Thursday, April 8, 2010
ভাষা বিতর্ক
ফেব্রুয়ারি এলে ভাষা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বেশ চলে। এবারও তর্ক উঠেছে। তর্কের বিষয় : এফএম রেডিওর ভাষা, টেলিভিশনের নাটকের কথ্য ভাষা ও উচ্চারণ এবং বানান নিয়ে নানা মতকে এক মতে আনার উদ্যোগ। এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে নানা কথাবার্তাও শুরু হয়েছে। টেলিভিশনে টক শো হচ্ছে, সংবাদপত্রে লেখা হচ্ছে। বাংলা একাডেমী বানানরীতির সমতা আনার জন্য শিগগিরই উদ্যোগ নেবে বলে জানা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা ব্যবহার ও উচ্চারণ নিয়ে মিডিয়া প্রধানদের সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ভাষা নিয়ে নীতিমালাও হবে। মিডিয়ায় নীতিমালা প্রয়োগের ব্যাপারে কর্তাদের আগ্রহের শেষ নেই। চালের দাম বাড়ছে তো বাজারের দিকে তাকানোর দরকার নেই, মিডিয়ায় চালের খবর কীভাবে পরিবেশিত হবে এ নিয়ে সমস্যা। কোর্টে অবাধে জামিন হচ্ছে, অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। কীভাবে কোর্টের সংবাদ পরিবেশন করা হবে এ নিয়ে নীতিমালা দিন, সমাধান হয়ে যাবে। টিভির লাইভ সংবাদ, টক শো নিয়ে নীতিমালা দিতে চান অনেকে, দেনও। মিডিয়ার হেন কোনো বিষয় বোধহয় পাওয়া যাবে না, যা নিয়ে নীতিমালা দিতে চান না কেউ। মিডিয়া যদি নীতিমালা নিতে চাইত তবে মিডিয়া আর মিডিয়া থাকত কি-না সন্দেহ। মিডিয়ার স্বাধীনতা কেমন হতো তখন তাও ভাবার বিষয়।
নীতিমালার তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন বানানবিধি, উচ্চারণবিধি, ভাষাবিধি। এগুলো নিশ্চয় খারাপ জিনিস নয়। পত্রিকাগুলো নিজেদের মতো করে নির্ভুলভাবে খবর ছাপতে চায়, টিভিগুলো নির্ভুল উচ্চারণে বলতে চায়, রেডিওগুলোও হয়তো তেমনটিই চায়। কিন্তু কেউ যদি ভাষা নিয়ে অবশ্যমান্য নীতিমালা তৈরি করে দেয় তবে তো সেটি চাপানো ব্যাপারই হবে। বাংলা একাডেমী যদি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বানানরীতি দিতে পারে, তবে লোকে নিজের গরজে কিনে নিয়ে সে বানানরীতি মানবে। কিন্তু আদেশ হিসেবে যদি একটি বানানরীতি পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেয়, তবে ক'জনের জন্য তা সুখকর হবে তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে।
কথা উঠছে, টেলিভিশনের নাটকের ভাষা ও উচ্চারণ নিয়েও। যে নাটকগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে সেগুলো বেশ জনপ্রিয়। মান ভাষায় করা নাটক সেগুলোর ধারে-কাছে যেতে পারছে না। এর পেছনের কারণটি খুঁজে বের করা দরকার বিরোধিতা করার আগে। এ নাটকগুলোর ভাষা মুুখের ভাষার খুব কাছাকাছি। বিষয়ও জীবনের নিকটবর্তী। তাই সেগুলো সহজেই গ্রহণ করছেন দর্শকরা। এখন কেউ যদি বলে, ফারুকীর নাটকের চরিত্রদের শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে এবং এ নিয়ে আইন হবে। তবে কে মানবে?
রেডিওর ক্ষেত্রেও তেমন। এ তো সেদিনও ভাবগম্ভীর উচ্চারণের বাংলাদেশ বেতার ছাড়া যখন কোনো দেশীয় রেডিও ছিল না। তখন তো সবাই ভাবতেই বসেছিল রেডিওর যুগ শেষ। কিন্তু এফএম এসে নিঃশেষিত রেডিওকে সবার কানে কানে ঠাঁই করে দিয়েছে। লোকে শুনছে, মজা পাচ্ছে, ব্যবসা হচ্ছে, মিডিয়ার বিকাশ হচ্ছে। এখন কেউ যদি বলে, রেডিওগুলোকে সরকারি বেতারের মতো শুদ্ধ উচ্চারণে ধীরে ধীরে কথা বলতে হবে, তবে কেউ মানবে?
আসলে গেল গেল রব তুলে ভাষা বাঁচানো কঠিন। নীতিমালা করেও বাঁচানো যায় না। ভাষা নদীর মতো। যতক্ষণ সচল আছে ততক্ষণ এক পাড় ভেঙেই চলে আর এক পাড় গড়ে চলে। একদিন এই বাংলা ভাষাও ছিল না। প্রাচীন প্রাচ্য, গৌড়ি প্রাকৃত, গৌড়ি অপভ্রংশ, বঙ্গ কামরূপী হলে বাংলাভাষার জন্ম হয়েছে মাত্র ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে। এদের কেউ যদি আইন করে গোঁ ধরে বসত তবে বাংলার জন্মই হতো না। আর বাংলা যদি তার আদিরূপে থাকতে চাইত তবে মানুষ কথাই বলতে পারত না। কারণ, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি নানা শব্দ নিয়ে আমরা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছি। নেব না নেব না করলে ভাষা বাঁচে না। কাজে লাগা শব্দ, অভিধানের শব্দের চাইতে অনিবার্য।
রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে গুণীজনদের একসময় মুখের ভাষা চালু করতে আন্দোলন করতে হয়েছিল। সাধুর জায়গায় চলিত ভাষা আসতে পেরেছিল। চলিত ভাষা তো চলিতই। যদি চলিত ভাষাকে থামিয়ে দেওয়া হয় তবে তার নাম থামিত দিতে হয়। ভাষাকে চলতে দিতে হবে মানুষের মধ্যে। মানুষই ঠিক করবে কে বাড়াবাড়ি করছে আর কে ষড়যন্ত্র করছে। কারণ মানুষই ভাষা আন্দোলন করেছে। মানুষই শেষ কথা।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment