Friday, September 16, 2011

আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশ

পার্বত্য দার্জিলিংয়ের একটি স্থানের নাম 'ঘুম'। সেখানে আছে একটি ছোট রেলওয়ে স্টেশন। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭ হাজার ৪০৭ ফুট ওপরের এ স্টেশনটি ভারতের সবচেয়ে উচ্চতম রেলওয়ে স্টেশন। দার্জিলিংয়ে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে ঘুম অন্যতম। জায়গাটির নাম ঘুম বলে নয়, ঘুমের কাছের টাইগার হিলই বরং পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। টাইগার হিল থেকে সুন্দরতম পার্বত্য চূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যায়। আকাশ ফরসা থাকলে মাউন্ট এভারেস্টের দেখাও মেলে। অবশ্য সবার কাঞ্চনজঙ্ঘা বা এভারেস্ট দেখার ভাগ্য হয় না। কারণ ঘুম মেঘের রাজ্য। সুউচ্চ এই পার্বত্য এলাকায় মানববসতির গায়ে গা ঘেঁষে মেঘ থাকে। চাইলেই ছোঁয়া যায় এমন সব মেঘ। পাশ দিয়ে মেঘ উড়ে গেলেও লোকে ভিজে যায়। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি হয়। আর দৃষ্টিপথকে আচ্ছন্ন করতে ঘুমের মেঘের কোনো জুড়ি নেই। তাই মেঘই ঠিক করে দেয় কে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে, কে দেখবে না।
আমি কখনও দার্জিলিং যাইনি, ঘুম দূরের কথা। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় দার্জিলিং দেখেছি। কলকাতার পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি সিনেমার নাম 'তিতলি'। তিতলি মানে বর্ষার প্রথম দিন। হিন্দিতে তিতলি মানে অবশ্য প্রজাপতি। মিঠুন চক্রবর্তী, কঙ্কনা সেনশর্মা, অপর্ণা সেন অভিনীত সেই সিনেমায় ঘুম নামের জায়গাটিতে মিঠুন চক্রবর্তীর গাড়ি থেমে গিয়েছিল। বাংলা অঞ্চলে ঘুম নামে যে একটি জায়গা আছে সেটি জানা হয়ে যায় ওই সিনেমা দেখতে দেখতে। ঘুম শব্দটি তখন থেকেই আমার কাছে একটি স্থানের নাম। সুউচ্চ পার্বত্য দার্জিলিংয়ের নির্জন একটি জায়গা। যেখানে মেঘের নিবাস। চাইলেই, হাত বাড়ালেই মেঘ ছোঁয়া যায়। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি এসে পথিককে ভিজিয়ে দেয় যেখানে। ঘুম বললে একটি দৃশ্যহীনতা তৈরি হওয়ার কথা। বড়জোর পাতা বন্ধ দুটো চোখের দৃশ্য ভাসতে পারে। কিন্তু ঘুম বলতে যে একরাশ বৃষ্টিভেজা সবুজ চোখে ভাসতে পারে তার কৃতিত্ব ঘুম জায়গাটিকেই দিতে হবে। কিন্তু জায়গাটির নাম কীভাবে ঘুম হলো? হয়তো পর্যটকের ভিড় লাগেনি যখন, যখন নীরবতাই ছিল স্থানটির আবহসঙ্গীত, তখন এর নামকরণ হয়েছিল ঘুম। নৈঃশব্দ্য জায়গাটিকে ঘুমের তুলনীয় করে তুলেছিল।
কিন্তু ঘুম কি নীরবতা? আমাদের কবির কাছেও ঘুম অরব অন্ধকারের ব্যাপার। কোন কবি? প্রশ্নটা কি খুব কঠিন? কে ঘুম শব্দটাকে বাংলায় বহুবর্ণিল তাৎপর্যে ও গভীর দ্যোতনায় ব্যবহার করেছেন সবচেয়ে বেশি? জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দীয় ঘুম আসলে মৃত্যুরই আরেক নাম। 'আট বছর আগে একদিন' কবিতার সেই বিখ্যাত ঘুমের কথা অনেকের কণ্ঠস্থ। একবার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল কবিতার চরিত্রটির। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত জাগরণের কালে জ্যোৎস্নায় সে হয়তো কোনো ভূতকেই দেখে ফেলেছিল। এর পর থেকে প্রেম, আশা, সন্তান, বধূসহ জীবনের সব আয়োজন থাকার পরও তার মরিবার সাধ হয়। অশ্বত্থের শাখায় উদ্বন্ধনে আত্মাহুতি দেয় সে। অবশেষে আকাঙ্ক্ষিত ঘুম আসে তার। লাশ কাটা ঘরে টেবিলের 'পরে শুয়ে ঘুমায় এবার। কিন্তু কখন মানুষ এই ঘুম চায়? 'নারীর হৃদয়_ প্রেম-শিশু-গৃহ_ নয় সবখানি;/অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়_/আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/খেলা করে;/আমাদের ক্লান্ত করে;/ক্লান্ত ক্লান্ত করে ;/লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই,/তাই/লাশকাটা ঘরে/চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।' তবে কি এক ধরনের বিদগ্ধ ক্লান্তি, জীবনের নেতিবাচক উপলব্ধি থেকে পলায়নের জন্য ঘুমকে আশ্রয় করে লোকে। কোনোদিন জাগিবে না জেনেও, সেই ঘুমকে আবাহন করে। কেননা সে জাগিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম অবিরাম ভার আর সহিবে না বলে সিদ্ধান্তে এসেছে। তাই এই চিরঘুম, চিরনীরবতা। অবশ্য 'অন্ধকার' কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিতে চিরঘুম থেকে জাগবার ক্ষীণ আশা দেখা গিয়েছিল। সেখানে শুরুতেই কবি বলেছেন, 'গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার'। কিন্তু পাঠক এই জাগরণকে স্বাগত জানাবার আগেই কবি জাগরণের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। বললেন, কোনোদিন জাগবেন না জেনেই পৌষের রাতে ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে শুয়েছিলেন। কিন্তু জেগে উঠে দেখলেন পাণ্ডুর চাঁদ কীর্তিনাশার দিক থেকে অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে। অবশ্য এই চাঁদের ক্ষমতা সামান্য। হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে, রয়েছে যে অগাধ ঘুম, সে ঘুম নষ্ট করার শেল তীব্রতা এ চাঁদের নেই। দোষ শুধু চাঁদের নয়। অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকার পর হঠাৎ আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে পৃথিবীর জীব বলে নিজেকে শনাক্ত করতে পারলেও কবি ভয় পেয়েছেন, বেদনাবিদ্ধ হয়েছেন, ঘৃণা ও আক্রোশে তার হৃদয় ভরে গেছে। তাই আবারও ঘুমকেই_ শ্রেয়তর মনে হয়েছে তার। 'গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;/আমাকে কেন জাগাতে চাও?/হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া/আমাকে জাগাতে চাও কেন।/অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর;/তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে/অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে/কীর্তিনাশার দিকে।/ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব-ধীরে-পউষের রাতে।/কোনদিন জাগব না জেনে-/কোনোদিন জাগব না আমি_ কোনোদিন আর।'
আমাদের প্রিয় কবির কাছে ঘুম হলো জীবনের প্রতি নির্মম প্রতিশোধের উপায়_ মৃত্যু। মৃত্যুর উপমা হিসেবে ঘুমের ব্যবহারে জীবনের প্রতি প্রত্যাখ্যান আছে; আশাহীন, দিশাহীন জীবন থেকে পলায়নের বার্তাও আছে।
বিশ শতকের আধুনিক এক কবির ঘুম চেতনায় হয়তো কেউ বিস্মিত হবেন না বা চমকে যাবেন না। নেতির এ আয়োজন আধুনিকোচিত বলেই বিবেচিত হয়। কিন্তু কোনো ধর্মীয় আচারে যদি ঘুমকে মৃত্যুর সমতুল্য বলা হয় তবে হয়তো অনেকেই চমকে যাবেন। মুসলমানরা দৈনন্দিন প্রায় সব কাজের আগে দোয়া পড়ে আল্লাহকে স্মরণ করেন। ঘুমের আগে তারা যে দোয়াটি পড়েন তা হলো, 'আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া'। আরবি এ দোয়ার অর্থ_ 'হে আল্লাহ তোমার নামে আমি মৃত্যুকে বরণ করলাম, তোমার নামেই জেগে উঠব আবার।' এখানে কি ঘুম মৃত্যুর উপমা, নাকি মৃত্যুই ঘুম এখানে?
ঘুমকে অন্য এক তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হতে দেখা যায় সুরা কাহফে। কোরআনের তাফসিরকারীদের মতে, ঘটনাটি এফসুস অঞ্চলের। রোমান শাসক সিজার দাকিয়ানুস বা ডিসিয়াসের সময়কার। তখন রোমে অনেকে ঈসা নবীর প্রচারে ধর্মান্তরিত হলেও সম্রাট ডিসিয়াস ছিলেন প্রচণ্ড বিরোধী মনোভাবাপন্ন। তার সাম্রাজ্যের কয়েকজন যুবক ঈসা নবীর অনুসারী হয়েছে জানতে পেরে তিনি তাদের ডেকে পাঠান এবং ধর্মমত পরিবর্তনের জন্য তিন দিন সময় বেঁধে দেন। তিন দিনের অবকাশের সুযোগে যুবকরা পাহাড়ের পথ ধরেন। তারা চেয়েছিলেন পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে থেকে রাজার রুদ্ররোষ থেকে বাঁচতে। পথে একটি কুকুর তাদের সঙ্গী হয়। পাহাড়ে গিয়ে একটি গুহায় লুকিয়ে পড়েন তারা। সঙ্গী কুকুরটি গুহার দরজায় পাহারার দায়িত্ব নেয়। যুবকরা জেগে ওঠার পর পরস্পরের মধ্যে কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। তাদের কেউ বলেন, একদিন, কেউ বলেন দিনের একটি অংশ বড়জোর ঘুমিয়েছেন তারা। ক্ষুধার্ত থাকায় সঙ্গীদের একজনকে খাবার আনতে শহরে পাঠান তারা। সঙ্গী খাবার আনতে গিয়ে দেখেন শহরে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। মূর্তিপূজা ছেড়ে সবাই এক স্রষ্টার অনুসারী হয়েছে। এতে তিনি ভীষণ অবাক হয়ে যান। দোকানে খাবারের বিনিময়ে মুদ্রা দিতে গেলে দোকানদার তাকে অবাক করে দিয়ে বলেন, এ মুদ্রা তো দুশ' বছর আগেকার। গুহাবাসী যুবক তখন বলেন, কালই তারা শহর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন। দোকানদার ও আশপাশের লোকেরা যুবককে সম্রাট তেযোসিস বা সিজার দ্বিতীয় থিয়োডসিসের কাছে নিয়ে যান। সম্রাটসহ লোকেরা গুহা পর্যন্ত তার সঙ্গী হন। গিয়ে দেখেন সত্যিই সেখানে দুশ' বছর আগের যুবকরা অবস্থান করছে। তখন মৃত্যুর পরের জীবনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিকে হয়ে আসছিল। আসহাবে কাহফের অভিনব ঘটনায় মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও পরকালের প্রতি সবার বিশ্বাস ফিরে আসে। লোকদের বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়ে যুবকরা আবার গুহায় গিয়ে শুয়ে পড়েন এবং সেখানে তাদের মৃত্যু হয়। আসহাবে কাহফ বা গুহার মানুষদের এ ঘটনা ঘুমের অন্য এক তাৎপর্য হাজির করে। ঘুম মৃত্যুর সমান_ এ কথা যেমন বলা হয়েছে; তেমনি ইসলামী বিশ্বাসে মৃত্যুর তুলনা হিসেবেও ঘুম ব্যবহৃত হয়েছে। ঘুমের পর যেমন আছে জাগরণ, তেমনি মৃত্যুর পরও আছে পুনরুত্থান ও পরকাল।
আসহাবে কাহফের ঘটনা ঈসা নবীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘটিত হলেও বাইবেলে এ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। জেমস সারোজি নামের একজন খ্রিস্টান জাজক ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ষোড়শ শতকের প্রোটেস্টান্ট সাহিত্যে এবং সিরিয়ান সাহিত্যে এ ঘটনার উল্লেখ আছে। কোরআনে ঘুমন্ত ব্যক্তিদের নিশ্চিত কোনো সংখ্যা বলা না হলেও পাশ্চাত্যের সাহিত্যে সাত সংখ্যাটি পরিচিত। পরবর্তীকালে পাহাড়ের সাত ঘুমন্ত ব্যক্তির দীর্ঘ ঘুমের ধারণা অবলম্বন করে আধুনিক সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্যে আমেরিকান লেখক ওয়াশিংটন আরভিংয়ের 'রিপ ভ্যান উইঙ্কেল' ব্যাপকভাবে পরিচিত। উপন্যাসে রিপ ভ্যান উইঙ্কেল একজন আমুদে, অলস ব্যক্তি। শহরে সবাই তাকে পছন্দ করে। কিন্তু বউ তাকে খোঁটা দেয়। বউয়ের খোঁটা সইতে না পেরে একদিন সে অপরিচিত কিছু লোকের সঙ্গী হয়। এবং সঙ্গীদের সঙ্গে নেশা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে ওঠার পর বাড়িতে গিয়ে কিছুই আর চিনতে পারে না। শহরে গিয়েও দেখে সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কেননা ঘুমের মধ্যেই অনেক বছর কাটিয়ে জেগে উঠেছিল রিপ ভ্যান উইঙ্কেল। রিপ ভ্যানের মতোই আরেক অলস চরিত্র অবলোমভ। রিপ ভ্যানের মতো বিখ্যাত না হলেও অবলোমভই বেশি অলস। তবে দীর্ঘস্থায়ী ঘুমের চক্করে অবলোমভকে পড়তে দেখি না আমরা। অবলোমভ বরং দীর্ঘস্থায়ী আলস্যের চক্করে পড়ে থাকে। অবলোমভ রাশিয়ান চরিত্র। তার আলস্য এতটাই সিরিয়াস ছিল যে, ১৯২২ সালে রাশিয়ার বিপ্লবী নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ ইলিয়ানভ লেনিন একটি বক্তৃতায় বলেন, 'রাশিয়া তিন-তিনটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু অবলোমভরা এখনও রয়ে গেছে, এদের ধুয়ে দিতে হবে, পরিষ্কার করে ফেলতে হবে, এদের মূলোৎপাটন করতে হবে। নতুনভাবে জেগে ওঠার আগে এদের ঝাড়েবংশে নির্মূল করতে হবে।' লেনিনের ঘোরতর শত্রু অবলোমভরা কিন্তু প্রতাপশালী জার, সামন্ত প্রভু বা বুর্জোয়া নয়। এরা একান্তই আলস্যের প্রতিভূ। তাও আবার বাস্তবের অলস নয়, উপন্যাসের চরিত্র। ইভান গনচারভের জনপ্রিয় উপন্যাস অবলোমভের মূল চরিত্র অবলোমভ। রাশিয়ার অভিজাত পরিবারের সদস্য অবলোমভ উদ্যমহীনতা, কর্মহীনতা, উদ্যোগহীনতা সর্বোপরি আলস্যের প্রতীক। রাশিয়ায় তরুণদের মধ্যে, বিশেষত অবস্থাপন্ন ঘরের তরুণদের মধ্যে একসময় আলস্য প্রবণতা প্রচণ্ড জাঁকিয়ে বসেছিল। এদের মাথায় রেখেই অবলোমভ উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল। পরে এ ধরনের লোকদের অবলোমভ হিসেবে আখ্যায়িত করা হতে থাকে। এবং অবলোমভিজম নামে একটি মতবাদেরও জন্ম হয়। অবলোমভিজমের প্রভাব কতদূর বিস্তৃত তা বলতে গিয়ে এক সমালোচক লিখেছেন, এমনকি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণও এই অবলোমভিজম। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, রাশিয়া তার জগৎ বিখ্যাত আলস্য কোথায় পেল? উত্তরও এসেছে। তা হলো পূর্বদিক বা প্রাচ্য থেকে এই আলস্য এসেছে। পূর্বদিক মানে আমাদের অঞ্চল। আমাদের অঞ্চল থেকে যদি আলস্য রাশিয়ায় রফতানি হয়ে থাকে তবে এখানে আলস্য ব্যাপারটা কতটা শক্তিশালী তা সহজেই অনুমেয়। একসময় আমাদের অঞ্চলে আলস্য ব্যাপারটি দর্শনের পর্যায়ে পেঁৗছে গিয়েছিল। মহাযান বৌদ্ধ মতবাদে জেন বলে একটি ঘরানা আছে। তাতে 'আর্ট অব ডুয়িং নাথিং' শেখানো হয়। অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিছু না করা তো শিখতে হয় না, কিছু না করলেই হয়। কিন্তু জেন মতবাদে বলা হচ্ছে, 'নিশ্চিতভাবেই আমরা সবাই জানি কীভাবে কিছু না করতে হয়। আমরা সবাই জানি কীভাবে বসে থেকে সময় নষ্ট করতে হয়। আমাদের অনেকেই এই কিছু না করতেই ব্যস্ত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমরা যখন কিছু করি না তখন আমাদের মন ব্যস্ত থাকে অন্যত্র, সে কিছু না করায় স্থিত থাকে না। আমরা আসলে আরাম করতে এবং কিছু না করাকে উপভোগ করতে পারি না।' জেন কিছু পালনীয় নিয়মের কথা বলছে যেগুলোর মাধ্যমে কিছু না করা একেবারে কিছু না করায় পর্যবসিত হতে পারে। রাশিয়ানরা যদি আরামের ব্যাপারটি জেনদের কাছে শিখে থাকে তাহলে তারা অনেকটা ভুল শিখেছে তা নিশ্চিত। জেনে যেমন আর্ট অব ডুয়িং নাথিং বলে একটি ব্যাপার আছে, তেমনি আর্ট অব সাউন্ড স্লিপিং বলে একটি ব্যাপারও আছে। নিরাপদ নিরবচ্ছিন্ন ঘুম কতটা প্রয়োজনীয় তা সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারেন অনিদ্রা রোগে আক্রান্ত মানুষেরা। অনিদ্রা রোগে আক্রান্তদের জন্য বহু আগে থেকে এক শান্তিদায়ক তেল তৈরি হয় এ দেশে। তেলটির নাম মোহনীয়_ নিদ্রাকুসুম। নিরাপদ ও নিরুপদ্রব আরাম ও ঘুমের মতো কি শান্তিময় মৃত্যুও আছে নাকি? একসময় কি শিখতে হবে কীভাবে নিরাপদে মরা যায়? তা যদি না হবে তাহলে আমাদের সমাজে কেন 'নিরাপদ মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই' দাবিটি দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে?

No comments:

Post a Comment