Monday, October 31, 2011

তাতা

তাতা বললে সহসা তাকে কারও চিনতে পারার কথা নয়। যদি বলা হয় মানিকের বাবা তাহলেও চেনা কঠিন। নামডাক ও ডাকনামের মধ্যে একটা সংঘর্ষ আছে। কারও নামডাক হলে তার ডাকনামটা সকলেই ভুলে যায়। যেমন সুকুমার রায়ের ডাকনাম যে তাতা সেটি তার নামডাকের পর অনেকেই ভুলে গেছে। তাকে যারা ডাকনামে ডাকতেন তাদের অনুপস্থিতি বড় কারণ বটে। কিন্তু শিশুদের কাছে ডাকনামের গুরুত্ব অনেক। ছোটরা ডাকনামেই অভ্যস্ত। ফলে তারা যখন শোনে যার ছড়া পড়ে তারা খুব পছন্দ করছে তার নাম তাতা, তবে নিজেদের একজন ভেবে নিতে সহজ হওয়ার কথা। তাতার কথা লোকে ভুলে গেলেও তাতার ছেলে মানিকের কথা অবশ্য অনেকেরই মনে থাকার কথা। চলচ্চিত্র অঙ্গনে এমন বহু মানুষ এখনও জীবিত যারা সত্যজিৎ রায়কে মানিকদা বলে ডাকতেন। তারা যখন সত্যজিৎ প্রসঙ্গে লিখেছেন তখন আমরাও জেনে গেছি যে ছোটদের প্রিয় চলচ্চিত্রকারের ডাকনাম মানিক। সুকুমার ও সত্যজিৎ দু'জনে বড়দেরও বেশ প্রিয়। সুকুমারের বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও ছোটদের বিশেষ পছন্দের নাম। রায় পরিবারের কথা বিশেষভাবে উঠছে, কারণ গতকাল ছিল তাতা অর্থাৎ সুকুমার রায়ের জন্মদিন। জন্মদিনের বাসি লেখা লেখার রেওয়াজ পত্রিকায় নেই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশে বোধহয় কারোই মনে ছিল না, কবে সুকুমার রায়ের জন্মদিন। আমারও মনে ছিল না। জন্ম ও মৃত্যুদিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের আয়োজন কয়েকটা তারিখকে কেন্দ্র করে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ২৫ বৈশাখ, ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২২ শ্রাবণ আমরা বেশ ঘটা করে পালন করি। এ দিনগুলোকে একেবারে জাতীয়ভাবে পালনীয় দিন বটে। কোনো কোনো দিবস ঘিরে মাস এমনকি বছরভর অনুষ্ঠানও হয়। মজার ব্যাপার, অনেকের অনেক পছন্দের কবি জীবনানন্দের জন্ম-মৃত্যুদিন কিন্তু অত ঘটা করে পালিত হয় না। এর কারণ কী? কেন বাৎসরিক রিচুয়ালের অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না স্মরণযোগ্য বাকি দিনগুলো? শুধু দু'চারজন বড় কবিকে স্মরণ করলেই কি দায় চুকে যায়? নতুন প্রজন্মের কাছে অন্যদের কথা পেঁৗছাবার দায় কার? সমালোচকরা বলেন, রিচুয়াল মেনে কাউকে স্মরণ করলে তাকে আত্মস্থ করা যায় না। এটা বহিরঙ্গের দিক। কিন্তু অন্তরে কোনো সাহিত্যিককে ধারণ করতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে, সাহিত্যকে ধারণ করতে হবে। কিন্তু রিচুয়ালের বহিরঙ্গেও কিন্তু অনেক মেসেজ থাকে। স্কুল পড়ূয়া শিক্ষার্থীরা কিন্তু এসব দেখে বুঝতে শেখে। তাদের কাছে, প্রিয় ও প্রয়োজনীয় মানুষগুলোকে তুলে ধরাও কিন্তু কর্তব্য। সেদিক থেকে সুকুমার রায় শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় সাহিত্যিক। প্রিয় তো বটেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় বলার পেছনে বিশেষ কারণ হলো, সুকুমার রায়ের গুরুত্ব ছোটদের জন্য এখনও সমান। অনেকেই বলেন, ছোটদের জন্য লেখা খুব বেশি এগোয়নি। কোথায় যেন থমকে আছে। অথচ শিশুদের জন্য তো ছড়া দরকার। গল্প দরকার। এখনও ছড়ার জন্য সুকুমারের কাছেই হাত পাততে হয়। ইংরেজি ভাষায় নার্সারি রাইমস বলে যে ছড়ার বিপুল সম্ভার আছে তার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন বাংলা ছড়া নেই।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ইংরেজি ছড়াগুলো ইংরেজি ভাষাভাষী সব দেশে এমনকি ইংরেজি মাধ্যমের সব স্কুলে ছড়িয়ে গেছে। তুলনায় বাংলা ছড়ার কী হাল? সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, শিশুদের জন্য সহজবোধ্য ছড়া কয়টি? তাই ছোটদের স্বার্থেই সুকুমার রায়কে স্মরণ করা দরকার। এখনও যদি ছোটদের জন্য সমৃদ্ধ সাহিত্যের ভাণ্ডার তৈরি না হয়, তবে কবে হবে? সুকুমার এখানে আমাদের অনেক কিছু শেখাতেও পারেন।

No comments:

Post a Comment