Tuesday, October 11, 2011

তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী

গায়কদের নিয়ে সাধারণের বিস্ময়ের সীমা নেই। শুধু সাধারণ কেন, অসাধারণ গীতিকার, কবি ও বিদগ্ধ একজন মানুষও যখন প্রশ্ন করেন, তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, তখন বোঝা যায় সুরের এক অদেখা ক্ষমতা আছে। কবির মতো সকলেই অবাক হয়ে গান শোনে। দেখে, সুরের আলো ভুবন ছেয়ে ফেলছে, পাষাণ ছিন্ন করে ব্যাকুল বেগে সুরের সুরধুনী বয়ে চলেছে। অমন সুরে গাইবার আকাঙ্ক্ষা জাগলেও কণ্ঠে সবার সুর মেলে না। কথা বলতে গিয়েও বেধে যায়। ফলে প্রাণ কাঁদে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মানুষও যখন ভাবেন গানের গুণী তার চারধারে সুরের জাল বুনে তাকে এক ফাঁদে ফেলেছেন তখন সাধারণ শ্রোতাদের হাল কী তা বলাই বাহুল্য। আমাদের প্রিয় কবির এ গানের কথা আবারও মনে পড়ে গেল সঙ্গীতগুরু জগজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর খবরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার গানে মজেছে, তার সুরে সুর ভেজেছে_ তার বাণীতে নিজেদের মর্মবেদনার প্রকাশ দেখেছে। এক প্রজন্ম চলে গেলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও তার আবেদন একটুকু কমেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পরিবর্তিত হয়েছেন। গজলের পরবর্তীকালের গায়করা তাকে গুরু মেনেই গেয়েছেন। এমনকি যে বাংলা ভাষায় গজলের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য নেই, সে ভাষাতেও গজল গেয়ে তিনি দর্শকদের মোহিত করেছেন। জগজিৎ সিং বললেই বহু বাঙালির কাছে সেই মধুর বাণী গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে_ বেদনা মধুর হয়ে যায়, তুমি যদি দাও। কিংবা আজ কিছু হতে চলেছে, বেশি কিছু আশা করা ভুল, তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে...। এসব গান বহু বছর ধরে শোনার পরও কারও কি মনে হয়েছে, এ শিল্পী পাঞ্জাবি? এ প্রশ্ন আজও শুনিনি। তাতেই অবাক লাগছে। গায়করা কেমন গুণী? যে ভাষা তার নয়, সে ভাষাতেও তারা হিল্লোল তোলেন কীভাবে? শুধু বাংলাই তো নয়_ মাতৃভাষা পাঞ্জাবির বাইরে তিনি গেয়েছেন হিন্দি, গুজরাটি, উর্দু, সিন্ধি এমনকি নেপালি ভাষাতেও। ভারতের শিল্পীদের মধ্যে যারা বড় তারা সাধারণত এক ভাষায় আটকে থাকতে চান না। এক ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে বহু ভাষায় ছড়িয়ে যেতে চান। তারা সর্বভারতীয় বলে আখ্যায়িত হন। জগজিৎ সিং অবশ্য সর্বভারতীয় শুধু নন, তিনি ভারতের গণ্ডি ছড়িয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সমান জনপ্রিয়। তার মৃত্যুর খবরে ভারতের মতো শোকগ্রস্ত হয়েছেন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মানুষও। কেউ স্মরণ করছেন তার বাংলা গানের কথা। কেউ বলছেন, মির্জা গালিব টিভি সিরিয়ালে গালিবের কথায় তার গানের কথা। কেউবা ভাজছেন হিন্দি সিনেমায় গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর স্মৃতি। ৭০ বছর খুব কম সময় নয়, তার কাজের ব্যাপ্তিও কম নয়। তবু এই সেদিন পর্যন্ত যিনি সচল ছিলেন, স্টেজে লাইভ পারফরম্যান্সে মাতিয়েছেন সবাইকে তার চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কঠিন। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। মানব কী? গায়কের মৃত্যু হলে গান থাকে, কবিদের মৃত্যু হলে কবিতা থাকে। মানব কি তবে মানুষের কর্মের সারাৎসার? যারা জগজিৎ সিংয়ের গান শুনেছেন সরাসরি, দেখেছেন তাকে_ তাদের বাইরে বিপুলসংখ্যক শ্রোতার কাছে তিনি শুধুই গান। এক প্রজন্মের কাছে তিনি গ্রামোফোনের গান, আরেক প্রজন্মের কাছে ক্যাসেট প্লেয়ারের গান, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কমপ্যাক্ট ডিস্কের গান। গান শুনে শুনেই তার সম্পর্কে একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছেন শ্রোতারা। তার মৃত্যু হলেও তিনি থাকবেন তেমনি। তার গান থাকবে। শিল্পের, কল্পনার, অনুভবের জগৎ ফুরাবে না। কিন্তু বাস্তবের যে জগজিৎ সিং তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। আর কোনো দিন লাইভ আসরে তাকে দেখতে পাবে না কেউ।

No comments:

Post a Comment