জুলাই ২৪, ২০১১ বিডিনিউজে প্রকাশিত
বিজ্ঞাপনটি অনেকেরই দেখা। বিজ্ঞাপনের কথাগুলো এমন :
শুধু লম্বা হলেই- আকাশ ছোঁয়া যায় না
শুধু বুদ্ধির জোরে- সাংবাদিকতা হয় না
শুধু শক্তি থাকলেই- সাঁতারু হওয়া যায় না
তাহলে কী দরকার?
খুব জরুরি প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞাপনেই দেওয়া আছে। তবু আমরা নিজেদের মতো করে উত্তর খুঁজবো। উত্তর খোঁজার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু আলাপও পেড়ে নেব।
সবার আগে বলে রাখি, হরলিক্সের বিজ্ঞাপন নিয়ে অতীতে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। হরলিক্স কোম্পানিকে সম্প্রচারিত বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার পর্যন্ত করতে হয়েছে। এখানে তেমন পুষ্টিগত বিতর্ক তোলার উদ্দেশ্য নেই। যে বিজ্ঞাপনটার কথা বলছি সেটি বরং আমার বিশেষ পছন্দ। সাধারণত যারা টিভি বিজ্ঞাপনের মডেল হন তারা এতে মডেল হননি। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতায় পরিচিত কয়েকজন নারী এতে মডেল হয়েছেন। এদের একজন সাংবাদিক, একজন বৈমানিক, একজন সাঁতারু। কলকাতার বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোতে হরলিক্সের এই বিজ্ঞাপন অনেকবার দেখেছি। চলচ্চিত্র বা টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে নিজেদের পেশায় সফল নারীরা সাধারণত নাম ও পেশাগত পরিচয়সহ বিজ্ঞাপনে হাজির হতে পারেন না। কিন্তু এ বিজ্ঞাপনে সেটা ঘটতে পেরেছে। কিন্তু খটকা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতেও বিজ্ঞাপনটা দেখানোর পর। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে পেশাগত পরিচয় রেখে মডেলদের নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। কেন এমন করা হলো? বাংলাদেশে এদের পরিচিতি নেই বলে? নাম-পরিচয় রাখলে কেউ কি প্রশ্ন তুলতেন, এরা কোথাকার সাংবাদিক বা বৈমানিক বা সাঁতারু? এমন প্রশ্ন উঠলে উত্তর মেলা কি কঠিন হতো? ভারতে তৈরি অনেক বিজ্ঞাপনই তো অহরহ বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয়। হিন্দিভাষায় নির্মিত বিজ্ঞাপন স্রেফ বাংলায় ডাবিং করে প্রচার করার ঐতিহ্যই রীতিমতো গড়ে উঠেছে। সে বিজ্ঞাপনগুলো দেখে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেন না- ঐশ্বরিয়া, প্রিয়াঙ্কা, দীপিকা, শাহরুখ কোথাকার অভিনেতা। প্রশ্ন ওঠে না, কারণ সবাই কমবেশি এদের চেনেন। কিন্তু কলকাতার খানিকটা অপরিচিত সেলিব্রেটিদের নিয়ে খটকা বেধেছে। বাংলাদেশে, এবং সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গেও খুব বেশি মানুষের জানাশোনা নেই এদের সঙ্গে। তবু পশ্চিমবঙ্গে নামপরিচয়সহ কাজ চলেছে, বাংলাদেশে চলছে না। বিজ্ঞাপনটি এখানে প্রচারের আগে কী ভাবা হয়েছিল? মডেলদের নাম-পরিচয়সহ উপস্থাপন করা হলে বাংলাদেশে প্রশ্ন উঠবে? হয়তো দাবিও উঠবে, বাংলাদেশের এমন নারীদের নিয়ে আরেকটা বিজ্ঞাপন তৈরি করা হোক? দাবি উঠলে, সেটি করা কঠিন হতো না।
বাংলাদেশে হরলিক্সের বাজার ছোট নয়- শুধু হরলিক্স কেন কোনো কমোডিটির বাজারই ছোট নয়। তবু বিজ্ঞাপনগুলো আসে পাশের বড়বাজার থেকে তৈরি হয়ে। তাদের নায়ক-নায়িকাদের মুখশ্রী সে বিজ্ঞাপন আলোকিত করে। এসব দেখে কাউকে এমন দাবি তুলতে দেখা যায়নি যে- শাহরুখের বদলে তো শাকিব, ঐশ্বরিয়ার বদলে শাবনুর কিংবা আসিনের বদলে মোনালিসাকে নিয়ে বিজ্ঞাপনটি একান্তই বাংলাদেশের টিভি দর্শকদের জন্য প্রচার করা হোক।
যে যুক্তিতে ভারতে নির্মিত সব বিজ্ঞাপন সেগুলোর আলোছায়াসঙ্গীত সহকারে শুধু ভাষা পরিবর্তন করে বাংলাদেশে সম্প্রচারিত হতে পারে সেই একই যুক্তিতে ভারতের কোনো মেট্রপলিটন শহরের আইকনদের নামপরিচয়সহ একটি বিজ্ঞাপনও প্রচার করা সম্ভব। সেই যুক্তিটা কী?
অবশ্যই বাজার।
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো যখন দক্ষিণ এশিয়ার ম্যাপ নিয়ে বসে তখন নিশ্চয়ই তারা একে একটি সাংস্কৃতিক একক হিসেবে বিবেচনা করে। এই এলাকার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বার্মা-থাইল্যান্ড-ফিলিপাইন-চীনের মতো নয়, আবার ইরান-ইরাক-সিরিয়ার মতোও নয়। মধ্য এশিয়া বা পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে অমিল আছে বলে দক্ষিণ এশিয়া আলাদা একক। দক্ষিণ এশিয়াও সমরূপ কোনো এলাকা নয়। এখানে বহু দেশ, বহুজাতি, বহুভাষা, বহু নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। শুধু ভারতকে বিবেচনায় আনা হলেও বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। কিন্তু নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের প্রশ্ন তুলে রেখে বাজারের প্রশ্নকে সামনে আনা হলে বাজারের কেন্দ্র ভারতই। শুধু কেন্দ্র নয় পরিধির অনেকটা জুড়েও ভারত। ভারতের বাইরে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ এমনকি পাকিস্তানেও বাজার তুলনামূলকভাবে ছোট। কিন্তু সেটাও বাজার বটে। তাই মুম্বাই বা দিল্লিতে সাউথ এশিয়া অফিস খুলে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি চেষ্টা করে ভারতের বাইরের পরিধিকেও সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। ভারতের নিজস্ব প্রস্তুতি ও অবকাঠামো এক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক। যেমন- বলিউডের সিনেমা, শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাতেও গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশে বসে সহজেই বলিউডের সিনেমা উপভোগ করা যায়। ফলে, ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন ভারতের শুধু নয়, আমাদেরও আইকন। বাংলাদেশে অনেকেই তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের খবর রাখেন। যেমন বচ্চন পরিবারের পুত্রবধু এখন অন্তঃসত্ত্বা, তার গর্ভে যমজ দুটি মেয়ে বেড়ে উঠছে। মুম্বাইতে বসে ইউনিলিভার যখন হিন্দি ভাষায় লাক্সের একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করে এবং তাতে মডেল হন ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন তখন মারাঠি, তামিল, তেলেগু, নেপালি, বাংলা, উর্দুসহ যে কোনো দক্ষিণ এশীয় ভাষায় একে ডাবিং করে ভারতসহ যে কোনো দক্ষিণ এশীয় দেশে প্রচার করা সম্ভব। বাস্তবে তা ঘটেও। এ নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠে না। এক যুগ আগে এমন হতো কি না, হলেও প্রশ্ন উঠতো কি না তেমন তথ্য আপাতত হাতে নেই। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিকাশ, তথ্যপ্রযুক্তির বিপুল বিস্ফারের এ যুগে কেউ এমন প্রশ্ন তোলেন না। চ্যানেল ঘোরালেই, ডিভিডি চালালেই যাকে প্রতিনিয়ত দেখি- তাকে দেশের চ্যানেলে দেখলে প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত বটে, হিপোক্রেসিও।
দর্শক হিসেবে আমি বলিউডে নির্মিত হিন্দি সিনেমার অনুরক্ত। সেখানকার তরুণতর নির্মাতারা নিত্যনতুন আইডিয়া নিয়ে যেভাবে একের পর এক সিনেমা তৈরি করে চলেছেন তা চমকপ্রদ। শুধু বিনোদন ও জনপ্রিয়তাতেই নয়, শিল্পমানেও সমৃদ্ধ অনেক সিনেমা। বলিউড রীতিমতো একটি ইন্ডাস্ট্রি। তেমন ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গড়ে ওঠার বা চমকে-বৈভবে পরিপূর্ণ তেমন সিনেমা তৈরির সম্ভাবনা বাংলাদেশে নেই, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশেও নেই। ফলে, সে সিনেমাকে তার নায়ক-নায়িকা, ফ্যাশন, কমোডিটি, বাজার সম্ভাবনা সহকারে আমরা গ্রহণ করেছি। এতে আমরা অসুখী নই, বরং স্বস্তিতেই আছি বলা যায়। শুধু বলিউডের সিনেমাই নয়, বলিউডের সিনেমা যে ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যে সংস্কৃতি টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নির্মিত ও পুননির্মিত হয়ে চলেছে তারও স্বতঃস্ফূর্ত গ্রাহক আমরা। সত্যি বলতে, দিনের যে কোনো সময় কেউ যদি সিনেমা দেখতে চান, বাচ্চারা যদি কার্টুন দেখতে চায়, কারো যদি গান শোনার ইচ্ছা নয়, কিংবা কেউ যদি সোপ অপেরা দেখতে চান কিংবা কোনো হাসির অনুষ্ঠান যদি কেউ খোঁজ করেন তবে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর দারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এমনকি নিউজ কর্পোরেশন, সনি বা ওয়াল্ট ডিজনির মতো মাল্টিন্যাশনাল সম্প্রচারকদের টিভি চ্যানেলগুলোও এখন ভারতীয় রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯৯২ সালে ভারতে কেবল টেলিভিশন উন্মুক্ত হওয়ার পর বড়বাজারের আকর্ষণে রুপার্ট মারডকের স্টার টিভি নেটওয়ার্ক, এমটিভিসহ অনেক মাল্টিন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানি ভারতে ব্যবসা সম্প্রসারিত করে। স্টার টিভি নেটওয়ার্ক ভারতের বিভিন্ন ভাষার জন্য, বিভিন্ন গোষ্ঠীর দর্শকের জন্য ৩২টি চ্যানেল খুলেছে। সিএনএন, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকও ভারতে বাজার সৃষ্টির জন্য তৎপর। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে কেবল টেলিভিশন উন্মুক্ত হওয়ার পর দৃশ্যমানভাবে কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এখানে চ্যানেল খোলেনি, আগ্রহ দেখিয়েছে এমন তথ্যও নেই। তার কারণও বাজার- বাজার শুধু দর্শক নয়, বিজ্ঞাপনদাতারাও। আমরা যখন স্টার মুভিজে সিনেমা দেখি তখন সেটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এশিয়াস্যাটের মাধ্যমে সম্প্রচারিত হয় বটে কিন্তু সম্প্রচারের সময় যে বিজ্ঞাপন দেখা যায় তা একান্তই ভারতীয় দর্শকদের জন্য। বিজ্ঞাপনে আমরা এমন অনেক কিছু দেখি যা আমাদের বাজারে পাওয়া যায় না। যেমন- ডিটিএইচ টেকনলজি। টাটা স্কাই বা ডিশ টিভির বিজ্ঞাপন দেখি, কিন্তু এগুলো কী জানি না। সরাসরি ঘরে স্যাটেলাইট সম্প্রচারের প্রযুক্তি আমরা চিনি না, কিন্তু দেখতে দেখতে চাহিদা তৈরি হচ্ছে।
অবশ্য বিজ্ঞাপনে দেখা অধিকাংশ পণ্যই হাত বাড়ালে স্থানীয় বাজারে মেলে। বিজ্ঞাপন দেখে সেগুলো কিনতে প্ররোচিতও হই আমরা। যখন লাক্স সাবান কিনি তখন স্টার মুভিজ, বাংলাভিশন নাকি জিটিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে কিনলাম সেটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে নির্মিত পণ্যের অবস্থান আমাদের কেনাকাটার তালিকায় আছে কি? এখন থাকলেও এই ভিজ্যুয়াল অভ্যাসে আর কতদিন থাকবে?
শুধু কেনাকাটায় নয়, ভেতরে ভেতরে সমাজে-পরিবারে একটা সাংস্কৃতিক রূপান্তরও কি ঘটছে না?
আমার এক বন্ধু তার মেয়েকে নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত। ছোটবড় কোনো সমস্যা হলে তার চার বছরের মেয়ে লর্ড গণেশাকে ডাকে। ’মাই ফ্রেন্ড গনেশা, মুঝে বাঁচাও’ বলে গণেশার সাহায্য চায়। মেয়ে যে গণেশাকে ডাকে এতে সমস্যা নেই। কিন্তু মেয়ে গণেশার কাছে আবদার জানায় হিন্দি ভাষায়। ভাষা শিক্ষার জটিল একটি সময়ে বাচ্চা দিনের একটা বড় অংশ হিন্দি চ্যানেল দেখে ব্যয় করে। না, জিটিভি বা সনিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখে না। দেখে বাচ্চাদের চ্যানেলই। কিন্তু ডিজনি, কার্টুন নেটওয়ার্ক, পোগোসহ অনেক চ্যানেলই এখন ভারতের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচারে চলে এসেছে। এগুলো এখন হিন্দিতে সম্প্রচারিত হয়, একটি দুটি তেলেগুতেও সম্প্রচার করে। ডোরেমন-পোকেমন দেখার ফাঁকে ফাঁকে হিন্দি শিখছে মেয়ে। টুকটাক হিন্দি বলতে পারে, বুঝতে পারে প্রায় সবই। মুফতে একটি ভাষা শিখে ফেলছে- এতে অভিভাবকদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো ব্যাজার হচ্ছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, ইংরেজি তো শিখতেই হয়, বিকল্প নেই। কিন্তু ইংরেজির সঙ্গে বাংলার মৌলিক পার্থক্য আছে, বাচ্চারা বুঝে ফেলে এটি আলাদা ভাষা। কিন্তু হিন্দি তাদের কনফিউশনে ফেলে দেয়। কাছাকাছি ভাষা বলে বাংলা বোলে হিন্দি ঢুকে পড়ছে অনায়াসে। আর সবচেয়ে পছন্দের অনুষ্ঠানগুলো দেখতে দেখতে তারা যে বোল শোনে তা মনেও থাকে, গেঁথে যায়। ফলে, একটি জেনারেশন না চাইতেই তিন ভাষা শিখতে শিখতে বেড়ে উঠছে। এর বাইরে আর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না তা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
অভিভাবকদের একটি বড় অংশ অবশ্য ঘরে হিন্দির বসতি ও বেড়ে ওঠা নিয়ে সচেতন নন। কিন্তু যারা সচেতন তারা কী করবেন? টিভি বন্ধ করে দেবেন? উপায় নেই। বাংলাদেশের চ্যানেল দেখাবেন? বাচ্চারা মজা পাবে না। উপায় হলো, অন্তত বাচ্চাদের চ্যানেলগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচার দাবি করা। হিন্দি বন্ধ করে ইংলিশ সম্প্রচারে ফিরে যাওয়ার যুক্তি আপাতত নেই। কিন্তু যেভাবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ডিসকভারি চ্যানেল, পিসটিভি বাংলায় সম্প্রচার শুরু করেছে- সেভাবে বাচ্চাদের চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো বাংলায় ডাবিং করে বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রচার করা যেতে পারে। তাতে বাচ্চারা আরও ভালভাবে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে। ডাবিং করার দায়িত্ব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো নিতে পারে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষগুলোকে তৎপর হতে হবে। সবার আগে বাংলাদেশের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচারের দাবি জোরেশোরে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের সরকার কি তেমন দাবি তুলতে পারবে? যেখানে আমরা স্বেচ্ছায় সানন্দে বলিউডের সিনেমা দেখছি, ভারতীয় টিভি চ্যানেলের ভক্ত হয়ে আছি, তাদের টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপিত পণ্যের ভোক্তা বনে আছি- সেখানে ভারতে বসে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল কেউ চাইলেও দেখতে পান না। কত বিনিময় হচ্ছে, কত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হচ্ছে- আমাদের টিভি চ্যানেলের দ্বার আর খুলছে না। পরিস্থিতি এখন যেখানে এসে ঠেকেছে তাতে মাল্টিন্যাশনাল ও ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য বরাদ্দ বিজ্ঞাপন ও বাজেট অচিরে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে পাঠিয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, বিজ্ঞাপনদাতাদের লোকসানও হবে না। কিন্তু আমাদের স্বার্থরক্ষার আলাপ-আলোচনা ও দাবি উত্থাপনে কোথায় যেন দ্বিধা আছে। এই দ্বিধা নিয়ে কি বাংলাদেশের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচার দাবি করা সম্ভব?
বিজ্ঞাপন বলে
‘শুধু লম্বা হলেই- আকাশ ছোঁয়া যায় না….’
কী দরকার?
দরকার আত্মবিশ্বাস, আত্মসচেতনতা আর আত্মপরিচয়ের বোধ। তার চেয়ে বড় কথা আমরা অতো লম্বাও তো হতে পারি নি।
মাহবুব মোর্শেদ : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
বিজ্ঞাপনটি অনেকেরই দেখা। বিজ্ঞাপনের কথাগুলো এমন :
শুধু লম্বা হলেই- আকাশ ছোঁয়া যায় না
শুধু বুদ্ধির জোরে- সাংবাদিকতা হয় না
শুধু শক্তি থাকলেই- সাঁতারু হওয়া যায় না
তাহলে কী দরকার?
খুব জরুরি প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞাপনেই দেওয়া আছে। তবু আমরা নিজেদের মতো করে উত্তর খুঁজবো। উত্তর খোঁজার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু আলাপও পেড়ে নেব।
সবার আগে বলে রাখি, হরলিক্সের বিজ্ঞাপন নিয়ে অতীতে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। হরলিক্স কোম্পানিকে সম্প্রচারিত বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার পর্যন্ত করতে হয়েছে। এখানে তেমন পুষ্টিগত বিতর্ক তোলার উদ্দেশ্য নেই। যে বিজ্ঞাপনটার কথা বলছি সেটি বরং আমার বিশেষ পছন্দ। সাধারণত যারা টিভি বিজ্ঞাপনের মডেল হন তারা এতে মডেল হননি। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতায় পরিচিত কয়েকজন নারী এতে মডেল হয়েছেন। এদের একজন সাংবাদিক, একজন বৈমানিক, একজন সাঁতারু। কলকাতার বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোতে হরলিক্সের এই বিজ্ঞাপন অনেকবার দেখেছি। চলচ্চিত্র বা টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে নিজেদের পেশায় সফল নারীরা সাধারণত নাম ও পেশাগত পরিচয়সহ বিজ্ঞাপনে হাজির হতে পারেন না। কিন্তু এ বিজ্ঞাপনে সেটা ঘটতে পেরেছে। কিন্তু খটকা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতেও বিজ্ঞাপনটা দেখানোর পর। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে পেশাগত পরিচয় রেখে মডেলদের নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। কেন এমন করা হলো? বাংলাদেশে এদের পরিচিতি নেই বলে? নাম-পরিচয় রাখলে কেউ কি প্রশ্ন তুলতেন, এরা কোথাকার সাংবাদিক বা বৈমানিক বা সাঁতারু? এমন প্রশ্ন উঠলে উত্তর মেলা কি কঠিন হতো? ভারতে তৈরি অনেক বিজ্ঞাপনই তো অহরহ বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয়। হিন্দিভাষায় নির্মিত বিজ্ঞাপন স্রেফ বাংলায় ডাবিং করে প্রচার করার ঐতিহ্যই রীতিমতো গড়ে উঠেছে। সে বিজ্ঞাপনগুলো দেখে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেন না- ঐশ্বরিয়া, প্রিয়াঙ্কা, দীপিকা, শাহরুখ কোথাকার অভিনেতা। প্রশ্ন ওঠে না, কারণ সবাই কমবেশি এদের চেনেন। কিন্তু কলকাতার খানিকটা অপরিচিত সেলিব্রেটিদের নিয়ে খটকা বেধেছে। বাংলাদেশে, এবং সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গেও খুব বেশি মানুষের জানাশোনা নেই এদের সঙ্গে। তবু পশ্চিমবঙ্গে নামপরিচয়সহ কাজ চলেছে, বাংলাদেশে চলছে না। বিজ্ঞাপনটি এখানে প্রচারের আগে কী ভাবা হয়েছিল? মডেলদের নাম-পরিচয়সহ উপস্থাপন করা হলে বাংলাদেশে প্রশ্ন উঠবে? হয়তো দাবিও উঠবে, বাংলাদেশের এমন নারীদের নিয়ে আরেকটা বিজ্ঞাপন তৈরি করা হোক? দাবি উঠলে, সেটি করা কঠিন হতো না।
বাংলাদেশে হরলিক্সের বাজার ছোট নয়- শুধু হরলিক্স কেন কোনো কমোডিটির বাজারই ছোট নয়। তবু বিজ্ঞাপনগুলো আসে পাশের বড়বাজার থেকে তৈরি হয়ে। তাদের নায়ক-নায়িকাদের মুখশ্রী সে বিজ্ঞাপন আলোকিত করে। এসব দেখে কাউকে এমন দাবি তুলতে দেখা যায়নি যে- শাহরুখের বদলে তো শাকিব, ঐশ্বরিয়ার বদলে শাবনুর কিংবা আসিনের বদলে মোনালিসাকে নিয়ে বিজ্ঞাপনটি একান্তই বাংলাদেশের টিভি দর্শকদের জন্য প্রচার করা হোক।
যে যুক্তিতে ভারতে নির্মিত সব বিজ্ঞাপন সেগুলোর আলোছায়াসঙ্গীত সহকারে শুধু ভাষা পরিবর্তন করে বাংলাদেশে সম্প্রচারিত হতে পারে সেই একই যুক্তিতে ভারতের কোনো মেট্রপলিটন শহরের আইকনদের নামপরিচয়সহ একটি বিজ্ঞাপনও প্রচার করা সম্ভব। সেই যুক্তিটা কী?
অবশ্যই বাজার।
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো যখন দক্ষিণ এশিয়ার ম্যাপ নিয়ে বসে তখন নিশ্চয়ই তারা একে একটি সাংস্কৃতিক একক হিসেবে বিবেচনা করে। এই এলাকার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বার্মা-থাইল্যান্ড-ফিলিপাইন-চীনের মতো নয়, আবার ইরান-ইরাক-সিরিয়ার মতোও নয়। মধ্য এশিয়া বা পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে অমিল আছে বলে দক্ষিণ এশিয়া আলাদা একক। দক্ষিণ এশিয়াও সমরূপ কোনো এলাকা নয়। এখানে বহু দেশ, বহুজাতি, বহুভাষা, বহু নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। শুধু ভারতকে বিবেচনায় আনা হলেও বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। কিন্তু নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের প্রশ্ন তুলে রেখে বাজারের প্রশ্নকে সামনে আনা হলে বাজারের কেন্দ্র ভারতই। শুধু কেন্দ্র নয় পরিধির অনেকটা জুড়েও ভারত। ভারতের বাইরে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ এমনকি পাকিস্তানেও বাজার তুলনামূলকভাবে ছোট। কিন্তু সেটাও বাজার বটে। তাই মুম্বাই বা দিল্লিতে সাউথ এশিয়া অফিস খুলে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি চেষ্টা করে ভারতের বাইরের পরিধিকেও সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। ভারতের নিজস্ব প্রস্তুতি ও অবকাঠামো এক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক। যেমন- বলিউডের সিনেমা, শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাতেও গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশে বসে সহজেই বলিউডের সিনেমা উপভোগ করা যায়। ফলে, ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন ভারতের শুধু নয়, আমাদেরও আইকন। বাংলাদেশে অনেকেই তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের খবর রাখেন। যেমন বচ্চন পরিবারের পুত্রবধু এখন অন্তঃসত্ত্বা, তার গর্ভে যমজ দুটি মেয়ে বেড়ে উঠছে। মুম্বাইতে বসে ইউনিলিভার যখন হিন্দি ভাষায় লাক্সের একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করে এবং তাতে মডেল হন ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন তখন মারাঠি, তামিল, তেলেগু, নেপালি, বাংলা, উর্দুসহ যে কোনো দক্ষিণ এশীয় ভাষায় একে ডাবিং করে ভারতসহ যে কোনো দক্ষিণ এশীয় দেশে প্রচার করা সম্ভব। বাস্তবে তা ঘটেও। এ নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠে না। এক যুগ আগে এমন হতো কি না, হলেও প্রশ্ন উঠতো কি না তেমন তথ্য আপাতত হাতে নেই। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিকাশ, তথ্যপ্রযুক্তির বিপুল বিস্ফারের এ যুগে কেউ এমন প্রশ্ন তোলেন না। চ্যানেল ঘোরালেই, ডিভিডি চালালেই যাকে প্রতিনিয়ত দেখি- তাকে দেশের চ্যানেলে দেখলে প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত বটে, হিপোক্রেসিও।
দর্শক হিসেবে আমি বলিউডে নির্মিত হিন্দি সিনেমার অনুরক্ত। সেখানকার তরুণতর নির্মাতারা নিত্যনতুন আইডিয়া নিয়ে যেভাবে একের পর এক সিনেমা তৈরি করে চলেছেন তা চমকপ্রদ। শুধু বিনোদন ও জনপ্রিয়তাতেই নয়, শিল্পমানেও সমৃদ্ধ অনেক সিনেমা। বলিউড রীতিমতো একটি ইন্ডাস্ট্রি। তেমন ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গড়ে ওঠার বা চমকে-বৈভবে পরিপূর্ণ তেমন সিনেমা তৈরির সম্ভাবনা বাংলাদেশে নেই, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশেও নেই। ফলে, সে সিনেমাকে তার নায়ক-নায়িকা, ফ্যাশন, কমোডিটি, বাজার সম্ভাবনা সহকারে আমরা গ্রহণ করেছি। এতে আমরা অসুখী নই, বরং স্বস্তিতেই আছি বলা যায়। শুধু বলিউডের সিনেমাই নয়, বলিউডের সিনেমা যে ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যে সংস্কৃতি টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নির্মিত ও পুননির্মিত হয়ে চলেছে তারও স্বতঃস্ফূর্ত গ্রাহক আমরা। সত্যি বলতে, দিনের যে কোনো সময় কেউ যদি সিনেমা দেখতে চান, বাচ্চারা যদি কার্টুন দেখতে চায়, কারো যদি গান শোনার ইচ্ছা নয়, কিংবা কেউ যদি সোপ অপেরা দেখতে চান কিংবা কোনো হাসির অনুষ্ঠান যদি কেউ খোঁজ করেন তবে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর দারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এমনকি নিউজ কর্পোরেশন, সনি বা ওয়াল্ট ডিজনির মতো মাল্টিন্যাশনাল সম্প্রচারকদের টিভি চ্যানেলগুলোও এখন ভারতীয় রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯৯২ সালে ভারতে কেবল টেলিভিশন উন্মুক্ত হওয়ার পর বড়বাজারের আকর্ষণে রুপার্ট মারডকের স্টার টিভি নেটওয়ার্ক, এমটিভিসহ অনেক মাল্টিন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানি ভারতে ব্যবসা সম্প্রসারিত করে। স্টার টিভি নেটওয়ার্ক ভারতের বিভিন্ন ভাষার জন্য, বিভিন্ন গোষ্ঠীর দর্শকের জন্য ৩২টি চ্যানেল খুলেছে। সিএনএন, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকও ভারতে বাজার সৃষ্টির জন্য তৎপর। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে কেবল টেলিভিশন উন্মুক্ত হওয়ার পর দৃশ্যমানভাবে কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এখানে চ্যানেল খোলেনি, আগ্রহ দেখিয়েছে এমন তথ্যও নেই। তার কারণও বাজার- বাজার শুধু দর্শক নয়, বিজ্ঞাপনদাতারাও। আমরা যখন স্টার মুভিজে সিনেমা দেখি তখন সেটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এশিয়াস্যাটের মাধ্যমে সম্প্রচারিত হয় বটে কিন্তু সম্প্রচারের সময় যে বিজ্ঞাপন দেখা যায় তা একান্তই ভারতীয় দর্শকদের জন্য। বিজ্ঞাপনে আমরা এমন অনেক কিছু দেখি যা আমাদের বাজারে পাওয়া যায় না। যেমন- ডিটিএইচ টেকনলজি। টাটা স্কাই বা ডিশ টিভির বিজ্ঞাপন দেখি, কিন্তু এগুলো কী জানি না। সরাসরি ঘরে স্যাটেলাইট সম্প্রচারের প্রযুক্তি আমরা চিনি না, কিন্তু দেখতে দেখতে চাহিদা তৈরি হচ্ছে।
অবশ্য বিজ্ঞাপনে দেখা অধিকাংশ পণ্যই হাত বাড়ালে স্থানীয় বাজারে মেলে। বিজ্ঞাপন দেখে সেগুলো কিনতে প্ররোচিতও হই আমরা। যখন লাক্স সাবান কিনি তখন স্টার মুভিজ, বাংলাভিশন নাকি জিটিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে কিনলাম সেটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে নির্মিত পণ্যের অবস্থান আমাদের কেনাকাটার তালিকায় আছে কি? এখন থাকলেও এই ভিজ্যুয়াল অভ্যাসে আর কতদিন থাকবে?
শুধু কেনাকাটায় নয়, ভেতরে ভেতরে সমাজে-পরিবারে একটা সাংস্কৃতিক রূপান্তরও কি ঘটছে না?
আমার এক বন্ধু তার মেয়েকে নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত। ছোটবড় কোনো সমস্যা হলে তার চার বছরের মেয়ে লর্ড গণেশাকে ডাকে। ’মাই ফ্রেন্ড গনেশা, মুঝে বাঁচাও’ বলে গণেশার সাহায্য চায়। মেয়ে যে গণেশাকে ডাকে এতে সমস্যা নেই। কিন্তু মেয়ে গণেশার কাছে আবদার জানায় হিন্দি ভাষায়। ভাষা শিক্ষার জটিল একটি সময়ে বাচ্চা দিনের একটা বড় অংশ হিন্দি চ্যানেল দেখে ব্যয় করে। না, জিটিভি বা সনিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখে না। দেখে বাচ্চাদের চ্যানেলই। কিন্তু ডিজনি, কার্টুন নেটওয়ার্ক, পোগোসহ অনেক চ্যানেলই এখন ভারতের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচারে চলে এসেছে। এগুলো এখন হিন্দিতে সম্প্রচারিত হয়, একটি দুটি তেলেগুতেও সম্প্রচার করে। ডোরেমন-পোকেমন দেখার ফাঁকে ফাঁকে হিন্দি শিখছে মেয়ে। টুকটাক হিন্দি বলতে পারে, বুঝতে পারে প্রায় সবই। মুফতে একটি ভাষা শিখে ফেলছে- এতে অভিভাবকদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো ব্যাজার হচ্ছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, ইংরেজি তো শিখতেই হয়, বিকল্প নেই। কিন্তু ইংরেজির সঙ্গে বাংলার মৌলিক পার্থক্য আছে, বাচ্চারা বুঝে ফেলে এটি আলাদা ভাষা। কিন্তু হিন্দি তাদের কনফিউশনে ফেলে দেয়। কাছাকাছি ভাষা বলে বাংলা বোলে হিন্দি ঢুকে পড়ছে অনায়াসে। আর সবচেয়ে পছন্দের অনুষ্ঠানগুলো দেখতে দেখতে তারা যে বোল শোনে তা মনেও থাকে, গেঁথে যায়। ফলে, একটি জেনারেশন না চাইতেই তিন ভাষা শিখতে শিখতে বেড়ে উঠছে। এর বাইরে আর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না তা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
অভিভাবকদের একটি বড় অংশ অবশ্য ঘরে হিন্দির বসতি ও বেড়ে ওঠা নিয়ে সচেতন নন। কিন্তু যারা সচেতন তারা কী করবেন? টিভি বন্ধ করে দেবেন? উপায় নেই। বাংলাদেশের চ্যানেল দেখাবেন? বাচ্চারা মজা পাবে না। উপায় হলো, অন্তত বাচ্চাদের চ্যানেলগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচার দাবি করা। হিন্দি বন্ধ করে ইংলিশ সম্প্রচারে ফিরে যাওয়ার যুক্তি আপাতত নেই। কিন্তু যেভাবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ডিসকভারি চ্যানেল, পিসটিভি বাংলায় সম্প্রচার শুরু করেছে- সেভাবে বাচ্চাদের চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো বাংলায় ডাবিং করে বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রচার করা যেতে পারে। তাতে বাচ্চারা আরও ভালভাবে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে। ডাবিং করার দায়িত্ব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো নিতে পারে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষগুলোকে তৎপর হতে হবে। সবার আগে বাংলাদেশের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচারের দাবি জোরেশোরে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের সরকার কি তেমন দাবি তুলতে পারবে? যেখানে আমরা স্বেচ্ছায় সানন্দে বলিউডের সিনেমা দেখছি, ভারতীয় টিভি চ্যানেলের ভক্ত হয়ে আছি, তাদের টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপিত পণ্যের ভোক্তা বনে আছি- সেখানে ভারতে বসে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল কেউ চাইলেও দেখতে পান না। কত বিনিময় হচ্ছে, কত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হচ্ছে- আমাদের টিভি চ্যানেলের দ্বার আর খুলছে না। পরিস্থিতি এখন যেখানে এসে ঠেকেছে তাতে মাল্টিন্যাশনাল ও ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য বরাদ্দ বিজ্ঞাপন ও বাজেট অচিরে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে পাঠিয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, বিজ্ঞাপনদাতাদের লোকসানও হবে না। কিন্তু আমাদের স্বার্থরক্ষার আলাপ-আলোচনা ও দাবি উত্থাপনে কোথায় যেন দ্বিধা আছে। এই দ্বিধা নিয়ে কি বাংলাদেশের জন্য বিশেষায়িত সম্প্রচার দাবি করা সম্ভব?
বিজ্ঞাপন বলে
‘শুধু লম্বা হলেই- আকাশ ছোঁয়া যায় না….’
কী দরকার?
দরকার আত্মবিশ্বাস, আত্মসচেতনতা আর আত্মপরিচয়ের বোধ। তার চেয়ে বড় কথা আমরা অতো লম্বাও তো হতে পারি নি।
মাহবুব মোর্শেদ : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments:
Post a Comment