Thursday, May 24, 2012

নারীর জন্য বাসযোগ্য দেশ

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১১ বিডি নিউজে প্রকাশিত
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১। ডিএনএইনডিয়া ডট কমের একটি খবরে চোখ আটকে গেল। ডেইলি নিউজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস (ডিএনএ) ভারতের একটি অনলাইন সংবাদপত্র। সংবাদপত্রটি একটি জরিপের বরাত দিয়ে লিখেছে, পৃথিবীতে নারীর বসবাসযোগ্য ১৬৫ দেশের তালিকায় ভারতের অবস্থান ১৪১-এ। পৃথিবীর উদীয়মান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময়ে নারীদের জন্য বসবাসযোগ্য দেশের তালিকার শেষ দিকে ভারতের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ খবর বটে। কিন্তু, খবরটি ভারতীয় মিডিয়ায় তেমন কল্কে পায়নি। বাংলাদেশেও খুব বেশি মানুষের চোখে পড়েছে বলে মনে হলো না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি সুখবর হতে পারতো। কারণ, ডিএনএ লিখেছে, ভারত যে শুধু ১৪১ নম্বর অবস্থানে আছে তা-ই নয়, এমনকি বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, শ্রী লংকা, চীনও ভারতের থেকে এগিয়ে আছে। চীন এগিয়ে আছে একথা কার্পণ্য করে ডিএনএ লিখেছে বটে, কিন্তু তারা যে অনেক এগিয়ে এবং ২৩ নম্বরে সেটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার ছিল। ভারতের প্রতিযোগিতা তো চীনের সঙ্গেই হওয়ার কথা। এ বিষয়ে ডিএনএ কথা বলেছে একজন রাজনীতিকের সঙ্গে। ইউনিভার্সেল সোসাইটি অব হিন্দুইজমের প্রেসিডেন্ট রাজন জেড তাদের বলেছেন, ভারত বিশ্বশক্তি হওয়ার পথে থাকলেও এই নতুন সক্ষমতা ও সমৃদ্ধিতে অনেকেরই বিশেষ করে নারীদের অধিকার অবারিত নয়।
খবরটি পড়তে পড়তে মনে পড়ছিল গত সপ্তাহেই ইকোনোমিস্ট পত্রিকায় ‌’গ্রোথ ইজ নট এনাফ’ শিরোনামের একটি খবরের কথা। তাতে গ্রোথ বা প্রবৃদ্ধি যে নারীকে যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে পারে না, তার একটি ছোট বিবরণ দেওয়া হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও চীন প্রবৃদ্ধিতে চ্যাম্পিয়ন হতে চললেও অতিরিক্ত নারীমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি চীন ও ভারতেই। হিসাব পুরো দুনিয়ার। তাতে এক নাম্বারে চীন আর দুই নাম্বারে ভারত। প্রশ্ন উঠবে, প্রবৃদ্ধি যদি যথেষ্ট না হয়, তবে কী দরকার? প্রশ্নটা তোলা থাকুক।
নিউজউইক/ডেইলি বেস্টের জরিপ প্রসঙ্গেই ফেরা যাক। প্রথাগত জরিপ ঠিক নয়, একে বলতে হয়- জরিপ ও বিশ্লেষণ। বেস্ট অ্যান্ড ওর্স্ট প্লেসেস ফর উওমেন বা ‌নারীর জন্য ভাল ও খারাপ দেশ- জরিপ ও বিশ্লেষণের বিষয়। উদ্যোগটি নিউজউইক ম্যাগাজিন ও ডেইলি বেস্ট সংবাদপত্রের। নিউজউইকের ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় বিশ্লেষণ ও জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। ডেইলি বেস্টও একই দিন এটি প্রচার করেছে। পত্রিকা দুটির অনুসন্ধানের বিষয় ছিল- কোন দেশ নারীকে সবচেয়ে বেশি অধিকার দিচ্ছে এবং নারীর জীবনমান কোথায় বেশি। প্রথম দশটি দেশ হলো- ১. আইসল্যান্ড ২. সুইডেন ৩. কানাডা ৪. ডেনমার্ক ৫.ফিনল্যান্ড ৬ সুইজারল্যান্ড ৭. নরওয়ে ৮. যুক্তরাষ্ট্র ৯.অস্ট্রেলিয়া ১০. নেদারল্যান্ডস। তালিকার শেষ দশটি দেশ হলো- ১৬৫.চাদ ১৬৪. আফগানিস্তান ১৬৩. ইয়েমেন ১৬২. কঙ্গো ১৬১. মালি ১৬০. সলোমন দীপপুঞ্জ ১৫৯. নাইজার ১৫৮. পাকিস্তান ১৫৭. ইথিওপিয়া ১৫৬. সুদান।

ডেইলি বেস্ট লিখেছে বিশ্লেষণের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দুটি দেশ অনুসারে নারীর অবস্থা বোঝার জন্য এ আয়োজন করেছে। ন্যায়বিচার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি ও রাজনীতি- এই ৫টি বিষয়কে তারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এই ৫টি বিষয়ে তারা দেশগুলোতে ০ থেকে ১০০-এর মধ্যে নাম্বার দিয়েছে।
বিচার্য বিষয় ছিল-
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে
বয়সের আগে বিয়ের হার, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আইন আছে কি না, বিবাহ বা ঘনিষ্ট সম্পর্কের ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌননির্যাতনের বিচার হয় কি না, নাগরিক অধিকার : নারীরা মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারে কিনা। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে কি না। সম্পদ ও জমিতে তাদের অধিকার আছে কি না। উত্তরাধিকার ব্যবস্থায় নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি গুরুত্ব পায় কি না।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে
বয়ঃসন্ধি কালে প্রসব হার, প্রসবকালীন মৃত্যু হার, জন্মনিরোধক ব্যবস্থা, প্রসবকালীন স্বাস্থ্যসেবা, এইচআইভি সংক্রমণ, অ্যাবরশন বৈধ থাকলে তা কী উদ্দেশে প্রযুক্ত হয়।
শিক্ষা ক্ষেত্রে
বয়স্ক নারী শিক্ষার হার, তরুণ নারীদের স্বাক্ষরতার হার, ২৫ বছরের বেশি বয়সের নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীনতার হার, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিকে থাকা নারীর হার, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে লিঙ্গ বৈষম্য।
অর্থনীতি ক্ষেত্রে
মেয়েরা কারখানায় কাজ করতে পারে কি না
শ্রমিকদের মধ্যে কত শতাংশ নারী
নারীদের পারিশ্রমিক পুরুষদের তুলনায় কেমন
উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের সম্ভাবনা কতটা
রাজনীতিতে
মন্ত্রিসভায় নারীর সংখ্যা
সংসদে নারীর উপস্থিতি
উচ্চতর পদে নারীর হার
পুরুষের তুলনায় নারী আইন প্রণেতা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ম্যানেজারের হার কত।
নিউজউইক ও ডেইলি বেস্ট যেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে তা ন্যায্য বলেই মনে হয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন জরিপ নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক আমাদের দেশে তৈরি হয় তাতে মেঠো যুক্তিতে জরিপের ফল বাতিলের প্রবণতা থাকে। আবার কিছু ন্যায্য তর্কও ওঠে। যেমন, কখনো কখনো জরিপ ইওরোসেন্ট্রিক ধারণা থেকে করা হয়। ইওরোপ-আমেরিকার মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি তাতে অন্য দেশগুলোর পরিস্থিতি বিচারের টুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রশ্ন না তুলেই বিভিন্ন দেশের জীবনমানের তুলনা করা হয়েছে এমনও অনেক সময় ঘটেছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত যেসব জরিপ নিয়ে আমাদের দেশে তোলপাড় হয় তার কিছু নির্দিষ্ট ধরন আছে। রাজনীতির গতিপ্রকৃতির সাথেও সেগুলোর সংশ্লিষ্টতা থাকে। দুর্নীতি, গণতন্ত্র কখন মিডিয়ায় কত গুরুত্ব পাবে তা নির্ভর করে রাজনীতির হালচালের ওপর। অনেক সময় এদেশে জরিপকারী সংগঠনের প্রতিনিধিরা বিষয়টিকে ফোকাস করেন। জরিপের কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ তা যেমন বলে দেন, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোন বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষ মনোযোগী তাও বলে দেন। স্বাভাবিকভাবে করণীয় নির্ধারণের পরামর্শও তারা দিয়ে থাকেন।
কিন্তু কোনো পত্রিকা যখন জরিপ বা তথ্য বিশ্লেষণ করে তখন বোধগম্য কারণেই তাদের প্রতিনিধিরা ঢাকায় প্রেস কনফারেন্স করেন না। পাঠকদের চোখে পড়লে সেটি আলোচিত হয়, কোনো স্থানীয় পত্রিকা মনে করলে সেটি অল্প-বিস্তর প্রচারও পায়। ব্যক্তিগতভাবে এমন জরিপ ও বিশ্লেষণ পদ্ধতির প্রচারেই পাঠক হিসেবে আমি স্বস্তি বোধ করি।
নিউজউইক/ডেইলি বেস্টের তালিকা দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হয়, এতে পশ্চিমাদের প্রতি পক্ষপাতের ব্যাপার নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নারীর জন্য সন্তোষজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ দরকার। একটি দেশের অথনৈতিক সক্ষমতার সঙ্গে বরাদ্দ জড়িত। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা একটি দেশ এমন বরাদ্দ দিতে পারবে কেন? তালিকার শেষ দিকের অধিকাংশ দেশই অর্থনৈতিক মানদণ্ডে পিছিয়ে। কিন্তু ১৪৭ নম্বর দেশ সৌদি আরব কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে নেই। তবে কি সমস্যাটা মুসলিম অধ্যুষিত মানুষের দেশেই বেশি? তাহলে ভারতের অবস্থান ১৪১ নম্বরে থাকে কী করে? অর্থনৈতিকভাবে পেছনের সারির দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের মুখে থাকা মুসলিম অধ্যুষিত মালদ্বীপকে তাহলে কী বলা হবে? দেশটি তালিকার ৯২ তম অবস্থানে এসেছে। এমনকি সমস্যাটি গণতন্ত্রেরও মনে হয় না। কেননা, সামরিক শাসনের জন্য দুর্নাম কামানো মায়ানমার আছে ৯১ তম অবস্থানে। গণতন্ত্রের দীর্ঘ ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, মুসলিম অপ্রাধান্য সত্ত্বেও জাপান ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতায় আসতে পারে নি। তারা ৮৭ নম্বর অবস্থানে। মুসলিম অধ্যুষিত মালয়েশিয়া জাপানের থেকে এগিয়ে ৮১ নম্বরে। পূর্ব ইউরোপের দেশ হলেও, রিপাবলিক অব মলডোভা দেশটির কথা খুব বেশি লোকের জানা নেই, অথচ নারীর বসবাসযোগ্য দেশের তালিকায় তারা পশ্চিম ইওরোপ-উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর খুব কাছাকাছি ১৬ নম্বর অবস্থানে। আবার চীন যেখানে ২৩ নম্বরে জার্মানি কিন্তু সেখানে ৩০-এ। এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো তথ্যগুলোর দিকে সার্বিক দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। সেখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্য আছে। সত্যটি হলো- গণতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ভেদে নারীর অবস্থা একই হতে পারে, আবার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাও সবসময় ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে না, এমনকি ধর্মীয় নৈতিকতাও সবসময় প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে না। তবে, নারীকে পিছনে ঠেলে দিচ্ছে কী, আর সামনেই বা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোন ব্যাপারগুলো? আমি যতদূর বুঝলাম তাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে সরকারগুলো আন্তরিক হলেই নিউজউইক/ ডেইলি বেস্ট তালিকায় একটি দেশের ভাল অবস্থানে আসা সম্ভব। এর ভেতর আরও কোনো গভীর তত্ত্ব থাকলে তা আমরা ভবিষ্যতে খুঁজতে পারি।
তালিকাটি এশিয়ার জন্য রীতিমতো দুসংবাদ বয়ে এনেছে। নারীর বসবাসযোগ্য সেরা ১০ দেশের তালিকায় এশিয়ার কোনো দেশ নেই। একমাত্র এশীয় দেশ হিসেবে প্রথম ২০ তালিকার ১৭ নম্বরে আছে ফিলিপাইন ১৭ নম্বরে। সেরা ৩০-এ এশিয়ার একমাত্র দেশ চীন। কিন্তু শেষদিকে এশিয়া-আফ্রিকার রমরমা। শেষ ১০-এ এশিয়ার আফগানিস্তান-পাকিস্তান তো আছেই।

তালিকার শেষ দেশ চাদ। দেশটির গড় স্কোর ০.০। দেশটিতে নারীদের প্রায় কোনো আইনি অধিকার নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিয়ের বয়স ১১-১২ বছর। ন্যায়বিচারে : ২০.৭, স্বাস্থ্যে ০.০, শিক্ষায় ০.০, অর্থনীতিতে ৭০.৯, রাজনীতিতে ২২.২ স্কোর দেশটির। প্রথম অবস্থানে আইসল্যান্ড। দেশটির গড় স্কোর ১০০। ন্যায়বিচারে : ১০০, স্বাস্থ্যে ৯০.৫, শিক্ষায় ৯৬.৭, অর্থনীতিতে ৮৮.০, রাজনীতিতে ৯২.৮।
এবার এশিয়ার কয়েকটি দেশের স্কোর পাশাপাশি রাখা যাক।
আফগানিস্তান
গড় স্কোর : ২.০
ন্যায়বিচার : ৮.৪
স্বাস্থ্য : ২.০
শিক্ষা :৪১.১
অর্থনীতি : ৫৫.৩
রাজনীতি : ১৬.৬
পাকিস্তান
গড় স্কোর : ২১.৪
ন্যায়বিচার : ৪৯.৭
স্বাস্থ্য : ৪৯.৬
শিক্ষা : ৩৪.০
অর্থনীতি : ৫০.৭
রাজনীতি : ১৯.৩
ভারত
গড় স্কোর ৪১.৯
ন্যায়বিচার : ৫৪.০
স্বাস্থ্য : ৬৪.১
শিক্ষা : ৬৪.৯
অর্থনীতি : ৬০.৭
রাজনীতি : ১৪.৮
মায়ানমার
গড় স্কোর ৬৬.৫
ন্যায়বিচার : ৬৭.৯
স্বাস্থ্য : ৪৯.৫
শিক্ষা : ৯৪.০
অর্থনীতি : ৮৭.৯
রাজনীতি : ৭.৫
বাংলাদেশ
গড় স্কোর ৪২.১
ন্যায়বিচার : ৩৫.৫
স্বাস্থ্য : ৪৫.৭
শিক্ষা : ৬৯.২
অর্থনীতি : ৭৫.১
রাজনীতি : ২০.৪
তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯-এ। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ নারীদের জন্য অনেক বেশি বসবাসযোগ্য। ভারতের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে। কিন্তু তাতে খুব বেশি খুশী হওয়ার কারণ নেই। যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে তাতে কী কী করতে হবে তা সকলের জানা। কাজগুলো করতে বিপ্লবও করতে হবে না। আমাদের সরকারগুলো আন্তরিক হলেই সম্ভব।

সম্পর্কিত লিংক
মাহবুব মোর্শেদ: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments:

Post a Comment