Thursday, January 13, 2011

এখন প্রগাঢ় শীত পৃথিবীতে


photo : soulsshine
একদেশদর্শিতা বলে একটি চমৎকার শব্দ আছে বাংলায়। যেখানে আছি সেখানকার সময়, স্থান, মানুষ ও প্রকৃতিকেই সারা পৃথিবীর বাস্তবতা বলে ভাবা একদেশদর্শিতার একটা নমুনা। আমাদের জনপ্রিয় গানে আছে, দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও-দাও ফুর্তি করো। মস্ত বড় দুনিয়াটা কত মস্ত সে ধারণা আমাদের নেই। কখনও শুনি আধুনিক প্রযুক্তি দুনিয়াটাকে হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। কখনোবা শুনি দুনিয়াটা অধিকাংশ মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। সে যা-ই হোক, যখন শীতের কথা ওঠে তখন পৃথিবী বলতে আমরা হয়তো উত্তর গোলার্ধকেই বুঝি। পুরো উত্তর গোলার্ধজুড়ে তীব্র শীত এখন। ইউরোপ-আমেরিকা আমাদের কাছে মিয়ানমার, নেপাল, ভুটানের চেয়ে নিকটবর্তী। এমনকি দার্জিলিংয়ে বরফ পড়ল কি-না সে খবর জানার আগে আমরা জেনে ফেলি লন্ডন, নিউইয়র্কের কী হাল। কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধে যে এখন রীতিমতো বন্যা চলছে, শহর-জনপদ পানির নিচে তলিয়ে গেছে সে খবর কয়জন রাখে? গত বছর লন্ডনের এক পত্রিকা লিখেছিল, ইউরোপ নাকি বড় একটা ফ্রিজে পরিণত হয়ে গেছে। এবারও অবস্থা তথৈবচ। সবাই বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমন হচ্ছে। এক পত্রিকায় কার্টুন আঁকা হয়েছে, সেখানে দুই চরিত্র পরস্পরকে বলছে, যখন জলবায়ু পরিবর্তন দরকার তখন তো তার দেখা নেই। সাধারণ অর্থে জলবায়ু পরিবর্তন বলতে উষ্ণায়নই বোধহয় বোঝানো হয়। উষ্ণায়ন, মেরুর বরফ গলে যাওয়া আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি_ এই হলো জলবায়ু পরিবর্তনের সহজ হিসাব। কিন্তু এটি যে বরফও বাড়াতে পারে, শীতও তীব্র করে তুলতে পারে তা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্পষ্ট হচ্ছে। তবে শীতকালকে সবসময়ই একটা রহস্য-কৌতুকে ঠাসা ঋতু বলে মনে হয়। কাউকে জিজ্ঞেস করুন, ঢাকা শহরে এত শীত দেখেছেন কখনও? বলবে, না ভাই, এমন শীত তো দেখিনি। তবে বছর কয়েক আগে বোধহয় ছিল। কেউ বলবে, পড়েছিল একবার। গত বছরের আগের বছর। আবহাওয়া দফতরের নথি ছাড়া মানুষের স্মৃতির শীতকাল সর্বদাই তীব্র। হালকা শীতের কথা কারইবা মনে থাকে! দেশের অঞ্চল ভেদে শীতের প্রকোপ একেক রকম। কিন্তু ঢাকা শহরে শীত মানে হরেদরে তিন দিনের অতিথি। এলো আর গেল। একটু রয়েসয়ে বঙ্গবাজারে গিয়ে পছন্দসই সোয়েটার-শাল কেনার আগেই শীত হাওয়া। শীত হাওয়া মানে আরামও হাওয়া। নগরবাসী একবার ফ্যান চালু করলেই দিনে পাক্কা ৫ ঘণ্টার লোডশেডিং শুরু। এবার শীত বড় প্রসন্ন। এসে আর যাওয়ার নাম নেই। সরকারের উচিত, শীতের উদ্দেশে একটা নাগরিক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা। এমন হিম বাতাস, উত্তুরে হাওয়া, গরম কাপড় ব্যবহারের এমন চমৎকার সুযোগ সহজে আসে না। অবশ্য শীতের এই সুযোগ ব্যবহার করতে গিয়ে বস্ত্রবঞ্চিত মানুষের কথা ভুললে চলবে না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, \'কন্?কনে শীত তাই/চাই তার দস্তানা;/বাজার ঘুরিয়ে দেখে,/জিনিসটা সস্তা না।/কম দামে কিনে মোজা/বাড়ি ফিরে গেল সোজা,/ কিছুতে ঢোকে না হাতে,/তাই শেষে পস্তানা।\' দস্তানা কেনার কথা কি কবির এদেশেই মনে এসেছিল? হাতমোজা পরার মতো শীত এলেও দস্তানা কী কাজে লাগে? হয়তো ইউরোপের অভিজ্ঞতার কথাও কবির মনে থাকবে। কবি একবার ইউরোপের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন এভাবে_ \'দিনে দিনে শীত খুব ঘনিয়ে আসছে; লোকে বলছে, কাল-পরশুর মধ্যে হয়তো আমরা বরফ পড়া দেখতে পাব। তাপমান যন্ত্র ত্রিশ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে গেছে, সেই তো হচ্ছে ফ্রিজিং পয়েন্ট। অল্পস্বল্প ফ্রস্ট দেখা দিয়েছে। রাস্তার মাটি খুব শক্ত। কেননা তার মধ্যে যা জল ছিল সব জমাট হয়ে গেছে। রাস্তার মাঝে মাঝে কাঁচের টুকরোর মতো শিশির খুব শক্ত হয়ে জমেছে। দু\'এক জায়গায় ঘাসের মধ্যে কে যেন চুন ছড়িয়ে দিয়েছে, বরফের এই প্রথম সূত্রপাত। খুব শীত পড়েছে, এক এক সময়ে হাত-পা এমন ঠাণ্ডা জ্বালা করতে থাকে। সকালে লেপ থেকে বেরোতে ভাবনা হয়। আমাদের দেশি কাপড় দেখে রাস্তার একেকজন সত্যি সত্যি হেসে ওঠে, একেকজন এত আশ্চর্য হয়ে যায় যে, তাদের আর হাসার ক্ষমতা থাকে না। কত লোক হয়তো আমাদের জন্য গাড়িচাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। প্যারিসে আমাদের গাড়ির পেছনে পেছনে একদল ইস্কুলের ছোকরা চিৎকার করতে করতে ছুটেছিল, আমরা তাদের সেলাম করলেম। একেকজন আমাদের মুখের ওপর হেসে ওঠে, একেকজন চেঁচাতে থাকে, “Jack look at the blackies!”

শীত বিলাসী, উদাস, আরামপ্রিয়, এলিটদের ঋতু। গরিবের জন্য শীত যত কম পড়ে ততই ভালো। ফলে এবারের এইটুকু শীত সকলের আরামে ও নিরাপদে কাটুক। কামনা
আপাতত এইটুকুই।

No comments:

Post a Comment