Sunday, December 12, 2010

বিজয় মিছিলে আমি পাগলের মতো আলীমকে খুঁজেছি : শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী


মাহবুব মোর্শেদ
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আ ফ ম আবদুল আলীম চৌধুরী একাত্তরে যুদ্ধের পুরো সময়টা ছিলেন ঢাকার পুরানা পল্টনে। ক্যামোফ্লেজ ক্লিনিক তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন নানা প্রক্রিয়ায়। প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর সদস্যরা। তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী সমকালকে জানিয়েছেন সেই দুঃসহ স্মৃতি, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, '৭১-এর ঢাকার কথা। ষ বিস্তারিত সাক্ষাৎকার পড়ূন পৃষ্ঠা-৫
.......................................................
শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর জন্ম ১৯৪২ সালে। স্বামী শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আ ফ ম আবদুল আলীম চৌধুরীর সঙ্গে একাত্তরে ছিলেন ঢাকার পুরানা পল্টনে। ডা. আলীম মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন, তাদের জন্য টাকা তুলেছেন, ক্যামোফ্লেজ ক্লিনিক তৈরি করে চিকিৎসা দিয়েছেন, শ্যামলী নাসরিন তখন তাদের জন্য সোয়েটার বুনেছেন। অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন ডা. আলীমের কাজে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের এ সমর্থনের কারণেই পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর সদস্যরা। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী জানিয়েছেন, শেষ ডিসেম্বরের দুঃসহ সেই স্মৃতি, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, '৭১-এর ঢাকার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ


সমকাল : মার্চে সবাই ঢাকা ছাড়ল কিন্তু আপনারা থেকে গেলেন কেন?
শ্যামলী নাসরিন : মার্চে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা বারবার ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম দেশে একটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। ডা. আলীম কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২৫ মার্চের আগে থেকেই ডা. আলীম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা তৎপরতা শুরু করেন। তখন তার চেম্বার ছিল ৬২/২ পুরানা পল্টনে। আমাদের বাসা ছিল ২৯/১ পুরানা পল্টনে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি তার চেম্বার স্থানান্তর করে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। এটা তিনি করেছিলেন কাজের সুবিধার জন্য। বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার স্বামীর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তখন তিনি থাকতেন মগবাজারের একটি বাসায়। ২৫ মার্চ রাত ১১টার সময় আমার এক ভাগ্নে ফোন করে বলল, আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। এখন সৈয়দ নজরুল সাহেবকে কোথায় লুকানো যায়? খুব তাড়াতাড়ি করে ঘটনাটি আমি আমার স্বামীকে বললাম। এক মুহূর্তও চিন্তা না করে তিনি বললেন, এখনই ওনাকে আমাদের বাসায় দিয়ে যেতে বল। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি আমাদের বাসায় এলেন। উনি তখন ছিলেন প্রায় উদভ্রান্তের মতো। মনটা খুব খারাপ। ওনাকে নিয়ে আমরা অস্থির হয়ে পড়লাম। আমাদের বাসার তৃতীয় তলায় ছোট্ট একটি ঘর ছিল। সেখানে আমরা তাকে রাখলাম। তিনি তখন ছিলেন খুব অস্থির। ঘরে চুপ করে বসে থাকতে পারছিলেন না। পরে আমরা তাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখলাম। বোম্বিং শুরু হওয়ার পর আমরা নিজের কথা ভাবিনি। শুধু ভেবেছি কী করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে রক্ষা করা যায়। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হওয়ার পর আমরা ওনাকে বের করার চেষ্টা করলাম। কারণ, এখানে থাকলে ওনাকে বাঁচানো যাবে না। আর তাকে বাঁচানোটাও ছিল খুব জরুরি। কারণ, রাজনৈতিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর পরই তার অবস্থান। আর বঙ্গবন্ধুর কী হয়েছে সেটা তখন পর্যন্ত আমরা জানি না। খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা চলল। পরে সৈয়দ নজরুল সাহেবকে শাড়ি-বোরকা পরিয়ে রিকশায় করে হোসনী দালানে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেখান থেকে তাকে ঢাকার বাইরে পাঠানো হলো। মনে আছে ২৫ মার্চ অনেক রাতে আমার স্বামী বাসায় ফিরেছে। কারণ, ওনার চেম্বারে অনেক মানুষ আটকা পড়েছিল। তখন তিনি তার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাইকে তাদের বাড়ি বাড়ি পেঁৗছে দিয়ে এসেছেন। এদিকে আমাদের বাসাতেও অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। কারফিউ শিথিল হলে ডাক্তার সাহেব গাড়িতে করে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে পেঁৗছে দিয়ে আসতেন। ডাক্তার সাহেব বলতেন, ভেতর থেকে আমরা যদি গেরিলা যোদ্ধাদের সাহায্য না করি তাহলে তারা আশ্রয় পাবে কোথায়? তাদের সাহায্য করার জন্যই আমাদের ঢাকায় থাকতে হবে।
সমকাল : ডা. আলীমের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন বলে জেনেছি আমরা।
শ্যামলী নাসরিন : ওনার কাছে তখন মুক্তিযোদ্ধারা আসত। তিনি তাদের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি গাড়িতে করে তাদের নিরাপদ জায়গায় পেঁৗছে দিতেন। ক্যামোফ্লেজ হাসপাতাল খুলেছিলেন তখন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য। গোপন কোনো একটা জায়গায় হাসপাতালটি ছিল। ডা. ফজলে রাবি্বর সঙ্গে সেখানে গিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতেন। হাসপাতাল কোথায় সেটি তিনি আমাকেও বলতেন না। আমি স্কুলে যেতাম, আলাপে আলাপে যদি কারও কাছে প্রকাশ করে দিই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ডাক্তারদের কাছে গিয়ে তিনি চাঁদা সংগ্রহ করতেন। বন্ধুদের কাছে শুনেছি তখন ডাক্তার আলীম চৌধুরীর গাড়ি দেখে অনেক ডাক্তারই দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিতেন। ওষুধ ফ্যাক্টরিগুলোতে গিয়ে তিনি ওষুধ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি পেঁৗছে দিতেন। চেম্বারে বসে যে টাকা তিনি পেতেন অর্ধেকেরও কম নিজের কাছে রেখে বাকি টাকা মুক্তিযুদ্ধের জন্য দিয়ে দিতেন।
সমকাল : আপনাদের বাসার ক্লিনিকটা বন্ধ হয়ে গেল কখন?
শ্যামলী নাসরিন : জুলাইয়ে মাওলানা মান্নান আমাদের বাসার নিচে আসার পর ক্লিনিকটা বন্ধ হয়ে গেল। পল্টনের চেম্বারটা ছিল। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়। আমাদের বাসার ক্লিনিকটা মোটামুটি খালি। পিডিপির মতিন সাহেব তখন আমাদের পাশের বাসায় থাকত। বৃষ্টি পড়ছে, এমন সময় তিনি একজন লোককে নিয়ে আমাদের বাসায় উপস্থিত হলেন। এসে বললেন, এক ভদ্রলোক খুব বিপদে পড়েছেন। তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে আশ্রয় দিতে হবে। দু'দিন থেকেই তিনি চলে যাবেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি এত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি, কাউকে দেখে আমার কখনো খারাপ লাগেনি। কিন্তু ওই লোকটাকে দেখামাত্রই আমার খারাপ লাগল। তাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। পরে তিনি গিয়ে আমার শাশুড়িকে বিষয়টি বললেন। আমার শাশুড়ির কথা আর উপেক্ষা করতে পারলাম না। লোকটি আর গেল না। বাড়িওয়ালার সঙ্গে ইতিমধ্যেই সে যোগাযোগ করে ফেলেছে। তারপর থেকে আমাদের বাড়িতে আর্মি আসতে শুরু করল। অ্যাশ কালারের প্যান্ট এবং খাকি শার্ট পরা আলবদরের লোকজন আসতে লাগল। তারা বন্দুক নিয়ে বাড়ির সামনে পাহারা বসাল। ডাক্তার সাহেব তখন ঘাবড়ে গেলেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা? লোকটি বলল, এরা তো আলবদর। আমি আলবদরের অর্গানাইজার। এরা আমাকে পাহারা দিতে এসেছে। মান্নান বলল, মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে চিঠি দিয়েছে আলীম ভাই ওপরে না থাকলে কবেই তোকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতাম। তখন আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে বুঝতে পেরেছি বাঁচার জন্য আলীমকে সে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে।
সমকাল : ডিসেম্বরে যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এলো তখনকার কোনো স্মৃতি আপনার মনে পড়ে কি?
শ্যামলী নাসরিন : হ্যাঁ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমি যুদ্ধের কথা শুনতাম। প্রত্যেক দিন পাক বাহিনীর পরাজয়ের খবর শুনতাম। আশপাশের কোথাও বোমা পড়লে আমরা সিঁড়ির নিচে চলে যেতাম। ১৪ তারিখে গভর্নর হাউসে বোমা হামলার সময় আমাদের বাসা কেঁপে উঠেছিল।
সমকাল : আপনি কি বাইরে বের হতেন?
শ্যামলী নাসরিন : হ্যাঁ, বিভিন্ন কাজের জন্য আমাকে বাইরে বের হতে হতো। আমি তখন ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে চাকরি করতাম। বাজার করা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের কাজের জন্য আমাকে বাইরে বের হতে হতো। রাস্তায় আর্মি জিপ টহল দিত। একবার দেখলাম, বেশ কিছু মানুষকে ট্রাকে করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। খুব ভীতিকর একটা পরিস্থিতি ছিল।
সমকাল : মুক্তিযুদ্ধের জন্য আপনি কী কী কাজ করতেন?
শ্যামলী নাসরিন : লুকিয়ে পত্রিকা বিতরণ, চাঁদা, ওষুধ সংগ্রহ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সোয়েটার বুনতাম।
সমকাল : মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা দেখেছেন?
শ্যামলী নাসরিন : আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের হামলার শব্দ বুঝতে শিখেছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের বোমার শব্দ পাকিস্তানিদের থেকে ভিন্ন ছিল। এ বোমার শব্দই ছিল তখন আমাদের জীবনী শক্তি। একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের বোমার শব্দ না শুনলে আমাদের মন খুব খারাপ হয়ে যেত।
সমকাল : ডা. আলীমকে ধরে নিয়ে যায় কবে?
শ্যামলী নাসরিন : ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায়। পিলখানায় মিত্রবাহিনী বোমা ফেলছে। আমরা বসে বসে দেখছি। পাকিস্তানিদের কাছে তখন বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র নেই। পাকিস্তানিদের দেখে আলীম হো হো করে হাসছে। বলছে, মিত্রবাহিনীকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। তখন একটা গাড়ি আসার শব্দ হলো। আমি দেখলাম কাদা লেপা একটা মাইক্রোবাস এলো। মাইক্রোবাসটি মাওলানার গেটে এসে থামল। কিছুক্ষণ পর আলবদর বাহিনীর ৩ জন সদস্য আমাদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে কড়া ভাষায় দরজা খুলতে বলল। এর আগে আমাদের বাড়িতে কেউ এমন করে দরজা খুলতে বলেনি। তখন ডাক্তার সাহেবের মুখ কালো হয়ে গেল। তখন তিনি আমাকে দরজা খুলে দিতে বললেন। তিনি দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাও? সে বলল, মাওলানা মান্নানের কাছে। কারণ, মাওলানা মান্নান তাকে বলেছিল আপনি আমার পরিবারকে রক্ষা করেছেন। আপনার পরিবারকে আমি বাঁচাব। আপনার কোনো ভয় নেই। কোনো সমস্যা হলে আপনি আমার কাছে চলে আসবেন। মাওলানা মান্নানের দরজায় গিয়ে তিনি অনেক ধাক্কাধাক্কি করলেন। কেউ দরজা খুলল না। ভেতর থেকে মাওলানা মান্নান বলল, আপনি যান আমি আছি। বাসায় ফেরার সময় তিনি যখন ওপরে উঠছিলেন তখন তাকে বলা হলো আমাদের সঙ্গে চলুন। ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায়? তারা বলল, গেলেই জানতে পারবেন। তিনি কাপড় পরে যেতে চাইলে তারা বলল, তার আর দরকার হবে না। যেভাবে আছেন সেভাবেই চলেন। আমি মাওলানার বাড়িতে ছুটে গিয়ে তাকে বললাম, আমার স্বামীকে কারা যেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দয়া করে আপনি দেখেন। মান্নান বলল, আপনি ঘাবড়াবেন না। ওরা আমার আলবদরের ছাত্র। ওরা নিয়ে গেছে। ওরা রাবি্বকেও নিয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন নিয়ে গেছে? মাওলানা বলল, চারিদিকে কী রকম বোম্বিং হচ্ছে, সেজন্য নিয়ে গেল। চিকিৎসা করানোর জন্য ওদের নিয়ে গেল। কখন ফিরে আসবে? মাওলানা বলল, কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবে। আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। তাকে যে মেরে ফেলা হবে সেটা আমি চিন্তাও করতে পারিনি। ডাক্তার সাহেব যার জীবন বাঁচালেন, পরিবারকে রক্ষা করলেন তার সাহায্যেই তাকে মেরে ফেলা হলো।
সমকাল : ১৬ তারিখের কথা আপনার মনে আছে?
শ্যামলী নাসরিন : ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকেই দেখি সবাই জয়বাংলা স্লোগান দিচ্ছে। বাইরে তাকিয়ে দেখি বাসার ছাদে ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। আমি সারাক্ষণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতাম। আলীমের চিন্তায় আর শুনতে পারিনি। স্বামীর জন্য আমি ছিলাম উদগ্রীব। বুঝতে পারলাম, পাক বাহিনী হয়তো আত্মসমর্পণ করবে। মনে হলো, পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে আমার স্বামী হয়তো ফিরে আসবেন। ১১টার দিকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এলেন। তাদের হাতে ছিল অস্ত্র। তারা এসে বললেন, সেই শয়তানটা কোথায় যারা আলীম ভাইকে মেরেছে। তখনই আমি প্রথম জানতে পেলাম, আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি তখনই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
সমকাল : বের হয়েছিলেন?
শ্যামলী নাসরিন : স্বাধীন বাংলার পতাকা টানানোর জন্য আমি আশা করে বসে ছিলাম। কিন্তু তা করতে পারিনি। আমি বিশ্বাস করিনি ডাক্তার সাহেবকে মেরে ফেলা হয়েছে। ১৬ তারিখ বিজয়ের দিন আমি তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। রিকশায় করে শহরের কত জায়গায় যে খুঁজেছি। আমার মনে হতো এই বুঝি তাকে দেখতে পাব। রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের স্লোগান দিতে দিতে আসছেন। মিছিল হচ্ছে। আশা করছিলাম ওই বিজয় মিছিলেই ডাক্তার সাহেবকে পাব। আমার মনটা তখন মিশে যেতে চেয়েছিল সেই মিছিলে। কিন্তু পারিনি। স্বামী হারানোর বেদনায় আমার মনটা ভারী হয়ে উঠেছিল। সেদিন ঢাকার অনেক রাস্তায় আমি পাগলের মতো ঘুরেছি। ভেবেছিলাম, হয়তো কোথাও তার সঙ্গে দেখা হবে।
সমকাল : মরদেহ পাওয়া গেল কখন?
শ্যামলী নাসরিন : ১৭ তারিখের পর।
সমকাল : মুক্তিযোদ্ধারা কি রায়েরবাজার গিয়েছিলেন?
শ্যামলী নাসরিন : আমি শুনিনি কীভাবে তারা জানতে পেরেছে।
সমকাল : আপনি রায়েরবাজার গিয়েছিলেন?
শ্যামলী নাসরিন : না, আমি রায়েরবাজার যাইনি। যাওয়ার মতো শক্তি তখন আমার ছিল না। ১৮ তারিখে ডাক্তার সাহেবের লাশ নিয়ে আসার পর তার লাশ দেখেছি। তার হাত দুটো রশি দিয়ে পেছনে বাঁধা ছিল। দু'চোখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। শরীরের অনেক জায়গায় বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন।

No comments:

Post a Comment