Monday, December 6, 2010

ঢাকার অসংখ্য বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অবারিত : মফিদুল হক


মাহবুব মোর্শেদ
১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর ঢাকা ছেড়ে গিয়ে ১৪ এপ্রিল ফিরে আসেন লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠক মফিদুল হক। উদ্দেশ্য, ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা তৎপরতায় সহযোগিতা করা। এ কাজ করতে গিয়েই দেখেছেন এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের ঢাকা। সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ডিসেম্বরের যুদ্ধ পরিস্থিতি, বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আগে-পরের কিছু বিরল অভিজ্ঞতার কথা।
............................
মফিদুল হকের জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে, নোয়াখালীতে। ১৯৭১ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এপ্রিলে যখন সবাই ঢাকা ছাড়ছিল তখন পার্টির সিদ্ধান্তে ঢাকায় ফিরে আসেন মফিদুল হক ও তার কয়েকজন সহকর্মী। উদ্দেশ্য, যুদ্ধাবস্থায় পার্টির তৎপরতা বজায় রাখা। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলে ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়, বিশেষত ডিসেম্বরে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ


সমকাল : কোন প্রেক্ষাপটে আপনি ১৯৭১-এ ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন?
মফিদুল হক : আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। মার্চে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাই। সীমান্তে তখন আমাদের একটা সভা হয়েছিল নিলখিয়াতে। তাতে ঠিক হয়, ১৪ এপ্রিল আমরা ঢাকায় ফিরে আসব। সেদিনের কথা বেশ মনে আছে। পহেলা বৈশাখ ছিল সেদিন। ঢাকা থেকে অসংখ্য মানুষ চলে যাচ্ছিল আর আমরা কয়েকজন মাত্র ফিরছিলাম। আমাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকায় আটকেপড়া নেতাকর্মী-শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। আমার সঙ্গে ছিলেন নিজাম উদ্দিন আজাদ (পরে তিনি সীমান্তে চলে যান গেরিলা ট্রেনিং নিতে। বেতিয়ারা যুদ্ধে শহীদ হন তিনি। আজাদের মৃত্যুর সংবাদটি আমাদের জন্য খুব কষ্টকর ছিল), নূহ-উল-আলম লেনিন এবং আরও অনেকে। আমাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকায় একটি নেটওয়ার্ক গঠন করা। এরপর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গোটা সময়টাই আমরা ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকায় ছিলাম। আমাদের কাজগুলো করতে হতো খুব গোপনে। প্রত্যেকের একটি নির্দিষ্ট এলাকা ভাগ করা থাকত। প্রত্যেকেই তার এলাকায় গোপনীয়তা রক্ষা করে কাজ করত। দায়িত্বের মধ্যে ছিল মূলত যোগাযোগ রক্ষা করা, আশ্রয়ের জায়গা ঠিক করা, মুক্তাঞ্চল থেকে আমাদের উদ্যোগে বের হওয়া 'মুক্তিযুদ্ধ' পত্রিকাটি বিতরণ করা। যাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রক্ষা করতাম তাদের মধ্যে ছিলেন কবি শামসুর রাহমান, কাইয়ুম চৌধুরী, নিজাম উদ্দিন সিদ্দিকী প্রমুখ। তারাও দায়িত্ব পালনে আমাদের নানাভাবে সাহায্য করতেন। ঢাকার গেরিলা তৎপরতায় এখানকার অনেক বাড়ির বিশেষ অবদান ছিল। অসংখ্য বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অবারিত। এটা না থাকলে যুদ্ধ চালানো অনেক কঠিন হতো। ঢাকার আশপাশের গ্রামের মানুষও অভূতপূর্ব সহযোগিতা করেছিল।
সমকাল : যুদ্ধের শেষ দিকে ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল?
মফিদুল হক : নভেম্বরের শেষ দিক থেকেই সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে সংঘাত বাড়তে থাকে। তখন শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা নিয়ে একটা আশঙ্কা ছিল সবার মধ্যে। কারণ, বোঝা যাচ্ছিল পাকিস্তানি বাহিনী ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। যুদ্ধের শেষ কীভাবে হবে তা উপলব্ধি করা তখন খুব কঠিন ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ছিল একটি সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী। তাদের কাবু করাটাও খুব কঠিন ছিল। নভেম্বরের শেষ দিকে সীমান্তে অনেক অঞ্চল যখন মুক্ত হতে শুরু করল তখন বোঝা গেল যে, যুদ্ধটা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। ভারতীয় বাহিনীও অনেক জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে শুরু করে। এরপর ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হলো। শুরু হলো সর্বাত্মক যুদ্ধ।
সমকাল : ঢাকায় আপনারা সেটা টের পেলেন কখন?
মফিদুল হক : ঢাকায় আমরা সেটা টের পেলাম ভোরের দিকে। রেডিওর মাধ্যমে আমাদের কাছে খবর পেঁৗছত। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী ও বিবিসি খবরের বড় উৎস ছিল। ইন্দিরা গান্ধী ৩ তারিখ কলকাতার জনসভা শেষ করে দিলি্ল ফিরে গেলেন। রাতে পার্লামেন্টে ভাষণ দিলেন। ভাষণ শেষ হতে না হতেই ঢাকার আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পাকিস্তানি বাহিনী লেসার বুলেট আকাশের দিকে ছোড়া শুরু করল। একটু পরেই বোঝা গেল, ভারতীয় বিমান ঢাকার আকাশে ঢুকে পড়েছে। রাডারের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বিমানের উপস্থিতি টের পেয়ে তাদের প্রতিহত করার জন্য এই পন্থা অবলম্বন করেছিল।
সমকাল : তখন আপনি ঢাকায়?
মফিদুল হক : হ্যাঁ, তখন আমি ঢাকায়। ঢাকার আশপাশে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে থাকতাম আমরা। ভারতীয় বাহিনী তখন টার্গেট করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বোম্বিং করেছিল। বিশেষ করে তারা বোম্বিং করেছিল ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। সে ঘটনাটাই মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। ঢাকা শহরে তখন মানুষ ছিল খুব কম। কারফিউ জারি করা হয়েছিল। জীবনযাত্রা ছিল অস্বাভাবিক। তবে রাস্তাঘাটে বের হলে মানুষের চোখের ভাষায়ও একটা পালাবদল লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। মিত্রবাহিনীও তখন আস্তে আস্তে ঢাকার দিকে এগোতে লাগল। এ খবরগুলো এখানকার পত্রপত্রিকাগুলোতে বিকৃতভাবে ছাপা হলেও মানুষের মধ্যে তার প্রভাব পড়ত না।
সমকাল : যুদ্ধ চলাকালীন খবরগুলো আপনারা পেতেন কীভাবে?
মফিদুল হক : যুদ্ধ চলাকালে আমরা খবরগুলো পেতাম মূলত বেতারের মাধ্যমে। এগুলোই ছিল আমাদের খবরের মূল উৎস। তবে মানুষ কোনো না কোনোভাবে সব খবরই পেয়ে যেত। ডিসেম্বরের ৯-১০ তারিখ থেকে যে পরিস্থিতি দাঁড়াল তাতে মূল যে প্রশ্নটি উঠল তা হলো, যুদ্ধটা শেষ হবে কীভাবে। আর একটা আশঙ্কা তখন ছিল_ ঢাকায় চূড়ান্ত লড়াই হবে কি-না। এই আশঙ্কা থেকেই চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য যে যার মতো প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। তবে সেটা শেষ পর্যন্ত ঘটেনি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঢাকার বাইরেই পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। যদি 'ঢাকা ওয়ার' বলে কিছু হতো তবে ঢাকার অবস্থা খুব ভয়ঙ্কর হতো। কারণ চোখে পড়ার মতো না হলেও যে পরিমাণ বেসামরিক মানুষ ঢাকায় ছিল তার সংখ্যাও ছিল অনেক।
আর পাকিস্তানি বাহিনী কী করতে পারে ৩০ নভেম্বর থেকেই সেটা বোঝা গিয়েছিল। ওষুধ ছিটানোর জন্য ব্যবহৃত ছোট্ট বিমানে করে বোমা নিয়ে এসে তারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ফেলত। প্রতিশোধ নেওয়ার লক্ষ্যে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে তারা এটা করত। এর কোনো সামরিক গুরুত্ব ছিল না। বোমা ফেলার আরেকটি কারণ ছিল। তাদের ধারণা ছিল, এ ধরনের বোমা ফেললে লোকজন মনে করবে ভারতীয় বাহিনী এটা ফেলেছে এবং এর একটি প্রতিক্রিয়া হবে। কিন্তু বিমানের আওয়াজ এবং প্রকৃতি তখন মানুষের জানা হয়ে গিয়েছিল। মানুষ বুঝতে পারত কোনটা পাকিস্তানি এবং কোনটা ভারতীয় বিমান। এর মধ্যে যে বড় ঘটনাটি পাকিস্তানি বাহিনী ঘটাল তা হলো বুদ্ধিজীবী হত্যা।
সমকাল : বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনাটি আপনারা জানতে পারলেন কখন?
মফিদুল হক : বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের একটি। ১৭ ডিসেম্বরের আগে আমরা এটা জানতে পারিনি। ১৭ ডিসেম্বরের সকালে কেউ কেউ জানতে পারলেও বিষয়টি সবাই জানতে পারে ১৮ ডিসেম্বর। এ রকম অনেক নৃশংস ঘটনাই পাকিস্তানি বাহিনী ঘটিয়েছে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে একটি এতিমখানার ওপর তারা বোমা ফেলেছিল। তাতে অনেক শিশু মারা গিয়েছিল।
সমকাল : ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল?
মফিদুল হক : ১৬ তারিখে ঢাকায় একটা টেনশন বিরাজ করছিল। ভারতীয় বাহিনীর দুটি দল ঢাকায় ঢুকেছিল। তাদের একটি গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের দিকে এবং অপরটি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (এখনকার শেরাটন হোটেল) দিকে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল তখন রেডক্রসের আন্ডারে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা তখন দল বেঁধে হেঁটে যাচ্ছিল ক্যান্টনমেন্টের দিকে। বাইরে ঢাকার দিকে আসার সময়ও পাকিস্তানি বাহিনী গোলাগুলি করেছে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে হঠাৎ করে একটা সংঘর্ষ বেধে গিয়েছিল। তখন ভারতীয় বাহিনীও তাদের অবস্থান নিল। সেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে কিছু পাকিস্তানি সৈন্যের মৃত্যু ঘটে।
সমকাল : আত্মসমর্পণের খবর জানলেন কীভাবে?
মফিদুল হক : আত্মসমর্পণ যে হতে যাচ্ছে এটা ১৬ তারিখ সকাল থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। কারণ, যুদ্ধের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছিল একটা যুদ্ধবিরতি ঘটেছে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও মানুষ মুক্তির স্বাদ পেল ১৭ ডিসেম্বর। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তখন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে চলে গেছে। পাকিস্তানি বাহিনী ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশের পর সেখানে আরেকটি সামরিক সারেন্ডার অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার বাইরে থেকে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারাও ১৭ তারিখে ঢাকায় আসতে শুরু করে। ১৭ তারিখ বিকেলেই বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসে শহীদ মিনারে জমায়েত হয়। যাওয়ার মতো অন্য কোনো জায়গা তো আর ছিল না। অনেকেই সেখানে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। ১৭ তারিখ থেকে মানুষ মুক্তির স্বাদ পেলেও তাদের মধ্যে এক ধরনের বিষণ্নতাও কাজ করছিল। বিজয়ের আগে ছিল শঙ্কা। আর বিজয় হওয়ার পর তৈরি হলো বিষণ্নতা।
সমকাল : ১৬ তারিখে আপনি কোথায় ছিলেন?
মফিদুল হক : ১৬ তারিখে আমি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। তাই আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ১৬ তারিখ সকালে আমি ডেমরার দিকে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় এলাম গভর্নর হাউস হয়ে (এখনকার বঙ্গভবন)। ইন্ডিয়ান আর্মি সেখানে বোম্বিং করেছিল। দরবার হলে গিয়ে আমি দেখলাম বোমার আঘাতে ছাদে বিশাল একটা গর্ত তৈরি হয়েছে। মূলত গভর্নর হাউসে এই আক্রমণের ফলেই গভর্নর মালিক পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
সমকাল : কেউ বাধা দিল না?
মফিদুল হক : না, কোনো বাধা ছাড়াই আমি দরবার হলে প্রবেশ করতে সক্ষম হই।
সমকাল : এটা কোন সময়ে?
মফিদুল হক : এটা বিকেলের দিকে কোনো এক সময়ে। তখন অবশ্য আত্মসমর্পণ হয়ে গেছে। এরপর আমি চলে এলাম তেজগাঁও বিমানবন্দরে। জেনারেল অরোরা এবং অন্য ভারতীয় সামরিক অফিসাররা তখন দেশে ফিরে যাচ্ছিলেন। আমি এসে দেখলাম তাদের বিদায়ের দৃশ্য। সেখানে বাঙালি সামরিক অফিসাররাও ছিলেন। মেজর হায়দার ছিলেন। একটা মিলনমেলা হলো সেখানে। আমরা যারা কাজ করতাম তাদের সবার সঙ্গে তো আর দেখা হতো না। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় সেদিন সেটা ঘটে গেল।
সমকাল : নয় মাসে একটি শক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কথা। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতেন কীভাবে?
মফিদুল হক : এটা আমরা কেউ পুরোপুরি জানতাম না। উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা জানতেন। আমরা শুধু আদেশ পালন করতাম। নিতুন কুণ্ডু যখন চলে গেলেন, তার গাড়িটা আমাদের দিয়ে গেলেন। আমরা তার গাড়িটা ব্যবহার করতাম। ওই গাড়িটা আমাদের বড় একটা অবলম্বন হয়েছিল। ওই গাড়িটা নিয়েই আমরা বিভিন্ন জায়গায় যেতাম এবং যোগাযোগ রক্ষা করতাম। আমাদের বলা হতো, এখান থেকে ওষুধ নিয়ে ওখানে যাও। এ জিনিসটা ওখানে পেঁৗছে দাও।
সমকাল : আপনাদের নেটওয়ার্কটি পরিচালনা করতেন কে?
মফিদুল হক : আমাদের নেটওয়ার্কটি পরিচালনা করতেন কাজী আজিজুল হক, ইঞ্জিনিয়ার আবুল কাশেম। আগে থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির গোপন তৎপরতা থাকায় আমাদের পক্ষে একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়েছিল। নতুন করে নেটওয়ার্ক গঠন করার জন্য তেমন কোনো প্রচেষ্টা চালাতে হয়নি। এটি ছিল খুব ভালো একটি দিক।
সমকাল : দুই নম্বর সেক্টর বা ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ হতো না?
মফিদুল হক : ফরমাল যোগাযোগের দরকার পড়ত না। ওরা নিজেদের মতো করে কাজ করত। আমরাও। তবে দেখা-সাক্ষাৎ কিছু কিছু হতো। সবাই জানত আমরা যার যার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। যদি ঢাকায় একটা বড় রকমের লড়াইয়ের দরকার হতো তখন হয়তো পারস্পরিক যোগাযোগের দরকার পড়ত।
সমকাল : এমন প্রস্তুতি ছিল?
মফিদুল হক : যদি তেমন ঘটত তবে প্রস্তুতিটা হয়ে যেত। কারণ ঢাকার আশপাশে গেরিলাদের একটা বড় বেল্ট দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বাঙালি প্রস্তুত ছিল।
সমকাল : যুদ্ধের সময় ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের মনোভাব কেমন ছিল?
মফিদুল হক : তারা ছিলেন খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। আমাদের সঙ্গে একটা বড় যোগাযোগ ছিল শামসুর রাহমানের। তিনি আমাদের সহযোগিতা করতেন। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। আজাদ ২৫ মার্চের পর শহীদ মধুদার বাড়িতে গিয়ে বুলেটের অনেক খোসা কুড়িয়ে এনেছিল। সে খোসাগুলো নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম শামসুর রাহমানের বাড়িতে। তিনি মধুদাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তার কিছু কবিতা আমরা কপি করে পাঠিয়েছিলাম। অবশ্য শাহাদৎ চৌধুরীর পাঠানো কবিতাগুলোই আগে পেঁৗছে গিয়েছিল। কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। ঠাণ্ডা চলে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শীতের কাপড়ের প্রয়োজন হয়েছিল। তিনি গায়ের কোটটাও খুলে দিয়েছিলেন। ইমদাদ হোসেনের বাসা ছিল আমাদের একটা বড় কেন্দ্র।
সমকাল : মুনির চৌধুরী বা শহীদুল্লা কায়সার?
মফিদুল হক : মুনির চৌধুরীর সঙ্গে অন্যদের যোগাযোগ ছিল। শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হতো। তিনি আমাদের পাড়ায় থাকতেন।
সমকাল : ১৬ তারিখের পরের বিশেষ কোনো ঘটনার কথা আপনার মনে পড়ে?
মফিদুল হক : ১৭ তারিখে জেলখানা খুলে দেওয়া হলো। জেলের বন্দিরা দলে দলে বেরিয়ে এসেছিলেন। সরদার ফজলুল করিমও জেলে বন্দি ছিলেন। তিনি জেল থেকে বেরিয়ে আসার পথে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি তখন বাংলা একাডেমীতে কাজ করতেন। পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। রিকশায় একটা ট্রাঙ্ক নিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৭ ডিসেম্বরে শহীদ মিনারের সেই সভার কথাই বেশি মনে পড়ে। বিকেলে অনুষ্ঠান ছিল। সুফিয়া কামাল এলেন। সবার চোখে পানি। শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হলো। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। ১৭ তারিখের পর একটা খাতা খোলা হলো থানায়, অনেক মানুষ পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন। থানায় গিয়ে তারা ডায়েরি করলেন। খাতা মুহূর্তে ভরে উঠেছিল। সে খাতা এখন কোথায় হারিয়েছে কে জানে!

No comments:

Post a Comment