এপ্রিল ২৫, ২০১১ বিডি নিউজে প্রকাশিত
গত ৫ এপ্রিল রাজবাড়ির পাংশায় সাধুসঙ্গ উপলক্ষে সমবেত ২৮ লালনপন্থী সাধু-গুরুর ওপর হামলা চালায় দুবৃর্ত্তরা। গণতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার আছে সমবেত হওয়ার, বিশ্বাস অনুসারে কর্মসূচি পালন করার এবং আদর্শ ও ধর্মমত প্রচার করার। কেউ যদি নিজের ধর্মমত, বিশ্বাস, রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি হুমকি মনে করে অন্য ধর্মমত, বিশ্বাস ও রাজনৈতিক মতের ওপর শারীরিক বা মানসিকভাবে হামলা করে তবে প্রথমত তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বরখেলাপ। আক্রমণটি যদি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত হয় তবে তা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ- ধর্মান্ধদের দ্বারা সংগঠিত হামলা। আর যদি রাজনৈতিক শক্তির সমর্থনে তারা কর্মীদের দ্বারা সংগঠিত হয় তবে তা একই সঙ্গে রাজনৈতিক ভিন্নমতের প্রতি আক্রমণও। রাজবাড়িতে সাধু-গুরুদের ওপর হামলা হয়েছে- এ খবরটি আমরা জানি। এ নিয়ে দেশের সাধু-গুরুরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন, অবিলম্বে থানায় গিয়েছেন। দেশের শহরগুলোতেও নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে- শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা, অসাম্প্রদায়িক নাগরিকদের উদ্যোগে। আমরাও আর অনেকের মতো এমন ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা জানাই। কিন্তু আমরা যে বর্গের বা গোষ্ঠীর অংশ সেই শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা, অসম্প্রদায়িক বর্গের প্রতিবাদে কিছু অস্পষ্টতা ও দিশাহীনতা আছে বলে মনে হচ্ছে। আলোচনার খাতিরে এই বর্গটিকে সংক্ষেপে শহুরে প্রগতিশীল বর্গ নামে ডাকা যায়। প্রথম প্রশ্ন হলো, শহুরে প্রগতিশীলদের প্রতিবাদে হামলাকারীদের পরিচয় মুছে দেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা কি চলছে? যারা সাধু-গুরুদের ওপর হামলা চালিয়েছেন তাদের একটি রাজনৈতিক, ধর্মীয় এমনকি শ্রেণীগত পরিচয়ও এ সংক্রান্ত খবরের সূত্রে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সেসব পরিচয়কে আড়াল করার কোনো চেষ্টা কি সচেতনভাবে চলছে? বলা হচ্ছে, ধর্মান্ধ অপশক্তি বাউলদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ধর্মান্ধ অপশক্তি বললে আমরা যাদের সহজে চিনি তাদেরকেই হয়তো আমরা রাজবাড়ির হামলার জন্য দায়ী করতে চাই। ফলে, রাজনৈতিক পরিচয়ে যে তারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সেটি গোপন করতে চাই? আমরা কি মনে করি, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে রাজবাড়ির স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের রাজনীতির পার্থক্য আছে? তারা ভুলবশত আওয়ামী লীগের আদর্শের বাইরে গিয়ে হামলা চালিয়েছেন? ৮ এপ্রিল তারিখের কালের কণ্ঠ পত্রিকা খবর দিচ্ছে, ‘’ধর্মবিরোধী’ কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তওবা পড়ানো হলো ২৮ বাউলকে!’ শিরোনামে। খবরের বলা হচ্ছে-
‘রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে লালন ভক্ত ২৮ বাউলকে লাঞ্ছিত করার পর মাথার চুল ও গোঁফ কেটে দিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ‘ধর্মবিরোধী’ কর্মকাণ্ড চালানোর কারণ দেখিয়ে বাউলদের মসজিদে নিয়ে তওবাও পড়ানো হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ও অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে গত বুধবার রাতে পাংশা টেম্পোস্ট্যান্ডে সভা করেন স্থানীয় শাহ জুঁই বাউল শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা।
শাহ জুঁই বাউল শিল্পীগোষ্ঠীর উপদেষ্টা অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর জানান, হাবাসপুর ইউপির চর রামনগর গ্রামে গত ৫ এপ্রিল লালন ভক্ত প্রবীণ বাউল মোহম্মদ ফকিরের বাড়িতে সাধু সংঘের দুই দিনব্যাপী বার্ষিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ২৮ জন লালন ভক্ত আসেন। সমাপনী দিনে তাঁরা ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান করছিলেন। এ সময় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গিয়ে লালন ভক্তদের লাঞ্ছিত করে। মসজিদে নিয়ে গিয়ে বাউলদের গান না গাওয়ার বিষয়ে তওবা করানোর পাশাপাশি তাঁদের লম্বা চুল ও গোঁফ কেটে দেওয়া হয়।
নজরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর জানান, ঘটনার পরপরই লালন ভক্তরা তাঁর কাছে যান। তিনি সবাইকে নিয়ে পাংশা থানায় যান। এরপর বাউল মোহম্মদ ফকির ১৩ জনকে আসামি করে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন।
থানায় অভিযোগকারী বাউল মোহম্মদ ফকির বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো এবারও সাধু সংঘের উদ্যোগে আমাদের বাড়িতে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শেষ দিন মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে পাড়া বেলগাছী গ্রামের ইউনুছ কারি ও চর রামনগর গ্রামের করিম বাজারী, জিন্দার শেখ, জয়নাল শেখসহ প্রায় অর্ধশত লোক আমার বাড়িতে আসে। তাঁরা অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বলে একটি মাইক, তিনটি মাইক্রোফোন, তিনটি ব্যাটারি, তিনটি টিউব লাইট ও একজন শিল্পীর বাদ্যযন্ত্রসহ বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যায়। এরপর তারা ২৮ জন লালন ভক্তকে পাশের মসজিদের সামনে নিয়ে গিয়ে তওবা পড়ায় এবং কাঁচি দিয়ে এলোমেলোভাবে তাদের চুল ও গোঁফ কেটে দেয়।’
ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হামলাকারী দলের সঙ্গে ছিলেন পার্শ্ববর্তী কালিকাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিউর রহমান নবাব। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বাউলদের ‘অনৈসলামিক’ কর্মকাণ্ডকে দায়ী করেন। আতিউর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মুসলিম ধর্মীয় রীতি না মেনে বাউলরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জিন্দা ফয়তা ও এক ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ অনুষ্ঠানের নামে মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করছিল। এটা এলাকার মুসল্লিরা মেনে নিতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে বাউলদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় এলাকার কিছু যুবক তাদের চুল ও গোঁফ কেটে দেয়।’
বিষয়টি শুনে ঘটনাস্থলে যাওয়া হাবাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আবদুল আজিজ বলেন, যেসব বাউল ভক্তকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে তাঁদের কারো বয়স ৬০ বছরের নিচে নয়। অন্যদিকে থানায় অভিযোগকারী বাউল মোহম্মদ ফকিরের ছেলে জিন্না মোল্লার স্ত্রী হাসিনা বেগম জানান, ঘটনার পর থেকে লালন ভক্তরা চাপের মুখে রয়েছেন। এলাকার কথিত মাতব্বর ও প্রভাবশালী লোকজন তাঁদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
এ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা ও পাংশা থানার উপপরিদর্শক নাসির উদ্দিন গতকাল বৃহস্পতিবার মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে বিষয়টির সংশ্লিষ্টতা থাকায় খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য বুধবার দুইপক্ষকে থানায় ডাকা হয়, কিন্তু বাউলদের পক্ষের কেউ না আসায় সুরাহা করা সম্ভব হয়নি। আগামী রবিবার আবার দুইপক্ষকে ডাকা হয়েছে।’’
খবরে স্পষ্ট, মোল্লাদের সহায়তায় রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে বাউলদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এবং এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, ১১ এপ্রিলের মানবজমিন জানাচ্ছে, এই ক্ষমতাসীনদের চাপের কারণেই তৎক্ষণাত মামলা না নিয়ে ৫ দিন পর পুলিশ মামলা নেয়। এবং একই কারণে আক্রমণে জড়িত অপরাধীদের পুলিশ আইনের আওতায় নিয়ে আসতেও গড়িমসি করে। শেষ পর্যন্ত আসামীদের নিয়ে প্রভাবশালীদের চাপে অনেক বাহানার পর সংবাদমাধ্যমের মারফত আমরা জানতে পারছি, ‘রাজবাড়ীতে ২৮ বাউল নির্যাতনের ঘৃণ্য ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য আদালতের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে আকস্মিকভাবে শালিস বৈঠক ডেকে বিষয়টি আপোসরফা করে দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। রাজবাড়ী-২ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মোঃ জিল্লুল হাকিমের উদ্যোগে ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৮টায় পাংশা ডাকবাংলোয় বসে একটি সমঝোতা বৈঠক। বৈঠকে বাউল নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বাদী, ক্ষতিগ্রস্ত বাউলদের কয়েকজন ও মামলায় অভিযুক্ত ১৩ আসামিসহ উভয়পক্ষের কয়েকশ মানুষ উপস্থিত ছিলেন’।
অপরাধ সংগঠন থেকে শুরু করে আপোষ রফার শালিসি পর্যন্ত অপরাধীরা যাদের সমর্থন ও সঙ্গ পেয়েছেন তারা সরকার দলীয় ক্ষমতাবান। অপরাধীদের অধিকাংশ সরকার দলের সক্রিয় নেতাকর্মীও। এসব তথ্য উহ্য রেখে আমরা যখন অপরাধীদের স্রেফ ধর্মান্ধ বলে ঘটনার প্রতিবাদে নেমে যাই তখন আমরা অর্ধসত্যের ওপর দাঁড়াই বটে। হয়তো শহরে আমরা আওয়ামী লীগকে আমাদের মতোই অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিমনা বলে চিনি বা চিনতে চাই বলে গ্রামে আওয়ামী লীগের দ্বারা সংগঠিত অপরাধকে গোপন করে যেতে চাই। তাদের সঙ্গে ধর্মান্ধ শক্তির আঁতাত আমাদের পর্যবেক্ষণের বাইরে থেকে যায়। বাউলদের ওপর হামলা, বাউলদের মামলা অকার্যকর থাকা ও শেষ পর্যন্ত শালিসির পেছনে রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার আমাদের আলোচনার বাইরে থেকে যায়। ফলে, সাধু-গুরুদের ওপর হামলাকারীদের পরিচয়কে আমরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে সেই ধর্মান্ধদের পরিচয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি যারা নারী নীতির বিরোধিতা করে এমনকি যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের দলভুক্ত করে ফেলি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আপাত অর্থে এই ধর্মান্ধ ও সন্ত্রাসীদের দলভুক্ত নয় রাজবাড়ির সন্ত্রাসীরা। তারা শহুরে প্রগতিশীল বর্গের কাছের দল আওয়ামী লীগের লোক। যারা শহরে বাউলদের পক্ষে মানববন্ধন করেছেন তাদের অনেককে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা আসলেই রাজবাড়ির হামলাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ওয়াকিবহাল নন। তারা শুধু ধর্মীয় পরিচয়টুকু জেনেই মাঠে নেমেছেন।
শুধু হামলাকারীদের পরিচয়ের অস্পষ্টতা নয়। যাদের ওপর হামলা করা হয়েছে তাদের পরিচয় নিয়েও আরেক ধরনের অস্পষ্টতা আছে। শহুরে প্রগতিশীলরা যাদের বাউল বলে চেনেন, আখ্যায়িত করেন- বাউল অভিধায় তাদের অনেকেরই আপত্তি আছে। শুধু বাউল বলেই কথা থেমে যায় না। আমাদের সাহিত্যে, সংবাদপত্রে, কলামে, কথায় এই বাউলদের যে রূপ নির্মাণ করি তাতে তাদের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পুননির্মাণ করি। মনে করি, এরা হিন্দু-মুসলিমের দ্বন্দ্বে সেতুবন্ধের ভূমিকায় অবতীর্ণ। প্রথম কথা হলো, বাউল শব্দের মধ্যে এদের সবার পরিচয় নেই। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব ঘর বা ঘরাণা আছে। ঘর অনুসারে বিশ্বাস ও আদর্শের ভিন্নতাও আছে। দ্বিতীয়ত, এরা হিন্দু, মুসলিম ও অসম্প্রদায়িকদের চেয়ে প্রগতিশীল বটে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ নয়। ঘরগুলো একেকটি ধর্ম। ফলে, আমাদের পূর্বজ বিদ্বানদের কেউ কেউ এদের ধর্মসম্প্রদায় বা উপাসক সম্প্রদায় হিসেবে চিনেছেন। ধর্ম ও দার্শনিক সম্প্রদায় হিসেবে এদের নিজস্ব পালনীয় আছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে, গার্হস্থ্য, বৈরাগ্যের রীতি-পদ্ধতি আছে। এমনকি বিশেষ ইউনিফর্মও আছে। চুল-দাড়ি, জোব্বা সবই সেই ইউনিফর্মের অংশ। বাইরে থেকে তারা অন্য ধর্ম সম্প্রদায় বা অসাম্প্রদায়িকদের থেকে যেমন আলাদা তেমনি তেমনি ভেতর থেকেও। ভারতবর্ষে জৈন-বৌদ্ধ থেকে শ্রীচৈতন্য পর্যন্ত যে বেদ-বিরোধী/অবৈদিক/প্রতিবাদী ধর্মধারার বিকাশ ঘটেছে সে ধারা শতধাবিভক্ত হয়ে আজও সমাজে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সেই ধর্মধারার একটি লালন সাঁইয়ের ঘর। লালন সাই পর্যন্ত আসার পথে এ ধর্মধারায় ইসলামী উপাদানগুলো প্রবেশ করেছে। কিন্তু বেদপুরাণের ক্ষেত্রে যেমন ইসলামের ক্ষেত্রেও তেমন শরিয়ত/কেতাব/আচার/বেদ/পুরাণকে তারা শত্রুজ্ঞান করেই এগিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবাদী ধর্মধারার বৈশিষ্ট্য অনুসারে এরা সবসময় মূলধারার ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই এ দুইকে প্রশ্ন করেছেন। ধর্মগুলো থেকে অনেক উপাদান গ্রহণ করেছেন আবার অনেক কিছু বর্জন করেছেন। ধর্মের চৌহদ্দীর মধ্যে কৌশলগত অবস্থান শুধু নয়, ধার্মিকদের চৌহদ্দীর মধ্যে থেকে তারা যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি ধর্মকে ফেলেন তা ধার্মিকদের পক্ষে মোকাবেলা করা কঠিন। হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মসম্প্রদায়ই সে কারণে তাদের বিরোধিতা করেছে, তাদের ওপর হামলা করেছে। কিন্তু প্রতিবাদী ধর্মগুলো দুই ধর্মের ডিকশন, নবী-রসুল, অবতার, বেদ-পুরাণকে এমনভাবে ব্যবহার করেছে, আত্মস্থ করেছে যে তারা এই দুই ধর্মের চৌহদ্দীর বাইরে অবস্থান করেন কি না সেটি বোঝাও অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমন এক পরিস্থিতিতে আমরা যখন দু’একটি গানের সূত্রে তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীকে পরিণত করি তখন অনেকটা ভুল পাঠ হয়ে যায়। এককালে হিন্দু লালন গবেষকরা লালনকে হিন্দু, মুসলিম লালন গবেষকরা মুসলিম হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন এখন অসাম্প্রদায়িক আদর্শে লালনকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে। প্রায় হাজার বছর ধরে যে প্রতিবাদী ধর্মধারার বিকাশ এই ভূখণ্ডে হয়েছে তাকে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে উৎখাত করে শহুরে মিডলক্লাসের সেক্যুলার আদর্শে গুম করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ফলে, শহুরে মধ্যবিত্ত প্রগতিশীলরা যখন তাদের কথিত বাউলের সম্মান রক্ষার জন্য একাট্টা হন তখন ‘বাউল’দের মত, বিশ্বাস, আদর্শ ও আচারের বাইরে আমরা এমন পুননির্মিত বাউলদের দেখা পাই যারা সেক্যুলার মিডলক্লাসের গ্রামীণ সংস্করণ ছাড়া আর কিছু নয়।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, মধ্যবিত্ত অ্যাক্টিভিস্টরা তাহলে কী করবে? রাজবাড়িতে বাউলরা নির্যাতিত হলে তারা কি চুপ করে থাকবে? আজ তো তাদের প্রতিবাদের কারণেই হাই কোর্ট নির্দেশ জারি করলো। বাউলদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব বাতলে দিল। কথা সত্য, আর শহুরে প্রগতিশীলদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে কিন্তু তাদের প্রতিবাদ যে সৎ মানবতাবাদী প্রয়াস তাতে সন্দেহ নাই। ফলে, এই প্রতিবাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তথাকথিত বাউলদের ইতিহাসটাও একটু জেনে নিতে হবে।
বৈদিক ধর্মের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এই বাউলদের পূর্বসূরিরা লড়াই করেছেন শত শত বছর ধরে। প্রতিবাদী সহজ ধর্মধারার উত্থান ও জনপ্রিয়তার কারণে শ্রীচৈতন্যকে প্রাণ দিতে হয়েছে। লালন ও তার অনুসারিরা দীর্ঘদিন ধরে শরিয়তপন্থী মুসলিমদের ফতোয়া, আক্রমণ ও কুৎসার শিকার হয়েছেন। মীর মশাররফ হোসেনের মতো সাহিত্যিকও লালনপন্থীদের ইসলাম-বিদ্বেষী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। মুন্সি মেহেরুল্লাহ, মোহাম্মদ রেয়াজ উদ্দিন আহম্মদ, শেখ রেয়াজউদ্দিন আহম্মদ, মৌলানা আকরাম খাঁ, মুন্সি এমদাদ আলি থেকে শুরু করে বহু বিরোধীর মোকাবেলা তাদের করতে হয়েছে। ফতোয়ার সর্বশেষ প্রতিনিধি মুফতি রিয়াজ। দীর্ঘকাল ধরে শরিয়তপন্থীরা যে আক্রমণ করে এসেছে তা লালনপন্থীরা মোকাবেলা করেছেন নিজেদের সংঘশক্তি ও চিন্তা শক্তির দ্বারা। লালনের লাঠিয়াল বাহিনী ছিল। সে লাঠিয়াল শুধু ফতোয়ার হাত থেকে তাদের রক্ষা করতো না। ঠাকুর পরিবারের জমিদারি-জনিত অত্যাচার থেকে সাংবাদিক বন্ধু কাঙাল হরিনাথকে রক্ষার কাজেও যে শক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। কয়েশত বছর ধরে লালনের ধর্ম ও চিন্তা লড়াই করেই সমাজে টিকে আছে। ইসলামের বহু উপাদান নিয়ে তারা ধর্মের চৌহদ্দী ও ধার্মিকের উঠানে বসে ধর্ম-সমালোচনার যে রীতি পালন করে আসছে সে সাহস সেক্যুলার মধ্যবিত্তের মধ্যে নেই। মধ্যবিত্ত যেখান থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেক্যুলার আদর্শ পেয়েছে সে আদর্শের ইতিহাসের মধ্যে এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না। লালনের আদর্শ মধ্যবিত্তের সমর্থনের অপেক্ষায় কখনোই নিজের লড়াইকে অপেক্ষায় রাখেনি। ফলে, মধ্যবিত্ত যদি নিজেদের লালনের আদর্শের জিম্মাদার ভেবে তার পক্ষে দাঁড়ায় তবে লালনের আদর্শের আত্মশক্তিকে তারা ভুলভাবে বিচার করবে।
মুফতি রিয়াজদের সঙ্গে লালনপন্থীদের সংঘর্ষের ইতিহাস দীর্ঘ। অফিসিয়াল ইসলামের আক্রমণে লালনপন্থীদের দমানো যায়নি। বরং তাদের উত্থাপিত প্রশ্ন অফিসিয়াল ইসলামের ভিতকে বহুভাবে পর্যুদস্ত করেছে, তর্কে পরাস্ত করেছে। তর্কে জেতার সম্ভাবনা নাই বলেই তাই তারা শারীরিক আক্রমণের পথ অবলম্বন করে, তাদের সম্পর্কে অপপ্রচার ও কুৎসা রচনা করে। কিন্তু সাধুগুরুদের লড়াইয়ের নতুন সঙ্গীরা কী চায়? তারা কি সাধুসঙ্গ নাকি সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব-জনিত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়? আক্রমণকারীর রাজনৈতিক পরিচয়, আক্রান্তের ধর্ম ও আদর্শ ও দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস গোপন রেখে ‘বাউল’দের পক্ষাবলম্বন আরও বড় কোনো অসাধু রাজনীতি-জনিত কি না সে প্রশ্ন তাই করে রাখছি।
মাহবুব মোর্শেদ: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
গত ৫ এপ্রিল রাজবাড়ির পাংশায় সাধুসঙ্গ উপলক্ষে সমবেত ২৮ লালনপন্থী সাধু-গুরুর ওপর হামলা চালায় দুবৃর্ত্তরা। গণতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার আছে সমবেত হওয়ার, বিশ্বাস অনুসারে কর্মসূচি পালন করার এবং আদর্শ ও ধর্মমত প্রচার করার। কেউ যদি নিজের ধর্মমত, বিশ্বাস, রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি হুমকি মনে করে অন্য ধর্মমত, বিশ্বাস ও রাজনৈতিক মতের ওপর শারীরিক বা মানসিকভাবে হামলা করে তবে প্রথমত তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বরখেলাপ। আক্রমণটি যদি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত হয় তবে তা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ- ধর্মান্ধদের দ্বারা সংগঠিত হামলা। আর যদি রাজনৈতিক শক্তির সমর্থনে তারা কর্মীদের দ্বারা সংগঠিত হয় তবে তা একই সঙ্গে রাজনৈতিক ভিন্নমতের প্রতি আক্রমণও। রাজবাড়িতে সাধু-গুরুদের ওপর হামলা হয়েছে- এ খবরটি আমরা জানি। এ নিয়ে দেশের সাধু-গুরুরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন, অবিলম্বে থানায় গিয়েছেন। দেশের শহরগুলোতেও নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে- শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা, অসাম্প্রদায়িক নাগরিকদের উদ্যোগে। আমরাও আর অনেকের মতো এমন ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা জানাই। কিন্তু আমরা যে বর্গের বা গোষ্ঠীর অংশ সেই শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা, অসম্প্রদায়িক বর্গের প্রতিবাদে কিছু অস্পষ্টতা ও দিশাহীনতা আছে বলে মনে হচ্ছে। আলোচনার খাতিরে এই বর্গটিকে সংক্ষেপে শহুরে প্রগতিশীল বর্গ নামে ডাকা যায়। প্রথম প্রশ্ন হলো, শহুরে প্রগতিশীলদের প্রতিবাদে হামলাকারীদের পরিচয় মুছে দেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা কি চলছে? যারা সাধু-গুরুদের ওপর হামলা চালিয়েছেন তাদের একটি রাজনৈতিক, ধর্মীয় এমনকি শ্রেণীগত পরিচয়ও এ সংক্রান্ত খবরের সূত্রে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সেসব পরিচয়কে আড়াল করার কোনো চেষ্টা কি সচেতনভাবে চলছে? বলা হচ্ছে, ধর্মান্ধ অপশক্তি বাউলদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ধর্মান্ধ অপশক্তি বললে আমরা যাদের সহজে চিনি তাদেরকেই হয়তো আমরা রাজবাড়ির হামলার জন্য দায়ী করতে চাই। ফলে, রাজনৈতিক পরিচয়ে যে তারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সেটি গোপন করতে চাই? আমরা কি মনে করি, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে রাজবাড়ির স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের রাজনীতির পার্থক্য আছে? তারা ভুলবশত আওয়ামী লীগের আদর্শের বাইরে গিয়ে হামলা চালিয়েছেন? ৮ এপ্রিল তারিখের কালের কণ্ঠ পত্রিকা খবর দিচ্ছে, ‘’ধর্মবিরোধী’ কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তওবা পড়ানো হলো ২৮ বাউলকে!’ শিরোনামে। খবরের বলা হচ্ছে-
‘রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে লালন ভক্ত ২৮ বাউলকে লাঞ্ছিত করার পর মাথার চুল ও গোঁফ কেটে দিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ‘ধর্মবিরোধী’ কর্মকাণ্ড চালানোর কারণ দেখিয়ে বাউলদের মসজিদে নিয়ে তওবাও পড়ানো হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ও অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে গত বুধবার রাতে পাংশা টেম্পোস্ট্যান্ডে সভা করেন স্থানীয় শাহ জুঁই বাউল শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা।
শাহ জুঁই বাউল শিল্পীগোষ্ঠীর উপদেষ্টা অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর জানান, হাবাসপুর ইউপির চর রামনগর গ্রামে গত ৫ এপ্রিল লালন ভক্ত প্রবীণ বাউল মোহম্মদ ফকিরের বাড়িতে সাধু সংঘের দুই দিনব্যাপী বার্ষিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ২৮ জন লালন ভক্ত আসেন। সমাপনী দিনে তাঁরা ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান করছিলেন। এ সময় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গিয়ে লালন ভক্তদের লাঞ্ছিত করে। মসজিদে নিয়ে গিয়ে বাউলদের গান না গাওয়ার বিষয়ে তওবা করানোর পাশাপাশি তাঁদের লম্বা চুল ও গোঁফ কেটে দেওয়া হয়।
নজরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর জানান, ঘটনার পরপরই লালন ভক্তরা তাঁর কাছে যান। তিনি সবাইকে নিয়ে পাংশা থানায় যান। এরপর বাউল মোহম্মদ ফকির ১৩ জনকে আসামি করে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন।
থানায় অভিযোগকারী বাউল মোহম্মদ ফকির বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো এবারও সাধু সংঘের উদ্যোগে আমাদের বাড়িতে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শেষ দিন মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে পাড়া বেলগাছী গ্রামের ইউনুছ কারি ও চর রামনগর গ্রামের করিম বাজারী, জিন্দার শেখ, জয়নাল শেখসহ প্রায় অর্ধশত লোক আমার বাড়িতে আসে। তাঁরা অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বলে একটি মাইক, তিনটি মাইক্রোফোন, তিনটি ব্যাটারি, তিনটি টিউব লাইট ও একজন শিল্পীর বাদ্যযন্ত্রসহ বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যায়। এরপর তারা ২৮ জন লালন ভক্তকে পাশের মসজিদের সামনে নিয়ে গিয়ে তওবা পড়ায় এবং কাঁচি দিয়ে এলোমেলোভাবে তাদের চুল ও গোঁফ কেটে দেয়।’
ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হামলাকারী দলের সঙ্গে ছিলেন পার্শ্ববর্তী কালিকাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিউর রহমান নবাব। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বাউলদের ‘অনৈসলামিক’ কর্মকাণ্ডকে দায়ী করেন। আতিউর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মুসলিম ধর্মীয় রীতি না মেনে বাউলরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জিন্দা ফয়তা ও এক ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ অনুষ্ঠানের নামে মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করছিল। এটা এলাকার মুসল্লিরা মেনে নিতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে বাউলদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় এলাকার কিছু যুবক তাদের চুল ও গোঁফ কেটে দেয়।’
বিষয়টি শুনে ঘটনাস্থলে যাওয়া হাবাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আবদুল আজিজ বলেন, যেসব বাউল ভক্তকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে তাঁদের কারো বয়স ৬০ বছরের নিচে নয়। অন্যদিকে থানায় অভিযোগকারী বাউল মোহম্মদ ফকিরের ছেলে জিন্না মোল্লার স্ত্রী হাসিনা বেগম জানান, ঘটনার পর থেকে লালন ভক্তরা চাপের মুখে রয়েছেন। এলাকার কথিত মাতব্বর ও প্রভাবশালী লোকজন তাঁদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
এ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা ও পাংশা থানার উপপরিদর্শক নাসির উদ্দিন গতকাল বৃহস্পতিবার মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে বিষয়টির সংশ্লিষ্টতা থাকায় খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য বুধবার দুইপক্ষকে থানায় ডাকা হয়, কিন্তু বাউলদের পক্ষের কেউ না আসায় সুরাহা করা সম্ভব হয়নি। আগামী রবিবার আবার দুইপক্ষকে ডাকা হয়েছে।’’
খবরে স্পষ্ট, মোল্লাদের সহায়তায় রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে বাউলদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এবং এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, ১১ এপ্রিলের মানবজমিন জানাচ্ছে, এই ক্ষমতাসীনদের চাপের কারণেই তৎক্ষণাত মামলা না নিয়ে ৫ দিন পর পুলিশ মামলা নেয়। এবং একই কারণে আক্রমণে জড়িত অপরাধীদের পুলিশ আইনের আওতায় নিয়ে আসতেও গড়িমসি করে। শেষ পর্যন্ত আসামীদের নিয়ে প্রভাবশালীদের চাপে অনেক বাহানার পর সংবাদমাধ্যমের মারফত আমরা জানতে পারছি, ‘রাজবাড়ীতে ২৮ বাউল নির্যাতনের ঘৃণ্য ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য আদালতের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে আকস্মিকভাবে শালিস বৈঠক ডেকে বিষয়টি আপোসরফা করে দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। রাজবাড়ী-২ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মোঃ জিল্লুল হাকিমের উদ্যোগে ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৮টায় পাংশা ডাকবাংলোয় বসে একটি সমঝোতা বৈঠক। বৈঠকে বাউল নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বাদী, ক্ষতিগ্রস্ত বাউলদের কয়েকজন ও মামলায় অভিযুক্ত ১৩ আসামিসহ উভয়পক্ষের কয়েকশ মানুষ উপস্থিত ছিলেন’।
অপরাধ সংগঠন থেকে শুরু করে আপোষ রফার শালিসি পর্যন্ত অপরাধীরা যাদের সমর্থন ও সঙ্গ পেয়েছেন তারা সরকার দলীয় ক্ষমতাবান। অপরাধীদের অধিকাংশ সরকার দলের সক্রিয় নেতাকর্মীও। এসব তথ্য উহ্য রেখে আমরা যখন অপরাধীদের স্রেফ ধর্মান্ধ বলে ঘটনার প্রতিবাদে নেমে যাই তখন আমরা অর্ধসত্যের ওপর দাঁড়াই বটে। হয়তো শহরে আমরা আওয়ামী লীগকে আমাদের মতোই অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিমনা বলে চিনি বা চিনতে চাই বলে গ্রামে আওয়ামী লীগের দ্বারা সংগঠিত অপরাধকে গোপন করে যেতে চাই। তাদের সঙ্গে ধর্মান্ধ শক্তির আঁতাত আমাদের পর্যবেক্ষণের বাইরে থেকে যায়। বাউলদের ওপর হামলা, বাউলদের মামলা অকার্যকর থাকা ও শেষ পর্যন্ত শালিসির পেছনে রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার আমাদের আলোচনার বাইরে থেকে যায়। ফলে, সাধু-গুরুদের ওপর হামলাকারীদের পরিচয়কে আমরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে সেই ধর্মান্ধদের পরিচয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি যারা নারী নীতির বিরোধিতা করে এমনকি যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের দলভুক্ত করে ফেলি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আপাত অর্থে এই ধর্মান্ধ ও সন্ত্রাসীদের দলভুক্ত নয় রাজবাড়ির সন্ত্রাসীরা। তারা শহুরে প্রগতিশীল বর্গের কাছের দল আওয়ামী লীগের লোক। যারা শহরে বাউলদের পক্ষে মানববন্ধন করেছেন তাদের অনেককে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা আসলেই রাজবাড়ির হামলাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ওয়াকিবহাল নন। তারা শুধু ধর্মীয় পরিচয়টুকু জেনেই মাঠে নেমেছেন।
শুধু হামলাকারীদের পরিচয়ের অস্পষ্টতা নয়। যাদের ওপর হামলা করা হয়েছে তাদের পরিচয় নিয়েও আরেক ধরনের অস্পষ্টতা আছে। শহুরে প্রগতিশীলরা যাদের বাউল বলে চেনেন, আখ্যায়িত করেন- বাউল অভিধায় তাদের অনেকেরই আপত্তি আছে। শুধু বাউল বলেই কথা থেমে যায় না। আমাদের সাহিত্যে, সংবাদপত্রে, কলামে, কথায় এই বাউলদের যে রূপ নির্মাণ করি তাতে তাদের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পুননির্মাণ করি। মনে করি, এরা হিন্দু-মুসলিমের দ্বন্দ্বে সেতুবন্ধের ভূমিকায় অবতীর্ণ। প্রথম কথা হলো, বাউল শব্দের মধ্যে এদের সবার পরিচয় নেই। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব ঘর বা ঘরাণা আছে। ঘর অনুসারে বিশ্বাস ও আদর্শের ভিন্নতাও আছে। দ্বিতীয়ত, এরা হিন্দু, মুসলিম ও অসম্প্রদায়িকদের চেয়ে প্রগতিশীল বটে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ নয়। ঘরগুলো একেকটি ধর্ম। ফলে, আমাদের পূর্বজ বিদ্বানদের কেউ কেউ এদের ধর্মসম্প্রদায় বা উপাসক সম্প্রদায় হিসেবে চিনেছেন। ধর্ম ও দার্শনিক সম্প্রদায় হিসেবে এদের নিজস্ব পালনীয় আছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে, গার্হস্থ্য, বৈরাগ্যের রীতি-পদ্ধতি আছে। এমনকি বিশেষ ইউনিফর্মও আছে। চুল-দাড়ি, জোব্বা সবই সেই ইউনিফর্মের অংশ। বাইরে থেকে তারা অন্য ধর্ম সম্প্রদায় বা অসাম্প্রদায়িকদের থেকে যেমন আলাদা তেমনি তেমনি ভেতর থেকেও। ভারতবর্ষে জৈন-বৌদ্ধ থেকে শ্রীচৈতন্য পর্যন্ত যে বেদ-বিরোধী/অবৈদিক/প্রতিবাদী ধর্মধারার বিকাশ ঘটেছে সে ধারা শতধাবিভক্ত হয়ে আজও সমাজে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সেই ধর্মধারার একটি লালন সাঁইয়ের ঘর। লালন সাই পর্যন্ত আসার পথে এ ধর্মধারায় ইসলামী উপাদানগুলো প্রবেশ করেছে। কিন্তু বেদপুরাণের ক্ষেত্রে যেমন ইসলামের ক্ষেত্রেও তেমন শরিয়ত/কেতাব/আচার/বেদ/পুরাণকে তারা শত্রুজ্ঞান করেই এগিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবাদী ধর্মধারার বৈশিষ্ট্য অনুসারে এরা সবসময় মূলধারার ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই এ দুইকে প্রশ্ন করেছেন। ধর্মগুলো থেকে অনেক উপাদান গ্রহণ করেছেন আবার অনেক কিছু বর্জন করেছেন। ধর্মের চৌহদ্দীর মধ্যে কৌশলগত অবস্থান শুধু নয়, ধার্মিকদের চৌহদ্দীর মধ্যে থেকে তারা যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি ধর্মকে ফেলেন তা ধার্মিকদের পক্ষে মোকাবেলা করা কঠিন। হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মসম্প্রদায়ই সে কারণে তাদের বিরোধিতা করেছে, তাদের ওপর হামলা করেছে। কিন্তু প্রতিবাদী ধর্মগুলো দুই ধর্মের ডিকশন, নবী-রসুল, অবতার, বেদ-পুরাণকে এমনভাবে ব্যবহার করেছে, আত্মস্থ করেছে যে তারা এই দুই ধর্মের চৌহদ্দীর বাইরে অবস্থান করেন কি না সেটি বোঝাও অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমন এক পরিস্থিতিতে আমরা যখন দু’একটি গানের সূত্রে তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীকে পরিণত করি তখন অনেকটা ভুল পাঠ হয়ে যায়। এককালে হিন্দু লালন গবেষকরা লালনকে হিন্দু, মুসলিম লালন গবেষকরা মুসলিম হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন এখন অসাম্প্রদায়িক আদর্শে লালনকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে। প্রায় হাজার বছর ধরে যে প্রতিবাদী ধর্মধারার বিকাশ এই ভূখণ্ডে হয়েছে তাকে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে উৎখাত করে শহুরে মিডলক্লাসের সেক্যুলার আদর্শে গুম করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ফলে, শহুরে মধ্যবিত্ত প্রগতিশীলরা যখন তাদের কথিত বাউলের সম্মান রক্ষার জন্য একাট্টা হন তখন ‘বাউল’দের মত, বিশ্বাস, আদর্শ ও আচারের বাইরে আমরা এমন পুননির্মিত বাউলদের দেখা পাই যারা সেক্যুলার মিডলক্লাসের গ্রামীণ সংস্করণ ছাড়া আর কিছু নয়।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, মধ্যবিত্ত অ্যাক্টিভিস্টরা তাহলে কী করবে? রাজবাড়িতে বাউলরা নির্যাতিত হলে তারা কি চুপ করে থাকবে? আজ তো তাদের প্রতিবাদের কারণেই হাই কোর্ট নির্দেশ জারি করলো। বাউলদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব বাতলে দিল। কথা সত্য, আর শহুরে প্রগতিশীলদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে কিন্তু তাদের প্রতিবাদ যে সৎ মানবতাবাদী প্রয়াস তাতে সন্দেহ নাই। ফলে, এই প্রতিবাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তথাকথিত বাউলদের ইতিহাসটাও একটু জেনে নিতে হবে।
বৈদিক ধর্মের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এই বাউলদের পূর্বসূরিরা লড়াই করেছেন শত শত বছর ধরে। প্রতিবাদী সহজ ধর্মধারার উত্থান ও জনপ্রিয়তার কারণে শ্রীচৈতন্যকে প্রাণ দিতে হয়েছে। লালন ও তার অনুসারিরা দীর্ঘদিন ধরে শরিয়তপন্থী মুসলিমদের ফতোয়া, আক্রমণ ও কুৎসার শিকার হয়েছেন। মীর মশাররফ হোসেনের মতো সাহিত্যিকও লালনপন্থীদের ইসলাম-বিদ্বেষী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। মুন্সি মেহেরুল্লাহ, মোহাম্মদ রেয়াজ উদ্দিন আহম্মদ, শেখ রেয়াজউদ্দিন আহম্মদ, মৌলানা আকরাম খাঁ, মুন্সি এমদাদ আলি থেকে শুরু করে বহু বিরোধীর মোকাবেলা তাদের করতে হয়েছে। ফতোয়ার সর্বশেষ প্রতিনিধি মুফতি রিয়াজ। দীর্ঘকাল ধরে শরিয়তপন্থীরা যে আক্রমণ করে এসেছে তা লালনপন্থীরা মোকাবেলা করেছেন নিজেদের সংঘশক্তি ও চিন্তা শক্তির দ্বারা। লালনের লাঠিয়াল বাহিনী ছিল। সে লাঠিয়াল শুধু ফতোয়ার হাত থেকে তাদের রক্ষা করতো না। ঠাকুর পরিবারের জমিদারি-জনিত অত্যাচার থেকে সাংবাদিক বন্ধু কাঙাল হরিনাথকে রক্ষার কাজেও যে শক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। কয়েশত বছর ধরে লালনের ধর্ম ও চিন্তা লড়াই করেই সমাজে টিকে আছে। ইসলামের বহু উপাদান নিয়ে তারা ধর্মের চৌহদ্দী ও ধার্মিকের উঠানে বসে ধর্ম-সমালোচনার যে রীতি পালন করে আসছে সে সাহস সেক্যুলার মধ্যবিত্তের মধ্যে নেই। মধ্যবিত্ত যেখান থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেক্যুলার আদর্শ পেয়েছে সে আদর্শের ইতিহাসের মধ্যে এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না। লালনের আদর্শ মধ্যবিত্তের সমর্থনের অপেক্ষায় কখনোই নিজের লড়াইকে অপেক্ষায় রাখেনি। ফলে, মধ্যবিত্ত যদি নিজেদের লালনের আদর্শের জিম্মাদার ভেবে তার পক্ষে দাঁড়ায় তবে লালনের আদর্শের আত্মশক্তিকে তারা ভুলভাবে বিচার করবে।
মুফতি রিয়াজদের সঙ্গে লালনপন্থীদের সংঘর্ষের ইতিহাস দীর্ঘ। অফিসিয়াল ইসলামের আক্রমণে লালনপন্থীদের দমানো যায়নি। বরং তাদের উত্থাপিত প্রশ্ন অফিসিয়াল ইসলামের ভিতকে বহুভাবে পর্যুদস্ত করেছে, তর্কে পরাস্ত করেছে। তর্কে জেতার সম্ভাবনা নাই বলেই তাই তারা শারীরিক আক্রমণের পথ অবলম্বন করে, তাদের সম্পর্কে অপপ্রচার ও কুৎসা রচনা করে। কিন্তু সাধুগুরুদের লড়াইয়ের নতুন সঙ্গীরা কী চায়? তারা কি সাধুসঙ্গ নাকি সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব-জনিত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়? আক্রমণকারীর রাজনৈতিক পরিচয়, আক্রান্তের ধর্ম ও আদর্শ ও দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস গোপন রেখে ‘বাউল’দের পক্ষাবলম্বন আরও বড় কোনো অসাধু রাজনীতি-জনিত কি না সে প্রশ্ন তাই করে রাখছি।
মাহবুব মোর্শেদ: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments:
Post a Comment