Wednesday, December 8, 2010
মিসেস আহমেদ ছদ্মনাম নিয়েছিলাম : এডলিন মালাকার
মাহবুব মোর্শেদ
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভিন্ন এক কাহিনী শুনিয়েছেন এডলিন মালাকার। স্বামী যুদ্ধে চলে যাওয়ার পর দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি থেকে যান ঢাকায়। নিজের বাড়িতে নিরাপদ নন বলে অন্যদের বাড়িতে থেকেছেন পুরো মার্চ থেকে ডিসেম্বর। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। চলাফেরার সুবিধার্থে জোগাড় করেছিলেন মিসেস আহমেদ ছদ্মনামে একটি আইডি কার্ড। ঢাকা শহরের তখনকার আতঙ্ক, অস্থিরতা ও যুদ্ধপরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৫
.............................................
সমকাল : ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে আপনি কোথায় ছিলেন?
এডলিন মালাকার : তখন আমি ঢাকা ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে (এখনকার উদয়ন স্কুল) চাকরি করতাম। আমার বাসা ছিল ফার্মগেট এলাকায়। ২৫ মার্চে আমাদের বাড়ির চারপাশে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছিল। এলাকাটি নিরাপদ ছিল না। আমার স্বামীও মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলেন। তিনি দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। সেই সূত্রে পার্টির লোকদের সঙ্গে আমারও কিছু যোগাযোগ ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধে চলে যাওয়ার পর বাড়ি ছাড়লাম আমরা। আমার ছোট্ট দুটি সন্তান ছিল। স্বামীর বন্ধু নুরুর রহমান তার ধানমণ্ডির বাসায় নিয়ে যান আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় আরও ক'টি পরিবার তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে অনেকেই সংখ্যালঘু ছিলেন। ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত সে-বাড়িতেই ছিলাম। ঢাকার ওপর যৌথবাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে আমাদের মনে হলো, ঢাকায় থাকা নিরাপদ নয়। তখন সে-বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলাম আমরা।
সমকাল : আপনি তো ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ঢাকায় চলাফেরা করতে হতো আপনাদের। এ সময় কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেন?
এডলিন মালাকার : আমরা তো নন-মুসলিম। বাসা থেকে আমাকে বলল, তোমার একটা কার্ড করা দরকার। তখন আমরা নাম পরিবর্তন করে স্কুল থেকে কার্ড করলাম। আমার দু'ছেলের নাম শাহীন এবং শামীম। চলাফেরার সুবিধার্থে আমি মিসেস আহমেদ ছদ্মনামে একটি আইডি কার্ড বানিয়ে নিয়েছিলাম। কার্ড সঙ্গে রাখতাম। স্কুল ও বাসা ছাড়া আর তেমন কোথাও যেতাম না। খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হতো আমাদের। একবার খুব বিপদে পড়তে হয়েছিল। সে সময় আমাদের কাজ ছিল সীমান্তের ওপার থেকে আসা পত্রিকাগুলো ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের ওপর এসব পত্রিকা আমরা আঁচলের নিচে লুকিয়ে বিতরণ করতাম। একবার পত্রিকা বিতরণ করতে যাচ্ছি। পথে আলবদরের এক কর্মী গাড়ি আটকালো। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ড্রাইভার আগেই বলে দিয়েছিল স্বাভাবিক থাকতে হবে। সেই আলবদরটির সঙ্গে কথা বলেছিল। আইডি কার্ড আর দেখাতে হয়নি। পত্রিকা বিতরণ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতাম। এমনিতে রিকশায় চলাফেরা করতাম, ঢাকা শহরে তখন বাস চলত খুবই কম।
সমকাল : স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গেছেন বলে কি বাড়তি সতর্কতা নিতে হতো?
এডলিন মালাকার : হ্যাঁ, সতর্ক থাকতে হতো যাতে কেউ না জানে। আমার ছেলেদের শিখিয়ে দিয়েছিলাম, কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, তুমি বলবে বাবা নানাবাড়ি গেছেন। নুরুর রহমানের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াত ছিল। তার দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। তাদের বন্ধুরা আসত। তবে তাদের এই যাতায়াত খুব গোপনে হতো। এত সতর্কতার মধ্যেও একবার ঢাকার মুক্তিযোদ্ধারা গ্রীন রোডে একটা অপারেশন করলেন। তখন সবাই বলল, এবার ধানমণ্ডি এলাকায় রেইড হবে। সে রাতে রেইড না হলেও পরদিন সকালে দেখা গেল ঠিকই আর্মি জিপ পেঁৗছে গেছে। তবে তারা বাসার ভেতর ঢোকেনি। গেটে গিয়ে নুরুর রহমান সাহেব তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা চলে গিয়েছিল।
সমকাল : মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কারা কারা ওই বাড়িতে আসতেন?
এডলিন মালাকার : নাসিরউদ্দিন ইউসুফরা আসত, আর্টিস্ট শাহাবুদ্দিন আহমেদ এসেছিল। আরও কয়েকজন; কিন্তু সবার নাম এখন আর আমার মনে নেই।
সমকাল : কার্ড করার পর রাস্তাঘাটে আপনাকে কি কেউ আটকিয়ে ছিল?
এডলিন মালাকার : কার্ডটি আমরা করেছিলাম মূলত নিরাপত্তার জন্য। এক দিন এক রাজাকার আমাদের পথরোধ করেছিল। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেই সে আমাকে ছেড়ে দিল। তবে কার্ড দেখানোর প্রয়োজন হয়নি। অমুসলিমদের ভয়টা তখন বেশি ছিল। আর যাদের লোকজন বেশি চিনত তাদের সমস্যাটা ছিল আরও বেশি। মেয়েদের ক্ষেত্রে সে সমস্যাটা আরও বেশি হতো।
সমকাল : ধানমণ্ডি এলাকায় লোকজন তখন কেমন ছিল?
এডলিন মালাকার : আমরা থাকতাম ৭ নম্বর রোডে। তখন সেখানে একটা বড় পুকুর ছিল। আশপাশে ছিল অনেক কোয়ার্টার। মানুষের জীবনযাপন যে খুব স্বাভাবিক ছিল, তা নয়। স্বাভাবিক জীবনযাপন করাটা সে সময় অনেক কঠিন ছিল।
সমকাল : স্কুলে বাচ্চারা আসত?
এডলিন মালাকার : প্রথমে তো স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে সামরিক নির্দেশে স্বাভাবিক অবস্থা দেখানোর জন্য স্কুল খুলে দেওয়া হলো। চারদিকে ভীতিকর পরিস্থিতি। আমাদের স্কুলে তখন খুব বেশি বাচ্চা ছিল না। কিছু কিছু বাচ্চা আসত। ক্লাসও হতো।
সমকাল : তখন তো আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতেন। ওখানে কী দেখতেন?
এডলিন মালাকার : লোকজনের চলাচল খুব কম ছিল। ক্লাস হতো কি-না সেটি এখন আমার মনে নেই।
সমকাল : ধানমণ্ডি এলাকা ছাড়লেন কবে?
এডলিন মালাকার : ঢাকায় বিমান আক্রমণ বেড়ে গেলে আমরা বাড়ি পরিবর্তন করে জিগাতলায় আমার স্বামীর এক বন্ধুর বাড়িতে গেলাম। নভেম্বরের দিকে আমরা বাড়ি পরিবর্তন করে বংশালে চলে গেলাম। সে বাড়িতে অনেক মুক্তিযোদ্ধার যাওয়া-আসা ছিল। পাকিস্তানিরা তখন ছোট বিমানে করে বোমা ফেলছিল। মাঝে মাঝে হেলিকপ্টারও উড়ছিল। তখন কেউ কেউ বলছিলেন, এটা কি ভারতীয় বাহিনীর কাজ? পরে বোঝা গেল, এগুলো পাকিস্তানিদেরই কাজ। এ অবস্থায় বংশালে আমরা নিরাপদ বোধ করলাম না। সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা ঢাকার কাছেই বাঘৈরে গেলাম।
সমকাল : আপনারা বাঘৈর গেলেন কবে?
এডলিন মালাকার : এটা সম্ভবত ৩ ডিসেম্বরের পর।
সমকাল : পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
এডলিন মালাকার : বাঘৈরে থাকতেই খবর পেলাম। খবরটি রেডিওতে প্রচারিত হওয়ার পর সবার মুখে মুখে ফিরছিল। আমিও সেভাবেই শুনেছিলাম। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণে সবাই ছিল উৎফুল্ল। আমরাও বাড়ির ছাদে উঠে উল্লাস প্রকাশ করেছিলাম। অনেক দিন পর খুব মজা হয়েছিল।
সমকাল : ঢাকায় ফিরলেন কবে?
এডলিন মালাকার : ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে, বিকেলের দিকে। আমরা সবাই একসঙ্গে ঢাকা অভিমুখে রওনা হয়েছিলাম। মনে আছে, অনেকে মিলে ফিরেছিলাম।
সমকাল : ঢাকায় এসে কী দেখলেন?
এডলিন মালাকার : ঢাকায় এসে দেখলাম বেশ আনন্দঘন পরিবেশ। কিছু আতঙ্ক ছিল। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ছিল আনন্দ। পরে রায়েরবাজারে বুদ্ধিজীবী হত্যার খবর পেয়ে হতবাক হয়েছিলাম। ডা. আলিম চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল আলবদররা। আমার বড় ছেলে অনেক দিন আলিম চৌধুরীর বাসায় ছিল। ঢাকায় এসে খবর শুনে আমরা আলিম চৌধুরীর বাসায় গেলাম। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ছিলেন। সেখানে কান্নার রোল পড়ে গেল।
সমকাল : রায়েরবাজারে গিয়েছিলেন?
এডলিন মালাকার : গিয়েছিলাম, কয়েক দিন পর। কোনো লাশ বোধহয় ছিল না। কিন্তু সেখানে তখনও অনেক লোক। অনেক মানুষ তখনও নিখোঁজ। তারা স্বজনদের খুঁজছিলেন।
সমকাল : আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে সাহায্য করতেন?
এডলিন মালাকার : আমি শ্যামলী নাসরিন এবং আমার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কাজ করতাম। শ্যামলী নাসরিনের মাও মুক্তিযুদ্ধে অনেক কাজ করেছেন। অর্থ সংগ্রহ, ওষুধ সংগ্রহ এবং তা পেঁৗছানো, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করা_ এভাবেই ঢাকা শহরের নারীরা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। অনেকে নার্সিংয়ে চলে গিয়েছিলেন। কবি সুফিয়া কামাল (আমাদের সুফিয়া খালা) নানাভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। সুলতানা কামাল এবং সাঈদা কামাল কলকাতায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নার্স হিসেবে কাজ করেছেন। আয়শা খানম, নার্গিস, রত্না, ফৌজিয়া, রোকেয়া কবীর_ তারা সবাই সীমান্তের ওপারে থেকে কাজ করেছেন। সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও এটা কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এটাও ছিল বড় একটা যুদ্ধ। আর যেসব নারী তখন ঢাকা শহরে ছিলেন, তাদের জীবনও ছিল অনেক বড় ঝুঁকির মধ্যে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করতাম। শীতকাল চলে এসেছিল। পরিচিত বাড়ি ঘুরে অনেক কাপড় জোগাড় করেছিলাম। এক দিন শিল্পী হাশেম খানকে বললাম, মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু কাপড়-চোপড় লাগবে। হাশেম খান এক রিকশা বোঝাই করে কাপড় নিয়ে আসতে গিয়ে এক দিন হঠাৎ আর্মির গাড়ি সামনে পড়ে। তখন বুদ্ধি করে হাশেম খান পাশের একটি লন্ড্রিতে ঢুকে পড়ে। পরে লন্ড্রি থেকে সে কাপড় উদ্ধার করা হয়েছিল।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment