Wednesday, December 15, 2010
কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে মনে হলো বাংলাদেশে ফিরেছি : অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম
মাহবুব মোর্শেদ
১৯৭১ সালে রফিকুল ইসলাম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ২৫ মার্চ দেখেছেন পাকিস্তানিদের বর্বরতম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। জুলাই থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে শেরেবাংলা নগরের ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে বন্দি রেখেছিল। সেপ্টেম্বরে স্থানান্তরিত করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বিচিত্র সেই অভিজ্ঞতা, অবরুদ্ধ ঢাকার ঘটনাবলি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
...................................
অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৪ সালে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ২৫ মার্চ তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায়। জুলাই মাসে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে রাখে, সেপ্টেম্বরে তাকে স্থানান্তর করে কেন্দ্রীয় কারাগারে, নভেম্বরে মুক্তি পান, ডিসেম্বরের প্রথম দিকে চলে যান আত্মগোপনে। বিচিত্র সেই অভিজ্ঞতা, অবরুদ্ধ ঢাকার ঘটনাবলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ
সমকাল : ২৫ মার্চ আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় ছিলেন। সে রাতে সেখানে কী ঘটেছিল?
রফিকুল ইসলাম : সে সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত অঞ্চলে থাকতাম। বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের পাশে তখন ৩টি বাড়ি (২৩, ২৪ ও ২৫ নম্বর) ছিল। আমি ২৪ নম্বর বাড়িতে থাকতাম। ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী সারারাত গোলাগুলি করার পর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। ইকবাল হলের ঘরে ঘরে ঢুকে শিক্ষক-ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে। ২৩ নম্বর বাড়িতে ড. ফজলুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। তার বাড়ির ছাদে আরও ৪৪ জন নিহত হয়। পাক হানাদার বাহিনী নীলক্ষেত বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দিলে এসব মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য ওই বাড়ির ছাদে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। এখানে এসে তাদের অনেকে নিহত হয়। ইয়াহিয়া খান তখন ঢাকায়। মিন্টো রোডের পুরনো গণভবনে ছিলেন তিনি। কিছু ইপিআর সৈন্য ইয়াহিয়া খানের বাড়ি পাহারা দিচ্ছিল। তারা কেউ কেউ সেখান থেকে পালিয়ে আসে। পালিয়ে আসা ইপিআর সদস্যদের রমনা মাঠে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাদের কয়েকজন ২৩ নম্বর বাড়িতে এসে মারা পড়েন। হানাদার বাহিনী আমাদের ২৪ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতেও অনেককে হত্যা এবং আহত করে রেখে চলে যায়। ২৫ নম্বরের সিঁড়িতেও অনেক নিহত লোক পাওয়া যায়। ২৫ মার্চ সারারাত, ২৬ মার্চ সারাদিন ও রাত এই আক্রমণের মধ্যেই আমরা ছিলাম। জাহানারা ইমাম আমার ছাত্রী ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালবেলা তিনি ও রুমী এসে একটি ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে আমাকে আমার পরিবার-পরিজনসহ ধানমণ্ডিতে ওর মায়ের বাড়ি নিয়ে যান। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছিল ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মনিরুজ্জামান, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ড. ফজলুর রহমানসহ আরও অনেক শিক্ষককে। আবার যুদ্ধ শেষে আত্মসমর্পণের আগে তারা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, পাক হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে এবং শেষও করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে। প্রথম হত্যাকাণ্ডটি পাকবাহিনী নিজেরাই ঘটায়। আর শেষ হত্যাকাণ্ডটি তারা ঘটিয়েছিল তাদের এদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে। তারাই খুঁজে খুঁজে বের করে বুদ্ধিজীবীরা কে কোথায় আছেন।
সমকাল : আপনারা ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করেছেন?
রফিকুল ইসলাম : আমার বাবা থাকতেন আর কে মিশন রোডে। একদিন রাতে ওখানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। খাট থেকে নিচে শুতে গিয়ে আমার বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার ভাই-বোন (আতিকুল ইসলাম এবং মাসুমা খাতুন) তখন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে থাকত। কারফিউর মধ্যে গাড়ি চালিয়ে এসে ওরা বাবাকে মেডিকেলে ভর্তি করায়। আমি লুকিয়ে ছিলাম। বাবাকে দেখাশোনা করার জন্য আমাকে বেরুতে হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে চলে এলাম, যাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি বাবাকে দেখাশোনা করতে পারি। মেডিকেলে তখন মাঝে মধ্যেই আর্মিরা আসত। সবসময় একটা ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করত। আর্মিরা এসে সবকিছু চেক করত। সেখানে তখন কিছু অবাঙালি ডাক্তার ছিল। তারাই পরে ডা. ফজলে রাব্বী এবং ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীকে ধরিয়ে দেয়। আর্মি এসে চেক করত কারা রোগী এবং কারা ভিজিটর। বাবাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। তিনি মারা যাওয়ার পর জুলাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৪ শিক্ষকসহ আমি গ্রেফতার হই। আমার সঙ্গে যারা গ্রেফতার হন তারা হলেন ইতিহাস বিভাগের ড. আবুল খয়ের, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সা'দ উদ্দিন, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আহসানুল হক এবং গণিত বিভাগের অধ্যাপক শহীদুল্লাহ। আর্মি সদস্যরা এসে মধ্যরাতে আমাদের ধরে নিয়ে যায়। ডা. ফজলে রাব্বী আমার বাবার চিকিৎসা করতেন। তিনি আমাকে বলতেন, চলুন আমরা বর্ডার ক্রস করে চলে যাই। আমি বললাম, বাবাকে এ অবস্থায় রেখে কী করে যাব? বাবা মারা যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা গ্রেফতার হয়ে যাই। কাজেই আমরা বর্ডার ক্রস করতে পারিনি।
সমকাল : আপনাদের কোথায় রেখেছিল?
রফিকুল ইসলাম : শেরেবাংলা নগরে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডো ইউনিট ছিল। তার মাঝখানে ছিল তাদের ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টার। সেখানে ধরে নিয়ে গিয়ে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করত। সেখানে আমাদের মাসের পর মাস বন্দি রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমাদের আলাদা আলাদা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ওটাকে তখন বলা হতো ভিআইপি কেজ বা ভিআইপি খাঁচা। ওখানে কিছু আর্মি অফিসার, কিছু সিএসপি অফিসার_ যারা ডিসি অথবা এসপি ছিলেন, রাজনীতিবিদ, বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ জনের মতো আমরা সেখানে বন্দি ছিলাম। এসও কোম্পানির কর্মকর্তা আলমগীর রহমান, ফরিদপুরের ডিসি ইউসুফ, কুষ্টিয়ার এসপি মিহির, টেলিকমিউনিকেশন্সের প্রধান লোকমান হাকিম এবং আরও অনেকেই সেখানে ছিলেন। পরে আমাদের মুক্তির জন্য একটা আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়। সে কারণেই সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাসে তারা আমাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করে। যার ফলে আমরা প্রাণে বেঁচে যাই। শেরেবাংলা নগরের ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে থাকলে আমরা হয়তো বেঁচে নাও থাকতে পারতাম। ডিসেম্বরে ভারতীয় বিমানের হামলায় ভবনটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও নিয়মিত তেজগাঁওয়ে আর্মির কার্যালয়ে গিয়ে হাজিরা দিতে হতো।
সমকাল : জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা কী জানতে চাইত?
রফিকুল ইসলাম : শুরুর দিকে প্রতিদিন জিজ্ঞাসাবাদ করত। সারাদিন একটা ঘরে দাঁড় করিয়ে রেখে কয়েকজন মিলে জিজ্ঞাসাবাদ করত। তারা সবাই ছিল সিভিল ড্রেসে। কখনও আর্মি অফিসার, নেভি অফিসার, এয়ারফোর্স অফিসার, পাঞ্জাব পুলিশের অফিসার এবং কখনও স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করত। নানা বিষয়ে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করত। তবে জিজ্ঞাসাবাদে বঙ্গবন্ধুর বিষয়টি ছিল কমন। এছাড়া জঘন্য কিছু বিষয়ে তারা প্রশ্ন করত, যা বলার মতো নয়। গালি দিত। তারা যে অসভ্য ও বর্বর তা তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভাষায় ফুটে উঠত। ওরা উর্দুতে জিজ্ঞাসাবাদ করত আর আমরা ইংরেজিতে উত্তর দিতাম। এতে ওরা ভীষণ বিরক্ত হতো। ওরা ওদের পক্ষে একটা স্টেটমেন্টে সাইন করাতে চেয়েছিল। কাগজে কী লেখা আছে সেটি আমাদের পড়তে দিত না, শুধু সাইন করতে বলত। শত চাপ সত্ত্বেও তারা সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত শান্তি কমিটির মৌলবি ফরিদ আহমদকে পাঠায়। সে এসে বলল, মাস্টার সাহেব আপনারা এত কষ্ট করছেন কেন। একটা সাইন দিলেই তো আমি আপনাদের বাড়িতে পেঁৗছে দিতে পারি। তখন আমি বললাম, আপনি এসেছেন এজন্য ধন্যবাদ। তবে আমরা চাই না যে আমাদের সন্তানরা জানুক তাদের পিতারা দালাল ছিল। আমরা তো ধরেই নিয়েছি আপনারা আমাদের মেরে ফেলবেন। কাজেই আমরা পাঁচজন শিক্ষক কোনো কাগজে স্বাক্ষর করিনি। তারা আমাদের শারীরিক নির্যাতন করেছে। কিন্তু তারপরও আমাদের দ্বারা কোনো কাগজে স্বাক্ষর করাতে পারেনি।
সমকাল : ভিআইপি কেইজ থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে কী দেখলেন?
রফিকুল ইসলাম : শেরেবাংলা নগর থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার সময় আমাদের মনে হচ্ছিল যেন দোজখ থেকে বেহেশতে যাচ্ছি। কেন্দ্রীয় কারাগার তখন মানুষে ভরে গিয়েছিল। বন্দিদের মধ্যে মূলত রাজনৈতিক কর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাই ছিল বেশি। আমরা সেখানে পেঁৗছলে ছাত্ররা আমাদের মাথায় তুলে নিল। আমাদের পেয়ে তারা অনেক যত্ন করল। হৈ-হুল্লোড় জুড়ে দিল। কেন্দ্রীয় কারাগারে পেঁৗছে মনে হলো বাংলাদেশে ফিরেছি। মনেই হয়নি যে আমরা জেলে আছি।
সমকাল : জেলখানা থেকে বের হয়ে ঢাকার পরিস্থিতি কী দেখলেন?
রফিকুল ইসলাম : নভেম্বরের সে সময়টিতে ঢাকা শহরের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। গোটা শহর ছিল বিরানভূমির মতো। কেউ এক ঠিকানায় দু'তিন দিনের বেশি থাকছে না। ভারতীয় বাহিনীর বোম্বিং শুরু হওয়ার পর অবস্থা আরও ভয়াবহ আকারে রূপ নিল। হানাদাররা কখন, কোথায় কাকে হত্যা করছে, তুলে নিয়ে যাচ্ছে, বন্দি করছে তার কোনো ঠিক ছিল না। হানাদার আর্মিদের চেয়েও বেশি অত্যাচার করত বিহারি রাজাকাররা।
সমকাল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি কেমন ছিল?
রফিকুল ইসলাম : যুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। তবে জুন মাসে জোর করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলানো হয়েছিল। ইউনিভার্সিটি খোলার পর সেখানে প্রতিদিন গ্রেনেড হামলা হতো। ইসলামী ছাত্র সংঘের কিছু ছাত্র ক্লাসে আসত। কিছু মুক্তিযোদ্ধাও ক্লাস খোলা থাকার সুযোগে ঢুকে যেত। বাথরুমে কিংবা অন্য কোনো ছলে বাইরে গিয়ে তারাই ওপর থেকে নিচে বোমা ফেলত। খুব বিকট আওয়াজ হতো সেসব বোমার। বোমা হামলার পর আর্মি আসত। কিন্তু কারা বোমা হামলা করল সেটা তারা কোনোদিন বের করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেউই নিজেদের বাড়িতে থাকতেন না। সবাই এদিক-সেদিক থাকতেন।
সমকাল : আবাসিক হলগুলোর পরিস্থিতি কেমন ছিল?
রফিকুল ইসলাম : একটি বিশেষ ঘটনার কথা আমার মনে আছে। নভেম্বর শেষ দিকে পাক আর্মি রোকেয়া হলে তল্লাশি চালায়। সেখানে কয়েকজন মেয়েকে ধর্ষণ করে। আমার মনে হয় ওরা হলে থেকে গিয়েছিল এবং সম্ভবত ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে জড়িত ছিল। ঘটনাটি সবাই একেবারে চেপে যায়। ওয়াশিংটন ডিসিতে লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে ডন পত্রিকার ফাইল থেকে খবরটি আমি বের করেছিলাম পরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ঘটনাটি চেপে গেছে। মেয়েদের পরে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। মিসেস আলী ইমাম তখন ছিলেন হাউস টিউটর। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমার কাছে কোনো কিছু বলেননি। আমার এক ছাত্রী আরবি বিভাগের শিক্ষিকা ও হাউস টিউটর ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমার কাছে ঘটনাটি স্বীকার করেন।
সমকাল : বাংলাদেশবিরোধী শিক্ষকদের তৎপরতা কেমন ছিল?
রফিকুল ইসলাম : উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী তখন লন্ডনে ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনকে উপাচার্য করে নিয়ে আসা হয়। তিনি পাকিস্তানিদের বিশ্বস্ত ছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ড. হাসান জামান পাকিস্তানিদের খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশনের (বিএনআর) পরিচালক ছিলেন। টিক্কা খান এটাকে ইনস্টিটিউট ফর পাকিস্তান স্টাডিজ নামে একটি ইনস্টিটিউটে পরিণত করে। এর অফিস ছিল তখন আবদুল গনি রোডের ১ নম্বর বাড়িতে। ওই জায়গাটা তখন ছিল দালাল শিক্ষকদের আখড়া। পাকিস্তান আর্মি সব সময় হাসান জামানের বাড়ি পাহারা দিত। সে ছাড়া আরেকজন ছিল ইতিহাস বিভাগের ড. মোহর আলী। তারা পাকিস্তানের পক্ষে টেলিভিশনে নানা রকম অনুষ্ঠান করত। শিক্ষকদের সম্পর্কে পাকিস্তানিদের খোঁজখবর দিত তারাই। পরে এরা দেশত্যাগ করে চলে যায়। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন পরে দেশে আসেন। হাসান জামান সম্ভবত মারা গেছেন এবং মোহর আলী সম্ভবত সৌদি আরবে আছেন।
সমকাল : আর্মিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করেছিল?
রফিকুল ইসলাম : টিএসসির দিকে তাদের একটা ক্যাম্প ছিল। সবসময় জিপে টহল দিত। আমরা তখন নিজ দেশে পরবাসী ছিলাম। দেশটা ছিল একটা মৃত্যুপুরী।
সমকাল : কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর সেনানিবাসে হাজিরা দিতে গেলে তারা আপনাদের কী জিজ্ঞেস করত?
রফিকুল ইসলাম : আর্মি অফিসাররা আমাদের দু'একটা প্রশ্ন করত। নিজেদের মধ্যেই তারা কথা বলত বেশি। পরিস্থিতি নিয়ে তারা আলোচনা করত। না জানি কী হয়ে যায়, এমন কথাও আমার কানে এসেছিল। ওদের মধ্যে তখন ভয় ঢুকে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা ঘেরাও করে ফেলেছিল। পাকিস্তানি অফিসারদের তখন খুব নার্ভাস মনে হতো।
সমকাল : সর্বশেষ হাজিরা দিয়েছেন কবে?
রফিকুল ইসলাম : সর্বশেষ হাজির দেই ডিসেম্বরের ৯ তারিখে। ১০ ডিসেম্বর আমার বোন মাসুমা খাতুন আমাকে একটা ঠিকানা দিয়ে বলল, এখনই তুমি এই ঠিকানায় চলে যাও। পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলছে, পালাও। এরপর আমি সপরিবারে পুরান ঢাকার কাছে চুড়িহাট্টায় এক গ্যারেজে গিয়ে আশ্রয় নিলাম।
সমকাল : কত দিন থাকলেন?
রফিকুল ইসলাম : যুদ্ধের শেষ চার দিন আমরা ওখানেই ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর আমি ছিলাম চুড়িহাট্টায়। সেদিন বের হতে পারিনি। আমি বের হই ১৭ তারিখে।
সমকাল : ঢাকায় ফিরে কী দেখলেন?
রফিকুল ইসলাম : ঢাকায় ফিরেই জানলাম, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, গিয়াস উদ্দিন আহমদ_ তারা নেই। আমাদের কোনো বিজয় উৎসব ছিল না। আমরা তখন লাশের সন্ধানে ব্যস্ত। আমাদের ডিসেম্বর কেটেছে সহকর্মীদের লাশ খুঁজে। কখনও মিরপুর আবার কখনও মোহাম্মদপুরে ছুটে গেছি। যেখানেই খবর পেয়েছি একটা লাশ পাওয়া গেছে সেখানেই আমরা ছুটে গিয়েছি।
সমকাল : রায়েরবাজারে গিয়ে কী দেখেছিলেন?
রফিকুল ইসলাম : রায়েরবাজার গিয়ে খুব কম লোককেই আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। কারণ, ততক্ষণে লাশগুলো শিয়াল, কুকুর এবং শকুন খেয়ে ফেলেছে। কাউকে ঠিকমতো চেনা যাচ্ছিল না। অনেককে মিরপুর নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের লাশ কোনোভাবেই পাওয়া যাচ্ছিল না। যে বাসে করে তাদের মিরপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই বাসের ড্রাইভারকে টাঙ্গাইল থেকে ধরে আনার পর সে আমাদের জায়গাটি দেখিয়ে দেয়। সেখানে আমরা কাদা লেপা একটি বাসও দেখেছিলাম। মিরপুরে আমরা ১১টি লাশ পাই। লাশগুলো শনাক্ত করে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে দাফন করা হয়।
সমকাল : ডিসেম্বরের শেষ দিকের পরিস্থিতি কেমন ছিল?
রফিকুল ইসলাম : ১৬ ডিসেম্বরের পর সব মানুষ ঢাকায় ফিরতে শুরু করে। কে বেঁচে আছে, কে মারা গেল, মুক্তিযুদ্ধে যারা গেছে তারা ফিরল কি-না এসব নিয়ে খোঁজখবর শুরু হতে থাকে। মানুষের মনে আরেকটি জিজ্ঞাসা ছিল_ বঙ্গবন্ধুর কী হলো? তিনি কবে দেশে ফিরবেন? ১০ জানুয়ারির আগে একদিন গুজব রটল বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরছেন। তখন গোটা ঢাকা শহরের মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি শুরু হলো। মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের দিকে অস্ত্র তাক করে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করল। বঙ্গবন্ধু যেদিন ধানমণ্ডিতে ফিরে আসেন বিজয় উৎসবটা সেদিনই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বিজয় তখন পরিপূর্ণ ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া মানুষ বিজয় উৎসব করেনি।
সমকাল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক গতি ফিরে এলো কবে?
রফিকুল ইসলাম : আমার যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে। মোজাফফর আহমদ চৌধুরী উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ১৬ ডিসেম্বরের পরপরই শিক্ষক-ছাত্ররা ফিরতে শুরু করেছিলেন। তখন থেকেই কোন বিভাগের কোন কোন ছাত্র-শিক্ষক ফিরল আর কে কে ফিরল না সেসব সম্পর্কে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছিল।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment