কলার মতোই কলাগাছ নিয়েও বাংলায় নানা কথা প্রচলিত। তবে শিল্পের মতো কলাও
এখানে দ্ব্যর্থবোধক। শিল্প বলতে এখানে আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি উভয়কে বোঝানো হয়।
আবার কলা বলে ব্যানানা ও আর্ট দুটিকেই বোঝানো হয়। তাই আর্টকে এ দেশে বলা
হয় শিল্পকলা। সমার্থক দুটি শব্দকে পাশাপাশি বসিয়ে দ্ব্যর্থকতা দমনের রীতিটি
প্রশংসনীয়। কলা ও কলাগাছ বহুল আলোচিত হলেও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে
কলা নিয়ে যে বিপুল আখ্যান তৈরি হয়েছে তা আমাদের দেশে ঘটেনি। ইউনাইটেড ফ্রুট
কোম্পানির দৌলতে লাতিন আমেরিকায় বিস্তর কলা আখ্যান তৈরি হয়েছিল। এই
কোম্পানি সেখানে স্থাপন করেছিল কলার খামার। সে খামারগুলো থেকে সংগৃহীত কলা
প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে আনা হতো বাহারি খাবার হিসেবে। খামারগুলো নিয়ে
লাতিন আমেরিকার নানা দেশে তৈরি হয়েছিল আশা-হতাশা-দুঃখ-বিক্ষোভ। অনেক
রক্তপাতের কারণও এই কলা চাষ। শেষ পর্যন্ত কলা হয়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক প্রতীক।
লাতিন আমেরিকায় বিদেশি শক্তির অনুগত সরকার পরিচালিত দেশকে বলা হয় ব্যানানা
রিপাবলিক। আমাদের ভাষায় অবশ্য দেশ বা সরকারকে কলা বিশেষণে অভিহিত করার মতো
ঘটনা ঘটেনি। এ দেশে কেউ অবৈধ উপার্জন করে হঠাৎ বড়লোক হলে বলা হয় আঙুল ফুলে
কলাগাছ। এ তো দুর্নীতির ব্যাপার। রাজনীতিতেও কলাগাছের উদাহরণ আছে। যেমন
কোনো আসনে কোনো নেতা বা প্রতীকের রমরমা থাকলে বলা হয়, ওখানে অমুককে দাঁড় না
করিয়ে একটা কলাগাছ দাঁড় করালেও জিতে আসবে। এই দুই উদাহরণে কলাগাছ কিছুটা
অসম্মানিত হলেও প্রাচীন বাংলায় কলাগাছ কিন্তু সমৃদ্ধির প্রতীক। প্রবচনে
আছে, কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত। কলা গাছ রোপণ করে পাতা
কাটতে নিষেধ করা হয়েছে। এতে কলাগাছের ফলনক্ষমতা বাড়ে। আর ফলন বেশি হলে কলাই
ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করবে। শুধু প্রাচীন বাংলা কেন, বর্তমান বাংলাতেও
কলা-বাণিজ্যের রমরমা। তাই অনেক কৃষকই ক্ষেতে কলাচাষ করছেন। অনেক সময় ধান
চাষ না করেও কলার চাষ করা হচ্ছে। কলার ফলন অনুসারে, দেশে উৎপাদিত কলা ততটা
সুনাম অবশ্য অর্জন করেনি। এর কারণ পিটিয়ে ফল পাকানোর বাজে অভ্যাস। কলাগাছে
কলা থাকলে একসময় পাকবেই। পাকার ঠিক আগে কলাগাছ কাটলেই ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।
কিন্তু তা না করে ফল একেবারে কাঁচা থাকতেই গাছ থেকে কাটা হয়। অপরিপকস্ফ সে
ফল রাস্তার ধারে মজুদ করা হয় শহরে পাঠানোর জন্য। শহরে এসে বা আসার পথে এ
ফলে মেশানো হয় বিষাক্ত রাসায়নিক। উদ্দেশ্য জোর করে পাকানো। ফলে
প্রাকৃতিকভাবে পরিপুষ্ট ও পাকা ফলের স্বাদ এতে মেলে না। এ কলা যেন কলা
নামের কলঙ্ক। দুঃখের বিষয়, শুধু পাকানোর জন্যই না, ফল সংরক্ষণের জন্যও
বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানোর রেওয়াজ আছে। এসব কারণে কলা যথেষ্ট দুর্নাম
কুড়িয়েছে। লোকে এখন বাজারে ভালো কলা খোঁজেন হন্যে হয়ে। কিন্তু রাসায়নিক
মেশানো কলার ভিড়ে ভালো কলা মেলা ভার। কলার মতো সুস্বাদু, দেশে উৎপাদিত সারা
বছরের এমন একটি ফলের এমন দুরবস্থা নিয়ে কিছু করা উচিত। কিন্তু দুঃখজনক
হলেও সত্য, আমাদের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে কলাগাছের
মতোই।
No comments:
Post a Comment