Sunday, May 16, 2010

সাদা সাদা আরও সাদা


ছোটবেলায় স্কুল পাঠ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি আপ্তবাক্যের ব্যাখ্যা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের করতে হয়। বাক্যটি হলো, 'অর্থই অনর্থের মূল।' এই অর্থ মিনিং বা মানে নয়, এই অর্থ হলো মুদ্রা বা টাকা। ছোটবেলায় অর্থকে অনর্থের মূল জানলেও ক্রমেই শিক্ষার্থীরা এ বিদ্যা অর্জন করতে পারে যে, টাকা জগতের অন্যতম আরাধ্য। লেখাপড়া করে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার সৌভাগ্য হয় এ-ও স্কুল পাঠ্যেরই শিক্ষা। গাড়ি-ঘোড়ায় চড়তে টাকা প্রয়োজন, একথা ছোটরা বুঝতে না পারলেও বড়রা বেশ ভালো করে বোঝেন। ফলে বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থাকে বড়রা এমনভাবে সাজিয়েছেন যে, এর মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে টাকা উপার্জন। অভিযোগ আছে, আমাদের বিদ্যায়তনে নৈতিক শিক্ষাকে অনেক নূ্যনতম গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে আমাদের প্রজন্মগুলো নৈতিক, মানবিক ও সামাজিক দায়িত্বের শিক্ষা ছাড়াই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। এমনকি ছাত্রাবস্থাতেই তারা টাকা উপার্জনের জন্য মূলধারার রাজনীতি ও রাজনীতির উপসর্গ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, দুর্বৃত্তপনায় হাত পাকিয়ে তুলছে। ফলে অর্থের অনর্থ উপলব্ধির আগেই কিংবা টাকার রঙ বোঝার আগেই তারা টাকা উপার্জন করে টাকার শক্তি ও প্রতিপত্তি উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। সম্প্রতি টাকার সাদা, টাকার কালো নিয়ে এক প্রস্থ তর্ক হয়ে গেল আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে। কেউ বলতে পারেন, খারাপ টাকাকে কালো বলা বর্ণবাদী ব্যাপার। সাদা মানে ভালো আর কালো মানে খারাপ_ এ ধারণা থেকে বের হতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আপাতত বিতর্কটি তোলা থাকুক। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে কালো টাকার গ্রহণযোগ্য একটা নামও আবিষ্কৃত হয়ে যাবে। সরকারি দলের একজন নেতার অভিযোগ, বিরোধীদলীয় নেত্রী কালো টাকা সাদা করেছেন। খবর নতুন নয়, বিস্ময়করও নয়। আমাদের রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলাদের অনেকেই কালো টাকাকে সাদা করেছেন। বৈধভাবে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা আমাদের আছে। তারপরও লোকে কালো টাকা কালোই রাখেন। সাদা করে ঝামেলা বাড়াতে চান না। কিন্তু অর্থনীতিতে কালো টাকা সাদা করাটাকে ভালো চোখেই দেখা হয়। ফলে বিরোধীদলীয় নেত্রী কালোকে সাদা করলে সেটি ভালোই করেছেন। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এক বিরোধীদলীয় নেতা বললেন, নেত্রী সাদা টাকাকেই সাদা করেছেন। এখানেই তর্কের সূত্রপাত। সাদাকে সাদা করার দরকার পড়ে না। তবে তিনি কেন করলেন? মনে পড়ল, জনপ্রিয় অভিনেতা রিয়াজের সেই দেশব্যাপী বিজ্ঞাপনী অভিযানের কথা। সার্ফ এক্সেল ব্যবহার করে দেশের লোকেরা সাদাকে আরও কত সাদা করে তুলছেন তা দেখতে রিয়াজ দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরছেন সাদা মাপার যন্ত্র সঙ্গে নিয়ে। দেখাচ্ছেন, এক সাদার চেয়ে আরেক সাদা কত সাদা। হয়তো বিরোধীদলীয় নেতা তেমনি আরও সাদার কথা বোঝাচ্ছেন। বলা হয়ে থাকে, আমাদের অর্থনীতিতে নাকি সাদার চেয়ে কালো বেশি। কালো টাকা বন্ধ হলে নাকি অর্থনীতি থমকে যাবে। এমন এক পরিস্থিতিতে সাদাকে আরও সাদা করার উদ্যোগ নিশ্চয়ই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু সত্যিই কি সাদাকে সাদা করার কোনো উদ্যোগ কখনও চালু হয়েছিল দেশে? ভাবতে হবে। তবে হ্যাঁ, সব কালো তো একই রকম কালো নয়। রোজগারের টাকা থেকে কেউ যদি আয়কর না দেন তবে সেই টাকাও যেমন কালো টাকা হিসেবে গণ্য হয়, তেমনি উৎকোচের টাকাও কালো টাকা আবার লুটের টাকাও কালো টাকা। কোন কালো সবচেয়ে বেশি কালো সেটি নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলবে। বিরোধীদলীয় নেত্রী কালো টাকাকে সাদা করেছেন, নাকি অল্প সাদাকে সাদা করেছেন_ সে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ব্যাংক বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডই ভালো বলতে পারবে। তবে তর্কটা রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির ব্যাপারই এখন পর্যন্ত। এর পেছনে কারও কোনো সৎ উদ্দেশ্য দেখা যাচ্ছে না। যদি সৎ উদ্দেশ্য থাকত, তবে কে কবে টাকা সাদা করেছেন সে প্রশ্নের চেয়ে অন্য প্রশ্ন উঠত বেশি করে। তা হলো, সরকারদলীয় মন্ত্রী, এমপি, বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব স্পষ্ট করে জনগণের সামনে হাজির করত। মেয়াদ শেষে আবার আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়েই প্রস্থান করত। সেসব এ দেশে দূর ভবিষ্যতে হবে কি-না জানি না_ তবে এমন হাস্যকর বিতর্ক যে আরও হবে তা বলাই বাহুল্য।

No comments:

Post a Comment