Thursday, December 9, 2010

আক্রমণ যদি করতে হয় তবে ইন্টারকন্টিনেন্টালেই : মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীরবিক্রম


মাহবুব মোর্শেদ
১৯৭১ সালের জুনে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয়েছিল বিশেষ মিশন নিয়ে। তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার আশপাশে ৩-৪ কিলোমিটারের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটানোর। কিন্তু ঢাকা পেঁৗছে তারা সিদ্ধান্ত নেন, আক্রমণ যদি করতেই হয় তবে দূরে কেন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই করবেন। দুর্ধর্ষ সে অভিযান, ক্র্যাক প্লাটুন, মেলাঘর ক্যাম্পের কার্যক্রম ও ডিসেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৪
........................................
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জন্ম ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে। ১৯৭১ সালে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পড়তেন বাংলাদেশ মিউজিক কলেজে। এপ্রিলে চলে যান সীমান্তে_ প্রথমে মতিনগর, পরে মেলাঘর ক্যাম্পে। মেলাঘর ক্যাম্পেই ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেন। গঠিত হয় ক্র্যাক প্লাটুন। মায়া ও সহযোদ্ধারা মিলে অনেক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেছেন ঢাকা ও এর
পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। ক্র্যাক প্লাটুন গঠন, চাঞ্চল্যকর অভিযান ও ডিসেম্বরের ঘটনাবলি
নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
মাহবুব মোর্শেদ



সমকাল : ২ নম্বর সেক্টরে কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন?
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া : ২৫ মার্চ যখন পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে তখন আমি সেগুনবাগিচা মিউজিক্যাল কলেজে ছিলাম। আমি বি মিউজের ছাত্র ছিলাম। সেতার শিখতাম। আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন বারীণ মজুমদার। ক্র্যাকডাউন হলে আমরা দেখলাম, আর্মিরা রমনা পার্কের দিকে গাড়ি নিয়ে আসছে। মিন্টো রোডের দিক দিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে এসে তারা ট্যাঙ্ক নিয়ে মুভ করছে। ট্যাঙ্কের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। লোকজন রাস্তায় বেরিয়ে এসে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া শুরু করে। আমরাও মিউজিক কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে ব্যারিকেডে অংশগ্রহণ করি। কিন্তু তাদের সামরিক শক্তির মুখে বেশিক্ষণ টিকে থাকা গেল না। কলেজে ফিরে এসে ছাদে অবস্থান নিলাম আমরা। পাকসেনারা ট্রেসার রাউন্ড ছুড়ে আমাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছিল। এক পর্যায়ে তারা আমাদের কলেজের গেটে এসে লাথি দিতে শুরু করে। তখন আমরা হোস্টেল ত্যাগ করি পেছনের দেয়াল টপকে। দেয়াল টপকে পার হওয়া সহজ ছিল না। বারীণ মজুমদারের স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা, বাপ্পা মজুমদার বৌদির পেটে। আমরা দরজা ভেঙে দুই দেয়ালের মধ্যে সেতু তৈরি করলাম। আশ্রয় নিলাম আওয়ামী লীগ নেতা কালু মিয়ার ফাঁকা বাসায়। সে বাসাতেই ২৬ তারিখ থাকলাম। ২৭ তারিখ সকাল ৭টা থেকে ৯টা_ দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। কারফিউ শিথিল হলে ঢাকা থেকে স্রোতের মতো মানুষ ছুটতে শুরু করে। ২৮ তারিখ ৪ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করল। ২৯ তারিখ সকালে আমরা জিঞ্জিরা যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। সেদিন ৬ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হলো। সেগুনবাগিচা থেকে রিকশায় করে আমরা গেণ্ডারিয়ায় গেলাম। সেখান থেকে নৌকায় জিঞ্জিরা গেলাম। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকার জিঞ্জিরা থেকে আমরা ১২ জন একসঙ্গে রওয়ানা দিই ৪ এপ্রিল। বর্ডার অতিক্রম করে ভারতের মতিনগর ক্যাম্পে উঠি। এ ক্যাম্পটি কুমিল্লা বর্ডারের খুব কাছে ছিল। আমাদের ট্রেনিংটা মূলত মতিনগরেই হয়েছিল।
সমকাল : মেলাঘর তখন চালু হয়নি?
মায়া : এর মধ্যে পাকিস্তান আর্মি মতিনগর ক্যাম্পে শেলিং শুরু করে। শেলগুলো আমাদের ক্যাম্পের কাছে আধা কিংবা এক কিলোমিটার দূরে এসে পড়ত। তখন আমরা ভাবলাম, তারা যদি আরেকটু এগিয়ে এসে আমাদের ক্যাম্পের ওপর শেলিং করে তাহলে ক্যাম্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রাতেই আমরা ক্যাম্পের জায়গা পরিবর্তন করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সন্ধ্যায় খাওয়ার পর আমাদের বলা হলো, রাতে আপনাদের একটা মিশন আছে। যার যা কিছু আছে সবকিছু নিয়ে সেখানে যেতে হবে। নিয়ম ছিল যার যা মালপত্র আছে সেটা তাকেই বহন করতে হবে। কারও জিনিস কেউ বহন করবে না। রাত ১টার দিকে আমরা মতিনগর থেকে রওয়ানা হলাম। সারারাত হেঁটে ভোরে মেলাঘরে পেঁৗছলাম।
সমকাল : বর্ডার থেকে মেলাঘর ক্যাম্পের দূরত্ব কত ছিল?
মায়া : আমার যত দূর মনে পড়ে, বর্ডার থেকে প্রায় ৩০-৩২ কিলোমিটার দূরে। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত আমাদের ট্রেনিং, আসা-যাওয়া সবকিছু মেলাঘর থেকেই পরিচালিত হতো।
সমকাল : মেলাঘরে কী ধরনের ট্রেনিং দেওয়া হতো?
মায়া : মূলত গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হতো। গ্রেনেড কীভাবে ছুড়তে হয়, থ্রি ইঞ্চ মর্টার কীভাবে চালনা করতে হয়, এলএমজি কীভাবে চালনা করতে হয়, এসএমজি কীভাবে চালাতে হয়, ডেটোনেটর কীভাবে ফিট করতে হয় সবকিছুর ট্রেনিং মোটামুটিভাবে সেখানে দেওয়া হতো।
সমকাল : কোন মাস থেকে ট্রেনিং শুরু হলো?
মায়া : এপ্রিল মাসে শুরু হয়ে মে মাস পর্যন্ত চলল।
সমকাল : ঢাকায় আপনাদের মিশন শুরু হলো কীভাবে?
মায়া : আর্মি অফিসাররা বিদ্রোহ করে সীমান্তে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের পরিবার তখনও বিভিন্নভাবে এদিক-সেদিক রয়ে গেছেন। খালেদ মোশাররফ, নুরুল ইসলাম শিশু, উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ, ব্রিগেডিয়ার মতিন প্রমুখের পরিবার তখন ঢাকায়। আমরা ঢাকা শহরের অলিগলি চিনতাম। ঢাকা থেকে সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা ভালো চেনা ছিল। আমাদের ওপর অফিসারদের পরিবারগুলোকে সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল। এ কাজে বেশ কয়েকবার আমরা ঢাকায় এসেছিলাম।
সমকাল : হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন কীভাবে হয়েছিল?
মায়া : মেলাঘরে ট্রেনিংয়ের সময় আমরা একদিন খবর পেলাম খালেদ মোশাররফ আসছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমরা তার অপেক্ষায় রইলাম। তিনি এসে অনেক কথা বললেন। বললেন, এখনই তোমাদের একটা অপারেশনে যেতে হবে। সেটা হবে এক দুঃসাহসী অপারেশন। ধরে নিতে হবে, তোমরা আর ফিরতে পারবে না। কে কে যেতে চাও স্বেচ্ছায় হাত উঠাও। আমরা যে ১২ জন একসঙ্গে ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলাম ঠিক করেছিলাম, যেখানেই আমরা যাই সবাই একসঙ্গে যাব। তখন সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। কে আগে হাত ওঠাবে। আমরা ১২ জন হাত উঠানোর পর আশপাশের সব মিলিয়ে ৬০-৬২ জন হাত উঠাল। আমাদের বলা হলো, যাদের বাড়ি ঢাকায় তারাই শুধু এই অপারেশনের জন্য উপযুক্ত। আমাদের নাম লিখে নেওয়া হলো। তিনি বললেন, তোমরা সন্ধ্যার পর আমার ক্যাম্পে দেখা কর। ওই সময় সেখানে ৬টি পল্গাটুন ছিল। অন্যদের নিজ নিজ ক্যাম্পে ফিরে যেতে বলা হলো। সব মিলিয়ে অপারেশনের জন্য শেষ পর্যন্ত ৪০-৪২ জন থাকল। সন্ধ্যায় ক্যাম্পে গেলে তিনি আমাদের ব্রিফ করলেন। জুন মাসের ৬-৮ তারিখে প্রিন্স করিম আগা খান আসবেন। তার সঙ্গে থাকবে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং বিশ্বের নামিদামি সাংবাদিকরা। পাকিস্তানিরা তাদের দেখাতে চায় দেশের মধ্যে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা নেই। আওয়ামী লীগের কর্মীরা যাওয়ার সময় বাড়িঘর পুড়িয়ে গেছে। এখন ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসিত করতে হবে। কমিটমেন্ট ছিল পরিস্থিতি অতিথিদের বোঝাতে পারলে তারা পাকিস্তানকে ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেবে। আমাদের তখনও পূর্ণ ট্রেনিং সমাপ্ত হয়নি। আমাদের বলা হলো, ডেলিগেটরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকবে না। আমাদের এক্সপেল্গাসিভ নিয়ে এসে ঢাকার ৩-৪ মাইল দূরবর্তী এলাকায় বিস্টেম্ফারণ ঘটাতে হবে। যাতে বিস্টেম্ফারণের শব্দ বিদেশিদের কানে পেঁৗছায়। শব্দ শুনলেই তারা বুঝতে পারবে দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়। যে ৩ দিন তারা থাকবে সে কয়েক দিন এ ধরনের বিস্টেম্ফারণ ঘটাতে হবে। ১০ জনের একেকটি গ্রুপ তৈরি করে আমাদের প্রত্যেককে দেওয়া হলো ৩০ পাউন্ড এক্সপেল্গাসিভ।
সমকাল : ঢাকায় কি আপনারা এক সঙ্গে এলেন?
মায়া : ভিন্ন ভিন্ন দল ভিন্ন ভিন্নভাবে এলো। আমরাও এসে এক জায়গায় থাকতাম না। কে কোথায় থাকতাম সেটা নিজেদের মধ্যেও আলোচনা হতো না। ঠিক করা ছিল, ঢাকায় পেঁৗছানোর পরদিন স্টেডিয়ামের সামনে আল ইসলাম হোটেলে সকাল ১০টা-সাড়ে ১০টার মধ্যে একত্র হবো। একত্র হওয়ার পর আমরা বললাম, আক্রমণ যদি করতেই হয় তাহলে ঢাকা থেকে দূরে কেন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই আক্রমণ করব। আক্রমণ করার জন্য আমাদের একটি গাড়ির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমাদের কোনো গাড়ি ছিল না। অনেক কষ্টে একটা গাড়ি জোগাড় করে ৭ তারিখ সন্ধ্যা ৭টা-সাড়ে ৭টার দিকে আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে উপস্থিত হই। বিদেশি ডেলিগেটদের দুটি গাড়ি তখন লবির সামনে দাঁড়িয়ে। ক্যামেরা ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে লোকজন নামছে। তখন গেটের দিকে লক্ষ্য করে আমরা দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করি। কয়েক সেকেন্ড পরে আরও দুটি। সবাই হুড়মুড় করে হোটেলের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু সবাই ঢুকতে পারেনি। দ্রুতগতিতে কাকরাইল রোড ধরে আমরা পালিয়ে যাই। বাড়িতে এসে বিবিসির ৮টার খবরে শুনলাম, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গেরিলা আক্রমণে ১৮-২২ জন মারা গেছে এবং ৩০-৩২ জন আহত হয়েছে। সেবার আমাদের সঙ্গে আর যাদের অপারেশনে পাঠানো হয়েছে তাদের সবারই অপারেশন ব্যর্থ হয়। খালেদ মোশাররফ বলেন, দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল। বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে। তিনিই আমাদের ক্র্যাক আখ্যা দেন। তখন থেকেই আমাদের পল্গাটুনটি 'ক্র্যাক পল্গাটুন' নামে পরিচিত হয়।
সমকাল : ঢাকার আশপাশের এলাকায় আপনারা কোনো ক্যাম্প করেছিলেন?
মায়া : ত্রিমোহনী, ভুলতা এবং ইছাপুরা বাজারে আমাদের ক্যাম্প ছিল। ইছাপুরা বাজারে আমাদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। সে ঘাঁটি রক্ষা করতে গিয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে বড় যুদ্ধ করতে হয়েছিল।
সমকাল : ঢাকায় অপারেশন চালানোর সময় এখানকার মানুষ আপনাদের কী ধরনের সাহায্য করত?
মায়া : তখন রাজাকার, আলবদর ছাড়া সবাই আমাদের সাহায্য করত। তারা সকলে আমাদের জন্য দোয়া করত। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করত। যে বাড়িগুলোতে আমরা আশ্রয় নিতাম তারা নফল নামাজ পড়ে এবং কোরআন তেলাওয়াত করে আমাদের জন্য দোয়া করত। সবার সহযোগিতায় আমরা ঢাকা শহরে সর্বমোট ৮২টি অপারেশন পরিচালনা করেছিলাম। আমাদের আক্রমণে পাকিস্তানিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।
সমকাল : ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনী গঠিত হওয়ার পর কী ঘটল?
মায়া : যৌথ বাহিনী আমাদের সঙ্গেই ঢাকায় প্রবেশ করেছিল। ৩ ডিসেম্বরের পর ভারতীয় বাহিনীর ১২ জনের একটি দল আমাদের এসে বলল, তাদের পাঠানো হয়েছে এই নির্দেশনা প্রদানের জন্য যে, যে কোনো সময় ওপর থেকে নির্দেশ এলেই তারা আমাদের সঙ্গে ঢাকার মধ্যে ঢুকে পড়বে। ঢাকায় ঢোকার রাস্তাটা আমাদের তৈরি করতে হবে। ডিসেম্বরের ৬-৭ তারিখে ধলেশ্বরী নদীর তীরে কয়েকজন ভারতীয় অফিসার এসে আমাকে বললেন পাকিস্তানি আর্মিদের সম্পর্কে সঠিক এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে। তাদের অবস্থান, ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র_ এসব সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। তারা আমাদের কাছে ৮ জন চাইলেন। দু'জন করে ভাগ হয়ে আমরা এগোলাম তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য। তারা আমাদের অস্ত্র দিয়ে ফায়ার করতে বলেছিল। আমরা ফায়ার করলে পাকিস্তানিরাও কাউন্টার ফায়ার করবে। সে ফায়ারের শব্দ শুনলেই তারা বুঝবে পাকিস্তানি আর্মির কাছে কী কী অস্ত্র আছে। কিছু দূর এসে আমরা দু'বার ফায়ার করে তাদের পক্ষ থেকে কোনো পাল্টা জবাব পেলাম না। তৃতীয়বার ফায়ার করার পর থেকেই তারা আমাদের লক্ষ্য করে বিরামহীনভাবে ব্রাশফায়ার এবং ট্রেসার রাউন্ডের গুলি শুরু করল। এভাবে তারা দু'ঘণ্টা ফায়ার করল। এ সময় ভারতীয়রা ফায়ারিংয়ের শব্দ রেকর্ড করে পাক আর্মির কী কী অস্ত্র আছে তা সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করল। সে অপারেশনে আমিসহ ৮ জন প্রায় মরতে বসেছিলাম। আমাদের রাইফেলে ট্রেসার রাউন্ড ছিল। ফলে পাকিস্তানিরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছিল এবং বিরামহীনভাবে গুলি করেছিল। ধানের জমিতে কাদার মধ্যে মাথাসহ পুরো শরীর ডুবিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলাম আমরা।
সমকাল : ১৬ তারিখে আপনারা ঢাকায় ঢুকলেন কখন?
মায়া : তখন ত্রিমোহনী, ভুলতা, ইছাপুরা বাজার, মাতুয়াইল, কমলাপুর রেলস্টেশন এই অঞ্চলটি মুক্ত ছিল। বিকেল ৪টার সময় আমরা ঢাকায় প্রবেশ করি। বিকেল ৩টা-সাড়ে ৩টার দিকে ভারতীয় আর্মি হেলিকপ্টার দেখতে পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, এগুলো পাকিস্তানিদের হেলিকপ্টার। আমাদের কাছে একটা বাইনোকুলার ছিল। বাইনোকুলারে দেখলাম এক ঝাঁক হেলিকপ্টার। সেগুলোতে ভারতীয় মনোগ্রাম। এগুলো আসছিল আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য। হেলিকপ্টারগুলোকে অনুসরণ করে আমরাও দৌড়াতে দৌড়াতে ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা হই। কিন্তু হেলিকপ্টারের সঙ্গে কুলাতে পারা গেল না। বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট কিংবা পৌনে ৫টার দিকে আমরা ডিআইটি বিল্ডিংয়ে পেঁৗছাই। সেখানে প্রথম স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়াই আমি। এর একটু আগে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ হয়ে গেছে।
সমকাল : আপনাদের সঙ্গে ভারতীয় যে বাহিনীটি ছিল, তারা?
মায়া : তারা আমাদের অনুসরণ করে ঢাকায় ঢুকেছে।
সমকাল : ১৬ তারিখের পর ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল?
মায়া : ঢাকা শহর ছিল উৎফুল্ল। লোকজন ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল রাস্তায়। রাজাকার, আলবদরদের খুঁজছিল তারা। আমি তখন ২০-২২ বছরের যুবক। আমাকে পায়ে হাঁটতে হয়নি। মানুষ কাঁধে করে আমাদের বাড়ি পেঁৗছে দিয়েছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়, মিত্রবাহিনীকেও মানুষ যে যেভাবে পেরেছে বরণ করেছে। একদিকে হাসি-কান্নার রোল, অন্যদিকে ফুলের পাপড়ি। স্বাগত জানানোর জন্য যত রকম আয়োজন করা যায়, সবকিছুই করেছে তারা। এ দৃশ্য না দেখলে ধারণা করা কঠিন। চারদিকে ছিল একটাই স্লোগান_ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

No comments:

Post a Comment