Friday, September 16, 2011

আমার 'দেহ' বই নিয়া চঞ্চল আশরাফের সমালোচনা

মাহবুব মোর্শেদের দেহতত্ত্বদেহ_মাহবুব মোর্শেদ। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ। প্রকাশক : ঐতিহ্য, প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১১। মূল্য : ১৫০ টাকাচঞ্চল আশরাফমাহবুব মোর্শেদের 'দেহ' গল্পগ্রন্থটিকে ভুল বোঝার কারণ যথেষ্ট রয়েছে। প্রধানত মনে হতে পারে, এটি ফ্রয়েডীয় যৌন সর্বস্বতাবাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। মনে হতে পারে, বেশির ভাগ গল্পের বিষয় শরীর বা সে সম্পর্কিত প্রসঙ্গগুলো। আমি মনে করি, যাঁরা এই ফাঁদে পড়বেন, তাঁরা গ্রন্থটির সম্ভবত প্রকৃত পাঠক নন। কেন নন, তা পরে আলোচ্য কিংবা এই আলোচনা থেকে কিছুটা বুঝতে পারা যাবে।
শরীরসংক্রান্ত যে থিসিস বইটির গল্পগুলোয় পাই, তাতে শেষ পর্যন্ত এটা নিশ্চিত যে 'দেহ' আদৌ ফ্রয়েডভাবিত গল্প সংকলন নয়। লোকদর্শনের অন্তর্গত দেহতত্ত্বের প্রতিনিধিত্বও এটি করছে না। হতে পারে ফ্রয়েডের অনুরসদ মাত্র; কিন্তু এর আসল জিনিসটি হলো সমকালীন বাস্তবতার পটভূমিতে মানুষের (নারী-পুরুষের) সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতার ভাষা। 'জিসম' গল্পটি এর একটি উদাহরণ। এর থিসিসটি হলো, শরীর শেষ পর্যন্ত একটা সংস্কার, যাকে আত্মস্থ ও অতিক্রম করতে হয়; নইলে এটি আচ্ছন্ন ও অধিকার করে ফেলে ব্যক্তিকে। করে ফেললে, সমষ্টি উপেক্ষিত হয়, যা সমাজবদলের প্রধান বাধা। গল্পকার পরোক্ষে একটি বার্তাও দিয়েছেন : সমাজ পরিবর্তনে সব কিছুর আগে দরকার শরীরসংক্রান্ত সংস্কার ভেঙে ফেলা। তা করতে গেলে জানা চাই শরীর কী জিনিস; তবে সেই জ্ঞান পুস্তকনির্দেশিত হলে চলবে না। হাতে-কলমে তা হওয়া চাই। গল্পটি পড়তে পড়তে হার্বাট মার্কুইসের একটি প্রত্যয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছেন, মুক্তযৌনতা আসলে সামাজিক প্রতিবাদের অংশ। 'জিসম' ধারণ করেছে মুক্তযৌনতার প্রত্যয়টি, এর মধ্যে প্রতিবাদ আছে; এবং একে সমষ্টিতে সঞ্চারের অভিপ্রায়ও দুর্লক্ষ্য নয় (পড়ুন ১০৩ পৃষ্ঠায় : শোনো, ও যখন যৌন সম্পর্ক করে তখন নিজের জীবনের ব্যর্থতা, গ্লানি, আমার মৃত স্বামীর প্রতি ক্ষোভ, এই ব্যবস্থা_সব কিছুর বিরুদ্ধে তার শারীরিক প্রতিবাদ জানায়। অ্যান্ড আই এনজয় ইট)। মনে হতে পারে, বিষয়টি ব্যক্তিক। কিন্তু গল্পের মধ্যেই সমষ্টির সূত্রটি প্রণয়ন করা হয়েছে। তিন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী তিনজনের পার্টি দিয়ে শুরু, শরীরসংক্রান্ত সংস্কার ভাঙার তথা প্রতিবাদও এই তিনে মিলেই ঘটানো হয়েছে। এসব নিয়ে 'জিসম' হয়ে উঠেছে প্রচলিত সংস্কার ও সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শারীরিক ভাষা। শুধু এতেই গল্পটির মর্ম নিঃশেষিত নয়; এর আরো ব্যাখ্যাসাপেক্ষ প্রান্ত রয়েছে। সেসব নিয়ে অন্যত্র আলোচনার আশা রাখি। গ্রন্থের প্রথম গল্প 'রাখী' এক ধরনের প্রতিবাদ আর প্রত্যাখ্যানের গল্প। 'আজ রাতে কোথায় ঘুমাব'ও প্রচলিত সমাজকে অস্বীকারের ভাষাকে মর্মে ধরেছে। তবে বইয়ের কোনো গল্পই চিন্তা বা আইডিয়ার দিক থেকে জিসমের মতো এত উচ্চাভিলাষী নয়; যদিও সেগুলো কোনো না কোনোভাবে সমকালীন বাস্তবতার পটভূমিতে মানবসম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতার রূপক হয়ে উঠেছে। 'লোলিতা রিলোডেড', 'লুক থ্রু সি থ্রু', 'ঘর মন জানালা, লাইফস্টাইল, আপনার রাশিফল', 'মেলানকলি', 'রুখসানার হাজব্যান্ড'_এই গল্পগুলো এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তবে 'সি পেই' গ্রন্থটির মান ও বৈশিষ্ট্যকে খানিকটা ক্ষুণ্ন করেছে বলে মনে হয়। রচনাটি দুর্বল, কারণ সেটা নয়; কারণ এটিও_বইয়ের অন্যান্য গল্পের সঙ্গে এর তাৎপর্যগত কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না।
মাহবুব মোর্শেদের 'দেহ' গল্পগ্রন্থের মূল অভিনিবেশ সময় ও সমাজের সমালোচনায় এবং বোঝা যায়, বেশ ভালো করে বোঝা যায়_গল্পকার প্রচলিত সমাজব্যবস্থা, বিশ্বাস, সংস্কার, রাজনীতি_এসবের প্রতি মোটেও সন্তুষ্ট নন। এই অসন্তোষ তাঁর গল্পভাষায়ও সঞ্চারিত হয়েছে। ব্যঙ্গ, বক্রোক্তি, পরিহাসে তা স্পষ্ট। প্রায় সব গল্পে চরিত্রের আত্মবিশ্লেষণই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সময়ের স্থবিরতা প্রামাণ্য করতে অবতারণা ঘটেছে অ্যাবসার্ডিটির (বিশেষ দ্রষ্টব্য 'অর্ডার অব থিংস'), তাতে সমাজ সম্পর্কে লেখকের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্য হয়ে গেছে; গল্পের মধ্যে রচয়িতার সরাসরি অংশগ্রহণও রয়েছে; কিন্তু তা বিশ্বস্ততায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে বলে মনে হয় না। বলা প্রয়োজন, মাহবুব মোর্শেদের গল্পের প্রধান সম্পদ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রভুত্ব করে চরিত্র কিংবা চরিত্র নির্বাচনের ওপর, ভাষায়ও করে; কিন্তু জবরদস্তি হয়ে তা দেখা দেয় না। এমনটি মনে হওয়ার কারণ, লেখক চরিত্রগুলোকে তাদের মতো করে কথা বলতে দেন; তাদের আচরণ সময়ের চেহারায় নির্দেশিত হলেও ঘটনাগুলো পূর্বনির্দিষ্টভাবে ঘটে না। শ্রেণীচরিত্রও গল্পে উপেক্ষিত নয়। তবে বোঝা যায়, লেখকেরও শ্রেণীগত একটি অবস্থান রয়েছে। সেটি কী? 'জিসম' গল্পের শিষ্যটির দিকে মনোযোগ দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।


কালের কণ্ঠে প্রকাশিত   

No comments:

Post a Comment