দুই নৌকায় পা দিয়াছেন, যদিও যেকোনও সৃজনশীল মানুষের মতোই সে-অধিকার তাঁহার আলবাত আছেতিনি শুধু অথই দরিয়া হইতে জালে তোলা মাছেই খুশি থাকেন নাই, পোক্ত হাতে হুইল-বঁড়শি দিয়া কাছাকাছি ঝিল-নালা-পুকুরের মাছ তুলিতেও কসুর করেন নাইগ্লোবালের মোড়কের আড়ালে তাঁহার গল্প আসলে এইসব লোকালদের লইয়াই দিব্য আড়ে-বহরে খেলিয়া গিয়াছেএইসব স্থানীয় চরিত্রগুলির জন্য বদনবইয়ের অবতারণা অবশ্য একটি বাহানা মাত্রতাহাদের লইয়া গল্প যেভাবে আগাইয়াছে, সেখানে বদনবই না থাকিলেও এমন কিছু আসিয়া যাইত নাতবে থাকাতেও অসুবিধা কিছু হয় নাই, মাঝে মাঝে বরং বৈচিত্র্যও তৈরি হইয়াছেযেমন নওরোজ ভাইয়ের তারুণ্যে উদ্দীপ্ত চরিত্রটিপরার্থপর ও শুভমঙ্গলবাদী জীবন সাহাও এক চমকার সৃষ্টিসমকামিতাটা তাহার জন্য যতই আলংকারিক মনে হউক, তিন্নি কিন্তু পাঠকের মন কাড়িয়া লয়শুভকে কেন্দ্র করিয়া তাহার স্ববিরোধী ও প্রাণচঞ্চল চরিত্রটির উš§াচন খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হইয়াছে তুলনায় সুপর্ণার চরিত্রায়ন একটু আড়ষ্টতাহার ও শুভর আপাতকাব্যিকতাময় যৌথদৃশ্যগুলি কথঞ্চি সু.গ-মার্কাকিন্তু চিরকিশোর পাঠকদের জন্য বাণিজ্যসাহিত্যের নির্মাতা প্রাগুক্ত লেখকের কাঁচা ও জোলো রোমান্টিকতা (পড়-ন, শারীরিকতা) বড় বেশি ছায়া ফেলিয়াছে রওনক ভাবীর সহিত শুভর ডেটিংয়ের দিনটিতেঅন্যথায় ভাবীর চরিত্রটি কিন্তু নওরোজ ভাইয়ের পরিপূরক হিসাবে ভালোই জমিয়াছিল

ফয়সল ভাইয়ের চরিত্রটি এ-উপাখ্যানে সম্পূর্ণ অনাবশ্যকভাবে আসিয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হয়যেন ২৫ গ্রাম জ্যোতিষ আর ৫০ গ্রাম পানশালা-দৃশ্যের অবতারণা করিবার জন্যই তাহার সৃষ্টিতাহাকে বানাইয়া বলা স-সুপর্ণা-শুভর রাজস্থান ভ্রমণবৃত্তান্তটিও হইয়া উঠিয়াছে যাদুবাস্তবতা সৃষ্টির একটি ব্যর্থ প্রয়াস সহস্রযোজন দূরের নায়াগ্রাপ্রপাতের জলধ্বনিও যেখানে বিশ্বাসযোগ্যভাবে অনুরণিত হইতে পারিল, রাজস্থানের মরু পাঠকদের কেন প্রতারিত করিল কে জানে! হয়তো বানাইয়া বলিতেছেন বলিয়া লেখক এরূপ সচেতন ছিলেন যে, প্রাণপ্রতিষ্ঠা হইল নানায়াগ্রা ও পিংক সিটির অভিজ্ঞতা বর্ণনার সামান্য কিছুটা করিয়া অংশ পাশাপাশি পাঠ করিলেই ইহাদের শিল্পমাত্রার তারতম্য আমাদের চোখে ধরা পড়েÑ

টানেল ধরে যখন জলপ্রপাতের একদিক থেকে অন্যদিকে যাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল প্রচণ্ড গর্জনের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিহয়তো এ রকম প্রচণ্ড বা এর চেয়ে তীব্র কোনো গর্জনের ভেতর ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেনশব্দের প্রচণ্ডত্বের মধ্যেও মানুষ যে হারিয়ে যেতে পারে নায়াগ্রা না গেলে বুঝতাম না। (পৃ.২৩) [ভাষা প্রাণবন্ত এবং কবিতামণ্ডিত]

চাঁদ তখন মাঝ আকাশেপূর্ণ আলো ফেলেছে শহরের খোলা স্থানেতার বিভা মরুর বুকে একটা গোলাপি ফুল ফুটিয়ে দিয়েছেছোট ঘরগুলো সেই গোলাপি ফুলের এক একটি পাপড়িতখন পুরো শহর ঘুমিয়ে পড়েছেনৃত্যলহরীর সঙ্গে আসা গান থেমে গেছে ছোট নির্জন ছাদে আমি আর সুপর্ণা। (পৃ. ৮৬) [ভাষা অসংহত ও কাব্যিকতাপ্রয়াসী]

এ-উপন্যাসের ভাষার সাবলীলতার উল্লেখ আমরা ইতোমধ্যেই করিয়াছিপরিবেশ প্রতিষ্ঠার দক্ষতায় মাহবুব প্রায়শই সেই প্রাথমিক সাফল্যকে টপকাইয়া যে-শিল্পিত আবহের সৃষ্টি করেন, তাহার দুএকটি নমুনায় একবার চোখ বুলাইয়া লইতে পারিÑ

১. তার মাঝে মাঝে মনে হতো, কুইবেকে সেই একলা বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবেচারদিকে সার সার বার্চ গাছতুষার জমে পার্কের জমিন শাদা হয়ে আছে তীব্র কুয়াশার মধ্যে যেখানে মারিয়া হেঁটে হেঁটে উজ্জ্বল আলো ভরা স্টোরে চলে যায়। (পৃ. ৬৯)

২. তখন বর্ষাকাল, আকাশে মেঘ কিন্তু দূরে দূরেপাকশী আসার আগেই ট্রেনলাইনের দুপাশের সবুজ ঘন গাছপালার প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলামদূরের বাজার, কাছের মানুষ, খুব ভালো লাগছিলট্রেন ব্রিজের ওপর উঠার আগেই দেখলাম এক অপূর্ব জলমণ্ডলসন্ধ্যার আলো তখনও মেলায়নিনীল জলে একটু একটু একটু শাদা-কালো মেঘের স্পষ্ট প্রতিবিম্ব। (পৃ. ৭১)

৩. ক্ষেতের ধারে শর্ষের ঝাঁঝালো গন্ধ নেয়ার পর দূরের গ্রাম লক্ষ্য করে আবার হাঁটতে থাকিশাদা মূলার ফুল ফুটে আছেতারও অন্যরকম ঝাঁঝালো গন্ধ মটরশুঁটিডাঁটা শাক, লাল শাক, করলার ক্ষেতের আল ধরে ধরে একটা গ্রামে পৌঁছাইকয়েকটা বাড়িকয়েকটা তালগাছএকটা ছোট টংয়ের দোকান। (পৃ. ১০৭)

প্রকৃতিবর্ণনার এই বহুবিধ পাঁয়তারা (শব্দটি এখানে প্রশংসার্থে ব্যবহৃত হইল) ছাড়াও বহু গভীর দার্শনিক উপলব্ধি, চমকপ্রদ উক্তি, ফাজলামি, কৌতুক ইত্যাদি উপন্যাসটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছড়াইয়া আছে

১. নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় নাকি ঐতিহাসিক স্থান দেখার মতো অনুভূতি তৈরি করে

২. স্মৃতিচারণ খুব খারাপ জিনিসস্মৃতি অতীতের কদর্য একটা ঘটনাকেও অনেক মধুর করে দেয়বাস্তবতা থেকে দূরে নিয়ে যায়। (পৃ. ৪৪)

৩. চারদিকে সব সিরিয়াস মানুষ না? সিরিয়াস মানুষগুলো একটা কথা কিছুতেই বোঝে না যে, সিরিয়াসনেস একটা বোরিং ব্যাপার। (পৃ. ৪৫)

৪. এ জীবন কি সুন্দর নয়? রাস্তার ভিড়, জ্যাম, জীবনযাপনের জন্য মানুষের পরিশ্রম, তার ঘর্মাক্ত মুখ কি সুন্দর নয়? এসবই তো টিকিয়ে রাখছে পৃথিবীকে আপনি এর থেকে মুক্তি নিয়ে কোথায় যাবেন? (পৃ. ৫১)

৫. আপনি বাথরুমে যাচ্ছেন, কাপড় বদলাচ্ছেন, গপ গপ করে খাবার গিলছেনআরও কত কী হচ্ছেএর মধ্যে মাঝে মাঝে আপনার মধ্যে ভালোবাসা যে জাগতে পারছে সেটা কি একটা দুর্লভ বস্তু নয়? (পৃ. ৫২)

৬. হয়তো অনিশ্চয়তার কথা জানি বলেই, সেখান থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্যই আমাদের যত কিছু নিশ্চয়তার আয়োজন। (পৃ. ৬৫)

৭. জীবনের জন্য অনিবার্যতা বলে কিছু নেইসবই নিবারণযোগ্য। (পৃ. ৮৯)

এই সকল স্মরণযোগ্য উক্তির ভিতর দিয়া পাঠক মানবচরিত্রের নানাবিধ অনাভাসিত দিককেই এ-উপন্যাসে উš§াচিত হইতে দেখেনএখন প্রত্যাশা এই যে, চরিত্রচিত্রণের মুনশিয়ানা, পটভূমি রচনার বাস্তবতাবোধ ও উপলব্ধির নৈর্ব্যক্তিকতার যে-পরিচয় মাহবুব মোর্শেদ তাঁহার এই প্রথম উপন্যাসটিতে নাজেল করিলেন, তাহা আগামীতে দেশ-কাল ও সমাজকে স্পর্শ করিবার মতো গভীরতর কোনও অনুষঙ্গ খুঁজিয়া পাইবেঅন্যথায় বেস্টসেলারের বিকল্প তো রহিলই

http://www.notundhara.com/content/2010/07/20/news0679.htm