
প্রফেসর জেমস লাভলক বলেছেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে আর ফল হবে না। এখন আমদের একটা কাজই করার আছে, সেটি হলো পৃথিবীর হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে পারি। দেখতে পারি, সম্পূর্ণ তালগোলহীন নানা জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যাকে প্রকৃতি কীভাবে মোকাবেলা করে। এ অবস্থায় মানুষের কী করার আছে? কী আর করা, যখন পারা যায় জীবনকে একটু উদযাপন করে নিতে হবে।
গত ৩ এপ্রিল বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেছেন প্রফেসর লাভলক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জন হামফ্রিস। লাভলকের এ কথাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে বিবিসি ও অন্য মিডিয়াগুলো। প্রায় ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণীর মতো এ কথাগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ তা জানতে প্রফেসর লাভলককে চিনতে হবে। লাভলকের পরিচয় তিনি পরিবেশবিদ, স্বাধীন বিজ্ঞানী এবং ভবিষ্যদ্বক্তা। থাকেন ইংল্যান্ডের ডেভনে। এসব পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে তার একটি তত্ত্ব। গেইয়া তত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবে পরিবেশ বিজ্ঞানী, তাত্তি্বকদের কাছে তিনি সুপরিচিত।
আমাদের দেশে গেইয়া তত্ত্ব তেমন পরিচিত না হলেও তত্ত্বটি বিশেষভাবে ভারতবর্ষীয় চিন্তার সঙ্গে মেলে। গেইয়া গ্রিক দেবী। শব্দটির অর্থ ভূমি বা পৃথিবী। পৃথি্বমাতা বলে যে ধারণা আমাদের মিথলজিতে প্রচলিত, তেমনি গ্রিক মিথলজিতেও গেইয়ার কথা বলা হয়েছে। গাইয়া আদি গ্রিক মিথলজির মাদার গডেস বা মাতৃকাদেবী। আদিমকালে বহু সভ্যতায় মাতৃকাদেবীর উদাহরণ মেলে। পৃথিবীর আলো, বাতাস, পানি, মাটি সবই গেইয়ার দেহজাত বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রফেসর লাভলক থিওরির নামটি নিয়েছেন এই মাতৃকাদেবীর নাম থেকে। আর তাকে নামটি বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ঔপন্যাসিক উইলিয়াম গোল্ডিং।
১৯৬০-এর দশকে মঙ্গলগ্রহে প্রাণের সন্ধান নিয়ে নাসার জন্য একটি কাজ করতে গিয়ে প্রফেসর লাভলক গেইয়া থিওরির কথা ভাবেন। সত্তর দশকের শুরুতে বিভিন্ন জার্নালে এ নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন। এ তত্ত্বের মর্মবাণী হলো, পৃথিবী একটি জৈব একক। এর জীবমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল, জলমণ্ডল, ভূমির নিচের পাথর ও খনিজ উপাদান, হিমমণ্ডল সবই পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এগুলোর মধ্যকার জটিল মিথস্ক্রিয়া জলবায়ু বা বাহ্যিক পরিস্থিতিগুলো তৈরি করে। এ তত্ত্ব অনুসারে পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এসব উপাদান মিলে পৃথিবীর অস্তিত্বকে সম্ভব করে তুলেছে। বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবীকে একটি জৈব একক হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আদিম হলেও পরিবেশ বিপর্যয়ের নতুন প্রেক্ষাপটে গেইয়া তত্ত্ব বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশেষ করে, এ তত্ত্ব মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে ঐকতান সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু মানুষ বহু আগেই প্রকৃতির সন্তান থেকে নিজেকে সভ্যতার জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ সভ্যতা তৈরি করতে তাকে প্রচুর কার্বন তৈরি করতে হয়েছে, প্রকৃতির ওপর অবিবেচনাপ্রসূত হামলা করতে হয়েছে। আর এ হামলা প্রকৃতিকে এমন একটি পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে, গেইয়া থিওরির প্রবক্তা নিজেই বলছেন, সময় শেষ। এখন কী হয় তা বসে বসে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা 'প্রকৃতির প্রতিশোধ'-এর কথা বলেছিলেন। জেমস লাভলকও বলছেন গেইয়ার প্রতিশোধের কথা। তার একটি বইয়ের নাম রিভেঞ্জ অব গেইয়া। জেমস লাভলকের থিওরি থেকে দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে। বোঝা যায়, বেশ একটা প্রভাব তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। মানুষকে নতুন চিন্তা ও জ্ঞানে উদ্বেলিত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু জ্ঞানই শেষ কথা নয়, কর্মোদ্যোগ তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। আজকের পৃথিবীতে মানুষ ভালো করেই জানে, তার কারণেই প্রকৃতির এই রুদ্ররোষ। তার কারণেই এত শীত, এত বৃষ্টি, এত খরা, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি। কিন্তু বিশ্বের নেতারা যখন একসঙ্গে বসেন তখন তারা সঠিক কর্মোদ্যোগ নিয়ে একমত হতে পারেন না। কারণ পৃথিবী টিকল কি টিকল না সেই বৃহত্তর স্বার্থের চেয়ে নিজেদের উন্নয়ন ও শিল্পায়নের স্বার্থই বড় তাদের কাছে। এখন মানুষ কী করবে? তারা কী হয় দেখবে আর পারলে আনন্দ-আয়োজন করবে প্রফেসর লাভলকের কথামতো? আর উপায় নেই, এ তথ্য মাথায় নিয়ে কি আনন্দ-আয়োজন সম্ভব? নাকি আরেকবার প্রফেসর লাভলককে অনুরোধ করব, দেখুন না, যদি কোনো উপায় থাকে। যদি কিছু করার থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কিছু করার থাকলে সেটি করার জন্য আমাদের নেতারা কি উদ্যোগ নেবেন?
No comments:
Post a Comment