বন্যাপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের বিশেষ পরিচয় আছে। শোনা যায়, এক সময়
দেশের বাইরে বাংলাদেশের অধিবাসী বলে পরিচয় দিলেই বিদেশিদের মুখে মেঘ করে
আসত। মুহূর্তেই তারা ভেবে বসতেন এ লোক নিশ্চয়ই বানভাসি, নয়তো
সাইক্লোনতাড়িত, নয়তো কোনো ঝড়ে এর ভিটেমাটি উচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখনও এই পরিচয়
পুরোটা ঘোচেনি। তবে দুর্যোগতাড়িত বাঙালির আরও নানা পরিচয় জুটেছে বিশ্বের
দরবারে। আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিচয় আছে। সঙ্গে আছে প্রবাসী,
অনাবাসীদের নানা সুকৃতিও। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বললে বন্যায় প্লাবিত সেই
বিস্তীর্ণ ভূভাগের কথা সহসা চোখে ভাসে না। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে
বন্যা কম হয়েছে। কিন্তু বন্যার বাস্তবতা তিরোহিত হয়েছে বলে মনে হয় না। এ
দেশে সবাই জানেন, বর্ষা মৌসুমে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। তাতে
জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতিও হতে পারে। দেখার মতো প্রস্তুতি না থাকলেও মনে
মনে সবাই প্রস্তুত থাকে। নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই নানা আশঙ্কায়
সকলে দিন গুনতে থাকে। এমন বন্যাপ্রবণ দেশ হিসেবে পৃথিবীর কোথায় বন্যা হচ্ছে
তার খোঁজখবর রাখাটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিককালের
কয়েকটি মহাবন্যার খবরও এ দেশের মানুষকে তেমন দোলা দিয়েছে বলে মনে হয় না।
মহাপ্লাবনের কথা আমরা ধর্মগ্রন্থ, পুরাণ, পুরনো সাহিত্য থেকে জানি।
সাম্প্রতিক এ ঘটনাগুলোকে অনেকে মহাপ্লাবনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু
আপাতত মহাবন্যা বললেই বোঝা যাবে এগুলোর আকার-প্রকার। থাইল্যান্ডের মহাবন্যা
প্লাবিত করেছে চাও ফারিয়া নদীর দুই কূল। বন্যা এখনও চলছে। ছড়িয়েছে মেকং
নদীতেও। সেপ্টেম্বরে শুরু হয়ে অক্টোবরে বন্যা বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবনকে
প্লাবিত, পর্যুদস্ত করে তুলেছে। সেখানকার বন্যার সচিত্র খবর প্রতিদিনই
বাইরের পত্রিকাগুলোতে দেখা গেলেও আমাদের পত্রপত্রিকাগুলোতে কিন্তু এখনও
দেখার মতো করে ছাপা হচ্ছে না। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার মহাবন্যার তেমন খবরও
আমরা দেখিনি। কুইন্সল্যান্ড ও ভিক্টোরিয়ার বিপুল অঞ্চল ২০১০-১১তে পুরো
তলিয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি, প্লাবন ও ঢলে মানুষের জীবন অচল হয়ে গিয়েছিল। তখন
বাইরের পত্রিকাগুলোতে এ বন্যাকে মহাপ্লাবন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এমনকি
সার্কভুক্ত পাকিস্তানের বন্যাও আমাদের এখানে বড় খবর তৈরি করতে পারেনি।
প্রায় ৩০ লাখ বর্গমাইল এলাকা প্লাবিত হয়েছিল ২০১০ সালে। জানমালের বিপুল
ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। পাকিস্তানে বোমা বিস্ফোরণ বা এমন কিছু ঘটলে তা মুহূর্তেই
ছড়িয়ে যায়। অথচ বন্যায় ২০ মিলিয়ন মানুষ প্রচণ্ড দুর্বিপাকে কাটাল সে খবর
আমরা নিলামই না। বন্যা এবারও হয়েছে পাকিস্তানে। ২০১০-এর মতো না হলেও এবারের
বন্যার ভয়াবহতাও কম নয়। কিন্তু রাজনৈতিক নানা খবরকে ছাড়িয়ে সে বন্যার খবর
আমাদের কানে পশতে পারেনি। পৃথিবীতে বড় ঘটনা ঘটলে তা প্রচার পাওয়ার কথা। এর
নিজস্ব রীতি আছে। পাঠক পড়তে চায়। কিন্তু বন্যার ব্যাপারটা আলাদা। আমরা যখন
পাশের দেশে এশিয়ায় বন্যার খবর নিচ্ছি না, বিচলিত হচ্ছি না তখন আমাদের দেশে
বন্যা, সাইক্লোন হলে পাশের দেশগুলোর মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচার হবে এটি
কীভাবে আশা করব? আমরা কি তখন বলব, বাংলাদেশের খবর বিশ্বমিডিয়ায় উপেক্ষিত?
আমরা যখন দায়িত্ব পালন করি না তখন অন্যদের দায়িত্ববোধ কীভাবে আশা করব?
No comments:
Post a Comment