Wednesday, October 27, 2010

পৃথিবীর একমাত্র সত্যি শহর_ ঢাকা :: শংকর


বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক শংকর সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) আমন্ত্রণে। এবারই প্রথম বাংলাদেশে এলেন শংকর। পুরো নাম মণিশংকর মুখার্জি হলেও কয়েক প্রজন্মের বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি প্রিয় লেখক শংকর নামে পরিচিত। ১৯৩৩ সালে যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায় ভাগ্যসন্ধানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই হাওড়ায় চলে আসেন। সেখানেই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা এবং সাহিত্যসাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে টাইপিস্ট, ক্লার্কসহ বিভিন্ন কাজ করেছেন। শংকরের বিখ্যাত উপন্যাস 'চৌরঙ্গী' নিয়ে তৈরি হয়েছে বিখ্যাত সিনেমা। সত্যজিৎ রায় তারই কাহিনী অবলম্বনে নির্মাণ করেছেন 'জনঅরণ্য' ও 'সীমাবদ্ধ'র মতো চলচ্চিত্র। ইংরেজি ভাষায় তার বিখ্যাত বইগুলো অনুবাদ হতে শুরু করেছে সম্প্রতি। ২০ অক্টোবর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আইইউবির স্থায়ী ক্যাম্পাসে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর শংকর কথা বলেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ, একরামুল হক শামীমও শেরিফ আল সায়ার।


সমকাল : এবারই প্রথম বাংলাদেশে এলেন?
শংকর : বাংলাদেশে এর আগে কখনও সাহিত্যিক হিসেবে আসিনি। পাঠকের সঙ্গে মিলতে এই প্রথম আমার বাংলাদেশে আসা।
সমকাল : আপনার জন্ম তো বাংলাদেশের যশোরে?
শংকর : না। বাংলাদেশে না। বনগ্রামে। বনগ্রাম তখন যশোরে ছিল। পরে পার্টিশনের সময় বনগাঁ আলাদা হয়ে গেছে।
সমকাল : তার মানে দেশভাগের পর এবারই লেখক হিসেবে প্রথম এলেন?
শংকর : দেশভাগের আগেও আসিনি।
সমকাল : কেন বাংলাদেশে এলেন না?
শংকর : যখন হিসাব করলাম তখন দেখলাম যে কলকাতার বাইরে বাঙালি পাঠকদের সন্ধানে আমার প্রথম দিনই গিয়ে উপস্থিত হওয়া উচিত ছিল অর্থাৎ সেই ১৯৫৫ সালেই। সেখানে পেঁৗছাতে আমার জীবনের ৫৫টি বছর কেটে গেল। কেন এই কাণ্ড হয়েছে আমি বলতে পারব না। এর কারণ আমি আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু ঘটে গেছে। যখন এখান থেকে টেলিফোনে নিমন্ত্রণ পেলাম, তখন আমি ভাবলাম, এটা কী হলো? 'বনলতা সেন' কবিতায় যেমন জিজ্ঞেস করা হয়েছে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?' সে কথাটিই মনে হলো তৎক্ষণাৎ। এক-একটা লোভ থাকে জীবনে; সেই লোভটাই ধরা দিল সামনে। প্রথম জীবনে বাবা আমাকে রেগে গিয়ে অকালপকস্ফ বলতেন। অকালপকেস্ফর ফল হলো_ আঠারো-উনিশ বছর বয়সে লিখে ফেললাম। কিন্তু তারপরই বোধহয় ওপরওয়ালা প্রতিশোধ নিলেন। দেখলাম জীবনের অনেক জিনিসপত্র দেরিতেই ঘটে চলেছে আমার ক্ষেত্রে। ৫৫ বছর আগে কী লিখেছি, সেটা হঠাৎ দিলি্ল-ইংল্যান্ড বিভিন্ন স্থান ঘুরে হঠাৎ ইংরেজি মাধ্যমে আবার আমাকে এমনসব জায়গায় এনে পেঁৗছে দিল যেখানে আমার বহুদিন আগেই উপস্থিত হওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, সেটা অন্য কথা।
সমকাল : এখানকার নিমন্ত্রণও তো ইংরেজি অনুবাদের সূত্রেই?
শংকর : শুনলাম এখানে আমাকে যারা ডেকেছেন, তারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে উৎসাহিত হয়ে আমাকে ডেকেছেন অর্থাৎ ইংরেজি ভাষার পাঠকদের প্রতিও আমার একটা কর্তব্য ঠেকে গিয়েছে। আজ সকালে আমি ভাবলাম_ ঢাকায় এসেছি, দুটো কথা বাংলায় বলব না, এটা কী করে হয়! সে জন্যই ওদের অনুমতি চাইলাম। ওরা সানন্দেই অনুমতি দিলেন। আমার জীবনের প্রথম পর্ব অর্থাৎ প্রথম বইটার কথা কিছু ওদের বলেছি। দ্বিতীয় পর্বটার ব্যাপারে ভেবেছিলাম, যেহেতু ইংরেজি মাধ্যমের আয়োজন; কয়েকটা কথা ইংরেজিতেই বলি। ইংরেজিতে বলার অসুবিধা অনেক। একবার ভাবতে হয় কী বলব, তারপর আবার ভাবতে হয় কেমন করে বলব। এটা শুধু ভাষার ব্যাপারে লজ্জা পাওয়া নয়। আমার এক বন্ধু সিলেটে আছেন। তিনি বললেন, তোমাদের তো খুব সুবিধে, যেখানে বক্তৃতা করতে যাও কী বলবে একটু ভেবে নিলে এবং বক্তৃতা করলে। আমি সিলেটি, আমাকে তো প্রথমে ঠিক করতে হয় কী বলব, তারপর সেটাকে বাংলায় ট্রান্সলেট করতে হয়। আমি বানিয়ে কিছু বলছি না। এখানে একটা জিনিস দেখে ভালো লাগল যে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি চর্চায় একটা প্রাণের স্পর্শ দেখতে পেলাম। আমার মনে হলো, এটা ভীষণ দরকার। ইংরেজি ছাড়া আমাদের চলবে না। ইংরেজিকে রেখেই আমাদের নিজস্ব সৃষ্টির আনন্দে মত্ত হতে হবে। এবং এটাও শেষ জীবনে এসে বুঝলাম যে, ইংরেজির মাধ্যমে না হলে বিশ্বের অন্যত্র পেঁৗছানো বড় কঠিন। এই চেষ্টা কীভাবে শুরু হয়েছিল? ঠিক একশ' বছর আগে। এই ১৯১০-১১ সালেই রবীন্দ্রনাথ তার ইংরেজি বই ছাপার জন্য কী করেছিলেন সেটা অনেকেই জানেন।
সমকাল : ঢাকায় এসে কেমন লাগছে?
শংকর : চমৎকার অনুভূতি হচ্ছে। এখানকার মানুষের আবেগ আমাকে স্পর্শ করেছে। ঢাকার অভিজ্ঞতা একই সঙ্গে আমার জন্য আনন্দের এবং সমীহের। আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছি। আমি মনে করি, যে লেখকরা জীবিত অবস্থাতেই তরুণ পাঠকদের কাছ থেকে স্বীকৃতি ও সম্মান পান তারা ভাগ্যবান।
সমকাল : কয়েকটি প্রজন্ম আপনার মুগ্ধ পাঠক। আপনার নিবিষ্ট পাঠকের তালিকায় পঞ্চাশ-ষাট দশকের মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন তরুণতর প্রজন্মের মানুষও। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কীভাবে পেঁৗছালেন?
শংকর : জানি না ভাই। দেখলাম, দেখে আনন্দ হলো এটা বলতে পারি। কোনো প্লান করে, পরিকল্পনামাফিক কিছু করিনি। হবে, এটাও ভাবিনি। পেলাম, এটাই জীবনের সার্থকতা।
সমকাল : আপনি যখন লিখতে শুরু করেন তখন বাংলা বই ও বাঙালি পাঠকের অবস্থা কেমন ছিল?
শংকর : আমার মনে হয় না কিছু বদলেছে। এসব তো শেয়ারমার্কেট নয় যে আজ একরকম, কাল একরকম। একটা ধারাবাহিকতা আছে। একটা নিবিষ্ট পাঠকগোষ্ঠী আছে, যারা বাংলা বই পড়তে পছন্দ করে। আর সংখ্যার দিক থেকে যদি বলেন আমরা যত মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলি তাতে আমাদের দাপট তো অনেক বেশি হওয়ার কথা ছিল। সেটার কতটুকু আর হয়েছে? ফরাসি দেশে ক'টা লোক থাকে, ইতালি-স্পেনে ক'টা লোক আছে? তাদের ভাষায় ক'টা লোক কথা বলে? সে তুলনায় আমাদের ভাষাভাষী মানুষের যে প্রাচুর্য রয়েছে তা তো আমরা এখনও কাজে লাগাতে পারিনি। ভাবুন, আমাদের ভাষায় ২৫ কোটি মানুষ কথা বলে।
সমকাল : সম্প্রতি আপনার সম্পর্কে ইন্টারনেটে খোঁজ-খবর করতে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে আপনাকে বাজার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলা হচ্ছে।
শংকর : এটা কে বলেছে আমি জানি না। কেন বলেছে তা-ও জানি না। আমি বইয়ের মার্কেটিং করিনি। যে যেটা করে না বা জানে না সে অভিধা দেওয়া আমাদের জাতীয় ধর্ম। এ প্রশ্নটা আমি একজনের কাছে শুনলাম। আমি বললাম, মার্কেটিং তো বিষয় নয়, ভালো লিখতে পারি কি-না সেটাই বিষয়। তখন বলল, এক ব্যাগ শংকর বের করেছিলেন, সেটা তো মার্কেটিং। আমি বললাম, তুমি কি বাংলা বইয়ের খবর রাখো? বলো তো, কোন বাংলা বইটা সবচেয়ে জনপ্রিয় এখন পর্যন্ত? সে বলল, কোনটা? আমি বললাম, 'ঠাকুরমার ঝুলি'। ঠাকুরমার ঝুলিই আমার বেলায় এসে ব্যাগ হয়েছে। এর মধ্যে মার্কেটিংয়ের কী আছে? যদি বলতে বাজে লিখে প্রতারিত করেছে লেখক তবে তা বলো। ইচ্ছা হলে বলো। আমি তো কোনো কিছু দাবি করিনি।
সমকাল : কিন্তু আপনি তো মার্কেটিং নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন।
শংকর : আমি বিশ্বাস করি বাঙালিকে ব্যবসায় আসতে হবে।
সমকাল : আপনি বলছিলেন, বিত্তসাধনার ব্যাপারে।
শংকর : হ্যাঁ, বিত্তসাধনায় আমি বাঙালির অগ্রযাত্রা দেখতে চাই। আর এজন্য লেখকদের কিছু ভূমিকা থাকতে হবে। আমরা তো আর কিছু পারি না, উৎসাহ দিতে পারি।
সমকাল : আপনি বলছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি পিছিয়েছে।
শংকর : শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, সব জায়গাতেই পিছিয়েছে। বিত্তসাধনায় আমরা পিছিয়ে গিয়েছি।
সমকাল :আপনি বলছেন এতদিন পর এলাম, এতদিন পর পুনরায় আবিষ্কৃত হলাম_ এবারের ভ্রমণ নিয়ে কি লিখবেন?
শংকর : লোভেরও তো একটা শেষ থাকা দরকার। লোকে বলবে, বুড়ো আর কতদিন জ্বালাবে। এতদিন নাকি একজন ভেবেছে যে, বুড়ো মরে গেছে। বিদায় হয়েছে আর কিছু করবে না। কিন্তু বেঁচে আছে শুনে বলছে, ওরে বাবা বেশি কিছু বলা যাবে না, তাহলে আবার কী করবে কে জানে। আবার গ্যাজ গ্যাজ করতে শুরু করবে। সেজন্য মধ্যদিনের পাখি অনেক সময় চায় গান বন্ধ হোক।
সমকাল : আপনি 'চৌরঙ্গী' লিখলেন। তারপর তো নিউমার্কেট হয়েছে। এখন তো শহর কত বদলেছে।
শংকর : বয়স একটু কম থাকলে নিউমার্কেট নিয়ে লেখা যেত, মন্দ হতো না। কারণ একে একটা যুগ বলতে পারেন। এই যে কতদিন ধরে কত মল-টল কী হচ্ছে! তাতে নিউমার্কেট টিকে থাকবে কি-না জানি না। কিন্তু ব্যবসায়ে বাঙালি, বিত্তের সাধনায় বাঙালির শেষ কতগুলো সাধনার চিহ্ন ওখানে থেকে গেছে। বাঙালির তো কিছুই থাকে না। সবই গেছে। আপনাদের এখানে দেখলাম, এখানে যত ভালো ভালো বাড়ি আছে সব নাকি বাঙালির। আমি বললাম, কেন ভাই আমাকে মিথ্যে কথা বলছ। আমাকে বলল_ না, এটা সত্যি। তার মানে পৃথিবীর একমাত্র সত্যি শহর ঢাকা, যেখানে এখনও বাঙালির বাড়িঘর সব কিছু রয়েছে। এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। আমাদের ওখানে আর সত্য নেই। আপনাদের এখানে এসে ভালো লাগছে। ফিউচার তো জানি না, তবে বর্তমান বলছে এগুলো বাঙালিদের বাড়ি। এটা কত বড় আনন্দের কথা তা আমি আপনাদের বিশ্বাস করাতে পারব না। ভীষণ আনন্দ পেলাম, জানেন? সত্যি, বিত্তসাধনায় বাঙালিকে আবারও জেগে উঠতে হবে।
সমকাল : লেখক হতে গেলে কী লাগে?
শংকর : লিখতে চাইলেই লিখবেন। এর জন্য তো লাইসেন্স লাগে না। মদের দোকান খুলতে গেলে লাইসেন্স লাগে, ড্রাইভিং করতে চাইলে লাইসেন্স লাগে। লেখক হতে গেলে কোনো অ্যাপ্লিকেশনও করতে হয় না।
সমকাল : আপনি কীভাবে লিখতে শুরু করলেন?
শংকর : সেটা পাকেচক্রে ঘটেছে। আমাদের পরিবার খুব সংগ্রামী ছিল। আমার বাবা যশোরের বনগাঁ থেকে কলকাতার কাছে হাওড়ায় মাইগ্রেট করেছিলেন। আমার বাবা অসুখে ভুগে মারা গিয়েছিলেন তিন সন্তান রেখে। আমি আমার বাবার দ্বিতীয় বিবাহের দ্বিতীয় সন্তান। আমার তেরো বছর বয়সে বাবা মারা যান। আমার মা ইন্স্যুরেন্স পলিসির ওপর ভর করে সংসার চালাতেন। আমার বয়স যখন ১৬ তখন মা আমাকে বলেছিলেন, আমাকে আয় করতে হবে। তখন আমার দেখা হলো নোয়েল ফ্রেড্রিক বারওয়েলের সঙ্গে। তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এবং ব্রিটিশ বারের সদস্য। তার দফতরে আমি ক্লার্ক হিসেবে যোগ দিলাম। বারওয়েলের উৎসাহে তার দফতরে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আমি লিখলাম আমার প্রথম বই। এভাবেই ৭০ রুপি মাসিকে চাকরি করা একটি বালক লেখক হয়ে গেল। আমার অনুতাপ একটাই, আমার নামের মণিশংকর মুখার্জির প্রথম ও শেষ অংশ কেটে ফেলে শুধু শংকর নামেই বের হলো 'কত অজানারে'। ৫০ বছর পরও বইটির কথা মানুষ মনে রেখেছে, এটা আমার আনন্দ। আরও খুশীর ব্যাপার হলো ঢাকা থেকে ফিরে নভেম্বরেই আমি বইটির ইংরেজি অনুবাদ দেখতে পাব। দেরিতে হলো, তবু ভালো।
১৯৫৪ সালে আমি দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে 'কত অজানারে' লিখতে শুরু করেছিলাম। লেখাটি পাঠকপ্রিয় হয়েছিল এবং সেটাই আমার কাল হলো। দেশ পত্রিকার একজন শ্রদ্ধেয় বড় কর্তা চাইলেন বিনাপয়সায় আমি যেন বইটি একজন প্রকাশককে ছাপতে দিই। আমাকে না জানিয়েই তিনি প্রকাশের ব্যবস্থা করে ফেললেন। দেরি না করে বইপাড়ায় গিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বললেন। আমি ছিলাম গরিব কেরানি। আমি তাকে না বলতে পারিনি।
সমকাল : আপনি শহুরে জীবন নিয়ে লিখেছেন মূলত।
শংকর : একটা শহরকে বুঝতে হলে দেখ, সেখানে মানুষের অবস্থা কী? হাউ দে লিভ, লাভ, লাই এবং ডাই। লাই শোয়া অর্থে, আবার মিথ্যা অর্থেও। এই চারটি ব্যাপার খেয়াল করলে একটি শহর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আমি শহরকেই জানি, শহরেই থেকেছি। সেটাই লিখেছি। যে যা জানে তাকে তো সেটুকুর মধ্যেই থাকতে হবে।
সমকাল : শহুরে মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে আপনি বাংলা ভাষায় অগ্রগণ্য সাহিত্যিক।
শংকর : আমার বিশেষ কিছু দাবি নেই। আমি সেটা বলব না। পাঠকরা ভালোবেসেছে সেটাই আমার সম্বল। তখন বোদ্ধারা বলত বাজে লেখা। এখন সাহেবরা বলছে, তাই হয়তো তাদের মত বদলেছে। তাদের মনে হচ্ছে, তাহলে বোধহয় কিছু থাকলেও থাকতে পারে এর লেখার মধ্যে।
সমকাল : বাংলা ভাষায় আপনার প্রিয় লেখক কারা ছিলেন?
শংকর : অনেকেই ছিলেন। মৃতদের মধ্যে গুরু শরৎচন্দ্র। আর জীবিতদের মধ্যে যাদের পেয়েছি তাদের মধ্যে বিমল মিত্র আছেন, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। আলী সাহেব আছেন। সৈয়দ মুজতবা আলী। এদের সঙ্গে আমার যথেষ্ট দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল।
সমকাল : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
শংকর : আপনাদেরও ধন্যবাদ।

Tuesday, October 26, 2010

পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসটি পড়া থাকুক বা না থাকুক, উপন্যাসের একটি লাইন অনেকেরই জানা। 'পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো?' নবকুমার সহযাত্রীদের রান্নাবান্নার সহযোগিতা করার জন্য বনে গিয়েছিল। তার ফিরে আসার দেরি দেখে সহযাত্রীরা ভেবেছিল, নবকুমারকে বাঘে খেয়েছে। তারা নদীর ধারের নির্জন বনে নবকুমারকে রেখে বাড়ি ফিরেছিল। আর নবকুমার বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে সহসা এ প্রশ্নের মুখে পড়েছিল যে, সে পথ হারিয়েছে কি-না? প্রশ্ন করেছিল কপালকুণ্ডলা, উপন্যাসের নায়িকা। এই প্রশ্নের পর নবকুমারের জীবন ও 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাস উভয়ের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। কিন্তু সে কাহিনীর পিছু ধাওয়া করা এখন আমাদের উদ্দেশ্য নয়। পথিকের পথ হারানোর এই কৌতুক ও শ্লেষপূর্ণ বাক্য কেন আমাদের সমাজে এত জনপ্রিয় হলো সেটাই প্রকারান্তরে আমাদের জিজ্ঞাস্য। বাঙালির সমাজ-ইতিহাস গভীর অভিনিবেশ সহকারে পর্যালোচনা করেন তাদের অনেকেই বলেন, বাঙালি পথহারা। অর্থাৎ যে পথে এই জাতির চলার কথা ছিল সে পথে তারা এগিয়ে যেতে পারেনি। কি রাষ্ট্রে, কি রাজনীতিতে, কি ব্যবসায়, কি শিল্পায়নে, কি সাহিত্যে বাঙালির নাকি প্রভূত উন্নতি করার কথা ছিল। কিন্তু বাঙালি তেমন কিছু করতে পারেনি। আজকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক জাতির বাঙালির চেয়ে কম সম্ভাবনা ও মেধা নিয়ে উন্নতির শিখরে পেঁৗছে গেছে। কিন্তু বাঙালির ভাগ্য যে লাউ সেই কদুই রয়ে গেছে। কারণ, আমরা নাকি পথভ্রষ্ট। ভুল পথে এগোতে গিয়ে সহসা থমকে পেছনে ফিরে কেঁচে গণ্ডূষ করাই নাকি আমাদের রীতি। বাংলাদেশ আকারে ছোট। এখানে শহর হোক কি গ্রাম সেখানে পথ হারিয়ে ফেলা বড় কষ্টকর। নিতান্তই শিশু ও ভুলোমন না হলে বাংলাদেশে কোথাও পথ হারানো কষ্টের কাজ। তারপরও 'পথহারা পথিক' আমাদের প্রিয় শব্দবন্ধ। আমাদের কত কবিতা গানে যে পথ হারানোর কথা আছে সে নিয়ে বিশাল গবেষণা হতে পারে। অনেকের মনে পড়বে কবি রবীন্দ্রনাথের গানের সেই বাণী_ 'আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি/ সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো/সকাল বেলার মলি্লকা/আমায় চেন কী?' পথিক নিজেই বলছেন এখানে যে, তিনি পথ হারিয়েছেন। কিন্তু পথ খোঁজার কোনো চেষ্টা নেই, তিনি বরং মলি্লকা-চামেলিরা তাকে চিনতে পারল কি-না এ নিয়েই চিন্তিত। বেশ বোঝা যাচ্ছে, পথ হারানো আমাদের কাছে কতটা প্রার্থিত, কতটা আয়াসসাধ্য এবং কত রোমান্টিক ব্যাপার। কেউ কেউ বলেন, বাঙালির যৌথ অবচেতনার ভেতরই নাকি পথ হারানোর ব্যাপারটি কাজ করে। জাতিগতভাবে পথ হারাবার কোনো সমাধান নেই, ফলে ব্যক্তিগতভাবে পথ হারাতেই আমাদের আনন্দ। আমাদের মহাজনরা যে পথে পথ হারিয়েছেন, সে পথেই পথ হারাতে পেরে আমরাও খুশি। কিন্তু মহাজনরা যদি শুনতেন যে, বাঙালির অন্যতম বৃহত্তম নগরী ঢাকায় পথ নিজেই হারাতে বসেছে, তবে কী ভাবতেন? সোমবারের সমকালে সচিত্র একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, পথিকের পথ দখল হয়ে গেছে। কোথাও গাড়ি পার্কিং, কোথাও হকার, কোথাও নর্দমা, কোথাও ডাস্টবিন। কত কি যে পথিকের পথ দখল করে বসে আছে! এ শহরে কেউ যদি হেঁটে গন্তব্যে পেঁৗছাতে চায় তবে সে কাজ যে কতটা ক্লেশকর হবে তা একবার পথে নামলেই বোঝা যায়। শহরে সত্যি পায়ে চলার পথ নেই। গাড়ি চলার পথ কি আছে? সে প্রশ্নের সুরাহা করতে হলে আরও বড় আলোচনা ফাঁদতে হবে। পত্রিকায় ইদানীং কিছু লেখা চোখে পড়ল, তাতে লেখক বলছেন, ঢাকায় সাইকেল চালাবার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এমন দখল হওয়া রাস্তায় বসে সাইকেল চালানোর চিন্তা_ ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার মতো ঘটনাই বটে। বাংলার পথিক এতদিনে এসে পথ হারাইয়াছে, এই ঢাকা শহরে। আগে পথ ছিল, পথিক পথে দিকদিশা হারাইতো। আমাদের মহাজনরা তাকেই বলতেন পথ হারানো। এখন পথিক সত্যই পথ হারাইয়াছে। কিন্তু মহাজনরা
নাই, এ হারানো সংবাদ নিয়া
কে লিখিবে?

Thursday, October 21, 2010

বিত্ত সাধনায় বাঙালির অগ্রযাত্রা দেখতে চাই :শংকর


বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক শংকর এখন ঢাকায়। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) আমন্ত্রণে ছয় দিনের সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল তিনি তার বিখ্যাত উপন্যাস 'চৌরঙ্গী' রচনার প্রেক্ষাপটসহ লেখালেখি ও জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এবারই প্রথম বাংলাদেশে এলেন শংকর। পুরো নাম মনিশংকর মুখার্জি হলেও কয়েক প্রজন্মের বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি প্রিয় লেখক শংকর নামে পরিচিত। সমকালকে জানান, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে গেছেন অনেকবার, বিমানবন্দরে নেমেছেন; কিন্তু লেখক হিসেবে বাংলাদেশে আসা এই প্রথম। দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, দেশ পত্রিকায় 'কত অজানারে' প্রকাশ শুরু হওয়ার পর সেই ১৯৫৫ সালেই তার বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) আসার কথা ছিল। কিন্তু লেগে গেল আরও ৫৫টি বছর। কারণ হিসেবে দায়ী করলেন ভাগ্যের বিড়ম্বনাকে। জিজ্ঞেস করা হলো, লোকে
আপনাকে বই বিপণনের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করে। আপনি কয়েক প্রজন্মের লাখো পাঠকের কাছে কীভাবে পেঁৗছলেন? তিনি বললেন, পাঠক ভালোবেসে বই পড়েছে। কেন পড়েছে সে কথা কী আমি জানি? যারা বিপণনের পথিকৃৎ বলে তারা হয়তো আমার সাহিত্যের কাটতির দিকে ইঙ্গিত করে। তারা তো আমাকে সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না। এখন ইংরেজরা আমার মূল্যায়ন করছে বলে তাদের আগ্রহও বেড়েছে।
প্রাণবন্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ভক্ত-পাঠকরা তাকে প্রশ্ন করলে স্বভাবসুলভ শান্তভঙ্গিতে হাস্যরসের মধ্য দিয়ে তিনি উত্তর দেন। পাঠকদের প্রশ্নের উত্তরে শংকর বলেন, 'বাঙালি সর্বত্রই বিত্তের সাধনায় পিছিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের কথা জানি না, তবে পশ্চিমবঙ্গে তারা পিছিয়ে পড়েছে। আমি বিত্তসাধনায় বাঙালির জয়যাত্রা দেখতে চাই।' তিনি লন্ডন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, সেখানে গিয়ে তিনি বাংলাদেশিদের পরিচালিত রেস্টুরেন্ট দেখতে গিয়েছিলেন। তার মতে, আজ যে চিকেন টিক্কা মাসালা ইংল্যান্ডের জাতীয় ডিশে পরিণত হয়েছে এটি ইংরেজের ওপর আমাদের মধুর প্রতিশোধ। আর এ প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার শুধু বাঙালির আছে।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আইইউবির স্থায়ী ক্যাম্পাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুরুতেই লেখককে স্বাগত জানান অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা খান। সম্মানসূচক 'উত্তরীয়' পরিয়ে দেন আইইউবির উপাচার্য অধ্যাপক বজলুল মোবিন চৌধুরী। অনুষ্ঠানে দর্শকসারিতে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসেছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ফারুক চৌধুরী, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, ফারুক সোবহান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখ। প্রশ্নোত্তর শেষে যখন অটোগ্রাফ নেওয়ার পালা এলো তখন পিছিয়ে ছিলেন না বিশিষ্ট অতিথিরাও।
১৯৩৩ সালে যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায় ভাগ্যের সন্ধানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর আগেই হাওড়ায় চলে আসেন। সেখানেই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা এবং সাহিত্য-সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে টাইপিস্ট, ক্লার্কসহ বিভিন্ন কাজ করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায় লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম বই বের হওয়ার সময় তার বয়স ছিল আঠারো। বয়স কম বলে প্রকাশকের পরামর্শে লোকের সামনে লেখক পরিচয় দিতেন না। প্রকাশক বলেছিলেন, চেহারায় নয়, গল্পের মাধ্যমেই পাঠক তাকে চিনবে।
শংকরের বিখ্যাত উপন্যাস 'চৌরঙ্গী' নিয়ে তৈরি হয়েছে বিখ্যাত সিনেমা। সত্যজিৎ রায় তারই কাহিনী অবলম্বনে নির্মাণ করেছেন 'জন অরণ্য' ও 'সীমাবদ্ধে'র মতো চলচ্চিত্র। ইংরেজি ভাষায় তার বিখ্যাত বইগুলো অনুবাদ হতে শুরু করেছে সম্প্রতি। শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের সাহিত্যিক রূপায়ণে তাকে পথিকৃৎ হিসেবে উল্লেখ করেন সমালোচকরা। কেন শহুরে জীবন তার লেখার বিষয় হলো? এ প্রশ্নের উত্তরে শংকর অসঙ্কোচে জানান, আর কিছু যে জানি না। ওই জীবনও যে ভালো করে জানি সেও বলতে পারি না।
স্বভাবে ভীষণ বিনয়ী, মার্জিত ও নিরহঙ্কারী লেখক বললেন, লেখকের মধ্যে আত্মপ্রসাদ সৃষ্টি হলে তার বিষময় ফল তৈরি হয়। লেখক শংকর ২৪ অক্টোবর সকালে ঢাকা ত্যাগ করবেন।