বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইতিহাসে বন্ধুত্ব, শান্তি, সহযোগিতা, বাণিজ্য ও
অংশীদারিত্বের বেশ কয়েকটি উদ্যোগ অতীতে এসেছে। কখনও ভুল বোঝাবুঝি, কখনওবা
আন্তরিকতার অভাব কিংবা রাজনৈতিক পালাবদলে অনেক উদ্যোগ পথ হারিয়েছে।
টানাপড়েনের সম্পর্কও তৈরি হয়েছে বহুবার। বিবদমান বিভিন্ন ইস্যুতে
চাপান-উতোর চলেছে দু'দেশের মধ্যে। এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের
ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক পৌঁছাতে চাইছে নতুন দিগন্তে। নতুন যুগে,
নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দু'দেশই বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, বাণিজ্য ও কানেকটিভিটির
অর্থপূর্ণ কর্মসূচির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, ট্রানজিট,
সহযোগিতার সমন্বিত রূপরেখা, ১৯৭৪ সালের সীমান্ত নির্ধারণ, সুন্দরবন ও বাঘ
রক্ষা, রেলওয়ে সহযোগিতাসহ বারোটি সম্মতিপত্র, চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা
স্মারক এ সফরে স্বাক্ষরিত হবে। তবে, সব পক্ষই স্বীকার করে বরফ গলতে শুরু
করেছে মাত্র। সব সমস্যার সমাধান এক সফরেই হবে না। সন্ত্রাসবাদ, পানি বণ্টন,
সমুদ্রসীমানা নির্ধারণ, বাণিজ্য ঘাটতি, ভিসা জটিলতা, আস্থার সংকটসহ বহু
ইস্যু এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। দু'দেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্কই পারে
ক্রমান্বয়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে।
অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন
ভারত ও বাংলাদেশ ৫৪টি অভিন্ন নদীর অংশীদার।
বাংলাদেশ আশা করে, আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে উজানের দেশ হিসেবে ভারত
বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা দেবে। বাস্তবে সেটি ঘটেনি। বিগত আওয়ামী
লীগ সরকারের আমলে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ৩০ বছর
মেয়াদি এ চুক্তির ফলে পদ্মায় পানিপ্রবাহ বেড়েছে। বাকি নদীগুলোর ক্ষেত্রে
এমন চুক্তির প্রত্যাশা থাকলেও এতকালে তা হয়নি। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাবি
ছিল উত্তরাঞ্চলের সেচকাজের সঙ্গে জড়িত তিস্তা ব্যারাজের স্বার্থে তিস্তা
চুক্তি হোক। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির
কারণে পূর্বনির্ধারিত থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত এ সফরে তিস্তা নদীর পানি
বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না।
ভবিষ্যতে বহুল আলোচিত টিপাইমুখ প্রকল্পটি আবার আলোচনায় আসতে পারে। ভারত যদি
বৃহৎ এ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জলাধার প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নেয়, তবে
দু'দেশের নদ-নদীর পানির হিস্যা নিয়ে নতুন সংকট দেখা দেবে। বাংলাদেশের
সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকায় নতুন প্রতিবেশগত সংকটও ঘনীভূত হবে।
বাণিজ্য ঘাটতি
বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানির ক্ষেত্রে ৪৮০টি পণ্য
স্পর্শকাতর হিসেবে তালিকাভুক্ত আছে। গত রোববার ভারতের বাজারে ৪৮০টি পণ্যের
ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চেয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন
এফবিসিসিআই। ৬২টি সুনির্দিষ্ট পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিতে রাজি
হয়েছে ভারত। এ পণ্যের ৪৭টি বস্ত্র খাতের। আশা করা হচ্ছে, মনমোহন সিংয়ের
সফরের সময় বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। ৩ সেপ্টেম্বর ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের
সূত্রে বিবিসি জানিয়েছে, বাংলাদেশের ৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার
দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআই সভাপতি এ. কে. আজাদ
জানিয়েছেন, ২০১০-১১ অর্থবছরে ভারত থেকে ৪৫৭ কোটি ডলার আমদানির বিপরীতে
বাংলাদেশ থেকে ভারতে মাত্র ৫১ কোটি ২৫ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। দুই
দেশের বাণিজ্য বাড়ছে, সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়ছে।
সুষম সম্পর্কের স্বার্থেই ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। এ প্রসঙ্গে আনন্দবাজার
পত্রিকার ১২ জুলাই তারিখের সম্পাদকীয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আনন্দবাজার
লিখেছে, 'বাংলাদেশের জন্য শর্তহীনভাবে ভারতীয় বাজার খুলিয়া দিতে হইবে
যাহাতে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতকে স্বাভাবিক বাজার হিসাবে বিবেচনা
করিতে পারেন। বাংলাদেশি পণ্যের উপর কোনও আমদানি শুল্ক আরোপ করা চলিবে না।
বাংলাদেশের নিকট ইহার প্রতিদান চাহিবার প্রশ্নই নাই। তাহাতে ভারতের কোনও
ক্ষতি নাই। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের মোট রফতানির পরিমাণ ১৫০০ কোটি ডলার, আর
ভারতের মোট আমদানির পরিমাণ ৩২,১০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের সমস্ত পণ্যও যদি
ভারতীয় বাজারে পৌঁছায়, তাহারও প্রভাব ভারতীয় অর্থনীতির উপর নামমাত্র।'
ভারতের বাজারের ধারণ ক্ষমতা অনুসারে তারা বাংলাদেশের জন্য যে ছাড় দিতে
যাচ্ছে তাকে রক্ষণশীলতাতাড়িত সামান্য ছাড় বলতে হয়। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে
দু'দেশের অংশীদারিত্বের অনেক ইস্যু মনমোহন সিংয়ের সফরের পরও অমীমাংসিত থেকে
যাবে। ২০১১ সালে দু'দেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ঘটনা হলো, মেয়াদ শেষ
হওয়ার আগেই বাংলাদেশে তৈরি ১ কোটি পিস শুল্কমুক্ত পোশাক ভারতের বাজারে
রফতানি করা সম্ভব হয়েছে। এর আগে ২০০৯ ও ২০১০ সালে ৩১ লাখ ও ৪৫ লাখ পিস
পোশাক রফতানির সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। সুযোগগুলো কাজে লাগেনি অশুল্ক
(নন-ট্যারিফ) বাধার কারণে। এবার রফতানির ক্ষেত্রে শুল্ক দিতে হয়নি, আবার
অশুল্ক বাধাও ছিল না। এ অভিজ্ঞতা থেকে রফতানিকারক, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুল্ক বাধা দূর করার সঙ্গে অশুল্ক বাধাগুলোও দূর করা
দরকার।
ট্রানজিট
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে
পণ্য পেঁৗছানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে ট্রানজিটের দাবি করে আসছে ভারত। এ দাবির
সঙ্গে জড়িত মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের প্রশ্নও। অতীতমুখী মানসিকতা
ঝেড়ে ফেলে বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে অগ্রসর ভূমিকা নিয়েছে। বাংলাদেশ শুধু
ভারত-বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিটই নয়, ভুটান-নেপাল এমনকি চীন পর্যন্ত
ট্রানজিটের ব্যাপারে উৎসাহী। ড. সিংয়ের সফরে ট্রানজিট নিয়ে সম্মতিপত্র
স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের
সঙ্গে দরকষাকষির মূল ভিত্তি ট্রানজিট। ফলে প্রস্তুতি নিয়েই চূড়ান্ত চুক্তি
করতে হবে। অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এখনও সন্তোষজনক নয়। এমন পরিস্থিতিতে
ট্রানজিট থেকে মাশুলসহ অর্থনৈতিক লাভের বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরার ওপর
গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে ভারতের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের
সরাসরি যোগাযোগ ছিল। এতে উভয় দেশ অতীতে লাভবান হয়েছে। দিলি্লভিত্তিক
সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সিনিয়র ফেলো সি. রাজা মোহন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
পত্রিকায় লিখেছেন, মনমোহনের এই সফর শুধু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেই
নয়, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের জন্যই একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।
নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এবং চীন পর্যন্ত এ সফরের প্রভাব পড়তে পারে।
ট্রানজিট থেকে ভারত যেমন পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে, তেমনি বাংলাদেশেরও
উপযুক্ত ট্রানজিট মাশুল পাওয়া উচিত। দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের বাইরে
নেপাল-ভুটান পর্যন্ত ট্রানজিট সুবিধা বিস্তৃত হওয়া উচিত।
সমুদ্রসীমা
বাংলাদেশ ও ভারতের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর অন্যতম সমুদ্রসীমা।
বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও
মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ। দুঃখজনক হলেও সত্য,
দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার পথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পথ সুগম হয়নি। সরকার
তাৎক্ষণিকভাবে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন ফর ল' অব
সি (ইউএনসিএলওএস) অনুসারে হেগভিত্তিক পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনের
দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেকেই মনে করেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত
সঠিক ছিল। সালিশ আদালতে বাংলাদেশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও মিয়ানমারও
তাদের দাবি জানিয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, গভীর সমুদ্রের প্রায় পুরো এলাকাই
নিজেদের বলে দাবি করেছে দেশ দুটি। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বাংলাদেশ এখন
সমুদ্রের ন্যায্য অংশ পাবে বলে আশা করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে
দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যাটির সমাধান কেন বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর মধ্যে সম্ভব হলো
না এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রতিবেশী অনেক দেশই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে
পরস্পরের মধ্যে চুক্তি করেছে। বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষেত্রে তা হবে না কেন, এ
প্রশ্ন সবার। সমুদ্রসীমা নির্ধারণ ছাড়াও দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা,
হাড়িভাঙা নদীপ্রবাহের দাবি অমীমাংসিত সমস্যার তালিকা দীর্ঘদিন ধরেই ভারী
করে রেখেছে।
ছিটমহল ও সীমান্ত পুনর্নির্ধারণ
ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশে, আর
বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল আছে ভারতে। সীমান্ত নির্ধারণের জটিলতায় দেশভাগের
সময় থেকেই এসব ছেঁড়া ভূখণ্ড তৈরি হয়েছে। 'না ঘরকা না ঘাটকা' অবস্থানে
ছিটমহলবাসী একরকম বন্দি জীবন-যাপন করেন। তিন বিঘা করিডোরের মানুষের যাতায়াত
সমস্যা বহুল আলোচিত। একটি ওভারব্রিজ নির্মাণ করে এ ছিটমহলে বাংলাদেশিদের
যাতায়াত সুগম করার ব্যবস্থা এবার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে
করেন, কিছু ছিটমহলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও
বেশ কয়েকটি কোনোভাবেই স্বাভাবিক যোগাযোগের আওতায় আসবে না। ফলে ছিটমহল
বিনিময়ই যথার্থ সমাধান দিতে পারে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে স্বাক্ষরিত
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের কথা থাকলেও তা সীমিত আকারে
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাস্তবায়িত হয়েছে। ভারত পার্লামেন্টে ইন্দিরা-মুজিব
চুক্তি রেটিফাই করেনি বলে তাদের দিক থেকে চুক্তি বাস্তবায়িত হতে পারেনি।
এবার আশা করা হচ্ছে, দু'দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি
চূড়ান্ত হবে। ছিটমহলবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হবে বলেও
সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। বাংলাদেশে ভারতের ছিটমহল আছে ১৭ হাজার ১৫৮ একর আর
বাংলাদেশের ভারতে ছিটমহলের মোট আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর। ইতিমধ্যে ভারতের
বিজেপি, আসামের উলফাসহ বিভিন্ন কট্টর রাজনৈতিক দল ভূমি বিনিময়ের বিরোধিতা
করেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ টিম ইতিমধ্যে ৪০৯০ কিলোমিটার অপদখলীয় ভূমি সমস্যা
সমাধান ও অনির্ধারিত সীমান্ত পুনর্নির্ধারণের কাজ শুরু করেছে।
সন্ত্রাসবাদ-বিচ্ছিন্নতাবাদ ও অপরাধ
২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের সময় যৌথ ইশতেহারে সব ধরনের
সন্ত্রাসবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও অপরাধীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যৌথ অঙ্গীকার
ব্যক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশ এ অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অতিদ্রুত সক্রিয়
হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খুঁজে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দিলি্ল-ঢাকা
সম্পর্কের ব্যারোমিটার ইতিহাসে বহুবার ওঠানামা করেছে এ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের
কেন্দ্র করে। এবার ঢাকার অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা দিলি্লকে আশ্বস্ত করতে
পেরেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতে লুকিয়ে থাকা
অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের হস্তান্তরের দাবি আছে। ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর
সাজাপ্রাপ্ত দুই খুনিকে ফেরত চায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সন্ত্রাসী ও
অপরাধীরা সীমান্ত পেরিয়ে যাতে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য ভারতের
মনোযোগও বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে। পাশাপাশি সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে মানব পাচার,
মাদক পাচার বন্ধের বিষয়গুলোও বিশেষ গুরুত্ব দাবি করছে। ভারতের
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদাম্বরমের সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে সন্ত্রাসী,
অপরাধী ও সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ফেরত প্রদানের আশ্বাস পাওয়া গেছে। আশা করা
হচ্ছে, পারস্পরিক স্বার্থেই দু'দেশ সন্ত্রাসবাদী ও অপরাধীদের বিষয়ে সজাগ
থাকবে।
সীমান্তে রক্তপাত
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দীর্ঘদিনের সমস্যা ভারতীয়
সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে বেসামরিক ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানি। অতীতে এ
সমস্যার কারণে বহুবার দু'দেশের মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে।
বিএসএফ, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্তে প্রাণহানি বন্ধের আশ্বাস দিলেও
পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। প্রাণঘাতী নয়, এমন রাবার বুলেট ব্যবহারের
প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। তাতেও হত্যাকাণ্ড কমেনি। অবশ্য ভারতের
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদাম্বরমের বাংলাদেশ সফরের পর সীমান্তে হত্যাকাণ্ড
কমে এসেছে। সাধারণত গ্রামবাসী, কৃষক, রাখালরা অসাবধানতাবশত সীমান্ত অতিক্রম
করে গুলির মুখে পড়ে। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাও গুলির শিকার হন।
আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে অসাবধানতাবশত সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য দায়ী
ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর হাতে সোপর্দও করা যায়। তা না করে গুলি করাকে সমাধান হিসেবে মানতে
নারাজ বাংলাদেশের মানুষ। সমস্যা সমাধানের জন্য প্রাণহানির বিকল্প কোনো পথ
বের হলে দু'দেশের জন্য তা স্বস্তির কারণ হবে।
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিনিময়
স্মরণাতীত কাল থেকে বাংলাদেশ ও ভারত একই
ইতিহাসের অংশীদার। ঐতিহাসিক কারণেই দু'দেশের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক,
বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক বিনিময় চালু আছে। স্বাভাবিক এই যোগাযোগ কখনও কখনও
রাষ্ট্রীয় গণ্ডিকেও অতিক্রম করতে চায়। ভারত ও বাংলাদেশে এমন বহু ভাঙা
পরিবার আছে যাদের এক অংশ থাকে বাংলাদেশে আরেক অংশ পশ্চিমবঙ্গে। এ
পরিবারগুলোর মধ্যে যোগাযোগ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। এছাড়া
শিক্ষাগত প্রয়োজন, ব্যবসা, পর্যটন, চিকিৎসাসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা
কারণে দু'দেশে মানুষের যাতায়াত আছে। রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সাফল্য অনেকটাই
নির্ভর করে এ যোগাযোগের ওপর। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে ভিসা পাওয়ার
ক্ষেত্রে নানা জটিলতা আছে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা
পদ্ধতি সম্মানজনক নয়। সম্প্রতি অনলাইনে আবেদনের ব্যবস্থা হয়েছে কিন্তু
তাতে ভিসা ভোগান্তি কমেনি। বাংলাদেশিরা এ ক্ষেত্রে সম্মানজনক ও সহজ একটি
ব্যবস্থা আশা করে।
সড়ক ও রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা আছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে
বাস যোগাযোগ সহজতর হয়েছে। দু'দেশের মধ্যে মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু হয়েছে।
শ্লথগতির কারণে মৈত্রী এক্সপ্রেস যাত্রী আকৃষ্ট করতে পারছে না। অথচ ট্রেনকে
জনপ্রিয় করতে পারলে দু'দেশের যোগাযোগ সহজ ও সুলভ হতে পারত। বাংলাদেশের
মানুষ আশা করে ট্রেনের মধ্যেই কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হোক। তাতে
ভোগান্তি কমবে, সময়ও বাঁচবে।
দু'দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা আছে। বিশেষত
বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভারতে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে যে বাধা আছে তা
অপসারণ করার দাবি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে।
দু'দেশের সরকারের মধ্যে চুক্তি করে বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে ভারতীয়
কর্মকর্তারা মনে করেন। ভারতীয় কেবল অপারেটর ও ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গেই
বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের চুক্তি করতে হবে। কিন্তু এমন যোগাযোগ শিগগিরই হয়ে
উঠছে না। আছে বই আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রেও জটিলতা। পশ্চিমবঙ্গ ও
বাংলাদেশের ভাষা এক হলেও বই বা পত্রিকা বিনিময় এত বছরেও একপক্ষীয় রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের প্রকাশকদের দাবি এ দেশের পর্যাপ্ত বই ভারতে রফতানির ব্যবস্থা
হোক। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধানের
প্রক্রিয়া ইতিবাচক গতি পাক, এটাই এদেশের সচেতন নাগরিকদের আশা।