লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির পতন তখন আসন্ন। সবাই ভাবছেন ক্ষমতার চূড়া থেকে
পতনের পর এখন কী করবেন কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি? গণমাধ্যমে জোর গুজব
দেশ ছেড়ে সপরিবারে পালাচ্ছেন গাদ্দাফি। সে সময়ও তিনি বলেছেন, 'আমি এই ভূমি
ছেড়ে কোথাও যাব না। এখানেই যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হব।' দেশবাসীর উদ্দেশে
উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন, যাতে তারা ঘর ছেড়ে ময়দানে, রাস্তায় নেমে
প্রতিরোধ করেন বিদ্রোহী সেনাদের। দীর্ঘদিনের অপশাসনে ক্লান্ত,
ত্যক্ত-বিরক্ত মানুষ তার পক্ষে নেমে আসেনি। বরং বিদ্রোহীদের সঙ্গেই হাত
মিলিয়েছে। কিন্তু কথা রেখেছেন গাদ্দাফি। ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের
(এনটিসি) যোদ্ধারা যখন একের পর এক শহরের পতন ঘটিয়ে গাদ্দাফির জন্মস্থান
সিরতের দিকে এগোচ্ছিল, তখনও তিনি দেশে ছিলেন। সিরতের চূড়ান্ত পতনের সময়ও
তিনি যুদ্ধরত ছিলেন। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, সিরতেই তিনি আহত
অবস্থায় গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকৃত অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে
বলে ধারণা করা হচ্ছে। এনটিসির শীর্ষ মুখপাত্র মাহমুদ শাম্মাম বলেছেন,
কর্নেল গাদ্দাফি মারা গেছেন। 'আজ নতুন এক লিবিয়ার জন্ম হলো। এটাই প্রকৃত
মুক্তির দিন। আমরা তার বিচার করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলাম। আল্লাহর হয়তো
অন্য ইচ্ছা ছিল।' এভাবেই তার মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেছেন শাম্মাম। ইরাকের
সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর পর আরব বিশ্বে তিনিই ছিলেন
পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর চক্ষুশূল একমাত্র জীবিত নেতা। ১৩ ডিসেম্বর ২০০৩-এ
গ্রেফতারের পর বিচারের মাধ্যমে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল ৩০
ডিসেম্বর ২০০৬ তারিখে। কর্নেল গাদ্দাফি কোনো বিচারের মুখোমুখি হতে পারলেন
না। ২০ অক্টোবর ২০১১ তারিখটিই ইতিহাসে তার মৃত্যুদিন হিসেবে লেখা
থাকবে। তবে, অনেক বিষয়ে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তার মিল। সাদ্দামের মতো গাদ্দাফিও আত্মরক্ষা ও পলায়নের জন্য পাতালপুরী ও পাতালপথ তৈরি করেছিলেন। সেগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে আসেনি। ধরা পড়ার মুহূর্তে দুই নেতাই গর্তে লুকিয়ে আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা করেছেন_ এও এক আশ্চর্য মিল।
সংবাদমাধ্যম তাকে বলে লিবীয় একনায়ক। কেউ কেউ বলে লিবীয় নেতা। লিবিয়ায় সীমিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর তার পদবি হয় 'ব্রাদার লিডার অ্যান্ড দ্য গাইড অব রেভলিউশন'_ অর্থাৎ নেতাভাই ও বিপ্লবের পথপ্রদর্শক। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য গণআন্দোলন শুরু হলে গাদ্দাফি বলেছিলেন তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট নন। তিনি লিবীয়দের স্বাভাবিক নেতা। দেশের সবাই তাকে ভালোবাসে। তাই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়।
কেউ তাকে বলেছেন খামখেয়ালি, গোঁড়া, কেউ বলেছেন পাগল। তার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কও তৈরি করেছেন অনেক নেতা। সম্পর্কের প্রয়োজন ফুরালে আবার তাকেই পাগল বলে গালি দিয়েছেন। গাদ্দাফি বহু বছর পশ্চিমাদের কাছে শত্রু বলে বিবেচিত হলেও নাইন ইলেভেনের পর তার ও পশ্চিমাদের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটে। তিনিই প্রথম ওসামা বিন লাদেনের গ্রেফতার দাবি করেছিলেন। লিবিয়ার গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছিলেন। রীতিমতো প্রেমে পড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসের। তাকে প্রিয় আফ্রিকান নারী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। লিবিয়ার এই পরিবর্তিত মনোভাবকে স্বাগত জানিয়েছিল ওয়াশিংটন, লন্ডনসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছিল। এনটিসির যোদ্ধারা আগস্টে গাদ্দাফির প্রাসাদের পতন ঘটানোর পর বেশ কিছু নথিপত্র মিলেছে যাতে বোঝা যায় শেষ সময়ে পাশ্চাত্য শক্তিগুলো তাকে রক্ষার চেষ্টাও করেছিল।
নিজের ও নিজের দেশের জন্য পৃথক একটি রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করেছিলেন গাদ্দাফি। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ক্ষমতা দখল করার পর নিজেকে মরুর বেদুইন দার্শনিক ও রাজা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি লিবিয়ার নতুন নাম দিয়েছিলেন_ দ্য গ্রেট সোশালিস্ট পিপলস লিবিয়ান জামাহিরিয়া। আরবি জামাহিরিয়ার অর্থ গণপ্রজাতন্ত্র। তার দর্শন অনুসারে জনগণ ক্ষমতাশালী হলে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তিনি স্থায়ী বিপ্লবের দর্শন প্রচার করেছিলেন যা বাস্তবায়িত হলে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র বিতাড়িত হবে।
দেশের মানুষের অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে মাও সে তুংয়ের রেড বুকের আদলে লিখেছিলেন গ্রিন বুক। তাতে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের নানা কৌশল ছিল, সঙ্গে ছিল দেশ গড়ার স্বপ্নও।
ভিন্নধর্মী পোশাক-আশাক ও কথাবার্তার কারণে নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে অভিহিত করেছিল বৃদ্ধ রকস্টার বলে। যে কোনো আন্তর্জাতিক আসরে সবার নজর কাড়ার মতো ব্যক্তিত্ব ছিল তার। ব্যতিক্রমধর্মী পোশাক, সোজাসাপ্টা কথাবার্তা আর চমকে দেওয়ার মতো ব্যবহার ছিল তার। প্যারিস, রোম এমনকি নিউ ইয়র্ক যেখানেই যেতেন সেখানেই সাদা তাঁবু সঙ্গে নিতেন তিনি। তাঁবু খাটিয়ে তাতে থাকতেন। তাঁবুর দেয়ালে মরুর খেজুর গাছ, উট এবং গাদ্দাফির বাণী থাকত।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। জাতিসংঘে ২০১০ সালে শেষ যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ আর দুনিয়াজুড়ে তাদের দখলদারিত্বে তীব্র বিরোধিতা ছিল। লিবীয়দের মধ্যে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে তীব্র ঘৃণা ছিল তার মূর্ত রূপ ছিলেন গাদ্দাফি। পশ্চিমের দেশগুলো গাদ্দাফির প্রতিটি পদক্ষেপ খেয়াল করত। তিনি তো বটেই, তার রাজনৈতিক দর্শন, তার দেশে প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীরা পৃথিবীতে অনেক হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত হয়েছে। বিশেষত লকারবি বোমা হামলার জন্য তাকে দায়ী করা হয়। অভিযোগ যাই থাকুক। তিনি যে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সাহসী ছিলেন এ বিষয়ে তার চরম শত্রুও সন্দেহ পোষণ করবে না। একজন আরব বিশ্লেষকের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, তাকে সম্প্রতি আরব রাজনীতির পিকাসো হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। বিশ্বখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোর শিল্পী জীবনে যেমন ছিল ব্লু, রোজ, কিউবিস্ট নানা কালপর্ব তেমনি গাদ্দাফির জীবনেও ছিল প্যান-আরব, ইসলামিস্ট এবং প্যান-আফ্রিকান পর্ব। ৪২ বছরের অধিক সময়ে ক্ষমতায় থাকাকালে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলেছেন গাদ্দাফি। আরব ঐক্য, মুসলিম ঐক্য, আফ্রিকান ঐক্যের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের ধুয়াও তুলেছিলেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে গোপন ও প্রকাশ্য বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৪২ সালে সিরতের কাছে এক আরব বেদুইন তাঁবুতে গাদ্দাফির জন্ম। তিনি ছিলেন গাদ্দাফা নামে আরবদের ছোট এক গোত্রের সন্তান। শৈশবেই তিনি দেখেছেন ইসরায়েলের কাছে আরব বিশ্বের পরাজয়ের নানা নজির। তখন কিশোর হিসেবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার কাছে তখনকার নেতা ছিলেন মিসরের গামাল আবদুল নাসের। ১৯৬১ সালে বেনগাজি মিলিটারি একাডেমীতে প্রশিক্ষণ নেন, ১৯৬৬ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন যুক্তরাজ্যে। যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন তিনি ছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট।
লিবিয়ার ক্ষমতা দখলের উদ্যোগের পেছনেও ছিল কৈশোরের গুরু গামাল আবদুল নাসেরের প্রেরণা। ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর তরুণ অফিসারদের সংগঠিত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন গামাল আবদুল নাসের। তরুণ অফিসারদের তৎপরতা 'ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট' হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। সে আদলেই ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তরুণ অফিসারদের নিয়ে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন গাদ্দাফি।
ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বহুদিন পর্যন্ত আরব জাতিগুলোর মধ্যে ঐক্যের উদ্যোক্তা ছিলেন গাদ্দাফি। তিনি আরব নেতাদের একত্র করার বহু চেষ্টা নিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে পশ্চিমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবে। শেষ পর্যন্ত সে আশা পূর্ণ হয়নি। পশ্চিমাদের কৌশলের কারণেই হোক আর নিজেদের মধ্যকার বিবাদের কারণেই হোক আরব নেতারা একত্র হতে পারেননি। তবে আরব দেশগুলোর বহু মানুষ তাকে স্বাধীনচেতা আরব নেতা হিসেবেই গণ্য করেছে। শুধু আরব দেশগুলো নয়, আরব দুনিয়ার বাইরেও মুসলমানরা তাকে সাদ্দামের মতোই সাহসী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখতেন।
আরব বিশ্বের ঐক্যের স্বপ্ন বিফল হলে তিনি মুসলিম ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। তাতেও তেমন সাড়া মেলেনি। শেষ পর্যন্ত তার উপলব্ধি হয় যে আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার নেতা হিসেবে তার কথা আরবরা শুনবে না। ফলে, আফ্রিকার ঐক্যের দিকেই তার মনোযোগ সরে যায়। তিনি বলেন, আরব ঐক্যের কথা তো অনেক বললাম গত ৪২ বছরে, কেউ বুঝল না। এখন আফ্রিকান ঐক্যই আমার লক্ষ্য। এ উপলব্ধি থেকে তিনি আফ্রিকান জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন এবং তাতে কিছুটা সফলও হন। সাম্প্রতিক সংকটে আফ্রিকার নেতা ও গোত্রপ্রধানদের অনেকেই তার পাশে ছিলেন। তার একটি স্বপ্ন আফ্রিকান জাতিগুলো পূরণ করতে পারেনি। তিনি চেয়েছিলেন পুরো আফ্রিকার রাজাদের রাজা হতে। সে আশা পূরণ হয়নি।
যখন তিনি হতে চেয়েছিলেন আফ্রিকার রাজাদের রাজা, তখন নিজের দেশেই তার সিংহাসন টলোমলো। ৪২ বছর তিনি লিবিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ১৯৫৯ সালে তেলের খনি আবিষ্কারের আগে লিবিয়া দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু তেল আবিষ্কারের এক দশক পর্যন্ত তাদের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থানের পর লিবীয় সরকার তেল কোম্পানিগুলোতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য করে। লিবিয়ার সাফল্য তখন অন্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকেও উৎসাহিত করেছিল। রাজস্ব আয় বেড়ে যাওয়ার পর রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুল, বাড়িঘর বানাতে শুরু করে গাদ্দাফি সরকার। দেশকে সবুজায়ন করার বিপুল উদ্যোগ নেয়। ১৯৬৯ সালে লিবীয়দের গড় আয়ু ছিল ৫১ বছর, এখন সেটি ৭৪-এ উন্নীত। স্বাক্ষরতার হার এখন ৮৮ শতাংশ। মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১২ হাজার ডলারে পেঁৗছেছে। কিন্তু গণতন্ত্র, আধুনিকতা আর মুক্তির স্বাদ দিতে পারেনি লিবিয়ার জনগণ। এজন্য একা গাদ্দাফিকে দোষারোপ করছেন না বিশ্লেষকরা। আরব বিশ্বের অধিকাংশ দেশ গণতন্ত্রবঞ্চিত। গণতান্ত্রিক অধিকার সেখানে সীমিত। ফলে, নতুন যুগের হাওয়া লেগে যখন তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়া পর্যন্ত লণ্ডভণ্ড হতে থাকল তখন গাদ্দাফির লৌহশাসন অবসানের বীণাও বেজে উঠল। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি গাদ্দাফি। নতুন যুগের চাওয়া অনুসারে নিজেকে ও দেশকে পরিচালনা করতে পারেননি। লিবিয়ায় কোনো সংসদ নেই, একক সামরিক নেতৃত্ব নেই, রাজনৈতিক দল নেই, কোনো গণসংগঠন নেই, নাগরিক সমাজ নেই, এমনকি কোনো এনজিও-ও নেই। একক শাসন পাকাপোক্ত করতে দীর্ঘদিন সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছেন তিনি। দেশবাসীর গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিহত করতে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছেন। সেই যুদ্ধের পরিণতিতেই বিদায় নিতে হলো তাকে, হাজারো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। কেননা, মুক্তির জন্য দেশবাসীর চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রামে প্রধান শত্রু তিনি। আরব বেদুইন তাঁবুতে যে ইতিহাসের শুরু হয়েছিল একদিন সেই তাঁবুর কাছে সে ইতিহাসের যবনিকাপাত ঘটল। গাদ্দাফির পর নতুন যুগের সূচনা ঘটল বটে কিন্তু লিবিয়া কী মুক্ত হলো নাকি নতুন শৃঙ্খলে জড়িয়ে পড়ল সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে এখনই।
থাকবে। তবে, অনেক বিষয়ে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তার মিল। সাদ্দামের মতো গাদ্দাফিও আত্মরক্ষা ও পলায়নের জন্য পাতালপুরী ও পাতালপথ তৈরি করেছিলেন। সেগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে আসেনি। ধরা পড়ার মুহূর্তে দুই নেতাই গর্তে লুকিয়ে আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা করেছেন_ এও এক আশ্চর্য মিল।
সংবাদমাধ্যম তাকে বলে লিবীয় একনায়ক। কেউ কেউ বলে লিবীয় নেতা। লিবিয়ায় সীমিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর তার পদবি হয় 'ব্রাদার লিডার অ্যান্ড দ্য গাইড অব রেভলিউশন'_ অর্থাৎ নেতাভাই ও বিপ্লবের পথপ্রদর্শক। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য গণআন্দোলন শুরু হলে গাদ্দাফি বলেছিলেন তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট নন। তিনি লিবীয়দের স্বাভাবিক নেতা। দেশের সবাই তাকে ভালোবাসে। তাই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়।
কেউ তাকে বলেছেন খামখেয়ালি, গোঁড়া, কেউ বলেছেন পাগল। তার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কও তৈরি করেছেন অনেক নেতা। সম্পর্কের প্রয়োজন ফুরালে আবার তাকেই পাগল বলে গালি দিয়েছেন। গাদ্দাফি বহু বছর পশ্চিমাদের কাছে শত্রু বলে বিবেচিত হলেও নাইন ইলেভেনের পর তার ও পশ্চিমাদের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটে। তিনিই প্রথম ওসামা বিন লাদেনের গ্রেফতার দাবি করেছিলেন। লিবিয়ার গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছিলেন। রীতিমতো প্রেমে পড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসের। তাকে প্রিয় আফ্রিকান নারী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। লিবিয়ার এই পরিবর্তিত মনোভাবকে স্বাগত জানিয়েছিল ওয়াশিংটন, লন্ডনসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছিল। এনটিসির যোদ্ধারা আগস্টে গাদ্দাফির প্রাসাদের পতন ঘটানোর পর বেশ কিছু নথিপত্র মিলেছে যাতে বোঝা যায় শেষ সময়ে পাশ্চাত্য শক্তিগুলো তাকে রক্ষার চেষ্টাও করেছিল।
নিজের ও নিজের দেশের জন্য পৃথক একটি রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করেছিলেন গাদ্দাফি। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ক্ষমতা দখল করার পর নিজেকে মরুর বেদুইন দার্শনিক ও রাজা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি লিবিয়ার নতুন নাম দিয়েছিলেন_ দ্য গ্রেট সোশালিস্ট পিপলস লিবিয়ান জামাহিরিয়া। আরবি জামাহিরিয়ার অর্থ গণপ্রজাতন্ত্র। তার দর্শন অনুসারে জনগণ ক্ষমতাশালী হলে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তিনি স্থায়ী বিপ্লবের দর্শন প্রচার করেছিলেন যা বাস্তবায়িত হলে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র বিতাড়িত হবে।
দেশের মানুষের অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে মাও সে তুংয়ের রেড বুকের আদলে লিখেছিলেন গ্রিন বুক। তাতে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের নানা কৌশল ছিল, সঙ্গে ছিল দেশ গড়ার স্বপ্নও।
ভিন্নধর্মী পোশাক-আশাক ও কথাবার্তার কারণে নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে অভিহিত করেছিল বৃদ্ধ রকস্টার বলে। যে কোনো আন্তর্জাতিক আসরে সবার নজর কাড়ার মতো ব্যক্তিত্ব ছিল তার। ব্যতিক্রমধর্মী পোশাক, সোজাসাপ্টা কথাবার্তা আর চমকে দেওয়ার মতো ব্যবহার ছিল তার। প্যারিস, রোম এমনকি নিউ ইয়র্ক যেখানেই যেতেন সেখানেই সাদা তাঁবু সঙ্গে নিতেন তিনি। তাঁবু খাটিয়ে তাতে থাকতেন। তাঁবুর দেয়ালে মরুর খেজুর গাছ, উট এবং গাদ্দাফির বাণী থাকত।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। জাতিসংঘে ২০১০ সালে শেষ যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ আর দুনিয়াজুড়ে তাদের দখলদারিত্বে তীব্র বিরোধিতা ছিল। লিবীয়দের মধ্যে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে তীব্র ঘৃণা ছিল তার মূর্ত রূপ ছিলেন গাদ্দাফি। পশ্চিমের দেশগুলো গাদ্দাফির প্রতিটি পদক্ষেপ খেয়াল করত। তিনি তো বটেই, তার রাজনৈতিক দর্শন, তার দেশে প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীরা পৃথিবীতে অনেক হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত হয়েছে। বিশেষত লকারবি বোমা হামলার জন্য তাকে দায়ী করা হয়। অভিযোগ যাই থাকুক। তিনি যে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সাহসী ছিলেন এ বিষয়ে তার চরম শত্রুও সন্দেহ পোষণ করবে না। একজন আরব বিশ্লেষকের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, তাকে সম্প্রতি আরব রাজনীতির পিকাসো হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। বিশ্বখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোর শিল্পী জীবনে যেমন ছিল ব্লু, রোজ, কিউবিস্ট নানা কালপর্ব তেমনি গাদ্দাফির জীবনেও ছিল প্যান-আরব, ইসলামিস্ট এবং প্যান-আফ্রিকান পর্ব। ৪২ বছরের অধিক সময়ে ক্ষমতায় থাকাকালে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলেছেন গাদ্দাফি। আরব ঐক্য, মুসলিম ঐক্য, আফ্রিকান ঐক্যের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের ধুয়াও তুলেছিলেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে গোপন ও প্রকাশ্য বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৪২ সালে সিরতের কাছে এক আরব বেদুইন তাঁবুতে গাদ্দাফির জন্ম। তিনি ছিলেন গাদ্দাফা নামে আরবদের ছোট এক গোত্রের সন্তান। শৈশবেই তিনি দেখেছেন ইসরায়েলের কাছে আরব বিশ্বের পরাজয়ের নানা নজির। তখন কিশোর হিসেবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার কাছে তখনকার নেতা ছিলেন মিসরের গামাল আবদুল নাসের। ১৯৬১ সালে বেনগাজি মিলিটারি একাডেমীতে প্রশিক্ষণ নেন, ১৯৬৬ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন যুক্তরাজ্যে। যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন তিনি ছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট।
লিবিয়ার ক্ষমতা দখলের উদ্যোগের পেছনেও ছিল কৈশোরের গুরু গামাল আবদুল নাসেরের প্রেরণা। ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর তরুণ অফিসারদের সংগঠিত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন গামাল আবদুল নাসের। তরুণ অফিসারদের তৎপরতা 'ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট' হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। সে আদলেই ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তরুণ অফিসারদের নিয়ে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন গাদ্দাফি।
ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বহুদিন পর্যন্ত আরব জাতিগুলোর মধ্যে ঐক্যের উদ্যোক্তা ছিলেন গাদ্দাফি। তিনি আরব নেতাদের একত্র করার বহু চেষ্টা নিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে পশ্চিমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবে। শেষ পর্যন্ত সে আশা পূর্ণ হয়নি। পশ্চিমাদের কৌশলের কারণেই হোক আর নিজেদের মধ্যকার বিবাদের কারণেই হোক আরব নেতারা একত্র হতে পারেননি। তবে আরব দেশগুলোর বহু মানুষ তাকে স্বাধীনচেতা আরব নেতা হিসেবেই গণ্য করেছে। শুধু আরব দেশগুলো নয়, আরব দুনিয়ার বাইরেও মুসলমানরা তাকে সাদ্দামের মতোই সাহসী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখতেন।
আরব বিশ্বের ঐক্যের স্বপ্ন বিফল হলে তিনি মুসলিম ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। তাতেও তেমন সাড়া মেলেনি। শেষ পর্যন্ত তার উপলব্ধি হয় যে আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার নেতা হিসেবে তার কথা আরবরা শুনবে না। ফলে, আফ্রিকার ঐক্যের দিকেই তার মনোযোগ সরে যায়। তিনি বলেন, আরব ঐক্যের কথা তো অনেক বললাম গত ৪২ বছরে, কেউ বুঝল না। এখন আফ্রিকান ঐক্যই আমার লক্ষ্য। এ উপলব্ধি থেকে তিনি আফ্রিকান জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন এবং তাতে কিছুটা সফলও হন। সাম্প্রতিক সংকটে আফ্রিকার নেতা ও গোত্রপ্রধানদের অনেকেই তার পাশে ছিলেন। তার একটি স্বপ্ন আফ্রিকান জাতিগুলো পূরণ করতে পারেনি। তিনি চেয়েছিলেন পুরো আফ্রিকার রাজাদের রাজা হতে। সে আশা পূরণ হয়নি।
যখন তিনি হতে চেয়েছিলেন আফ্রিকার রাজাদের রাজা, তখন নিজের দেশেই তার সিংহাসন টলোমলো। ৪২ বছর তিনি লিবিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ১৯৫৯ সালে তেলের খনি আবিষ্কারের আগে লিবিয়া দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু তেল আবিষ্কারের এক দশক পর্যন্ত তাদের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থানের পর লিবীয় সরকার তেল কোম্পানিগুলোতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য করে। লিবিয়ার সাফল্য তখন অন্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকেও উৎসাহিত করেছিল। রাজস্ব আয় বেড়ে যাওয়ার পর রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুল, বাড়িঘর বানাতে শুরু করে গাদ্দাফি সরকার। দেশকে সবুজায়ন করার বিপুল উদ্যোগ নেয়। ১৯৬৯ সালে লিবীয়দের গড় আয়ু ছিল ৫১ বছর, এখন সেটি ৭৪-এ উন্নীত। স্বাক্ষরতার হার এখন ৮৮ শতাংশ। মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১২ হাজার ডলারে পেঁৗছেছে। কিন্তু গণতন্ত্র, আধুনিকতা আর মুক্তির স্বাদ দিতে পারেনি লিবিয়ার জনগণ। এজন্য একা গাদ্দাফিকে দোষারোপ করছেন না বিশ্লেষকরা। আরব বিশ্বের অধিকাংশ দেশ গণতন্ত্রবঞ্চিত। গণতান্ত্রিক অধিকার সেখানে সীমিত। ফলে, নতুন যুগের হাওয়া লেগে যখন তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়া পর্যন্ত লণ্ডভণ্ড হতে থাকল তখন গাদ্দাফির লৌহশাসন অবসানের বীণাও বেজে উঠল। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি গাদ্দাফি। নতুন যুগের চাওয়া অনুসারে নিজেকে ও দেশকে পরিচালনা করতে পারেননি। লিবিয়ায় কোনো সংসদ নেই, একক সামরিক নেতৃত্ব নেই, রাজনৈতিক দল নেই, কোনো গণসংগঠন নেই, নাগরিক সমাজ নেই, এমনকি কোনো এনজিও-ও নেই। একক শাসন পাকাপোক্ত করতে দীর্ঘদিন সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছেন তিনি। দেশবাসীর গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিহত করতে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছেন। সেই যুদ্ধের পরিণতিতেই বিদায় নিতে হলো তাকে, হাজারো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। কেননা, মুক্তির জন্য দেশবাসীর চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রামে প্রধান শত্রু তিনি। আরব বেদুইন তাঁবুতে যে ইতিহাসের শুরু হয়েছিল একদিন সেই তাঁবুর কাছে সে ইতিহাসের যবনিকাপাত ঘটল। গাদ্দাফির পর নতুন যুগের সূচনা ঘটল বটে কিন্তু লিবিয়া কী মুক্ত হলো নাকি নতুন শৃঙ্খলে জড়িয়ে পড়ল সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে এখনই।
No comments:
Post a Comment