Sunday, December 12, 2010

৭ মার্চের ভাষণ শুনে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম :: লে. কর্নেল (অব.) এসআইএম নূরুন্নবী খান, বীরবিক্রম

বাম থেকে পঞ্চম অবস্থানে বাইনোকুলার সহ নূরুন্নবী খান

মাহবুব মোর্শেদ
ক্যাসেটে ধারণ করা ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন আর নয়, এবার দেশে ফিরতে হবে। পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমী থেকে পালিয়ে আসেন ঢাকায়। যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৫ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন। পরিচালনা করেছেন দুঃসাহসিক সব অভিযান। যুদ্ধের সেই অভিজ্ঞতা, চূড়ান্ত যুদ্ধ ও ডিসেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। ষ বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৫
............................................................................
এসআইএম নূরুন্নবী খানের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৮ অক্টোবর। ১৯৬৫ সালে তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ইউকসুর ভিপি হিসেবে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল করপস-এ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৫ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন। পরিচালনা করেছেন দুঃসাহসিক সব অভিযান। যুদ্ধের সেই অভিজ্ঞতা, চূড়ান্ত যুদ্ধ ও ডিসেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার
নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ


সমকাল : কীভাবে আপনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন?
নূরুন্নবী খান : বাঙালি সেনা কর্মকর্তা হিসেবে আমি প্রথম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ প্রদান করেন সেই ভাষণের একটা ক্যাসেট মেজর মুজিবুল হক চৌধুরী লোক মারফত গোপনে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্টে। ক্যাসেটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ২৬ মার্চ বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন আমি পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবর শুনে আমি সেখান থেকে পালিয়ে আসি। পাকিস্তান আর্মির সিক্সটিন ডিভিশন তখন ছিল কোয়েটাতে। ওটি ছিল একটি রিজার্ভ ডিভিশন। প্রতিদিনই আমরা খবর পেতাম সিক্সটিন ডিভিশনের সব ইউনিট প্লেনে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে। এভাবে এক সময় পুরো ডিভিশনই নিয়ে আসা হলো পূর্ব পাকিস্তানে। সামরিক পরিভাষায় রিজার্ভ সৈন্য মুভ করার অর্থই হলো যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া। আমারও আর বোঝার বাকি রইল না। কোন দিক দিয়ে কীভাবে সেখান থেকে পালিয়ে আসব সেই পরিকল্পনাই তখন করছিলাম। বেলুচিস্তানের বর্ডারে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে আমি কথা বলে রাখি। ২৫ মার্চ রাতে বিবিসির খবরে শুনতে পেলাম, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ। আগেই আমি একটি মুভমেন্ট অর্ডার নিয়ে রেখেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত কোথাও ধরা পড়লে ডকুমেন্ট হিসেবে যাতে সেটি দেখাতে পারি। সেই সুযোগে আমি তখন ট্রেনে করে করাচি চলে আসি। করাচি এসে আমি সিভিলিয়ান হিসেবে পিআইএ ফ্লাইটে ঢাকা যাওয়ার চেষ্টা করলাম। তারা জানাল, এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত শুধু আর্মির জন্য বুকিং আছে। তারা আমাকে পরামর্শ দিল স্টেশন হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সিভিলিয়ান হিসেবে যেতে হলেও আমাকে মিলিটারির অনুমতি নিয়েই যেতে হবে। এরপর স্টেশন হেডকোয়ার্টারে গিয়ে আমি এক মেজরের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে ২৭ তারিখে রিপোর্ট করতে বললেন। বললেন, পূর্ব পাকিস্তানগামী কোনো এক ইউনিটের সঙ্গে আমাকে সংযুক্ত করে দেবেন। ভাবলাম, ইউনিটের সঙ্গে গেলে আমার মিশন সফল হবে না। সেখান থেকে চলে গেলাম ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে দেখি, একটি সেকেন্ড কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ঢাকা যাচ্ছে। সেখানে ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম নামে একজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। তিনি সুবেদার সাদেক নামে আরেকজন বাঙালি অফিসারকে দেখিয়ে দিলেন। তিনি সেকেন্ড কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার জন্য আমার টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। ২৮ মার্চ সকালে ঢাকায় এসে পেঁৗছলাম।
সমকাল : সিভিলিয়ান হিসেবে?
নূরুন্নবী খান : না, সেকেন্ড কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সঙ্গে এলাম। প্লেনে সবাই ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। আমার আইডি কার্ড দেখতে বা পরিচিতি কেউ জানতে চাইল না।
সমকাল : ঢাকায় এসে?
নূরুন্নবী খান : ঢাকায় এসে এখানকার বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। দেখলাম তারা সবাই হতাশাগ্রস্ত। সবাইকে বোঝালাম, এভাবে বসে থাকলে চলবে না। তাদের বিদ্রোহ করার প্রস্তাব করলে কেউ রাজি হলো না। তখন আমি জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার সুবেদার ওয়াহেদকে খুুঁজে বের করলাম। তাকে বললাম, অন্য বাঙালি অফিসারদের একত্র করা যায় কি-না। সব অফিসারকে একত্র করে বিদ্রোহ করে কুর্মিটোলা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করলাম। তিনি আমাদের প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হলেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন। ধীরে ধীরে খবর পেলাম, বিভিন্ন বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং পুলিশরা বিদ্রোহ করেছে। পিলখানাতেও বিদ্রোহ হয়েছে।
সমকাল : ঢাকা থেকে বের হলেন কীভাবে?
নূরুন্নবী খান : ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় আমার মাথায় আইডিয়া এলো, পদ্মার ওপারের অঞ্চলটা তাড়াতাড়ি স্বাধীন করা সম্ভব। কেননা ওখানে একটাই মাত্র ক্যান্টনমেন্ট। ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টও ছিল সেখানে। তবে তাদের বিদ্রোহের খবর আমি তখনও পাইনি। আমার বিশ্বাস ছিল, অন্য বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো যেহেতু বিদ্রোহ করেছে, সেহেতু তারাও করবে। তাদের পাশাপাশি আনসার, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় যশোর ক্যান্টনমেন্টটা দখল করতে পারলে ওই অঞ্চলটা তাড়াতাড়ি মুক্ত করা সম্ভব। তখন আমি যশোর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এপ্রিলের ২ তারিখে নড়াইল গিয়ে পেঁৗছলাম। সেখানে গিয়ে ক্যাপ্টেন হালিম এবং ক্যাপ্টেন রহমানের সঙ্গে আমার দেখা হলো। তারা তখন যশোরে প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তাদের কাছে রিপোর্ট করলে তারা আমাকে সাদরে গ্রহণ করল। বিরামহীনভাবে যুদ্ধ করে তারা তখন ক্লান্ত। তারা আমাকে ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিতে বলল। আমাকে তারা দিল একটি স্টেনগান এবং ৭.৬২ পিস্তল। সেখানেই আমি প্রথম দেশের স্বাধীনতার জন্য পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলাম।
সমকাল : সীমান্তের দিকে এগোলেন কবে?
নূরুন্নবী খান : এপ্রিলের ৬ তারিখে পাক হানাদার বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে খুলনার দিকে মুভ করল। মংলা বন্দরে প্রায় ৮ হাজার টন অস্ত্র নিয়ে একটি পাকিস্তানি জাহাজ অপেক্ষা করছিল। পাক আর্মিরা বিরামহীনভাবে মর্টারের গোলাবর্ষণ করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ৮ তারিখের মধ্যেই তারা কয়েকশ' ট্রাকভর্তি করে প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ক্যান্টনমেন্টের ভেতর নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সেদিনই নড়াইল শহরে হেভি এয়ার স্ট্রাইকিং হয়। ফাইটার বিমানগুলোও স্ট্রাইকিং করতে থাকে। ফ্রন্টে এসে দেখি কেউ নেই। পুরো নড়াইল শহর ফাঁকা। খবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম, বিএসএফ কোনো ফিজিক্যাল হেলপ করছে কি-না। জানতে পারলাম, বিএসএফ কোনো ফিজিক্যাল হেলপ করছে না তবে আশ্রয় দিচ্ছে। আমরা সুবেদার জলিলসহ তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, মেইন ট্রুপস মাগুরা হয়ে মুভ করবে বর্ডারের দিকে আর আমি কিছু লোক নিয়ে সাতক্ষীরা হয়ে বর্ডারের দিকে অগ্রসর হবো। তখন এপ্রিলের ১৫-১৬ তারিখ। বর্ডার ক্রস করে কলকাতায় পেঁৗছলাম। সেখানে সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদসহ অনেক পুরনো ছাত্রনেতার সঙ্গে দেখা হলো।
সমকাল : আবার দেশে ফিরলেন কবে?
নূরুন্নবী খান : এপ্রিলেই দিনাজপুরের বিরলে চলে এলাম। সেখানে এসে খবর পেলাম ইপিআরের পুরো সেক্টর বিদ্রোহ করেছে এবং সুবেদার মেজর রবের নেতৃত্বে তারা ওই বেল্টে বেশ ভালো লড়াই করছে। বাঙালিরা একবার দখল করলে পাক হানাদাররা সেটা পুনরুদ্ধার করে, পরে বাঙালিরা আবার সেটা দখল করে। এভাবেই লড়াই চলছিল বিরল বেল্টে। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র তো তখন তেমন কিছু ছিল না। সে সময় প্রশিক্ষিত জনবলেরও খুব প্রয়োজন ছিল আমাদের। সেখানে আমি তাদের কমান্ড নিয়ে নিলাম। যুদ্ধ চলাকালে খবর পেলাম, ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করেছে। তখন আমি প্রবাসী সরকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য সুবেদার মেজর রবকে দায়িত্ব দিয়ে পুনরায় কলকাতা রওয়ানা হলাম। সেখানে গিয়ে আমি সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে প্রবাসী সরকারের হেডকোয়ার্টারে গেলাম। প্রবাসী সরকারের হেডকোয়ার্টার তখন ৫৭/২ বালীগঞ্জে। সেখানে ওসমানী সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাকে তার এডিসি হিসেবে দায়িত্ব দিলেন। মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ছিলাম। কিন্তু কলকাতায় বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই খানিকটা লবিং করেই ফিরলাম যুদ্ধক্ষেত্রে।
সমকাল : কোন ফ্রন্টে?
নূরুন্নবী খান : মেজর শাফায়াত জামিলকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধান করে কলকাতায় নেওয়া হলে আমি তাকে বললাম, যুদ্ধ করার জন্য আমি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছি। কলকাতায় থাকলে তো আমার যুদ্ধ করা হবে না। তখন আমাকে তার সঙ্গে নেওয়ার অনুরোধ জানালাম। তিনি রাজি হলেন। পরে তার সঙ্গে বালুরঘাটে চলে এলাম। তিনি আমাকে তৃতীয় বেঙ্গলকে রিঅ্যারেঞ্জ করার দায়িত্ব দিলেন। আমি বিভিন্ন জায়গা ঘুরে প্রশিক্ষিত জনবল সংগ্রহ করে সেখানে একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তুললাম।
সমকাল : আপনাদের অপারেশনগুলো সম্পর্কে বলুন।
নূরুন্নবী খান : জুন মাসের ১৭ তারিখে আমাদের ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ে নিয়ে আসা হলো। সেখানে তিনটি বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে এসে একত্র করে নাম দেওয়া হয় ওয়ান ইবি ব্রিগেড। পরে এটিকে ওয়ান আর্টিলারি নাম দেওয়া হলো। সেপ্টেম্বরে এটিকে জেড ফোর্স নাম দেওয়া হলো। জিয়াউর রহমান এসে কমান্ড নিলেন। বিভিন্ন বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় অপারেশনে পাঠানো হলো। আমাদের তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দেওয়া হলো বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনের জন্য। সেখানে আমি এসাল্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
সমকাল : অপারেশনটি হয়েছিল কোন মাসে?
নূরুন্নবী খান : জুলাইয়ের ৩১ তারিখে। বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনে আমাদের একজন শহীদ হয়। সেখান থেকে আমরা দেওয়ানগঞ্জ অপারেশন করি। বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে চিলমারী পর্যন্ত ছিল তখন মুক্ত। এরপর ৪ আগস্ট পাকিস্তানি আর্মি এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। সে সময় রৌমারীর কোদালকাটি নামে একটি চর তারা দখল করে। সুবেদার আলতাফ ছিলেন তখন সেখানকার কমান্ডার। তখন তিনি আমার কাছে এলেন। সেখানে আমরা খবর পেলাম, ১৪ আগস্ট সেখানে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো হবে। সেদিনই আমরা সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টার খুললাম। তখন রৌমারীতে আমরা সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ওপেন করি।
সমকাল : সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কী কী কাজ করত?
নূরুন্নবী খান : সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তখন সবরকম কাজ করত। তাদের কাজ ছিল বিভিন্ন পজিশনে সৈন্যদের কাছে খাবার পেঁৗছানো, টোল কালেকশন, পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট, হাসপাতাল, থানা_ এরকমভাবে সব বিভাগ আমরা সেখানে খুলি। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এগুলো চালু ছিল।
সমকাল : ভারতীয় সাহায্য আসা শুরু করল কখন?
নূরুন্নবী খান : জুন মাসের শুরু থেকে। ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে, দিকনির্দেশনা দিয়ে তারা আমাদের সাহায্য করত। ফিজিক্যাল কোনো হেলপ তারা তখনও আমাদের করত না।
সমকাল : ফিজিক্যাল হেলপ শুরু হলো কখন?
নূরুন্নবী খান : জুলাই-আগস্ট থেকে। এ সময় তারা আমাদের গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করে।
সমকাল : ভারতীয় সৈন্যরা সরাসরি যুদ্ধ করতে শুরু করে কখন?
নূরুন্নবী খান : ২১ নভেম্বর যৌথ বাহিনী গঠিত হওয়ার পর। তবে সেটা বর্ডার এলাকার মধ্যেই সীমিত ছিল।
সমকাল : আর কোন কোন অপারেশনে আপনি অংশগ্রহণ করেন?
নূরুন্নবী খান : ছাতক, রাধানগর, গোয়াইনঘাটসহ আরও অনেক জায়গায় অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। তামাবিল বেল্টে অপারেশন করার সময় আমি তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। প্রায় ১৫টি উল্লেখযোগ্য অপারেশনের ওপর আমার আলাদা আলাদা বই আছে।
সমকাল : ৩ ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে কী কী পরিবর্তন এলো?
নূরুন্নবী খান : নভেম্বর শেষ দিক থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী বর্ডার এলাকাগুলোতে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। তাদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলোতেও তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে তারা ঘাঁটিগুলো গড়ে তুলেছিল। শক্ত ঘাঁটিগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাক হানাদার বাহিনী মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়ে।
সমকাল : ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য ছাড়া কি এত দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হতো?
নূরুন্নবী খান : একটি জায়গা দখল করাই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো সেটির দখল ধরে রাখা। ডিসেম্বর নাগাদ পুরো বাংলাদেশেই তো আমাদের অবাধ বিচরণ ছিল, কিন্তু দখল ধরে রাখার জন্য সে রকম অস্ত্র আমাদের ছিল না। এয়ার সাপোর্ট, নেভাল সাপোর্ট ছিল না। লং রেঞ্জে আমরা হামলা করতে পারতাম না। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী ছিল ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। সারা বাংলাদেশ তখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তা ধরে রাখা আমাদের জন্য কষ্টকর হতো। ভারতীয় বাহিনী সহায়তা না করলে অনেক দিন ধরে গেরিলা যুদ্ধ চলত। কিন্তু তারপরও চূড়ান্ত যুদ্ধে এ রকম সাহায্য আমাদের দরকার হতো।

No comments:

Post a Comment