Thursday, April 8, 2010

শেখ ফরিদ


বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ_ 'বগলে ইট, মুখে শেখ ফরিদ।' যেসব লোকের মুখে এক আর মনোবাঞ্ছা আরেক তাদের মনোভাব বোঝাতেই প্রবাদটির উল্লেখ হয়। ইট অবশ্যই পাটকেল জাতীয় বস্তু, যা আক্রমণের কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু শেখ ফরিদ কে? মুখে শেখ ফরিদ বলতে যদি কোনো উত্তম বাণী বা উত্তম মানুষের নাম বোঝানো হয় তবে সেই পুণ্যবান ব্যক্তি কে? একদা বাংলায় সুফি-সাধকদের ব্যাপক আগমন ঘটেছিল। ইতিহাস বলে, বাংলার মানুষ এই সুফিদের হাত ধরেই ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। আর সুফি ইসলামে শেখ ফরিদ খুব পরিচিত ও প্রিয় নাম। এই সুফি সাধক ও কবির নাম আবু হামিদ বিন আবু বকর ইব্রাহিম। কিন্তু ইরানের নিশাপুরের এই কবি লিখতেন ফরিদউদ্দিন আত্তার নামে। আত্তার মানে ফার্মাসিস্ট। পিতার কাজের সূত্রে তিনি ফার্মাসিস্ট হয়েছিলেন কিন্তু কুফা, মক্কা, দামেস্ক, তুরস্কে ভ্রমণকালে তিনি সুফি শায়খ বা শেখদের সানি্নধ্যে এসে ভাবুক ও কবি বনে যান। ইরান-তুরস্কে তিনি মহত্তম সুফি কবি হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশেও ফরিদউদ্দিন আত্তার খুব পরিচিত নাম। তার বই 'তাজকেরাত-উল-আউলিয়া' বাংলায় খুব জনপ্রিয়, বহু ঘরে বইটি গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করা হয়। মজার ব্যাপার, পাখির সঙ্গে ফরিদউদ্দিন আত্তারের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তার একটি বই 'মানতেক আত তায়ের', বহুল আলোচিত এ বইটি 'কনফারেন্স অব বার্ডস' নামে পরিচিত। বাংলায় এর নাম হবে, 'পাখি সম্মেলন'। যতদূর জানি, সুফি সাধনার উচ্চমার্গীয় এ বইটি বাংলায় অনুবাদিত হয়নি। মানতেক আত তায়েরে ফরিদউদ্দিন আত্তার পাখিদের কথা বলেছেন। হুপি নামে এক পাখির নেতৃত্ব মেনে বিশ্বের পাখিরা একবার তাদের রাজা সিমুর্গের সঙ্গে দেখা করতে যায়। তারা জীবন, জগৎ, সৃষ্টি রহস্য বিষয়ে এবং বিশেষত ভালোবাসা বিষয়ে অপূর্ব সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। তাজকেরাত-উল-আউলিয়ার বহুল প্রচারের কথা মনে রাখলে মানতেক আত তায়ের বাংলায় সম্পূর্ণ অপরিচিত বই এ কথা বলা যায় না। হতে পারে, মানতেক আত তায়েরের প্রসঙ্গ থেকেই পাখির নামের সঙ্গে ফরিদউদ্দিন আত্তারের জুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে থাকবে। পত্রিকান্তরে শেখ ফরিদের সংবাদ পড়ে তাই একটু চমকে গেলাম। শেখ ফরিদ নামের সঙ্গে শেখ বা শায়খ ফরিদের যোগ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তথ্য-যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা একটু কঠিনই বটে। প্রথম আলো পত্রিকায় গত মঙ্গলবার পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে তোলা একটি শেখ ফরিদ পাখির ছবি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় পাখিটির নাম কালা তিতির। কালা তিতির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায় বটে, কিন্তু বাংলাদেশে এটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। বিলুপ্তপ্রায় পাখি হলেও লোকে পাখিটি চেনে এবং স্থানীয় নাম পর্যন্ত জানে। বলা হচ্ছে, ব্ল্যাক প্যাট্রিজ বা ব্ল্যাক ফ্যাংকোলিনই কালা তিতির। কিন্তু তিতির বলতে যে পাখিটিকে বোঝানো হয়, উইকিপিডিয়া বলছে, বুনো টার্কির প্রজাতি হলো সেই পাখি। টার্কি নাকি স্বভাবে খুবই বোকা। কিন্তু তিতির বা প্যাট্রিজ অতিশয় ক্ষিপ্র পাখি হিসেবে পরিচিত। তিতির শিকারের শ্বাসরুদ্ধকর অনেক গল্প আছে, যেখানে দেখতে শান্ত, চিন্তাশীল এ পাখিটির রহস্যময় গতিবিধি ও ক্ষিপ্রতা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলায় গল্পকার ও ঔপন্যাসিক শওকত আলী 'প্যাট্রিজ' নামে একটি গল্পে এ পাখির রহস্যময়তা ও ক্ষিপ্রতা নিয়ে একটি চমৎকার গল্প লিখেছেন। কালা তিতিরই প্যাট্রিজ কি-না আর প্যাট্রিজই ওয়াইল্ড টার্কি কি-না আর এসবই শেখ ফরিদ কি-না এ নিয়ে পাখি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয় ভাববেন। আপাতত আমাদের চিন্তা শুধু শেখ ফরিদ নিয়ে। ফরিদউদ্দিন আত্তারের পাখি সম্মেলনে বিশ্বের বহু পাখি যোগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে অতিশয় ভাবুক ও ক্ষিপ্র তিতির বা প্যাট্রিজও হয়তো ছিল। আর হয়তো ভাবুক আচরণের কারণে পাখিটিই বাংলার মানুষের কাছে শেখ ফরিদ আখ্যা পেয়েছিল। অনুমান করে হয়তো আরও নানা কথা বলা যায়, কিন্তু নাম-মাহাত্ম্য আর পাখির প্রকার দুটি ভেদ করতে ভাষাবিদ আর পাখিবিশারদরা এবার একসঙ্গে বসলে আমরা আরও যে মজার অনেক কথা জানতে পারব, তা বলাই বাহুল্য।

No comments:

Post a Comment