মাহবুব মোর্শেদ
৯ মাসে অনেক চেষ্টার পরও মুক্তিযোদ্ধারা কাবু করতে পারেননি কামালপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। অবশেষে ৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ তৎপরতায় মুক্ত হয় কামালপুর। দ্রুততম সময়ে শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ট্রেনে ঢাকা আসেন হারুন হাবীব। ঢাকা ফেরার সেই ট্রেন ছিল 'জয় বাংলা' স্লোগানে মুখরিত। পথে পথে পুঁতে রাখা মাইনের ভয়ে ট্রেন চলেছে ধীরে ধীরে। ট্রেনে ঢাকা আসতে লেগেছে ৪-৫ ঘণ্টা। বিজয়ের আনন্দে মুখরিত হলেও সে সময় ঢাকাকে মনে হচ্ছিল আতঙ্কিত এক শহর। এ সময়ের মধ্যে মুজিবনগর সরকার কলকাতা থেকে ধীরে ধীরে ঢাকায় চলে আসছে। কামালপুর বিজয় ও মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের নানা ঘটনার কথা জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবাদদাতা ও ফটোগ্রাফার হারুন হাবীব।
..............................................
লেখক ও সাংবাদিক হারুন হাবীবের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একজন গেরিলা হিসেবে যোগ দেন ১১ নম্বর সেক্টরে। কাজ করেন যুদ্ধকালীন সংবাদপত্র 'জয়বাংলা' ও 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে'র যুদ্ধ সংবাদদাতা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের বিরল অনেক মুহূর্তের ছবি তুলেছেন তিনি। সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বরের কামালপুর জয়ের কথা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের আখ্যান। তার সঙ্গে কথা বলেছেন মাহবুব মোর্শেদ
সমকাল : ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আপনি কোথায় ছিলেন?
হারুন হাবীব : আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। ১১ নম্বর সেক্টর টাঙ্গাইলসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা (বর্তমানে শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ) এবং গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের একটা বড় অংশ নিয়ে গঠন করা হয়েছিল। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আমি ওই সেক্টরের প্রধান সদর দফতর মহেন্দ্রগঞ্জে ছিলাম।
সমকাল : ডিসেম্বরের প্রথমদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যুদ্ধকৌশলে কী কী পরিবর্তন এলো?
হারুন হাবীব : ২৫ মার্চ থেকে যুদ্ধ শুরু হলেও ডিসেম্বরের প্রথম থেকে যুদ্ধের কৌশলে তাৎপর্যমণ্ডিত একটি পরিবর্তন আসে। এর একটি মূল কারণ হলো, পাকিস্তান যখন পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতকে আক্রমণ করে বসে তখন ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ৩ ডিসেম্বর এ যুদ্ধ শুরু হয়। সেদিন থেকেই ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। যৌথ সামরিক কমান্ড গঠিত হওয়ার পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা এই বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন যুদ্ধের কৌশলে প্রকৃতিগত একটি পরিবর্তন আসে। গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সেই সময় আমি সীমান্ত অঞ্চলে ছিলাম। তখন আমি দেখেছি, শত শত ভারতীয় সৈন্য সীমান্ত পার হয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত পাকিস্তানি স্থাপনাগুলো বিনষ্ট করতে শুরু করে। আমরা দ্রুতগতিতে লক্ষ্যের দিকে এগোতে থাকি।
সমকাল : আপনাদের সেক্টর কবে যৌথ কমান্ডের অধীনে আসে?
হারুন হাবীব : শুধু আমাদের সেক্টরই নয়, যৌথ কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনী একই কমান্ডের অধীনে আসে। কাজেই বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কমান্ডের সুযোগ তখন ছিল না। পুরো বাংলাদেশের সব কমান্ডারই যে যেখানে ছিল, যৌথ বাহিনী গঠিত হওয়ার পর সবাই যৌথ বাহিনীর কমান্ডের অধীনে আসে। আর সব কমান্ডারের প্রধান ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
সমকাল : ৩ ডিসেম্বরের পর আপনারা কোনদিকে অগ্রসর হতে থাকলেন?
হারুন হাবীব : অন্যান্য এলাকার কথা আমি অতটা বলতে পারব না। আমি আমাদের সেক্টরের কথা বলতে পারি। কামালপুর রণাঙ্গন (বর্তমানে এটি জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত) ছিল মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল। এ রণাঙ্গনে শত শত মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় এবং পাকিস্তানি সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছে। নয় মাসের পুরো সময়ই এ রণাঙ্গনে যুদ্ধ হয়েছে। ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল তাহের পা হারিয়েছিলেন এ কামালপুর রণাঙ্গনে। দিনটি ছিল ১৪ নভেম্বর। আমরা কখনও পাকিস্তানের দুর্ভেদ্য এ ঘাঁটি দখল করতে পারিনি। কিন্তু যৌথ কমান্ড গঠিত হওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে এগিয়ে এলো তখন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেল। আমাদের মধ্যেও নতুন আশার আলো ফুটে উঠল। কারণ গেরিলা যুদ্ধে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছি ঠিকই কিন্তু সম্মুখ সমরে সব জায়গায় তাদের পর্যুদস্ত করতে পারিনি। তাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র ছিল আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। ভারতীয় বাহিনী আসার ফলে তারা পিছিয়ে গেল। কর্নেল তাহের আহত হওয়ার পর আমাদের সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন ক্যাপ্টেন আজিজ। ৪ ডিসেম্বর সকালে ঠিক করা হলো যেভাবেই হোক আজ কামালপুর আক্রমণ এবং দখল নেওয়া হবে। সেদিন ব্রাহ্মণপাড়ায় শত শত মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনীর সদস্য এসে জমা হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হলো কে সারেন্ডার লেটার নিয়ে কামালপুরে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যাবে? আমাদের এলাকার একটি ছেলে বসির আহমদ (পরে সে বিডিআরে যোগ দেয় এবং বীরপ্রতীক খেতাব অর্জন করে) রাজি হলো। রাজি হওয়াটা ওই সময় কিন্তু সাধারণ ব্যাপার ছিল না। কারণ রাজি হওয়ার অর্থই হচ্ছে মৃত্যুকে অবধারিতভাবে মেনে নেওয়া। যাত্রাপথে চারদিকে পেতে রাখা মাইনে কিংবা পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে যে কোনো মুহূর্তেই তার মৃত্যু ঘটতে পারে। মৃত্যুকে অবধারিতভাবে মেনে নিয়েই বসির সারেন্ডার লেটার নিয়ে গেল। তখন আমাদের খুব খারাপ লাগছিল। আমাদের ক্যাম্পটা ছিল ভারতীয় সীমান্তের সনি্নকটে। ফলে সব কিছু দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। আমরা ভাবছিলাম, একটু পরেই বসির হয়তো মৃত্যুবরণ করবে। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে যায় কিন্তু বসির আর ফিরে আসে না। তারপর আনিসুল হক সঞ্জু নামে একটি ছেলে একইভাবে আরেকটি সারেন্ডার লেটার নিয়ে গেল। ভারতীয় এক কর্নেলের স্বাক্ষরিত সেই চিঠিতে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তোমরা আত্মসমর্পণ না করলে আমরা এয়ার স্ট্রাইক করব। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে তারা আত্মসমর্পণ করল না। তখন দেখা গেল মিত্রবাহিনীর অনেক বিমান এসে কামালপুরের ওপর বোমাবর্ষণ করে চলে গেল। এতে করে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে গেল। এরপর আনিসুল হক সঞ্জু আরেকটি সারেন্ডার লেটার নিয়ে গেল। তার বেশ কিছুক্ষণ পর (সম্ভবত) ক্যাপ্টেন আসলামের নেতৃত্বে পাকিস্তান নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য এবং রাজাকারসহ মোট ১৭০ জন সারিবদ্ধ হয়ে হাত উঁচু করে বেরিয়ে এলো। তাদের আত্মসমর্পণের দৃশ্যটি আমার স্মৃতিতে এখন ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
সমকাল : কামালপুর মুক্ত হওয়ার পর কী দেখলেন?
হারুন হাবীব : পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর তাদের দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ ছুটে এলো। আমরা কামালপুর গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলাম। দেখি ডজন ডজন মেয়েকে তারা ঘরের মধ্যে ধরে রেখেছে। বহু বাঙালিকেও তারা বেঁধে রেখেছে ঘরের মধ্যে। আমরা তাদের সবাইকে ছেড়ে দিলাম। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলো আমরা উদ্ধার করলাম। তারপর মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনী মিলে বকশীগঞ্জের দিকে এলাম। বকশীগঞ্জে এসে দেখি চারদিকে পোড়া বাড়িঘর। মানুষজন ভীত-সন্ত্রস্ত। তারপরও মানুষ জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে। তাদের মধ্যে ফুটে উঠেছে আশার আলো। ৬ তারিখ আমরা চলে এলাম শেরপুরে। শেরপুর তখন ছিল হিন্দুপ্রধান অঞ্চল। সেখানে এসে দেখি হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার করা হয়েছে তা অবর্ণনীয়। এ অত্যাচার করেছিল মূলত রাজাকার-আলবদররাই। আমরা চারদিকে মার্চ করে পুরো শহর দখল করে ফেললাম। এরপর অগ্রসর হলাম জামালপুরের দিকে। কারণ জামালপুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা তখনও রয়ে গিয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র নদের একপাশে শেরপুর এবং অপর পাশে জামালপুর শহর। নদীর ওপার থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের ওপর শেলিং করছিল। শেলিং করতে করতে তারা চুপি চুপি পালিয়ে যাচ্ছিল ঢাকার দিকে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল তাদের পক্ষে আর সেখানে থাকা সম্ভব নয়। ৬-১০ তারিখ পর্যন্ত আমরা ব্রহ্মপুত্রের চরেই থাকলাম। ১০ তারিখ আমরা ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা এবং শেরপুর মুক্ত করলাম।
সমকাল : ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করলেন কখন?
হারুন হাবীব : আমি ঢাকায় ১৬ ডিসেম্বর কিংবা তার আগে আসতে পারিনি। ঢাকায় আসি ১৬ ডিসেম্বরের পর। কারণ ময়মনসিংহে বড় একটা অ্যাকসিডেন্টের শিকার হই। মোটরসাইকেলসহ ট্রাকের নিচে পড়ে যাই। আমার সঙ্গে ছিল সঞ্জু। দুর্ঘটনায় সে এবং আমি গুরুতর আহত হই। ২০ তারিখ পর্যন্ত আমি ময়মনসিংহ হাসপাতালে ছিলাম। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই রেডিওতে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমপর্ণের খবর শুনেছিলাম।
সমকাল : আপনি ঢাকায় ফিরলেন কবে?
হারুন হাবীব : আমি ঢাকায় ফিরেছি ডিসেম্বরের ২১/২২ তারিখে। ট্রেনযোগে। ট্রেন চলছিল খুব আস্তে আস্তে। কারণ পুঁতে রাখা মাইনের ভয় ছিল তখন। ট্রেনে ঢাকায় আসতে তখন ৪-৫ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। ট্রেনে আসার দৃশ্যটাও ছিল অভূতপূর্ব। টিকিট করার কোনো ব্যাপার কিংবা সুযোগ তখন ছিল না। ট্রেনে ছিল মুক্তিযোদ্ধা, ভারতীয় সৈন্য এবং বাস্তুহারা লোকজন। মুক্তিযোদ্ধারা যে যেখানে পারছে ট্রেনে উঠছে, আবার নামছে। জয় বাংলা স্লোগানে গোটা ট্রেন ছিল মুখরিত।
সমকাল : ঢাকায় এসে কী দেখলেন?
হারুন হাবীব : ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ দেখার সুযোগ আমার হয়নি। যুদ্ধে যাওয়ার আগে আমি থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ১০৭ নং কক্ষে। গিয়ে দেখি কেউ নেই। সব রুম তালাবদ্ধ। পুরান ঢাকায় নীলাম্বর সাহা রোডে আমার দূরসম্পর্কের এক চাচাতো বোনের বাড়ি ছিল। সেখানে গেলাম। অন্য আত্মীয়-স্বজনদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এসে আমার বন্ধুবান্ধবদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। ১৬ তারিখ আত্মসমর্পণের পর ঢাকা শহর আনন্দে মুখরিত হলেও সেই সময় ঢাকা শহরকে মনে হচ্ছিল আতঙ্কিত একটা শহর। এ সময়ের মধ্যে মুজিবনগর সরকার কলকাতা থেকে আস্তে আস্তে ঢাকায় চলে আসছে।
সমকাল : দূরে যুদ্ধরত সেক্টরগুলোর ঢাকা শহরের ফেরার ব্যাপারটা কেমন ছিল? ১১ নম্বর সেক্টর ঢাকা শহরে কি আদৌ ফিরেছিল নাকি ময়মনসিংহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল?
হারুন হাবীব : ১১ নম্বর সেক্টর টাঙ্গাইল পর্যন্ত এসেছিল। যৌথ কমান্ড গঠিত হওয়ার পর পুরো যুদ্ধের কৌশলগত দায়িত্ব ছিল ভারতীয়দের ওপর। ১১ নম্বর সেক্টর ছিল মূলত একটি গেরিলা সেক্টর। প্রায় ২০-২২ হাজার লোক ছিল এ সেক্টরের সদস্য। তাদের অধিকাংশই ছিল গ্রাম-গঞ্জের মানুষ। ইপিআর সদস্যরাও সংখ্যায় ছিল অনেক বেশি। অন্য সেক্টরগুলোর অবস্থা এ রকম ছিল না। ঢাকায় প্রবেশ করেছিল ৩ নম্বর সেক্টর_ 'এস' ফোর্স। এটা ছিল একটি রেগুলার ফোর্স। মুক্তিযুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি হচ্ছে_ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বাঙালি সৈনিক যারা বিদ্রোহ করে চলে এসেছিল তাদের সংখ্যা সব মিলিয়ে ৮-৯ হাজারের বেশি নয়। মুক্তিযুদ্ধের মূল ফাইটিং ফোর্স ছিল সাধারণ জনগণ। তারা মূলত ছাত্র, গ্রামের কৃষক এবং তরুণ। তবে আমাদের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। কারণ তাদের নেতৃত্বেই তো সবাই সংগঠিত হয়েছিল। সাধারণ মানুষকে ট্রেনিং দিয়েছিল তারাই। আর ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। তারা মূল ব্যাপারটা কিন্তু ধারণ করেছিল। এ প্রশংসা তাদের দিতেই হবে। কারণ অস্ত্র প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তারা যাবতীয় সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ১৭ থেকে ১৮ হাজার সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছে। ভাবতে ভালো লাগে মুক্তিযুদ্ধের ৩৯ বছর পর ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধের মনুমেন্ট হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের ব্যাপার। ত্রিপুরার লোকসংখ্যা তখন ছিল ১৫ লাখ। আর তখন ত্রিপুরায় আমাদের শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে মনুমেন্ট নির্মিত হলো ত্রিপুরায়। অথচ ভারতের ১৭-১৮ হাজার সৈন্য আমাদের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দান করলেও আমরা তাদের জন্য আজও কোনো মনুমেন্ট তৈরি করতে পারলাম না।
No comments:
Post a Comment