চেক লেখক মিলান কুন্ডেরা বলেন, নগর হলো শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ থাকার
স্থান। কথাটা অনেকটা রূপকার্থে বলা। প্রকৃত নগরে, মানে যেখানে নাগরিক
সংস্কৃতি মেট্রোপলিটন স্তরে উন্নীত সেখানে কেউ কারো জাত জানতে চায় না,
অপরিচিত লোকদের দেখলে জেরা করে না। শুধু শরণার্থী নয়, নানা বর্ণের, নানা
ধর্মের, নানা মতের মানুষের অস্থায়ী আবাস পৃথিবীর নগরগুলো। নিরাপত্তা রক্ষার
দায়িত্বে তদারকি ছাড়া নিউইয়র্কে কোনো বাঙালি, কোনো চীনা কিংবা কোনো
নাইজেরিয়ানকে দেখলে সাধারণ নাগরিকদের মনে এ প্রশ্ন উঠবে সে কী করছে এখানে,
কেন এসেছে, কয়দিন থাকবে। কিন্তু ঢাকায় একটু অচেনা বর্ণের, অচেনা মতের
মানুষের চলাচল দেখলেই সাধারণ মানুষই প্রশ্ন তুলবে, এ কে? বৈরিতা হোক কি
বন্ধুত্ব কোনো অর্থেই এ প্রশ্ন ওঠা নাগরিক সংস্কৃতি-সম্মত নয়। কিন্তু ঢাকায়
এ প্রশ্ন ওঠে। আর প্রশ্ন ওঠার অর্থই হলো, আমাদের নাগরিকতা প্রকৃত নাগরিকতা
হয়ে ওঠেনি। আর্থসামাজিক সূত্রে গ্রামের টান সেখানে রয়ে গেছে। নগরের আরেক
বৈশিষ্ট্য হলো, সেখানে সবসময় কর্মক্ষম তরুণদের ভিড় থাকবে। তরুণরা বৃদ্ধ হলে
অবসর নিয়ে একসময় নগর ছেড়ে দূরের শহরে কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত
গ্রামে চলে যাবে। নতুন প্রাণোচ্ছল তরুণরা এসে নগর দখল করবে। কিন্তু ঢাকায়
মানুষের আসাটা একমুখী। এখানে মানুষ আসে শুধু, এখান থেকে মানুষ যায় না। আরও
শুদ্ধ করে বললে, যেতে চায় না। বাধ্য হলে কেউ কেউ যায়, কিন্তু বেশিরভাগ
মানুষ একবার নগর জীবনে অভ্যস্ত হলে আর গ্রামে ফিরতে চায় না। গ্রামের ছেলেটি
শহরে পড়তে এসে চাকরি করে, পয়সা জমায়, পয়সা জমিয়ে নগরেই থেকে যাওয়ার স্বপ্ন
দেখে। পরবর্তী প্রজন্মের উন্নততর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার তাগিদে ঢাকায় বা
আশপাশে বাড়ি করে। থেকে যায়। গত চলি্লশ বছরে থেকে যাওয়ার হার এতটাই বেশি যে,
ঢাকার আশপাশের জেলা শহরগুলো, কৃষিজমি, অকৃষিজমি, বনবাদাড় সব উজাড় করে তৈরি
হচ্ছে মানববসতি। এই বসতিগুলোর আকুতি একটাই, ঢাকার পাশে থাকা। অবস্থাপন্ন
মানুষরা তো আসন গেড়ে বসেছেনই। ঢাকায় একবার ঢুকলে এর বিকল্প ভাবেন না
শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাও। ঋণ করে, কষ্ট করে একটা ফ্ল্যাটের কথা মাথা থেকে
কিছুতেই বাদ যায় না। যারা শেষ পর্যন্ত বাড়ি কিনতে পারেন না, তাদেরও অনেকে
ভাড়া বাড়িতেই থেকে যান। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে, নারায়ণগঞ্জের
এক স্থায়ী বাসিন্দা একটি লেখায় লিখেছিলেন, রাজধানীর চাহিদা মেটাতে গিয়ে
আশপাশের আদি অধিবাসীদের টিকে থাকাই দায় হয়ে উঠেছে। খুব গভীর এক সমস্যায়
পড়তে যাচ্ছে ঢাকা। আগামীতে যারা ঢাকায় থেকে যেতে চান তাদের অধিকাংশ চাইলেও
থাকতে পারবেন না। জায়গা হবে না। কিন্তু ঢাকার বাইরে যদি নাগরিক
সুবিধা-সম্পন্ন শহর থাকত। জেলা শহরগুলোর পরিকল্পিত উন্নয়ন যদি নিশ্চিত করা
যেত, গ্রামে যদি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যেত তাহলে কিন্তু লোকে এভাবে ঢাকার
জন্য মরিয়া হয়ে থাকতেন না। একজন আর্মি অফিসার অবসর নিয়ে চলে যেতেন গ্রামে।
একজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন অধ্যাপক মফস্বলে থাকতেন। তাদের মাধ্যমে
মফস্বল-গ্রাম আলোকিত হতো। জ্যামের শহরে, নাগরিক জীবনের দুর্বিপাকের চক্রে
তাদের অবসর জীবন কাটাতে হতো না। এমন হলে মানুষ বিকল্প ঠিকানার জন্য
প্রস্তুত হতে পারত। নাগরিক জীবনের সুবিধার জন্য প্রাণান্ত সংগ্রামের বদলে
অন্য কিছু তখন চোখে পড়ত আমাদের।
No comments:
Post a Comment