Friday, December 3, 2010

আত্মসমর্পণ টেবিলের পেছনদিকে থাকার কথা ছিল আমারও : মেজর জেনারেল (অব.) কেএম সফিউল্লাহ, বীরউত্তম


পায়ে হেঁটে আগরতলা থেকে ডেমরা পৌঁছেছিলেন সফিউল্লাহ
মাহবুব মোর্শেদ
১৯৭১ সালের নয় মাসের দীর্ঘ সংগ্রামে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, তখন ৩ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু করে পাকিস্তান। পরাজয়ের আগ মুহূর্তে কেন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান? মেজর জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহর মতে, পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায়নি এবং মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণেও ছিল তাদের অনীহা। ফলে মুক্তিবাহিনীর কাছে
পরাজয়ের আগ মুহূর্তে তারা
আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ
ঘোষণা করে। এর মধ্য
দিয়ে তারা চেয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে মোটামুটি সম্মানজনক আত্মসমর্পণের আয়োজন করতে। এ অবস্থায় ডিসেম্বরের ৩ তারিখের পর শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় যৌথ কমান্ড। এ সময় 'এস' ফোর্স নিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন কেএম সফিউল্লাহ। আখাউড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরা পর্যন্ত পেঁৗছেন পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। দুর্গম পথের বাধা, নদী, যানবাহনের অপ্রতুলতা কিছুই এ অগ্রাযাত্রার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সাধারণ মানুষেরও অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সহযোগিতা পেয়েছেন তারা। কিন্তু প্রায় পুরো পথই হেঁটে যেতে হয়েছে এস ফোর্স এবং এর প্রধান কেএম সফিউল্লাহকে। ডেমরায় অবস্থানকালে ১৬ তারিখ সকালে টিম হেড কোয়ার্টার থেকে মেসেজ পান কেএম সফিউল্লাহ। বিকেল ৩টার মধ্যে ঢাকা এয়ারপোর্টে পেঁৗছতে হবে জেনারেল অরোরাকে রিসিভ করার জন্য, বিকেল সাড়ে ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। সেখানে তাকে থাকতে হবে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে। কিন্তু সঙ্গে গাড়ি নেই, হেঁটেও সময়মতো পেঁৗছানোর উপায় নেই। ডিসেম্বরের সেই শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের কথা বলেছেন মেজর জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ।
.........................................................................................
মেজর জেনারেল (অব.) কেএম সফিউল্লাহর জন্ম ১৯৩৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন মেজর পদবির কর্মকর্তা, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড। গাজীপুরের জয়দেবপুরে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ১৯৭১-এর ১৯ মার্চ তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টর ও পরে 'এস' ফোর্সের নেতৃত্ব দেন। ১৬ ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে বীরউত্তম পদকে ভূষিত করা হয়। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের নানা ঘটনা নিয়ে তিনি সম্প্রতি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ



সমকাল : সমকালের ডিসেম্বরের আয়োজনে মূলত মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের ঘটনাবলির দিকেই মনোযোগ দেব। আপনি মুক্তিযুদ্ধে 'এস' ফোর্সের প্রধান ছিলেন। আপনার মনে পড়ে, চূড়ান্ত যুদ্ধে কখন আপনারা সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকার দিকে অগ্রসর হবেন?
সফিউল্লাহ : ডিসেম্বরের ঘটনা বলতে হলে পেছনের দিকের অনেক ঘটনার কথা বলতে হবে। আমাদের যুদ্ধ হয়েছিল নয় মাস। এই নয় মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এমন এক পর্যায়ে নেওয়া হয়েছিল যে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। তারা এমনি এমনি আত্মসমর্পণ করেনি। ৫ তারিখে বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার জন্য আমাদের অপারেশন শুরু হয়েছিল।
সমকাল : ৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল।
সফিউল্লাহ : ২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি যুদ্ধ করছিলাম আখাউড়ায়। ৩ তারিখেই পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই সময়েই ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড কার্যকর হয়। যৌথ কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হলে আমার ফোর্স ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে চলে যায়। মাউন্টেন ডিভিশনের সাহায্যে ৪ ডিসেম্বর আমরা আখাউড়া দখল করি। আখাউড়া দখল করার পর সেখানকার পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ৫ তারিখে আমাদের ভারতীয় কমান্ডার সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আমরা ঢাকা অগ্রসর হবো। ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল গনজালবেজ যখন ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন ঠিক হলো তিন দিক দিয়ে তিনটি ব্রিগেড ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবে। একটি ব্রিগেড ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবে কুমিল্লা-ব্রাক্ষণবাড়িয়া রোডের উজানিশার ব্রিজ দিয়ে। একটি ব্রিগেড রেলরোড দিয়ে যাবে এবং আমার ব্রিগেড 'এস' ফোর্স যাবে সিলেট হাইওয়ে দিয়ে। আমরা তিন দিক থেকে ব্রাক্ষণবাড়িয়া গিয়ে মিট করব। আমি সরাইল পেঁৗছাই ৯ ডিসেম্বর। সরাইল পেঁৗছার পর প্রথম বাধা আসে আশুগঞ্জে। পাকিস্তানের ১৪ ডিভিশন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিল। তারা আমাদের ধাওয়া করে ভৈরবের ভেতরে। আশুগঞ্জেই গুলিবিনিময় হয়। ১০ তারিখ তারা আশুগঞ্জের দিকে ভৈরব রেল ব্রিজের একাংশ ধ্বংস করে দেয়। ১১ তারিখ তারা ভৈরবের দিকের ব্রিজ ধ্বংস করে। সেই সময় ভারতীয় একটি ব্যাটালিয়ন হেলিকপ্টারে নদীর ওপারে চলে যায় এবং আমার ব্যাটালিয়ন নদীর এপারে আশুগঞ্জে থাকে। এভাবে আশুগঞ্জ-ভৈরবকে অবরোধ করে রাখা হয়। সেখানে ১৪ ডিভিশন পুরো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ওখানে আমাদের ফোর্সের একটি অংশ থাকল। ইন্ডিয়ান ফোর্সের বাকি অংশ হেলিকপ্টারে করে নরসিংদী যায়। আমি আমার ফোর্স নিয়ে পায়ে হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে লালপুর, লালপুর থেকে মেঘনা নদীর পাড় হয়ে রায়পুরা, রায়পুরা থেকে নরসিংদী, নরসিংদী থেকে গাউছিয়া যাই। গাউছিয়া থেকে ইন্ডিয়ান আর্মি চলে যায় ডেমরার দিকে। আমি শীতলক্ষ্যা পার হয়ে ডেমরা দিয়ে নদীর পশ্চিম পাশে পেঁৗছলাম। ভারতীয় সেনারা থাকল নদীর পূর্ব পাশে। পশ্চিমে ছিল পাকিস্তানি ১২ ব্যাটালিয়ন। ১৩ তারিখ রাতে আমরা সেখানে পেঁৗছলে ১২ ব্যাটালিয়নের সঙ্গে আমাদের গুলিবিনিময় হয়। ১৪ তারিখ সকালে যখন আমরা ঢাকার দিকে অগ্রসর হবো, তখন থেকেই ইন্ডিয়ান হাইকমান্ড থেকে আকাশবাণীতে একটি মেসেজ প্রচার করা হচ্ছিল পাকিস্তানিদের উদ্দেশে। তাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। এক পর্যায়ে পাকিস্তানিরা বলল, সিজফায়ার (যুদ্ধবিরতি) করো, সিজফায়ার করলে আমরা আত্মসমর্পণ করব। তখন ১৪ তারিখে সিজফায়ার করে বসে থাকলাম। আমার একটা ব্যাটালিয়ন থাকল আশুগঞ্জে, বাকি একটা ব্যাটালিয়ন নিয়ে আমি ডেমরায় অবস্থান করতে থাকলাম। আমরাও পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ করতে বলছিলাম। সিজফায়ারের কথা উঠলে আমরা সিজফায়ার করলাম। আমরা ইচ্ছা করলে ১৪ তারিখে ঢাকায় ঢুকে যেতে পারতাম।
সমকাল : ঢাকার দিকে অগ্রসর হলেন না কেন?
সফিউল্লাহ : ঢাকার দিকে এগোলাম না, কারণ আমরা ডেমরা থেকে দেখছিলাম হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে। অগ্রসর হতে হলে আমাদের ফায়ার করে করে অগ্রসর করে হবে। ফায়ারিং মুভমেন্ট করতে গেলে আমাদের লোকদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
সমকাল : লোকজন ঢাকা ছাড়ছিল কেন?
সফিউল্লাহ : নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে, নিয়াজি আত্মসমর্পণ করছে না। করছে না বিধায় মানুষ মনে করছে, তাহলে তো ঢাকা শহরে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে। এই ভয়ে মানুষ ঢাকা ছাড়তে শুরু করে। আমরা অগ্রসর হলে ঢাকা ছাড়তে থাকা লোকজন আমাদের গুলির সামনে পড়ত। এ জন্য আমরা ওইখানে অবস্থান করতে থাকলাম। সত্যি কথা বলতে কি, পাকিস্তানিরা সিজফায়ারের নামে আমাদের সঙ্গে বেইমানি করেছে। একদিকে সিজফায়ারের ঘোষণা দিয়েছে, অন্যদিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে তুলে এনে এবং বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। আমরা যদি ১৪ তারিখে ঢাকায় ঢুকতে পারতাম তবে হয়তোবা কিছু মানুষ বেঁচে যেত বলে আমার বিশ্বাস। ১৬ তারিখ সকালে কমান্ডার বললেন, আমরা ঢাকার দিকে অগ্রসর হবো।
সমকাল : কখন?
সফিউল্লাহ : সকাল ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে। এই সময় আমি একটা মেসেজ পেলাম টিম হেডকোয়ার্টার থেকে। আমি যেন বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকি জেনারেল অরোরাকে রিসিভ করার জন্য। আর বিকেল সাড়ে ৪টায় আমি যেন রেসকোর্সে থাকি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে। আমাকে সেখানে বাংলাদেশ ডেলিগেট হিসেবে থাকতে হবে।
সমকাল : এই মেসেজ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড থেকে এসেছিল?
সফিউল্লাহ : হ্যাঁ। ৫৭ ব্রিগেড কমান্ডারের তরফ থেকে আমার কাছে মেসেজ এসেছিল। ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মিশ্রা ও ডেল্টা সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং আমাকে এই নির্দেশ দেন। আমি আখাউড়া থেকে ডেমরা পেঁৗছি পায়ে হেঁটে। আমি যখন খবরটা পেলাম তখন ১২টা পার হয়ে গেছে। আমাকে ঢাকায় পেঁৗছতে হবে বিকেল সাড়ে ৩টায়। তখনও ডেমরা থেকে ঢাকা পর্যন্ত রাস্তাটি একটি রণক্ষেত্র। গাড়ি-ঘোড়া চলছে না। পায়ে হেঁটে ঢাকা যেতে হলে আমি সময়মতো পেঁৗছতে পারব না। তখন আমি গাড়ি খুঁজছি।
সমকাল : কোনো গাড়ি আপনাদের ছিল না?
সফিউল্লাহ : আগরতলা থেকে পুরো পথের সবটাই আমরা পায়ে হেঁটে এসেছি। অল্প কিছু গাড়ি ছিল। কিন্তু আমি তো গাড়ি নিয়ে নদী পার হতে পারিনি। মেঘনা নদী পার হয়েছি নৌকায়। এখন আমার একটি গাড়ি দরকার। পাকিস্তান আর্মির ১২ ব্যাটালিয়ন যেটি আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য সিজফায়ার করেছিল, তার কমান্ডার ছিল আমার জানাশোনা একজন। তার নাম ছিল ব্রিগেডিয়ার খিলজি। আমি তার কাছে তার ব্যাটালিয়ন কমান্ডের ভেহিকেল চাইলাম। সে গাড়িতে করে আমি, খিলজি এবং সাবেক সিং রওনা হলাম ঢাকার দিকে। আমরা ডেমরা থেকে ঢাকার দিকে যাওয়ার সময় কলাপাড়ায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ওই গাড়ির ওপর গুলি করতে শুরু করল। যদিও খিলজি গাড়ি ড্রাইভ করছিল কিন্তু সাবেক সিং ও আমার পরনে ছিল অলিভ গ্রিন ইউনিফর্ম। এই ইউনিফর্ম দেখে তাদের মনে হয়েছিল, এটি তাদের গাড়ি নয়। খিলজিকে দিয়েই আমরা তাদের গুলি থামিয়েছিলাম।
সমকাল : এয়ারপোর্টে গিয়ে কী দেখলেন?
সফিউল্লাহ : এয়ারপোর্টে আমি জেনারেল জ্যাকবকে দেখলাম, জেনারেল নিয়াজি ছিলেন। তারা জেনারেল অরোরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা ওখানে থাকতে থাকতেই এক ঝাঁক হেলিকপ্টার এসে নামল। জেনারেল অরোরা, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। খিলজিকে সেখানে রেখে আমি তার গাড়ি নিয়ে রেসকোর্সে চলে গেলাম। এখন রমনায় যে পুলিশ হেডকোয়ার্টার তার পাশে একটি বটগাছ ছিল। সে বটগাছের নিচে একটা টেবিল ও দুটি চেয়ার পাতা ছিল। সেখানে জেনারেল নিয়াজি ও তার স্টাফ অফিসাররা গেলেন। এ কে খন্দকার গেলেন। আমারও সেখানে থাকার কথা ছিল; কিন্তু আমি ছিলাম টেবিলের সামনে দাঁড়ানো। দলিলে সাইন করার পর জেনারেল নিয়াজি তার বেল্ট, পিস্তল ও ব্যাজ খুলে দিলেন। ওই সময় আমার হাতের এই ঘড়িটায় ৪টা ৩১ মিনিট বাজে।
সমকাল : এই ঘড়িটায়?
সফিউল্লাহ : হ্যাঁ। এই ঘড়িটাই। আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে লোকজন জয় বাংলা স্লোগান দিতে থাকল।
সমকাল : লোকজনের উপস্থিতি কেমন ছিল?
সফিউল্লাহ : মুক্তিযোদ্ধাই বেশি ছিলেন। এলাকার সাধারণ মানুষও ছিল। অনেক মানুষ ছিল। কিন্তু তখনও পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেনি। মানুষ তখনও ওইভাবে বেরিয়ে আসেনি। তারপরও মানুষ ঢিল ছুড়ছিল, থুথু দিচ্ছিল। তখন আমরা একজন আরেকজনের হাত ধরে নিয়াজিকে ঘিরে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমি যখন ডেমরা থেকে চলে আসি, তখন আমার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ও ব্রিগেড মেজরকে বলে এসেছিলাম, তাড়াতাড়ি ঢাকায় রেসকোর্সে আসার জন্য। তারা এলে তাদের আমি স্টেডিয়ামে থাকতে বললাম।
সমকাল : আপনি রমনায় ক্যাম্প করলেন ১৭ ডিসেম্বর।
সফিউল্লাহ : ১৬ তারিখ আমার ফোর্স থাকল স্টেডিয়ামে। আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল পাবনা সিল্ক হাউসে। অনেকদিন পর সেই দোকানে গদিতে শুয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। তবে স্টেডিয়ামে যাওয়ার আগে ১৬ তারিখ সন্ধ্যার পর আমি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। সব জায়গায় ইন্ডিয়ান আর্মি গার্ড দিয়ে আছে।
সমকাল : ইন্ডিয়ান আর্মি তখনও সংখ্যায় কম ছিল। সম্ভবত তারা ছিলেন নাগরার নেতৃত্বে আসা এক ডিভিশন সৈন্য।
সফিউল্লাহ : তখনও ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন ক্যান্টনমেন্টের বাইরে। জাতীয় সংসদ ভবন তখন অর্ধসমাপ্ত। সংসদ ভবনের উল্টোদিকে মণিপুরি পাড়ার ফাঁকা জায়গায় তারা ক্যাম্প করেছিল।
সমকাল : তখনও তো পাকিস্তান আর্মি ডিসআর্মড হয়নি।
সফিউল্লাহ : অস্ত্র তাদের হাতেই ছিল। সেনানিবাসে আমার ফ্যামিলি থাকত সেনাভবনের উল্টোদিকে একটা দোতলা সাদা বিল্ডিংয়ে।
সমকাল : যুদ্ধের সময় কি তারা ওখানে ছিল?
সফিউল্লাহ : না। তারা ১০ মার্চ ১৯৭১ এখান থেকে চলে যায়।
সমকাল : আপনি বিদ্রোহ করেছেন ১৯ মার্চ।
সফিউল্লাহ : আমি ১ মার্চ টাঙ্গাইলে ছিলাম। সেখান থেকেই আমি বুঝতে পারছিলাম যে অবস্থা খারাপ। তখন আমি ঢাকায় এসে ফ্যামিলি মেম্বারদের কুমিল্লায় আমার শ্বশুরবাড়ি অথবা রূপগঞ্জে আমার বাড়িতে চলে যেতে বললাম। তখন ফ্যামিলি সরিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না। ১০ মার্চ আমার শ্বশুরের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল, সে অজুহাতে তারা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বের হতে পেরেছিল।
সমকাল : ১৬ তারিখ বাসায় ফিরে আপনি কী দেখলেন?
সফিউল্লাহ : আমার বহু বছর সেই বাড়িতে কেটেছিল, সেখানে গচ্ছিত ছিল সমস্ত সম্পদ। আমি বাড়িতে গিয়ে দরজায় নক করলাম। ভেতর থেকে একজন সোলজার বেরিয়ে এলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কোনো অফিসার আছে কি-না। যে অফিসারটি বেরিয়ে এল, সে আমার পরিচিত। আমাকে দেখে বলল, সফিউল্লাহ কেমন আছ? আমি বললাম, তুমি কি জানো এই বাড়িতে আমি থাকতাম? ও বলল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তুমি কি জানো আমার পুরো জীবনের সঞ্চয় এখানে আছে? বলল, আমি তা-ই ভেবেছিলাম। আমি তোমার জিনিস দেখাশোনা করেছি। যেগুলো ব্যবহার করার সেগুলো করেছি। আর যেগুলো করার নয় সেগুলো প্যাক করে রেখেছি। তুমি এখনই বাড়ি বুঝে নিতে চাও? আমি বললাম, এখনই চাই না। তুমি আরও কয়েকদিন থাকতে পারো। ওই বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে কিছুদূর যেতেই গাড়ির পেট্রোল ফুরিয়ে গেল। দুপুর ১২টা থেকে আমি গাড়ি চালাচ্ছি, কিন্তু পেট্রোল ফুরিয়ে যেতে পারে এটি মাথায় ছিল না। এক্সট্রা ফুয়েলও ছিল না। আমি ভাবছিলাম, পাম্প থেকে পেট্রোল এনে গাড়ি চালু করব। এমন সময় উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ি আসতে দেখলাম। গাড়িটা থামালাম। গাড়ি থেকে যে লোকটি বেরিয়ে এলো সে ছিল একজন বাঙালি অফিসার। আমাকে দেখে হাই, হ্যালো করার পর বলল, আমি ডিউটিতে ছিলাম, এখনই ছাড়া পেলাম। এ কথাটা শোনার পর আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল।
সমকাল : তিনি পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করছিলেন!
সফিউল্লাহ : আত্মসমর্পণ হয়ে গেছে বিকেল সাড়ে ৪টায়। রাত তখন সাড়ে ৮টা-৯টা বাজে। এ পর্যন্ত সে ডিউটি করে এলো। আমি তখন চিৎকার করে উঠলাম। বললাম, গিভ ইওর ওয়েপন অ্যান্ড জিপ, অ্যান্ড গেট লস্ট ফ্রম মাই সাইট। সে পিস্তল দিল, জিপ ছেড়ে চলে গেল।
সমকাল : ক্যান্টনমেন্টে ফোর্স নিয়ে আপনারা ঢুকলেন কবে?
সফিউল্লাহ : ২২ ডিসেম্বর প্রবাসী সরকার ফিরল। ২৪ তারিখে জেনারেল ওসমানী এলেন। এসেই তিনি বললেন, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে অফিস করতে চান। ২৬-২৭ তারিখের দিকে আমরা ক্যান্টনমেন্টে এলাম। তখন ইন্ডিয়ান আর্মি পার্লামেন্ট ভবনের পাশে ক্যাম্প করে। ৩০ তারিখের দিকে পাকিস্তান আর্মির সদস্যদের অস্ত্রশস্ত্র সহকারে সীমান্তের দিকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায় তারা। ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানিদের ডিসআর্ম করা হয়নি। ইন্ডিয়ান বর্ডার ক্রস করার পর পাকিস্তানিদের ডিসআর্ম করা হয়।
সমকাল : ১৬ তারিখের পর ঢাকার মানুষের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
সফিউল্লাহ : তখন অনেকে প্রশ্ন করত আমাকে, সফিউল্লাহ, আমরা কি হাতবদল হলাম? আমি এর সদুত্তর দিতে পারিনি তখন। ওই সময় বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী যদি বাংলাদেশ ও ভারতের নেতৃত্বে না থাকতেন, তবে ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। ইতিহাসে কোথাও এমন উদাহরণ নেই যে, সাহায্যকারী বাহিনী সাহায্য গ্রহণকারী দেশ এত অল্প সময়ে ছেড়ে গেছে। বাংলাদেশই একমাত্র ব্যতিক্রম। আর এটি ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর ভালোবাসার কারণে।

No comments:

Post a Comment